পাখী-পোষা
আধুনিক যুগের য়ুরোপীয় পক্ষিপালকগণকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিতে পারা যায়। প্রথম, যাঁহারা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হইয়া উদ্যান-শোভন, জীবজন্তুপালন প্রভৃতি প্রীতিপ্রদপাশ্চাত্য পক্ষিপালক ব্যাপারে লিপ্ত থাকিয়া আপনাদিগের অবসরকাল সুখে অতিবাহিত করেন। কর্ম্মহীন সুদীর্ঘ অবসরে আপনাদিগকে নিযুক্ত রাখিবার বাসনাই অনেকস্থলে তাঁহাদিগের এই প্রকার সুখদ অনুষ্ঠানের মূল। দ্বিতীয়,—আর একশ্রেণীর লোক আছেন, যাঁহারা অর্থ বা যশোলিপ্সু হইয়া পক্ষিপালনে ব্রতী হ’ন। ইঁহাদিগের চিত্ততিনটি বিভিন্ন দল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের উপভোগ বা বিজ্ঞানচর্চ্চা দ্বারা তত আকৃষ্ট হয় না, যতটা নাম এবং ধনোপার্জ্জনের তীব্র বাসনা ইঁহাদিগকে বিচিত্র ক্রিয়াকাণ্ডে প্রবর্ত্তিত করে। য়ুরোপের বিভিন্ন স্থানে পাখীদিগের প্রদর্শনীর নিমিত্ত যে সমস্ত ব্যবস্থা আছে, ঐ প্রদর্শনী কর্ত্তৃক অর্পিত পদকাদির লোভে প্রণোদিত হইয়া ইঁহারা কৃত্রিম খাদ্যাদির সাহায্যে পাখীদিগের স্বাভাবিক বর্ণের বিকৃতি[১] ঘটাইতে উদ্যত হন, এবং নিজ নিজ কূটবুদ্ধিপ্রভাবে খাঁচার বিচিত্র নির্ম্মাণ-কৌশল প্রদর্শন করিয়া সাধারণের নিকট বাহবা পাইবার প্রয়াস পাইয়া থাকেন। প্রদর্শনীকালে তাঁহদিগের উদ্ভট ক্রিয়াকলাপের প্রতি সহজেই দর্শকবৃন্দের চিত্ত আকৃষ্ট হওয়ায় যশোলাভের পন্থা সুগম হইয়া উঠে; সঙ্গে সঙ্গে বর্ণ-বৈচিত্র্যপ্রাপ্ত পক্ষীদিগকে ইঁহারা অসম্ভব দরে বিক্রয় করিবার সুযোগ পান। তৃতীয়;—এই শ্রেণীর পক্ষিপালকগণ ধন, মান বা স্বার্থের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করিয়া একাগ্রমনে বিজ্ঞানচর্চ্চায় ব্যাপৃত থাকেন। বিহঙ্গজাতির জীবন-বৈচিত্র্যের ধারা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লক্ষ্য করিয়া ইঁহারা যে সকল তথ্যে উপনীত হইতেছেন, ঐ তথ্য বা সিদ্ধান্তসমূহ তাঁহদিগের চিত্ত উদ্ভাসিত করিয়া জ্ঞানপিপাসা মুহুর্মুহুঃ জাগাইয়া তুলিতেছে। যিনি পক্ষিপালনের উদ্দেশ্য যথাযথরূপে উপলব্ধি করিতে পারিয়াছেন, তিনি যে দ্বিতীয় শ্রেণীর পক্ষিপালকগণকে নিকৃষ্ট বলিয়া গণ্য করিবেন, সে বিষয়ে আদৌ সন্দেহ নাই। এই শ্রেণীর পক্ষিপালকগণের প্রত্যেক ক্রিয়াকলাপ এত স্বার্থ-বিজড়িত যে, সেগুলি প্রদর্শনীর দর্শকবৃন্দের নিকট অত্যাশ্চর্য্য বলিয়া পরিগণিত হইলেও অনেক সময়ে তত্ত্বানুসন্ধিৎসু বৈজ্ঞানিকের তত্ত্বমীমাংসার বিঘ্ন ঘটাইবার উপক্রম করে। পরন্তু অনেক সময়ে তাহাদিগের চেষ্টা প্রকৃতির বিরুদ্ধে প্রযোজিত হইয়া থাকে এবং কখন কখন ইহাকে প্রাকৃতিক শক্তির ব্যতিক্রম[২] ঘটাইয়া কল্পিত পথে সগর্ব্বে অগ্রসর হইতে দেখা যায়। এই বিজয়দম্ভ যে বহুকালের নিমিত্ত নহে তাহা বিজ্ঞানসেবী নিঃস্বার্থ পক্ষিপালকমাত্রেই ধ্রুব জানেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা দেখিতে পাই যে, বর্ণোৎপাদক খাদ্যাদি-প্রয়োগে কেনেরী (Canary) পক্ষীর স্বাভাবিক বর্ণ সহজে বৈচিত্র্য লাভ করে; এবং যদ্যপি ঐ পক্ষীর স্বভাবসিদ্ধ দুই একটি পক্ষের বর্ণ দ্বিতীয় শ্রেণীর পক্ষিপালকগণের চক্ষে বিসদৃশ বোধ হয়, প্রদর্শনীর নিমিত্ত পাখীগুলি “প্রস্তুত” করিবার সময়ে উহা উৎপাটন করিতে তাঁহারা দ্বিধা বোধ করেন না। এই সমস্ত কৃত্রিম অনুষ্ঠান বৈজ্ঞানিকের চক্ষে বাস্তবিকই হাস্যাস্পদ; এবং সেগুলি যিনি যত্ন সহকারে অনুধাবন করিবেন, তিনি বুঝিতে পারিবেন যে, এই প্রকৃতিপরাজয়-ব্যাপার ক্ষণস্থায়ী ব্যতীত আর কিছুই নহে। কৃত্রিম উপায়ে বৈচিত্র্যপ্রাপ্ত পক্ষীর বর্ণ উহার স্বভাবগত নহে। কৃত্রিম খাদ্যাদির প্রয়োগ বন্ধ করিবামাত্র কেনেরী (Canary) পক্ষীর স্বাভাবিক বর্ণ পরিস্ফুট হইতে দেখা যায়; প্রকৃতি সজাগ হইয়া উঠে।
