পর্ব্বতবাসিনী/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।
রঘুজীর গৃহে এখন শম্ভূজীই সর্ব্বেসর্ব্বা। তারার গৃহনির্ব্বাসনের পর সে ভিন্ন রূপ ধারণ করিল। শম্ভূজীর তরেই তারা পর্ব্বতবাসিনী, এই কারণে মায়ী এবং মহাদেব উভয়েই তাহার উপর রুষ্ট। মায়ী একবার কথায় কথায় শম্ভূজীকে দুর্ব্বাক্য বলিয়াছিল। সেই অবধি শম্ভূজী তাহাদের উপর পীড়ন আরম্ভ করিল। রঘুজী মন্ত্রমুগ্ধ সর্পের মত শম্ভূজীর বশীভূত। তাহার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ শুনিলে শম্ভূজীকে কিছু বলা দূরে থাকুক, অভিযোগীকে মারিতে উদ্যত হইত। সংসারের সমুদায় ভার শম্ভূজীর উপর। যাহাকে ইচ্ছা রাখে যাহাকে ইচ্ছা তাড়াইয়া দেয়। মহাদেবকে তাড়াইবার চেষ্টা করায় মহাদেব বলিয়াছিল, আমি এ বৃদ্ধ বয়সে আর কোথায় যাইব? তাড়াইয়া দাও, দ্বারের সম্মুখে অনাহারে মরিয়া থাকিব। এই শুনিয়া শম্ভূজী তাহাকে বহুশ্রমসাধ্য কর্ম্মে সর্ব্বদাই নিযুক্ত রাখিত। বলিত যে কাজ না করিলে খাইতে পাইবে না। এইরূপ আরও বহুবিধ অত্যাচারে সকলে সশঙ্কিত রহিত।
দুই মাস অতিবাহিত হইল। তারা পর্ব্বতপ্রবাস হইতে গৃহাভিমুখে ফিরিল। গরুর পাল আগেই গিয়া গোগৃহে প্রবেশ করিল।
পাহাড় হইতে রঘুজীর গৃহে আসিতে পথে সোহিনীর বাড়ী। সোহিনী অপরাহ্নকালে বাড়ীর সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে, এমন সময় তারাকে দেখিতে পাইল। সোহিনী আসিয়া তাহার হাত ধরিল।
তারার আর তেমন রূপ নাই। মাথায় জটা, গায় খড়ি উঠিতেছে। মলিন, ছিন্নবসনা, যোগিনীমূর্ত্তি। কিন্তু সে তীব্র চক্ষের দৃষ্টি পূর্ব্বাপেক্ষা চঞ্চল। সোহিনী তাহাকে দেখিয়া এক ফোঁটা চক্ষের জল মুছিল। বলিল, আমি তোমাকে ছাড়িয়া পলাইয়া আসিয়াছিলাম বলিয়া কি আমার উপর রাগ করিয়াছ?
তারা হাসিয়া কহিল, না, আমি রাগ করি নাই। আমি সেখানে বেশ ছিলাম।
সো। তবে তুমি একবার আমার সঙ্গে এস। এখনি বাড়ী যেও না।
তারা। কেন?
সো। তোমাকে একটা বিশেষ কথা বলিবার আছে! খানিকক্ষণ আমাদের ঘরে বস, তার পর বাড়ী যাইও।
তারা, সোহিনীর মুখ দেখিয়া বুঝিল তাহার মনে কোন অমঙ্গল সংবাদ আছে, মুখে বলিতে পারিতেছে না। তখন সে সোহিনীর সঙ্গে ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি হইয়াছে?
সোহিনী উত্তর করিল, এত ব্যস্ত কেন? একটু বস, মুখে হাতে জল দাও, তার পর বলিব এখন।
তারা বিরক্ত হইয়া কহিল, কি বলিবার আছে, বল। নহিলে আমি চলিলাম।
সোহিনী। বলিতেছিলাম কি, তোমাদের বাড়ীতে অনেক নূতন কাণ্ড হইয়াছে। শম্ভূজীই এখন কর্ত্তা, যা ইচ্ছা তাই করে। সে এখন বড় অত্যাচার আরম্ভ করিয়াছে।
তারা ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া কহিল, তা আমি জানি। আর কিছু আছে? আমাকে ডাকিলে কেন? এই কথা বলিবার জন্য?
সো। না, শুধু এই কথা নয়। আরও কথা আছে। সে মহাদেবকে বড় যন্ত্রণা দেয়। আর মায়ীকে তাড়াইয়া দিয়াছে।
তারার মুখের ভাবে কোন বৈলক্ষণ্য লক্ষিত হইল না। পূর্ব্বের অপেক্ষা কিছু স্থিরভাবে কহিল, আর কি?
সো। তাহার পর মায়ীর বড় ব্যারাম হইয়াছে, বাঁচে কি না সন্দেহ।
তারা দুই তিনবার স্থির দৃষ্টিতে সোহিনীর মুখের দিকে চাহিয়া, ধীরে ধীরে বলিল, মায়ী আর বাঁচিয়া নাই, সত্য বল?
সোহিনী একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, হাঁ।
তারার স্বর কিছুমাত্র কম্পিত হইল না, পূর্ব্বের মত স্থির স্বরে জিজ্ঞাসা করিল—এবার কণ্ঠস্বর আরও ধীর আরও মৃদু—সে কদিন মরিয়াছে?
সো। দিন পাঁচ ছয়।
তারা। কোথায়?
সো। আমাদের বাড়ীতে। শম্ভূজী তাহাকে তাড়াইয়া দিলে আমাদের বাড়ীতে দিন দশেক ছিল। ব্যারাম হইয়া আরও দশ দিন বাঁচিয়াছিল। সে সময় কেবল তোমার নাম করিত।
তারা আর কিছু না বলিয়া পিতৃ গৃহাভিমুখে চলিয়া গেল।
সোহিনী মনে ভাবিল, ধন্য মেয়ে! শরীরে যদি কিছু মায়া থাকে! বুড়ী মার মত মানুষ কোরেছিল, তার জন্যে একবার কাঁদ্লে না গা, একবার আহা বল্লে না। বেশ কোরেছিল বাপ ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এমন পাষাণ প্রাণ মেয়ের পাহাড়েই থাকা ভাল।