পর্ব্বতবাসিনী/দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ।

 একদিবস প্রাতঃকালে মহাদেব গৃহকর্ম্মের তত্ত্বাবধানে ব্যস্ত রহিয়াছে, এমন সময় গোকুলজী গৃহদ্বাবে আসিয়া দাঁড়াইল। মহাদেব ব্যস্তসমস্ত ভাবে এদিক ওদিক করিতেছে, কখন ঘরের ভিতর যাইতেছে, কখন বাহিরে আসিতেছে, একটা ভৃত্যকে তিরষ্কার করিতেছে, আর একজনকে কোন কর্ম্মে নিযুক্ত করিতেছে! গোকুলজী হাসিয়া তাহাকে ডাকিয়া কহিল, মহাদেব চিনিতে পার?

 মহাদেব ফিরিয়া গোকুলজীকে দেখিতে পাইয়া বলিয়া উঠিল, কে গোকুলজী? তোমার আর চিনিতে পারিব না? কোথা থেকে হে? আজ বড় ভাগ্য। এস, এস!

 এই বলিয়া বৃদ্ধ গোকুলজীর হাত ধরিয়া হড় হড় করিয়া টানিয়া ঘরের মধ্যে বসাইল। গোকুলজী হাসিতে হাসিতে কহিল, মহাদেব, তুমি আমাদের যেমন শুভানুধ্যায়ী, তাহাতে তোমার সঙ্গে সর্ব্বদা দেখা শুনা করা আমার কর্ত্তব্য। আগে তুমি আমাদের বাড়ী যেতে আসতে, এখন ত আর যাও না। তা, এখন কার কাছেই বা যাবে?

 এই বলিয়া গোকুলজী মস্তক অবনত করিল।

 মহাদেব। ভাল মন্দ ও সকলেরই আছে, গোকুলজী। তোমার মার বয়সও হয়েছিল। তোমার কি চির কাল শোক করা উচিত?

 গোকুলজী। না, তাই এতদিন তোমার কাছে আসিতে পারি নাই। তা নহিলে আরও আগে আসিতাম। তোমার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করিবার ইচ্ছা সর্ব্বদাই হয়। কিন্তু এ বাড়ীতে আসিতেও বড় সাহস হয় না। রঘুজীর কন্যা রাগ করিতে পারেন।

 ম। সে কি? কেন রাগ করিবে? তুমি তারার কি করিয়াছ?

 গো। কিছু করি নাই। তবে সেই যে একবার রঘুজীর সঙ্গে ঝগড়া মারামারি হইবার উপক্রম হইয়াছিল, সেই জন্য যদি কিছু মনে করিয়া থাকেন।

 মহাদেব হাসিয়া উঠিল। কহিল, তবে তুমি তারাকে চেন না। আমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিলে তারা তোমায় কিছু বলিবে? সে তেমন মেয়ে নয়।

 অন্য গৃহ হইতে কে ডাকিল মহাদেব, কোথায় তুমি?

 মহাদেব উত্তর করিল, এই যে আমি।

 যে ডাকিতেছিল, সে গৃহে প্রবেশ করিল। কহিল, আমি তোমায় বাহিরে খুঁজিয়া পাইলাম না। আজ যে তুমি বড় ঘরের ভিতর বসিয়া আছ? কিছু অসুখ করিয়াছে না কি?

 মহাদেব। না। এই গোকুলজী আমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছেন। তাই ইঁহাকে ঘরে বসাইয়াছি। তুমি কি ইঁহাকে চেন না?

 চেনে না? তারা গোকুলজীকে চেনে না? চন্দ্র সূর্য্যকে চেনে না? ফুল ভ্রমরকে চেনে না? চিরদরিদ্র চিরাকাঙ্ক্ষিতকে চেনে না? কথা শুন! যাহাকে ভাবিয়া বাঁচিয়া আছি, তাহাকে আমি চিনি না! যে জীবনের কেন্দ্রস্থান, যাহাকে, উপলক্ষ্য করিয়া জাবনের চক্র ঘূরিতেছে, তাহাকে চিনি না! হৃদয়ের সন্ধ্যাকাশে যে একটা মাত্র নক্ষত্র জ্বলিতেছে, সে নক্ষত্র আমি চিনি না!

