পর্ব্বতবাসিনী/একবিংশ পরিচ্ছেদ
একবিংশ পরিচ্ছেদ।
গ্রামের প্রান্তস্থিত ক্ষুদ্র কুটীর মধ্যে গোকুলজী এখন একাকী। পাশের ঘরে চারপাই পড়িয়া আছে, কিন্তু তাহাতে আর বিছানা পাতা নাই। গোকুলজীর মাতৃবিয়োগ হইয়াছে। যে সময় তারা পিতৃগৃহে অগ্নি জ্বালাইয়া পলায়ন করে সেই সময় বৃদ্ধার কাল হয়।
ঘর দু খানি এখনও পূর্ব্বের মত পরিষ্কার। গোকুলজীর মাতার ঘর আগে যেমন ছিল ঠিক তেমনি রহিয়াছে। গোকুলজী নিতা সব দেখে, স্বহস্তে ঘর ঝাঁট দেয়, পরিষ্কার করে, যেটা যেখানে থাকে যত্ন পূর্ব্বক সেইটা সেইখানে রাখে। বুড়ীর সাজা পান রাখিবার পিতলের একটা ছোট বাটা ছিল, গোকুলজী সেটা প্রত্যহ মাজিয়া রাখে। পানবাটা ঝক্ ঝক্ করিতেছে, তাহাতে মুখ দেখা যায়। দোক্তা রাখিবার একটী ছোট ঝাঁপি ছিল, তাহার ভিতরে এখনো দোক্তা রহিয়াছে। দিনের বেলা চারপাইয়ের উপর বিছানা দেখিতে পাওয়া যায় না, সত্য; কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় গোকুলজী বিছানা পাতে ও প্রাতে তুলিয়া রাখে। বিছানা আগেকার মত ঝর্ঝরে পরিষ্কার।
মাতার মৃত্যু হইলে পর কয়েক দিবস গোকুলজী কুটীরের বাহির হইত না। একদিন বাহির হইয়া গৃহদ্বার রুদ্ধ করিয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া কোথায় চলিয়া গেল। লোকে ভাবিল, মাতৃশোকে বুঝি গোকুলজী গ্রাম ছাড়িল। দুই তিন সপ্তাহ পরে গোকুলজী একটী যুবতী সঙ্গে করিয়া ফিরিয়া আসিল। লোকে আবার ভাবিল, গোকুলজী বিবাহ করিয়া আসিয়াছে।
সত্য হউক মিথ্যা হউক, লোকে একটা কিছু মনে করিতে কখন ছাড়ে না। গোকুলজীর সম্বন্ধে লোকে দুইবার দুই রকম মনে করিল, দুইবারই ভুল। গোকুলজী গ্রাম ছাড়িয়াও যায় নাই, সঙ্গিনী যুবতীকে বিবাহ করিয়াও লইয়া আইসে নাই।
গোকুলজীদের গ্রামে একটী কুটীরে এক বিধবা বাস করে। তাহার ত্রিসংসারে কেহ ছিল না, সে একাই থাকিত। স্ত্রীলোকটী অর্দ্ধবয়স্কা, প্রাচীনাই বলিতে হয়, তবে নিতান্ত বৃদ্ধা নয়। মাথার চুল বেশী ভাগ কাল, মাঝে মাঝে সাদা চুল দেখা দিয়াছে। চক্ষু দুটী কাল, কিছু ছোট ছোট। ললাট ও ভ্রু ঈষৎ কুঞ্চিত। দেখিলে বোধ হয় স্ত্রীলোকটী কিছু কোপনস্বভাবা। বাস্তবিক এই তাহার একমাত্র দোষ নহিলে তাহার আর কোন দোষ ছিল না। পরিশ্রমে অকাতর, প্রতিবেশীদিগের উপকার করিতে সর্ব্বদা প্রস্তুত। এজন্য গ্রামের লোকেরা তাহার অনেক প্রত্যুপকার করিত।
গোকুলজী, যুবতীকে সঙ্গে করিয়া আপনার কুটীরে প্রবেশ না করিয়া একেবারে সেই বিধবা স্ত্রীলোকটীর কুটীরে গেল। গোকুলজীর সহিত বিধবার পূর্ব্বেই কিছু কথাবার্ত্তা হইয়া থাকিবে, কারণ সে গৌরীকে দেখিয়া বিশেষ বিস্মিত না হইয়া কহিল, কি গোকুল, এই মেয়েটী?
