পর্ব্বতবাসিনী/ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ

ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ।

 পশ্চিম গগনে অন্তগমনোন্মুখ সূর্য্যদেব সে পণ শুনিলেন। তিনি আর বিলম্ব করিলেন না। অন্ধকার পশ্চাতে দাঁড়াইয়াছিল, তাহাকে সম্মুখীন করিয়া দিননাথ মুখ লুকাইলেন। নিঃশব্দে সন্ধ্যা আসিল। তাহার অঞ্চল ধারণ করিয়া, আপনার অঞ্চলে নক্ষত্র পূরিয়া যামিনী আসিল। যেমন নিত্য আসে তেমনি আসিল। কৃষ্ণ চতুর্দ্দশী রাত্রি। চাঁদ উঠিল না। একটী, দুটী, তিনটী করিয়া তারা উঠিল,—ক্ষীণ, চঞ্চল জ্যোতি, ছোট ছোট মুখের মত, হারাণ মুখের মত, আশার আলোকের মত, চিরবাঞ্ছিত অস্পৃশ্য প্রিয়জনের মত। জন্মাবধি নক্ষত্র দেখিয়া আসিতেছি, কখন নক্ষত্র স্পর্শ করিতে পাইলাম না। বালকে যাহা দেখে তাহাই স্পর্শ করে, কিন্তু মানুষের এ সাধ কখন মেটে না। নক্ষত্রকুল জগতের পাপপুণ্যের অনন্ত সাক্ষী, তাহারা এ পৃথিবীর সব জানে, আমরা তাহাদের কিছুই জানি না।

 নক্ষত্রে যদি কথা কহিতে পারিত, কোটি বৎসর ধরিয়া কি দেখিয়া আসিতেছে, মনুষ্যের অগোচর মানব হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে নিহিত তথ্য সমূহ যদি বলিতে পারিত, তাহা হইলে ইতিহাসে আর মিথ্যা বলিত না। মানবচরিত্র লোকে কেবল কল্পনা করিত না, বহির্জগৎ, অন্তর্জগৎ এরূপ সংশয়ান্ধকারে আছন্ন রহিত না।

 যামিনী আসিয়া দাঁড়াইল। তুমি যেই হও না কেন, নিশাগমে তোমার স্পষ্ট বোধ হইবে যেন কে তোমার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। যখন দেখিবে রাত্রি আসিয়া তোমার গাত্রস্পর্শ করিল, অমনি সাবধান হইবে। মনে কোন পাপ চিন্তা আছে? সাবধান, তবে সাবধান! দেখিও যেন রাত্রির পরামর্শে মনোভাব কার্য্যে না পরিণত হয়। প্রদীপ জ্বাল, দ্বার রুদ্ধ কর, নিশীথে কদাচ একাকী বাহির হইও না। বিবেচনাশূন্য হইয়া রজনীর ক্রোড়ে কখন ঝাঁপ দিও না। সে তোমাকে ক্রোড়ে লইবে, অঙ্গে কোমল, সুশীতল হস্ত বুলাইবে, সুবুদ্ধিকে ঘুম পাড়াইবে, দুর্বুদ্ধিকে জাগাইয়া রাখিবে।

 তুমি বিষণ্ণমুখি, অভাগিনি, রাত্রিকালে মাথায় হাত দিয়া একেলা বসিয়া ভাবিও না। ছি! উঠ, ঘরে যাও, রাত্রিকালে একান্তে এরূপ একাকিনী বসিয়া থাকিও না। কেহ কিছু মন্দ বলিয়াছে? সে আবার ভাল কথা বলিবে। তুমি কাহার কাছে মনের কথা বলিতেছ? সর্ব্বনাশ! এমন রাত্রির কাছে এমন দুঃখের কথা! অন্ধতমসী নিশি কি তোমাকে চক্ষের জল মুছিতে বলিবে, সে কি তোমায় আশ্বাস প্রদান করিবে? সে কি বলিবে, জান? সে বলিবে নারীজন্মে অনন্ত দুঃখ, তোমার এ দুঃখ ইহজন্মে ঘুচিবে না। সূর্য্যের আলোক দুঃখময়। তুমি আলোকরাজ্য হইতে পলায়ন কর। আমার সঙ্গে আইস, আমি তোমাকে অনন্ত অন্ধকারে, সুবিস্তীর্ণ নিশারাজ্যে লইয়া যাইব। সে অন্ধকারে তারকা নাই। সেখানে আর তোমাকে এ দুঃখ ভোগ করিতে হইবে না, এ যন্ত্রণাজ্বালা চিরদিনের মত ঘুচিবে। ঘরে একটু দড়ী নাই? না থাকে বস্ত্রের অঞ্চল ত আছে। রাত্রে মরিও না, লোকে আমার নিন্দা করিবে। সূর্য্যালোকে, নিভৃতকক্ষে, গলায় ফাঁস দিও, আমি তোমায় রাত্রিকালে আসিয়া লইয়া যাইব।

 পা টিপিয়া টিপিয়া শোণিতাক্ত কলেবরে, ঘূর্ণিত আরক্ত চক্ষে, পাণ্ডুর অধরে নরহত্যাকারী যাইতেছে। মনে করিতেছে, যামিনীই আমার পরম হিতকরী। লুকাও, লুকাও, নক্ষত্রের মুখ ঢাক, পথঘাট অন্ধকারে আচ্ছন্ন কর, আমি তোমার আশ্রয় লইয়াছি। তোমার কৃপায় পলায়ন করিব। হস্তে শোণিত লিপ্ত রহিয়াছে। জল পাইলেই হস্ত প্রক্ষালন পূর্ব্বক আবার পলাইব। কেহ আমাকে ধরিতে পারিবে না, কেহ আমাকে বিচারালয়ে নীত করিবে না। প্রভাতকে নিকটে আসিতে দিও না। তোমার জয় হউক, ধরাতলে তোমার অনন্ত রাজ্য স্থাপিত হউক! মূর্খ! পাপে তোমার চিত্ত ভ্রষ্ট হইয়াছে। আজ যে রজনীর গুণগান করিতেছে, কাল সেই রজনীকে ভয়ে পরিত্যাগ করিতে হইবে। আজ রজনী কিছু বলিতেছে না, কাল তোমায় বিভীষিকা দেখাইবে। কাল তোমার মনের মুকুরে ভীষণ অন্ধকারময় মূর্ত্তি সমূহ প্রতিবিম্বিত করিবে, কাল তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আরম্ভ হইবে। মানুষে দেখুক আর নাই দেখুক, রাজদণ্ডে দণ্ডিত হও আর নাই হও, নিশীথের নির্যাতন এড়াইতে পারিবে না। সহস্র বৃশ্চিক তোমায় দংশিতে থাকিবে। রজনীর অন্ধকার পটে, পরিণামের চিত্র, নরকের চিত্র দেখিতে পাইবে। নিশীথে যমদূতগণ তোমাকে ধরিবার জন্য কৃষ্ণবর্ণ হস্ত প্রসারিবে। তখন সূর্য্যের আলোকের জন্য লালায়িত হইবে, রাজদণ্ডও সুখের বোধ হইবে।

 এ আবার কে? দেখ, দেখ! ইহার মনে কোন খল কপট নাই। কোন পাপ ইচ্ছা নাই, ধনমানের আশা নাই, বশ মর্য্যাদার প্রার্থী নয়। একমনে, তন্মনা হইয়া আকাশের দিকে চাহিয়া রহিয়াছে। তারা গণিতেছে? না, তাহার হাতে যে বাঁশী আছে, তাহার কোলে বীণা রহিয়াছে। শোন, নিশীথ বংশীধ্বনি! কদম্বমূলে নিশীথেই বাঁশী বাজিত না—যখন যমুনা উজান বহিত? ওই শোন, আকাশে নক্ষত্র অবনত মস্তকে শুনিতেছে, পৃথিবীতে ফুল মাথা তুলিয়া তাহাই শুনিতেছে, সুপ্ত শিশু স্বপ্নে সেই মধুর ধ্বনি শ্রবণ করিয়া হাসিতেছে। আবার দেখ, বীণা তুলিয়া লইল। বীণার তারে নক্ষত্রকে নক্ষত্রের সহিত বাঁধিতেছে, ফুলকে ফুলের সহিত বাঁধিতেছে, হৃদয়কে হৃদয়ের সহিত বাঁধিতেছে। তাহার পরে অঙ্গুলির আঘাত বীণায় ঝঙ্কার দিয়া গায়িল, ‘সব মিশিয়া যাও, কেহ দূরে থাকিও না। সকলে মিলিয়া একসুরে গান গাও। সব এক, দুই কিছু নয়।’ যামিনী সস্নেহে নক্ষত্রহীরকখচিত স্বপ্নবিজড়িত নীল অঞ্চলে তাহার মস্তক আবৃত করিয়াছে।

