পর্ব্বতবাসিনী/আভাষ
পর্ব্বতবাসিনী।
আভাষ।
সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। পর্ব্বতশ্রেণীর উপত্যকাপথে দুইজন পথিক। একজন বিদেশী, দেশপর্য্যটনে বাহির হইয়াছেন, আর একজন সেই প্রদেশবাসী, যৎকিঞ্চিৎ অর্থলাভের আশায় তাঁহাকে পথ দেখাইয়া চলিয়াছে।
পর্ব্বতের উপরে সূর্য্যোদয় আর সূর্য্যাস্ত উভয়ই সুন্দর। শৃঙ্গের উপর শৃঙ্গ, অভ্রভেদী চূড়া সমূহ আকাশ ভেদ করিয়া উঠিয়াছে। কোথাও পর্ব্বতশিখরে মেঘ জড়াইয়া উঠিতেছে। কোথাও পর্ব্বতঝরণার অবিশ্রাম ঝর ঝর শব্দ। সেই বিজন প্রদেশে পর্ব্বতের গুহার গুহায় সেই মৃদুমধুর শব্দ প্রতিধ্বনিত হইয়া অতি গম্ভীর, ধীর গর্জ্জন করিতেছে। উপত্যকাপার্শ্বে একটা বিশাল শৃঙ্গ পথিকের পথরোধ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে; ললাটে ভ্রূকুটী, যেন মাথার উপর ভাঙ্গিয়া পড়ে। কদাচিৎ একটা বৃহৎ শিলা খণ্ড বজ্রনাদে খসিয়া পড়িতেছে; শৃঙ্গে শৃঙ্গে, শিখরে শিখরে, আহত প্রত্যাহত হইয়া অতি ভয়ঙ্কর রবে গড়াইয়া পড়িতেছে। পথিক চমকিত, ভীত হইতেছে। চারিদিকে প্রতিধ্বনি, এই মস্তকের উপরে, এই দক্ষিণে, এই উত্তরে, ঐ দূর দিগন্তে পুনঃ পুনঃ সেই বজ্রনিনাদ।
এদিকে সূর্য্য ডুবিতেছে। এক শৃঙ্গ হইতে অপর শৃঙ্গের পশ্চাতে লুকাইতেছে। পর্ব্বতশিখরে অস্তগামী সূর্য্যের তরল কনকপ্রবাহ, তাহার ভিতরে হরিৎবর্ণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লতা গুল্ম। সেইখানে মেঘ বিচরণ করিতেছে। কখন হরিণ, কখন বাঘ, কখন রাজা, কখন ভিখারী, নানাবেশ ধারণ করিতেছে। কখন অর্ণবযানের আকারে সেই স্বর্ণসাগরে ভাসিয়া বেড়াইতেছে। পথিক মোহিত হইয়া দাঁড়াইলেন।
সূর্য্য অস্ত গেল। আকাশের প্রান্তভাগ ক্রমে ক্রমে ধুসর বর্ণ হইয়া আসিল, কেবল মধ্যভাগ গাঢ় নীল রহিল। তখন পথপ্রদর্শক পথিককে ইঙ্গিত করিয়া দেখাইল, ঐ দেখুন।
পথিক নির্দ্দিষ্ট পথে চাহিয়া দেখিলেন। অনেক দূরে তুঙ্গ শৃঙ্গশ্রেণী ছাড়াইয়া আর একটা শিখর উঠিয়াছে। পথ নিতান্ত বন্ধুর, মনুষ্যের অগম্য। গিরিশৃঙ্গ আকাশভেদী, দেখিতে গেলে দৃষ্টি চলে না। মেঘমালা একবার অন্ধকার করিয়া জড়াইয়া ধরিতেছে, আবার ঘূরিয়া চলিয়া যাইতেছে, আবার জড়াইতেছে। পথিক অনেক ক্ষণ চাহিয়া রহিলেন, কিছু দেখিতে পাইলেন না।
পর্ব্বতবাসী জিজ্ঞাসা করিল, কিছু দেখিতে পাইতেছেন?
পথিক উত্তর করিলেন, না।
সে আবার জিজ্ঞাসা করিল, কিছু দেখিতে পাইতেছেন? মনুষ্যমূর্ত্তি, রমণীমূর্ত্তি, দেখিতে পাইতেছেন কি? বস্ত্রাঞ্চল অথবা হস্তের আন্দোলন, কিম্বা বিলম্বিত কেশ, কিছু দেখিতে পাইতেছেন কি? আবার ভাল করিয়া দেখুন।
পথিক পুনরপি অতি ব্যগ্রভাবে চাহিয়া দেখিলেন। অনেক ক্ষণ চাহিয়া দেখিলেন। দেখিতে দেখিতে চক্ষু ভরিয়া আসিল। পরিশেষে ভ্রমক্রমেই হউক অথবা যথার্থই হউক, তাঁহার বোধ হইল যেন সেই নক্ষত্রস্পর্শী পর্ব্বতশিখরে মুক্তকেশী রমণী দাঁড়াইয়া আছে। পরনে তাহার বসনাঞ্চল উড়িতেছে। পথিক ফিরিয়া সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ও কি?
পর্ব্বতবাসী চারিদিকে চাহিয়া নমিতস্বরে কহিল, ও তারা বাই। আমরা গল্প শুনিয়াছি, সে ঐ পাহাড়ে বাস করিত। অদ্যাবধি তাহার প্রেতাত্মা পর্ব্বতশিখরে বিচরণ করে। আপনি স্বচক্ষে দেখিলেন।
এই বলিয়া সে পথ দেখাইয়া পর্ব্বত হইতে অবতরণ করিতে লাগিল।