পর্ব্বতবাসিনী/অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
তারা ফিরিয়া আসিল। এবার আর গোগৃহে যাইবার আদেশ শুনিতে হইল না, এখন তারাই গৃহকর্ত্রী। রঘুজীর যাহা টাকা ছিল, তাহা শম্ভূজীর হাতে। তারা আসিবামাত্র শম্ভূজী তাহার হাতে চাবি দিয়া টাকা বুঝাইতে আরম্ভ করিল। তারা বড় লজ্জিত হইল। শম্ভূজী তারার নিকট অপমানিত হইয়া প্রহার সহ্য করিয়াও প্রতিশোধ লইবার কোন চেষ্টা করিল না। রঘুজীর অর্থে হস্তক্ষেপ করে নাই, এখন আবার তারাকে টাকার হিসাব বুঝাইয়া দিতেছে। তারা হিসাব পত্র কিছু না শুনিয়া, কিছু লজ্জার সহিত, কিছু বিষণ্ণভাবে বলিল, শম্ভূজী, আমাকে হিসাবে বুঝাইবার আবশ্যক নাই। তুমি আমার সম্পত্তি রক্ষা করিয়াছ বলিয়া আমি তোমাকে অর্দ্ধেক অংশ দিতে প্রস্তুত আছি। তুমি এই অর্থের অর্দ্ধাংশ লইয়া যাও।
শম্ভূজী বলিল, আমি এক পয়সাও লইব না। তোমার সম্পত্তি তুমি সুখে ভোগ কর।
তারা কহিল, না লও, আমি তোমায় পীড়াপীড়ি করিব না। কিন্তু এ বাড়ীর সহিত তোমার আর কোন সম্বন্ধ নাই। তোমার সহিত আমার আর সাক্ষাৎ হইবে না। যাহারা এ বাড়ীর বেতনভোগী তাহারা পূর্ব্বের মত নিযুক্ত থাকিবে।
শম্ভূজী কোন উত্তর করিল না, একবার মস্তকে হস্তস্পর্শ করিল। তারা দেখিল তাহার মস্তকে বৃহৎ ক্ষতচিহ্ন রহিয়াছে। বুঝিল, শম্ভূজী কিছু বিস্মৃত হয় নাই।
শম্ভূজী কোন উত্তর না দিয়া সে স্থান হইতে ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।
রঘুজীর কন্যা ফিরিয়া আসিয়া পিতৃসম্পত্তির অধিকারিণী হইয়াছে শুনিয়া গ্রামের লোকে বড় ভয় পাইল। যে দাসী তারাকে অপমানিত করিয়াছিল, সে রঘুজীর মৃত্যুর পরেই অন্যত্র চলিয়া গেল। যাহারা রঘুজীর অন্নে প্রতিপালিত তাহারা মনে করিল, এইবার আমাদের অন্ন মারা যাইবে। লোকে মনে করিল তারা বাই না জানি কতই অত্যাচার করিবে।
তারা বাই সে সব কিছুই করিল না। যে দিন গৃহে ফিরিল তাহার পর দিবস ভৃত্য, ক্ষেত্রের কৃষাণ, রাখাল, সকলকে ডাকাইয়া কহিল, তোমরা যেমন পূর্ব্বে কাজ করিতে তেমনি করিবে। কাহারও চাকরি যাইবে না।
এই কথা শুনিয়া তাহারা বড় বিস্মিত, ও আহ্লাদিত হইয়া আপন আপন কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইল। তাহাদের আনন্দ দিন দিন বাড়িতে লাগিল। রঘুজীর লাঠির চিহ্ন তাহাদের অনেকের ছিল, সে দাগ ক্রমে ক্রমে মিলাইয়া গেল। এখন আর কেহ তাহাদিগকে মারে না। পূর্ব্বে কর্ম্মে কিছুমাত্র ত্রুটি হইলে, রঘুজী মাহিয়ানা কাটিত, এখন আর সে সব নাই। কোন ঝঞ্জাটই নাই। পরিজনবর্গের মধ্যে তারার