 জ্ঞান চাও? বিশাল বিশ্বের আয়তন পরিমিত করিতে চাও? শতসূর্য্য তুল্য এক এক নক্ষত্রের ব্যাস, পরিধি জানিতে চাও? সৃষ্টির কতদূর পর্য্যন্ত প্রসার; বিশ্বের পর বিশ্ব; এক সৌরজগতের পর আর এক সৌরজগৎ, পরিদৃশ্যমান ব্রহ্মাণ্ডের পর নিহারিকারূপী অনুমিত ব্রহ্মাণ্ড; যেখানে অন্ধকার অসঙ্কোচে বিচরণ করিতে পারে না, আলোকের পদক্ষেপ শ্রবণ করিয়া ভীত হইয়া পলায়ন করে? আবার এই বিশ্বক্ষেণের পতিত ভূমি স্বরূপ চিরান্ধকার অরাজক স্থান কল্পনা করিতে চাও; যেখানে নিয়ম নাই, সমুদয় বিশৃঙ্খলাময়, যেখানে অনু, সূক্ষ্মানু, পরমাণু কখন আশ্লিষ্ট হয় না, অন্ধকারে অবিচ্ছিন্ন বিলোড়িত হইতে থাকে, যেখানে সৃজনের অপূর্ব্ব মন্ত্র কখন উচ্চারিত হয় নাই? কল্পনাকে অভিভূত করিতে চাও? মনুষ্যত্বের গৌরব বর্দ্ধিত করিতে চাও? এই সময় তবে এই সময়। দেখ দেখি, নক্ষত্রে কিছু সাহায্য করে কি না? মৃত্তিকাময় কীটানুকীট ক্ষুদ্র মানব নক্ষত্রের সহিত কোন সম্বন্ধ রাখে কি না? বিশ্বকাব্যপ্রণেতার গ্রন্থ পাঠ করিতে চাও? এই সময় তবে এই সময়।

 রজনী গভীরা হইতেছে, স্তরের উপর অন্ধকার স্তর নামিতেছে, অন্ধকার ঘনীভূত হইতেছে। তারা কোথায়?

 প্রতিশোধানল কর্ত্তৃক উত্তেজিত হইয়া সে গোকুলজীর প্রাণ হননে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিল। শম্ভূজী তাহার চক্ষে অতিশয় ঘৃণার পাত্র, তথাপি সে অসঙ্কোচে তাহাকে পাণিপ্রদানে সম্মত হইল।

 অথচ সে গোকুলজীকে প্রাণের অধিক ভাল বাসিত।

 এই কি সেই ভালবাসার ফল? গোকুলজী কর্ত্তৃক অপমানিত হইয়া তাহার প্রাণবিনাশে উদ্যত হইল?

 ইহাই নিয়ম। যাহাকে ভাল বাসি তাহার একটী কথাও সহ্য করা যায় না। প্রণয়ের অপমানে যত ক্রোধ হয় এত আর কিছুতে নয়। তারার হৃদয়ের মধ্যে অগ্ন্যুদ্গারী পর্ব্বত লুক্কায়িত ছিল, গোকুলজীর হৃদয়ভেদী অবমাননায় সে পর্ব্বত জ্বলিয়া উঠিল, তরলবহ্নিপ্রবাহে তারা স্বয়ং দগ্ধ হইল, সেই অগ্নিস্রোতে গোকুলজীকে দগ্ধ করিবার উপক্রম করিল।

 সন্ধ্যা হইলে তারা ভাবিতে বসিল। মহাদের বুঝাইতে আসিলে তাহাকে ইঙ্গিত দ্বারা নিষেধ করিল। আবার ভাবিতে বসিল, কিছু ভাবিতে পারিল না। আপাদমস্তক কেবল প্রজ্বলিত অগ্নি জ্বলিতে লাগিল।

