পর্ব্বতবাসিনী/প্রথম পরিচ্ছেদ
প্রথম পরিচ্ছেদ।
প্রভাত হইয়াছে। পর্ব্বতের উপরে প্রভাত। আকাশ বেশ পরিষ্কার, বড় কোমল, সেই কোমল আকাশের গায়ে কঠিন গিরিশৃঙ্গের ছায়া। বড় পাহাড়ের উপরে ছোট ছোট গাছ, কদাচিৎ দুই একটা বড় গাছ। বৃক্ষপত্র কম্পিত করিয়া প্রভাতপবন বহিল। পাখীগুলি গাছের ডালে বসিয়া পাখা ঝাড়িতেছিল, একে একে তাহারা আকাশে উড়িয়া বেড়াইতে লাগিল, আবার গাছে বসিয়া পালক ফুলাইয়া প্রভাত সঙ্গীত ধরিল। নির্ঝরিণী বাঁকিয়া বাঁকিয়া, ঘুরিয়া ফিরিয়া, সারারাত্রি ছুটিতেছিল—অন্ধকারে, আবার প্রভাতের আলোক পাইল। কাল পাথরে জল আছাড়িয়া পড়িয়া সাদা ঢেউ, সাদা ফেন তুলিল, সমীরণ আসিয়া তরঙ্গদল তাড়িত করিল, জল আর একটু দ্রুত ছুটিল, তরঙ্গ আর একটু উঁচু হইল, আঘাত প্রতিঘাতের বেগ আর একটু বাড়িল। ক্রমে ক্রমে সূর্য্যোদয় হইল। প্রথমে পূর্ব্বদিকের নীলবর্ণ উজ্জ্বল শুভ্রবর্ণ, তার পরে ঈষৎ লাল, দেখিতে দেখিতে ঘোর লাল, সাদা সাদা দুই একখানি বিরল মেঘখণ্ড ঘোর লাল, গাছের মাথা, পাতার উপরে শিশির বিন্দু, জলের ঢেউ, ঢেউয়ের ফেণা, সব লাল। শেষে পর্ব্বতের অন্তরালে তপন উদিত হইল। মাতার স্কন্ধে উঠিয়া, জননীর নিবিড় কৃষ্ণ কেশ গুচ্ছের মধ্য হইতে বালক যেমন হর্ষোৎফুল্ললোচনে চাহিয়া থাকে, উন্নত পাষাণস্তূপের পশ্চাতে সূর্য্য সেইরূপ উদিত হইল। নির্ঝরিণীর জলকণা, বৃক্ষপত্রে শিশিরবিন্দু, প্রতিক্ষিপ্ত সূর্য্যকিরণে ঝলমল করিতে লাগিল। অধিত্যকা, উপত্যকা, সানুপ্রদেশ, দ্রোণি, সমুদয় আলোকিত হইল। পর্ব্বতপাদমূল হইতে গাভীগণ তৃণশষ্পের আশায় গোক্ষুরচিহ্নিত পথে দ্রুতগতি পর্ব্বত আরোহণ করিতে আরম্ভ করিল, কোথাও বা পিচ্ছিল জানিয়া সাবধানে উঠিতে লাগিল। পথিপার্শ্বে কোথাও একটা শৃগাল শয়ন করিয়াছিল, গোশৃঙ্গ দেখিয়া আস্তে আস্তে উঠিয়া গেল। বৃক্ষশাখা ত্যাগ করিয়া বিহঙ্গমকুল আহারান্বেষণে লোকালয়ে চলিল, কতক গুলা উপত্যকায় গিয়া কীটের অন্বেষণে প্রবৃত্ত হইল।
পর্ব্বততল হইতে কিছু দূরে একটী বিস্তৃত দেবখাত। হ্রদ হইতে আর কিছু অন্তরে একটী ক্ষুদ্র গ্রাম। গিরিশ্রেণীর নাম সাতপুরা, গ্রামের নাম সেতারা। মহারাষ্ট্রীয় দেশে সেতারা অতি বৃহৎ নগরীর নাম, সে নগর স্বতন্ত্র।
