পর্ব্বতবাসিনী/নবম পরিচ্ছেদ

নবম পরিচ্ছেদ

 দিবা দ্বিপ্রহরের পর তারা গৃহত্যাগ করিল।

 গোরুর পাল ছাড়া পাইলেই পর্ব্বতের দিকে যাইত, তাহাদের লইয়া যাইতে কোন কষ্ট হয় না। চারিজন রাখাল ও চারিজন রঘুজীর বেতনভোগী তাহার আদেশক্রমে সেই সঙ্গে গেল, পর্ব্বতের পদপ্রান্তে পঁহুছিলে তাহারা ফিরিয়া আসিবে।

 গ্রামে একটী সঙ্গতিশূন্য বুদ্ধা তাহার এক মাত্র কন্যাকে লইয়া বাস করিত। কন্যাটীর নাম সোহিনী, তারার অপেক্ষা পাঁচ সাত বৎরের বড়। সোহিনী কখন কখন রঘুজীর গৃহে কাজকর্ম করিত; কখন ধান ভানিত, কখন ডাল ভাঙ্গিত, কখন ময়দা পিষিত। মায়ী গোপনে সোহিনী ও তাহার মাতার অনেক সাহায্য করিত। মহাদেব, রঘুজীর অজ্ঞাতসারে সোহিনীকে তারার সঙ্গে যাইতে বলিল, আর তাহাকে অনেক করিয়া বলিয়া দিল, অন্ততঃ দুই চারিদিন তারার সঙ্গে থাকিও।

 তারার সঙ্গে আর কেহ যাইতে পাইল না, রঘুজীর নিষেধ ছিল। তারাও কাহাকে লইতে অসম্মত হইল।

 পর্ব্বতের যে অংশ দিয়া লোকের যাতায়াত ছিল, সে দিকে গোরু চরিবার মত তেমন ঘাস পাতা জন্মিত না। গোচারণের স্থান আর এক দিকে। রঘুজীর বেতনভুক্ত রাখালেরা সেইখানে গরু চরাইত। এবারেও সেই স্থলে গাভীর পাল লইয়া যাইবার আদেশ। পাহাড়রে নীচে লোক রাখিবার কথা রঘুজী তারাকে ভয় দেখাইবার জন্য বলিয়াছিল।

 পাহাড়ে উঠিতে সন্ধ্যা হইয়া আসিল। তারার সঙ্গীরা সকলে ফিরিল, কেবল সোহিনী রহিল।

 জনপ্রাণীশূন্য দুর্গম স্থান। চারিদিকে পর্ব্বতশিখর। দুর্ব্বাদলবিমণ্ডিত অতি বিশাল স্তূপাকার শিলারাশি। একটা শৃঙ্গ আকাশের সহিত মিশাইয়া গিয়াছে, আর একটা একদিকে হেলিয়া আছে। শিখরের উপরে গাছ গুলি ক্ষুদ্র ঝোপের মত দেখাইতেছে। একটা প্রশন্ত উপত্যকা ঘুরিয়া বাঁকিয়া দূরে চলিয়া গিয়াছে। পাখী উড়িয়া পাহাড়ের নীচে কুলায় যাইতেছে। আর সেই সর্বব্যাপী নিস্তব্ধতা অতি ভয়ানক!

 তারা একটা ঝরণায় হাত পা ধুইয়া, অঞ্জলি পূরিয়া জল পান করিল। সোহিনী ও তৃষ্ণায় কাতর। সেও তৃষ্ণা নিবারণ করিয়া অঞ্চল খুলিয়া জলপান বাহির করিয়া তারাকে খাইতে বলিল। তারা তাহাকে হস্ত দ্বারা নিবারণ করিল।

 চারিদিকে চাহিয়া চাহিয়া তারা দেখিল, স্থান বিজন ও গাম্ভীর্য্যপূর্ণ। গোরুগুলা এ দিক সে দিক চরিয়া বেড়াইতেছে, তাহাদের রোমন্থন শব্দ, কখন বা নীড়োন্মুখ একটা পক্ষীর চীৎকার, পর্ব্বত নির্ঝরের শব্দ কখন শ্রবণে পশে কখন পশে না, নচেৎ সেই উচ্চ পর্ব্বতপৃষ্ঠ সম্পূর্ণরূপে শব্দশূন্য।

