পর্ব্বতবাসিনী/ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ

ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ

 এতদিনে সব ফুরাইল, আশা ভরসা সব ঘুচিল, সব সাধ মিটিল। প্রণয় গিয়াছে আর গৃহসংসারে কাজ কি? যে পাখীর জন্য খাঁচা কিনিয়াছিলাম, সেই পাখীই উড়িয়া গিয়াছে। এখন আর পিঞ্জর লইয়া কি হইবে? রূপ বল, যৌবন বল, অর্থ বল, এ সব লইয়াও মানুষ বাস করে বটে। শুধু কি প্রণয় লইয়াই লোকে ঘর করে? না, তা নয়। অল্প বয়সে অনাথিনী হইয়াও ত বিধবা বনে যায় না। সংসারে তার কোন সুখই নাই, তবু ত সে সংসারেই থাকে। তবে তারার প্রকৃতি তেমন ছিল না। তাহার হৃদয়ে যে সময় যে আগুন জ্বলে তাহাতেই আর সব পুড়িয়া যায়। যখন প্রণয়ের রাজত্ব তখন আর সব দাহ হইতেছিল। প্রেম গেল ত আর কিছু পুড়িবার রহিল না। এখন কি পোড়াইবে? নিজে পুড়িবে?

 পাপের গরল চিন্তাকে তারা আপনার হৃদয়ে স্থান দিয়া ছিল। এখন তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। সংসারের সুখ ঐশ্বর্য্যে একেবারে জলাঞ্জলি দিল, ইহার কমে প্রায়শ্চিত্ত হইবে না। পাহাড়ে থাকা তাহার অভ্যাস, সেইখানে গিয়া একা রহিল।

 ঝঞ্ঝাবাত, প্রবল ঝটিকা দেখিলে ভয় হয়। মেঘগর্জ্জনে হৃৎকম্প হয়। বিদ্যুৎ চমকিলে প্রাণ চমকিয়া ওঠে, চক্ষু ঝলসিত হয়। সমুদ্রে তুফান অতি ঘোর দর্শন, উত্তুঙ্গ তরঙ্গমালা দেখিলে প্রাণ শুকাইয়া যায়। ঝটিকা গর্জ্জিতেছে, রুদ্ধ দ্বার বেগে আহত করিতেছে, গাছপালা ভাঙ্গিয়া, ফুল ছিঁড়িয়া ভীষণ কণ্ঠে চীৎকার করিতেছে, কখন সিংহগর্জ্জনে ধরাতল কম্পিত করিতেছে। সে হুহুঙ্কার শুনিলে প্রাণী ভীত হয়।

 আর এক প্রকার ঝটিকা আছে। সে ঝটিকার দৌরাত্ম্য কেহ দেখিতে পায় না, কেহ শুনিতে পায় না। সে ঝড় কোন কথা কয় না, কোন সাড়া দেয় না, কোন শব্দ করে না। সে ঝড় অন্ধকার করিয়া নিঃশব্দ পদসঞ্চারে আইসে। অন্ধকার, অন্ধকার, অন্ধকার! সেই ধোঁয়ান্ধকারে সে একা ভ্রমণ করে। সে মূক অন্ধ। বাহু প্রসারিত করিয়া ইতস্ততঃ বিচরণ করে। যাহাকে সম্মুখে পায় তাহাকেই নিঃশব্দে চূর্ণিত বিচূর্ণিতি করে। আবাব বক্র পদক্ষেপে ভ্রমণ করিয়া বেড়ায়। অন্ধকারে মেঘ গর্জ্জন করে না, বিদ্যুৎ প্রভা স্ফুরিত হয় না। কেবল অন্ধকার বাড়িতে থাকে, আর সেই অন্ধকারে সেই ভয়ঙ্কর ঝঞ্ঝা যাহা পায় তাহাই ধরিয়া চাপিতে থাকে। সে ঝটিকার অবসানে চাহিয়া দেখ, আর কিছু দেখিতে পাইবে না। যেখানে সুন্দর হর্ম্ম্যশোভিত নগরী দেখিতেছিলে সেখানে আর তাহার চিহ্ণমাত্র দেখিতে পাইবে না। যেখানে সহস্র জীবের আনন্দ কোলাহল শুনিতেছিলে সেখানে জীবনের কোন চিহ্ণ লক্ষিত হইবে না। যেখানে জনপদ সেখানে মরু, যেখানে মনোহর অরণ্যানী সেখানে বিশাল প্রান্তর, যেখানে কলরব সেখানে স্তব্ধতা, সেখানে স্রোতস্বতী সেখানে মরীচিকা দৃষ্ট হইবে।

