পর্ব্বতবাসিনী/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ।
রন্ধনগৃহদ্বারে মুখরা দাসী পদাহত হইয়া কিয়ৎকাল মুখের ভরে ভূপতিত রহিল। তাহার পর উঠিয়া বসিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া চক্ষু রগড়াইয়া আরক্তবর্ণ করিল। তখন, ধীরে ধীরে উঠিয়া রঘুজীর ঘরে গেল। তাহার সম্মুখে কাঁদিয়া বলিল, আমি আর এখানে থাক্ব না। আমি চল্লাম।
রঘুজী পীড়িত, বাতরোগে শয্যাশায়িত। অস্থিগ্রন্থি সকল অবশ, অসাড়, বাতের বেদনায় অস্থির। দাসীকে রোদন কারতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন? কি হইয়াছে?
দাসী কহিল, তোমার সেই মেয়ে আসিয়াই বিনাপরাধে আমাকে লাথি মারিয়াছে। আমি আর এখানে থাকিব না। এই বলিয়াই দাসী চীৎকার করিয়া ক্রন্দন করিতে আরম্ভ করিল।
রঘুজী যন্ত্রণা সহকারে উঠিয়া বসিল। জিজ্ঞাসা করিল, সে কোথায় আছে?
তারা থালা হাতে করিয়া বাড়ীর পিছন দিকে গেল, দাসী তাহা দেখিয়াছিল। রঘুজীর কথায় উত্তর করিল, বোধ হয়, বাগানে আছে।
রঘুজী বলিল, তুই যা, আমি বাগানে যাইতেছি। তুই আমার আগে সেই খানে গিয়া তাহাকে দেখ্।
দাসী রঘুজীর ঘর হইতে ধীরে ধীরে বাহিরে আসিয়া, দ্রুতগতি বাগানের দিকে চলিয়া গেল। রঘুজী লাঠি ধরিয়া অনেক কষ্টে পশ্চাতে আসিতেছিল।
দাসী উদ্যানে প্রবেশ করিরাই দেখিল, তারা শম্ভূজীর মস্তকে কুঠারাঘাত করিল ও শম্ভূজী রুধিরাক্ত কলেবরে ধরণীশয়ন করিল। এই দেখিয়াই দাসী প্রাণপণে চীৎকার করিয়া উঠিল, ওরে বাবারে! খুন করেছে রে! তোমরা সব দৌড়ে এস গো! ওরে খুন কল্লে রে!
শম্ভূজী মুমূর্ষুর মত পড়িয়া গেল দেখিয়া তারার চৈতন্য হইল। কুঠার পরিত্যাগ পূর্ব্বক, যেখানে দাসী দাঁড়াইয়াছিল, সেই দিকে গেল। তাহাকে দেখিয়া দাসী চীৎকার করিতে লাগিল, খুন করে পালিয়ে যাচ্চে গো! খুনে মাগীকে তোমরা ধর গো!
তারা ধীরে ধীরে দাসীকে কহিল, আমি পালাই নাই। তুই চীৎকার রাখিয়া শম্ভূজীকে দেখ্। সত্য সত্যই উহাকে মারিয়া ফেলিয়াছি কি না, আগে দেখ। তাহার পর চীৎকার করিস্।
দাসী ভীতা হইয়া শম্ভূজীর নিকটে গেল। চীৎকারও বন্ধ হইল। তাহার সে উগ্রচণ্ডা মূর্ত্তি বিলুপ্ত হইয়াছে।
তারা স্থির গতিতে গৃহে প্রবেশ করিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময় দেখিল, যষ্টির উপর ভর করিয়া দ্বারের সম্মুখে রঘুজী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। রঘুজী ক্লিষ্ট, দুর্ব্বল, যন্ত্রণাকাতর, কিন্তু এ সময় ক্রোধে কাঁপিতেছে। মুখমণ্ডল অতি বিকট অন্ধকার।
