পল্লী-সমাজ/দশম পরিচ্ছেদ
মাস তিনেক পরে একদিন সকালবেলা তারকেশ্বরের যে পুষ্করিণীটিকে দুধপুকুর বলে, তাহারই সিঁড়ির উপর একটি রমণীর সহিত রমেশের একেবারে মুখোমুখি দেখা হইয়া গেল। ক্ষণকালের জন্য সে এম্নি অভিভূত, অভদ্রভাবে তাহার অনাবৃত মুখের পানে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল যে, তাহার তৎক্ষণাৎ পথ ছাড়িয়া সরিয়া যাইবার কথা মনেই হইল না। মেয়েটির বয়স, বোধ করি, কুড়ির অধিক নয়। স্নান করিয়া উপরে উঠিতেছিল। তাড়াতাড়ি হাতের জলপূর্ণ ঘটিটি নামাইয়া রাখিয়া সিক্ত বসনতলে দুই বাহু বুকের উপর জড় করিয়া, মাথা হেঁট করিয়া মৃদুকণ্ঠে কহিল,—“আপনি এখানে যে?” রমেশের বিস্ময়ের অবধি ছিল না; কিন্তু তাহার বিহ্বলতা ঘুঁচিয়া গেল। একপাশে সরিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি আমাকে চেনেন?” মেয়েটি কহিল,—“চিনি। আপনি কখন্ তারকেশ্বরে এলেন?” রমেশ কহিল, “আজই ভোরবেলা। আমার মামার বাড়ী থেকে মেয়েদের আস্বার কথা ছিল, কিন্তু তাঁরা আসেন নি।” “এখানে কোথায় আছেন?” রমেশ কহিল,—“কোথাও না। আমি আর কখনো এখানে আসিনি। কিন্তু আজকের দিনটা কোনমতে কোথাও অপেক্ষা ক’রে থাকতেই হবে। যেখানে হোক, একটা আশ্রয় খুঁজে নেব।” “সঙ্গে চাকর আছে ত?” “না, আমি একাই এসেছি।” “বেশ যা হোক্” বলিয়া মেয়েটি হাসিয়া হঠাৎ মুখ তুলিতেই, আবার দুজনের চোখোচোখি হইল। সে চোখ নামাইয়া লইয়া মনে মনে, বোধ করি একটু ইতস্ততঃ করিয়া শেষে কহিল, “তবে আমার সঙ্গেই আসুন” বলিয়া ঘটিটি তুলিয়া লইয়া অগ্রসর হইতে উদ্যত হইল। রমেশ বিপদে পড়িল। কহিল,—“আমি যেতে পারি, কেন না, এতে দোষ থাক্লে আপনি কখনই ডাক্তেন না। আপনাকে আমি যে চিনি না, তাও নয়; কিন্তু কিছুতেই স্মরণ কর্তে পাচ্ছিনে। আপনার পরিচয় দিন।” “তবে মন্দিরের বাইরে একটু অপেক্ষা করুন, আমি পূজোটা সেরে নিই। পথে যেতে যেতে আমার পরিচয় দেব” বলিয়া মেয়েটি মন্দিরের দিকে চলিয়া গেল। রমেশ মুগ্ধের মতো চাহিয়া রহিল। এ কি ভীষণ, উদ্দাম যৌবনশ্রী ইহার আর্দ্র বসন বিদীর্ণ করিয়া বাহিরে আসিতে চাহিতেছিল। তাহার মুখ, গঠন, প্রতি পদক্ষেপ পর্য্যন্ত রমেশের পরিচিত; অথচ, বহুদিনরুদ্ধ স্মৃতির কবাট কোনমতেই তাহাকে পথ ছাড়িয়া দিল না। আধঘণ্টা পরে পূজা সারিয়া মেয়েটি আবার যখন বাহিরে আসিল, রমেশ আর একবার তাহার মুখ দেখিতে পাইল; কিন্তু তেমনই অপরিচয়ের দুর্ভেদ্য প্রাকারের বাহিরে দাঁড়াইয়া রহিল। পথে চলিতে চলিতে রমেশ জিজ্ঞাসা করিল,—“সঙ্গে আপনার আত্মীয় কেউ নেই?” মেয়েটি উত্তর দিল,—“না। দাসী আছে, সে বাসায় কাজ কর্চে। আমি প্রায়ই এখানে আসি, সমস্তই চিনি।” “কিন্তু, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্চেন কেন?” মেয়েটি খানিকক্ষণ চুপ করিয়া পথ চলিবার পরে বলিল,—“নইলে আপনার খাওয়া-দাওয়ার ভারি কষ্ট হ’ত। আমি রমা।”