 সেই গোকুলজী আজ তারার গৃহে পদার্পণ করিয়াছে, আজ সে তারার ঘরে বসিয়াছে। আর তারা তাহাকে চিনিবে না? আজ ত সে গোকুলজীকে নিকটে পাইয়াছে। আজ সে কেন তাহাকে আত্ম সমর্পণ করুক না? তাহার চরণ ধরিয়া মিনতি করিয়া বলুক না কেন, জীবিতেশ্বর, আমি তোমাকে মনে মনে বরমাল্য দান করিয়াছি, তুমি আমার স্বামী। বিধাতা আমাদিগকে পরস্পরের তরে সৃজন করিয়াছেন। তুমি আমাকে বিবাহ কর। লোকে যাহা বলিতে হয় বলুক। তাহাতে আমাদিগের কি ক্ষতি? আজ তুমি আমার গৃহে আসিয়াছ। তোমাকে কি বলিয়া অভ্যর্থনা করিব, তোমাকে কি করিয়া সমাদর করিব? তুমি আমার জীবনসর্ব্বস্ব, তোমাকে আমার জীবন সর্ব্বস্ব দিব, গ্রহণ কর।

 তারা ত এ সব কথা বলিল না। কেন?

 গোকুলজী যে তাহাকে চায় না। সে যে অন্যের প্রণয়ী।

 তবে তারা কি বলিবে? চুপ করিয়া থাকিবে? তাও কি থাকা যায়? তবে কি বলিবে, গোকুলজীকে চিনি না? ছি! মিথ্যা বলিবে? তারা বলিল, চিনিব না কেন?

 মহাদেব বলিতে লাগিল, গোকুলজী কেমন লোক, তা তোমায় বলিয়া থাকিব। সম্প্রতি ইঁহার মাতার কাল হইয়াছে। ইনি এ বাড়ীতে কখন আসেন নাই। আজ আসিয়াছেন।

 তারা এখন কথা খুঁজিয়া পাইল, কহিল, তা বেশ ত, উনি যদি আমাদের বাড়ী কখন কখন আসেন, সে ত আমাদের সৌভাগ্যের কথা।

 মহাদেব কহিল, আমি ও তাই বলিতেছিলাম।

 এমন সময় বাহিরে ডাক পড়িল, মহাদেব।

 মহাদেব তাড়াতাড়ি উঠিয়া তারাকে কহিল, তুমি একটু গোকুলজীর সঙ্গে কথাবার্ত্তা কও, আমি এখনি আসিতেছি। বাহিরে ক্ষেতের লোক আমায় ডাক্‌চে।

 মহাদেব উঠিয়া গেল। সে লোকের সাক্ষাতে তারাকে “তুমি” বলে। নির্জ্জনে আদর করিয়া “তুই” বলিত।

 ঘরে রহিল কেবল তারা আর গোকুলজী। এইবার বিষম বিপদ। কে কি বলিবে? কে আগে কথা কহিবে? তারা চুপ করিয়া দাঁড়াইল রহিল। এই দেখিয়া গোকুলজী কথা কহিল, বলিল, পর্ব্বতে যখন তোমার সহিত দেখা হইয়াছিল, তখন তোমাকে অনর্থক মন্দ কথা বলিয়াছিলাম। সে অপরাধ কি মার্জ্জনা কর নাই?