প্রকৃতপক্ষে পরস্পরের তুলনায় উল্লিখিত তিন শ্রেণীর পক্ষিপালকগণের ক্রিয়াকলাপ উচ্চ-নীচরূপে গণ্য হইলেও আমরা বিস্মৃত হইতে পারি না যে, তাঁহাদিগের পালনব্যাপারে সাফল্য লাভের চেষ্টায় বিজ্ঞানসেবার পথ অল্প-বিস্তরকিরূপে পক্ষিবিজ্ঞানের উন্নতিবিধান করিতেছেন সুগম হইয়া আসিতেছে। পালনব্যাপারে লিপ্ত থাকিয়া পালকেরা সবিশেষ যত্ন এবং অধ্যবসায়ের ফলে যে সমস্ত অভিজ্ঞান লাভ করিয়া বিহঙ্গ-জাতির জীবন-ঘটিত তথ্যে উপনীত হইতেছেন, ঐ তথ্যসমূহ সাধারণের গোচরীভূত করিবার সুযোগ উল্লিখিত পক্ষি-প্রদর্শনীসমূহ কর্ত্তৃক প্রদত্ত হইয়া থাকে। ক্ষীণপ্রাণ বিহঙ্গ-জীবনের খুঁটিনাটি লইয়া যে সকল সমস্যা উপস্থিত হইয়া পালকগণকে চঞ্চল করিয়া তোলে, সেগুলি যে সম্যক্রূপে মীমাংসিত হইতেছে, তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ প্রদর্শনীর পাখীরাই প্রদান করিয়া থাকে। কারণ, উহাদিগের সানন্দ লাবণ্যময় অঙ্গকান্তির দিকে তাকাইয়া দেখিলে, আবদ্ধাবস্থায় অসুস্থতানিবন্ধন শারীরিক বা মানসিক বৈপরীত্যের কিছুই নিদর্শন লক্ষিত হয় না; বরং পাখীগুলির স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য্যের বিকাশ পূর্ণমাত্রায় দেখা যায়। বলা বাহুল্য যে, এইরূপ পক্ষিজীবনের সমস্যাভঞ্জন এবং তথ্যনিরূপণের ফলে বিজ্ঞানশাস্ত্রের কলেবর উত্তরোত্তর বর্দ্ধিত হইতেছে। প্রদর্শনীকালে এই সকল নিরূপিত তথ্য দর্শকবৃন্দের যতই জ্ঞান-গোচর হয়, ততই তাঁহাদিগের চিত্ত বিহঙ্গতত্ত্বে কৌতূহল-পরবশ হইয়া বিজ্ঞান-সেবায় ধাবিত হইয়া থাকে।
তত্ত্বলাভের তীব্র বাসনা য়ুরোপীয় পালকবৃন্দকে যে কেবল দেশীয় পক্ষীর পালন-ব্যাপারে লিপ্ত রাখিতেছে তাহা নহে; তাঁহারা বহু বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া নানাবিধ বিদেশীয় পক্ষীকে সাবধানে ও সযত্নে স্বদেশে আনয়নপূর্ব্বকস্বদেশের ও বিদেশের পাখী পুষিয়া অনভ্যস্ত প্রকৃতি-প্রতিকূল জলবায়ু কৃত্রিম উপায়ে অভ্যাস করাইয়া কৃত্রিম খাদ্যাদির সাহায্যে উহাদিগের পুষ্টিসাধন করিয়া বৈদেশিক পাখীগুলির জীবন-লীলা পর্য্যবেক্ষণের যথেষ্ট অবসর পাইতেছেন। এমন কি কোন কোন তত্ত্ব-জিজ্ঞাসু[৩] কেবল বৈদেশিক পক্ষিপালনে নিযুক্ত থাকিয়া ধারাবাহিকরূপে উহার জীবনরহস্য উদ্ঘাটনের নিমিত্ত আপনাদিগের জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন। বলা বাহুল্য, পাখীগুলিকে বাঁচাইয়াপাখীর জীবনরহস্যের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা রাখিতে হইলে যে সমস্ত সমস্যা আসিয়া উপস্থিত হয়, এই সমস্যাসমূহের সম্যক্রূপে সমাধান ব্যতীত বিহঙ্গজাতির অতি সূক্ষ্ম জীবনরহস্যগুলির উদ্ঘাটনের প্রয়াস নিষ্ফল হইয়া থাকে। পূর্ব্বে আমরা য়ুরোপীয় পক্ষিপালকগণের বিচিত্র ক্রিয়াকলাপের কিঞ্চিৎ আভাস প্রদান করিয়াছি। এক্ষণে পালন সম্বন্ধে কয়েকটি সমস্যার অবতারণা করিয়া সেগুলি মীমাংসার চেষ্টা করিব।