গ্রীষ্মকাল। প্রভাতসমীরণসঞ্চালিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গমালা হ্রদের কুলে মৃদু মৃদু আঘাত করিতেছে। গ্রামবাসীরা একে একে স্নান করিতেছে! বালকের দল ক্রীড়া করিতে আসিল। সুশীতল বায়ু সেবনে স্ফূর্ত্তি অনুভব করিয়া তাহারা ইতস্ততঃ ছুটাছুটি আরম্ভ করিল। একজন কেবল তাহাদের খেলায় যোগ দিল না, দূরে দাঁড়াইয়া তাহাদের খেলা দেখিতে লাগিল। দুই একটী বালক খেলা ছাড়িয়া কিছু বিস্ময়ের সহিত তাহাকে দেখিতে লাগিল। ভাল করিয়া দেখিতে গেলে বিস্ময়ের সহজেই উদ্রেক হয়। বালকের বেশে পঞ্চদশ বর্ষীয়া বালিকা! স্ত্রীলোকের বেশে যুবতী বলিতে হয়, কিন্তু পুরুষের বেশে বালিকা। রমণীস্বভাবশোভন লজ্জা বালিকার কিছুমাত্র ছিল না। পুরুষের বেশ, দীর্ঘায়ত সবল শরীর, বিশাল বিস্ফারিত চক্ষের দৃষ্টি স্থির, গর্ব্বিত; নিবিড় কৃষ্ণতারা, নয়নে তীব্রজ্যোতি; ওষ্ঠাধর ঈষন্মুক্ত, গর্ব্বপ্রস্ফুরিত; সরল উন্নত নাসিকা, নাসারন্ধ্র, বিস্ফারিত। দীর্ঘ, কুঞ্চিত কৃষ্ণকেশ, রুক্ষ, অবেণীবদ্ধ, মুক্ত, স্কন্ধে, বুকে, পৃষ্ঠে ঝুলিতেছে। শরীর স্ফূর্ত্তিব্যঞ্জক, শারীরিক সুস্থতাজনিত প্রফুল্লতা মুখে লক্ষিত হইতেছে। দেহ এখনও যৌবনের পূর্ণায়তন প্রাপ্ত হয় নাই।
বালিকা দাঁড়াইয়া বালকদিগের খেলা দেখিতেছিল, তাহার পরে চক্ষু ফিরাইয়া পর্ব্বতশিখরে নবীন রৌদ্রের শোভা দেখিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে ক্লান্ত দৃষ্টি শীতল জলের দিকে ফিরাইয়া তরঙ্গসমূহের উত্থানপতন দেখিতে লাগিল। এই অবসরে দ্বাদশবর্ষীয় একটী বালক সমধিক কুতূহলপরবশ হইয়া বালিকার নিকটে আসিয়া একদৃষ্টে তাহার পানে চাহিয়াছিল। বালিকা একটু পরেই মুখ ফিরাইয়া বালককে দেখিতে পাইল, তখন একটু হাসিয়া জলের দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ওটা কি পদ্ম ফুল?
বহুদূরে, সেই বিস্তৃত জলরাশির গর্ভে, তরঙ্গের বক্ষপরে, বিকসিত রক্তোৎপল, প্রভাতসমীরণ ও তরঙ্গের তাড়নে ইতস্ততঃ সঞ্চালিত হইয়া হেলিতে দুলিতেছিল, এক একবার জলে নিমজ্জিত হইতেছিল।
বালক একবার বালিকার মুখের দিকে চাহিয়া উত্তর করিল, হাঁ।
বালিকা আবার জিজ্ঞাসা করিল, এমন ফুল কেউ তোলে না কেন? তুলিতে কি বারণ আছে? তোমরা কেন তোল না?
বলিতে বলিতে বালিকার নয়নপ্রান্তে একটু হাসির দেখা দিল, মাথা নাড়িয়া কথা কহিতে এক গুচ্ছ কেশ তাহার চক্ষের উপর আসিয়া পড়িল, বিরক্তভাবে কেশগুচ্ছ হাত দিয়া সরাইয়া ফেলিল।
বালক বলিল, এক এক দিন আমরা ভেলা বাঁধিয়া ফুল তুলি। সব দিন ভেলা বাঁধা হয় না, সকলে বারণ করে। সব দিন ফুল তোলাও হয় না। আমার ভেলায় চড়িতে ভয় করে। এক দিন আর একটু হইলে আমি ডুবিয়া গিয়াছিলাম।
বালিকা এইবার ভাল করিয়া বালকের দিকে মুখ ফিরাইল, কহিল, এতটা সাঁতার দিয়ে কি কেউ যেতে পারে না, যে ভেলা বাঁধিতে হয়? এতটা সাঁতার দেওয়া কি বড় শক্ত?