 তারা। কি মার্জ্জনা করিব? তুমি আমায় যে কথা বলিয়াছিলে, গ্রাম শুদ্ধ লোকে সে সময় আমায় সেই কথা বলিতেছিল। বরং আমি যে তোমায় দুর্ব্বাক্য বলিয়াছিলাম, সেজন্য আমার মার্জ্জনা চাওয়া উচিত।

 গোকুলজী! অমন কথা বলিও না। তুমি যে আমায় কোন মন্দ কথা বলিয়াছিলে, তাহা ত স্মরণ হর না; বরঞ্চ আমাদের খুব যত্ন করিয়াছিলে তাহাই মনে পড়ে।

 তারা কথা ফিরাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোমার বিবাহ কবে হইল? বলিতে কিছু আপত্তি আছে কি?

 গোকুলজী অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া কহিল, সে কি? আমার বিবাহ—কৈ আমার ত বিবাহ হইবার কোন কথা নাই। সে সম্বন্ধে যদি কিছু শুনিয়া থাক, সব মিথ্যা কথা। আমি সত্য বলিতেছি আমার বিবাহের এখন কোন সম্ভাবনা নাই। সে সম্বন্ধে যাহা কিছু শুনিবে, কিছু বিশ্বাস করিও না। সব মিথ্যা কথা।

 তারার শ্বাস রুদ্ধ হইবার উপক্রম হইল, সম্পূর্ণ কণ্ঠরোধ হইল। তাহার ভয় হইল, পাছে হৃদয়ের কোলাহল গোকুলজী শুনিতে পায়। সেই ভয়ে বস্ত্রের মধ্যে হস্ত দিয়া হৃদয় চাপিয়া অনেক ক্ষণ পরে তাহার কণ্ঠস্বর ফিরিয়া আসিল। ধরিল। তখন সে অতি মৃদু স্বরে, মস্তক উত্তোলন না করিয়া, কহিতে লাগিল, গোকুলজী, আমি আর একটা অত্যন্ত অন্যায় কাজ করিয়াছি, তাহা আমার এখন স্মরণ হইতেছে—

 গো। কৈ—না? তুমি ত আমার কিছু অপকার কর নাই।

 তারা। আমি এক দিবস বিনা দোষে গৌরীকে অপমান করিয়াছিলাম—

 গো। আমি ত তা জানি না। আর স্ত্রীলোকে স্ত্রীলোকে সামান্য একটা ঝগড়া হইলে আমাদের ত জানিবার আবশ্যক নাই। গৌরীর সহিত তোমার ঝগড়া হইলে আমি রাগ করিব কেন? সে আমার কে?

 গোকুলজী মিথ্যা বলিল। সে আজ পর্য্যন্ত মিথ্যা বলে নাই। আজ সে অপমানের প্রতিশোধ লইবার জন্য মিথ্যা কথা কহিল। গোকুলজীর মনে কি ছিল, তাহা জানিলে তারা তাহাকে দেখিয়া কখন এত আনন্দিত হইত না।

 তারা আর কিছু বলিল না। তাহার হৃদয়ে আনন্দ উথলিতেছিল।

 মহাদেব ঘরে ফিরিয়া আসিয়া গোকুলজীকে কহিল, গোকুলজী, অনেক বেলা হইয়াছে, ভীলপুর এখান হইতে অনেক দূর। আজ এইখানে আহার কর।

 গোকুলজী কহিল, না, বাড়ী যাই। আমাদের একটু অবেলায় আহার করিলে কোন অপকার হয় না।—এমন সময় তারার দিকে তাহার দৃষ্টি পড়িল,—অমনি মহাদেবকে পুনর্ব্বার কহিল, তা তুমি যদি বল, ত এখানেই আহার করি।

 গোকুলজী আহার করিয়া মহাদেবের সহিত কথাবার্ত্তা কহিতে লাগিল। মাঝে মাঝে তারাও তাহাদের সঙ্গে যোগ দিল। বৈকাল বেলা গোকুলজী তারার সহিত দেখা করিয়া গেল। গমনকালে বলিয়া গেল, পারি ত কাল আসিব।