পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি

পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি

বিশ্বযাত্রী রবীন্দ্রনাথ

পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ

কলিকাতা

‘যাত্রী’ গ্রন্থের অন্তর্গত
প্রকাশ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৬
সংস্করণ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪২
পুনর্‌মুদ্রণ কার্তিক ১৩৫৩

...

রবীন্দ্র-শতবর্ষ-পূর্তি উপলক্ষে স্বতন্ত্র গ্রন্থরূপে প্রকাশ
শ্রাবণ ১৩৬৮
পুনর্‌মুদ্রণ ভাদ্র ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক

© বিশ্বভারতী

১৩৩৬ জৈষ্ঠে ‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি’ ও ‘জাভা-যাত্রীর পত্র’ উভয়ের সমাহারে ‘যাত্রী’ গ্রন্থের প্রকাশ। বিষয়বস্তু এবং রচনাকাল উভয়েই ভিন্ন; এজন্য রবীন্দ্র-শতবর্ষ-পূর্তি উপলক্ষে ‘বিশ্বযাত্রী রবীন্দ্র- নাথ’ গ্রন্থমালার দুটি স্বতন্ত্র গ্রন্থরূপেই ‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি’ এবং ‘জাভা-যাত্রীর পত্র’ প্রচার করা হইল।

 এই গ্রন্থমালায় অনুরূপ অন্যান্য গ্রন্থ প্রকাশিত হইতেছে।

চিত্রসূচী

সম্মুখীন পৃষ্ঠা
রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৪
আখ্যাপত্র
‘সাবিত্রী’-রচনা-নিরত-রবীন্দ্রনাথ
১৭
নন্দিনী-সহ-রবীন্দ্রনাথ
৮৮

গ্রন্থপরিচয়

১৯৩৬ সালের জ্যৈষ্ঠে যাত্রী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। উহার পূর্বোত্তর ভাগে যথাক্রমে ‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি’ (সেপ্টেম্বর ১৯২৪—ফেব্রুয়ারি ১৯২৫) এবং ‘জাভাযাত্রীর পত্র’ (জুলাই—অক্টোবর ১৯২৭) সংকলিত হয়। প্রসঙ্গ এক নহে, রচনাকালও ভিন্ন, এজন্য রবীন্দ্রশতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে বর্তমানে রচনা-দুইটি পৃথক দুইখানি গ্রন্থের আকারে প্রকাশ করা হইল।

 ‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি’ অংশ প্রবাসীতে অগ্রহায়ণ ১৩৩১ হইতে জ্যৈষ্ঠ ১৩৩২ পর্যন্ত বিভিন্ন সংখ্যায় প্রথম মুদ্রিত হইয়াছিল। ১৩৩৩ সালের ফাল্গুনের প্রবাসীতে উক্ত ডায়ারির কিছু নূতন অংশ ‘উদ্‌বৃত্ত’ নামে এবং যাত্রীর প্রথম সংস্করণে ‘পরিশিষ্ট’রূপে (পৃ ১৩৫—১৬২) মুদ্রিত হয়। উহার মুখবন্ধস্বরূপ রবীন্দ্রনাথ প্রবাসীতে লিখিয়াছিলেন—

 গাছতলায় শুকনো পাতার নীচে ঝড়ে-পড়া কাঁচাপাকা ফল কিছু-না-কিছু পাওয়া যায়। আমার আবর্জিত ছিন্ন পাতার মধ্য থেকে যে লেখার টুকরোগুলি আমার তরুণ বন্ধু[] কুড়িয়ে পেয়েছেন, মনে হচ্ছে, সেগুলি সাহিত্যের ভোজে ব্যবহার করার বাধা নেই। তাই তিনি যখন ভাণ্ডারে তোলবার প্রস্তাব করলেন আমি সন্মতি দিলাম।

—প্রবাসী। ফাল্গুন ১৩৩৩


 যাত্রীর দ্বিতীয় সংস্করণে (১৩৪২ জ্যৈষ্ঠ) উক্ত উদ্‌বৃত্ত লেখাগুলি ‘পরিশিষ্ট অংশে না রাখিয়া তাহাদের রচনার তারিখ অমূসারে ডায়ারির ভিন্ন ভিন্ন স্থানে সন্নিবেশিত করা হইয়াছিল। বর্তমান গ্রন্থে প্রথম-সংস্করণ যাত্রীর অণুসরণ করা হইয়াছে।

 রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ আমেরিকা যাত্রা করেন। “তাদের শতবার্ষিক উৎসবে যোগ দেবার জন্যে”, এবং ১৯২৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

 বর্তমান ডায়ারির ২৮ বা ২৯ সেপ্টেম্বর (১৯২৪) তারিখের লেখায় ‘ শুভ-ইচ্ছা-পূর্ণ যে চিঠির উল্লেখ আছে তাহা পূরবীর ‘শিলংয়ের চিঠি’ কবিতার উদ্দিষ্টা শ্রীমতী নলিনীদেবী লিখিয়াছিলেন। এই চিঠির জবাবে রবীন্দ্রনাথ যাহা লেখেন, ১৩৪৯ আশ্বিনের ‘অলকা’ মাসিকপত্র হইতে তাহা এ স্থলে সংকলন করা গেল—

