পর্ব্বতবাসিনী/একাদশ পরিচ্ছেদ

একাদশ পরিচ্ছেদ

 নিস্তব্ধ বিজন পর্ব্বতোপরে অনাবৃত মস্তকে তারা নিদ্রাভিভূত ছিল। পরদিবস প্রত্যূষে উঠিয়া গোদুগ্ধ পান করিয়া ক্ষুন্নিবৃত্তি করিল, তাহার পর পর্ব্বতজাত সুমিষ্ট সুপক্ক ফল আহরণ করিয়া ভোজনানন্তর ঝরণার শীতল জল পান করিল। ক্ষুধা তৃষ্ণা নিবৃত্ত হইলে, অন্য কথা ভাবিতে বসিল। মাথার উপরে আকাশ মাত্র চন্দ্রাতপ রাখিয়া নিদ্রা যাওয়া অসম্ভব। মাথা রাখিবার একটা স্থান চাই। এই মনে করিয়া তারা একটা মনোমত স্থান অন্বেষণ করিতে চলিল। এদিক ওদিক ঘুরিতে ঘুরিতে দেখিতে পাইল, উপত্যকার পার্শ্বে একটা বৃহৎ গণ্ডশৈল পড়িয়া রহিয়াছে। তাহার নিম্নভাগ কতকটা একটা গহ্বরের মত, ডালপাতা জড় করিয়া সহজেই একটা কুটার নির্মাণ করা যায়। বিশেষ, সে স্থলে ঝড় বৃষ্টি কোনক্রমেই লাগিতে পারে না। তারা স্থির করিল, এই স্থানে গৃহ নির্ম্মাণ করিব।

 কাজটাও বিশেষ অসাধ্য ব্যাপার নয়। পাহাড়ে গাছপালা বিস্তর, শুষ্কপর্ণ সংগ্রহ করিয়া গাছের ডাল ভাঙ্গিয়া অনায়াসে কুটীর রচিত হয়। গহ্বরের মুখের কাছে কতকগুলা গাছের ডাল রাখিয়া খুঁটির কার্য্য চলে। সেই খুঁটিতে লতা পাতা জড়াইয়া গৃহপ্রাচীর নির্ম্মিত হইল। ভিতরে সেইরূপ একটা বেড়ার গৃহদ্বার, আর একখণ্ড বৃহৎ প্রস্তর অর্গল হইল। কুটীর নির্ম্মিত হইলে তারার আর আনন্দের সীমা রহিল না। একবার কুটীরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দেখে, আবার দূর হইতে অনিমেষলোচনে দেখে, একবার এ পাশ দিয়া দেখে, আবার ও পাশ দিয়া দেখে, অবশেষ ভিতরে গিয়া আনন্দে হাসিয়া উঠিল। দেখ, তারা কেমন ঘর বাঁধিয়াছে! এ তারার নিজের গৃহ, এখান হইতে কে তাহাকে বহিষ্কৃত করিয়া দিবে? তারা হাসিয়াই আকুল। সে হাসি শুনিলে বুঝা যায় না যে তারা যুবতী, সে হাসি দেখিলে জানা যায় না তাহার কত দুঃখ! মনুষ্যের হৃদয়মন্দিরে দুঃখ সর্ব্বদা প্রবেশ করিবার চেষ্টা করে। কতবার সে দ্বারে করাঘাত করে কেহ তাহাকে প্রবেশ করিতে দেয় না। কত রন্ধ্র অন্বেষণ করে, কোথাও প্রবেশপথ পায় না। কতবার হৃদয়ে প্রবেশ করিয়াও বাস করিতে পায় না। এমন কত দিনের পর সে হৃদয়ের সিংহাসনে আরোহণ করে, আর কেহ তাহাকে সে সিংহাসনচ্যুত করিতে পারে না। এ পর্যন্ত তারার হৃদয়রাজ্য একেবারে দুঃখের হস্তগত হয় নাই। এমন স্থলে তারাকে একেলা পাইয়া দুঃখ আপন রাজ্য স্থাপন করিবার যত্ন করিতেছিল। বুঝি তারা তাহাকে হাসিয়া তাড়াইয়া দিল।

 দুই মাস দীর্ঘকাল। মানুষ মানুষের আসঙ্গলিপ্সু। যেখানে মানুষের মুখ দেখিতে পাই না, সে স্থানে একদিন যাপন করা এক যুগ বলিয়া বোধ হয়। একে রমণী, তাহাতে যুবতী। অনেকাংশে অপ্রাকৃত তবু মানুষী। বিশেষ সে স্থান ভীতিসঙ্কুল। মনুষ্যমুখ দেখিবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই, মনুষ্যের জীবনঘাতী হিংস্র বন্যপশু দেখিবার অনেক সম্ভাবনা। জীবনরক্ষার কোন উপায় নাই। এমন স্থলে তারা দুইমাস কাটাইবে কিরূপে?

 মানবজগতের আর এক মোহময় বন্ধনের গ্রন্থি তারার হৃদয়ে পড়িয়া ছিল। সে বন্ধন প্রণয়ের। প্রথম প্রণয়, রমণী হৃদয়ের প্রণয়, অদম্য প্রকৃতির প্রণয়, শিলারুদ্ধ উষ্ণ প্রস্রবণের ন্যায় তাহার হৃদয়ের মধ্যে নিরুদ্ধ ছিল। পর্ব্বতে উঠিয়া প্রথম রজনীতে যে স্বপ্ন দেখিয়াছিল, তাহাতেও বড় উৎকণ্ঠিত হইয়াছিল। সেই ভীষণ স্থানে তারা সম্পূর্ণ একাকিনী। দুইমাস কাল অতীত না হইলে প্রত্যাবর্ত্তন করিবে না, ইহাও তাহার স্থির সঙ্কল্প।

 এমন সঙ্কল্প কেন? তারা কি তাহার পিতার কথার বাধ্য? তাহা নহে। গোকুলজী যে তাহার প্রতি প্রণয়াসক্ত, তাহার ত সে কোন প্রমাণ পায় নাই। আবার যে তাহাদের পরস্পরে কখন সাক্ষাৎ হইবে তাহাও সংশয় স্থল। তবে গোকুলজীর মুর্ত্তি হৃদয়মন্দিরে ধ্যান করিয়া কি হইবে? এই পর্ব্বত নিতান্ত নির্জ্জন। এইখানে গোকুলজীকে সহজে ভুলিতে পারিব। কোন সুখেই বা গৃহে ফিরিব? আমার গৃহই বা কোথায়? আর গোকুলজী?—গোকুলজী হইতে ত আমার কোন মঙ্গল হইবে না। এই কথা বলিতে বলিতে স্বপ্নদৃষ্ট তুষারচক্ষু পাষাণপুরুষ তাহার স্মরণ হইত। সে শিহরিয়া উঠিত। চতুদ্দিকে পর্ব্বত প্রাচীর পরিবেষ্টিত বৃহৎ কারাগার মধ্যে তারা বন্দিনী। পলাইলে কেহ তাহার গতি রোধ করিবে না, কিন্তু পলায়ন করিয়া কোথায় যাইবে? মনুষ্যসমাজে কে তাহাকে আশ্রয় দিবে? মানুষের আবাস স্থান যেন একটা সমুদ্র বিশেষ; নিষ্ঠুর তরঙ্গমালা তারাকে সে সমুদ্র হইতে ভাসাইয়া লইয়া, তরঙ্গ হইতে তরঙ্গে বহন করিয়া, অবশেষে এই শিলাময় উপকুলে নিক্ষেপ করিয়াছে।

 গোকুলজীকে ভোলা দূরে থাকুক, তাহার স্মৃতি দিন দিন গাঢ়তর হইয়া উঠিল। বিরলে বসিয়া স্মৃতি ও কল্পনা একত্রে যোগ দিল। যোগ দিয়া তারার হৃদয়ে হৃদয়ে, শোণিতে শোণিতে, জাগ্রতে, স্বপ্নে গোকুলজার মূর্ত্তি দৃঢ়রূপে অঙ্কিত করিল। দিনমানে সূর্য্য, রাত্রে কখন নক্ষত্রপরিবৃত চন্দ্র কখন কেবল চঞ্চলজ্যোতি তারকারাশি। তারা কেবল তাহাই দেখিত। ভাবিত প্রভাত সূর্য্যের পশ্চাতে গোকুলজী আসিতেছে। চন্দ্রের সহিত সে মুখের তুলনা করিত, ক্ষীণরশ্মি নক্ষত্রের পশ্চাতে গোকুলজীর জ্যোতির্ম্ময় আয়তলোচন দেখিতে পাইত। দ্রুতগামিনী ভয়চকিতলোচনা হরিণী দেখিলে মনে করিত পশ্চাতে ধনুর্ধারী গোকুলজী আসিতেছে। মেঘে সহস্রবিধ মূর্ত্তি দেখিলেও কেবল মনে করিত গোকুলজীর প্রতিমূর্ত্তি দেখিতেছি। তারার চিত্ত আর তাহার বশে নহে, প্রেমে তন্ময় হইয়া উঠিল।

 প্রণয় দুই প্রকার। এক কল্পনা আর এক সম্ভোগ। আমি যাহাকে ভাল বাসি, সে আমার নিকটে আসিয়াছে, আমি তাহাকে স্পর্শ করিতেছি। আনন্দসাগর উচ্ছসিত, উচ্ছলিত হইতেছে। এই এক প্রকার প্রেম। আমি যাহাকে ভালবাসি সে আমার নিকটে নাই। কল্পনায় আমি তাহাকে সহস্ররূপ প্রণয়োপহার দিতেছি। হৃদয়ের কত রূপ আবেগ, স্মৃতির কৌশলগ্রথিত ঘটনাবলী, কল্পনার উন্মাদকারিণী লহরী। অদর্শনের যন্ত্রণা, কুহকিনী কল্পনার প্রণোদনা। এই আর এক প্রেম। এক প্রেম বিরহ আর এক প্রেম মিলন।