বালকের হাসি পাইল, ভয়ও বোধ হইল, বলিল, দুই একজন পারে। কিন্তু তাহারা আমাদের গাঁয়ে থাকে না। আর কেউ এতখানি সাঁতার দিতে পারে না।
বালিকার চক্ষু আর একটু চঞ্চল, মুখ আর একটু রাঙ্গা হইল, বলিল, কেন? আমি এখনই তুলিতে যাইব। এই টুকু সাঁতার দেওয়া কি এমনি একটা মস্ত কাজ না কি? এই বলিয়া বালিকা জলের দিকে অগ্রসর হইল।
বালক আর দাঁড়াইল না। উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া তাহার সঙ্গীদিগকে সম্বাদ দিল। তাহারা আসিয়া বালিকাকে ঘিরিল। স্নানকারীরা এ সংবাদ পাইয়া বালিকাকে নিষেধ করিতে আসিল। কেহ জিজ্ঞাসা করিল, পুরুষের মত কাপড় পরণে, এ মেয়েটা কে? এ ত আমাদের গ্রামের মেয়ে নয়। একজন বলিল, আমি উহাকে চিনি। ও রঘুজীর কন্যা, তাহার একমাত্র সন্তান। মামার বাড়ী না কোথায় থাকিত, কাল বাপের সঙ্গে গ্রামে আসিয়াছে। আসিয়াই এই কাণ্ড! কি পাহাড়ে মেয়ে বাপ্! বাপের মেয়ে বটে! আর একজন বলিল, ডুবে মরে মরুক না, আমাদের তাতে কি? একজন যুবক সকলের পশ্চাতে আসিতেছিল, সে বলিল, ও যে তারা!
সকলে মিলিয়া বালিকাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। কেহ ভর্ৎসনা করিতে লাগিল, কেহ বুঝাইতে আরম্ভ করিল, কেহ চুপ করিয়া রহিল। বালিকা কিছুই উত্তর করে না, কেবল মুখ টিপিয়া একটু একটু হাসে, আর মাঝে মাঝে এক একবার জলের দিকে একটু অগ্রসর হয়। বালিকা কাহারও কথা শুনে না দেখিয়া একজন কহিল, আমি গিয়া রঘুজীকে ডাকিয়া আনিতেছি, তোমরা সে পর্য্যন্ত উহাকে ধরিয়া রাখ। বাপের কাছে উচিত শাস্তি পাইবে। বালিকা তবু শোনেনা, জলের দিকেই যায়। এমন সময়ে যে যুবক কহিয়াছিল ও যে তারা, সে আসিয়া উপস্থিত হইল। তারার পরিচিত এই এক ব্যক্তি, সে আসিয়াই তারাকে ভর্ৎসনা করিয়া কহিল, তারা, তুই কি পাগল হয়েছিস্ না কি? তোর কি প্রাণ এতই ভারি হয়েছে যে এই জলে সে বোঝা নামাতে এসেছিস্?
তারা মাথা নাড়িল। সেই কুঞ্চিত কৃষ্ণকেশগুচ্ছ তাহার চক্ষের উপর আসিয়া পড়িল। তারার এ বিপদ সর্ব্বদাই ঘটিত। কেশগুচ্ছ সরাইয়া তারা হাসিয়া উঠিল। সে হাসি সরল বালিকার। হাসিয়া কহিল,
এতে পাগলামি কি দেখিলে? আমি ফুল তুলিয়া আনিতেছি, তোমরা দেখ। চেষ্টা করিলে সকলেই পারে। এই বলিয়া দ্রুতপদে বালুকাসৈকতে অবতরণ করিতে লাগিল।
যুবক ধাবিত হইয়া তাহার হস্ত ধরিল, বলিল তুই কি কথা বুঝিবি না? এ সব কি মেয়েমানুষের কাজ? যে সাহস পুরুষের শোভা পায় সে সাহসে মেয়েমানুষের কাজ কি?