সম্মুখে বসিয়া আহার করাইয়া, পান দিয়া বিশ্রামের জন্য নিজের হাতে সতরঞ্চি পাতিয়া দিয়া, রমা কক্ষান্তরে চলিয়া গেল। সেই শয্যায় শুইয়া পড়িয়া চক্ষু মুদিয়া, রমেশের মনে হইল, তাহার এই তেইশবর্ষব্যাপী জীবনটা এই একটা বেলার মধ্যে যেন আগাগোড়া বদলাইয়া গেল। ছেলেবেলা হইতেই তাহার বিদেশে পরাশ্রয়ে কাটিয়াছে। খাওয়াটার মধ্যে ক্ষুন্নিবৃত্তির অধিক আর কিছু যে কোনো অবস্থাতেই থাকিতে পারে, ইহা সে জানিতই না। তাই, আজিকার এই অচিন্তনীয় পরিতৃপ্তির মধ্যে তাহার সমস্ত মন বিস্ময়ে, মাধুর্য্যে, একেবারে ডুবিয়া গেল। রমা বিশেষ কিছুই এখানে তাঁহার আহারের জন্য সংগ্রহ করিতে পারে নাই। নিতান্তই সাধারণ ভোজ্য ও পেয় দিয়া তাঁহাকে খাওয়াইতে হইয়াছে। এই জন্য তাহার বড় ভাবনা ছিল, পাছে তাঁহার খাওয়া না হয় এবং পরের কাছে নিন্দা হয়। হায় রে পর! হায় রে তা’দের নিন্দা! খাওয়া না হইবার দুর্ভাবনা যে তাহার নিজেরই কত আপনার এবং সে যে তাহার অন্তরের অন্তরতম গহ্বর হইতে অকস্মাৎ জাগিয়া উঠিয়া, তাহার সর্ব্ববিধ দ্বিধা-সঙ্কোচ সজোরে ছিনিয়া লইয়া, এই খাওয়ার জায়গায় তাহাকে ঠেলিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিল, এ কথা কেমন করিয়া আজ সে তাহার নিজের কাছে লুকাইয়া রাখিবে। আজ ত কোন লজ্জার বাধাই তাহাকে দূরে রাখিতে পারিল না। এই আহার্য্যের স্বল্পতার ত্রুটি শুধু যত্ন দিয়া পূর্ণ করিয়া লইবার জন্যই সে সুমুখে আসিয়া বসিল। আহার নির্ব্বিঘ্নে সমাধা হইয়া গেলে, গভীর পরিতৃপ্তির যে নিশ্বাসটুকু রমার নিজের বুকের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল, তাহা রমেশের নিজের চেয়ে যে কত বেশি, তাহা আর কেহ যদি না জানিল, যিনি সব জানেন, তাঁহার কাছে ত গোপন রহিল না।
দিবানিদ্রা রমেশের অভ্যাস ছিল না। তাহার সুমুখের ছোট জানালার বাহিরে নববর্ষার ধূসর-শ্যামল-মেঘে মধ্যাহ্ন-আকাশ ভরিয়া উঠিয়াছিল; অর্দ্ধ-নিমীলিত চক্ষে সে তাহাই দেখিতেছিল। তাহার আত্মীয়গণের আসা না আসার কথা আর তাহার মনেই ছিল না। হঠাৎ রমার মৃদুকণ্ঠ তাহার কানে গেল। সে দরজার বাহিরে দাঁড়াইয়া বলিতেছিল,—“আজ যখন বাড়ী যাওয়া হবে না, তখন এইখানেই থাকুন!” রমেশ তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিয়া বলিল,—“কিন্তু যাঁর বাড়ী, তাঁকে এখনো ত দেখ্তে পেলাম না। তিনি না বল্লে থাকি কি ক’রে?” রমা সেইখানে দাঁড়াইয়াই