পর্ব্বতবাসিনী/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।

 হূ—হূ হূ হূ বায়ু বহিল। পর্ব্বতশিখর হইতে নামিয়া উপত্যকায় প্রধাবিত হইয়া; পর্ব্বতপৃষ্ঠস্থিত তরুলতা প্রমথিত, তরুমূল উন্মূলিত করিয়া ভীষণ ঝটিকা গর্জ্জিতে লাগিল। বাত্যাবিতাড়িত রাশি রাশি উপলখণ্ড চট্ চট্ শব্দে প্রস্তরে প্রহৃত হইল। ঘূর্ণীবায়ু ধূলিস্তম্ভ তুলিয়া ক্ষিপ্তের মত ইতস্ততঃ আবর্ত্তিত হইতে লাগিল। কৃষ্ণমেঘ ঝটকামুখে ধাবিত হইয়া শিখরশৃঙ্গে জমিয়া বসিল। কাল মেঘের পর কাল মেঘ, দেখিতে দেখিতে আকাশ বিচ্ছেদশূন্য কৃষ্ণজলদে সমাচ্ছন্ন হইল। আকাশ অত্যন্ত অন্ধকার, মসীময়। পর্ব্বতের উপরে তুমুল ঝটিকা। ধূলিরাশি বায়ুবেগে উৎক্ষিপ্ত হইয়া আকাশে উঠিল। মেঘ, আকাশ হইতে নামিয়া ধূলির সহিত মিশিল। সঙ্কীর্ণসলিলা নির্ম্মল নির্ঝরিণীর জল আবিল হইয়া উঠিল। পর্ব্বতপ্রদেশের নিস্তব্ধতার সমাধি ভঙ্গ করিয়া ঝঞ্ঝা গর্জ্জিতে লাগিল।

 গগনব্যাপী অন্ধকারময় মেঘের বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করিয়া দীর্ঘ বিদ্যুৎ চমকিল। তাহার পর মেঘগর্জ্জন। আবার গগনপ্রান্ত হইতে পর্ব্বতশিখরের উপরিভাগ পর্য্যন্ত বিদ্যুৎ হানিল। আবার অতি ভয়ঙ্কর রবে দীর্ঘকাল মেঘ মন্দ্রিত হইল। আদিগুহার সতন্ত্র স্থলে সে গর্জ্জন প্রতিধ্বনিত হইয়া, এক কন্দর হইতে অন্য কন্দরে, উপত্যকা হইতে অধিত্যকায় দ্বিগুণিত হইয়া গড়াইতে লাগিল। ভয়বিহ্বলা হরিণী দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হইয়া প্রাণভয়ে ছুটিয়া পলাইল। কোন পশু ভীত হইয়া গুহার আশ্রয় লইয়াছিল, গুহাভান্তরে ভৈরব শব্দ শুনিয়া বেগে পলায়ন করিল। কদাচিৎ কোন পক্ষীর কাতর চীৎকার ঝটিকাগুর্জ্জনের মধ্যে শ্রুত হয়। মেঘগর্জ্জনের মধ্যে মধ্যে ঝঞ্ঝাবায়ু আঘুর্ণিত হইয়া গর্জ্জিতে লাগিল।

 মধ্যাহ্ণ অতীত হইয়াছে মাত্র। তথাপি পর্ব্বতের উপর মেঘে অন্ধকার করিয়া রহিয়াছে। উপত্যকায় সেই সময় দুইজন পথিক অত্যন্ত বিপদগ্রস্ত হইয়াছে। একজন অশ্বপৃষ্ঠে আর একজন অশ্বের বল্‌গা ধরিয়া যাইতেছে, এমন সময় সহসা তাহাদের মস্তকের উপর দিয়া ঝটিকা বহিল, সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকিল, মেঘ গর্জ্জিল। চক্ষে নাসিকায় মুখে ধূলা পূরিয়া যাওয়াতে তাহাদের নিশ্বাস রোধ হইবার উপক্রম হইল। অন্ধকারে দিঙ্‌নিরূপণের উপায় রহিল না। অশ্ব যদৃচ্ছাক্রমে বিচরণ করিতে লাগিল। অশ্বারোহণে একটী রমণী ছিল। সে তাহার সঙ্গীকে মিনতি করিতেছিল, অশ্বের মুখরজ্জু ছাড়িয়া দিও না।