বালিকা ফিরিয়া দাঁড়াইল। অতি বেগে আপনার হস্ত মুক্ত করিল। এখন আর বালিকার আকৃতি নহে, এখন গর্ব্বিতা যুবতী। ধীর, মুক্ত স্বরে কহিল, আমার কাজ নয়, তোমার কাজ ত? তুমি ত পুরুষ, তবে ফুল তুলিয়া আন না কেন? আসন্ন ঝটিকার অব্যবহিত পূর্ব্বে আকাশ আরও শান্ত হইল। চুলের আড়ালে চক্ষুযুগল বড় উজ্জ্বলরূপে জ্বলিতেছিল। তারার মুখের উপর কেশগুচ্ছ আসিয়া পড়িয়াছিল, কিন্তু এবার আর সরান হইল না।
যুবক কোন উত্তর করিল না, এক পদ পশ্চাতে সরিল।
ঝড় বহিল। বালিকা অতি উচ্চৈহাস্য করিয়া কহিল,
পুরুষ যেমন সাহস তেমন! নহিলে কি পুরুষে সাহসের পথে বাধা দেয়? তুমি যাও গিয়ে ভেলা বাঁধগে। দেখো যেন বাঁধন শক্ত হয়। তার পর ফুল তুলিও।
যুবকের বয়ঃক্রম বিংশতি বর্ষ হইবে। তাহার সহিত তাহার একদিনের পরিচয় মাত্র। শম্ভূজী তাহার রূপ দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছিল কিন্তু তাহার আচরণে তাহাকে নিতান্ত মূঢ়া বলিকা স্থির করিয়াছিল। সে ব্যাঘ্রীর কোমল করতল দেখিয়া তাহার সহিত খেলা করিতেছিল, এতক্ষণ নখর দেখিতে পায় নাই। এইবার তাহার হস্তে নখ বিদ্ধ হইল।
বালিকার কাছে এরূপ অপমানিত হইয়া শম্ভূজী একটা কিছু কঠোর উত্তর দিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময়ে কে বলিল, আর গোলে কাজ নাই। ঐ রঘুজী আসিতেছে।
সকলে সেই দিকে ফিরিয়া চাহিল। দীর্ঘ যষ্টি হস্তে এক জন লোক গ্রাম হইতে হ্রদের দিকে আসিতেছিল। আকৃতি ঈষৎ খর্ব্ব, কিন্তু সেই বিশাল বক্ষ, দীর্ঘ, স্থূল, কঠিন বাহু অসুর বলের পরিচায়ক; ভ্রূযুগল মিলিত, অন্ধকার; ক্ষুদ্র, উজ্জ্বল, কোটরনিবিষ্ট চক্ষু; ওষ্ঠাধর স্থূল, কর্কশ, শ্মশ্রু কঠিন, কুঞ্চিত, নিবিড়; কেশ অর্দ্ধপলিত, অর্দ্ধ তাম্রবর্ণ, অযত্নে জটাবদ্ধ হইয়াছে। পথিক একাকী পথ চলিতে সে মূর্ত্তি দেখিলে, অর্থনাশ, প্রাণনাশের আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়। পিতা কন্যাকে একত্র দেখিলে মনে হয় যেন কঠিন শিলাসম্ভূতা অমৃতসলিলা নির্ঝরিণী দেখিলাম।
রঘুজীকে আসিতে দেখিয়া সকলে একটু সম্ভ্রমের সহিত সরিয়া দাঁড়াইল। রঘুজী দেখিল সকলে মিলিয়া তাহার কন্যাকে ঘিরিয়াছে। সে তারাকে চিনিত। মিলিত ভ্রূযুগল কুঞ্চিত করিয়া, ললাট অন্ধকার করিয়া, কর্কশ, ক্রুদ্ধ স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, কি হইয়াছে?
