পাখীর কথা/প্রথম ভাগ/পাখী-পোষা (৪)

পাখী-পোষা

(৪)

 পাখীর নীড়-রচনার কথা অলোচনা করিতে করিতে আমরা পরভৃৎ-রহস্যের অবতারণা করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম; কিন্তু এখনও পাখীর বাসা সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য শেষ হয় নাই। পক্ষিপালক বাসার আধারের ব্যবস্থা করিয়া খড়কুটা প্রভৃতি উপাদান যোগাইয়া দিয়া, এমন কি সময়ে সময়ে নীড়-নির্ম্মাণে পক্ষিদম্পতির ভ্রমসংশোধন করিয়া কেমন করিয়া উহাদের ডিম্বরক্ষার সহায়তা করেন তাহার কিঞ্চিৎ আভাস আমরা পূর্ব্বে দিয়াছি। কিন্তু অনেকে হয়ত’নীড় পরিষ্কার রাখার জন্য পক্ষিপালকের
চেষ্টা পাখীর স্বভাবের বিরোধী কি না?
মনে করিতে পারেন যে নিসর্গ-ক্রোড়চ্যুত বিহঙ্গকে লইয়া আদরের আতিশয্যে মানুষ কিছু বাড়াবাড়ি করে। প্রত্যহ যত্নসহকারে সে যেমন করিয়া বাসাটি পরিপাটিরূপে গুছাইয়া পরিষ্কৃত রাখিতে চেষ্টা করে, বাস্তবিক স্বাধীন অবস্থায় বন্য বিহঙ্গ কি তার স্বরচিত নীড় তেমন করিয়া গুছাইয়া পরিষ্কৃত রাখিতে পারে? যাঁহারা বিশেষ ভাবে পাখীর কার্য্যকলাপ সযত্নে নিরীক্ষণ করিয়াছেন তাঁহারা অতি সহজে ইহার সদুত্তর দিতে পারিবেন। হয়ত’ সে উত্তর শুনিয়া সাধারণ লোকে বিস্মিত হইবে; এবং পাখীর বিচার-শক্তি আছে কি না সেই প্রশ্ন ঘুরিয়া ফিরিয়া আবার এক্ষেত্রে আসিয়া পড়িবে। পাখীর বাসা সুন্দর কি অসুন্দর, সেইটাই সবচেয়ে বড় কথা নয়; বৈজ্ঞানিক তত্ত্বজিজ্ঞাসু প্রধানতঃ লক্ষ্য করিবেন যে নীড় সুন্দর হউক বা না হউক, উহা যে উদ্দেশ্যে রচিত হইয়াছে সেই উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য সেটা সম্পূর্ণ উপযোগী কি না। এই উপযোগিতা বা utilityর দিক হইতে বিচার করিতে বসিলে বিহঙ্গজাতি সম্বন্ধে একটি নূতন শাস্ত্র গঠিত হইয়া উঠে; পণ্ডিত সমাজে তাহা caliology নামে পরিচিত। এস্থলে আমরা এই শাস্ত্রের বিশেষ বিবরণ বা ব্যাখ্যা দিবার প্রয়োজন দেখি না; শুধু এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে যে উপায়ে নীড় রচনা করিলে পক্ষিদম্পতির ও শাবকের জীবনরক্ষার অনুকূল হইতে পারে, সাধারণতঃ দেখা যায় যে ঠিক সেই উপায় অবলম্বিত হইয়া থাকে।

 আমরা যে দুইটি নূতন কথার অবতারণা করিলাম,—পাখী নিজের বাসা পরিষ্কার করে কি না এবং নিজের ও শাবকের জীবন রক্ষার উপযোগী করিয়া নীড় নির্ম্মাণ করে কি না,—এই দুইটি বিষয় স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্নভাবে অলোচনাপাখীর স্বীয় বাসা রচনাপ্রণালী কতদূর উদ্দেশ্যমূলক;
পরিচ্ছন্নতা এই উদ্দেশ্যের অনুকূল কি না?