 এ ঝটিকা বড় ভয়ানক।

 তারার হৃদয়ে এই ঝড় বহিয়াছিল।

 দুঃখের মধ্যে এই টুকুই সুখ। যাহার মস্তকে বজ্রাঘাত হয় তাহাকে আর কোন যাতনা ভোগ করিতে হয় না। সে কোন যন্ত্রণা অনুভব করে না। ঘোর আপৎকালে লোকে স্তম্ভিত হয়। অত্যন্ত প্রিয়জনের মৃত্যুতে লোকে বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়। তাহাতেই অনেক রক্ষা। তারা নিজের উপর রাগ করিয়া আসিয়াছিল। কেন রাগ করিয়াছিল, তাহা ভাবিতে গিয়া কিছু ঠিক পায় না। মন শিথিল, শরীর শিথিল, বুদ্ধি স্খলিত হইতে লাগিল। তাহার প্রাণের মধ্যে অতি বিস্তীর্ণ মরুভূমি ধূ-ধূ করিতে লাগিল। পর্ব্বতে ফলাহারমাত্র প্রাণধারণের উপায়। সব দিন ফল আহরণেও যাইত না। শরীর দিন দিন অবসন্ন, হীনবল হইয়া পড়িল। তারা ভাবিল, মৃত্যু নিকট।

 পাহাড়ে প্রভাতকালে পাখী ডাকিত, নির্ঝর কলকল রব করিয়া, চঞ্চল বেগে নীচে গড়াইয়া যাইত, প্রভাতপবনের স্পর্শে রজনীর মোহ ভঙ্গ হইত, মেঘ, সূর্য্যের কিরণ চুরী করিয়া, পর্ব্বতশিখরের কণ্ঠে বসিয়া, তাহাকে বিদ্রূপ করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইত। পর্ব্বতগুহার মুখে লতাপাতায় ফুল ফুটিয়া প্রভাত সূর্য্যালোকে হাসিত। মধ্যাহ্ণকালে পাতার আড়ালে বসিয়া বনবিহঙ্গিনী করুণ স্বরে গান করিত।

 সূর্য্য আলো করিয়া উদিত হয়, রক্তমুখে অন্ত যায়। পূর্ণিমার চন্দ্র ক্রমশঃ ক্ষীণ হইয়া অন্ধকারে লুকাইল, তাহাতে তারাগুলির মুখ আরও উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।

 আবার পূর্ণিমা আসিল। পবিত্র কিরণে পর্ব্বত ধৌত করিয়া চন্দ্র উঠিল। তারা কুটীরে বাহিরে বসিয়া একখণ্ড প্রস্তরে মস্তক রক্ষা করিয়া শূন্যমনে চাঁদের পানে চাহিয়া আছে। সে কি ভাবিতেছে? সে কি আপনার অদৃষ্টের কথা মনে করিতেছে? জীবনে কোথাও সুখ নাই, তাহাই ভাবিতেছে? না, তাহার সে ক্ষমতা নাই। দুঃখের ভাবনা ভাবা আরও দুঃখ। সেটী, তারার ঘটে নাই। চাঁদ উঠিল, তাহার হৃদয় আলোকিত হইল না। সে চাহিয়াই রহিল। চাঁদ মাথার উপরে উঠিতেছে, আবার পশ্চিমে হেলিয়া পড়িল, মেঘ ভাসিয়া যাইতেছে, কখন আকাশ প্রান্তে তারা খসিতেছে, কখন শুষ্কপত্রের পতন শব্দ, শৃগালরব, কখন পবনের মরমর সরসর নিশ্বাস, কখন ঝরণাপাতশব্দ, কখন নিশীথ প্রতিধ্বনি। তারা বসিয়া বসিয়া, শেষে শয়ন করিয়া চাহিয়া রহিল। কিছু দেখিল না, কিছু শুনিল না। শূন্যমনে, শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়াই রহিল। চন্দ্র পশ্চিমে গেল, বায়ু শীতল হইল, তারার একবার একটু শীত বোধ হইল, আবার সে চাহিয়াই রহিল। পরিশেষে তাহার চক্ষে নিদ্রা আসিল।

 সূর্য্যকিরণ স্পর্শে তাহার নিদ্রা ভঙ্গ হইল। শিশিরসিক্ত কেশে, মলিন মুখখানি তুলিয়া, তারা ভাবিল উঠিয়া কুটীর মধ্যে যাই। প্রভাত সূর্য্যের অলোক ভাগ লাগিল বলিয়া আর উঠিল না। ম্লানমুখে, শিশিরমুক্তাশোভিত কেশে, প্রভাতকালে কোন ম্লান কমলিনী তুল্য বসিয়া রহিল।

 সহসা তারা দেখিল সেই বিজন, মনুষ্যশূন্য স্থানে একজন লোক আসিতেছে। দূর হইতে মুখ চেনা যায় না, তবু তারার বুকের মধ্যে কেমন করিয়া উঠিল। দীর্ঘচরণবিক্ষেপে তারার কুটীরাভিমুখে কে চলিয়া আসিতেছে। আর কি চিনিতে বাকী থাকে?