 অকস্মাৎ ধূলিপূর্ণ ঘূর্ণীবায়ু তাহাদিগকে আবৃত করিলে অশ্ব ভীত হইয়া সবেগে ধাবিত হইবার চেষ্টা করিল। বলিষ্ঠ পুরুষ তাহাকে নিবৃত্ত করিল। রমণী ভয়ে চীৎকার করিয়া মূর্চ্ছিত হইল। সহসা সেই মানবশূন্য প্রদেশে মনুষ্য কণ্ঠে সেই চীৎকারের প্রতিশব্দ হইল। অশ্বমুখরজ্জুধারী পুরুষ মনে করিলেন, এ শব্দ প্রতিধ্বনি মাত্র। তখনি আবার শুনিলেন, অদূরে ঝটিকা এবং মেঘগর্জ্জন ভেদ করিয়া অতি তীক্ষ্ণ মনুষ্য কণ্ঠ আশ্বাস বাক্য প্রদান করিতেছে। পথিক তখন ভেরীনিনাদ তুল্য স্বরে ডাকিয়া কহিলেন, আমরা অত্যন্ত বিপদে পড়িয়াছি, এ ভয়াবহ স্থানে আর কোন মনুষ্য আছে কি?

 এই সময় ধূলিরাশি অপহৃত হওয়াতে পথিক চক্ষু মর্দ্দিত করিয়া চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন। অশ্বারোহিণী অপহৃতচেতন হইয়া নিমীলিত চক্ষে অশ্বপৃষ্ঠে রহিয়াছেন। পাদচারী পুরুষ এক হস্তে তাঁহার কটিদেশ বেষ্টন করিয়াছেন, আর একহস্তে অশ্বের মুখরজ্জু ধরিয়াছেন। রমণীর মস্তক তাঁহার স্কন্ধে রক্ষিত হইয়াছে। অশ্ব ভয়ে নিতান্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। পথিক বড় বিপদে পড়িয়াছেন। চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন। কিয়দ্দূরে একজন স্ত্রীলোক দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তাহাকে দেখিয়া পথিক বলিয়া উঠিলেন, মহাদেব! এ যে স্ত্রীলোক! মনে করিলেন, ইহাকে দিয়া উপকৃত হওরা দূরে যাউক, ইহার বিপদ আমার অপেক্ষাও অধিক।

 পথিক বিস্মিত হইয়া দেখিলেন, রমণী স্থিরপদক্ষেপে দ্রুতগতি সেই অভিমুখে আসিতেছে। সমীপে আসিলে দুজনেই পরস্পরকে চিনিতে পারিয়া চমকিয়া উঠিল। একজন মনে মনে বলিল, গোকুলজী! অপর ব্যক্তি অস্ফুট স্বরে কহিল, রঘুজীর কন্যা!

 ইতিপূর্ব্বে তারাকে দেখিলে গোকুলজীর আহ্লাদের সীমা থাকিত না। এখন সে তাহাকে দেখিতে পাইয়া ভ্রু কুঞ্চিত করিল। তারা তাহা লক্ষ্য করিল।

 গোকুলজী অনায়াসে বুঝিল যে তারা গৃহনির্ব্বাসিত হইয়া পর্ব্বতে কোন স্থানে বাস করে, ঘটনাক্রমে এই বিপত্তিকালে তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছে। গোকুলজী প্রথম বিস্ময়ের ভাব লুপ্ত হইলে কথঞ্চিৎ পরুষ স্বরে তারাকে কহিল, তোমা দ্বারা আমাদের কি সাহায্য হইবে? যে পিতৃগৃহে অগ্নি প্রদান করে, তার নিকট উপকৃত হওয়ার চেয়ে মরণ ভাল।

