পর্ব্বতবাসিনী/সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ।
তারা ফিরিয়া, শম্ভূজীর জন্য কিছুমাত্র চিন্তিত না হইয়া গ্রামমুখে ধাবিত হইল। কোন বাধা না মানিয়া, অনুল্লঙ্ঘনীয় স্থান সকল অতিক্রান্ত করিয়া, লতাপাতা ছিন্ন করিয়া, চরণে বিদলিত করিয়া বায়ুবেগে ছুটিল। তীক্ষ্ণ উপলখণ্ড চরণে বিদ্ধ হইয়া রক্ত ঝরিতে লাগিল, সর্ব্বাঙ্গে কণ্টক ফুটিতে লাগিল, তাহাতে সে ভ্রুক্ষেপ করিল না। একেবারে গৃহদ্বারে উপস্থিত হইল।
গৃহে প্রবেশ করিয়াই ডাকিল, মহাদেব, উঠ, উঠ!
মহাদেব ধড়মড় করিয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি হইয়াছে? কি হইয়াছে?
উঠ, উঠ, ভারি বিপদ। একজন লোকের প্রাণ যায়। তাহাকে রক্ষা করিতে হইবে।
মহাদেব অন্ধকারে হাতড়াইয়া চকমকি পাথর বাহির করিয়া অগ্নি উৎপাদন করিল। তাহার পর গন্ধকের কাঠি জ্বালিয়া প্রদীপ জ্বালিল। প্রদীপালোকে তারার মুখ দেখিতে পাইয়া কহিল, কি, ব্যাপারখানা কি? হয়েছে কি?
এখন বলিবার সময় নাই। একজন লোকের প্রাণ যায়, এখন বিলম্ব করিলে তাহার প্রাণরক্ষা হইবে না। সঙ্গে মোটা মোটা দড়ি কাছি যত পার লও। আরও জনকতক লোক ডাকিয়া আমার সঙ্গে এস। দেরি কোরো না।
কোথায় যাইতে হইবে?
আমি পথ দেখাইয়া লইয়া যাইব। কোন কথা জিজ্ঞাসা করিও না। মহাদেব প্রদীপ হাতে লইয়া দড়াদড়ী সংগ্রহ করিল। তারা দেখিয়া কহিল, ইহাতে কুলাইবে না।
মহাদেব বলিল, ঘরে ত আর নাই। যারা ক্ষেতে কাজ করে তাহাদের কাছে মোটা মোটা বড় বড় কাছি আছে।
চল, তাহাদের বাড়ী যাই।
বাড়ীতে যে দুই একজন লোক ছিল, তাহাদিগকে ডাকিয়া লইয়া, তারা ত্বরান্বিত হইয়া, কৃষকদিগের গৃহে গেল। মহাদেব বেগে গমন করিতে অসমর্থ হইয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে পিছাইয়া পড়িল। তারা চীৎকার করিয়া কৃষক পরিবারের নিদ্রাভঙ্গ করিয়া, রজ্জু ও সাত আট জন লোক লইয়া, পর্ব্বত গহ্বরাভিমুখে ফিরিয়া চলিল।
কন্দরে পৌঁছিতে আকাশ পরিষ্কার হইয়া আসিল, নক্ষত্র একে একে মিলাইয়া গেল, আকাশের নীলিমা উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। শুক্রতারার নিম্নে দুটী একটি কিরণাঙ্গুলিশীর্ষ দেখা দিল। যে কন্দরে গোকুলজী পতিত হইয়াছিল, তাহার মধ্যে কোথাও কোথাও বৃক্ষলতা, কোথাও কোথাও পা রাখিবার মত দুই একটা শিলাখণ্ড আছে। তাহাতে পতনশীল জীবের কিছুক্ষণ কালগ্রাস হইতে রক্ষা পাইবার সম্ভাবনা। গহ্বর অত্যন্ত গভীর, অতলস্পর্শ। ভিতরে একখও প্রস্তর নিক্ষেপ করিলে, উপরে পতনশব্দ শুনা যায় না।
কন্দরাভ্যন্তরে কুজ্ঝটিকায় সমুদয় আচ্ছন্ন রহিয়াছে। পঞ্চ হস্ত নীচে আর কিছু দেখা যায় না। কুজ্ঝটিকা নিম্ন হইতে ক্রমশঃ উপরে ঘনাইয়া উঠিতেছে।
তারা মুখ বাড়াইয়া নীচে চাহিয়া দেখিল।
শুভ্রবর্ণ কুজ্ঝটিকা পাকাইয়া পাকাইয়া উঠিতেছে, আর কিছু দেখা যায় না।
পূর্ব্বাকাশে শুক্রতারা মলিন হইতেছিল।
তারা ডাকিল, গোকুলজী, কোথায় আছ?