 যষ্টি হস্তে, যষ্টির উপর ভর করিয়া গোকুলজী পর্ব্বতারোহণ করিতেছে!

বাণবিদ্ধ বিহঙ্গিনী তুল্য তারা কাতর চীৎকার করিয়া কহিল, এখানে, এখানেও আবার আসে কেন? যাহা ভুলিতে আসিয়াছি, আবার তাহাই মনে পড়িবে।

 গোকুলজী দ্রুত চলিয়া আসিতেছে, দেখিয়া তারা তাহাকে হস্ত দ্বারা ফিরিতে ইঙ্গিত করিল। গোকুলজী ফিরিল না। তখন, তারা যে প্রস্তরখণ্ডে মস্তক রক্ষা করিয়া নিশা যাপন করিয়াছিল, তাহাই দুই হস্তে জড়াইয়া প্রস্তরে মুখ লুকাইল।

 গোকুলজী আসিয়া কহিল, এ কি এ, তারা?

 তারা কহিল, যাও, যাও, তুমি এখানে কেন? এখান হইতে শীঘ্র চলিয়া যাও। আমি আর কাহারও সহিত দেখা সাক্ষাৎ করি না। তুমি এখান হইতে যাও।

 শীর্ণ শুষ্ক লতাজাল যেমন সহজে কোন বৃক্ষ হইতে উন্মোচিত করা যায়, গোকুলজী সেইরূপে তারার বাহুবন্ধন খুলিয়া তাহাকে আপনার বক্ষে ধারণ করিল। তারা মুমূর্ষুর মত কহিল, কি কর, আমাকে ছাড়িয়া দাও! তুমি যাও, যাও, এখানে কেন আসিয়াছ?

 গোকুলজী কহিল, শোন, একটা কথা শোন। তাহার পর সে তারার রুক্ষ কেশে শিশিরবিন্দু দেখিয়া কহিয়া উঠিল, তুমি কি সমস্ত রাত্রি হিমে বসিয়াছিলে? চল, আমার সঙ্গে বাড়ী চল।

 তারা গোকুলজীর আলিঙ্গন হইতে মুক্ত হইয়া একটু দূরে গিয়া বসিল। কহিল, গোকুলজী তুমি আমার নিকটে আসিও না। যাহা বলিবার হয় ঐখান হইতেই বল। আমি আর ঘরে ফিরিব না। সে কথা আমায় আর বলিও না।

 গোকুলজী। আমি তোমাকে সঙ্গে লইয়া যাইব বলিয়া আসিলাম, আর তুমি যাইবে না?

 তারা। না। আমি না যাই, তোমার তাতে ক্ষতি কি?

 গোকুলজী কহিল, আমার তাতে কি? তুমি না ফিরিলে আমার বাঁচিয়া কি সুখ? তোমাকে না পাইলে জীবনে সুখ কোথায়?

 ও কি কথা! তুমি গৌরীর সঙ্গে সুখে স্বচ্ছন্দে ঘর কর। আমার কাছে ও সকল কথা কি তোমার বলা উচিত।

 তারা, আজ তোমাকে অনেক কথা বলিতে হইবে, নহিলে তুমি বুঝিবে না। আর কাহাকেও সে সব কথা বলিবার নয়, কিন্তু তোমাকে বলিতেই হইবে। প্রণয় কি তাহা আমি আগে জানিতাম না। তোমাকে দেখিয়া অবধি, আমার প্রাণে নুতন আলোক আসিয়াছে। আমার প্রাণ তুমি একবার রক্ষা করিয়াছ। তোমাকে না পাইলে সে প্রাণে আমার কাজ কি?

 তারা মাথা নাড়িল।

 গোকুলজী আবার বলিতে লাগিল, তবে তোমায় খুলিয়া না বলিলে তুমি বুঝিবে না। গৌরী আমার ভগিনী।

 তারা চমকিয়া উঠিল। আগে অনেক কথা বুঝিতে পারিত না, এখন বুঝিল। আবার ভাবিল ভ্রাতা ভগিনীর সম্বন্ধ লুকাইবে কেন?

