পর্ব্বতবাসিনী/সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
পর্ব্বতের প্রস্থদেশে চঞ্চললোচনা বিকলাঙ্গী তারা উন্মাদিনীর মত বিচরণ করিতেছে। কোন দিন আহার নাই, কোন রাত্রে নিদ্রা নাই, অসীম আকাশে কক্ষভ্রষ্ট গ্রহের ন্যায় অসংযত উদ্ভ্রান্ত গতিতে নিরন্তর ভ্রমণ করিতেছে। হৃদয় মধ্যে কখন নরকের জ্বালা, কখন শূন্যময় নিরাশা। ঝঞ্ঝাতাড়িত, আবর্ত্তসঙ্কুল, ভীমনাদে কল্লোলিত হৃদয় সমুদ্রের উচ্ছ্বাসে ব্যাকুলিত হইয়া বিবেকশূন্য হইয়া তারার চিত্তের বিকৃতি জন্মিবার উপক্রম হইয়া উঠিল। সেই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে একমাত্র আলোক দেখিতে পাইল মরণ! কিন্তু আত্মঘাতিনী হইতে তারার প্রবৃত্তি হইল না, সাহস হইল না। ভাবিল, কেন মরিব? কাহার তরে মরিব? আত্মহত্যা করিয়া কেন অনন্ত নরক ভোগ করিব? গোকুলজীকে পাইলাম না বলিয়া মরিব? গোকুলজী আমার কে? আমার শরীরে রমণীধর্ম কিছুই নাই তবু আমি পতঙ্গের মত কেন প্রণয়ানলে ঝাঁপ দিই? মরিলেই বা আমার কি সুখ? লোকে না জানুক, আমি ত জানিব যে গোকুলজীর জন্য প্রাণত্যাগ করিলাম। ছি! ছি! সহস্র নরক যন্ত্রণা এ চিন্তার তুল্য নয়। আমি মরিব না।
তারা মরিল না। কিন্তু বাঁচিয়াও কোন সুখ দেখিতে পাইল না। চিত্তের চাঞ্চল্য বশতঃ সর্ব্বদা ভ্রমণ করিত। কুটীরের আশ্রয় পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিল।
এই অবস্থায় একদিন মহাদেবের সহিত সাক্ষাৎ হইল। তাহার সে মূর্ত্তি দেখিয়া মহাদেব ভীত হইল। মনে করিল, পাগল হইয়া গিয়াছে। মহাদেবকে দেখিয়া তারা চক্ষু স্থির করিয়া কোমল স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, শম্ভূজী তোমায় তাড়াইয়া দিয়াছে?
মহাদেব মাথা নাড়িল। ধীরে ধীরে সমস্ত কথা তারাকে অবগত করাইল। রঘুজীর মৃত্যু সংবাদ শুনিয়া শিলাখণ্ডে উপবেশন করিয়া, জানুদ্বয় মধ্যে মস্তক রাখিয়া তারা চিন্তা করিতে লাগিল। পিতৃবিয়োগ সংবাদ শ্রবণ করিয়া তাহার চক্ষে জল আসিল, বলিলে, মিথ্যা বলা হয়। বুঝি সে হৃদয় বড় কঠিন, বুঝি সে চক্ষের জল ফুরাইয়াছিল, তাই সে কাঁদিল না। কেবল বসিয়া ভাবিতে লাগিল। অনেকচিন্তার পর, মাথা তুলিয়া মহাদেবকে জিজ্ঞাসা করিল, এখন ত শম্ভূজীই সমস্ত বিষয়ের উত্তরাধিকারী?
মহাদেব বলিল না, সে কেন বিষয় পাইবে? মরণের সময় বোধ হয় তোর বাপের বুদ্ধি ফিরিয়া থাকিবে। শম্ভূজী বলিতেছে, তারার বাড়ী, তারার বিষয়, সে আসিলেই, তাহার হাতে সব বুঝাইয়া দিব। আমি তোকে ডাকিতে আসিয়াছি। তোর বাড়ীতে এখন তুই না থাকিবি ত কে থাকিবে? তুই না ফিরিলে আমি বা কোথায় আশ্রয় পাইব?
তখন তারা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বৃদ্ধের হাত ধরিল, কহিল, তবে চল, বাড়ী যাই।