নিকটেই আর একটা মুক্ত দ্বার দেখিয়া তারা সেই পথে ঘরে প্রবেশ করিল। সেখান হইতে বাহির হইয়া গৃহ প্রাঙ্গণে দাঁড়াইল। দাসীর চীৎকারে চারি পাঁচ জন লোক পার্শ্বস্থিত ক্ষেত্র হইতে ছুটিয়া আসিয়াছিল। তাহারা রঘুজীর বেতনভুক্ত। দেখিতে দেখিতে আরও চারি পাঁচ জন লোক আসিয়া জুটিল। প্রাঙ্গণে লোক পূরিতে আরম্ভ হইল। রঘুজী আবার লাঠি ধরিয়া প্রাঙ্গণের নিকটে আসিয়া তারাকে দেখিতে পাইয়া দাঁড়াইল। তারা স্থির, গম্ভীর, সম্পূর্ণ অবিচলিত।
শম্ভূজী মরে নাই। তারা কুঠারের শাণিতাগ্র দিয়া আঘাত করে নাই, তাহা হইলে শম্ভূজীর নিশ্চিত প্রাণবিনাশ হইত। কুঠারের পশ্চাদ্ভাগ দিয়া প্রহার করিয়াছিল মাত্র। কিন্তু সেই আঘাতে শম্ভূজী মূর্চ্ছিত হইয়াছিল। মস্তকাবরণ চর্ম্ম কাটিয়া যাওয়ায় রক্ত বহিতেছিল। অল্পকাল পরে চৈতন্য প্রাপ্তি হইলে শম্ভূজী হস্তদ্বয়ের ভরে উঠিয়া বসিল। পরিহিত বস্ত্রের কিয়দংশ ক্ষতস্থানে বাঁধিয়া আস্তে আস্তে উঠিয়া, প্রাঙ্গণের উপরে যাইয়া দাঁড়াইল। দাসীও সেই সময় উঠিয়া গেল।
রঘুজী তারার দিকে চাহিয়া ভৃত্যদিগকে বলিল, উহাকে ধর্।
তারা একবার তাহাদের দিকে কটাক্ষ করিল। তাহারা কেহ তাহাকে ধরিতে অগ্রসর হইল না। তারা রঘুজীর দিকে ফিরিয়া কহিল, আমাকে ধরিতে হইবে না, সঙ্গে লোক থাকিলেই হইবে। আমায় কোথায় যাইতে হইবে বল, আমি আপনিই যাইতেছি।
রঘুজী। আমার বাড়ীতে আমিই বিচারকর্ত্তা। আমার নিকট অপরাধ করিয়া কেহ কখন অন্য বিচারালয়ে যায় নাই। আমার কন্যা আমার দণ্ডে দণ্ডিত হইবে? তোরা উহাকে ধর্, আমি বলিতেছি।
তারা গর্জ্জিয়া উঠিল, সাবধান, কেহ আমায় ধরিও না। তুমি আমার অপরাধের বিচার করিবে, রঘুজী? মনুষ্যহত্যা স্ত্রীহত্যার পাতকী, মানবকুলকলঙ্ক, তুমি আমার বিচারকর্ত্তা? কাপুরুষ, দুর্ব্বলের পীড়ককে উচিত শাস্তি দিয়াছি, তুমি আমার বিচার করিবে? রঘুজী, তোমার বিচার ঐখানে হইতেছে। এই বলিয়া ঊর্দ্ধে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিল।
সে ভীমা মূর্ত্তি দেখিয়া তাহার অঙ্গস্পর্শ করিবার কাহারও সাধ্য রহিল না।
ক্রোধে রঘুজীর বাক্শক্তি রহিত হইবার উপক্রম হইল। রুদ্ধকণ্ঠে পার্শ্বস্থ একটা ভৃত্যকে সম্বোধন করিয়া কহিল, ভীরু, একটা বালিকাকে ধরিতে পারিস্ না? আমি আপনিই ধরিতেছি। এই বলিয়া লাঠি ধরিয়া তারা যে দিকে দাঁড়াইয়াছিল, সেই দিকে বহু কষ্টে অগ্রসর হইল।
তারা আর এক দিকে সরিয়া গেল। রঘুজী স্বয়ং আসিতেছে দেখিয়া দুই জন বলিষ্ঠকায় পুরুষ সাহস করিয়া তারাকে ধরিবার জন্য হাত বাড়াইল। তারা মাথা তুলিয়া, জটাভার আন্দোলিত করিয়া, চক্ষু হইতে জ্বলন্ত বিদ্যুৎ নিক্ষেপ করিয়া কহিল, আমি কোথাও পালাই নাই। এখনও কেহ আমায় স্পর্শ করিও না। শম্ভূজীর দশা মনে রাখিও। তাহারা নিরস্ত হইল।
রঘুজীর দিকে ফিরিয়া তারা জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে ধরিয়া কি করিবে?
রঘুজী বেদনায় অস্থির, আর চলিতে পারে না। যে স্থলে দণ্ডায়মান ছিল, সেই স্থান হইতে উত্তর করিল, তোকে ধরিয়া বন্য পশুর মত একটা ঘরে পুরিয়া রাখিব। যতদিন তোর দর্প না চূর্ণ হয়, ততদিন তোকে মুক্ত করিব না।
তারার পক্ষে ইহাই অত্যন্ত কঠিন শাস্তি। সে ভীত হইয়া কাতর স্বরে কহিল, আমার জন্য আর কোন শাস্তির বিধান কর, আমাকে প্রাণে বধ কর, কিন্তু আমাকে ঘরে বন্ধ করিও না, সে যন্ত্রণা আমি সহ্য করিতে পারিব না।
রঘুজী অল্প ঈষৎ- পিশাচে যদি ঈষৎ হাসিতে পারে, সেই রূপ—অল্প হাসিয়া কহিল, আমাকে তুই জানিস্। আমি তোকে আর কোন শাস্তি দিব না। অনুচরগণকে বলিল, উহাকে এখনি ধর্, নহিলে কাল তোদের সকলকে দূর করিয়া দিব।
এরূপ আজ্ঞা শুনিয়া সকলে তারাকে ধরিতে উদ্যত হইল। যে দুইজন তাহাকে ধরিবার জন্য হস্ত প্রসারিত করিয়াছিল, তাহারা তারার দুই হস্ত ধারণ করিল।
গহন বনে শাবক রাখিয়া আহারান্বেষণে লোকালয়ে আগতা ব্যাঘ্রী অকস্মাৎ কারারুদ্ধ হইলে যেরূপ ভীত ও ক্রুদ্ধ হয়, তারা রঘুজীর দণ্ডাজ্ঞা শুনিয়া সেইরূপ বিকলচিত্ত হইয়া উঠিয়াছিল। ভাবিবার চিন্তিবার অবকাশ রহিল না। দুইজনে তাহার হস্ত ধরিল দেখিয়া সে অতি বেগে আপনার হস্ত আকর্ষণ করিল। একজন হস্তাকর্ষণের বেগে দূরে নিপতিত হইল, আর একজন দৃঢ়মুষ্টিতে তারার হাত ধরিয়া রহিল। মুক্তহস্তে তারা তৎক্ষণাৎ তাহার মুখে প্রচণ্ড চপেটাঘাত করিল। সে তারার হস্ত পরিত্যাগ করিয়া ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িল। তাহার নাসিকা দিয়া রক্ত ঝরিতে লাগিল!
নিমেষ মধ্যে তারা রন্ধনশালায় প্রবেশ করিয়া চুল্লী হইতে একখণ্ড জ্বলন্ত ইন্ধন কাষ্ঠ তুলিয়া লইয়া মাথার উপর ঘুরাইতে ঘুরাইতে ঘর হইতে বাহির হইল। হুতাশননয়না, হুতাশনহস্তা, রুদ্ররূপিনী রমণী দেখিয়া যে যেদিকে পাইল, পলায়ন করিল। বাটীর বাহিরে আসিয়া তারা দেখিল, রঘুজীর উত্তেজনায় অনেকে তাহার পশ্চাদ্ধাবিত হইয়াছে। তারার শরীরে আর বড় বল নাই। এত লোকে পশ্চাদ্ধাবিত হইলে পলায়ন দুষ্কর। আর কোন উপায় না দেখিলে নিস্তার নাই।
তারা ফিরিয়া দাঁড়াইল। সে যে স্থানে দাঁড়াইল, সেখান হইতে অনুমান পঞ্চাশ হস্ত দূরে একটা বৃহৎ মরাই ছিল। তাহার উপরে আঁটি বাধা রাশীকৃত খড় থাকিত। তারা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া উচ্চৈস্বরে উপহাস করিয়া কহিল, আমাকে ধরিবে? তবে ধর! এই বলিয়া জ্বলন্ত কাষ্টখণ্ড ঘুরাইয়া মরাইয়ের উপর নিক্ষেপ করিল। খড় দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল।
কি হইল! কি হইল! বলিয়া সকলে আগুন নিভাইতে ছুটিল। দেখিতে দেখিতে অগ্নি বিস্তৃত হইয়া পড়িল।
সেই অবকাশে তারাবাই, পিঞ্জরমুক্ত বনবাসিনী কুরঙ্গিণীর মত লঘুপদক্ষেপে পলায়ন করিল। আবার যে পর্ব্বতবাসিনী সেই পর্ব্বতবাসিনী হইল।