পর্ব্বতবাসিনী/অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ

অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ।

 মহাদেব জন কতক লোকের সাহায্যে দুইজনকে তদবস্থায় গৃহে লইয়া গেল। তারা মূর্চ্ছিতা, গোকুলজী জীবন্মৃত। গোকুলজীকে নিজের ঘরে শয়ন করাইল। তারাকে তাহার ঘরে পাঠাইয়া দিল।

 লোকে সন্দেহ করিয়াছিল তারাই কোন উপায়ে গোকুলজীকে পর্ব্বতগহ্বরস্বরূপ সাক্ষাৎ মৃত্যুগ্রাসে নিক্ষেপ করিয়া থাকিবে। তারার অলৌকিক সাহস এবং পরের প্রাণরক্ষার জন্য এরূপ আত্মবিসর্জ্জন দেখিয়া তাহাদের সে সন্দেহ নিরাকৃত হইল। সে দৃশ্য তাহারা কখন ভূলিল না।

 গোকুলজীর পৃষ্ঠক্ষত দিয়া রক্ত বহিয়া তাহাকে আরও বলশূন্য এবং জীবনশূন্য করিয়া ফেলিয়াছিল, মহাদেব ক্ষতমুখ বন্ধ করিয়া শোণিতস্রাব রহিত করিল। অল্পে অল্পে গোকুলজীর চৈতন্যোদয় হইল।

 তারার মূর্চ্ছা দীর্ঘকাল ভঙ্গ হইল না। মানুষের শরীর, মন তার বাঁধা যন্ত্রের মত। তারার শরীরে, মনে এত আকর্ষণ পড়িয়াছিল, যে অন্য কেহ হইলে জীবন রক্ষা ভার হইত। তারা অনেকক্ষণ মূর্চ্ছিত রহিল।

 মূর্চ্ছাপগমে তারা চারিদিকে চাহিয়া, দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, গোকুলজী!

 নিকটে একজন দাসী শুশ্রূষায় নিযুক্ত ছিল, কহিল, গোকুলজী বাঁচিয়া আছে। একটু ভাল আছে।

 তার। আবার মূর্চ্ছিত হ‍ইল।

 অনেকক্ষণ পরে যখন তাহার উত্তমরূপ চৈতন্য হইল, তখন সে এত দুর্ব্বল যে শয্যা হইতে উঠিতে পারে না। সেই অবস্থায় মহাদেবকে ডাকাইল। মহাদেব আসিলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, গোকুলজী কেমন আছে?

 অনেক ভাল।

 বাঁচিবে ত?

 বাঁচিবে বই কি। সে জন্য তুই কোন চিন্তা করিস্ না। এখন উঠে হেঁটে বেড়া।

 তারা কহিল, বড় কাহিল বোধ হইতেছে। উঠিতে পারিতেছি না।

 শরীরের আর অপরাধ কি? ধন্য সাহস তোর! আজ তুই দেবতার কাজ করিয়াছিস্। তা, খেলে দেলেই কাহিল সেরে যাবে এখন।

 তারা আর একবার কহিল, না সারিলে যেন গোকুলজী না যায়।

 পাগল না কি! এখন কি গোকুলজীর নড়িবার শক্তি আছে? কেউ যদি তাকে নিতে আসে, তখন আমি যেতে দিলে ত!

 যেই তারা একটু বল পাইল, অমনি উঠিয়া গিয়া গোকুলজীর শয্যার পাশে বসিল। গোকুলজীর মুখ ম্লান, চক্ষু মুদ্রিত, অর্দ্ধচৈতন্যাবস্থায় শয়ান রহিয়াছে। সে তারাকে দেখিতে পাইল না, দেখিলে ও চিনিতে পারিত না। সে এ পর্য্যন্ত সম্পূর্ণ চেতনা প্রাপ্ত হয় নাই।