করিবার দরকার হয় না। দেখিবামাত্রই বুঝিতে পারা যায় যে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সহিত মিলাইয়া উপযুক্ত উপকরণের সাহায্যে পাখী যে বাসাটি রচনা করিয়াছে তাহা সুন্দর অথবা কুৎসিত হউক তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না; কিন্তু সেই বাসাটি যে তাহাকে এবং তাহার শাবককে নানা প্রতিকূল শক্তি ও বিপদ আপদ হইতে রক্ষা করিবার উপযোগী সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকে না। শত্রুর কবল হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য যে বৃক্ষপত্রান্তরালে গোপনে নীড়টি প্রস্তুত করা হয়, সেই পতার রংএর সঙ্গে নব-রচিত নীড়ের এমন আশ্চর্য্য বর্ণসাদৃশ্য দেখা যায় যে ভাল করিয়া লক্ষ্য না করিলে মানবেতর জাতির ’ত কথাই নাই, মানুষই অনেক সময়ে বুঝিতে পারে না যে ওখানে একটা বাসা আছে। রূপের দিক দিয়া যে দ্রব্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য না হইয়া থাকে, গন্ধের সাহায্যে হয়ত’ তাহাকে ধরা যায়, কিন্তু নৈসর্গিক রহস্য এই যে পাছে পক্ষিপুরীষের গন্ধ গাছের পাতার মধ্যে অথবা তন্নিম্নস্থ মাঠের ঘাসের উপরে গোপন নীড়টির সন্ধান প্রকাশ করিয়া দেয়, সেই জন্য বোধ হয় প্রকৃতির বিচিত্র বিধি-বিধানে পাখী নিজেদের পরিত্যক্ত পুরীষ বাসা হইতে সযত্নে এমন করিয়া সরাইয়া ফেলে যে তাহা সমীপস্থ তৃণগুল্মের উপরেও পতিত হয় না; সুতরাং হিংস্র শত্রু যে গন্ধের সাহায্যে কোনও প্রকারে তাহার অনিষ্ট করিবে সে সম্ভাবনা বড় থাকে না। একটা বিশিষ্ট জাতিকে রক্ষা করিবার জন্য বর্ণের ও গন্ধের এমন বিস্ময়কর সামঞ্জস্য বিহঙ্গতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতেরা অনেক দিন ধরিতে পারেন নাই। অনেকেই শুধু প্রশ্ন করিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছেন যে রচিত নীড়ের মধ্য হইতে পক্ষিপুরীষ কোথায় এবং কেমন করিয়া অন্তর্হিত হয়? এইখানে অবশ্যই পাঠককে একটু সতর্ক হইতে হইবে;—সব পাখীই যে নিজের বাসা ময়লা হইতে দেয় না বা বৃক্ষতলে পুরীষ নিক্ষেপ করে না এমন কথা আমি বলিতেছিনা। যে যে পাখী নিজেদের বাসা পরিষ্কার রাখে তাহারা অধিকাংশই passeres ও pici[] শ্রেণীভুক্ত। ইহা সহজে অনুমান করা যাইতে পারে যে, যে সকল পাখীর ছানা জন্মিবামাত্রই চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইতে পারে অথবা যাহারা স্বভাবতঃ হিংস্র তাহাদের এমন করিয়া আত্মগোপন করিবার আবশ্যকতা নাই বলিয়া তাহাদের এই রকম লুকোচুরি প্রায় দেখা যায় না। দেখা না যাউক, কিন্তু হিংস্র পাখীগুলা সাধারণতঃ নিজেদের বাসা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে; তাহাদের পরিত্যক্ত পুরীষ বাসার বাহিরে ভূমিতলে নিক্ষিপ্ত হয়। এক্ষেত্রে এমন কোনও আশঙ্কা থাকে না যে পুরীষগন্ধ অনুসরণ করিয়া কোনও আততায়ী তাহাদিগকে ধ্বংসের ভয় দেখাইতে পারে। পূর্ব্বোক্ত passeres জাতীয় পক্ষী যে চঞ্চুপুট সাহায্যে ময়লা স্থানান্তরিত করে ইহা মার্কিন প্রাণিতত্ত্ববিৎ এফ্ হেরিক্‌প্রমুখ পণ্ডিতগণ লক্ষ্য করিয়াছেন। শাবককে খাবার খাওয়াইবার পরেই ঘড়ির কাঁটার ন্যায় নিয়মিতরূপে প্রত্যেকবারই ধাড়ি পাখীগুলি কর্ত্তৃক এই কার্য্য সুসম্পন্ন হইয়া থাকে। যাহারা নিজের বাসা ময়লা করিয়া থাকে সেই সমস্ত পাখীর মধ্যে কাহারও কাহারও পুরীষ আবার তাহাদেরই কাজে লাগিয়া যায়; পারাবতপুরীষ তাহার কাঠিকুটিনির্ম্মিত বাসাটিকে শিথিল হইতে দেয় না, গাঁথুনিটাকে যেন শক্ত করিয়া রাখে।

 এই প্রসঙ্গে কেনেরি পাখীর উল্লেখ করা যাইতে পারে। পক্ষিপালকমাত্রেই অবস্থাবিশেষে এই passeres জাতীয় পাখীটিকে লইয়া কিছু বিব্রত হইয়া পড়েন। সাধারণতঃ আমাদের পক্ষিগৃহ মধ্যে (aviary) তাহার জন্য যে নীড় রচিত হইয়া থাকে তন্মধ্যে অসঙ্কোচে সে ডিম্ব প্রসব করে। এসম্বন্ধে এস্থলে অন্য কিছু আলোচনা আবশ্যক নয়, কেবল এইটুকু জানা দরকার যে ধাড়ি পাখীটা ডিমের উপর বসিয়া প্রায় এক পক্ষ তা দিতে থাকে। এই অপেক্ষাকৃত দীর্ঘকালের মধ্যে তাহাকে প্রায় স্থানচ্যুত হইতে দেখা যায় না; তজ্জন্য বাসাটা যে কিছু ময়লা হয় না বা তাহাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কীটাদির আবির্ভাব হয় না এমন বলা যায় না। ডিম্ব প্রসবের দশ বার দিন পরে, যখন আমরা বুঝিতে পারি যে ডিম ফুটিয়া শাবক বাহির হইবার বড় বেশী দেরি নাই, তখন অতি সাবধানে সেই aviaryর মধ্যে অপর একটি নবরচিত বাসায় সেই ডিমগুলিকে স্থানান্তরিত করা হয়। এই নূতন বাসাটি অবশ্যই আমরা ইতিমধ্যে উপযুক্ত উপকরণ সাহায্যে প্রস্তুত করিয়া রাখি এবং পুরাতন ময়লা বাসাটা সরাইয়া ফেলিয়া সেইখানে ইহাকে স্থাপিত করি। এইরূপ করার অভিপ্রায় এই যে যথাসম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নীড়ে পক্ষিশাবক জন্ম গ্রহণ করিতে পারে। এই নূতন পরিবেষ্টনীর মধ্যে তাহার জীবনরক্ষার অনুকূল সমস্ত ব্যবস্থাই থাকে; যাহাতে তাহার প্রাণসংশয় হইতে পারে,—কীটাদি অথবা দুর্গন্ধ পুরীষাদি—তাহা আদৌ সেখানে থাকে না। এই খানেই কিন্তু আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ শেষ হইল না। প্রথম প্রথম কয়েক দিন অন্তরে এই নবপ্রসূত শাবকগুলিকে আবার নূতন নূতন বাসায় রাখিয়া