 তারা চক্ষু ফিরাইয়া আপনার হৃদয়ের মধ্যে চাহিয়া দেখিল,—দেখিল সে হৃদয় বড় শূন্য। তবে শূন্যে শূন্যে মিশুক না কেন? উপরে সেই নিস্তব্ধ নীল শূন্য, চারিদিকে পাষাণময় হৃদয়বিহীন শূন্যতা, আর তারার সেই শূন্যময় হৃদয়, এই তিনে একত্র হইয়া মিশুক না কেন? সমানে সমান ত মিলিবার কথা। তারাও ভাবিতেছিল তাই। রঘুজীর গৃহে আমার স্থান হইল না, আমি তাহার গৃহে থাকিবার উপযুক্ত নহি। এইবার ত আমি আমার যথার্থ বাসস্থানে আসিয়াছি। এখানে আসা আমার পক্ষে আবার নির্ব্বাসন কি? এই ত আমার গৃহ। এই খানে আমার ঘর, এই পাহাড় আমার জনক জননী। আমার চক্ষে এ স্থান জনশূন্য নয়। যেমন আমার হৃদয়, তেমনি এই স্থান। কেন, এখানে থাকিলে আমার কষ্ট কি? আমি এখানে বেশ থাকিব।

 তা হইল কৈ, তারা? এ স্থান যে বড় শূন্য। তোমার শূন্য হৃদয় অপেক্ষাও শূন্য। দেখ দেখি, তোমার হৃদয়ের নিভৃত কক্ষে কোথাও কি কিছু নাই? হৃদয় কি এতই শূন্য? এই বয়সেই কি সব শূন্য? তবে এ পর্ব্বতের সহিত তোমার হৃদয় একীভূত হয় না কেন?

 কেন হইবে? কার হৃদয় এত নিস্তব্ধ, যে কোথাও কোন শব্দ শুনা যায় না? তারা আশার কথা কাণে তত স্পষ্ট শুনিতে পায় না। আশা ত কখন কাহাকে ছাড়ে না। তারা চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, আশার মূর্ত্তি বড় ভাল দেখিতে পায় না। কাণ পাতিয়া শুনিল, আশার সে মধুর রাগিণী তেমন স্পষ্ট শুনিতে পায় না। সুতরাং তারা নিতান্ত সঙ্গীহারা হইল, চতুর্দ্দিক নিতান্ত শূন্যময় দেখিল। তবু হৃদয় একেবারে শূন্য নয়।

 পথ চলিয়া তারা বড় ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। খানিকক্ষণ ভাবিতে ভাবিতে সেই কঠিন শয্যায় শয়ন করিবা মাত্র নিদ্রিত হইল। যে শ্রান্ত, তাহার নিদ্রার জন্য সুখশয্যার আবশ্যক হয় না।

 সোহিনী ভাবিতেছিল আর কিছু। স্থানটা এরূপ নির্জ্জন দেখিয়াই তাহার মনে ভয়ের সঞ্চার হইল। গভীর নিস্তব্ধতা তাহার পক্ষে মহা কোলাহলময় হইয়া উঠিল। চারিদিক হইতে যেন নানাবিধ বিভীষিকা তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। সেই সঙ্গে আবার কিছু কিছু সম্ভবপর ভয়ের কারণ তাহার স্মরণে আসিতে লাগিল। একবার ভাবিল, যদি রঘুজী তারার সহিত আমার এ স্থলে অবস্থানবার্ত্তা ঘুণাক্ষরেও জানিতে পারে, তাহা হইলেই আমার সর্ব্বনাশ। প্রাণ রক্ষা হয় ত অন্নের উপায় ঘুচিবে। তাহার বাটীতে খাটিয়া খাই, তাহাও আর পাইব না। আবার এদিকে পাহাড়ে কত কি থাকে, ভর্ সন্ধ্যা বেলা পাহাড়ের উপর দুইটা মাত্র স্ত্রীলোক! নিকটে কেহ কোথাও নাই। কেন মরিতে আসিয়াছিলাম, আগে কেন ভাবি নাই?