পূর্ব্বে বলা হইয়াছে যে, পালকগণ কি প্রকার পক্ষী পালন করিতে ইচ্ছুক আছেন, তাহা অবধারণপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে পাখীদিগের রক্ষণোপযোগি স্থান-নির্ম্মাণে এবং উহার বাহ্যাভ্যন্তরীণ সজ্জা-সামগ্রীর সন্নিবেশ-ব্যাপারে যেরূপ যত্নবান হইতে হইবে, তদ্রূপ তাঁহাদিগের মনোনীত পক্ষিসমূহের সঞ্চয় এবং সেগুলির পিঞ্জর (cage) অথবা পক্ষিগৃহ (aviary) মধ্যে স্থাপন-বিষয়ে মনোযোগী হওয়া আবশ্যক। পক্ষি-মিথুন অথবা এক একটি পক্ষীকে পৃথক্ভাবে রাখিবার অনুকূল সুকৌশলে নির্ম্মিত বিবিধ পিঞ্জরসমূহের আবশ্যকতা সম্বন্ধে আমাদিগের বক্তব্য পূর্ব্বে প্রকাশ করিয়াছি। বিভিন্ন শ্রেণীর বহুবিধ পক্ষিগণের গৃহমধ্যে একত্র সমাবেশ ও সংরক্ষণ বড়ই দুরূহ সমস্যা। আকার প্রকার স্বভাবপক্ষিসংরক্ষণে প্রকৃতি ও ও শ্রেণীগত বৈলক্ষণ্যপ্রযুক্ত পাখীগুলির পরস্পর বিদ্বেষাচরণ অবশ্যম্ভাবী বলিয়া গৃহমধ্যে তাহাদের একত্র অবিমৃষ্ট সমাবেশ কখনই সম্ভবপর নহে। এই প্রকার যথেচ্ছ সংরক্ষণের ফলে দুর্ব্বল এবং ভীরুস্বভাব পক্ষিগণ বৃহৎ ও উগ্রপ্রকৃতির বিহঙ্গের তাড়নায় উপদ্রুত হইয়া অকালে কালমুখে পতিত হইতে পারে। এই নিমিত্ত হঠকারিতা পরিত্যাগপূর্ব্বক সুদক্ষ পালকগণের আয়াসলব্ধ জ্ঞানমার্গে পরিচালিত হইলে অকারণ নৈরাশ্যের তীব্রবেদনা অনুভব করিতে হয় না।
পালনাভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই অবগত আছেন যে, বিহঙ্গ-জগতে এত
প্রকার পক্ষী দৃষ্ট হয়, যাহাদিগের রুচির তারতম্যপ্রযুক্ত খাদ্যাদির পার্থক্য পরিলক্ষিত হইয়া থাকে। যদিও অধিকাংশ পক্ষী কীট-পতঙ্গ ভক্ষণ করে,রুচিবিচার তথাপি কোন বিশিষ্ট খাদ্যের উপর তাহাদিগের অধিকতর ঝোঁক দেখা যায়। বুলবুলজাতীয় পক্ষিগণ কীটাদি ভোজন করিলেও তাহারা সুপক্ব ফলের বিশেষ পক্ষপাতী; কোকিল, “বসন্ত,” “হরেওয়া” প্রভৃতি কতিপয় পক্ষীও সুপক্ব ফল খাইতে বড়ই ভালবাসে। দুর্গাটুনটুনি এবং এই জাতীয় ক্ষুদ্রকায় পক্ষী প্রজাপতি প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কীট পতঙ্গ ভক্ষণ করিলেও মধুমক্ষিকার ন্যায় মধুপানের তীব্র বাসনা হৃদয়ে পোষণ করিয়া থাকে, এবং বিধিবিনির্ম্মিত সুপটু চঞ্চপুটের সাহায্যে সরস কুসুম-নিচয় হইতে মধুপান করিয়া আপনাদিগের দেহের পুষ্টিসাধন করে। কতিপয় পক্ষী বীজাণুভোজী হইলেও তাহাদিগকে সময়ে সময়ে কীট-পতঙ্গ ভোজন করিতে দেখা যায়। কীটপতঙ্গপ্রিয় কোন কোন জাতীয় বিহঙ্গ উদর-তৃপ্তির নিমিত্ত ক্রমাগত ক্ষুদ্র কীটাদির বিনাশ সাধন পূর্ব্বক এতই হিংস্রভাবাপন্ন হইয়া উঠে যে, গৃধ্র প্রভৃতি মাংসাশী পক্ষীর ন্যায় অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রকায় ক্ষীণপ্রাণ বিহঙ্গগণকে হত্যা করিতে উদ্যত হয়। “মাছরাঙা” জাতীয় পাখীগুলি যদিও কীটাদি ভক্ষণ করে, তথাপি মৎস্যের উপর উহাদিগের অসক্তি বিশেষরূপে লক্ষিত হয়। এই সকল ভিন্নরুচি পক্ষীকে একত্র এক গৃহমধ্যে রক্ষা করা কতদূর সঙ্গত এবং সম্ভবপর, তাহা নির্ণয় করা একমাত্র অভিজ্ঞানসাপেক্ষ। মোটামুটি বলিতে গেলে, তুল্যাবয়ব এবং সমানস্বভাবের পাখীগুলিকে একত্র রক্ষা করিলে বিপদ্পাতের অতি অল্পই সম্ভাবনা। উল্লিখিত হিংস্রভাবাপন্ন কীটপতঙ্গভোজী বিহঙ্গগণকে অপরাপর নিরীহ পক্ষিসমূহের সহিত রক্ষা করা কখনই বিধেয় নহে। প্রায় দেখা যায় যে, পক্ষিপালকগণ অবয়ব এবং স্বভাবের সামঞ্জস্য সত্ত্বেও বীজাণুভোজী এবং কীটপতঙ্গভক্ষণকারী পক্ষিগণের মধ্যে পরস্পর সবিশেষ পার্থক্যবোধে উহাদিগকে একত্র রাখিতে অনিচ্ছুক। ইহা তাঁহাদিগের ভুল ধারণা মাত্র। স্বভাব এবং অবয়বের সামঞ্জস্যের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া এই দুই জাতীয় বিহঙ্গগণের একত্র সংরক্ষণ দোষাবহ নহে; কারণ সচরাচর বীজাণুভোজী পাখীকে কীট-পতঙ্গও ভক্ষণ করিতে দেখা যায়; এবং পক্ষিগৃহমধ্যস্থ কীটপতঙ্গপ্রিয় বিহঙ্গগণের নিমিত্ত যে সমস্ত কৃত্রিম খাদ্য প্রদত্ত হয়, তাহা যে বীজাণুভোজী পক্ষিসমূহের পক্ষে হিতকর, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। বস্তুতঃ ইহা তাহাদিগের সবিশেষ পুষ্টিসাধন করিয়া থাকে। টিয়া (parrot) জাতীয় বিহঙ্গগণের চঞ্চুপুট স্বভাবতঃ অতিশয় সবল এবং তীক্ষ্ণ; ইহার আঘাতে অপর পক্ষী সহজে ক্লিষ্ট ও আহত হইয়া পড়ে। এই নিমিত্ত উহাদিগকে স্বতন্ত্র গৃহে রক্ষা করা সঙ্গত।