 তারার চক্ষের জ্যোতি নিভিয়া গেল, হৃদয় স্তম্ভিত হইল। মনোভাব গোপন করিয়া দৃঢ় স্বরে কহিল, বিপদের সময় কোন বিচার চলে না। আমি অতি পাপিষ্ঠা হইলেও এ সময় আমাকে ঘৃণা করিও না। একবার এদিকে চাহিয়া দেখ। এই বলিয়া, অশ্বপৃষ্ঠস্থিতা রমণীকে ক্রোড়ে করিয়া নামাইল। রমণী তখনও অচৈতন্য।

 তারা মূর্চ্ছিতা যুবতীর প্রতি একবার অতি তীব্র কটাক্ষপাত করিল, তাহার পর তাহাকে ক্রোড়ে লইয়া, গোকুলজীকে কহিল, তুমি অশ্ব লইয়া আমার পশ্চাৎ আইস। আমার কুটীর অতি নিকটে।

 তখনও প্রবলবেগে ঝটিকা গর্জ্জিতেছে। তারা যুবতীকে ক্রোড়ে করিয়া অনায়াসে কুটীর মুখে চলিল। গোকুলজী তাহার অদ্ভুত সামর্থ্য দেখিয়া মনে মনে বলিল, বিধাতঃ! এমন শরীরে পাপের বাসস্থান কেন নির্দ্দেশ করিয়াছিলে?

 কুটীরে প্রবেশ করিয়া তারা মূর্চ্ছিতা রমণীকে পর্ণশয্যায় শয়ন করাইল। তাহার পর তাহার চৈতন্যোৎপাদনের উপায় উদ্ভাবন করিতে প্রবৃত্ত হইল। মুখে জলসিঞ্চনানন্তর মুখমণ্ডল নির্ম্মল হইলে তারা দেখিল যে সে বড় সুন্দরী। একবার ঈর্ষানল জ্বলিয়া উঠিল, তারা ভাবিল, আমার অপেক্ষা এ কোন অংশে সুন্দরী যে গোকুলজী ইহাকে বিবাহ করিল? আবার তখনি ভাবিল, আমার ত সে সব আশা ঘুচিয়াছে। গোকুলজী যাহাকে ইচ্ছা বিবাহ করুক না কেন, আমার তাতে কি?

 তবু হৃদর মানিল না। তারা মনকে কত বুঝাইল, তবু মন বুঝিল না। কত শতবার তারা গোকুলজীর মূর্ত্তি ভুলিবার চেষ্ট। করিয়াছিল, শতবার সে মূর্ত্তি তাহার স্মৃতিপটে উজ্জ্বলতর বর্ণে অঙ্কিত হইয়াছিল। কতবার ভাবিত আমি পাথারে ভাসিয়াছি, কোথাও কূল কিনারা পাইব না, তবু আশার একটী তৃণ ছাড়িতে পারিত না। কতবার ভাবিত আমি মনুষ্যসমাজবহির্ভূত, মানুষ যে বন্ধনে আবদ্ধ হয় আমি তাহাতে বাধা পড়িব কেন? ইহাতে হৃদয়ে আরও কঠিন নিগড় পড়িল। পোড়া মন এমনি অবুঝ, যত বুঝাও তত আরও উল্‌টা বুঝিবে। যখন তারার প্রতীতি জন্মিল যে, এই যুবতী গোকুলজীর বিবাহিত। স্ত্রী, তখন তাহার হৃদয় বিস্তীর্ণ মরুভূমির মত একেবারে শূন্য হইয়া উঠিল। বিষাদসাগরে ভাসমান তরণী যেন অগাধ জলে নিমগ্ন হইল। কুটীরের বাহিরে ঝটিকাগর্জ্জন যেন দূরে মিশাইয়া গেল। কুটীরদ্বারে গোকুলজীর মুখ ভাল লক্ষিত হয় না। লুপ্তচেতন তরুণীর সুন্দর মুখ অন্ধকারে লুকাইল। তারা চতুর্দ্দিকে চক্ষু ফিরাইল। চক্ষে কেবল অন্ধকার দেখা যায়, আর কিছু না। তখন সে দুই হস্তে চক্ষু আবৃত করিল।