পার্শ্বস্থ লোকেরা গোকুলজীর নাম শুনিয়া শিহরিয়া তারার নিকট হইতে একটু সরিয়া দাঁড়াইল।
তারা আবার ডাকিল, অতি উচ্চকণ্ঠে ডাকিল।
কোন উত্তর নাই। হয়ত কুজ্ঝটিকা ভেদ করিয়া ক্ষীণ স্বর আসিতে পারিল না। হয়ত গোকুলজী আর জীবিত নাই।
তারা ফিরিয়া কহিল, দড়ী মজবুত করিয়া বাঁধ। কে নীচে যাইবে? সকলে নিরুত্তর রহিল।
তারা মনে মনে হাসিল। তাহার সেই ফুলতোলা মনে হইল। প্রকাশ্যে কহিল, শীঘ্র দড়ি বাঁধ। কোন চিন্তা নাই, আমিই নীচে যাইব।
যোজনা করিয়া রজ্জু বিলক্ষণ দীর্ঘ হইয়াছিল। রজ্জু লইয়া তারা আপনার কটিদেশে দৃঢ়রূপে বাঁধিল। তাহার পর বলিল, আর একগাছা রজ্জু প্রস্তুত কর। একগাছায় দুইজনের ভর সহিবে না। জীবিত হউক, মৃত হউক, আমি গোকুলজীকে তুলিয়া আনিব। না পারি, আমি আর উঠিব না। তোমরা দড়ি সামলাও। ভাল করিয়া ধর, আমি ঝাঁপ দিব।
সকলে মিলিয়া রজ্জুর অপর প্রান্তে একখণ্ড বৃহৎ প্রস্তর জড়াইয়া প্রাণপণে টানিয়া রহিল। তারা আর একবার নীচে চাহিয়া লাফাইয়া পড়িল।
শিথিল রজ্জুতে অতি বেগে আকর্ষণ পড়িল। তারা পর্ব্বতকন্দরগর্ভে ঝুলিতেছে!
যদি রজ্জু ছিঁড়িয়া যায়!
যাহারা উপরে দড়ী ধরিয়াছিল, তাহারা প্রস্তরখণ্ডে ভাল করিয়া দড়ী বাঁধিয়া, দুই তিন জনের হাতে সেই দড়ি দিয়া, গহ্বরের ধারে দাঁড়াইয়া ঘন ঘন নীচে চাহিয়া দেখিল।
কুজ্ঝটিকা চক্রীভূত, কুণ্ডলীভূত হইয়া, গড়াইয়া গড়াইয়া, জড়াইয়া জড়াইয়া, পাকাইয়া পাকাইয়া উঠিতেছে!