একত্র সমাবেশকালে পাখীগুলির স্বভাব এবং দেহের আয়তনের প্রতি পালকের যেরূপ লক্ষ্য রাখা উচিত, তদ্রূপ তুল্যপ্রকৃতি ও সমান আকারের নির্ব্বাচিত পক্ষী বা পক্ষিমিথুনগুলিকে গৃহমধ্যে ছাড়িয়া দিয়া তাহাদিগের পরস্পর আচরণ প্রত্যক্ষ করা তাঁহার একটি অবশ্যকর্ত্তব্য কর্ম্ম; কারণ এই প্রকারে তিনি ভাবী বিপদ্পাত প্রতীকারের অবসর পাইয়া থাকেন। অনেক সময়ে দেখা গিয়াছে যে, পাখীগুলির স্বভাব বা শ্রেণীগত কোন প্রকার দোষ না থাকিলেও শ্রেণীমধ্যস্থ কোন এক বিশিষ্ট পক্ষীর অচিরণ অকারণ রূঢ় হইয়া থাকে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, সুকোমল-স্বভাব বুলবুলজাতীয় পক্ষিগণের মধ্যেও কোন কোনটির বিদ্বেষপ্রিয়তা লক্ষিত হয়। মানবগণের মধ্যেও এরূপ দৃষ্টান্তের অসদ্ভাব নাই।একত্র সমাবেশে বাধা এইরূপ স্থলে রূঢ়-প্রকৃতি পাখীটিকে অবিলম্বে গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করা কর্ত্তব্য; নচেৎ অন্যান্য প্রকৃতি-কোমল পক্ষিসমূহ যে ইহার দ্বারা আহত কিংবা ইহার সংস্রবে থাকিয়া স্বভাব-দুষ্ট হইবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। বীজাণুভোজী ফিঞ্চজাতীয় (finch family) বিভিন্ন শ্রেণীর পক্ষিগণকে একত্র কিংবা অপর জাতীয় তুল্যাবয়ব এবং সমানপ্রকৃতি বিহঙ্গগণের সহিত এক গৃহমধ্যে রক্ষা করিবার পূর্ব্বে উহাদিগের চঞ্চুপুটের সামর্থ্য এবং পরিমাণের প্রতি লক্ষ্য করা উচিত; কারণ পরস্পর বিবাদ বাধিলে চঞ্চপুটই তাহাদিগের অস্ত্রের কার্য্য করে। অতএব সহজেই অনুমিত হয় যে, আক্রমণ কিংবা আত্মরক্ষার সময়ে যে পাখীটির চঞ্চু তীব্র এবং সুদীর্ঘ, তাহার বিজয়লাভ অবশ্যম্ভাবী; এবং যাহাদিগের চঞ্চু অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও হীনবল, তাহারা আহত ও উপদ্রুত হইয়া থাকে। বিহঙ্গজাতির মধ্যে এরূপ পক্ষীও আছে, যাহাকে অযুগ্মাবস্থায় অপরজাতীয় পক্ষিগণের সহিত গৃহমধ্যে রাখিলে শান্ত ও সুশৃঙ্খলভাবে অবস্থান করিতে দেখা যায়; কিন্তু মিথুনাবস্থায় উক্তরূপে অপর পক্ষীর সহিত রক্ষা করিলে পক্ষিদ্বয় নিতান্ত উচ্ছৃঙ্খল হইয়া অপরাপর পাখীগুলিকে আক্রমণ করিতে থাকে। বীজাণুভোজী “ক্রস্বিল” (crossbill) পক্ষী মিথুনাবস্থায় উগ্রভাবাপন্ন হয় বলিয়া কখনই উহাকে অপর পক্ষিগণের সহিত একত্র রাখা বিধেয় নহে।
ইহাই মোটামুটি সংরক্ষণের বিধি। পাখীগুলির স্বভাব যদি সুকোমল এবং বিদ্বেষবর্জ্জিত হয়, তাহা হইলে ইহাদিগের ভিন্ন ভিন্ন খাদ্যের প্রতি রুচি অথবা অবয়বের অল্পবিস্তর প্রভেদ থাকিলেও কিছু আসে যায় না। পক্ষিভবনটি বৃহৎ এবং সুপ্রশস্ত হইলে যথেচ্ছ বিচরণ এবং অবস্থানের নিমিত্ত প্রচুর জায়গা পাইয়া পাখীদিগের পরস্পর বিবাদ ঘটিবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা থাকে না। অনেক সময়ে এইরূপ পক্ষিভবনে অবয়বের পার্থক্য সত্ত্বেও সুকোমল-স্বভাব বিহঙ্গগুলিকে একত্র রাখা বেশ চলে। কলিকাতানিবাসী শ্রীযুক্ত গোকুলচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়ের পক্ষিগৃহে অতি ক্ষুদ্রকায় দুর্গাটুনটুনি হইতে বৃহৎকায় কৃষ্ণগোকুল (Oriole) পর্যন্ত একত্র নির্ব্বিবাদে অবস্থান করিতেছে। এইরূপ গৃহমধ্যে বিবিধ পাখীগণের উপযোগী খাদ্যের প্রাচুর্য্য এবং খাদ্যপাত্রগুলির বহু স্থানে স্থাপন-বিষয়ে পালকের সবিশেষ মনোযোগ থাকা আবশ্যক।