 কতক্ষণ পরে মূর্চ্ছিতা রমণী চেতনা পাইয়া চক্ষুরুন্মীলিত করিয়া সাতিশয় বিস্ময় সহকারে দেখিল সে এক ক্ষুদ্র কুটীর মধ্যে কোমল শয্যায় শয়ান রহিয়াছে। আরও বিস্মিত হইয়া দেখিল তাহার পার্শ্বদেশে এক যোগিনী হস্তদ্বয়ের মধ্যে মুখ লুক্কায়িত করিয়া বসিয়া আছে। তৈলশূন্য জটাভার চারিদিকে পড়িয়াছে, পরিধেয় বসন ছিন্ন, গ্রন্থিবিশিষ্ট, নিতান্ত মলিন। যুবতী কৌতূহলাবিষ্ট হইয়া মনে করিল, এ কে? আসন্ন বিপদ হইতে এই তপস্বিনী নিশ্চিত আমাকে রক্ষা করিয়া থাকিবে। এই ভাবিয়া তাহার মুখ দেখিবার জন্য হস্তদ্বারা তাহার অঙ্গস্পর্শ করিল। বিজনবাসিনী সচকিত হইয়া হাত সরাইয়া লইল। দুইজনে পরস্পর চাহিয়া দেখিল, দুজনেই সুন্দরী। তারার চক্ষের জ্যোতি বড় প্রখর, কোমলচক্ষু কোমল প্রকৃতি সুন্দরী সে চক্ষের সমক্ষে আপনার চক্ষু অবনত করিল।

 গোকুলজী কুটীরের বাহিরে অশ্ব বন্ধন করিয়া কুটীরের দ্বারদেশে নীরবে দণ্ডায়মান ছিল, রমণী প্রকৃতিস্থ হইয়াছে দেখিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, কেমন গৌরী, এখন কিছু ভাল বোধ হইতেছে?

 গৌরী নিতান্ত দুর্ব্বল হইয়া পড়িয়াছে। কথা কহিবার শক্তি নাই। হস্তদ্বারা ইঙ্গিত করিল, ভাল আছি।

 তারা মনোভাব গোপন করিয়া গৌরীকে বলিল, তুমি বড় দুর্ব্বল হইয়াছ। একটু দুধ গরম করিয়া দিতেছি, পান কর। তাহা হইলে শরীরে একটু বল পাইবে।

 গোকুলজী কিছু বেগের সহিত শুষ্কভাবে কহিল, দুধ খাইবার কোন আবশ্যক নাই। আমরা এখনি যাইব।

 তারা গোকুলজীর দিকে স্থিরদৃষ্টি ফিরাইয়া অকম্পিত স্বরে কহিল, নিতান্ত নির্দ্দয় হইলেও এমন অবস্থায় কেহ স্ত্রীলোককে পথ চলিতে বলে না। অসময়ে চণ্ডালের আতিথ্যও অস্বীকার করিতে নাই। যে এখনও কথা কহিতে পারিতেছে না, তাহাকে এই পর্ব্বতের উপর দিয়া ঝড়বৃষ্টিতে লইয়া যাইতে কি তোমার কিছুমার সঙ্কোচ বোধ হয় না?

 এই বলিয়া তারা দুধ গরম করিতে বসিল।

 পাহাড়ের উপর দু চার ফোঁটা বৃষ্টি পড়িয়া আবার থামিয়া গেল। ঝড়ের বেগ মন্দীভূত হইয়া আসিতেছিল।

 গোকুলজী তারার কথায় কোন উত্তর না দিয়া, কুটীরের বাহিরে যেখানে অশ্ব বাঁধা ছিল, সেইখানে চলিয়া গেল।

 তারা অনেক সন্ধান করিয়া দু একটা মৃৎপাত্র জড় করিয়াছিল। একটী পাত্রে দুগ্ধ কিঞ্চিৎ উষ্ণ হইলে অল্প অল্প করিয়া গৌরীকে পান করাইল। তাহার পর বাহিরে গিয়া গোকুলজীকে বলিল, কুটীরে কিছু ফলমূল আছে, আসিয়া আহার কর। আমার গৃহে আহার করিলে জাত যাইবে না।

 গোকুলজী উত্তর করিল, আমার ক্ষুধা বোধ হয় নাই। আমি কিছু খাইব না।

 তারা একটু চুপ করিয়া রহিল, তাহার পর অতি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, তোমার সঙ্গে কি তোমার স্ত্রী?