 রাত্রি হইয়া আসিল। তারা কাহারও সহিত বাক্যালাপ করিল না। জ্বলিতে, পুড়িতে, ভাবিতে লাগিল।

 আরও রাত্রি হইল। মহাদেব আহারের জন্য ডাকিতে আসিল। তাহাকে তারা ধমক দিল। সে চলিয়া গেল।

 তারা গৃহের বাহিরে আসিল। নিশীথের শীতল পবন তাহার ললাট, কপোল স্পর্শ করিল। সে ভাবিতে লাগিল।

 ভাবিতেছিল, গোকুলজী আমার দারুণ অপমান করিযাছে। আমি তাহার প্রাণ লইব। তাহা হইলে আর কেহ কখন আমার অপমান করিবে না। গৌরী কাঁদিবে, তাহার সে অশ্রুমুখ দেখিলে আমার প্রাণ শীতল হইবে। শম্ভূজী আমার ভর্ত্তা হইবে? তা হইলেই বা? সে যে গোকুলজীকে হত্যা করিবে, তাহার হস্ত যে নরশোনিতে কলুষিত হইবে! তাহাতে তাহার অপরাধ কি? আমিই ত তাহাকে সে কর্ম্মে নিযুক্ত করিয়াছি। আচ্ছা, গোকুলজী মরিলে আমার কি লাভ? লোকে নিশ্চয় আমাকে সন্দেহ করিবে, মনে করিবে আমি তাহাকে হত্যা করিয়াছি। লোকের যাহা ইচ্ছা হয় মনে করুক না কেন, আমার তাতে কি? লোকের জন্য যেন নাই ভাবিলাম, নিজের জন্য ভাবিতে হয় ত। গোকুলজীকে মারিলে পরে কি আমার মনে কষ্ট হইবে না? এখনি যখন সাত পাঁচ ভাবিতেছি, তখন না জানি কত মনকষ্টই ভোগ করিতে হইবে। তাহাকে মারিয়া কি হইবে? সে বাঁচিয়া থাকুক, অন্য কোন উপায়ে এ অপমানের শোধ তুলিব। দূর ছাই! মিছে এ ভাবনা কেন? গোকুলজীকে কে বধ করিবে? শম্ভূজী? ভাল হাসির কথা! শৃগালে সিংহ বধ করিবে! কি জানি, বলা যায় কি? যদি কোন কৌশলে অকস্মাৎ তাহার প্রাণনাশ করে তা ত পারে। যদি নিদ্রিতাবস্থায় তাহার কুটীরে প্রবেশ করিয়া তাহার গলায় ছুরী বসাইয়া দেয়। কেন শম্ভূজীকে এমন কথা বলিয়াছিলাম? সে হাসিতে হাসিতে রক্তমাখা হস্তে আমাকে আলিঙ্গন করিবে! তাহার অপেক্ষা গোকুলজীর কাছে শতবার অপমানিত হওয়া ভাল। নরহন্তার সহধর্ম্মিনী, নরহত্যাপাপভাগিনী! জীয়ন্তেই আমাকে যমদূতগণ পীড়ন করিবে। শম্ভূজী কোথায়? একবার তাহাকে খুঁজিলে হয় না? সে ত বলিয়াছে আজ রাত্রেই গোকুলজীকে হত্যা করিবে। বোধ হয় আজ পারিবে না। তাহার সহিত যদি দেখা হয় ত তাহাকে নিষেধ করিয়া দিব।

 রাত্রি দ্বিপ্রহর অতীত হইয়াছে। তারা শঙ্কাশূন্য হৃদয়ে অন্ধকার রজনী মধ্যে একাকিনী বিচরণ করিতে লাগিল।

 কোথায় যাইবে? শম্ভূজীকে কোথায় অন্বেষণ করিবে?

 শম্ভূজীর গৃহে? সেখানে ত সে নাই!

 ভীলপুরের পথে? সেই ভাল, কিন্তু সাক্ষাৎ হইবার সম্ভাবনা কি?

