পর্ব্বতবাসিনী/বিংশ পরিচ্ছেদ
বিংশ পরিচ্ছেদ।
এই ঘটনার পর কয়েকদিন শম্ভূজী আর আসিল না। একদিন সে একটা বড় খবর লইয়া আসিল। তারা যে গৌরীকে দেখিয়াছিল, শম্ভূজী তাহা জানিত না। কহিল, একটা ছোট রকম মেলা হইবে। স্থানটা সেতারা ও নয় ভীলপুর ও নয়, মাঝামাঝি একটা জায়গা। সেখানে গৌরী নিশ্চয়ই যাইবে। সেইখানে গিয়া একবার তাহাকে দেখিয়া আসিলে হয় না?
গৌরীকে তারা একবার দেখিয়াছিল, শম্ভূজী তাহা জানিত না। শম্ভূজীর কথায় তারা কোন উত্তর না দিয়া আপনার মনে ভাবিতে লাগিল। শম্ভূজী মনে করিয়াছিল একটা মস্ত খবর আনিয়াছি। এরূপ গতিক দেখিয়া চলিয়া গেল।
তারা ভাবিয়া চিন্তিয়া একটা স্থির করিল। পূর্ব্বেকার মত এখন আর তাহার বেশভূষার তেমন পারিপাট্য নাই। মলিন বেশ, মলিন কেশ, মলিন মূর্ত্তি। মেলার দিনে তারা যত্ন করিয়া অঙ্গরাগ করিল; অতি বিচিত্র বহুমূল্য বসন পরিধান করিল; কেশ সযত্নে রঞ্জিত করিল; কাণে সোনা পরিল; অঙ্গুলীতে অঙ্গুরী পরিল; নয়নে কজ্জল পরিল; অধরে তাম্বুল দিল। এই রূপে সজ্জিত হইয়া মহাদেবকে সঙ্গে করিয়া মেলা দেখিতে গেল।
মেলার একস্থলে কতকগুলি স্ত্রীলোক জড় হইয়াছিল। তাহাদের সুবিধার জন্য পুরুষেরা তাহাদিগকে সেই দিকটা ছাড়িয়া দিয়াছিল। মধ্যস্থলে একটু উচ্চ স্থান; সেখানে বসিবার বেশ সুবিধা। সেইখানে গৌরী বসিয়াছিল, তাহার পাশে একজন বৃদ্ধা। তারা মহাদেবকে সঙ্গে করিয়া সেই দিকে গেল। তাহাকে দেখিরাই, চারিদিকে কাণাকাণি, গা টেপাটিপি, অঙ্গুলিনির্দ্দেশ হইতে লাগিল। স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে একজন বলিলেন, ঐ বুঝি রঘুজীর কন্যা! লজ্জা নেই, সরম নেই, পুরুষ মানুষের মতন হট্ হট্ কোরে বেড়াচ্ছে। আর একজন কহিলেন, মাগীর ঠ্যাকার দেখ! টাকার গুমরে ফাট্চেন! কাপড় রে, গহনা রে, গায়ে আর ধর্চে না। তবু যদি অমন বাপের মেয়ে না হতিস্! অপর একজন কহিলেন, বাবা, এমন মেয়ে সাত জন্মে দেখি নি। হন্ হন্ কোরে আস্চে দেখ। আগে কত গুণবতীই ছিলেন, এখন নাকি একটু তবু ভাল হয়েচে। জাতসাপের বংশ, আবার কোন্ দিন ফোঁস কোরে ওঠে দেখ।
এইরূপ নানা কথা চলিতেছে, এমন সময় তারা তাহাদের মধ্যে আসিয়া উপস্থিত। অমনি সকলে চুপ, যেন কেহ তাহাকে চেনেই না, যেন কেহ তাহার ছায়াই মাড়ায় নাই। একজন পূর্ব্বোক্ত বৃদ্ধার কাণে কাণে বলিয়া দিল, যদি কেউ তোমাকে উঠিতে বলে, কখনো উঠিও না। আর একজন গৌরীর গা টিপিয়া দিল, তুমি প্রাণান্তে নড়িও না।