প্রত্যুত্তর করিল,—“তিনিই বল্চেন থাক্তে। এ বাড়ী আমার।” রমেশ বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিল,—“এ স্থানে বাড়ী কেন?” রমা বলিল, —“এ স্থানটা আমার খুব ভাল লাগে। প্রায়ই এসে থাকি। এখন লোক নেই বটে, কিন্তু, এমন সময় হয় যে, পা-বাড়াবার জায়গা থাকে না।” রমেশ কহিল, “বেশ ত, তেমন সময় নাই এলে?” রমা নীরবে একটু হাসিল। রমেশ পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, “তারকনাথ ঠাকুরের উপর, বোধ করি, তোমাদের খুব ভক্তি, না?” রমা বলিল,—“তেমন ভক্তি আর কই? কিন্তু যতদিন বেঁচে আছি, চেষ্টা কর্তে হবে ত।” রমেশ আর কোন প্রশ্ন করিল না। রমা সেইখানেই চৌকাঠ ঘেঁসিয়া বসিয়া পড়িয়া, অন্য কথা পাড়িল, জিজ্ঞাসা করিল,—“রাত্রে আপনি কি খান?” রমেশ হাসিয়া কহিল, “যা’ জোটে তাই খাই। আমার খেতে বস্বার আগের মুহুর্ত্ত পর্য্যন্ত কখনো খাবার কথা মনে হয় না। তাই, বামুনঠাকুরের বিবেচনার উপরেই আমাকে সন্তুষ্ট থাক্তে হয়।” রমা কহিল,—“এত বৈরাগ্য কেন?” ইহা প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ কিংবা সরল পরিহাস মাত্র, তাহা রমেশ ঠিক বুঝিতে পারিল না। সংক্ষেপে জবাব দিল,—“না। এ শুধু আলস্য।” “কিন্তু, পরের কাজে ত আপনার আলস্য দেখিনে?” রমেশ কহিল,—“তার কারণ আছে। পরের কাজে আলস্য কর্লে ভগবানের কাছে জবাবদিহিতে পড়্তে হয়। নিজের কাজেও হয় ত হয়, কিন্তু নিশ্চয়ই অত নয়।” রমা একটুখানি মৌন থাকিয়া কহিল,—“আপনার টাকা আছে, তাই আপনি পরের কাজে মন দিতে পারেন; কিন্তু যাদের নেই?” রমেশ বলিল,—“তাদের কথা জানিনে রমা! কেন না, টাকা থাকারও কোন পরিমাণ নেই, মন দেবারও কোন ধরাবাঁধা ওজন নেই। টাকা থাকা না থাকার হিসেব তিনিই জানেন, যিনি ইহ-পরকালের ভার নিয়েচেন।” রমা ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল,—কিন্তু, পরকালের চিন্তা কর্বার বয়স ত আপনার হয় নি। আপনি আমার চেয়ে শুধু তিন বছরের বড়।” রমেশ হাসিয়া বলিল,—তার মানে, তোমার আরও হয় নি। ভগবান্ তাই করুন, তুমি দীর্ঘজীবী হ’য়ে থাক; কিন্তু, আমি নিজের সম্বন্ধে আজই যে আমার শেষ দিন নয়, এ কথা কখনও মনে করিনে।” তাহার কথার মধ্যে যেটুকু প্রচ্ছন্ন আঘাত ছিল, তাহা বোধ করি, বৃথা হয় নাই। একটুখানি স্থির থাকিয়া রমা হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিল,—“আপনাকে সন্ধ্যে-আহ্নিক কর্তে ত দেখলুম না। মন্দিরের মধ্যে কি আছে না আছে, তা’ না হয় নাই দেখ্লেন, কিন্তু খেতে ব’সে গণ্ডূষ করাটাও কি ভুলে গেছেন?” রমেশ মনে মনে হাসিয়া বলিল,—“ভুলিনি বটে, কিন্তু ভুল্লেও কোন ক্ষতি বিবেচনা