 সোহিনীর গা ছম্ ছম্ করিতেছে, এক একবার গায়ে কাঁটা দিতেছে, এমন সময়ে সে দেখিল যে তারা নিদ্রিতা।

 সোহিনী একবার মনে করিল, চীৎকার করি, আবার তখনি ভাবিল, পালাই। তখনও তেমন অন্ধকার হয় নাই। যাহারা সঙ্গে আসিয়াছিল, তাহারা হয় ত এখনো বহুদূরে যায় নাই। সোহিনী আর দ্বিতীয় চিন্তা করিল না। আস্তে আস্তে উঠিয়া দুই চারি পা সাবধানে চলিয়া, যে পথে আসিয়াছিল, সেই পথে ঊর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল।

 তারা নিদ্রিতাবস্থায় অতি বিচিত্র স্বপ্ন দেখিল।

 শৈলশিখরে একজন মহাকায় পুরুষ উপবিষ্ট রহিয়াছে। শরীর কৃষ্ণবর্ণ, হস্তপদ দীর্ঘ, অতিশয় প্রশান্ত, অতিশয় গম্ভীর মূর্ত্তি। মস্তকে দীর্ঘ জটাজুট। চক্ষে পলক নাই, কটাক্ষ নাই। তারা চাহিয়া দেখিল, সে চক্ষু তুষারাবৃত! দেখিতে দেখিতে তারার হাত পা হিম হইয়া আসিল, বক্ষের ভিতরে যেন সেই শীতলতা প্রবেশ করিয়া, তাহার হৃদয়কে কম্পিত করিল। তারা সেই তুষারময় চক্ষু দেখিয়া কাঁপিতে লাগিল।

 জটাধারী পুরুষ তাহাকে ইঙ্গিত করিয়া নিকটে ডাকিল। তারা উঠিয়া তাহার কাছে গেল। মহাকায় পুরুষ বলিল, তারা তুই আজ হইতে আমার কন্যা হইলি। আমি এই পর্ব্বতের দেবতা। তোর পিতা তোকে গৃহবহিষ্কৃত করিয়া দিয়াছে। এখন তুই আমার আশ্রয়ে থাক্। আমি তোকে কন্যা বলিলাম, তুই আমাকে পিতা বলিবি। আমার নিকটে থাকিবি?

 শব্দ অতি গম্ভীর শ্রুত হইল। চতুর্দ্দিকে পর্ব্বতশিখরশ্রেণী অবনত মস্তকে সে কথা শুনিতেছে। তারা মনে করিল, আকাশবাণী হইতেছে। উত্তর করিল, তোমার নিকটে থাকিব। আমার আর স্থান কোথায়?

 অতিকায় পুরুষ দীর্ঘ হস্তদ্বয় প্রসারিত করিয়া তারাকে ধরিয়া ক্রোড়ে টানিয়া লইল।

 সে ক্রোড়ের স্পর্শ নিতান্ত শীতল, রক্ত জমিয়া যায়। তারা অস্ফুট স্বরে কহিল, আমার বড় শীত বোধ হইতেছে।

 নীহারচক্ষু পুরুষ সে কথা শুনিতে না পাইয়া, তারাকে কহিল, আমার আরও কন্যা আছে। চাহিয়া দেখ্‌।

 তারা বিস্মিত হইয়া দেখিল, সাত জন যুবতী তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়াছে। সাত জনই অপূর্ব্ব সুন্দরী, আলুলায়িতকেশা, সে কেশ চরণে লুটাইয়া পড়িয়াছে। সবই সুন্দর, কেবল নয়ন তুষারময়! সকলে মিলিয়া হাততালি দিয়া পুলকভরে নৃত্য করিতেছে। একজন তারার হাত ধরিয়া তাহাকে সেই পুরুষের অঙ্কদেশ হইতে টানিয়া তুলিল। সকলে হাসিয়া কহিল, আমরা আর একটী ভগিনী পাইয়াছি। এই বলিয়া আবার ঘুরিয়া নৃত্য আরম্ভ করিল। আগুল্‌ফলম্বিত কেশরাশি অপূর্ব্ব তরঙ্গিত হহল।