মনোনীত পাখীগুলির একত্র সংরক্ষণ পালকের পক্ষে দুরূহ সমস্যা হইলেও আবদ্ধাবস্থায় তাহাদিগের উপযোগী খাদ্যের নির্ব্বাচন আরও দুরূহ সমস্যা; কারণ, স্বাভাবিক অবস্থায় উহারা এতপক্ষিভবনে আহার্য্য-বিচার প্রকার খাদ্য ভক্ষণ করিয়া থাকে যে ঐ খাদ্য-সামগ্রী আহরণ করা পালকের পক্ষে অসম্ভব। আবার, বিবিধ খাদ্যের মধ্যে কোন্টি পক্ষিবিশেষের প্রধান আহার, তাহার নির্ণয়ও সুকঠিন। বিহঙ্গজাতির বিবিধ খাদ্যের প্রতি আসক্তি এবং উহার রুচিভেদের আমরা কিঞ্চিৎ আভাস দিয়াছি। এখন, আবদ্ধ পাখীদিগের এই রুচিভেদের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া যে সমস্ত কৃত্রিম খাদ্য সামগ্রীর উদ্ভাবনা বা আবিষ্কার হইয়াছে, তৎসম্বন্ধে সংক্ষেপে কিছু বলিতে ইচ্ছা করি। আমাদের দেশে প্রচলিত ছাতুর ব্যবস্থার বিষয় অনেকেই অবগত আছেন; এমন কি মাংসের টুকরা ঘৃতপক্ব ছাতুর সহিত মিশ্রিতাবস্থায় কীটভোজী পক্ষিগণের আহার্য্যরূপে ব্যবহৃত হয়। এই খাদ্য-কৃত্রিমতার বৈচিত্র্য য়ুরোপেই অধিক পরিলক্ষিত হয়; তথাচ পালকগণ পাখীগুলিকে আপন উপযোগী কৃত্রিম খাদ্যের আখ্যানুরূপ অভিধা প্রদান করিয়া থাকেন। ইংলণ্ড প্রদেশে আমরা দেখিতে পাই যে, কীটপতঙ্গভোজী পাখীদের নিমিত্ত যে সকল কৃত্রিম আহার্য্যের প্রচলন আছে, তাহারা “কোমল খাদ্য” বা “soft food” নামে অভিহিত হয় এবং খাদ্যের নামানুরূপ পাখীগুলিও (যাহাদিগের নিমিত্ত এইরূপ খাদ্যের একান্ত প্রয়োজন) “কোমল-চঞ্চু” বা soft-bill আখ্যা পাইয়া থাকে। তথায় এই “কোমল খাদ্য” প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত ছাতুর পরিবর্ত্তে হংস-কুক্কুটাদি পক্ষীর সুসিদ্ধ ডিম্ব প্রধান উপকরণরূপে ব্যবহৃত হয়; অপরাপর উপকরণের মধ্যে বিস্কুটচূর্ণ এবং পিপ্ড়ার ডিম (ants’ eggs), সময়ে সময়ে বোল্তার ডিম (wasp grub) এবং মৃত শুষ্ক মক্ষিকার ব্যবহার দৃষ্ট হয়। যে সকল নানাজাতীয় শস্যবীজ বীজাণুভোজী পক্ষিগণের আহার্য্যরূপে ব্যবহৃত হয়, বীজসমূহের শক্ত খোসা ছাড়াইয়া অভ্যন্তরস্থ শস্যদানা ভক্ষণ করিতে হইলে পাখীগুলিকে তাহাদিগের সুকঠিন চঞ্চুপুটের সাহায্য সর্ব্বদাই গ্রহণ করিতে হয়। এই জাতীয় পক্ষিবৃন্দ ইংলণ্ডে “কঠিন চঞ্চু” বা “hard-bill” নামে অভিহিত হয় এবং ইহাদিগের প্রয়োজনীয় খাদ্য-সামগ্রী “hard-bill food” আখ্যা পাইয়া থাকে[৪]। আর এক প্রকার অকৃত্রিম খাদ্য এই “কঠিন-চঞ্চু” পাখীগণের স্বাস্থ্যের একান্ত অনুকূল—দূর্ব্বাঘাস, মূলা ও কপি প্রভৃতি শাকসব্জীর সুকোমল পত্রসমূহ। বিলাতে ইহারা “সবুজ খাদ্য” বা “green food” নামে পরিচিত। মানব-ভোগ্য সুমিষ্ট সুপক্ব ফল পিঞ্জর-বিহঙ্গগণের স্ব স্ব রুচি-বৈলক্ষণ্য সত্ত্বেও যে অতি উপাদেয় খাদ্য, সে বিষয়ে মতদ্বৈধ নাই। যদিও “কোমলচঞ্চু” বিহঙ্গগণের নিমিত্ত “কঠিন খাদ্যের” অবশ্যকতা প্রায় দৃষ্ট হয় না, আবদ্ধাবস্থায় সকল রকম পাখীর নিমিত্ত কিন্তু অল্পবিস্তর “কোমল খাদ্যের” প্রয়োজন; এমন কি সন্তানজননকালে (breeding time) “কঠিন-চঞ্চু” পিঞ্জর-পক্ষিগণ “কোমল খাদ্যের” সাহায্য ব্যতীত শাবক প্রতিপালনে সমর্থ হয় না। “কোমল-চঞ্চু” বিহঙ্গগুলির ত কথাই নাই। য়ুরোপে নানা প্রকার কৃত্রিম খাদ্যের