একজন বৃদ্ধ অগ্রসর হইয়া উত্তর করিল, তোমার কন্যা বড় দুরন্ত। সে সাঁতারিয়া ঐ ফুল তুলিতে চাহে। আমরা এত করিয়া বারণ করিলাম, কিছুতে শোনেনা। তুমি আসিয়াছ, ভালই হইয়াছে। এমন অসমসাহসিক কাজে কি এই বালিকার প্রবৃত্ত হওয়া উচিত?
রঘুজী একবার সেই ইতস্ততঃ আন্দোলিত ফুল্ল কমল দেখিল, আর একবার তাহার কন্যার দিকে কটাক্ষ করিল। তখন তাহার অধরপ্রান্ত ঈষৎ কুঞ্চিত হইল। কন্যাকে জিজ্ঞাসা করিল,
তুই ফুল তুলিতে পারিবি?
তারার চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল, বলিল, আমি না পারি ডুবিয়া মরিব, সেও স্বীকার, কিন্তু আমি ফুল তুলিতে যাইব। আমি কি কখন এতটা সাঁতার দিই নাই?
রঘুজীর ললাট একটু পরিষ্কার হইল, কহিল, তবে যা!
এই আদেশ শুনিয়া সকলে চমৎকৃত হইল। প্রথম বক্তা কহিল, রঘুজী তুমিও কি পাগল হইলে না কি? তোমার আর কেহ নাই, এই একটি সন্তান। তাহারও মরণের উপায় নিজে করিয়া দিতেছ? এতটা সাঁতার দিয়া কি ফিরিয়া আসিতে পারিবে? নিশ্চিত ডুবিবে।
রঘুজীর ললাট কুঞ্চিত হইয়া ফুলিয়া উঠিল। চক্ষুদ্বয় আরও ক্ষুদ্র হইয়া আরও উজ্জ্বল হইল। হস্তস্থিত যষ্টি বাম কক্ষে রাখিয়া, প্রসারিত বাম হস্তের উপর দক্ষিণ হস্ত স্থাপিত করিয়া, বিপুল গ্রীবা উত্তোলন করিয়া, তীক্ষ্ণ, স্পষ্টস্বরে কহিল।
যাহা অপরের অসাধ্য, তাহা আমার অসাধ্য নহে। যাহা অপরের পুত্ত্রের অসাধ্য তাহা আমার কন্যার পক্ষেও অসাধ্য নহে। আমার শোণিতে, আমার বংশে বল আছে। তারা আপনার ইচ্ছায় যাইতেছে, আমি তাহাকে যাইতে বলি নাই। আপনার প্রাণের ভয়ে বা আপনার সন্তানের ভয়ে রঘুজী কখন সাহসের পথে বাধা দিয়াছে, এ কথা আজ পর্য্যন্ত কেহ বলে নাই। কেহ কখন বলিব না।
সকলে চমৎকৃত হইল। সকলে নিরুত্তরে রহিল।
রঘুজীর কন্যাও শম্ভূজীকে এই কথা বলিয়াছিল।
তারা একেবারে জলের ধারে আসিয়া দাঁড়াইল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীচিমালা অর্দ্ধস্ফুট পুলকের স্বরে মৃদু মৃদু তাহার চরণ চুম্বন করিতে লাগিল। উন্নত শরীর আরও উন্নত করিয়া তারা কটির বসন আরও আঁটিয়া বাঁধিল, তৎপরে অতিবেগে, লম্ফ প্রদান পূর্ব্বক জলে পড়িল। অম্বুরাশি ঘোর কোলাহলে বিদারিত হইয়া ফেনময় উত্তাল তরঙ্গ তুলিয়া কূলে আহত হইল। সে ফেন, সে তরঙ্গ আবার ধীরে ধীরে মিশাইয়া গেল।