দিতে হয়। শুধু যে আমরাই তাহাদের বাসা পরিষ্কার রাখিবার জন্য চেষ্টা করি, ধাড়িগুলা কিছু করে না, এরূপ মনে করিলে ভুল হইবে। কারণ দেখা যায় নীড়াভ্যন্তরে যদি একটি শাবক কোনও কারণে মরিয়া যায়, তাহা হইলে সেই ধাড়ি পাখীটা আপনার চঞ্চু-সাহায্যে সেই শবদেহটাকে নীড় হইতে বাহিরে ফেলিয়া দেয়; একটুও কাল-বিলম্ব করে না, কারণ তাহা হইলে হয় ’ত বাসাটি দূষিত হইয়া উঠিতে পারে। ইহাকে instinct বলিতে হয় বলুন; reason বলিয়া স্বীকার না করেন ক্ষতি নাই। কিন্তু ইহা স্বীকার করিতেই হইবে যে পক্ষিজাতি স্বভাবতঃ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হইয়া থাকিতে ভালবাসে; এত ভালবাসে যে শুধু বাসাটি পরিষ্কার থাকিলেই যে চলিবে তাহা নহে; তাহাদের নিজের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিপাটি রূপে পরিষ্কৃত রাখিবার চেষ্টা তাহাদের মধ্যে লক্ষিত হয়। পক্ষিতত্ত্ববিৎ ফ্রান্‌ক্ ফিন্ অনেক পর্য্যবেক্ষণ করিয়া এমন কতকগুলি বিষয় জানিতে পারিয়াছেন যাহা আমাদের বিস্ময় উৎপাদন করিতে পারে।

 পাখীর যে বিলাস-বিভ্রমের দিকে ঝোঁক আছে, সে যে গাত্র মার্জ্জনা করিয়া প্রসাধনের চেষ্টা করে, জলাশয়ে সন্তরণ করিয়া কিম্বা ডুব দিয়া অথবা জলবিন্দুসম্পাতে আপাদমস্তক সিক্ত করিয়া গায়ের ময়লাপাখীর প্রসাধন-প্রবৃত্তি ও তাহার উপকরণাদি দূরীকরণের ব্যবস্থা করে, ইহা হয়’ত সাধারণতঃ আমাদের নয়নগোচর হইয়া থাকে। বালুকাসংঘর্ষে কোনও কোনও পাখীর গাত্র উজ্জ্বল ভাব ধারণ করে; ইহাও আমাদের অজ্ঞাত নহে। কিন্তু সে যে নিজ দেহের প্রসাধনকল্পে একটা গোপন পেটিকাভ্যন্তর হইতে মসৃণ তৈলের মত পদার্থ বাহির করিয়া চঞ্চুপুট সাহায্যে প্রত্যেক পতত্রের উপর দিয়া বুলাইয়া যায়, পালকগুলিকে অল্পবিস্তর টানিয়া তাহাতে অতি যত্ন সহকারে ঐ স্নিগ্ধ প্রলেপ লাগাইয়া দেয় এ তত্ত্ব কয়জনে অবগত আছেন? কোনও কোনও বিহঙ্গের অঙ্গমার্জ্জনার জন্য আবার প্রকৃতিদত্ত “টয়লেট পাউডার” ও চিরুণীর ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায়। Powder-puff পালকের মধ্যেই স্বতঃ প্রস্তুত হইয়া থাকে, আর ঐ চিরুণীটি পদনখসান্নিধ্যে গুপ্ত থাকে; আর ঐ স্নেহ-পদার্থটি পুচ্ছমূলসমীপস্থ একটি glandমধ্যে সঞ্চিত থাকে। ফ্রান্‌ক্ ফিন্ বলেন যে এক হিসাবে পাখী পশুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ;—সে গাত্রমার্জ্জনা করিবার অভিপ্রায়ে স্নান করিবার আবশ্যকতা অনুভব করে, কোনও পশু তাহা করে না (They are the only creatures which bathe for cleanliness’ sake; beasts may lick themselves or wallow luxuriously for pleasure—in mud as readily as in water, or often more so—but deliberate washing in water is purely a bird custom.)