 অন্ধকার রজনী। বসন্তকাল। আকাশময় তারকা। শীতল পবন মন্দ মন্দ সঞ্চালিত হইতেছে। নিরবচ্ছিন্ন ঝিল্লীরব। গাছগুলা দীর্ঘকায় অন্ধকারের মত দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তলায় রাশি রাশি শুষ্ক পত্র পড়িয়া রহিয়াছে। তাহারি মধ্য দিয়া অপ্রশস্ত পথ।

 তারা মন্দগমনে চলিল। ভয়ে নহে। শম্ভুজীর সহিত সাক্ষাৎ হইবার আশা অল্প।

 শুষ্ক বৃক্ষপত্রের মধ্যে কি খস্ খস্ করিয়া উঠিল। নিশাচর সর্প? তারা সরিয়া দাঁড়াইল।

 কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া আবার দাঁড়াইল। কোথায় যেন শব্দ শুনিতে পাইল।

 অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল, আর কোন শব্দ শোনা যায় না।

 অনর্থক দাঁড়াইয়া কি হইবে? আবার চলিতে লাগিল, চলিতে চলিতে ভাবিতে লাগিল। ভাবিতে ভাবিতে পথ হারাইয়া গেল। অনিশ্চিত গতিতে এদিক সেদিক ভ্রমণ করিতে লাগিল।

 রাত্রি তৃতীয় প্রহর অতীত হইল। ঝিল্লীরব আর তেমন শোনা যায় না। বাতাস আর একটু শীতল হইল, আর একটু খর বহিল। বৃক্ষতলে বৃক্ষপত্র মধ্যে খদ্যোতিকা ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল।

 তারা উপরে চাহিল। দেখিল উত্তর পশ্চিম কোণ হইতে একখণ্ড কৃষ্ণবর্ণ মেঘ উঠিতেছে। দেখিতে দেখিতে মেঘখণ্ড তারার মস্তকের উপর আসিল; তাহার বোধ হইল যেন সে মেঘ আকাশের মধ্যে স্থির হইল।

 তাহার মনে বড় ভয়ের সঞ্চার হইল।

 চারিদিকে চাহিয়া বুঝিল, পথ হারাইয়া গিয়াছে। কোথায় আসিয়াছে, ভাল বুঝিতে পারিল না।

 অকস্মাৎ যেন দূর হইতে মনুষ্যকণ্ঠ শ্রুত হইল।

 তখনও সেই কৃষ্ণমেঘ তাহার মস্তকের উপর অন্ধকার করিয়া রহিয়াছে।

 তারা সভয়ে কহিল, এখানে কোন মনুষ্য আছে?

 কোথাও কিছু না। কেবল গভীর স্তব্ধতা।

 সম্মুখে পর্ব্বতের অস্পষ্ট রেখা দেখা যাইতেছে। মাথার উপর অন্ধকার বলিয়া ভাল দেখা যায় না।

 আর একবার বলিল, কেহ আমার কথা শুনিতেছে?

 একটা পেচক কর্কশ কণ্ঠে উত্তর দিল। নিশীথের শ্রবণে সে কর্কশ স্বর ভীষণ শ্রুত হইল।

 মেঘখণ্ড ধীরে ধীরে সরিয়া গেল।

 তখন তারা স্পষ্ট দেখিতে পাইল, অতি নিকটে নিম্ন গিরিশ্রেণী রহিয়াছে। বুঝিল যে সে স্থান গ্রামের আর এক প্রান্তে স্থিত। সেখান হইতে তাহার গৃহ অধিক দূর নয়।

 সহসা অতি বিকট কাতর চীৎকার শ্রুত হইল। চীৎকার ধ্বনি পর্ব্বত গহ্বরে পুনঃ পুনঃ প্রতিধ্বনিত হইয়া নিশীথের গর্ভে ডুবিয়া গেল।

 আবার চারিদিক ভয়ানক নিস্তব্ধ।

 তারার মনে দারুণ সন্দেহ জন্মিল। সাহসে ভর করিয়া যে দিকে চীৎকার শুনিয়াছিল, সেই দিকে অগ্রসর হইল।

 বিপরীত দিক হইতে অন্ধকারে আর এক মনুষ্য মূর্ত্তি অগ্রসর হইতে লাগিল। অবশেষে সম্মুখবর্ত্তী হইল।

 শম্ভূজী?

 তারা!

 এখানে?

 তুমি এখানে?

