পল্লী-সমাজ/নবম পরিচ্ছেদ
যত রাগ করিয়াই রমেশ চলিয়া আসুক, বাড়ী পৌঁছিতে না পৌঁছিতে তাহার সমস্ত উত্তাপ যেন জল হইয়া গেল। সে বার বার করিয়া বলিতে লাগিল—“এই সোজা কথাটা না বুঝিয়া কি কষ্টই না পাইতেছিলাম। বাস্তবিক, রাগ করি কাহার উপর? যাহারা এতই সঙ্কীর্ণভাবে স্বার্থপর যে, যথার্থ মঙ্গল কোথায়, তাহা চোখ মেলিয়া দেখিতেই জানে না, শিক্ষার অভাবে যাহারা এম্নি অন্ধ যে, কোনমতে প্রতিবেশীর বলক্ষয় করাটাকেই নিজেদের বল-সঞ্চয়ের শ্রেষ্ঠ উপায় বলিয়া মনে করে, যাহাদের ভাল করিতে গেলে সংশয়ে কণ্টকিত হইয়া উঠে, তাহাদের উপর অভিমান করার মত ভ্রম আর ত কিছুই হইতে পারে না!” তাহার মনে পড়িল, দূরে সহরে বসিয়া সে বই পড়িয়া, কানে গল্প শুনিয়া, কল্পনা করিয়া কতবার ভাবিয়াছে, ‘আমাদের বাঙ্গালী জাতির আর কিছু যদি না থাকে ত নিভৃত গ্রামগুলির সেই শান্তি-স্বচ্ছন্দতা আজও আছে, যাহা বহুজনাকীর্ণ সহরে নাই। সেখানে স্বল্পেসন্তুষ্ট, সরল গ্রামবাসীরা সহানুভূতিতে গলিয়া যায়, একজনের দুঃখে আর একজন বুক দিয়া আসিয়া পড়ে, একজনের সুখে আর একজন অনাহূত উৎসব করিয়া যায়। শুধু সেইখানে, সেই সব হৃদয়ের মধ্যেই এখনো বাঙ্গালীর সত্যকার ঐশ্বর্য অক্ষয় হইয়া আছে।’ হায় রে! এ কি ভয়ানক ভ্রান্তি! তাহার সহরের মধ্যেও যে এমন বিরোধ, এত পরশ্রীকাতরতা চোখে পড়ে নাই! আর সেই কথাটা মনে পড়িতে তাহার সর্ব্বাঙ্গ বহিয়া যেন অসংখ্য সরীসৃপ চলিয়া বেড়াইতে লাগিল। নগরের সজীব চঞ্চল পথের ধারে যখনই কোন পাপের চিহ্ন তাহার চোখে পড়িয়া গেছে; তখনই সে মনে করিয়াছে, কোনমতে তাহার জন্মভূমি সেই ছোট্ট গ্রামখানিতে গিয়া পড়িলে সে এই সকল দৃশ্য হইতে চিরদিনের মত রেহাই পাইয়া বাঁচিবে। সেখানে যাহা সকলের বড়—সেই ধর্ম্ম আছে, এবং সামাজিক চরিত্রও আজি সেখানে অক্ষুণ্ণ হইয়া বিরাজ করিতেছে! হা ভগবান্! কোথায় সেই চরিত্র? কোথায় সেই জীবন্ত ধর্ম্ম আমাদের এই সমস্ত প্রাচীন নিভৃত গ্রামগুলিতে! ধর্ম্মের প্রাণটাই যদি আকর্ষণ করিয়া লইয়াছে, তাহার মৃতদেহটাকে ফেলিয়া রাখিয়াছে কেন? এই বিবর্ণ বিকৃত শবদেহটাকেই হতভাগ্য গ্রাম্য-সমাজ যে যথার্থ ধর্ম্ম বলিয়া প্রাণপণে জড়াইয়া ধরিয়া, তাহারি বিষাক্ত পূতিগন্ধময় পিচ্ছিলতায় অহর্নিশি অধঃপথেই নামিয়া চলিতেছে! অথচ সর্ব্বাপেক্ষা মর্ম্মান্তিক পরিহাস এই যে, জাতিধর্ম্ম নাই বলিয়া সহরের প্রতি ইহাদের অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধারও অন্ত নাই!