নীচে হইতে দড়ী চারিদিকে স্থানান্তরিত হইতে লাগিল।
তারা গোকুলজীকে অন্বেষণ করিতেছে।
রজ্জু শিথিল হইল।
কোন উপায়ে, হয়ত বৃক্ষমূল ধরিয়া তারা উপরে উঠিতেতেছে। গোকুলজীকে খুঁজিতেছে।
সূর্য উঠিল।
গ্রাম হইতে লোক ছুটিয়া আসিতেছে। কৃষকপত্নীরা সকলকে সংবাদ দিয়াছিল।
গহ্বরপার্শ্বে বিস্তর লোক দাঁড়াইল। পালা করিয়া তিন চার জনে দড়ী ধরিয়া রহিল।
রজ্জু বড় শিথিল হইয়াছে।
বোধ হয় তারা অনেক উপরে উঠিয়াছে।
সহসা অতি তীব্র চীৎকারধ্বনি উঠিল।
বহু দুরে নয়, অনেক নীচে নয়। যেন অল্প দূরে, বিংশ হস্ত নীচে সেই চীৎকার শ্রুত হইল।
তারা গোকুলজীকে দেখিতে পাইয়াছে? ভয় পাইয়াছে? তাহাকে সর্প দংশন করিয়াছে? মূর্চ্ছিত হইয়াছে?
সকলে ব্যগ্র চিত্তে দড়ীর দিকে চাহিয়া রহিল। দড়ী কোন সঙ্কেত করিল না। সুস্থির।
রৌদ্র বাড়িতে লাগিল। কুজ্ঝটিকাজাল তরল হইতে আরম্ভ হইল।
দড়ি সজোরে নড়িতে উঠিল। মহাদেব, সে সঙ্কেত বুঝিয়া আর এক গাছা রজ্জু ফেলিয়া দিল।
রজ্জু স্পন্দন রহিত হইল।
অনেক ক্ষণ পরে আবার দুই রজ্জু একত্রে স্পন্দিত হইল।
মহাদেব কহিল, এইবারে সকলে মিলিয়া দড়ী ধর। দুই দড়ী ভাল করিয়া পাথরে বাঁধ। তাহার পর আস্তে আস্তে তোল। হুড়াহুড়ি করিও না। জোরে টানিও না। দুই দড়ী এক সঙ্গে টান। ধীরে ধীরে।
কুজঝটিকা ক্রমে ক্রমে মিলাইয়া গেল।
তখন সকলে দেখিল, তারা নিম্নমুখী হইয়া সাবধানে দক্ষিণ হস্ত দ্বারা গোকুলজীর কটি রজ্জু ধারণ করিয়াছে। বামহস্তে বৃক্ষ, প্রস্তর ধরিয়া গোকুলজীর ও আপনার শরীর রক্ষা করিতেছে, যাহাতে অঙ্গে আঘাত না লাগে। গোকুলজীর মস্তক স্কন্ধে ঝুলিতেছে, দেখিতে মৃত প্রায়। নীচে অত্যন্ত অন্ধকার।
উপর হইতে ধীরে ধীরে টানিতে লাগিল।
যদি রজ্জ ছিঁড়িয়া যায়!
যাহারা দড়ী টানিতেছে, তাহাদের হস্ত হইতে যদি রজ্জু স্খলিত হয়!
যদি কটিবন্ধন খুলিয়া যায়!
সে সব কিছু হইল না। গহ্বরের মুখের সমীপবর্ত্তী হইলে সকলে মিলিয়া গোকুলজী ও তারাকে টানিয়া তুলিল।
দুইজনকে ধরিয়া বসাইল। দুইজনে পড়িয়া গেল। গোকুলজী নিমীলিতচক্ষু, শ্বাস প্রশ্বাস অনুভব করা যায় না; সর্ব্বাঙ্গ রুধিরাপ্লুত, পৃষ্ঠ দিয়া এখন ও অল্প অল্প রক্ত বহিতেছে।
তারা একদৃষ্টে গোকুলজীর দিকে চাহিয়াছিল। বাহিরে
আসিয়াও অন্য দিকে চাহিল না। গোকুলজীর পার্শ্বে পতিত হইয়া তাহার বক্ষের উপর দক্ষিণ হস্ত রাখিল। কিছু পরে, চীৎকার করিয়া মূর্চ্ছিতা হইল।
গোকুলজীর হৃদয়ের উপর তারার দক্ষিণ হস্ত স্থাপিতই রহিল।