পর্ব্বতবাসিনী/ষোড়শ পরিচ্ছেদ
ষোড়শ পরিচ্ছেদ।
খড় ধূ ধূ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল দেখিয়া সকলে আগুন নিভাইতে ছুটিল। আগুন লাগিলে যত লোকে চীৎকার করে, তত লোকে কখনই অগ্নি নির্ব্বাপিত করিবার যত্ন করে না। কথায় বলে, ‘কারও সব্বনাশ, কারও পোষ মাস।’ জল আনিতে আগুন নিভাইতে মরাইয়ের ধান ভস্মীভূত হইয়া গেল, কিন্তু আগ্ন আর বিস্তৃত হইল না। রঘুজীর গৃহ রক্ষা পাইল।
গ্রামের লোকে পূর্ব্বেই তারাকে বড় দুরন্ত মনে করিত। এখন লোকে তাহাকে রাক্ষসী স্থির করিল। জননীরা শিশুদিগকে তাহার নাম করিয়া ভয় দেখাইত, যুবতীরা ভয়ে তাহার নাম পর্য্যন্ত করিত না।
রঘুজীর পীড়া সেই রাত্রে বৃদ্ধি হইল। সে আর তারার নাম করিত না। তারাকে অন্বেষণ করিয়া ধৃত করিবার জন্য দুইজন লোক সম্মত হওয়াতে রঘুজী তাহাদিগকে গালি দিল। বলিল, আমার কন্যা মরিয়াছে। তাহাকে খুঁজিবার আবশ্যক নাই।
পীড়া দিন দিন বাড়িতে লাগিল। গ্রামের চিকিৎসক যথাসাধ্য প্রলেপ ও অন্যান্য ঔষধি প্রয়োগ করিলেন; কিছুতেই কোন ফল দর্শিল না। পীড়ার সময়ে শম্ভূজী দিবানিশি রঘুজীর নিকটে থাকিত। সকলেই বুঝিল এবার রঘুজী রক্ষা পাইবে না। কেবল রঘুজী এ কথা বিশ্বাস করিত না। একদিন চিকিৎসক বলিলেন, রঘুজী, তুমি আপনার বিষয় আশয়ের একটা বন্দোবস্ত কর, মানুষের কবে দিন আসে বলা যায় না।
রঘুজী অত্যন্ত বিস্মিত ও কুপিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমি কি মরিব না কি?
চিকিৎসক। না, তা নয়। তবু ত কিছু বলা যায় না। ব্যারাম দিন দিন বাড়িতেছে, তোমার আর উত্থানশক্তি নাই। মানুষ কখন আছে কখন নাই, তা ত কেহ বলিতে পারে না।
রঘুজী রাগিয়া কহিল, তুমি দূর হও। তুমি আমায় আরোগ্য না করিয়া মারিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিতেছ।
চিকিৎসক, রোগী হাতছাড়া হয় দেখিয়া, তাহাকে বুঝাইতে আরম্ভ করিলেন। অর্থের প্রত্যাশা মানুষে, বিশেষ চিকিৎসকে সহজে ছাড়িতে পারে না। রঘুজীর খাটের পাশে তাহার লাঠি থাকিত, সেই লাঠি ধরিয়া কবিরাজ মহাশয়ের মস্তক লক্ষ্য করিয়া নিক্ষেপ করিল। কবিরাজের মাথা কাটিয়া রক্ত বহিতে লাগিল। তিনি দুই হাতে মাথা ধরিয়া কাতরোক্তি করিতে করিতে পলায়ন করিলেন।
মৃত্যু ঘনাইয়া আসিতেছিল। রঘুজী ভীত হইয়া শম্ভূজীকে ডাকাইয়া আপন সম্পত্তি তাহাকে দান করিতে চাহিল। শম্ভূজী তাহাতে স্বীকৃত হইল না। অতঃপর তাহার পরামর্শে রঘুজী দুই জন সাক্ষীর সমক্ষে আর এক দানপত্র লিখাইল, তাহার মর্ম্ম কেহ জানিল না।
মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পূর্ব্বে রঘুজীর বিকার হইল। বিকারাবস্থায় অনর্গল প্রলাপ উচ্চারণ করিত। সে সকল কথা কেবল শম্ভূজী আর সেই দাসী শুনিত। প্রলাপকালীন অনেক কথা তাহারা বুঝিতে পারিত না, অনেক কথা শুনিয়া তাহাদের লোমহর্ষণ হইত। রঘুজী কখন কখন তারার নাম করিত। কখন কখন অন্যমনে আর কাহার নাম করিয়া স্নেহের দু একটী কথা বলিত। তাহাতে পাতকের পাপ কথা আরও ভয়ঙ্কর শুনাইত।
মৃত্যুর পূর্ব্ব দিবস রঘুজী সংজ্ঞা প্রাপ্ত হইল। নিকটে শম্ভূজীকে না দেখিতে পাইয়া, তাহাকে ডাকাইয়া পাঠাইল। শম্ভূজী আসিল না। রঘুজী তখন তাহাকে অশ্রাব্য গালি পাড়িতে লাগিল। তাহাতে সে আবার বিকারগ্রস্ত হইল। পর দিবস তাহার মৃত্যু হইল।
তারা শম্ভূজীকে আঘাত করিল দেখিয়া মহাদেব পলায়ন করিয়াছিল। এতদিন যে সে শম্ভূজীর নিষ্ঠুর ব্যবহার সহ্য করিয়াছিল, তাহার একটী কারণ ছিল। মহাদেব মনে করিত তারা ফিরিয়া আসিলে শম্ভূজী ঈদৃশ কঠোর, আচরণ পরিত্যাগ করিবে। বৃদ্ধ বয়সে যায়ই বা কোথা? কেহ ত তাহাকে বিনা পরিশ্রমে আহার যোগাইবে না। এইরূপ সাত পাঁচ ভাবিয়া সে কোথাও যায় নাই। তারার নির্ব্বাসনের পর নিজের কষ্টের দিকে তাহার আর বড় দৃষ্টি ছিল না। মায়ীর মৃত্যুর পর তাহার মন একেবারে ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। জীবনে অনাস্থা এবং মরণ তাহার একমাত্র কামনা হইয়া উঠিল। চিত্ত অবশ, শিশুর ন্যায় দুর্ব্বল। শম্ভূজীর উৎপীড়নে শরীরও ভগ্ন হইয়া পড়িল। নানা কারণে মহাদেব এরূপ অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করিয়াও পলায়নে অসমর্থ হইয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু যে সময় দেখিল শম্ভূজী দারুণ আঘাতে ধরাশায়ী হইল, তখন নানাবিধ নূতন আশঙ্কায় তাহার চিত্ত অধিকৃত হইল। মনে করিল শম্ভূজী আরোগ্য লাভ করিয়া তাহাকে হত্যা করিবে। এইরূপ নানাবিধ আশঙ্কায় বিকৃতচিত্ত হইয়া পলায়ন করিল।
গ্রামের অনেকে সময়ে অসময়ে মহাদেবের নিকট উপকৃত, শম্ভূজীর হস্তে তাহার নির্যাতনের সংবাদ পাইয়া অনেকের দয়ার উদ্রেক হইয়াছিল, এজন্য মহাদেবকে অন্নের জন্য লালায়িত হইতে হইল না। তাহাকে প্রতিদিন খাইতে দেয়, গ্রামে এমন কাহারও সঙ্গতি ছিল না, পর্য্যায়ক্রমে দুই এক বেলা করিয়া সকলে আহার করাইত। রাত্রিকালে মহাদেব একজনের বাড়ীতে শরন করিত। গ্রামে অনেকেই রঘুজীর টাকা ধারে, সে ইচ্ছা করিলে টাকার জন্য পীড়াপীড়ি করিয়া মহাদেবকে গ্রাম হইতে বাহির করিয়া দিতে পারিত। এখন রঘুজী পীড়িত, মৃত্যুশয্যায় শয়িত, সুতরাং সে কিছু করিতে পারিল না। মহাদেবের অন্নকষ্ট রক্ষা হইল!
রঘুজীর মৃত্যু হইয়াছে শুনিয়া মহাদেব মনে করিল, তারাকে ডাকিয়া আনিব। এখন ত তাহারি বাড়ী, তাহারি ঘর, সে কেন পাহাড়ে বনের পশুর মত থাকে? তারাকে যেমন করিয়া পারি খুঁজিয়া লইব। এই সঙ্কল্প করিয়া পর্ব্বতের অভিমুখে যাত্রা করিল।