 গোকুলজী বিরক্ত ভাবে কহিল, সে খোঁজে তোমার কাজ কি? তারা কিছুমাত্র রাগ করিল না। আবার অতি করুণ স্বরে কহিল, লোকে যাই বলুক, গোকুলজী, তুমি আমাকে তত মন্দ মনে করিও না। তুমি ত ভিতরকার সব খবর জান না।

 গো। ভিতরকার খবর জানিবার আবশ্যক কি? তুমি কি শম্ভূজীকে খুন করিবার চেষ্টা কর নাই? শম্ভূজী হাজার দোষ করিলেও তোমার পাপের ভাগ ত কিছু কমিবে না? পিতৃগৃহে অগ্নি জ্বালাইয়া পলায়ন করিয়াছিলে, তাহার অপেক্ষা মহাপাতক কিছু আছে? তোমার নিকটে উপকৃত না হইয়া যদি আমরা গিরিগহ্বরে পতিত হইতাম ত ভাল হইত।

 তারার নয়নে অগ্নি জ্বলিল। সে প্রকৃতির অনবনমনীয় গর্ব্ব ফিরিয়া আসিল। উদ্ধতস্বরে কহিল, তুমি আমাকে মন্দ কথা বলিবার কে? আমার যাহা ইচ্ছা হয় তাহাই করিব, সে জন্য তোমার কাছে দায়ী নহি। তুমি কি জানিবে কেন আমি শম্ভূজীকে আঘাত করিয়াছিলাম, কেন আমি রঘুজীর গৃহে অগ্নি প্রদান করিয়াছিলাম? তুমি আমাকে মন্দ কথা বলিবে কেন? তোমার কোন কথা আমি কেন সহ্য করিব?

 গোকুলজী ভাবিল বাঘিনীর ঘরে আসিয়া তাহাকে ঘাঁটান ভাল নহে। এই ভাবিয়া নিরুত্তর হইল। তারার সম্বন্ধে তাহার যে বিশ্বাস জন্মিয়াছিল, তাহা আরও দৃঢ় হইল।

 তারা কুটীরে ফিরিয়া গেল। অভিমানানল নির্ব্বাপিত হইল। কুটীরে গিয়া দেখিল, গৌরা উঠিয়া বসিয়াছে। তারা তাহার পার্শ্বে উপবেশন করিয়া তাহার হাত ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, যিনি তোমার সঙ্গে আছেন, উনি কি তোমার স্বামী?

 গৌরী একটু খানি দুষ্ট হাসি হাসিয়া, চোক ঘুরাইয়া, তাহার পানে আড়নয়নে কটাক্ষ করিয়া কহিল, না।

 তারা। তবে কি উনি তোমায় বিবাহ করিবার জন্য লইয়া যাইতেছেন?

 গৌরী। না।

 তারা। কিছুদিন পরে তোমাদের বিবাহ হইবে?

 গৌরী। না।

 তবে—এই বলিয়াই তারা চুপ করিল।

 গৌরী বুঝিয়া কিছু গম্ভীরভাবে কহিল, আমি তোমার কথা বুঝিয়াছি। তবে আমি পরপুরুষের সঙ্গে কেন একাকিনী এমন পথ দিয়া যাইতেছি, তুমি এই কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাও। এই কথাটীর উত্তর দিতে পারিব না। নিষেধ আছে। তুমি সে কথা জিজ্ঞাসা করিও না।

 তারা কিছু চিন্তিতা হইল, কিছু ভাল বুঝিতে পারিল না। অবশেষে কহিল, আজ রাত্রি তোমরা এইখানেই থাক, কাল প্রাতে যাইও।

 গৌরী হাসিয়া বলিল, ক্ষতি কি। তুমি আমাকে যে বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছ, সে ঋণ কখন শুধিতে পারিব না। তা না হয় তোমার আশ্রয়ে একটা রাত থাকিলাম। সে ত ভালই।

 এই সময় গোকুলজী পুনরার কুটীরদ্বারের সম্মুখে আসিল। তারা তাহাকে দেখিয়া বলিল, আজ তোমরা এইখানে থাক। কাল না হয় যাইও। এখনও কি হয় বলা যায় না।