গৌরী নিতান্ত মেয়েটী নয়, সে বিধবার কথা শুনিয়া একটু হাসিল।
গোকুলজী উত্তর করিল, হাঁ। কেমন, একে রাখতে পারবে ত?
বিধবা বলিল, শুন কথা! মানুষের কাছে মানুষ থাক্বে তার আবার কথা। এস বাছা! এই বলিয়া সে অগ্রসর হইয়া গৌরীর হাত ধরিয়া ঘরে লইয়া গেল। গৌরীও কিছু না বলিয়া তাহার সঙ্গে গেল। গোকুলজী আপনার কুটীরে ফিরিয়া গেল।
বিধবা কয়েক দিনের মধ্যেই গৌরীকে কন্যার মত স্নেহ করিতে আরম্ভ করিল; গৌরীও যথাসাধ্য তাহার সেবা করিত।
মেলার দিন গৌরী ও বিধবা স্ত্রীলোকটী একত্রে মেলা দেখিতে যায়, সেইখানে সর্ব্বজনসমক্ষে তারা নিরপরাধে গৌরীকে অপমান করিল। গৌরী, বৃদ্ধার হাত ধরিয়া অধোবদনে কাঁদিতে কাঁদিতে কুটীরাভিমুখে গমন করিল। বিধবা চীৎকার করিয়া তারাকে গালি পাড়িতে লাগিল।
পথে গোকুলজীর সহিত সাক্ষাৎ হইল। গৌরীকে কাঁদিতে দেখিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল, কি হইয়াছে?
গৌরী কোন উত্তর করিল না, অধোবদনে কাতর হৃদয়ে রোদন করিতে লাগিল। তাহার সঙ্গিনী কহিল, সেতারার তারা বাই, রঘুজীর কন্যা, তাকে জানত? মাগী বিনা দোষে আমার বাছাকে গাল দিয়েচে আর নড়া ধোরে ফেলে দিয়েচে। দর্পহারী মধুসূদন আছেন, মাগীর দর্প চূর্ণ হবে হবে হবে!
সেই পথের ধারে দাঁড়াইয়া, গোকুলজী একটী একটী করিয়া সর কথা শুনিল। তখন, তাহার নির্ম্মল ললাট অন্ধকার হইয়া উঠিল, ওষ্ঠাধর স্ফুবিল, চক্ষে বিচ্যুৎ ঘনীভূত হইল। ধীরে ধীরে বলিল, আমি কখনও তাহার কোন অনিষ্ট করি নাই। একবার তাহার পিতার সহিত বিবাদ হইয়াছিল, কিন্তু তাহাতে তাহার কন্যার রাগ হইবার কোন কথা ছিল না। সে আমাকে নিজে বলিয়াছিল যে তাহার কিছু রাগ হয় নাই, দুই একবার আমার সঙ্গে মিষ্ট কথাও কহিয়াছিল। এখন তাহার অন্তরের গরল প্রকাশ করিতেছে। গৌরী, পর্ব্বতবাসিনীকে মনে পড়ে?
গৌরী রোদন ভুলিয়া সাশ্চর্য্যে কহিল, পড়ে বই কি!