বড় প্রশংসা উঠিল। মহাদেবের দিন ফিরিল। সে এখন পায়ের উপর পা দিয়া রাজার হালে দিনাতিপাত করিতে লাগিল। তারা তাহাকে কোন কর্ম্ম করিতে দেয় না, নিকটে বসিয়া আহার করায় আরও সহস্র যত্ন করে। সময়ে সময়ে মহাদেবের নিকট মায়ীর জন্য কাঁদিত। মহাদেব অল্প কালের মধ্যেই আবার সুস্থকায় ও সবল হইয়া উঠিল। তখন সে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে অসম্মত। তারাকে কহিল, “চাকর বাকর গুলা সব ফাঁকি দেয়, তুই ত তাহাদের দেখিবি না। আমি তাহাদের কাজ কর্ম্ম পর্যবেক্ষণ করিব।” তারা মহাদেবের আগ্রহ দেখিয়া সম্মত হইল। মহাদেব সেই অবধি একরূপ ঘরের কর্ত্তা হইয়া উঠিল।
গ্রামের মধ্যে যাহারা নিতান্ত দীন, দুঃখী, তারার অনুরোধ মতে মহাদেব তাহাদের সন্ধান লইত। তারা মলিন বেশে স্বয়ং তাহাদের সাহায্য করিতে যাইত। ইহাতে লোকে আরও আশ্চর্য্য হইল।
সুদে কর্জ্জ দেওয়া তারা আসিয়া বন্ধ করিল। গ্রামের লোকেরা বড় গরিব, অনেক সময় তাহাদের ধার করিতে হয়। রঘুজী সুদে সুদে তাহাদের রক্ত শোষণ করিতেছিল, এখন তাহারা বিনাসুদে ঋণ পাইয়া দুই হাত তুলিয়া তারাকে আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিল।
বেশভূষায় তারার কখন তেমন অভিরুচি ছিল না। এখন সে ভাল ভাল কাপড়, ভাল ভাল গহনা পরিতে আরম্ভ করিল। তাহা দেখিয়া গ্রামের যুবতীদিগের বড় হিংসা হইত। বুড় বুড়ীরা বলিত, আহা, পরুক্, পরুক্, বাপ থাকৃতে ত কোন সাধ মেটাতে পারে নাই। এখন একটা বর মিলিলেই হয়, তা হলে সব সুখই হয়। এত গুণের মেয়ে কখনো হয় না।
বর ত মিলিবার ভাবনা ছিল না, কিন্তু কন্যার মনের মতন বর এখন কোথায় পাওয়া যায়? রঘুজী ত আর নাই, যে জোর করিয়া তারার বিবাহ দিবে। তারার আর কোনও অভিভাবক নাই, সে ইচ্ছা করিলেই নিজে বিবাহ করিতে পারে। মহাদেব, বারকতক বিবাহের জন্য খোচাখুঁচি করাতে তারা কিছু বিরক্ত হইল, বলিল, আমি বিবাহ করিব না। মহাদেব মুখে আর কিছু বলিল না, কিন্তু মনে করিল, যদি বিবাহই না করিবে, ত এত সাজগোজ কিসের জন্য? আগে ত এ সব কিছু ছিল না।
গ্রামের জন কতক যুবকের আশা ছিল, তাহারা তারার প্রণয় চক্ষে পড়িবে। এই আশায় তাহারা মনোহর বেশ ধারণ করিয়া মহাদেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিত। মহাদেব তাহাদের অভিসন্ধি বুঝিতে পারিত না। যুবকদিগের আশা ছিল ক্রমশঃ তারার সহিত কথোপকথন চলিবে। তারা, তাহাদিগের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া, তাহাদিগকে তাড়াইয়া দিল। তাঁহারা অগত্যা রণে ভঙ্গ দিয়া পলায়ন করিলেন।