 কাহার অনুসন্ধানে?

 তোমার।

 সংবাদ কি?

 তুমি আমার।

 এই বলিয়া শম্ভূজী বাহু প্রসারিত করিয়া তাবাকে আলিঙ্গন করিতে আসিল। তারা লম্ফ দিয়া আর এক দিকে দাঁড়াইয়া কহিল,

 এখন নয়। কাহার চীৎকার শুনিলাম?

 যে তোমাকে অপমান করিয়াছিল, তাহার।

 সে কোথায়?

 পর্ব্বতগহ্বরে। সে আর এখন চীৎকার করিবে না।

 তারা পুনর্ব্বার লম্ফ দিয়া দুই হস্তে শম্ভূজর বাহুর উপরিভাগ দৃঢ়রূপে ধরিয়া চীৎকার করিয়া কহিল, কি? সত্য কথা?

 সত্য কথা। চীৎকার কর কেন? যদি কেহ শুনিতে পায়; হাত অত চাপিও না, লাগে।

 সে কোথায় আছে? কতদূরে? তারা মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল।

 গহ্বরের মুখ অতি নিকটে। সে বহুদূরে, ধরণীগর্ভে।

 আমাকে সেই স্থানে লইয়া চল।

 সেখানে গিয়া কি হইবে? কিছু ত দেখিতে পাইবে না। রাত শেষ হইল, চল বাড়ী যাই।

 তা হউক। বাড়ী খুব কাছে। তুমি আমাকে আগে সেই স্থানটা দেখাও।

 শম্ভূজী তারাকে পথ দেখাইয়া চলিল। পথিমধ্যে তারা কহিল, যাহা যাহা ঘটিয়াছে, সব বল।

 সে অনেক কথা। বিবাহের পর বলিব।

 তুমি এখনি বল। দাঁড়াইয়া শুনিব।

 তবে শুন। তোমার নিকট হইতে বিদায় হইয়া গৃহ হইতে এক তীক্ষ্ণ ছুরিকা ল‍ইলাম। তাহার পর ভীলপুরের পথে অতি বেগে ধাবিত হইলাম। সে পথে গোকুলজী থাকিলে নিঃসন্দেহ তাহার সহিত দেখা হইত। অর্দ্ধেক পথ চলিয়া তাহাকে দেখিতে না পাইয়া ফিরিয়া আসিলাম। আসিতে অন্ধকার হইল। তোমার বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া দেখি গোকুলজী প্রচ্ছন্নভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। সাহসটা একবার দেখ! বোধ হয় তোমাকে আরও কিছু অপমান করিবার অভিপ্রায় ছিল। সেখানে তাহাকে মারিতে সাহস হইল না। একে ত ছুরী লইয়াও তাহার সম্মুখে যাওয়া সহজ নয়, আবার তাহাতে চারিদিকে লোকজন থাকে, চীৎকার করিলে অনেক লোক জড় হইবার সম্ভাবনা। এই রূপ নানা কথা ভাবিতেছি, এমন সময় সে এই দিকে আসিল। আমিও তাহার অনুসরণ করিলাম। এখানে আসিয়া দেখিলাম এমন সুবিধা আর হইবে না। হয় মারিব, না হয় মরিব। আর কেহ দেখিবে না। অনেকক্ষণ কোন সুবিধা হইল না। সে চারিদিকে ঘুরিতে লাগিল, অলক্ষ্যভাবে তাহার পার্শ্ববর্ত্তী হইতে পারিলাম না। অবশেষে আমি একটা কন্দরের নিকটে বসিয়া বালকের মত মৃদু মৃদু রোদন করিতে লাগিলাম। গোকুলজী দ্রুতপদে আমার নিকটে আসিল। ধীরে ধীরে তাহার পশ্চাতে গিয়া পৃষ্ঠে ছুরী বিদ্ধ করিলাম। যেমন ফিরিরা আমার হাত ধরিবে, অমনি ঠেলা মারিয়া তাহাকে পর্ব্বত কন্দরে নিক্ষেপ করিলাম।—এই জায়গাটা।

 গহ্বরের মুখ হইতে হাত দশেক অন্তরে দাঁড়াইয়া শম্ভূজী অঙ্গুলি দ্বারা স্থানটা নির্দ্দেশ করিয়া দিল। তাহার পর হাসিয়া কহিল, তারা, আমাদের বিবাহ হইবে কবে?