অনেক দূরে গিয়া বালিকা ভাসিয়া উঠিল। তখন, একবার মাথা নাড়িয়া, হংসীর মত দ্রুত সন্তরণ করিয়া চলিল। কুঞ্চিত, কৃষ্ণ, দীর্ঘ কেশভার সলিসংস্পর্শে ঋজু হইয়া, তরঙ্গের মৃদু মৃদু আন্দোলনে উঠিতে পড়িতে লাগিল। বালিকা অবলীলাক্রমে দ্রুত সন্তরণ করিয়া চলিল। একবার কুলের দিকে ফিরিয়া চাহিল না।
কূলে দাঁড়াইয়া সকলেই দেখিতেছিল। বালক খেলা ভুলিয়া, বিস্ময়বিস্ফারিত চক্ষে, প্রভাততপনালোকিত স্বর্ণশ্যাম জলে সেই অনাবৃত শ্বেত বাহুযুগলের অবিশ্রাম সঞ্চালন আর সেই কৃষ্ণকেশরাশির আন্দোলন দেখিতেছিল। স্নানকারী আর্দ্রবসনে তাহাই দেখিতেছিল, বস্ত্র তাহার অঙ্গেই শুকাইতেছিল। একএকজন একএকবার রঘুজীর প্রতি কটাক্ষপাত করিতেছিল।
রঘুজীর নিকটে আর কেহ ছিল না, সে একাই দাঁড়াইয়াছিল। দক্ষিণ হস্তে যষ্টির মধ্যভাগ ধারণ করিয়া, বামমুষ্টির মধ্যে যষ্টির অগ্রভাগ রাখিয়া, মুষ্টির উপরে চিবুক রাখিয়া, একদৃষ্টে সন্তরণমানা বালিকার প্রতি চাহিয়াছিল। ললাট, ভ্রূ, অতি ঘনকুঞ্চিত, চক্ষের দৃষ্টি অতি তীক্ষ্ণ। সে চক্ষে স্নেহের লেশ মাত্র ছিল না।
তারা সাঁতারিয়া অনেক দূর গেল। অবশেষে ফুলের কাছে গেল। একবার হাত বাড়াইয়া আবার হাত টানিয়া লইল,—হাতে বুঝি কাঁটা ফুটিল! আবার হাত বাড়াইল, এবারে ফুল ছিঁড়িল। ছিঁড়িয়া, সনাল, উৎফুল্ল, প্রস্ফুটিত রক্ত পদ্ম, দক্ষিণ হস্তে তুলিয়া ধরিল। তীরস্থিত দর্শকবৃন্দের মধ্যে বিস্ময়ের অস্ফুট ধ্বনি উঠিল, আবার সকলে ভাবিল, ফিরিয়া আসিতে পারিবে কি?
তারা ফুল ছিঁড়িল দেখিয়া রঘুজী আর দাঁড়াইল না, ধীরে ধীরে ফিরিয়া গেল। গমনকালে তাহার অধরপ্রান্তে ঈষৎ হাসির চিহ্ন লক্ষিত হইতেছিল, আবার একটু পরে সে ললাটের চিরপরিচিত অন্ধকার ফিরিয়া আসিল।
বোধ হয় এই রঘুজীর অপত্যস্নেহ! চলিয়া গেল, বালিকা ডুবিবে কি বাঁচিবে একবার ভাবিল না! বালিকা মরিলে তাহার হত্যা কাহাকে লাগিবে?
ফুল ছিঁড়িয়া বালিকা কূলের অভিমুখে ফিরিল। এবার আর সে অন্ধকার কেশরাশি দেখা গেল না, কেবল সেই বহুদূরবর্ত্তী, দুর্নিরীক্ষ্য, সুন্দর মুখমণ্ডলের উপর লোহিত তপনকিরণে জলবিন্দু মিশিয়া ঝলমল করিতে লাগিল। সন্তরণের তরে হস্তদ্বয় মুক্ত রাখিবার জন্য পদ্মমৃণাল দন্তে ধারণ করিল,—রাঙ্গামুখে রাঙ্গাফুল ফুটিল, কমলে কমল মিলিল!
