পর্ব্বতবাসিনী/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

 গৃহে প্রবেশ করিতে তারা দেখিল, গৃহদ্বারে একটা স্থূলাঙ্গী প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক বসিয়া আছে। সে তারাকে ঘরে প্রবেশ করিতে নিষেধ করিল। তারা কিছু বিস্মিত হইয়া দাঁড়াইল। স্ত্রীলোকটা কালো, চক্ষু দুটা লাল লাল, তারার দিকে চাহিয়া ব্যঙ্গসূচক অল্প হাস্য করিতেছিল। তারাকে দাঁড়াইতে দেখিয়া কহিল, আমাকে নতুন দেখ্‌চ, না? আমি নতুন এসেছি বটে, কিন্তু সব এখন আমার হাতে। তুমি বুঝি কর্ত্তার মেয়ে। তা আমি কি কর্‌ব বল? কর্ত্তা বলেচে যে যদি তুমি তার কথা শোন, তবেই বাড়ী ঢুক্‌তে পাবে। কি কথা তা আমি ভাল জানি না, কিন্তু আমায় আগে না বল্লে কর্ত্তা তোমার সঙ্গে দেখা কর্‌বে না। আর যদি তুমি এখনও আপনার গোঁ বজায় রাখিতে চাও, ত তোমায় গোয়াল ঘরে শুতে হবে। এই বলিয়া মাগী একটু হাসিল।

 বার দুই তারার চক্ষু হইতে বিদ্যুৎ ছুটিল, শেষ ক্রোধ সম্বরণ করিয়া কহিল, তুই দাসী, তোর কিছু অপরাধ নাই। নহিলে তোর মুখ দিয়া রক্ত তুলিতাম। সরে যা! পথ ছাড়্!

 দাসীর মূর্ত্তি ফিরিল। হাত নাড়িয়া চোক ঘুরাইয়া বলিয়া উঠিল, জানি লো জানি তোর বড় তেজ! তেজ দেখাতে হয়, তোর বাপকে দেখাগে যা। আমার কাছে কিসের তেজ দেখাস্ লা? আমি কি তোর খাই না তোর পরি যে তোকে ভয় কর্‌ব? বাপে ঠাঁই দেয় না ঘরে ছুঁড়ি এল আমার কাছে জোর দেখাতে। বের এখান থোকে। যা, গোয়ালঘরে যা!

 তারা দন্তের উপর দন্ত রাখিয়া কহিল, ভাল চাস্ ত সরে যা। সরে যা বল্‌চি।

 দাসী আর এক পা আগে আসিয়া কহিল, কিলা, মার্‌বি না কি? মার্ দেখি, তোর কত বড় সাধ্য?

 তারা একবার বদ্ধমুষ্টি মারিবার হেতু উঠাইল, আবার তখনি হাত নামাইল।

 দাসী তাড়াতাড়ি একটা চেলা কাঠ তুলিয়া লইয়া, সেইটা দক্ষিণ হস্তে আস্ফালন করিয়া কহিল, এক ঘা যদি মার্‌বি ত তোকে সাত ঘা মার্‌ব। আয় না একবার তোর পিঠে এই চেলা কাঠ বসিয়ে দিই, তখন সুখ টের পাবি।

 তারা আর কিছু না বলিয়া সেখান হইতে ফিরিল। দাসী উচ্চ হাস্য করিয়া উঠিল।

 তারার হৃদয়ের ভিতর কি হইতেছিল, কে বলিবে? গৃহদ্বারে এইরূপে অপমানিত হইয়া, ঘুরিয়া বাড়ীর পশ্চাতে যে উদ্যান সেইখানে গেল। এইখানে তারা স্বহস্তে ফুলগাছ রোপন করিত। এইখানে শম্ভূজীকে মর্ম্মপীড়িত করিয়াছিল। এখন তাহার প্রতিফল ভোগ করিতে হইতেছে।

 উদ্যানে গিয়া তারা দেখিতে পাইল, মহাদেব কুঠার হস্তে কাষ্ঠ ছেদন করিতেছে। মহাদেব এখন আরও বৃদ্ধ, শীর্ণ, অবনতকায়, মরণাপন্ন। মহাদেবকে দেখিয়া তারা কহিল, মহাদেব, তুমি যে কাঠ কাটিতেছ? এ ত তোমার কাজ নয়।

 মহাদেব ফিরিয়া তারাকে দেখিল। দেখিয়া ললাটের স্বেদবিন্দু মুছিল। মুছিয়া বলিল, তারা এসেছিস্? তোকে যে আর দেখ্‌তে পাব সে আশা ছিল না। মায়ী মরেচে, বেঁচেছে। আমি এখন মরিলেই বাঁচি। এই বয়সে কপালে এত কষ্টও ছিল। এই বলিয়া বৃদ্ধ বালকের মত রোদন করিতে লাগিল।

 তারা তাহার হাত হইতে কুঠার লইয়া ভূতলে রাখিল। তাহার পর তাহার হাত ধরিয়া আম্রবৃক্ষতলে বসাইল। বসাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি হইয়াছে, সব বল।

 বৃদ্ধ কাঁদিয়া কহিল, ওই গুলি কাঠ না কাটিলে খাইতে পাইব না। আমায় ছেড়ে দে, আমি আগে কাঠ কাটি, তাহার পর বলিব। এখনি শম্ভূজী আসিবে। এই বলিয়া সভয়ে চারিদিকে চাহিয়া দেখিল।

 তারা বৃদ্ধের হাত চাপিয়া ধরিয়া, উদ্বিগ্ন হইয়া কহিল, তুমি কি সারাদিন অনাহারে আছ?

