পর্ব্বতবাসিনী/ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ।

 গোকুলজী চলিয়া গেলে মহাদেব তারাকে কহিল, দেখ তারা, আমি ভাবিতেছিলাম কি, যে গোকুলজীর সঙ্গে তোর বিবাহ হইলে বড় সুখের হইত। আমার তা হলে মরণকালে আর কোন দুঃখ থাকিত না। এই কথা তোকে আর একবার বলেছিলেম, না? তা বিয়ের কথা বল্লেই ত তুই রাগ করিস্। এ দিকে গোকুলজীরও না কি আর এক জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েছে?

 তারা। সব মিথ্যা কথা। গোকুলজী আজ আমাকে নিজে বলেচে, যে তার বিয়ে হবার কোন কথা নাই। লোকে কেবল মিথ্যা রটায়।

 মহাদেব তারার মুখের দিকে চাহিয়া কিছু বিস্মিত হইল, জিজ্ঞাসা করিল, তবে কি তোর সঙ্গে বিয়ে হবে না কি?

 তারা। তুমি কেবল ঐ কথাই বল। গোকুলজীর বিবাহ হয় নাই বলিয়াই কি আমার সঙ্গে বিবাহ হইবে? যেমন তোমার কথা!

 এবার ত তারা রাগ করিল না। আর একবার তারাকে এই কথা বলাতে সে হাসিয়াছিল। তবে কি তারা গোকুলজীকে ভাল বাসে? মহাদেব ভাবিতে লাগিল। বুড় মানুষ, কত কথা মনে আসে কত কথা মনে আসে না। এ কথাটা ভাবিতে সে কথাটা ভুলিয়া যায়। মাথামুণ্ড, ছাইভস্ম, আপনার মনে কত কি ভাবিল। ভাবিয়া স্থির করিল, তারা গোকুলজীকে ভাল বাসে। তাহার পরেই স্থির করিল, ইহাদিগের বিবাহ দিব।