তারা পাছে ডুবিয়া মরে, কি উপায়ে তাহাকে রক্ষা করা যাইতে পারে, কূলে দাঁড়াইয়া অনেকে সেই পরামর্শ করিতেছিল। ইহাদের মধ্যে শম্ভূজী প্রধান। তারাকে ফিরিতে দেখিয়া সে কহিল, যখন দেখিব তারা ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে, তখন তাহাকে ধরিয়া ডাঙ্গায় লইয়া আসিব। এই বলিয়া জলে ঝাঁপাইয়া পড়িল।
তাহার দেখাদেখি আরও পাঁচ সাত জন জলে পড়িল।
শম্ভূজী সকলের আগে আগে সাঁতার দিয়া চলিল। আর সকলে তাহার অনুবর্ত্তী হইল। অনেক দূরে গিয়া শম্ভূজী দেখিল, কমলমুখে জলদেবীর মত বালিকা চলিয়া আসিতেছে, কিন্তু মুখ পাণ্ডুবর্ণ, চক্ষু হীনজ্যোতি, হস্তদ্বয় কষ্টে সঞ্চালিত হইতেছে। শম্ভূজী সাঁতারিয়া তাহার পাশে গেল, কহিল, তারা, ধন্য তোর বল! কিন্তু আর ত তুই পারিবি না। এখন না ধরিলে ডুবিয়া যাইবি। আয় আমার হাতের উপর ভর দে, আমি তোকে কিনারায় লইয়া যাইতেছি।
তারার চক্ষু পূর্ব্বের মত জ্বলিয়া উঠিল, কিন্তু আবার তখনি নিভিয়া গেল। মুখের ফুল হাতে করিয়া কহিল—সে স্বর পূর্ব্বাপেক্ষা ক্ষীণতর, কিন্তু স্থিরপ্রতিজ্ঞ—তুমি আমায় বাঁচাইবে? লোকে বলিবে শম্ভূজী তারাকে রক্ষা করিয়াছে। আমি মরিলেও তোমার হাত ধরিব না, তোমাকে ছুঁইব না। তুমি আমাকে ধরিলেই ডুরিব। তুমিও মরিবে। আমার নিকটে আসিও না, সরিয়া যাও।
শম্ভূজী সরিয়া গেল। তারার পানে চাহিয়া দেখিল, এ এক নূতন রূপ। সে রূপ তাহার হৃদয়ে দৃঢ়রূপে অঙ্কিত হইয়া রহিল। দেখিল, মলিন মুখ, তবুও ভিতরে অনল জ্বলিতেছে। দেখিল, অতি স্বচ্ছ, শীতল, জ্যোতিহীন নয়নযুগলের মধ্যে, প্রজ্বলিত, তরল বিদ্যুদ্বহ্নি জ্বলিতেছে। সে জ্বলন্ত শিখা দেখিয়া শম্ভূজী পতঙ্গের সদৃশ অনিবার্য্য আকর্ষণে আকৃষ্ট হইল।
শম্ভূজী সরিয়া গেল বটে, কিন্তু একেবারে ফিরিয়া আসিল না। মগ্নমান ব্যক্তি তৃণ পাইলেও তাহা অবলম্বন করে, তারা প্রাণের দায়ে কি শম্ভূজীর হাত ধরিবে না?
আর কেহ তারার নিকটে যাইতে সাহস করিল না।
তারা অত্যন্ত পরিশ্রম সহকারে কূলের নিকট আসিল। হাত পা অবশ হইয়া পড়িল, আর চলে না, একবার ভাবিল ডাঙ্গায় আসিয়া বুঝি ডুবিলাম। যন্ত্রণার চক্ষু মুদ্রিত হইয়া আসিল। এমন সময়ে পায়ে মাটী ঠেকিল। তারা দাঁড়াইতে পারে ন।, চক্ষে অন্ধকার দেখিল, কর্ণরন্ধ্রে ঝাঁ ঝাঁ শব্দ শুনিল, তাহার পরে আর কিছু শুনিল না, কিছু দেখিল না। বালিকা চেতনা হারাইল।
সে কিনারায় আসিয়াছিল। অর্দ্ধ অঙ্গ বালুকায় প্রোথিত হইল। কটি পর্য্যন্ত জলে নিমজ্জিত রহিল। দৃঢ়নিমীলিত চক্ষে, মুখে, আর্দ্রকেশে বালুকা পূরিয়া গেল। আবিল, বালুকাময় তরঙ্গ বক্ষে লাগিল, আর একটা ঢেউ আসিয়া সে বালুকা ধৌত করিয়া লইয়া গেল। বদনবিচ্যুত রক্তসরোজিনী জলে ভাসিতে লাগিল।