পর্ব্বতবাসিনী/পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ।
তারার মাথা ঘুরিয়া আসিল। নিকটে এমন কোন অবলম্বন ছিল না যাহা ধরিয়া দাঁড়াইবে। তবু সে দাঁড়াইয়া রহিল। বজ্রাহতের তুল্য স্থির রহিল। সেই সময় কে তাহার কর্ণে বলিল, এ অপমানের প্রতিফল আছে।
তারা মাথা তুলিয়া চাহিল। নিকটে আর কোন লোক ছিল না, সকলে প্রস্থান করিয়াছিল। যে দুই চারিজন লোক ছিল, তাহারাও ক্রমে চলিয়া গেল। তারাব পার্শ্বে দাঁড়াইয়া শম্ভূজী বলিতেছিল, এ অপমানের প্রতিশোধ আছে।
তারা শম্ভূজীকে দেখিতে পাইল। শম্ভূজী দেখিল, তারার মুখ পাংশুবর্ণ, চক্ষের জ্যোতি নিভিয়া গিয়াছে। তারা তাহার কথা শুনিতে পাইল না, দেখিয়া শম্ভূজী আবার কহিল, এ অপমানের কি প্রতিশোধ নাই?
তারার মস্তকে, হৃদয়ে সহস্র নরকজ্বালা, চক্ষের সম্মুখে নরক নৃত্য করিতেছিল। নরক হইতে কে আসিয়া তাহার কাণে কাণে কহিল, এ অপমানের একমাত্র প্রতিবিধান আছে।
শম্ভূজীকে দেখিয়া তারার শিরার মধ্যে রক্তস্রোত বেগে প্রবাহিত হইয়া তাহার মুখ অন্ধকার করিয়া তুলিল। চক্ষে একবার মাত্র লোহিত বিদ্যুৎ জ্বলিয়া উঠিল।
তারা কথা কহিতে চেষ্টা করিল, পারিল না। শোণিতস্রোতে স্বর রুদ্ধ হইল। কণ্ঠ হইতে বাঙ্নিষ্পত্তি হইল না। মুখমণ্ডল আরও অন্ধকার হইয়া উঠিল!
সে আবার বাক্যস্ফূত্তির প্রয়াস করিল। এবার কণ্ঠ হইতে শব্দ নির্গত হইল। ভগ্ন, জড়িত কণ্ঠে কহিল, এ অপমানের একমাত্র প্রতিশোধ আছে।
শম্ভূজী আরও নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি উপায়ে?
তাহাদের অঙ্গস্পর্শ হইল।
তারা কহিল, যে মুখে আমার অপমান করিয়াছে, সেই মুখ চরণ তলে দলিত করিতে পারি, তাহার জিহ্বা ছেদন করিয়া কুক্কুরকে খাওয়াইতে পারি, আর তাহার হৃৎপিণ্ড ছিঁড়িয়া গৌরীর ক্রোড়ে নিক্ষেপ করিতে পারি, তবেই আমার এ অপমান ভুলিতে পারিব। নহিলে বৃথাই জীবন। গোকুলজী জীবিত থাকিতে আমার শান্তি নাই।
শম্ভূজী থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। কহিল, যে তোমার এ উপকার করিবে, যে গোকুলজীকে নিধন করিবে, তাহাকে তুমি কি দিবে?
তারা। তাহাকে আমার অদেয় কিছুই নাই।
তখন আশা শম্ভূজীর কর্ণে পৈশাচ মন্ত্র প্রদান করিল। সে কহিল, গোকুলজী আর কখন প্রাতঃসূর্য্যের মুখ দেখিবে না। সে ভার আমার উপর। আমাকে তুমি বিবাহ করিবে?
তারা হস্তোত্তলন করিয়া কহিল, আমার হৃদয়ের মধ্যে যে নরক জ্বলিতেছে, সেই নরক সাক্ষী করিয়া কহিতেছি, আমি তোমায় বিবাহ করিব। পূর্ব্বে আমার ভ্রম হইয়াছিল, নহিলে এতদিন তোমাকে বিবাহ করিতাম। আমার এ নরকাগ্নি কোন দিন আমাকেই ভস্মীভূত করিত। এখন আমরা দুইজনে মিলিত হইয়া এ অগ্নিতে হবিঃপ্রদান করিব। গোকুলজী মরুক, তাহার শোণিতে এ অনল নিভাইব।
শম্ভূজী কহিল, আমি শপথ করিতেছি, তোমার পায়ের কাঁটা না তুলিয়া জলস্পর্শ করিব না। তোমাকে লাভ করিবার জন্য সহস্র গোকুলজীর প্রাণ বধ করিতে পারি। তাহাকে আজ রাত্রেই হত্যা করিব। আজ রাত্রেই তোমাকে সে সংবাদ আনিয়া দিব। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করিও।
তারা কহিল, ভাল। তুমি যেন সিদ্ধকাম হও।
শম্ভূজী তারাকে আলিঙ্গন করিতে উদ্যত হইল। তারা তাহাকে নিবারিত করিয়া কহিল, কি? আমাদের আবার আলিঙ্গন কি? কোমল হৃদয় নরনারী যাহা করে, আমরাও কি তাই করিব? ছি! হাত ধর, শপথ কর, গোকুলজীর রক্ত আনিয়া আমার কপালে সিন্দুর পরাইবে।
দুইজনে দুইজনের হাত চাপিয়া ধরিল, দুইজনে পরস্পর নয়নের ভিতরে দীর্ঘকাল চাহিয়া রহিল, আর কোন কথা কহিল না। দুইজনে মনে মনে শপথ করিল।
তৎকালে সে স্থলে তৃতীয় ব্যক্তি ছিল না।
এই লোমহর্ষণ স্বয়ম্বরের ভয়ঙ্কর পণ আর কেহ শুনিল না।