 বৃষ্টি আদৌ অধিক পড়ে নাই। ঝটিকার বেগ অনেক পরিমাণে শমিত হইয়াছিল, মেঘগর্জ্জনও ক্রমে বিরল হইয়া আসিতেছিল। কিন্তু আকাশ ঘোরতর মেঘাচ্ছন্ন, অন্ধকার রহিল।

 গোকুলজী কহিল, আর আমরা থাকিতে পারি না। এখন আর কোন ভয় নাই। আমরা চলিলাম।

 গৌরী গোকুলজীকে সম্বোধন করিয়া মধুর কণ্ঠে কহিল, তুমি এত ব্যস্ত হইয়াছ কেন? ইনি আমাকে এমন বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছেন, ইঁহারও ত একটা কথা রাখা উচিত। আকাশ এখনও অন্ধকার হইয়া আছে, আজ রাত্রি এখানে থাকিলে দোষ কি? তুমি কিছু খাও দাও। ঘোড়াটাকে কিছু খাইতে দাও, তার পর কাল সকাল যাইব।

 গোকুলজী কঠোরস্বরে কহিল, এখনি যাইতে হইবে। তুমি আর বিলম্ব করিও না, উঠিয়া আইস।

 গোকুলজীর অন্ধকার মুখ দেখিয়া গৌরী আর কিছু বলিতে সাহস করিল না। তারার নিকটে বিদায় লইবার মানসে তাহার চরণস্পর্শ করিতে উদ্যত হইল। তারা ব্যতিব্যস্ত হইয়া তাহার হাত ধরিয়া নিবারণ করিল। গোকুলজী আসিয়া গৌরীর হাত ধরিয়া, ক্রুদ্ধস্বরে কহিল, অনর্থক আর বিলম্ব করিও না। আমার সঙ্গে আইস।

 গৌরী অতিমাত্র বিস্মিতা, অজানিত ভয়ে ভীতা হইয়া কাষ্ঠপুত্তলিকার ন্যায় গোকুলজীর সঙ্গে সঙ্গে চলিল। বাহিরে আনিয়া গোকুলজী তাহাকে অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করাইয়া অশ্বের মুখরজ্জু ধরিয়া শীঘ্রগমনে চলিয়া গেল। পশ্চাতে ফিরিয়া চাহিল না।

 পর্ব্বতের পথ অত্যন্ত উচ্চনীচ, গোকুলজী শীঘ্রই পথ চিনিয়া লইয়া তারার দৃষ্টির বহির্ভূত হইল।