নিত্য নূতন আবিষ্কার দেখিয়া সহজেই অনুমিত হয় যে, আধুনিক যুগের পক্ষিপালকগণের পালন-সাফল্য তাঁহাদিগের কৃত্রিম খাদ্যের প্রস্তুতকুশলতার উপর অধিক পরিমাণে প্রতিষ্ঠিত। একদিকে যেরূপ তত্ত্বজিজ্ঞাসু বুধমণ্ডলী মুক্ত আকাশতলে বিহঙ্গগণের স্বাধীন আহার-বিহার, হাবভাব-ভঙ্গী প্রভৃতি সূক্ষ্ম জীবনরহস্যগুলির উদ্ঘাটনের প্রয়াস পাইতেছেন, তদ্রূপ আবার আর এক সম্প্রদায় পাখীদিগের আবদ্ধ-জীবন সুদীর্ঘ এবং সুখময় করিবার নিমিত্ত তাহাদিগের উপযোগী আহার্য্য ও অপরাপর আবশ্যক উপাদান নিরূপণবিষয়ে অনন্যমনা হইয়াছেন। এইরূপে উভয় সম্প্রদায়ের সমবেত চেষ্টা এবং অভিজ্ঞানের ফলে যে সকল পক্ষীকে ইতঃপূর্ব্বে আবদ্ধাবস্থায় জীবিত রাখা একান্ত অসম্ভব বলিয়া বিবেচিত হইত, ইদানীং তাহাদিগকে স্বাভাবিক খাদ্যের অভাব সত্ত্বেও কৃত্রিম আহার্য্যের সাহায্যে অসঙ্কোচে পালন করা সম্ভবপর হইয়া উঠিতেছে। এই প্রসঙ্গে মিঃ আলফ্রেড এজ্রার (Mr. Alfred Ezra) নামোল্লেখ না করিয়া থাকিতে পারিলাম না। লণ্ডনের প্রতিকূল জলবায়ু এবং আব-হাওয়ার মধ্যে তিনি বহুক্লেশ স্বীকারপূর্ব্বক স্বভাব-চঞ্চল ও লঘুকায় দুর্গাটুনটুনির রক্ষণোপযোগী এক সুন্দর গৃহ নির্ম্মাণ করিয়াছেন।আলফ্রেড এজ্রার কৃতিত্ব নিরুপম সৌন্দর্য্যশালী এই জাতীয় পক্ষিগণের আহারবিধান এতদিন মানবের স্বপ্নাতীত ছিল। এজ্রা মহোদয় ইহাদিগের আহার্য্য এবং পালন-বিধির আবিষ্কার ও নিরূপণদ্বারা পালন-ইতিহাসের এক নূতন অধ্যায় রচনা করিতে সমর্থ হইয়াছেন। দুগ্ধ এবং মধু পিঞ্জর-টুনটুনির প্রধান খাদ্য। উষ্ণ জলের সহিত যৎসামান্য ছাতু, মধু বা শর্করা, Mellins food, condensed milk প্রভৃতি য়ুরোপীয় কৃত্রিম দুগ্ধ একত্র উত্তমরূপে মিশাইয়া যে তরল অহার্য্য প্রস্তুত হইবে, তাহাই শীতল করিয়া দুর্গাটুনটুনির বিশিষ্ট খাদ্যরূপে ব্যবহার্য্য। পিঞ্জর-বিহঙ্গগণের নিমিত্ত কৃত্রিম আহার্য্য বিধান সত্ত্বেও যে বিবিধ কীটপতঙ্গের আবশ্যকতা আছে, তাহা স্বতন্ত্ররূপে উল্লেখ করা বাহুল্য মাত্র। জীবন্ত অবস্থায় প্রায় ব্যবহৃত হয় বলিয়া বিলাতে উহারা “live food” বা “জীবন্ত খাদ্য” নামে পরিচিত; কতিপয় কীট আবার মৃত এবং শুষ্ক অবস্থায় বিহগভোজ্যরূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। অপেক্ষাকৃত বৃহৎকায় মাংসাশী পাখীদিগের জন্য চড়াই প্রভৃতি ছোট ছোট পাখী অথবা মূষিক প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী খাদ্যরূপে গণ্য হয়; মাংসের টুকরাও সচরাচর এই নিমিত্ত ব্যবহৃত হয়।
পথ্যহিসাবে খাদ্যবিশেষের ব্যবস্থা পীড়িত পাখীদিগের নিমিত্ত আবশ্যক হয়। পূর্ব্বে আমরা উল্লেখ করিয়াছি যে বীজাণুভোজী পক্ষিগণের পক্ষে বালুকা অতিশয় হিতকর, কারণ ইহা তাহাদিগের পরিপাক-শক্তির বিশেষরূপে সহায়তা করে। তদ্রূপ আবার কতিপয় শ্রেণীর কীট-পতঙ্গ, কীটভোজী পাখীদিগের স্বাস্থ্যের অনুকূল। কপি, মূলা প্রভৃতি শাক-সব্জীর সুকোমল পত্রপথ্য বীজভোজী পাখীদিগের কোষ্ঠ-পরিষ্কারক; দুগ্ধ-মিশ্রিত রুটিও য়ুরোপীয় পালকগণ কর্ত্তৃক এই নিমিত্ত ব্যবহৃত হয়। উদরাময় রোগ নিরাকরণের জন্য দুগ্ধ-মিশ্রিত arrowroot বিস্কুটের সহিত গোটাকতক পোস্তদানা মিশাইয়া রুগ্ন পক্ষীকে খাওয়াইতে হয়। এতদ্ব্যতীত পালিত পক্ষিগণের নানাবিধ ব্যাধির প্রতীকারের নিমিত্ত বিবিধ ঔষধের প্রয়োগ সময়ে সময়ে আবশ্যক হইয়া থাকে। আবদ্ধতাই যে উহাদিগের এই সকল রোগের হেতু তাহা নহে; পরন্তু আবদ্ধাবস্থায় পাখীদিগের ব্যাধির সুচিকিৎসা হইবার সম্ভাবনা অধিক। বনে-জঙ্গলে