কল্যাণীয়াসু,

 কলম্বোতে এসে যাত্রার আগের দিনেই তোমার সুন্দর চিঠিখানি পেয়ে বড়ো খুশি হয়েছি। আজ সকালে এসে পৌঁছলুম। তখন থেকে আকাশ মেঘে অন্ধকার। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি পড়ছে, আর বাদলা হাওয়া খামকা হাহুতাশ করে উঠছে। যাত্রার পূর্বে এরকম দুর্যোগে মনের উৎসাহ কমে। যায়—সূর্যকিরণ না পেলে মনে হয় যেন আকাশের দৈববাণী থেকে বঞ্চিত হলুম। এমন সময় তোমার চিঠি আমার হাতে এল, মনে হল বাংলাদেশ যেন একটি বাঙালি মেয়ের কণ্ঠে আমার কাছে জয়ধ্বনি পাঠিয়ে দিলেন। এই বৃষ্টিবাদলের পর্দার ভিতর থেকে বাংলার অন্তঃপুরের শাঁখ বেজে উঠল। যিনি সকল শুভ বিধান করেন তোমার শুভকামনা নিশ্চয় তাঁর কাছে গিয়ে পৌঁছবে, আমার যাত্রা সফল হবে।

 এবারে কলকাতা থেকে বেরোবার আগে আমার চারি দিকে যেমন ছিল ভিড় তেমনি আমার দেহে মনে ছিল ক্লান্তি। আস নি ভালোই করেছ, কেননা তোমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলা অসম্ভব হত। তুমি হয়তো ভাবছ আমি ভারী অহংকারী— ছোটো মেয়েদের ছোটো বলে খাতির করি নে। ভারী ভুল, আমি বড়োদের ভয় করি, তাদের সব কথা বিশ্বাস করি নে— আমার অন্তরের শ্রদ্ধা ছোটোদের দিকে। আমার কেবল ভয় পাছে আমার পাকা দাড়ি দেখে অকস্মাৎ তারা আমাকে নারদঋষির মতো ভক্তিভাজন মনে করে বসে।

 কিন্তু যাই বলো, আমি ডায়ারি লিখতে পারব না। আমি ভারী কুঁড়ে। চিঠি লেখার, ডায়ারি লেখার, একটা বয়স আছে; সে বয়স আমার কেটে গেছে। কিন্তু, অল্প বয়সেও আমি ডায়ারি লিখি নি। যে-সব কথা ভুলে যাবার সে-সব কথা জমিয়ে রাখবার চেষ্টাই করি নি; যে-সব কথা না ভোলবার সে-সব তো মনে আপনিই আঁকা থাকে।

 সময় পেলে তোমার সঙ্গে দু ঘণ্টা তিন ঘণ্টা ধ’রে গল্প করতে রাজি আছি। অবশ্য, তোমাকেই থেকে থেকে তার ধুয়ো ধরিয়ে দিতে হবে।

 গল্প বলার চেয়ে গল্প শুনতেই ভালোবাসি, যদি গল্প বলার গলাটি মিষ্ট থাকে। অভি[] ব’লে আমার একটি ভাইঝি ছিল, তার গলা ছিল খুব মিষ্টি। একদিন কী একটা কারণে আমার খুব রাগ হয়েছিল, অভি এসে আমার চৌকির পিছনে দাঁড়িয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঠিক সেই সময়ে যা-তা বকে গেল; এক মুহূর্তে আমার সমস্ত রাগ জুড়িয়ে গেল। সে আজ অনেক দিনের কথা, কিন্তু আজও মনে আছে। তারই মুখে রূপকথা শুনে আমি ‘সোনার তরী’তে বিম্ববতীর গল্প লিখেছিলেম। সে অনেক দিন হল মারা গেছে। এখন আমার কাছে অনেকে তর্ক করতে আসে, গম্ভীর বাজে কথা আলাপ করতে চায়, কিন্তু অনেক দিন তেমন করে গল্প কেউ বলে নি। আমি ফিরে এলে দু ঘণ্টা ধরে গল্প করবে বলেছ, ভয় হয় পাছে ততদিনে তুমি বেশি বড়ো হয়ে গম্ভীর হয়ে যাও। লোভ হচ্ছে শিগ্‌গির ফিরে আসতে। কিন্তু ও দিকে তোমার শুভকামনা সব জায়গায় সম্পূর্ণ সফল করতে তো দেরি হবে। এই দ্বিধায় রইলুম। ফিরে এলে দ্বিধা কাটবে, ইতিমধ্যে আমার অন্তরের আশীর্বাদ গ্রহণ করো। ইতি

 ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯২৪

পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি ও পূরবী

পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি ও পূরবীর মুখ্য কবিতাগুলি (কালক্রম-অনুসারে ‘পথিক’ অংশে সন্নিবিষ্ট) একই সময়ে লেখা এবং এরূপ বলিলে ভুল হইবে না যে, উভয় রচনাতে একই প্রকার মানসিক অবস্থার প্রতিফলন হইয়াছে। প্রবাসী পত্রে পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারির ধারাবাহিক প্রকাশ-কালে সমকালীন বহু কবিতাই ডায়ারির অন্তর্গতভাবে মুদ্রিত হইয়াছিল। জিজ্ঞাসু পাঠক পূরবী ও পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি মিলাইয়া পড়িলে বিশেষ উপকৃত হইবেন মনে হয়। এ স্থলে এই তথ্যটুকুর উল্লেখ করা যায় যে, ডায়ারির রচনা ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯২৪ হইতে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ তারিখ অবধি, আর কবিতা রচনার ব্যাপ্তিকাল ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯২৪ হইতে ২৪ জানুয়ারি ১৯২৫ পর্যন্ত। পূরবীর ‘পথিক’ অংশের প্রথম কবিতা ‘সাবিত্রী’র শেষে ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখ থাকিলেও, উহার সূচনা যে ২৫ সেপ্টেম্বরের বিকালে তাহা ডায়ারি হইতেই জানা যায়। বোধ করি ১ অক্টোবর ১৯২৪ তারিখের ‘আহ্বান’ কবিতার মানসিক পটভূমি সবটাই পাওয়া যায় ২৮, ২৯, ৩০ সেপ্টেম্বরের দিনলিপিতে, অপর পক্ষে ‘লিপি' কবিতার জন্মকথাও ৩ অক্টোবরের দিনলিপিতে পরিষ্কার লিপিবদ্ধ হইয়াছে। বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, ৭ অক্টোবর ১৯২৪ তারিখের পর দীর্ঘকাল ফাঁক দিয়া আবার দিনলিপি শুরু হইয়াছে ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ তারিখে এবং আর বেশি দিন লেখাও হয় নাই। রবীন্দ্রনাথের অনভ্যস্ত ডায়ারি-লেখায় ছেদ পড়িলেও, এই সময়ে কবিতা রচনা প্রায় অবিচ্ছেদে চলিয়াছিল তাহার সাক্ষ্য আছে পূরবীর ‘অপরিচিতা’ (১৮ অক্টোবর ১৯২৪) হইতে ‘ইটালিয়া (২৪ জানুয়ারি ১৯২৫) পর্যন্ত মোট ৫৪টি কবিতায়; কবিতা-রচনায় বিশেষ আবিষ্টতার কারণেই ডায়ারি লেখা হয় নাই, এরূপ ও মনে করা চলিতে পারে। পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি এবং পূরবীর অন্তর্গত ‘পথিক’ কবিতাগোষ্ঠী উভয়ই পথে ও প্রবাসে লেখা ইহা লক্ষ্য করিবার বিষয়।

চিত্রপরিচয়

‘সা বি ত্রী’-রচনা-নিরত রবীন্দ্রনাথ। ফ্রান্স্‌গামী হারুনামারু জাহাজে ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২৪ তারিখের সকালে, গিরিজাপতি ভট্টাচার্য এই আলোকচিত্র গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথের এই বিদেশযাত্রাকালে তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী, শিল্পী সুরেন্দ্রনাথ কর এবং ইনি কবির সঙ্গী ছিলেন। “কাল অপরাহ্ণে আচ্ছন্ন সূর্যের উদ্দেশে” যে কবিতার সূচনা, ২৬ সেপ্টেম্বর সকালে তাহারই রচনায় কবি একান্তভাবে তন্ময় ছিলেন—গিরিজাপতিবাবু কবির সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়া তাঁহার সেই ভাব দেখিয়া তাড়াতাড়ি ক্যামেরা লইয়া আসেন এবং কামরার মধ্যে অত্যন্ত ক্ষীণালোকে প্রায় ৭ মিনিট সময়ে আট-ন ফুট দূর হইতে এই ফোটো তুলিয়াছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ‘সাবিত্রী’-রচনায় এতদূর নিবিষ্ট ছিলেন যে ঐ সময়ে মূর্তির মতোই স্থির ছিলেন এবং কক্ষের ভিতরে অন্য কাহারও উপস্থিতির বিষয় কিছুই জানিতে পারেন নাই।

 গিরিজাপতি ভট্টাচার্যের ৭ জুলাই ১৯৬০ তারিখের পত্রে এই তথ্য জানা গিয়াছে; তাঁহারই সৌজন্যে এই চিত্র মুদ্রিত হইল।

  1. অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তী
  2. অভিজ্ঞাদেবী, হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয়া কন্যা

প্রকাশক শ্রীজগদিন্দ্র ভৌমিক

বিশ্বভারতী। ৬ আচার্য জগদীশ বসু রোড। কলিকাতা ১৭

মুদ্রক স্বপ্না প্রিণ্টিং ওয়ার্কস প্রাইভেট লিমিটেড

৫২ রাজা রামমোহন রায় সরণী। কলিকাতা ৯

পরিচ্ছেদসমূহ (মূল গ্রন্থে নেই)

সূচীপত্র

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।