 তখন, কুটীরমধ্যে প্রস্তরাসনে বসিয়া অভাগী তারা রোদন করিতে লাগিল। দুই হস্তে চক্ষু আবৃত করিয়া সেই প্রাণীশূন্য ভয়ঙ্কর স্থানে আপনার অদৃষ্ট ভাবিতে লাগিল। অঙ্গুলির মধ্য দিয়া আগে বড় বড় দু ফোঁটা অশ্রুজল, দুইটা মুক্তার মত গড়াইয়া পড়িল। তার পর আরও দু ফোঁটা, তার পর অবিরল অশ্রুধারা বহিতে লাগিল। ভাবিল, কি কপাল লইয়া সংসারে আসিয়াছিলাম! পূর্ব্বজন্মকৃত কত পাপের ফল ভোগ করিতেছি। গোকুলজী, কুক্ষণে তোমায় আমায় সাক্ষাৎ হইয়াছিল। কেন গৃহবহিষ্কৃত হইয়াছিলান, তা কি তুমি জান না? সে কথা যে বলিবার নয়, গোকুলজী, তা নহিলে আজ আমি তোমায় সব কথা খুলিয়া বলিতাম। বুকে যে পাথর বাঁধিয়াছি, আজ সে পাথর তোমার সাক্ষাতে ভাঙ্গিয়া ফেলিতাম। লোকে বলিবে তারা মহাপাপিষ্ঠা। তারা কেন যে পাপিষ্ঠা হইল, তাহা ত কেহ জানিবে না। গোকুলজী, গৃহত্যাগ করিয়া এই পর্ব্বতে আশ্রয় লইয়া ছিলাম, কার আশায় তা তোমাকে কেমন করিয়া বলিব? হায় স্বপ্নের কথা কেন ভুলিলাম? কেন আবার লোকালয়ে ফিরিলাম? যে সুখ অদৃষ্টে নাই কেন সে সুখের আশায় মুগ্ধ হইয়াছিলাম? পর্ব্বতশিখর হইতে ঝাঁপ দিয়া পড়িলাম না কেন? গোকুলজী ত আমার মনের কথা কিছুই জানিবে না। সে ত আমাকে চিরকাল ঘোর পাপিষ্ঠা মনে করিবে। তাহাকে সব কথা না বলিয়া কেমন করিয়া মরিব? সে যদি নিরপরাধে আমাকে গুরুতর অপরাধিনী মনে করে, তাহা হইলে আমি মরণেও শান্তি পাইব না। কেন গোকুলজীর সহিত বিবাদ করিলাম, কেন তাহাকে কুকথা বলিলাম, কেন তাহার পায়ে ধরিয়া ক্ষমা চাহিলাম না, কেন তাহার নিকটে সব কথা বলিলাম না? তাহা হইলে তাহার কোমল হৃদয়ে দয়া হইত, তাহা হইলে সে আমায় তৃণবৎ পায়ে ঠেলিয়া যাইত না। তাহাকে বলিয়াই বা কি ফল? গোকুলজী আমাকে মন্দ মনে করিল, তাহাতেই বা আমার কি? আমি ত আর তাহাকে পাইবার আশা রাখি না। এই যে ননীর পুতুলের মত সুন্দরী দেখিলাম, ওই কি গোকুলের স্ত্রী নয়? স্ত্রী নয় ত কি? বিবাহ না করিয়া থাকে, বিবাহ করিবে। গোকুলজীর ত কখন দুষ্কর্ম্মে প্রবৃত্তি হইবার নয়। মাগীকে যত জিজ্ঞাসা করি তত হাসে আর কেবল বলে, না। ইচ্ছা হইল ছুঁড়ীর দাঁত ভাঙ্গিয়া দিই। তা’র বা অপরাধ কি? কাকেই বা দোষ দিই? দোষ ত আমার অদৃষ্টের। কপালে কোন সুখই লেখে নাই। আমার মত পোড়াকপালীর মরণ হওয়াই ভাল।

 বিষাদ, বিদ্বেষ, ক্ষীণ আশা, প্রবল নিরাশা, এইরূপ পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী আরও কত ভাব তুমুল বেগে তারার হৃদয়ের মধ্যে আন্দোলিত, আলোড়িত, পরস্পর প্রতিহত হইতে লাগিল। সে একাসনে নিস্পন্দ ভাবে উপবিষ্ট হইয়া অনবরত নিঃশব্দে রোদন করিতে লাগিল। রোদন আর চিন্তা। দুই নয়ন দিয়া অশ্রুধারা অবিরত একভাবে প্রবাহিত হইতেছে। চিন্তার ধারা সহস্রমুখে ছুটিতেছে। অশ্রুধারা একমুখী, চিন্তা সহস্রমুখী। রমণীর অতল হৃদয়ে অগণিত তরঙ্গ বিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল।

