পর্ব্বতবাসিনী/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
রঘুজী গৃহে ফিরিয়া গেল। তাহার বাটীতে একজন ভৃত্য ও এক দাসী। ভৃত্যের নাম মহাদেব, দাসীর নাম কেহ জানে না, সকলে তাহাকে মায়ী বলিয়া ডাকে। রঘুজী তাহাদিগকে বলিল, তারা বুঝি ডুবিয়া মরে, তোরা দেখিতে চাস্ ত যা।
মহাদেব বৃদ্ধ, মায়ি বর্ষীয়সী। দুজনেই রঘুজীর কথা শুনিয়া একেবারে হ্রদের দিকে ছুটিল। ওঠে কি পড়ে সে জ্ঞান নাই।
তারা রঘুজীর কন্যা। রঘুজী কন্যাকে মৃত্যুমুখে ফেলিয়া নিশ্চিন্তে ফিরিয়া আসিল। এক ভৃত্য আর এক দাসী, তাহারা তাহাকে রক্ষা করিবার জন্য প্রাণপণে ছুটিল।
তাহারা দুজনে এত দৌড়িল কেন? তাহারা তারাকে মানুষ করিয়াছিল।
তারা আশৈশব মাতৃহারা।
উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিতে ছুটিতে মায়ী কহিল, হায়, হায়, কোন দিন মেয়েটা অপঘাত মারা যাবে, আর আমি দেখিতে পাব না। এমন বাপের ঘরেও জন্মেছিল!
বলিতে বলিতে বুড়ী কাঁদিয়া ফেলিল। মহাদেব কহিল, এখন চুপ কর। মেয়েটা মরিল কি বাঁচিয়া আছে আগে দেখ তার পর না হয় কাঁদিও।
দুজনে হাঁপাইতে হাঁপাইতে গিয়া দেখিল, তারা কিনারায় উঠিয়া মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িল। মায়ী জানু পাতিয়া তাহাকে ক্রোড়ে তুলিয়া লইল।
ফুলটি ভাসিয়া যায় দেখিয়া একটা বালক সেটী তুলিয়া মায়ীর হাতে দিল।
শম্ভূজী জল হইতে উঠিয়া আসিয়া মায়ীর পার্শ্বে দাঁড়াইল। আবার সকলে মিলিয়া মূর্চ্ছিতা বালিকাকে ঘিরিল।
মায়ী তাহার মুদ্রিত চক্ষে হাত বুলাইয়া মহাদেবকে কহিল, এ যে অজ্ঞান হইয়াছে। ইহাকে বাড়ী লইয়া যাইব কেমন করিয়া?
মহাদেব বলিয়া উঠিল, কেন, আমি লইয়া যাইব। তারাকে আমি বুকে পিঠে করিয়া মানুষ করিলাম, আর তাহাকে এইটুকু লইয়া যাইতে পারিব ন!? তারা যে সে দিন পর্য্যন্ত আমার কাঁধে উঠিত।
মায়ী। তবে আর বিলম্ব করিও না। ঘরে লইয়া চল।
শম্ভূজী পাশ হইতে মহাদেবকে বলিল, আমি লইয়া যাইতেছি। আমি তোমার অপেক্ষা সবল আছি।
মহাদেব হস্তদ্বারা নিষেধ করিল। তাহার পর তারাকে দুই হাতে ধরিয়া তুলিল। তারার মস্তক মহাদেবের স্কন্ধে ঝুলিয়া পড়িল। লম্বিত কেশের মধ্যে বালুকাকণার উপর সূর্য্যরশ্মি পতিত হইয়া ঝিক্মিক্ করিতে লাগিল। মায়ী মহাদেবের পশ্চাৎ চলিল।
শম্ভূজী ভাবিতেছিল, লজ্জার উপর লজ্জা পাইতেছি, পদে পদে অপ্রতিভ হইতেছি। না জানি কাহার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছিলাম।
রঘুজী গৃহে নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়াছিল।