পর্ব্বতবাসিনী/অষ্টম পরিচ্ছেদ
অষ্টম পরিচ্ছেদ।
এই নিদারুণ নির্ব্বাসনাজ্ঞা মুহূর্ত্তের মধ্যে রঘুজীর গৃহে প্রচারিত হইল। মায়ী ছুটিয়া একেবারে রঘুজীর সম্মুখে উপস্থিত হইল। কত কাঁদিল, কত বুঝাইল, কত পূর্ব্ব কথা স্মরণ করাইল, বলিল, তোমার সেই সতী লক্ষ্মী স্ত্রীকে কত কষ্ট দিয়াছিলে, একবার মনে করিয়া দেখ। সেই স্ত্রীর একটী কন্যা, তাহাকে আজ গৃহবহিষ্কৃত করিয়া দিতেছ। পাহাড়ের উপর গিয়া বাছা মরিয়া যাইবে। মাথার উপর দেবতা আছেন, রঘুজী, এমন কর্ম্ম করিও না। পাপের উপর আর পাপ চাপাইও না। তারার মা স্বর্গে গিয়াছে, আর তাহার আত্মাকে কষ্ট দিও না।
রঘুজী কোন কথা শুনিল না। তখন বুড়ী রাগের মুখে তাহাকে গালি দিল। রঘুজী উঠিয়া তাহাকে লাথি মারিল। মায়ী ঘরের বাহিরে পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল। মহাদেব বকিতে বকিতে আসিতেছিল, রঘুজীর হাতে লাঠি দেখিয়া সরিয়া গেল। শম্ভূজী অনেক করিয়া বুঝাইল। রঘুজী কাহারও কথায় কর্ণপাত করিল না। কহিল, পাহাড়ের সহিত সম্বন্ধ আছে, পাহাড়েই গিয়া থাকিবে। তারাও সকলকে নিষেধ করিল, বলিল, আমি পাহাড়ে বেশ থাকিব। গোরুর দুধ আর ফলমূল খাইয়া, পাহাড়ের উপর একটা ঘর বাঁধিয়া থাকিব। তোমরা কেহ রঘুজীকে অন্যমত করিবার চেষ্টা করিও না। আমার আর এখানে থাকিবার মন নাই।
মায়ী আর মহাদেব দেখিল, তারা এখন পিতাকে রঘুজী বলে, আর পিতা বলে না। তাহারা ভাবিল একটা বিশেষ কিছু ঘটিয়া থাকিবে।
তারার পক্ষে দুটা কথা বলে এমন কেই বা ছিল? একটা চাকর, একটা দাসী, দুইজনে যাহা বলিবার তাহা বলিল, আর কাঁদিল, আর কি করিবে? শম্ভূজীর আধিপত্য যথেষ্ট, সেও অনেক চেষ্টা করিল, শেষে ধমক খাইয়া চুপ করিয়া গেল। তারা যার নাড়ী ছেঁড়া ধন, সে ত আর ইহসংসারে নাই। তারার কষ্ট দেখিলে যার বুক ফাটিয়া যায় সে ত আর নাই। অভাগী নির্ব্বাসিতা, এ কথা শুনিলে যে গৃহসংসারে জলাঞ্জলি দিয়া কন্যাকে লইয়া আপনি নির্ব্বাসিতা হইত, সে জননী ত আর নাই। যাহার জননী আছে, তাহার আবার গৃহনির্ব্বাসন কি? মা কি সন্তানকে ছাড়িয়া থাকিতে পারে? যেখানে মাতা সেই গৃহ, পিত্রালয় মাতুলালয় ত কথার কথা। যে মাতৃহারা সেই প্রকৃত নির্ব্বাসিত। সে মঙ্গলময় স্নেহরাজ্য হইতে যে নির্ব্বাসিত হইয়াছে, সে ত পথের পথিক। পথ হাঁটিয়া শ্রান্ত হইলে আর ত কেহ কোলে করিয়া মাথায় হাত বুলাইয়া সে শ্রান্তি দূর করে না; আর ত কেহ তেমন বক্ষে লইবার জন্য হস্ত প্রসারিত করে না। যাহার নিকটে থাকিলে মস্তকের উপর নীলাকাশ মাত্র আবরণ রহিলে, বোধ হয় গৃহের ভিতর আছি, সে ত আর নাই!
মাতার মমতা কেমন, তারা তাহা বুঝিতে না বুঝিতেই, মাতার মুখ হারাইয়া গেল। দুই পা চলিতে হইলে যখন চারিবার আছাড় খায়, থলমল করিয়া একটু চলে আবার আছাড় খায়, মুখে লাল আর ধূলা, আর রাঙ্গা মুখে দুই চারিটী খুদে খুদে মুক্তার মত দাঁত, যখন আধ আধ করিয়া মা বলিয়া ডাকিত, হাসিতে হাসিতে লাল ফেলিতে ফেলিতে মার বুকে মুখ লুকাইত, সেই সময় মার মুখ হারাইয়া গেল। সে মুখের আলোক নিভিয়া গেল, কই, আর ত জ্বলিল না? সেই অবধি তারার অদৃষ্ট অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইল। মাতার মুখ ভুলিয়া তারা রঘুজীর অন্ধকার ললাট চিনিতে শিখিল। সে ললাটে স্নেহের কোমল কর কখনো স্পর্শ করে নাই, সে চক্ষে স্নেহের প্রশান্ত আলোক কখনো জ্বলে নাই। তারার জীবনাকাশে ঊষাকালে অরুণ উঠিতে না উঠতেই মেঘ উঠিল, তাহার জীবন ঘোর মেঘাচ্ছন্ন হইল।