 অন্ধকার মেঘের অন্তরালে সূর্য্য অলক্ষিতে অস্তমিত হইল। মেঘ দিগ্‌দিগন্ত পরিব্যাপ্ত করিয়া অন্ধকার করিয়া রহিল। মাঝে মাঝে অন্ধকার দীর্ণ করিয়া বিদ্যুৎ চমকিতে লাগিল। আকাশে একটীও তারা উঠিল না। আকাশ, পর্ব্বত, সমভূমি সব এক হইয়া গেল। সন্ধ্যার সময় একটি পাখী ডাকিল না। সমীরণ এক একবার সোঁ সোঁ করিয়া ছুটিয়া আসে, আবার ভয় পাইয়া দূরে পলায়ন করে। হরিণী বৃক্ষমূলে অঙ্গ রক্ষা করিয়া নিদ্রার জন্য আসিল না। অন্ধকার গাঢ়, গাঢ়তর হইয়া আসিল। বৃক্ষপত্র বহিয়া প্রস্তরের উপর টপ্ টপ্ করিয়া জল পড়িতে লাগিল। শৃগাল ভয়ে প্রহর ডাকিল না। গুটিকতক খদ্যোতিকা কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করিয়া অন্ধকারের গর্ভে ডুবিয়া গেল। ক্রমে বিদ্যুৎ বিরল হইল। বায়ু সঞ্চরণ ক্রমে ক্রমে শান্ত হইয়া একেবারে রহিত হইল। চারিদিক নিঝুম, নিস্তব্ধ। অন্তঃশূন্য, দিগ্বিদিক্‌শূন্য, জনপ্রাণীশূন্য, ভয়ময়, অন্ধকার ভূমণ্ডল অধিকার করিল। পর্ব্বতঝরনার পতন শব্দ নিস্তব্ধের মধ্যে অতি ভীষণ শ্রুত হইতেছে। জীবনের কোন চিহ্ন লক্ষিত হয় না, সৃষ্টি যেন অন্ধকারসমুদ্রে নিমজ্জিত হইল। কেবল অন্ধকারের অদৃশ্য ভয়ঙ্কর তরঙ্গভঙ্গ নিঃশব্দে কোলাহল করিতে লাগিল।

 সে সময় সেই পর্ব্বতের উপরে মনুষ্যের অবস্থান কদাচিৎ সম্ভাবিত নহে,—পর্ব্বতবাসী পশুকুল পর্য্যন্ত ত্রাসে পলায়ন করিয়াছিল, মনুষ্য কোন সাহসে সেখানে বাস করিবে? সে স্থান দেখিলে কে বলিত যে সেখানে জীবিত প্রাণী বাস করে? কে বলিত যে সেই সময় দগ্ধচিত্ত রমণী একাকিনী সেই পর্ব্বতপ্রদেশে বসিয়া আপনার ভাবনায় মগ্ন ছিল? ক্ষুদ্র কুটীরে বসিয়া অজস্র রোদন করিতেছিল? বাহিরের বিভীষিকাময়ী রজনী দেখিয়া সে কিছুমাত্র শঙ্কিত হয় নাই? সে দিকে তাহার মনই ছিল না। আপনার হৃদয়সমুদ্রের তরঙ্গাভিঘাতে আকুল, আর কোন দিকে চাহিবার তাহার অবসর ছিল না। দুষ্পাঠ্য গর্জ্জনে বধির যে, তাহার অন্যদিকে কর্ণপাত করিবার সাধ্য কি? মানুষের মন অগাধ, অপার, অনন্ত,—অসীম সমুদ্র ত তাহার ক্ষুদ্র উপমাস্থল মাত্র। সে সমুদ্র কেহ দেখিতে পায় না। এ জন্য সে সমুদ্র অপ্রমেয়। সে সমুদ্র কল্লোল কেহ শুনিতে পায় না, এ জন্য সে সমুদ্র ভয়ঙ্কর। সে সমুদ্র মানুষে কল্পনা করিতে পারে, এই জন্য সে সমুদ্র অতি বিশাল।

 সেই সমুদ্রে তুফান উঠিয়াছে!

 কুটারের বাহিরে যে রজনী বড় ভয়ঙ্করী, তারা সে কথা একবার মনে করিল না। কিছু আহার করিল না। একবার উঠিল না। এক মুহূর্ত্তের জন্য নিদ্রা তাহার চক্ষে আসিল না। চতুষ্পার্শে অতান্ত অন্ধকার এবং ভয়ানক নিস্তব্ধ। সে স্থলে মনুষ্য ভয়বিহ্বল হইয়া মূর্চ্ছিত হয়। চতুষ্পার্শে সেই অন্ধকার, মধ্যস্থলে রূক্ষ জটাধারিণী রমণী। বাহিরে দৃষ্টি নাই, বাহিরে দৃষ্টি করিবার শক্তি পর্য্যন্ত নাই। নিমুদিত নয়নে হস্ত দ্বারা চক্ষু আবৃত করিয়া বসিয়া আছে। মুদিত নয়নে দর দর ধারা। নয়নজলে হৃদয়াগ্নি নির্ব্বাণ করিবার প্রযত্ন করিতেছে।