করিনে। কিন্তু, এ কথা কেন?” রমা বলিল,—“পরকালের ভাবনাটা আপনার খুব বেশী কি না, তাই জিজ্ঞেসা কর্চি।” রমেশ ইহার জবাব দিল না; তার পর কিছুক্ষণ পর্য্যন্ত দুই জনে চুপ করিয়া রহিল। রমা আস্তে আস্তে বলিল,—“দেখুন, আমাকে দীর্ঘজীবী হ’তে বলা শুধু অভিশাপ দেওয়া। আমাদের হিন্দুর ঘরে বিধবার দীর্ঘজীবন কোন আত্মীয় কোন দিন কামনা করে না।” বলিয়া আবার একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল,—“আমি মর্বার জন্যে যে পা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছি, তা সত্যি নয় বটে, কিন্তু বেশীদিন বেঁচে থাক্বার কথা মনে হ’লেও আমাদের ভয় হয়। কিন্তু আপনার সম্বন্ধেও ত সে কথা খাটে না! আপনাকে জোর ক’রে কোনও কথা বলা আমার পক্ষে প্রগল্ভতা; কিন্তু, সংসারে ঢুকে যখন পরের জন্যে মাথাব্যথা হওয়াটা নিজেরই নিতান্তই ছেলেমানুষি ব’লে মনে হবে, তখন আমারই এই কথাটি স্মরণ কর্বেন।” প্রত্যুত্তরে রমেশ শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেলিল। খানিক পরে রমার মতই ধীরে ধীরে বলিল,—“কিন্তু তোমাকে স্মরণ ক’রে বল্চি, আজ আমার এ কথা কোন মতেই মনে হচ্চে না। আমি তোমার ত কেউ নই রমা, বরং তোমাদের পথের কাঁটা। তবু প্রতিবেশী ব’লে আজ তোমার কাছে যে যত্ন পেলুম, সংসারে ঢুকে এ যত্ন যারা আপনার লোকের কাছে নিত্য পায়, আমার ত মনে হয়, পরের দুঃখ-কষ্ট দেখ্লে তারা পাগল হয়ে ছোটে। এইমাত্র আমি একা ব’সে চুপ ক’রে ভাব্ছিলুম, আমার সমস্ত জীবনটি যেন তুমি এই একটা বেলার মধ্যে আগাগোড়া বদ্লে দিয়েচ। এমন ক’রে আমাকে কেউ কখনো খেতে বলেনি, এত যত্ন কোরে আমাকে কেউ কোন দিন খাওয়ায়নি। খাওয়ার মধ্যে যে এত আনন্দ আছে, আজ তোমার কাছ থেকে এই প্রথম জান্লাম রমা।” কথা শুনিয়া রমার সর্ব্বাঙ্গ কাঁটা দিয়া বারংবার শিহরিয়া উঠিল; কিন্তু সে তৎক্ষণাৎ স্থির হইয়া বলিল,—“এ ভুল্তে আপনার বেশী দিন লাগ্বে না। যদি বা একদিন মনেও পড়ে, অতি তুচ্ছ ব’লেই মনে পড়্বে।”
রমেশ কোন উত্তর করিল না। রমা কহিল,—“দেশে গিয়ে যে, নিন্দে করবেন না, এই আমার ভাগ্য।” রমেশ আবার একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া ধীরে ধীরে বলিল,—“না রমা, নিন্দেও কর্ব না, সুখ্যাতি করেও বেড়াব না। আজকের দিনটা আমার নিন্দা-সুখ্যাতির বাহিরে।” রমা কোন প্রত্যুত্তর না করিয়া, খানিকক্ষণ স্থির হইয়া বসিয়া থাকিয়া, নিজের ঘরে উঠিয়া চলিয়া গেল। সেখানে নির্জ্জন ঘরের মধ্যে তাহার দুই চক্ষু বাহিয়া বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা টপ্-টপ্ করিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল।