পর্ব্বতবাসিনী/দশম পরিচ্ছেদ

দশম পরিচ্ছেদ।

 ভীলপুর গ্রামের এক প্রান্তে একটা ক্ষুদ্র কুটীর; সেই কুটীরে গোকুলজী ও তাহার জননী বাস করে। দুইটা ঘর, খড়ের চাল, তাহার উপরে খোলা। এক ঘরে গোকুলজী থাকে, আর এক ঘরে তাহার মাতা পাক করে, শয়ন করে। ঘরের একদিকে উনান পাতা, আর একদিকে একখানি সঙ্কীর্ণ চারপাই। সেই চারপাইয়ের উপর পরিষ্কার বিছানা। দেয়ালে বাঁশের চোঙ্গ করা তৈল রহিয়াছে। হাঁড়িতে চাল, ডাল, লবণ, ময়দা। মেজের উপর কিছু তরকারি। ঘরখানি দেখিলেই জানা যায় যে সে গরিবের বাসস্থান। ঘরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অবস্থা দেখিলে ইহাও বোধ হয় যে, যাহারা সে ঘরে থাকে তাহারা প্রসন্নচিত্ত, আপনার অদৃষ্টের নিন্দা করে না। গোকুলজীর ঘরে চারিদিকে মৃগয়ার উপকরণ; একটা শার্দ্দূলচর্ম্ম, খানকতক মৃগচর্ম্ম, ধনুক, শরপূর্ণ তূণ, আরও কত কি রহিয়াছে। শয়নের নিমিত্ত একখানি চারপাই।

 গোকুলজীর মাতা পাক করিতেছে; গোকুলজী গৃহদ্বারে বসিয়া এক খণ্ড বর্ষাফলক মার্জ্জিত করিতেছে, সূর্য্যরশ্মি বর্ষাফলকে প্রতিফলিত হইতেছে। গোলকুলজীর মাতা প্রাচীনা, শুভ্রকেশ স্কন্ধে ঝুলিতেছে, মাংস চর্ম্ম, লোল, কিন্তু চক্ষের জ্যোতি হ্রাস হয় নাই, দৃষ্টি স্নেহপূর্ণ। মাতাপুত্রে কথোপকথন হইতেছিল।

 গোকুলজী বলিতেছে, মা, তুই এখন আর ভাল রাঁধিতে পারিস্‌নে। আমি এমন চমৎকার রাঁধিতে শিখিয়াছি। এইবার হইতে আমি পাক করিব।

 বুড়ী একটু হাসিয়া কহিল, নে বাপু, তুই আর জ্বালাস্‌নে। আমি বুঝি তোর কথা বুঝিতে পারিনে? আমার রাঁধিলে পাছে কষ্ট হয়, তাই তুই একটা ফন্দী বার কোরে আপনি রাঁধিতে আরম্ভ করবি, না? তুই তো আমায় কোন কর্ম্মই করিতে দিস্‌নে। আমার বিছানা পর্য্যন্ত আপনি পাতিস্। আমার ত রাঁধিতে কোন কষ্ট হয় না, তবু তুই রোজ রোজ খোঁচাবি। দেখ, শেষে আমি পায়ের উপর পা দিয়ে বসে বসেই মরে যাব।

 গো। এখন আর মরিতে হয় না। এখন তোর কিসের বয়স? তোর পাকা চুল আবার কাল হবে এখন দেখিস্।

 । যদি সুসন্তানের সেবায় বেঁচে থাকিবার হত, তা হলে আমার এ সুখ কখনো ফুরাইত না। দশ ছেলে মেয়ে যা না করে, তুই আমার তাই করিতেছিস্। আর জন্মে না জানি কত পুণ্যই কোরেছিলেম, তাই তোর মত সন্তান পেটে ধরেছি। লোকে আমাদের দুঃখী বলে, কিন্তু আমার যত সুখ, এত সুখ মানুষের কদাচ ঘটে।

 এই বলিয়া বুড়ী চক্ষু মুছিল।

 গোকুলজী মাতার দিকে পৃষ্ঠ রাখিয়া বসিয়াছিল। মাতার এই কথা শুনিয়া মুখ ফিরাইয়া হাসিয়া কহিল, দেখ মা, ও সব কথা বলিবি ত একটা বউ আনিয়া তোর গলায় গাঁথিয়া দিব। তখন সুখ টের পাবি।

 মা। যদি বিয়ে করিস্, তা হলে ত ভালই হয়। বউ এসে আমার সেবা করিবে, আর আমিও বউয়ের মুখ দেখিয়া বত্তাই। তোর যেমন কথা, তুই কেবল বলিস্ যে বউ এলে আমার কষ্ট হবে। তা তুই ত বুঝেও বুঝ্‌বি নি।

 গো। আচ্ছা, মা, সে দিন মহাদেব যে তোর কাছে এয়েছিল, সে তোকে কি বলিয়া গেল?

 মা। ও কপাল, তুই বুঝি তাই ভাবছিলি? গোকুল, দেখ, তুই বুঝি মনে করিস যে আমি বুড় হয়েছি, আর চোখে কিছু দেখতে পাই নে। ওরে, এখনও তেমন চোকের মাথা খাই নি। রঘুজীর মেয়েকে তুই বিয়ে কর্‌তে চাস, কেমন? রঘুজীর মেয়েকে বিয়ে কর্‌তে তোর ইচ্ছা হলেও, রঘুজী বিয়ে দেবে কি? আর দেখ্, আমি লোকের মুখে শুন্‌তে পাই যে মেয়েটা বড় দুরন্ত। রঘুজী না কি তাকে বাড়ীর বার্ করে দিয়েছে?

 গোকুলজী কৃত্রিম কোপে তর্জ্জন গর্জ্জন করিয়া কহিল, তুই যদি আমাকে মিছামিছি মন্দ কথা বল্‌বি, ত এখনি ভাতের হাঁড়ি ভাঙ্গিয়া ফেলিব, আর তোর পা টিপিয়া ভাঙ্গিয়া দিব। এই বলিয়া তাড়াতাড়ি মায়ের পদসেবা করিতে আরম্ভ করিল।

 মাতা বিব্রত হইয়া গোকুলজীর হাত ধরিয়া বলিল, এমন ছেলে ত কোথাও দেখি নি। কোন কাজ কর্‌তে দেবে না, কেবল ব্যস্ত কোর্‌বে। সর্ বাছা, এখন সরে যা, আমি ভাতের হাঁড়ি নামাই।

 গোকুলজী পা ছাড়িয়া মাথা ধরিল, বলিল, মা, তোর পাকা চুল তুলে দিই।

 বুড়ী রাগিয়া কহিল, তুই ত আচ্ছা জ্বালাতন আরম্ভ কর্‌লি। ভাত গলে পাঁক হয়ে যায়, আর তুই এলি পাকা চুল তুল্‌তে। এখন সরে যা। এই বলিয়া আবার চক্ষু মুছিল।

 গোকুলজী তখন মার বিছানা ঝাড়িয়া আবার পাতিল। বুড়ী পানের সঙ্গে একটু করিয়া দোক্তা খায়, গোকুলজী দোক্তা দিয়া পান সাজিতে বসিল।

 ভীলপুর গ্রামের একপ্রান্তে, ক্ষুদ্র কুটীরে, দরিদ্র বিধবা তাহার একমাত্র পুত্ত্রকে লইয়া এইরূপে বাস করিত।