 শুন তারা। কলঙ্কের কথা বলিয়াই আমি এ সম্বন্ধ গোপন করিয়াছি। গৌরী আমার সহোদরা ভগিনী নয়। আমার পিতা কিছুদিন আর এক স্থানে গিয়া একেলা বাস করিতেন। সেই খানে গৌরীর জন্ম হয়। গৌরীর মাতার সহিত আমার পিতার বিবাহ হয় নাই। পিতা এ কথা অনেক দিন পরে আমার জননীকে বলিয়াছিলেন। মেয়েটী বড় কষ্ট পাইতেছে শুনিয়া মাতা মৃত্যুকালে আমাকে সব কথা বলিয়া যান। গৌরীর মাতা জীবিতা নাই। তাই আমি তাহাকে একটী আশ্রয় দিয়াছি। এখন বুঝিলে?

 তারা বুঝিল। কিন্তু ভাবিল, গোকুলজী আমায় যে ভালবাসে সে কেবল কৃতজ্ঞতার ফল। আমি ইহার একটু উপকার করিয়াছিলাম তাই সে আমার বিবাহ করিতে চাহিতেছে। প্রকাশ্যে কহিল, গৌরী যেন তোমার ভগিনী হইল। কিন্তু আমার সঙ্গে আর এ জগতের কোন সম্বন্ধ নাই। আমি সংসার পরিত্যাগ করিয়াছি।

 আমার সহিত ও কি তোমার কোন সম্বন্ধ নাই? নহিলে আপনার প্রাণ দিয়া আমার প্রাণ রক্ষা করিতে উদ্যত হইয়াছিলে কেন? সে ভয়ঙ্কর দিনে তুমি না থাকিলে কে আমার রক্ষা করিত? যে পাপিষ্ঠ আমার জীবন বিনাশে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, কে তাহার চেষ্টা বিকল করিল? তারা, আর তোমাকে ছাড়িয়া আমি থাকিতে পারিব না। তুমি আমার সঙ্গে না যাও, আমি তোমায় কখন পরিত্যাগ করিয়া যাইব না। আমি এখনও দুর্ব্বল, সকলে আমাকে এখানে আসিতে নিষেধ করিয়াছিল। আমি কাহারও কথা শুনি নাই। তুমি ত আমার মন জান না। যে দিন তোমাকে আমি প্রথম দেখিয়াছিলাম সেই দিন হইতেই আমার চিত্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। লোকে তোমার অনেক কুৎসা করিত, সকলে তোমায় বড় মন্দ বলিত বলিয়া আমি তোমার নিকটে আসিতাম না। দূরে থাকিতাম। সেই জন্য যখন এই স্থলে তোমার সহিত সাক্ষাৎ হয়, তখন তোমাকে মন্দ কথা বলিয়াছিলাম, তোমার কুটীরে অবস্থান করি নাই। তখন আমার হৃদয়ের ভিতর কি হইতেছিল, জান? আমার ভয় ছিল পাছে তোমার কাছে অধিকক্ষণ থাকিলে তোমাকে না ছাড়িতে পারি, পাছে তুমি আমায় তাচ্ছিল্য কর, উপহাস কর। লোক মুখে তোমার আচরণ শুনিয়া কতবার তোমাকে একেবারে ভুলিবার চেষ্টা করিতাম, কখন পারিতাম না। শেষে যখন শুনিলাম তুমি বিনা দোষে গৌরীর অপমান করিয়াছ, তখন ক্রোধে অন্ধ হইলাম। গৌরী নেহাত ভালমানুষ, কখনও কাহারও সহিত কলহ করে না, সেই জন্য আরও রাগ হইল। ক্রোধোপশম না হইতেই তোমাকে নিতান্ত কাপুরুষের ন্যায় অপমানিত করিলাম। তাহার পর মনের মধ্যে কি হইতেছিল, তা কি তুমি জান, তারা? মনে মনে আপনাকে কত ধিক্কার দিয়াছিলাম, বনের ভিতর প্রবেশ করিয়া তোমার মলিন মুখখানি স্মরণ করিয়া মরিতে ইচ্ছা হইয়াছিল, তা কি তুমি জান? পরে অন্ধকার হইলে আমি তোমার বাড়ীর চারিদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইয়াছিলাম, মনে করিয়াছিলাম, তোমার দেখা পাইলে তোমার পা ধরিয়া তোমার কাছে মার্জ্জনা চাহিব, তাহা হইলে আর তোমার রাগ থাকিবে না। বুকের ভিতর হু হু করিয়া জ্বলিতেছিল, তারা! তোমার দেখা না পাইয়া অস্থির হইয়া কোথায় চলিয়া গেলাম। শেষে দেখি পাহাড়ে গিয়া পড়িয়াছি। ভাবিলাম সেইখানে বেড়াইলে মনের জ্বালা একটু জুড়াইবে। এমন সময় বালকের রোদনশব্দ শুনিতে পাইয়া সেই দিকে গেলাম। সন্দেহ হইল কোন বালক পথহারা হইয়া একা কাঁদিতেছে। তাহার পর কি হইল, আমি জানি না। তুমি জান। বোধ হয় ডাকাতে আর কাহারও সন্ধানে ফিরিতে ফিরিতে ভ্রমবশতঃ আমাকেই মারিয়াছিল। তুমি আমার প্রাণদাত্রী, তুমি আমার রক্ষা করিলে। এখন আমি তোমাকে ছাড়িয়া একেলা ফিরিয়া যাইব?