 মহাদেব ক্ষীণকণ্ঠে কহিল, কাঠ না কাটিলে রাত্রেও কিছু পাইব না, বরং প্রহারের জ্বালায় প্রাণ যাইবে। এই বলিয়া বৃদ্ধ কাঁপিতে লাগিল।

 তারা বলিল, আমি যতক্ষণ আছি, তোমার কোন ভয় নাই। আমার সমক্ষে যদি কেহ তোমার গায়ে হাত দেয়, তাহাকে আমি ভাল করিয়া শিক্ষা দিব। তুমি নিশ্চিন্ত হইয়া আমার অপেক্ষা কর। এখনি খাদ্যসামগ্রী লইয়া আসিতেছি।

 এই বলিয়া তারা পুনরার গৃহে প্রবেশ করিল।

 এবার তারা একেবারে রন্ধনশালায় গিয়া উপস্থিত। দ্বারে সেই দাসী বসিয়াছিল। তারাকে দেখিয়া দাঁড়াইয়া উঠিয়া, রূক্ষস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, কি লা! আবার যে বড় এলি?

 তারা জিজ্ঞাসা করিল, খাবার কোথায়?

 দাসী কটিদেশে দুই হস্ত রক্ষা করিয়া কহিল, খাবার এখানে কেন? তোকে সেই গোয়াল ঘরে খাবার দিরে আসব। এখানে এসেছিস্ কেন?

 তারা আবার বলিল, আমার জন্য নয়। খাবার কোথায় আছে বল্।

 দাসী নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া, হাসিয়া বলিল, নেকামি করিস্ কেন? নিজে পেটের জ্বালা দেখাতে বড় লজ্জা করে বুঝি?

 এবার আর কিছু না বলিয়া তারা দাসীকে পদাঘাত করিল। দাসী মুখের ভরে পড়িয়া গেল। তারা গৃহে প্রবেশ করিয়া থালায় আহারদ্রব্য; ঘটী করিয়া জল লইয়া আবার উদ্যানে গেল। সেখানে গিয়া দেখিল মহাদেব পূর্ব্বের মত কাষ্ঠ ছেদন করিতেছে। তারা আম্রতরুতলে থালা ঘটী রাখিয়া পুনর্ব্বার মহাদেবের হস্ত হইতে কুঠার লইয়া তাহাকে খাইতে বলিল। মহাদেব অনশনে কাতর; দ্বিতীয় কথা না বলিয়া আহারে বসিয়া গেল। আহার করিতে করিতে বলিল, আজ সব কাঠ কাটা হইল না। না জানি অদৃষ্টে কত ভোগই আছে।

 তারা কহিল, তোমার ভয় নাই, তুমি আহার করিয়া একটু বিশ্রাম কর। আমি তোমার কাঠ কাটিয়া রাখিতেছি।

 তারা স্বয়ং ক্ষুৎপিপাসাপীড়িতা। মহাদেব তাহা জানে না, তারাও কিছু বলিল না।

 যতক্ষণ মহাদেব আহার করিতেছিল, ততক্ষণ তারা তাহার নিকটে দাঁড়াইয়া রহিল। আহারান্তে তাহাকে বলিল, তুমি এইখানে একটু বস, আমি কাঠ কাটিয়া আনিতেছি।

 মহাদেব অনেক দিন এমন বিশ্রামের অবকাশ পায় নাই। সে বসিয়া রহিল। তারা এক হাতে কাষ্ঠভার অপর হস্তে কুঠার লইয়া কিয়দ্দূর উদ্যানের ভিতর গিয়া কাষ্ঠ ছেদন করিতে আরম্ভ করিল। কুঠারের এক এক আঘাতে কাষ্ঠ খণ্ড খণ্ড হইয়া বিদীর্ণ হইয়া যাইতে লাগিল। কাঠুরিয়া সে হস্তের বল দেখিলে নিঃসন্দেহ বিস্মিত হইত।

 সে পর্য্যন্ত তেমন অন্ধকার হয় নাই। তারা কাষ্ঠ ছেদন প্রায় সমাপ্ত করিয়াছে, এমন সময় কাতর আর্ত্তনাদ শুনিতে পাইল। অনুমানে বুঝিল, মহাদেব আর্ত্তনাদ করিতেছে। কুঠার হস্তে তারা সেই দিকে ছুটিয়া গেল। গিয়া দেখিল, মহাদেব ধূলিলুণ্ঠিত হইয়া চীৎকার করিতেছে, শম্ভূজী বারম্বার তাহাকে নির্দ্দয়রূপে কষাঘাত করিতেছে, আর বলিতেছে, বড় বসিয়া বসিয়া আহার করিতিস্, না? এখনও কেবল বসিয়াই খাবি, কেমন! আচ্ছা খা, এই খা, এই খা, এই খা, আরও খা। বৃদ্ধ যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্ করিতেছে।

 সহসা শম্ভূজী দেখিল, মস্তকে দীর্ঘ জটা, চক্ষে অতি ভয়ানক কোপকটাক্ষ, এক ভৈরবী বেগে তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। ভৈরবীর নয়নাগ্নি, তাড়িৎপ্রবাহের ন্যায় শম্ভূজীর চক্ষু ঝলসিত করিল। তারা আসিয়াই কহিল, নরাধম, এই খা! সন্ধ্যালোকে একবার শাণিত কুঠার চমকিল। সেই মুহূর্ত্তে শম্ভুজী হৃতচেতন হইয়া ভূতলশায়ী হইল।