গোকুলজী। এই সেই। সেই জটাধারিণী, মলিনাঙ্গী রমণী আর এই ধনগর্ব্বিতা যুবতী, দুই-ই এক। পর্ব্বতপ্রবাসে রঘুজীর কন্যা অনেক দিন কাটাইয়াছিল। তাহার আশ্রয় গ্রহণ করিতে কেন অসম্মত হইয়াছিলাম, এখন কি তাহা বুঝিলে?
গৌরী। ভাল বুঝিতে পারিলাম না।
গো। আজ তাহার আচরণ দেখিলে ত? আমি তাহার কিছু করি নাই, অথচ সে আমার পরম শত্রু। সে মনে করিয়াছে আমরা গরিব, অপমানের শোধ তুলিতে পারিব না। আমাকে কিছু বলিলে, আমি হয়ত কিছু মনে করিতাম না, সহ্য করিয়া যাইতাম। কিন্তু কিছুমাত্র দোষ না পাইয়া এত লোকের সাক্ষাতে যখন তোমার অপমান করিয়াছে, তখন ইহার প্রতিফল দিবই দিব।
গৌ। তা হউক, আমার অপমান করিয়াছে, করিয়াছে। তুমি কি করিতে কি করিবে, আর কথায় কাজ নাই! আর মেলা দেখিতে না গেলেই হইবে। তুমি রাগের মাথায় কি করিয়া বসিবে, তার ত ঠিক নাই। তোমার পায়ে পড়ি আর কোন গোল কোরো না। যা হবার তা হয়ে গিয়েছে।
গো। না, না, সে সব ভয় কিছু নাই। আমি কখন স্ত্রীলোকের গায়ে হাত তুলিব না। সে যেমন লোকের সাক্ষাতে তোমার মাথা হেঁট করেছে, আমিও তেমনি করিব। কিন্তু তার অঙ্গস্পর্শ করিব না।
এই বলিয়াই গোকুলজী চলিয়া গেল। গৌরী, অঞ্চলে চক্ষু মুছিয়া, বিধবার সঙ্গে বাড়ী গেল।
দুঃখের জগতে আরও দুঃখ এই। তুমি আমার মন বুঝ না, আমি তোমার মন বুঝিতে পারি না। গোকুলজী তারার মন জানিল না। কেন যে তারা গৌরীর অপমান করিয়াছিল, তাহা বুঝিতে পারিল না। তারা যথার্থ গুরুতর অপরাধে অপরাধিনী। কিন্তু সে অপরাধ যে কেন করিয়াছিল, গোকুলজী তাহা একবার বুঝিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল না। তারা যে তাহার প্রণয়াকাঙ্ক্ষিনী, গোকুলজী আর কাহারও প্রণয়াসক্ত হইবে, ইহা তাহার প্রাণে সয় না, এই কারণেই যে গৌরীকে অপমানিত করিয়াছিল, তাহা আর কেহ জানিতে পারিল না। যে গোকুলজীর জন্য তারা অকারণে অন্যায়াচরণে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, সেই গোকুলজীই তাহার শত্রু হইয়া দাঁড়াইল।
দুইটি মানুষ, একে অপরের জন্য গঠিত, পরস্পরের প্রতি স্বতঃই আকর্ষিত হইবে। আবার দেখিবে, সহসা তাহাদের মধ্যে এমন এক ব্যবধান আসিয়া উপস্থিত হয়, যাহাতে পরস্পর আকৃষ্ট না হইয়া, অন্তরিত হয় ও ক্রমশঃ ভিন্ন মুখে গমন করিতে থাকে। এইরূপে ক্রমাগত দীর্ঘ, দীর্ঘতর ব্যবধান ঘটিতে ঘটিতে অকস্মাৎ তাহারা আর একস্থলে গিয়া মিলিত হয়। যেখানে মিলিবার কথা, হয় ত ঠিক তাহার বিপরীত স্থানে মিলন সংঘটিত হয়। যাহাদের ইহজীবনেই মিলন হইবার কথা, তাহারা হয় ত মরণে মিলিত হয়।