 তারা তৎক্ষণাৎ কহিল, এই দণ্ডে, এই মুহূর্ত্তে।

 এখন তামাসার সময় নয়। এইমাত্র একটা খুন করিয়াছি।

 তামাসা নয়। সত্যই বলিয়াছি।

 শম্ভূজী অস্ফুট আলোকে তারার মুখ দেখিয়া বুঝিল, বিদ্রূপ নয়। বুঝিয়া এক এক পা করিয়া পিছাইতে লাগিল।

 তারা দীর্ঘ চরণক্ষেপে শম্ভূজীর পার্শ্বে আসিয়া তাহার হস্ত লৌহমুষ্টিতে ধারণ করিয়া কহিল, মূর্খ, পলাও কোথায়? আইস, বিবাহ করিবে। এই বলিয়া তাহাকে পর্ব্বতকন্দরের মুখের দিকে টানিয়া লইয়া চলিল।

 শম্ভূজী ভীত হইয়া কহিল, সে কি? আমায় কেন টানাটানি করিতেছ?

 বিবাহের জন্য। যেখানে গোকুলজী গিয়াছে সেইখানে আমাদের বিবাহ হইবে।

 বিদ্রূপ মন্দ নয়। আমার সঙ্গে কি এই বিবাহের পণ করিয়াছিলে?

 নরক সাক্ষী করিয়াছিলাম। চল, আমরা নরকে যাই। আমরা অক্ষয় নরক ভোগ করিব।

 আমার এমন বিবাহে কাজ নাই। আমাকে ছাড়িয়া দাও, আমি তোমাকে বিবাহ করিতে চাহি না।

 শুন, শম্ভূজী। তুমি যখন আমাকে প্রথমে বিবাহ করিতে চাহিয়াছিলে, তখন আমার হাতে কাঁটা বিধিয়া রক্ত পড়িয়াছিল। তখন আমি কিছু বুঝিতে পারি নাই। এখন বুঝিতে পারিতেছি। শোণিত স্রোতেই আমাদের বিবাহ হইবে। সে সময় আসিয়াছে। সর্পিণীর গরল নিশ্বাসের ন্যায় এ কথা শম্ভূজীর কর্ণে লাগিল।

 গহ্বরমুখে এবং তারা ও শম্ভূজীর মধ্যে তিন হাত মাত্র ব্যবধান রহিল।

 শম্ভূজী প্রাণের দায়ে টানাটানি আরম্ভ করিল। গৃধিনীর চঞ্চুর মধ্যে ভুজঙ্গ যেমন ছট্‌ফট্ করে, সেইরূপ ছট্‌ফট্ করিতে লাগিল। তারা এক অঙ্গুলি পশ্চাতে সরিল না, অল্পে অল্পে শম্ভূজীকে টানিয়া লইয়া অগ্রসর হইতে লাগিল। শম্ভূজী প্রাণভয়ে কাতর আর্ত্তনাদ করিতে লাগিল।

 আর একপদ অগ্রসর হইলেই গহ্বরে পতিত হয়, এমন সময় গহ্বরের মধ্য হইতে অতি ক্ষীণ শব্দ হইল, রক্ষা কর!

 প্রতিধ্বনি? না আশার ছলনা?

 তারা মুখ নত করিয়া তীব্র কণ্ঠে কহিল, গোকুলজী, তুমি কি জীবিত আছ?

 তারা কাণ পাতিয়া কহিল। অনেক ক্ষণ কিছু শোনা গেল না, অবশেষে পুনর্ব্বার ক্ষীণস্বরে শব্দ হইল, আছি। রক্ষা কর।

 তারা পূর্ব্বাৎ কহিল, তুমি যেমন আছ, তেমনি আর কিছুক্ষণ থাক। তোমাকে রক্ষা করিব।

 আর কোন উত্তর আসিল না।

 আগ্রহাতিশয়ে তারা শম্ভূজীকে ছাড়িয়া দিয়াছিল। সে মুহূর্ত্তমাত্র অপেক্ষা না করিয়া প্রাণভয়ে বেগে পলায়ন করিল।