 আর তারা? সে কি ভাবিতেছিল? সে এইমাত্র বুঝিল যে হৃদয়ের মধ্যে আনন্দের বন্যা আসিয়া সব ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছে। দুদণ্ড বসিয়া যে ভাল করিয়া বুঝিয়া দেখিবে কি দুঃখ ছিল, কি দুঃখ নাই, কিসের জন্য এত আনন্দ, তাহার সে ক্ষমতা রহিল না। শুষ্ক হৃদয়, তাহাতে বিন্দু বিন্দু জল সেচন করিবারও উপায় ছিল না। সে হৃদয় মরুভূমির তুল্য হইয়া উঠিতেছিল। সে হৃদয়ের মধ্যে সহসা অতি বেগে বন্যা ছুটিল। সেই বন্যা সব ডুবাইল, সব গ্রাস করিল। চক্ষু অন্ধ হইবার উপক্রম হইয়াছে, আর থাকে না। দিন দিন দৃষ্টির হ্রাস হইতেছে, অবশেষে চক্ষে আর আলোক প্রবেশ করে না। এমন সময় অকস্মাৎ অন্ধতা ঘুচাইলে কি হয়? সূর্য্যরশ্মি যে চক্ষে অনেক দিন প্রবেশ করিতে পায় নাই, সে চক্ষে অকস্মাৎ সূর্য্যের আলোক পতিত হইলে, চক্ষু নষ্ট হইবার সম্ভাবনা। বিষাদের ভাবনায় এক রাত্রির মধ্যে কৃষ্ণকেশ শুভ্রবর্ণ হইতে শুনা গিয়াছে। অভাবনীয় আকস্মিক আনন্দের আতিশয্যে মৃত্যু পর্য্যন্ত হইয়াছে, এরূপ শুনা যায়। যাহার হৃদয় আনন্দপরিপ্লুত, সে চিন্তা করিবে কিরূপে? গভীর নিশীথে স্বপ্নবশে কেহ যেমন মুদিত নয়নে ভ্রমণ করে, তারার সেই রূপ মোহজনিত অবস্থা উপস্থিত হইল। কোন মাদক দ্রব্য সেবন করিলে যেরূপ বিকলচিত্ত ও বিকলাঙ্গ হওয়া যায়, তারার ঠিক সেই দশা হইল। চলিতে পা টলে, ভাবিতে মাথা টলে। মৃতপ্রায় আশা পুনর্জীবিত হইয়া তারাকে পাগল করিয়া তুলিল। হর্ষসমুদ্রে তরঙ্গ দোলায় তাহাকে দোলাইতে লাগিল। ইতিপূর্ব্বে শ্রবণে পশিতেছিল,—বহুদূরশ্রুত ভগ্নকণ্ঠ রোদন সঙ্গীত, এখন যেন হৃদয়ের মধ্যে কে শ্রুতিহর মধুর গীত গায়িল। আকাশে চন্দ্র হাসিল। সঙ্গীতে মাদকতা আছে, প্রেমে মাদকতা আছে, সর্ব্বাপেক্ষা আশাভাণ্ড মাদকতাময়! সে নেশা কখন ছাড়ে না। তারা সেই পাত্র পূর্ণ করিয়া পান করিল। গোকুলজী আর কাহারও নয়। সে আর কাহাকেও বিবাহ করিবে না। আজ সে তারার বাটীতে আসিয়াছিল, তাহার সহিত বাক্যালাপ করিয়াছে,—আর,—আর সে বলিয়াছে, আবার আসিবে।—তাহাতে কি হইল? কি হইল?—শুন, আশা কি বলিতেছে। সে বলিতেছে সব হইল, গোকুলজী তারার হইল, গোকুলজী ত তারারই হইয়াছে। কি হইল? কি হইল না? আবার কল্পনাকে জিজ্ঞাসা কর। সে বলে আমিই সুখ। পৃথিবীতে বা পৃথিবীর বাহিরে যাহা কিছু সুখ আছে, তাহা আমারই ভাণ্ডারে। মানুষে আর যাহা কিছু সুখ পায়, তাহা আমার উচ্ছিষ্ট মাত্র। আমিই সুখের সার, বাকী সুখ নীরস। যদি প্রকৃত সুখ চাও ত আমাকে ভজ। তবে মায়াময়ি, তোমার ইন্দ্রজাল দেখাও তারাকে মুগ্ধ কর। তারা অসংযতচিত্ত, হৃদয়ে অপ্রতিহত প্রণয়ের লীলাময়ী লহরী। মরাল মরালী স্বর্ণ সরোবরে ভাসিতেছে। আকাশে চন্দ্র হাসিতেছে, তাহার নিকটে একটা নক্ষত্র। দুই একখানি ছোট ছোট সাদা মেঘ ভাসিয়া যাইতেছে। থাকিয়া থাকিয়া বাতাস ঘুমন্ত গাছগুলির মাথা নাড়িয়া দিতেছে, আর তাহারা বিরক্ত হইয়া মর্ মর্ করিতেছে। জীবন আর মৃত্যু এই এক মুহূর্ত্তে মিশিয়া গিয়াছে। জীবনরাজ্যের শেষ সীমার পর মরণরাজ্যের আরম্ভ। এখন সে সীমা আর অনুভব করা যায় না। এই এক মুহূর্ত্তে জীবন মৃত্যু সমান, সুখ দুঃখ সমান, স্বর্গ নরক থাকে না। সর্ব্বত্রই স্বর্গ, সর্ব্বত্রই জীবন, সর্ব্বত্রই সুখ। তারার চক্ষে ঘুম নাই। এত সুখের ভার বুকে করিয়া নিদ্রা হয় না। এ সুখ রাশির কিছু বিলান চাই। তাই তারা বিনিদ্র নয়নে জ্যোৎস্নাময়ী রজনীর হৃদয়ে আপনার সুখের স্রোত ঢালিতেছে। রজনীর মত এমন রহস্য সখী আর কোথায়? দুঃখের কথা বল, চুপ করিয়া শুনিবে, কিছু বলিবে না, কেবল তোমার নিশ্বাসের সহিত আপন নিশ্বাস মিশাইবে। সুখের কথা বল, নীরবে হাসিবে। নিশীথের কাণে কাণে মনের সব কথা বল, কিছুমাত্র আশঙ্কা নাই। সে সব কথা আর কেহ জানিবে না। মহা সমুদ্রে সহস্র সহস্র নদ, নদী, ক্ষুদ্র তটিনী, সলিলধারা ঢালিতেছে। সে জলরাশি সমুদ্র নিজগর্ভে ধারণ করিতেছে। কোন কথা কয় না, সমুদ্রতীর কখন উদ্বেলিত হয় না। মানুষের সুখ দুখের, ভাবনা চিন্তার, পাপ পুণ্যের, এইরূপ আরও লক্ষ লক্ষ স্রোত রজনীর গর্ভে মিশাইয়া যায়। রজনী সমুদয় আপনার গর্ভে ধারণ করে। নির্ম্মল, অমৃত সলিলই হউক অথবা লবণাক্ত গরল ধারাই হউক, হাস্যের লহরীই হউক অথবা রোদনের অশ্রুই হউক, নিঃশব্দে রজনী সমস্তই আপনার বিশাল প্রশান্ত গর্ভে ধারণ করে।

 প্রেম তুচ্ছ সামগ্রী নয়। প্রেমে পৃথিবী, প্রেমে স্বর্গ অনুপ্রাণিত হয়। বিশাল বিশ্বের ধমনীর মধ্যে প্রেমই জীবন। পৃথিবীর মধ্যে যে মুহূর্ত্তে নরনারী প্রেমে বদ্ধ হয়, যে মুহূর্ত্তে আর এক নবীন দম্পতী মিলিত হয়, সেই এক মাহেন্দ্র ক্ষণ। সে মুহূর্ত্তে নন্দনবনে পারিজাত ও মন্দার ফোটে, সে মুহূর্ত্তে নরকে যমদূত পাপীকে তাড়না করিতে বিস্মৃত হয়, হতভাগা নরের আত্মা এক মুহূর্ত্তের জন্য পরিত্রাণ পায়।

 কে বলিয়াছে নারী ভালবাসিতে জানে ইহাই তাহার গুণের চরমোৎকর্ষ নয়? রমণী ভাল বাসিতে জানে বলিয়াই অপরাপর মহৎ কার্য্য সমাধা করিতে সক্ষম হয়। ভালবাসাই তাহার মূলমন্ত্র। যে দিন রমণী ভাল বাসিতে জানিবে না, সে দিন চন্দ্র সূর্য্যের গতি রোধ হইবে, বসুন্ধরা স্তম্ভিত হইবে, নক্ষত্র নিভিয়া যাইবে।