সমবেত স্ত্রীলোকেরা তারাকে দেখিয়া পথ ছাড়িয়া দিল। সে একেবারে যেখানে গৌরী ও বৃদ্ধা উপবেশন করিয়াছিল, সেইখানে গেল। গৌরী তাহাকে ভ্রমেও চিনিতে পারিল না। পর্ব্বতের সে চীরপরিহিতা, কালিমাময়ী, জটাধারিণী মূর্ত্তিতে আর এই গর্ব্বিতা সুন্দরী যুবতীতে অনেক প্রভেদ। তারা গৌরীকে সম্বোধন করিয়া উদ্ধতস্বরে কহিল, এ স্থান তোমাদের জন্য নয়। তোমরা অন্যত্র যাও। তোমরা এ স্থলের উপযুক্ত নও।
গৌরী ভাল ভালমানুষ, ঝগড়া করিতে চায় না। তারাকে দেখিয়া মনে করিল, দূর হউক, সরিয়া যাই, তাহাতে অপমান কি? ইহাকে দেখিয়া বড়মানুষ বোধ হইতেছে। মিছামিছি ইহার সহিত ঝগড়া করিয়া কি হইবে? সরিয়াই যাই।
এই ভাবিয়। গৌরী উঠিয়া দাঁড়াইল।
গৌরীর পাশে যে বুড়া বসিয়াছিল, সে মাগী বড় কুঁদুলী। তারার কথার তাহার গা জ্বলিয়া উঠিল। গৌরী উঠিয়া যায় দেখিয়া তাহার হাত চাপিয়া ধরিল। তারার দিকে ফিরিয়া আর এক হাত নাড়িয়া কহিল, কেন গা, তুমি কি রাজার রাণী এয়েচ না কি, যে তোমায় দেখে উঠে যেতে হবে? তুমিও এয়েচ যেমন দেখ্তে আমরাও এয়েচি তেমনি দেখ্তে। তোমার খরিদ করা জায়গাও নয় আমার কেনাও নয়। বড় মানুষ আছ, বাছা, আপনার ঘরে আছ। তা, এখানে তোমায় দেখে কেউ সর্বে কেন?
তারা, বুড়ীর কথায় কিছু না বলিয়া গৌরীকে বলিল, গ্রামে গোকুলজীর সঙ্গে ঢলাঢলি করিয়া এখানে বসিতে লজ্জা করে না? এ স্থান দুশ্চারিণীর বসিবার জন্য নয়।
গৌরী রাগিয়া কহিল, তোমাকে আমি চিনি না, কোথাও কিছু নাই, তুমি এখানে আসিয়া আমায় মন্দ বলিতেছ, আমায় মিথ্যা অপবাদ দিতেছ। কে তুমি যে আমি তোমায় ভয় করিব? গালি দিলেই গালি শুনিতে হইবে। এই বলিয়া গৌরী আর তিলার্দ্ধ বিলম্ব না করিয়া ব্রহ্মাস্ত্র ত্যাগ করিল। তাহার কোমল মুখখানি বহিয়া অশ্রু পড়িতে লাগিল।
তারা ইহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া নিতান্ত নিষ্ঠুরের মত গৌরীর হাত টানিয়া সরাইয়া দিল। গৌরী অধোবদনে অজস্র রোদন করিতে লাগিল। রোদন দেখিলে বোধ হয় যেন তাহার বুক ফাটিয়া যাইতেছে।
এই নিষ্ঠুর ব্যবহারের পর চারিদিকে গর্ব্বিত দৃষ্টিপাত করিয়া তারা চলিয়া গেল। নারীদল ভয়ে তাহার সাক্ষাতে কোন কথা বলিতে সাহস করিল না। বুড়ী পর্য্যন্ত চুপ করিয়া রহিল।
তারা এইজন্যই আসিয়াছিল। মেলায় আসিবার তাহার দুইটী উদ্দেশ্য। প্রথম, গোকুলজীর নেত্রপথে পতিত হওয়া, দ্বিতীয় লোকের সমক্ষে গৌরীকে অপমান করা। দুই উদ্দেশ্যই পূর্ণ হইল। মেলায় প্রবেশ করিতে গোকুলজীর সহিত সাক্ষাৎ হওয়াতে, গোকুলজী তৎক্ষণাৎ অন্য দিকে চক্ষু ফিরাইল। সুতরাং কথাবার্ত্তা আর কিছু হইল না। গৌরীকে যেরূপে অপমানিত করিল, তাহা উপরে বিবৃত হইয়াছে।