যে উহাদিগের স্বাধীন জীবন রোগমুক্ত নহে, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। এমন কি মিঃ গ্যালোয়ে বলেন[৫]—মে জুন মাসেও (অর্থাৎ যে ঋতুতে বিহঙ্গগণের স্বাভাবিক খাদ্যের অনটন নাই) যখন তিনি জীর্ণ শীর্ণ অস্থিচর্ম্মসার রুগ্ন পক্ষীকে ভূমি হইতে কুড়াইয়া পাইয়াছেন, তখন সহজেই বুঝা যায় যে পাখীদিগের স্বাধীন জীবন যে সম্পূর্ণ নিরাময়, তাহা নহে। তিনি আরও বলেন যে, বনে জঙ্গলে তাহারা ব্যাধিনাশক কোনও ঔষধ পায় না বলিয়া অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
বস্তুতঃ, মানবদিগের মধ্যে যে সকল ব্যাধি পরিদৃষ্ট হয়, বিহঙ্গগণের মধ্যেও ঐরূপ অধিকাংশ ব্যাধি লক্ষিত হইয়া থাকে। সাধারণতঃ পাখীদিগের নিম্নলিখিত ব্যাধিগুলি উল্লেখযোগ্য বলিয়া মনে করি:—ব্যাধি ও তাহার প্রতীকারমূর্চ্ছা, হাঁপানি, সর্দ্দিকাসি, বিসূচিকা, বিকলাঙ্গ, উদরাময়, আমাশয়, যক্ষ্মা, প্লীহারোগ, বাত, চক্ষুরোগ, ক্ষত, ফোড়া ইত্যাদি। এই সকল রোগের উপশমনের নিমিত্ত উপযোগী ঔষধের মাত্রা স্বল্প পরিমাণে বিশেষ সতর্কতার সহিত ব্যবহার্য্য। এরূপ অনেক দৃষ্টান্ত ঘটিয়া গিয়াছে, যেখানে এক ফোঁটার স্থলে দুই ফোঁটা ঔষধ-প্রয়োগের ফলে রুগ্ন পক্ষীগুলির বোগোপশমন দূরে থাকুক অবিলম্বে তাহাদিগের মৃত্যু সংঘটিত হইয়াছে। এই সকল ব্যাধির চিকিৎসার নিমিত্ত হোমিওপ্যাথি ঔষধের প্রয়োগই প্রশস্ত; কিন্তু আমরা সময়ে সময়ে এলোপ্যাথি ঔষধও ব্যবহার করিয়া থাকি—যেমন দাস্ত পরিষ্কারের নিমিত্ত Epsom salt; হাঁপানি রোগের নিমিত্ত Glycerine এবং Gum arabic; যক্ষ্মার নিমিত্ত Cod liver oil ব্যবহার করিতে হয়। পাখীগুলিকে সবল রাখিতে হইলে Parrish’s Chemical food প্রভৃতি স্বাস্থ্যবর্দ্ধক ঔষধ-প্রয়োগ দরকার। ঘা এবং ফোড়ার নিমিত্ত Vaseline এবং আবশ্যক হইলে অস্ত্র-চালনাও বিধেয়। ঔষধের সাহায্যে পীড়িত পক্ষিগণের রোগের উপশম করিতে সমর্থ না হইলেও, পালক চেষ্টা করিয়া তাহাদিগকে রোগের আক্রমণ হইতে রক্ষা করিতে পারেন। স্বাস্থ্যকর স্থানে উহাদিগকে রাখিয়া, স্বাস্থ্যবর্দ্ধক খাদ্য এবং পানীয়ের ব্যবস্থা করিয়া দিয়া, মাঝে মাঝে পথ্যের তারতম্য করিয়া এবং অসুস্থতার সূত্রপাত হইতে না হইতেই উপযুক্ত ঔষধ প্রয়োগ করিয়া তিনি পাখীগুলিকে রোগাক্রান্ত হইবার সুযোগ দেন না। সুপ্রশস্ত পক্ষিগৃহে যদি কোনও পক্ষীর অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পায়, তৎক্ষণাৎ তাহাকে ধরিয়া একটি স্বতন্ত্র পিঞ্জরমধ্যে রাখিতে হইবে। উপযোগী খাদ্য এবং ঔষধ ইহার নিমিত্ত আবশ্যক; পিঞ্জরটী এরূপ স্থানে রাখিতে হইবে, যেখানে রুগ্ন পক্ষীর আদৌ ঠাণ্ডা না লাগে;—কারণ দেখা গিয়াছে উত্তাপের সাহায্যে পাখী শীঘ্র শীঘ্র রোগমুক্ত হইয়া থাকে। য়ুরোপীয় পক্ষিপালকগণ বোগ নিবারণের জন্য এক প্রকার তাপযন্ত্র বাবহার করিয়া থাকেন, তাহার নাম Radiator। য়ুরোপে এই যন্ত্রের ব্যবহার যত বেশী আবশ্যক, ভারতবর্ষের মত গ্রীষ্মপ্রধান দেশে অবশ্যই ঠিক তত বেশী নহে। এখানে আমরা অনেক সময়ে বুঝিতে পারি যে, অত্যধিক উত্তাপের মধ্যে পাখীগুলি আবদ্ধাবস্থায় হাঁপাইতে থাকে; গৃহমধ্যস্থ এবং গৃহের বাহিরের পারিপার্শ্বিক উত্তপ্ত বায়ু তাহাদিগকে ক্লিষ্ট করিয়া তোলে। তখন পাখীগুলিকে সেখান হইতে সরাইয়া ঠাণ্ডা জায়গায় রাখিয়া আসিলে তাহারা শান্তি লাভ করে।