। মানবেতর বিহঙ্গজাতি যে এমন করিয়া সর্ব্বতোভাবে নির্ম্মল থাকিতে ভালবাসে এবং তজ্জন্য উপযোগী উপকরণ সকল প্রকৃতির নিকট হইতে আদায় করিয়া লইয়া প্রফুল্লচিত্তে জীবন যাপন করিতে পারে, এ তত্ত্বটুকু না জানিয়াও মানুষের সঙ্গে পাখীর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ অনেক দিন হইতে দাঁড়াইয়া গিয়াছে।

 এখন আবার সেই নীড় ও নীড়স্থ পক্ষিমিথুনের ইতিহাস-সূত্র অবলম্বন করিয়া আরও কয়েকটি জ্ঞাতব্য বিষয় পাঠকের সমক্ষে উপস্থাপিত করিব। প্রাঙ্‌মিথুন লীলা ও পক্ষিমিথুনের গার্হস্থ্যজীবনের প্রথম পর্ব্ব সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হইল। যথা সময়ে ডিম্ব প্রসূত হইলে বিহঙ্গজীবনের আর একটি রহস্যময় তথ্য আলোচনার বিষয়ীভূত হইয়া পড়ে। এমন অনেক পাখী আছে যাহারা ক্রমে ক্রমে দিনের পর দিন একটি একটি করিয়া ডিম পাড়িয়া থাকে; মনে করুন একটি, দুইটি, তিনটি, চারিটি ডিম পরে পরে পাওয়া গেল;—একই দিনে নয়; প্রথমটি ও শেষটির মধ্যে ৮-১০ দিনের অতিরিক্ত কালের ব্যবধান থাকিতে পারে। এমন অবস্থায় সকল দিক বিবেচনা করিয়া পক্ষিগৃহস্বামীর কর্ত্তব্য কি? যদি পর্য্যায়ক্রমে ডিম্ব প্রসূত হইবামাত্র প্রত্যেকটি তা দিয়া ফুটাইয়া তুলিবার ব্যবস্থা করা হয়, তাহা হইলে কতকটা সুবিধার এবং অনেকটা অসুবিধার সম্ভাবনা থাকিতে পারে। হংসজাতীয় পক্ষীর কিন্তু সুবিধাই বেশী; এক একটি ডিম হইতে পক্ষিশাবক নির্গত হইয়া অপেক্ষাকৃত স্বাধীনভাবে গোড়া হইতেই খাদ্যের সহিত পরিচয়সম্বন্ধ স্থাপিত করিতে পারে, জনক জননীকে সকলে মিলিয়া খাদ্যের জন্য বিপন্ন করিয়া তুলে না, যদিও ধাড়ি পাখীগুলা এই অসহায় শাবকগুলির সম্পূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণের ভার লইয়া থাকে। কিন্তু সাধারণতঃ যে সকল পাখী আমাদের কৃত্রিম পক্ষিগৃহের মধ্যে তিন চার দিনে সর্ব্বসমেত তিন চারটি ডিম পাড়িয়া থাকে, তাহাদিগকে আমরা পূর্ব্বাপর অণ্ডগুলির উপর দিনের পর দিন বসিতে দেওয়াপাখীর সব ডিমগুলি হইতে একই সময়ে যাহাতে
শাবক বাহির হয় সেজন্য পক্ষিপালক কি
উপায় অবলম্বন করেন এবং কেন?