 গোকুলজী তারার চরণের নিকট শয়ন করিয়া করতলে মস্তক ন্যস্ত করিয়া এই সব কথা বলিল।

 তারার চক্ষের আলোক অন্ধকারে মিশাইল। ধীরে কহিল, গোকুলজী, তুমি আমাকে বিবাহ করিবার বাসনা পরিত্যাগ কর। তোমার আমার মধ্যে নরক মুখ ব্যাদান করিয়া রহিয়াছে। আমি ঘোর পাপিষ্ঠা। শোন তুমি, শুনিয়া আমার নিকট হইতে পলায়ন কর। তুমি বলিতেছ, তস্করে তোমার প্রাণ হত্যা করিবার চেষ্টা করিয়া থাকিবে। শোন গোকুলজী, সে তস্কর আমি। স্বহস্তে আমি তোমার জীবনবিনাশে উদ্যত হই নাই, কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর পাতকে আর একজনকে নিয়োগ করিয়াছিলাম। সে কার্য্য উদ্ধার করিতে পারিলে তাহাকে বিবাহ করিতে স্বীকার করিয়াছিলাম। গোকুলজী, শ্রবণপথ রোধ কর, আমার দিকে চাহিও না। এইবার এ অপবিত্র স্থান পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন কর।

 গোকুলজী ধীরে ধীরে উঠিয়া, মৃদু মৃদু হাসিল। তাহার পর তারার দিকে চাহিয়া অতি মুক্ত কণ্ঠে কহিল, শোন তারা, সূর্য্য সাক্ষী, এই প্রকাণ্ড পর্ব্বত সাক্ষী! তুমি যেমন আছ, তেমনি আমি তোমাকে হৃদয়ের মধ্যে গ্রহণ করিব। তুমি যেমন দোষাশ্রিত আছ, তেমনি থাক। আমি তোমা হইতে ভাল চাহি না। একবার ছাড়িয়া তুমি যদি শতবার আমার হত্যা করিতে চাহিতে, তাহা হইলেও আমি তোমাকে প্রাণতুল্য ভাল বাসিব। তুমি আমার প্রাণদাত্রী। তোমা ব্যতীত আমার জীবনে সুখ নাই। তোমার ঘরে তুমি যাইবে চল। এস, তুমি আমার হৃদয়কে আলোকিত করিবে, এস।

 সূর্য্যের মুখ বড় উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।

 গোকুলজী তারাকে তুলিয়া, দৃঢ় আলিঙ্গন পূর্ব্বক তাহার যুখ চুম্বন করিল। তারা বাতকম্পিত পত্রবৎ থর থর কাঁপিতে লাগিল। তাহার মুখ গোকুলজীর বক্ষে ঢুলিয়া পড়িল। গোকুলজী সেই শীর্ণ, সুন্দর মুখ তুলিয়া আবার চুম্বিত করিয়া কহিল, তুমি অত্যন্ত দুর্ব্বল হ‍ইয়াছ। তোমার সে বল গেল কোথায়?

 তারা ক্ষীণ হাসি হাসিয়া উত্তর করিল, তুমিই বা কি হইয়াছ?

 গোকুলজী বলিল, আমি তবু তোমার চেয়ে ঢের সবল আছি। আর কিছু দিনে সারিয়া উঠিব। তখন তোমারও এ মুর্ত্তি থাকিবে না।

 তারা একটু খানি হাসিল।

 গোকুলজী কহিল, চল, তবে বাড়ী যাই।

 চল।

 দুইজনে পরস্পরের মুখ দেখিতে দেখিতে প্রভাত তপনালোকে পর্ব্বত হইতে নামিয়া চলিল।