এমনই করিয়া মানুষ সর্বান্তঃকরণে পক্ষিজাতির সেবা করিতেছেন। প্রকৃতির ক্রোড় হইতে ছলে বলে কৌশলে বিচ্যুত বিহঙ্গগুলিকে কৃত্রিম গৃহমধ্যে আবদ্ধ রাখিয়া তিনি হয়’ ত কতকটা স্বার্থপর ও নিষ্ঠুর বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকেন; হয়’ ত তাঁহার নিজের আনন্দের জন্য অথবা তাঁহার চারিদিকে সমাজবদ্ধ মানবজাতির আনন্দের জন্য অথবা কেবলমাত্র আনন্দহীন বিজ্ঞান-রাজ্যে নূতন তত্ত্ব আবিষ্কার করিবার জন্য তিনি এই কার্য্যে প্রথমে ব্রতী হইয়াছিলেন। কিন্তু যে তাঁহাকে এত আনন্দ দেয়, তাঁহার বিজ্ঞান-চর্চ্চায় এত সাহায্য করে, সেই মূক বন্দী বিহঙ্গকে যেমন তিনি তাঁহার নিজের জ্ঞানের ও আনন্দের কাজে লাগাইয়াছেন, তেমনই তিনি আবার সেই একান্ত নির্ভর-পরায়ণ বন্দীটির সেবক হইয়া প্রাণপণে তদ্গতচিত্ত হইয়া তাহাকে সুস্থ ও আনন্দিত রাখিবার চেষ্টা করেন। যখন তাহাদের আনন্দোচ্ছ্বসিত কলকাকলীতে তাঁহার সযত্নরচিত সামান্য পক্ষি-ভবনটী মুখরিত হইয়া উঠে, তখন তাঁহার আনন্দের সীমা থাকে না।
- ↑ পাশ্চাত্য পক্ষিপালকগণ যে সকল কৃত্রিম খাদ্যবস্তুর সাহায্যে পক্ষিগণের এই প্রকার অস্বাভাবিক বর্ণ-বৈচিত্র্য ঘটাইয়া থাকেন, তন্মধ্যে উদ্ভিজ্জ পদার্থই প্রধান উপকরণ। যে উপকরণগুলি একত্র মিশাইয়া খাদ্যের সহিত সেবন করাইলে কেনেরী (canary) পক্ষীর বর্ণান্তর সাধিত হয়, তাহাদের একটী তালিকা দিলাম—
গাঢ় পীতবর্ণ হরিদ্রাচূর্ণ
২ আউন্স গাঢ়গাঢ়প Annato seed২ আউন্স„ গাঢ়গাঢ়প Salad oil৬ আউন্স„ উল্লিখিত উপকরণসমূহের ভাগের তারতম্য অনুসারে কেনেরী পক্ষীর বর্ণের তারতম্য ঘটিতে দেখা যায়—যথা, কোন স্থানে গাঢ় পীতবর্ণের আধিক্য, কোথাও বা কমলালেবুর রং। এইরূপ বর্ণ-কৃত্রিমতা উৎপাদনের নিমিত্ত লঙ্কা এবং জাফরান (saffron) সময়ে সময়ে ব্যবহৃত হইয়া থাকে।
- ↑ বিজ্ঞানসেবী পাশ্চাত্য পক্ষিপালকগণ কিন্তু বিহঙ্গজীবন লইয়া যাহা কিছু experiment করিতেছেন, তাহা প্রায়ই প্রকৃতির বিরুদ্ধগামী নহে। প্রকৃতির পন্থানুসরণে যে সকল কার্য্য সম্পাদিত হয়, তাহা চিরস্থায়ী; সুতরাং চিরস্থায়ী কার্য্যের উপায় উদ্ভাবনই তাঁহাদিগের মুখ্য উদ্দেশ্য। তজ্জন্য তাঁহারা খাদ্য-কৃত্রিমতার সাহাযো পক্ষীর ক্ষণস্থায়ী বর্ণ-বৈচিত্র্যের প্রতি লক্ষ্য না করিয়া পক্ষিমিথুনের সুনির্ব্বাচন, একত্র সংস্থাপন এবং তদবস্থায় সন্তানজননের ফলে পক্ষিশাবকের চিরস্থায়ী রূপান্তর সংসাধনে প্রয়াসী হইতেছেন।
- ↑ বৈদেশিক পক্ষিপালনে একনিষ্ঠ ব্যক্তিগণের মধ্যে আমরা ডাক্তার কীস্ (Dr. Keays) এর নামোল্লেখ না করিয়া থাকিতে পারিলাম না। লণ্ডনের নিকটবর্ত্তী East Hoathly গ্রামে তিনি যে সকল পক্ষিভবন নির্ম্মাণ করিয়াছেন তাহার সুচারু বর্ণনা ১৯১৫ খ্রীঃ অব্দের নভেম্বর মাসের “Cage Birds” নামক সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছে। এই বর্ণনা হইতে আমরা জানিতে পারি যে, অন্যূন পাঁচ শত পক্ষী তিনি ঐ সময়ে পালন করিতেছিলেন; এবং তাহাদিগকে রাখির নিমিত্ত প্রায় ৫৪০০ স্কোয়ার ফুট জায়গা তাঁহাকে জাল দ্বারা বেষ্টন করিতে হইয়াছিল। উক্ত বর্ষের গ্রীষ্মঋতুর শেষাশেষি তাঁহার পক্ষিগৃহমধ্যে আটাত্তরটি বিভিন্ন শ্রেণীর পক্ষিশাবক নীড় পরিত্যাগ করিয়া বাহির হইতে সমর্থ হইয়াছিল। Vide “Cage Birds” edited by F. Carl, Nov. 13th, 1915.
- ↑ সাধারণতঃ কাঁকনিদানা, Canary seed, পাটবীজ (hemp seed), সর্ষপদানা (rape seed), পোস্তদানা, তিসি (linseed), এই জাতীয় বিহঙ্গগণকে খাইতে দেওয়া হয়।
- ↑ “Diseases of Birds, and their treatment and cure—I.” by P. F. M. Galloway in the Avicultural Magazine, April, 1918.