 একজন হাসিয়া তারার বেণী খুলিয়া দিল। আর একজন তাহার গলা ধরিয়া ঘুরিতে আরম্ভ করিল। তারা কাতরস্বরে কহিল, আমি শীতে মরি, আমাকে অঙ্গবস্ত্র দাও।

 গলবেষ্টিতা সর্পিণীকে কেহ যেমন সত্বর পরিত্যাগ করে, সপ্তসুন্দরী সেইরূপ তারাকে পরিত্যাগ করিয়া অন্তরে দাঁড়াইল। সকলের অপেক্ষা যে প্রগল্‌ভা সে কহিল, আমরা পাষাণকন্যা, আমাদের আবার শীতগ্রীষ্ম কি? সর্ব্বনাশ! আমরা ভুজঙ্গিনীকে বক্ষে পুষিতে উদ্যত হইয়াছিলাম। এ যে মানবী, ইহাকে এখানে কেন আনিলে? ইহার হৃদয়ে যে এখনো পাপ পৃথিবীর বাসনা প্রবল রহিয়াছে। পিতঃ! ইহাকে দূর কর, দূর কর! নহিলে আমরা কলঙ্কিত হইব।

 পাষাণ পুরুষ উত্তর করিল, ইহার হৃদয়ে যাহা আছে, তাহা বাহির করিয়া ফেলিয়া দাও। তখন এ তোমাদের ভগিনী হইবার উপযুক্ত হইবে।

 সপ্তযুবতী তুষারনয়নে তারার প্রতি তীব্র দৃষ্টিপাত করিল। তারার বোধ হইল যেন তাহার হৃদয় ভেদ করিয়া সেই শীতল কটাক্ষ ছুটিতেছে। হৃদয়ের গভীরতম, অন্তরতম প্রদেশ সে দৃষ্টি হইতে লুক্কায়িত রহিল না। তারা আপনার হৃদয়ের ভিতরে দেখিল, এ কি? অন্তরে, বাহিরে, এ কে? হৃদয়ের অতিশয় প্রচ্ছন্ন কন্দরে, আবার চক্ষের সম্মুখে, এ দীর্ঘকায়, মনোমোহন সুন্দর যুবাপুরুষ কে? তারা চমকিয়া দেখিল, তাহার সম্মুখে গোকুলজী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।

 মহাকায় পুরুষ অতি গম্ভীর স্বরে কহিল, এই সকল অনর্থের মূল। ইহাকে শিখরশৃঙ্গ হইতে নীচে ফেলিয়া দাও।

 সাত জনে গোকুলজীকে ধরিয়া শিখরশৃঙ্গে লইয়া চলিল, সেইখান হইতে তাহাকে নীচে ফেলিয়া দিবে। কত সহস্র হস্ত নীচে পাষাণের উপর পড়িয়া তাহার অস্থি চূর্ণ হইয়া যাইবে। গোকুলজী স্বয়ং নিশ্চেষ্ট, যন্ত্রচালিত পুত্তলিকা সদৃশ। নিস্পন্দ নয়নে কাতরদৃষ্টিতে তারার প্রতি চাহিয়া তাহাকে কটাক্ষে বলিতেছে, আমাকে রক্ষা কর। ইহাদিগের হস্ত হইতে আমাকে মুক্ত কর।

 তারা আজানুপ্রণত হইয়া, যুক্তকরে, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে মহাকায় পুরুষকে সম্বোধন করিয়া কহিল, আমি তোমার নিকটে থাকিতে চাহিনা, তুমি গোকুলজীকে ছাড়িয়া দাও। আমি সংসারের যন্ত্রণা ভোগ করিতে স্বীকৃত আছি, তুমি গোকুলজীকে ছাড়িয়া দাও। আমি এখনি গোকুলজীকে লইয়া এখান হইতে চলিয়া যাইতেছি। তোমার পায়ে ধরি, তুমি গোকুলজীকে ছাড়িয়া দাও।