রমেশ বাড়ীতে পা দিতেই দেখিল, প্রাঙ্গণের একধারে একটি প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক একটি এগারো বারো বছরের ছেলেকে লইয়া জড়সড় হইয়া বসিয়াছিল, উঠিয়া দাঁড়াইল। কিছু না জানিয়া শুধু ছেলেটির মুখ দেখিয়াই রমেশের বুকের ভিতরটা যেন কাঁদিয়া উঠিল। গোপাল সরকার চণ্ডীমণ্ডপের বারান্দায় বসিয়া লিখিতেছিল; উঠিয়া আসিয়া কহিল,—“ছেলেটি দক্ষিণপাড়ার দ্বারিক ঠাকুরের ছেলে। আপনার কাছে কিছু ভিক্ষার জন্য এসেচে।” ভিক্ষার নাম শুনিয়াই রমেশ জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, “আমি কি শুধু ভিক্ষা দিতেই বাড়ী এসেচি, সরকার মশায়? গ্রামে কি আর লোক নেই?” গোপাল সরকার একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিল, “সে ত ঠিক কথা বাবু! কিন্তু কর্ত্তা ত কখনও কারুকে ফেরাতেন না; তাই, দায়ে পড়লেই, এই বাড়ীর দিকেই লোকে ছুটে আসে।” ছেলেটির পানে চাহিয়া প্রৌঢ়াটিকেই উদ্দেশ করিয়া বলিল,—“হাঁ কামিনীর মা, এদের দোষও ত কম নয়, বাছা! জ্যান্ত থাক্তে প্রায়শ্চিত্ত ক’রে দিলে না, এখন মড়া যখন ওঠে না, তখন টাকার জন্য ছুটে বেড়াচ্চে! ঘরে ঘটিটা বাটিটাও কি নেই বাপু?” কামিনীর মা জাতিতে সদ্গোপ। এই ছেলেটির প্রতিবেশী। মাথা নাড়িয়া বলিল,—“বিশ্বেস না হয়, বাপু, গিয়ে দেখ্বে চল। আমার কিছু থাক্লেও কি মরা বাপ ফেলে একে ভিক্ষে কর্তে আনি? চোখে না দেখ্লেও শুনেচ ত সব? এই ছমাস ধ’রে আমার যথাসর্ব্বস্ব এই জন্যই ঢেলে দিয়েচি। বলি, ঘরের পাশে বামুনের ছেলেমেয়ে না খেতে পেয়ে মর্বে!” রমেশ এই ব্যাপারটা কতক যেন অনুমান করিতে পারিল। গোপাল সরকার তখন বুঝাইয়া কহিল,—“এই ছেলেটির বাপ—দ্বারিক চক্রবর্ত্তী, ছয়মাস হইতে কাসরোগে শয্যাগত থাকিয়া, আজ ভোরবেলায় মরিয়াছে; প্রায়শ্চিত্ত হয় নাই বলিয়া, কেহ শবস্পর্শ করিতে চাহিতেছে না—এখন সেইটা করা নিতান্ত প্রয়োজন। কামিনীর মা গত ছয়মাসকাল তাহার সর্ব্বস্ব এই নিঃস্ব ব্রাহ্মণ-পরিবারের জন্য ব্যয় করিয়া ফেলিয়াছে; আর তাহারও কিছু নাই। সেই জন্যে ছেলেটিকে লইয়া আপনার কাছে আসিয়াছে।” রমেশ খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বেলা ত প্রায় দুটো বাজে। যদি প্রায়শ্চিত্ত না হয়, মড়া পড়েই থাকবে?” সরকার হাসিয়া কহিল, “উপায় কি বাবু? অশাস্তর কাজ ত আর হ’তে পারে না। আর এতে পাড়ার লোককেই বা দোষ দেবে কে, বলুন—যা হোক্, মড়া প’ড়ে থাক্বে না; যেমন ক’রে হোক, কাজটা ওদের কর্তেই হবে। তাই ত ভিক্ষে—হাঁ কামিনীর মা, আর কোথাও গিয়েছিলে?” ছেলেটি মুঠা খুলিয়া একটি সিকি ও চারিটি পয়সা দেখাইল। কামিনীর মা কহিল, “সিকিটি মুখুয্যেরা দিয়েচে, আর পয়সা চারটি হালদার মশাই দিয়েচেন। কিন্তু যেমন ক’রে হোক ন’সিকের কমে ত হবে না! তাই, বাবু যদি”—রমেশ তাড়াতাড়ি কহিল, “তোমরা বাড়ী যাও বাপু, আর কোথাও যেতে হবে না! আমি এখনি সমস্ত বন্দোবস্ত ক’রে, লোক পাঠিয়ে দিচ্চি।” তাদের বিদায় করিয়া দিয়া রমেশ, গোপাল সরকারের মুখের প্রতি অত্যন্ত ব্যথিত দুই চক্ষু তুলিয়া প্রশ্ন করিল,—“এমন গরীব এ গাঁয়ে আর কয়ঘর আছে, জানেন আপনি?” সরকার কহিল,—“দু’তিন ঘর আছে, বেশী নেই। এদেরও মোটা ভাত-কাপড়ের সংস্থান ছিল, বাবু, শুধু একটা চালদা গাছ নিয়ে মামলা ক’রে দ্বারিক চক্কোত্তি আর সনাতন হাজরা, দু’ঘরেই বছরপাঁচেক আগে শেষ হ’য়ে গেল।” গলাটা একটু খাটো করিয়া কহিল,—“এতদূর গড়াত না, বাবু, শুধু আমাদের বড় বাবু, আর গোবিন্দ গাঙুলীই, দু’জনকেই নাচিয়ে তুলে এতটা ক’রে তু্ল্লেন।” “তার পরে?” সরকার কহিল,—“তার পর, আমাদের বড়বাবুর কাছেই দুঘরের গলা পর্য্যন্ত এতদিন বাঁধা ছিল। গত বৎসর উনি সুদে-আসলে সমস্তই কিনে নিয়েচেন। হাঁ, চাষার মেয়ে বটে ওই কামিনীর মা! অসময়ে বামুনের যা কর্লে, এমন দেখ্তে পাওয়া যায় না।” রমেশ, একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিয়া রহিল। তার পর, গোপাল সরকারকে সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া দিবার জন্য পাঠাইয়া দিয়া, মনে মনে বলিল,—“তোমার আদেশই মাথায় তুলে নিলাম, জ্যাঠাইমা! মরি এখানে, সেও ঢের ভাল, কিন্তু এ দুর্ভাগ্য গ্রামকে ছেড়ে আর কোথাও যেতে চাইব না।”