সমীচীন বোধ করি না, কারণ তাহা হইলে একই দিনে সব কয়টা ডিম হইতে শাবক নির্গত হইবার কোনও সম্ভাবনা থাকে না; এবং সেরূপ ব্যবস্থা না করিতে পারিলে যে শাবকটি অণ্ড হইতে প্রথম বাহির হইবে সে আহার্য্য লইয়া এমন গোল বাধাইতে পারে যে পরবর্ত্তী সদ্যঃপ্রসূত শাবকগুলিকে বলপ্রয়োগে পিতৃমাতৃপ্রদত্ত খাদ্য হইতে বঞ্চিত করিয়া তাহাদিগের প্রাণসংশয় ঘটাইতে পারে। জীবতত্ত্ব হিসাবে এই খাদ্য লইয়া কাড়াকাড়ি ব্যাপার অত্যন্ত সাধারণ biological সত্য। জাতিবর্ণনির্ব্বিশেষে পশুপক্ষী কীটপতঙ্গাদির মধ্যে প্রকৃতির রহস্যযবনিকার অন্তরালে এই যে তুমুল সংগ্রাম চলিতেছে ইহার সংবাদ আমরা না রাখিতে পারি, কিন্তু ইহাতে জয়-পরাজয়ের উপর বিশিষ্ট জাতির রক্ষা কিংবা বিনাশ নির্ভর করে। তাই মানুষ চেষ্টা করিয়া বুদ্ধি খাটাইয়া প্রকৃতির নিয়মকে অমান্য না করিয়া স্বরচিত পক্ষিগৃহ-মধ্যে এমন ব্যবস্থা করেন যে নবপ্রসূত শাবকগুলির মধ্যে খাদ্য লইয়া দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা সত্ত্বেও বয়সের তারতম্য বশতঃ কেহ কাহাকেও বলপ্রয়োগে বঞ্চিত করিতে না পারে। তাহা না করিতে পারিলে জ্যেষ্ঠ শাবকটি খাদ্য বিতরণের সময় আগে হইতে মুখ বাড়াইয়া অপেক্ষাকৃত হীনবল কনিষ্ঠের প্রাপ্য অংশটুকু বারে বারে আত্মসাৎ করিয়া কনিষ্ঠের ক্ষুধা মিটাইবার বিষম অন্তরায় হইয়া দাঁড়ায়; ফলে আহার্য্যের অভাবে তাহারা মৃত্যুমুখে পতিত হয়। অতএব পক্ষিপালক ফাঁকি দিয়া পাখীকে ভুলাইয়া একটি একটি করিয়া সদ্যপ্রসূত ডিম্বগুলিকে যথাক্রমে সযত্নে সরাইয়া ফেলিয়া তৎপরিবর্ত্তে একটি একটি করিয়া নকল ডিম্ব[] নীড়মধ্যে সন্নিবেশিত করিয়া দেন; ধাড়ি পাখী বুঝিতে পারে না যে আসল জিনিষ অন্তর্হিত হইয়াছে। যখন সব ডিমগুলি পাড়া হয়, আর ডিম্ব-প্রসবের সম্ভাবনা থাকে না, তখন পক্ষিগৃহস্বামী নকল জিনিষ উঠাইয়া লইয়া আসল ডিম্বগুলি নীড়াভ্যন্তরে সাবধানে রাখিয়া দেন। এই dummyগুলি রাখিবার তাৎপর্য্য এই যে ডিম্বাকৃতি কোনও কিছু নীড়াভ্যন্তরে না থাকিলে ধাড়ি পাখীর ডিমে তা দেওয়ার অভ্যাস নষ্ট হইয়া যায়; সে কিছুতেই আর সেই বাসার মধ্যে বসিতে চাহিবে না; ডিমগুলি পরে আনিয়া দিলেও আর সে তা দিবে না। এখন এক সময়ে একত্র সব ডিমগুলিতে তা দেওয়ায় শাবকগুলির মধ্যে কেহ কাহারও অপেক্ষা এমন ভাবে বয়োজ্যেষ্ঠ হইতে পারে না যে অন্যের চেয়ে সে অধিকতর বলশালী হইয়া অনর্থ ঘটাইতে পারে। বয়সের তারতম্য না থাকায়, খাদ্য লইয়া পরস্পরের দ্বন্দ্ব প্রায়ই হইতে পারে না; সকলেই যথোপযুক্ত আহার পাইয়া যুগপৎ সমান ভাবে বর্দ্ধিত হইবার অবসর পায়। তাহাদের সম্বন্ধে বিশেষ কোনও আশঙ্কার কারণ আর পক্ষিপালকের থাকে না। তবে শাবকদিগের আহারের ব্যবস্থা এই সময়ে খুব সাবধানের সহিত করিতে হয়। পক্ষিগৃহমধ্যে প্রসূত সকল পাখীর ছানা সম্বন্ধেই এই সতর্কতা আবশ্যক। আহারসামগ্রী অপ্রচুর হইবে না; পরন্তু খাদ্যের প্রকারভেদের