পর্ব্বতবাসিনী/সপ্তম পরিচ্ছেদ

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

 পরদিবস প্রাতে উঠিয়া মুখ হাত ধুইয়া তারা গৃহকর্ম্মে ব্যাপৃতা রহিয়াছে, এমন সময় রঘুজী তাহাকে ডাকিল। তারা একবার মায়ীর দিকে চাহিল, যেন কটাক্ষে জিজ্ঞাসা করিল, আজ যে আমার বড় ডাক পড়িল? রঘুজী বাহিরের ঘরে বসিয়া রহিয়াছে; ঘরখানি একতালা, সঙ্কীর্ণ, অনুচ্চদ্বার, একদিকে একটা ক্ষুদ্র গবাক্ষ। তারা ঘরে প্রবেশ করিয়া সেই গবাক্ষে পিঠ দিয়া দাঁড়াইল। দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুমি আমাকে কেন ডাকিয়াছ?

 রঘুজী দরজার দিকে চাহিয়াছিল। দরজার বাহিরে খানিক দূরে ঘাসের উপর বসিয়া দুইজন লোক দুইখানা পাথর হাতে লইয়া দুইটা কোদালে শান দিতেছে। তারার প্রশ্ন শুনিয়া রঘুজী ফিরিয়া চাহিল।

 তারা আবার জিজ্ঞাসা করিল, তুমি আমাকে কেন ডাকিয়াছ?

 রঘুজী বড় বিস্মিত হইল, তাহার পর বড় বিরক্ত হইল। তাহার কন্যা তাহাকে প্রশ্ন করে? বলিল, হাঁ আমি ডাকিয়াছি। কেন ডাকিয়াছি, তোর সে খোঁজে কাজ কি?

 তারা কখন ভয়ে রঘুজীর মুখের দিকে চাহিতে পারে না। আজ সে স্বচ্ছন্দে স্থির দৃষ্টিতে রঘুজীর দিকে চাহিয়া রহিল। একবার চক্ষু নত করিল না, একবার ঘাড় হেঁট করিল না, সভয়ে ইতস্ততঃ করিল না। দিব্য গবাক্ষের নিকট দেয়ালে পিঠ দিয়া, লম্বিত বাম হস্তের উপর দক্ষিণ হস্ত রাখিয়া নির্ভয়ে দাঁড়াইয়া রহিল। আজ সে নিশ্চয় একটা কিছু মনে করিয়াছে।

 তার। পূর্ব্বের মত বলিল, কেন ডাকিরাছ বল, নহিলে আমি যাই।

 রঘুজী ভ্রূকুটী করিয়া কহিল, চুপ করিয়া সমস্ত দিন দাঁড়াইয়া থাক্‌। আমি তোকে কেন ডাকিয়াছি বলিব না।

 তারা, আচ্ছা বলিয়া স্থির হইয়া রহিল।

 রঘুজী রাগিয়া বলিল, দূর হইয়া যা!

 তারা নিঃশব্দে চলিয়া যায়, রঘুজী আবার ধমক দিয়া দাঁড়াইতে বলিল। তারা দাঁড়াইয়া রহিল।

 রঘুজীর রাগ বাড়িতে লাগিল। ইচ্ছা যে তারাকে মারে, কিন্তু মারিবার কোন কারণ তখন না পাইয়া তাহাকে কহিল, কেন তোকে ডাকিয়াছি জানিস্?

 তারা। না।

 রঘুজী। শম্ভূজী তোকে বিবাহ করিতে চাহিতেছে। তুই না কি বলিয়াছিস্ যে তাহাকে বিবাহ করিবি না?

 তারা। বলিয়াছি।

 রঘুজী। তুই কি তাহাকে বিবাহ করিবি না?

 তা। না।

 র। তুই ভাবিয়াছিস্ যে তুই আপনার মতে বিবাহ করিবি, না? এক মাসের মধ্যে শম্ভূজীর সঙ্গে তোর বিবাহ দিব।

 তা। আমি শম্ভূজীকে বিবাহ করিব না।

 র। আমি বলিতেছি শম্ভূজীর সঙ্গে তোর বিবাহ দিব। আমার ইচ্ছার বিপরীত কখন কিছু হয়?

 তা। আমার উপর আর তোমার ইচ্ছা চলিবে না। শম্ভূজীকে আমি কখন বিবাহ করিব না।

 অন্যদিন হইলে এতক্ষণ রঘুজী তারাকে মারিত। আজ সে বড়ই বিস্মিত হইয়াছিল। ক্রোধ সম্বরণ করিয়া অন্য কথা আরম্ভ করিল। বলিল, আমার অনেক টাকা আছে জানিস্?

 তা। জানি।

 রঘু। আামার কথা না শুনিলে তোকে আমি কিছু দিয়া যাইব না। তোকে পথে দাঁড়াইতে হইবে। আমি আপন সম্পত্তি শম্ভূজীকে দিয়া যাইব।

 তারা হাত কচলাইয়া সানন্দে বলিল, স্বচ্ছন্দে। তুমি শম্ভূজীকে সব দাও, আমি এক পয়সাও চাই না। আমায় ছাড়া শম্ভূজীকে সব দাও।

 রঘুজীর হার হইল। আবার বলিল, তুই আমার খাইয়া মানুষ হইয়াছিস্। তোতে আয়াতে সম্বন্ধ আছে।

 এইবার তারার মুখ লাল হইয়া উঠিল। মস্তক উত্তোলন করিয়া গর্ব্বিত স্বরে বলিল, তোমাতে আমাতে আবার সম্বন্ধ কি? তুমি আমাকে কেন মানুষ করিয়াছিলে? জীবনের ভার আমার গলায় কেন গাঁথিয়া দিয়াছিলে? এ বোঝা আমার বড় ভারি হইয়াছে। তুমি যে জীবন রক্ষা করিয়াছ সে জীবনে আমার কাজ কি? আমাকে তখনি মারিয়া ফেলিলে না কেন? তোমায় আমার আবার সম্বন্ধ কি? কোন সম্বন্ধ নাই।