 পাষাণপুরুষ কিছুই শুনিল না, কহিল, সংসারে তোর কপালে যন্ত্রণা ব্যতীত আর কিছুই নাই। তুই সংসারের সুখের আশা পরিত্যাগ করিয়া এইখানে থাক্। গোকুলজীর দ্বারা তোর কেবল অমঙ্গল হইবে।

 সপ্তরমণী মিলিত হইয়া গোকুলজীকে টানিয়া পর্ব্বতশিখরে লইয়া যাইতেছে। তারা চীৎকার করিয়া ছুটিয়া গিয়া গোকুলজীকে ধরিয়া তাহাকে ছিনিয়া লইবার জন্য টানাটানি আরম্ভ করিল। পাষাণ রমণীদের চক্ষে ঘৃণায় এবং ক্রোধে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছুটিতে লাগিল। তুষারনয়নে অগ্নিকণা! তারা প্রাণপণে গোকুলজীকে মুক্ত করিবার চেষ্টা করিতেছে, দেখিয়া একজন কহিল, ইহাকেও নীচে ফেলিয়া দাও।

 তারা দেখিল, উভয়েরই প্রাণ যায়। প্রাণ ভয়ে তখন সে চীৎকার করিয়া উঠিল। সেই চীৎকারে তাহার নিদ্রাভঙ্গ হইল।

 যামিনী অন্ধকার, কিন্তু আকাশ নির্ম্মল। আকাশে নক্ষত্র বায়ুবিচলিত প্রদীপের মত কম্পিত হইতেছে।

 চক্ষু মুছিয়া তারা উঠিয়া বসিল। তখনো তাহার বক্ষের ভিতর গুর্ গুর্ করিতেছে। মুখ ফিরাইয়া ডাকিল, সোহিনী! কেহ কোন উত্তর দিল না। উঠিয়া দেখিল, কেহ কোথাও নাই। তখন তাহার ভীতিশূন্য হৃদয়েও একবার ভয়ের সঞ্চার হইল। উপত্যকাপথে কিছু দূর গিয়া অতি মুক্তকণ্ঠে ডাকিল, সোহিনী! সোহিনী! প্রতিধ্বনি ছুটিয়া নিমেষের মধ্যে পর্ব্বতের গহ্বরে গহ্বরে ডাকিল, সোহিনী! সোহিনী! উপত্যকায় ছুটিয়া নীচে গিয়া ডাকিল, সোহিনী! সোহিনী! পর্ব্বতশিখরে উঠিয়া, তাহার পর আকাশে উঠিয়া, ক্ষীণতর স্বরে ডাকিল, সোহিনী! সোহিনী! তৎপরে দিগন্তে মিলাইয়া গেল। কেহ কোথাও কোন উত্তর দিল না, কেবল গোরুগুলা চব্বিতচর্ব্বণ পরিত্যাগ করিয়া কিয়ৎকাল চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, দুই একটা দুই একবার ইতস্ততঃ ছুটাছুটি করিয়া পূর্ব্বের মত স্থির ভাবে রোমন্থনে নিযুক্ত হইল।

 এই সময়ে শৃগালে প্রহর ডাকিল।

 সেই জনমানবশূন্য ভয়ঙ্কর পর্ব্বতে তারা এখন একাকিনী। কিন্তু সে হৃদয় ভয়ে বিচলিত হইবার নহে। তারা বুঝিল, যে কারণেই হউক, সোহিনী তাহাকে একেলা রাখিয়া চলিয়া গিয়াছে। এই পর্ব্বতেই এখন তাহাকে থাকিতে হইবে। আজ রাত্রে আর কোথায় যাইবে?

 এই ভাবিয়া সেই তারকিত, নক্ষত্রখচিত, অনন্ত নীলাম্বর তলে শয়ন করিল। পথের পরিশ্রমে শরীর অবসন্ন, পুনরায় অবিলম্বে নিদ্রিত হইল। সমস্ত রাত্রি তারকারাজি সহস্র চক্ষু মেলিয়া পাষাণশয্যায় শায়িত সেই রূপরাশি দেখিতে লাগিল।