প্রতি লক্ষ্য রাখিতে হইবে। অবশ্যই সমস্ত খাদ্যদ্রব্য যথাসম্ভব টাট্‌কা হওয়া চাই। আবার সেই টাট্‌কা খাবার অনেক আধারের মধ্যে রক্ষা করিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারা যায় না। কারণ উহা অল্পবিস্তর খারাপ হইয়া যাইতে পারে;শাবকের আহার-ব্যবস্থা দুর্গন্ধ ও বিস্বাদ হইলে পাখীর পক্ষে কল্যাণকর হইবে না। অতএব মাঝে মাঝে উহার পরিবর্ত্তন ও খাদ্যাধারের পরিমার্জ্জন আবশ্যক। আরও একটু কথা আছে। যে সকল পাখী সাধারণতঃ নিরামিষভোজী তাহাদের শাবকগণের জন্য এই সময়ে কীটপতঙ্গ ভক্ষ্যরূপে ব্যবহৃত না হইলে তাহাদের প্রায়ই প্রাণসংশয় হইয়া থাকে। কেহ যেন মনে না করেন যে আবদ্ধ অবস্থায় পাখীর প্রকৃতির বিরুদ্ধে একটা অস্বাভাবিক অভ্যাসের প্রশ্রয় দেওয়া হইয়াছে। স্বাধীন অবস্থায় নিরামিষাশী পক্ষিদম্পতি স্বীয় শাবকের জন্য কীট পতঙ্গ সংগ্রহ করে, এরূপ ব্যাপার প্রায়ই দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে।

 এতক্ষণ বিহঙ্গজাতির যৌনসম্মিলন ও দাম্পত্যলীলার আলোচনা একই শ্রেণীর পক্ষিমিথুনের জীবনলীলা অবলম্বন করিয়া কতকটা বিশদ করিতে চেষ্টা করিলাম। বিভিন্ন শ্রেণীর ভিতর হইতে স্ত্রীপুং পক্ষীর অবাধ সম্মিলন ঘটিত বর্ণসাঙ্কর্য্যের প্রসঙ্গ এস্থলে বৈজ্ঞানিকের আলোচ্য। পাখীদের বর্ণসাঙ্কর্য্য বিশেষভাবে খাঁচার মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায় সঙ্ঘটিত হইয়া থাকে বটে;পাখীর বর্ণসাঙ্কর্য্য কিন্তু বনে জঙ্গলে যখন তাহারা স্বাধীন ভাবে বিচরণ করে, তখনও বিভিন্ন শ্রেণীর স্ত্রী-পুং পক্ষী পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া সঙ্গত হইয়া থাকে এরূপ দৃষ্টান্ত অন্ততঃ পাশ্চাত্য ভূখণ্ডে বিরল নহে। কোনও কোনও পক্ষিপালক লক্ষ্য করিয়াছেন যে স্বভাবতঃ পরস্পর বিরোধী পাখীরা কিছুতেই স্বাধীন অবস্থায় যৌনসম্মিলনের প্রশ্রয় দেয় না; কিন্তু পক্ষিগৃহ-মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায় তাহারা আপনা আপনি মিলিত হইয়া নূতন বর্ণসঙ্কর উৎপন্ন করে। এই নূতন বর্ণসঙ্করের বন্ধ্যাত্ব-দোষ অনেক ক্ষেত্রে থাকে না;—যদিও তাহাদের শাবক বর্ণে ও আকারে প্রকৃতির খেয়াল বশতঃ অনেক সময়ে তাহাদের জনকজননী অথবা আরও ঊর্দ্ধতন পূর্ব্ব পুরুষ হইতে পৃথক হইয়া থাকে অথবা কখনও কখনও কোন পূর্ব্ব পুরুষের সহিত তাহার সম্পূর্ণ সাদৃশ্য পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায়ই বর্ণসঙ্কর যেখানে খুব বেশী পৃথক পৃথক শ্রেণীর জনক জননী হইতে উৎপন্ন, সেখানে তাহাকে বন্ধ্যাত্বদুষ্ট দেখা যায়। অতএব এই প্রকার বর্ণসঙ্করের