 রঘুজীর মুখ বড় মলিন হইয় গেল। সে বসিয়াছিল, উঠিয়া দাঁড়াইল। রুদ্ধ কণ্ঠে কহিল, কি বলিলি আবার বল্‌ দেখি।

 তারা কহিল, যে দিন তুমি আমার পিঠে লাঠি মারিয়াছিলে, সেই দিন হইতে তোমার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ঘুচিয়াছে। তোমার সঙ্গে যেমন সম্বন্ধ, আর ঐ পাহাড়ের সঙ্গেও আমার তেমনি সম্বন্ধ। এই বলিয়া মুক্তগবাক্ষপথে হস্ত প্রসারিত করিল। সেখান হইতে পর্ব্বত দেখা যায়। তাহার পর বলিতে লাগিল, বরঞ্চ পাহাড়ের সঙ্গে আমার কিছু সম্বন্ধ আছে, তবু তোমার সহিত নাই।

 রঘুজী লাফাইয়া তারার মুখে করাঘাত করিল। অপর মুহূর্ত্তে তাহাকে ভূতলে নিক্ষেপ করিয়া তাহার বুকে পা দিয়া দাঁড়াইল। তারার বোধ হইল যেন বুকে পাথর দিয়া চাপিয়া ধরিতেছে। যন্ত্রণায় প্রাণ অস্থির হইল। অস্থিপিঞ্জর যেন চূর্ণ হইয়া গেল। শ্বাস রুদ্ধ, প্রাণ কণ্ঠাগত হইল। পাছে যাতনায় চীৎকার করিতে হয়, এই কারণে তারা দন্তে দৃঢ়রূপে অধর চাপিয়া ধরিল, তাহাতে অধর কাটিয়া রক্ত বহিল।

 রঘুজীর মুখ নরকের মত অন্ধকার হইয়া উঠিল, চক্ষে নরকানল জ্বলিতেছিল। কেবল দন্তে দন্ত ঘর্ষিত করিয়া বলিতে লাগিল, তবে নে, এই পাথর বুকে ধর্। মর্, মর, আজ তোকে মারিয়া ফেলিব।

 তারা একবার মাত্র বলিল, মারিয়া ফেল। মরিলেই বাঁচি। অনন্তর অধর চাপিরা, অবিকৃত মুখে স্থিরনেত্রে রঘুজীর দিকে চাহিয়া রহিল। সে চক্ষে যন্ত্রণার লেশ মাত্র নাই, শুধু অত্যন্ত ঘৃণা। সে ঘৃণার অচঞ্চল দৃষ্টিতে রঘুজী চঞ্চল হইল।

 পিতার বাৎসল্য নাই, মমতা নাই; সন্তানের ভক্তি নাই, পিতৃস্নেহ নাই। নিতান্ত স্বভাবের বিরোধী। এখন একজন পুরুষে আর এক রমণীতে বলের পরীক্ষা হইতেছে। পুরুষের হৃদয়ে হত্যার পাপ বাসনা বড় প্রবল; রমণীর হৃদয়ে অসীম ঘৃণা! দুইজনে কায়মনোবাক্যে দুইজনের শত্রু। উভয়ে প্রাণপণে উভয়কে পরাজয় করিবার চেষ্টা করিতেছে। উভয়ে অনন্যচিত্ত। অতি ভীষণ দৃশ্য!

 রঘুজী পা নামাইয়া লইল। বলিল, তোকে হত্যা করিয়া অনর্থক পাপ সংগ্রহ করিব না, ধরা ইতিপূর্ব্বেই ভারি হইয়াছে।

 তারা অনেকক্ষণ পড়িয়া রহিল। অনেকক্ষণ তাহার উঠিবার শক্তি রহিল না। শেষে দুই হাতে ভর দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

 রঘুজীর সম্পূর্ণ পরাজয় হইল। দুজনেই বুঝিল যে রঘুজীর হার হইয়াছে। দুইজনে দীর্ঘকাল হিংস্র জন্তুর সদৃশ পরস্পরের প্রতি চাহিয়া রহিল।

 কিয়ৎকাল পরে রঘুজী ধীরে ধীরে বলিল, আমার সঙ্গে তোর কোন সম্বন্ধ নাই, বরং পাহাড়ের সঙ্গে আছে, বটে? তবে শোন্। তুই আমার বাড়ী ছেড়ে ঐ পাহাড়ে গিয়ে থাকিবি। সেখানে কেমন ঘর মিলে, একবার দেখে আয়। দু চার দিনে গোরু গুলা পাহাড়ের উপর চরাইবার জন্য নিয়ে যাবার কথা। আজকেই তুই সেই গোরুর সঙ্গে যাবি। পাহাড়ের উপর দুমাস গোরুর রক্ষণাবেক্ষণ করিবি। পাহাড়ের নীচে আমার লোক থাকিবে। তোকে কখনো নামিতে দেখিলে আবার তোকে ধরিয়া পাহাড়ের উপর রাখিয়া আসিবে। যখন শীত পড়িবে, পাহাড়ের উপর আর বড় ঘাস থাকিবে না, তখন গোরুগুলা সঙ্গে নিয়ে আসিবি। দেখি, তা হলে আমার কথা শুনিস্ কি না।

 তারা উত্তরে বলিল, হানি কি? আমার এখন সর্ব্বত্র সমান। আজই পাহাড়ে যাইব।