 দিন দুই পরে তারা গোকুলজীর শয্যাপার্শ্বে উপবিষ্ট রহিযাছে, এমন সময় অকস্মাৎ গৌরী সেই ঘরে প্রবেশ করিল। তাহাকে দেখিয়া তারার রাগ হইল, কহিল, এখানে কোন ভরসায় আসিয়াছিস্? তোর বুকে যে বড় বল দেখিতে পাই।

 গৌরী রাগিয়া কহিল, আমি তোমার বাড়ী আসি নি, তোমার কাছেও আসিনি। যাহার কাছে আসিয়াছি, সে ঐ শুইয়া রহিয়াছে।

 তারা দেখিল, গোকুলজী নিদ্রিত। সে নতচক্ষে কিয়ৎকাল ভাবিয়া, দাঁড়াইয়া উঠিয়া মনে মনে বলিল, আমারই ভুল। পাপের প্রায়শ্চিত্তের সময় আসিয়াছে। এই ভাবিয়া সেখান হইতে চলিয়া গেল।

 গৌরী আসিয়া গোকুলজীর পাশে বসিল।

 অল্পকাল পরেই তারা ফিরিয়া আসিয়া গৌরীকে বলিল, একবার পাশের ঘরে এস। তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।

 তারার কথার কিছু রাগ নাই, তবু গৌরীর তত সাহস হইল না। কহিল, কি বলিবে, এইখানেই বল, আমি আর কোথাও যাইব না।

 তারা ঘরে আসিয়া গোকুলজীর চরণের নিকট দাঁড়াইয়া, গৌরীকে নিকটে ডাকিয়া মৃদুস্বরে কহিতে লাগিল, তুমি আমাকে বড় মন্দ মনে কর, না? যথার্থ কথা। আমার মত পাপীয়সী আর ইহ জগতে নাই। সেই পাপের সাধ্যমত প্রায়শ্চিত্ত করিব। আমার এই বাড়ী তোমাদের দিয়া পাহাড়ে চলিলাম। এই ঘর দোর তোমাদের রহিল।

 গৌরী আকাশ হইতে পড়িল। ভাবিল, তারা পাগল হইয়াছে। কহিল, সে কি কথা! তোমার বাড়ী আমি নেব সে আবার কেমন কথা! তোমার বাড়ী তোমার ঘর, তুমি জন্ম জন্ম ভোগ কর, আমি কেন নিতে গেলাম? এমন অনাছিষ্টি কথাও মানুষে বলে!

 রা আবার কহিল, আমার কথা শোন। কোন উত্তর করিও না। গোকুলজী তোমাকে চায়, তুমি গোকুলজীকে চাও, আমি মাঝখানে কেন? আমার মন আমার বশে নয়। আমি এখানে থাকিলে তোমাদের সুখস্বচ্ছন্দের অনেক ব্যাঘাত জন্মিবে। আমি এ পাপ মন বশ করিব। সংসারে আমার আর কোন বন্ধন নাই। আমি পর্ব্বতে চলিলাম। সেখানে কোন জ্বালা নাই। যাবার সময় তোমাদের এই বাড়ী আর আমার বিষয় সম্পত্তি দিয়া চলিলাম। দিয়াই আমার সুখ, আমার এ টুকু সুখে বিঘ্ন ঘটাই ও না। গোকুলজীকে আমি বেশ জানি। তাহার কাছে মহাদেবের কোন কষ্ট হইবে না। মহাদেবের নিজের টাকাও আছে। তুমি ভাল করিয়া গোকুলজীর শুশ্রূষা করিও। বিবাহের সময় একবার আমাকে মনে পড়িবে ত? আমি চলিলাম। এই ধর।

 এই বলিয়া তারা গৌরীর হাতে এক গোছা চাবি দিল।

 গৌরীর মুখ কাঁদ কাঁদ হইল। সে অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে কহিল, তোমার বড় ভুল হইয়াছে, তারা। তুমি কি মনে করিতে কি মনে করিয়াছ। আমাদের বিবাহ কখন হবার কথা নয়। সব কথা যদি তোমাকে বলিবার হইত

 তারা আর দাঁড়াইল না।