ইতিহাস ইহাদের জীবন-লীলার সঙ্গে সঙ্গে পর্য্যবসিত হইয়া যায়। একই পরিবারভুক্ত বিভিন্ন শ্রেণীর মিশ্রণে যে সন্তান উৎপন্ন হয় তাহা অনেক সময়ে পক্ষিপালকের আনন্দবর্দ্ধক হইয়া থাকে। Passeres পরিবারভুক্ত কেনেরি (canary) ও ফিঞ্চ জাতীয় নানা সুকণ্ঠ বিহঙ্গের যৌনসম্মিলনে পাশ্চাত্য পক্ষিগৃহমধ্যে উৎপন্ন সমস্ত বর্ণসঙ্কর তাহাদের জনক জননী অপেক্ষা অধিকতর সুমধুরকণ্ঠ হইয়া থাকে; কিন্তু তাহাদের বন্ধ্যাত্ব দোষ জন্মে।

 পাখীর বর্ণসাঙ্কর্য্য লইয়া আমরা এক নিঃশ্বাসে এত কথা বলিয়া গেলাম, বোধ হয় তাহাতে পাঠকের বুঝিবার পক্ষে কিছু বাধা জন্মাইতেছে, অতএব বিষয়টা আরও পরিষ্কার করা আবশ্যক। প্রধানতঃ আমরা খাঁচার পাখী লইয়া যদিও আলোচনা করিতে বসিয়াছি, তথাপি বিজ্ঞানসম্মত পন্থা অবলম্বন করিতে হইলে স্বাধীন পাখীর তত্ত্বালোচনা না করিলেপক্ষীগৃহে এসম্বন্ধে পালকের চেষ্টা চলে না। এই জন্য গোড়াতেই আমরা স্বাধীন বন্য অবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণীর পাখীর যৌনসম্মিলন হয় কি না সেই কথা পাড়িয়াছি। পূর্ব্বেও প্রসঙ্গক্রমে পাখীর অসবর্ণ বিবাহের কথার ইঙ্গিত আমরা করিয়াছি, বোধ হয় পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে। তবে ইহা স্বীকার করিতে হইবে যে মুক্ত অবস্থায় এইরূপ যৌনসম্মিলন প্রায়ই সঙ্ঘটিত হইতে পায় না, কারণ একই পরিবারভুক্ত বিভিন্ন শ্রেণীর পক্ষীদের মধ্যে এমন একটা বিরোধের ভাব থাকে যে কেহ কাহাকেও সহজে কাছে আসিতে দেয় না;—এইখানে পক্ষিপালকের কৃতিত্ব দেখিতে পাওয়া যাইবে। কেমন করিয়া সে পক্ষিভবনে সেই সকল বিভিন্ন শ্রেণীর আবদ্ধ পাখীর সম্মিলন সঙ্ঘটিত করায়, কেমন করিয়া তাহাদের প্রসূত ডিম্ব হইতে শাবক ফুটাইয়া তুলিতে কৃতকার্য্য হয়, এই সকল বিষয় নিবিষ্টচিত্তে পর্য্যালোচনা করিলে আমাদের বিস্ময়ের সীমা থাকিবে না। অথচ পাখীদের প্রকৃতিগত বৈষম্য সত্ত্বেও মানুষের চেষ্টা আশ্চর্য্যরূপে ফলবতী হইয়া বিহঙ্গজগতে বর্ণের ও সঙ্গীতের, অকারের ও প্রকৃতির নব নব উন্মেষে বিজ্ঞানের পথ আলোকিত করিয়াছে;—সেই আলোকে ভবিষ্যতে আরও অভিনব বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হইবে আশা করা যায়। ভারতবর্ষে বহুশতবর্ষ পূর্ব্বে অন্ততঃ সম্রাট আক্‌বরের সময়ে এইরূপ বর্ণসঙ্কর সৃষ্টির চেষ্টা হইয়াছিল; তিনি বিভিন্ন শ্রেণীর পারাবতের সংমিশ্রণে যে সমস্ত নূতন পায়রার উদ্ভাবন করিলেন তাহার উল্লেখ আমরা পূর্ব্বে করিয়াছি। জাপানে মোরগ জাতীয় বিভিন্ন শ্রেণীর পাখী লইয়া এইরূপ পরীক্ষার ফলে যে bantam এবং লম্বপুচ্ছ মোরগের উদ্ভব হইয়াছে তাহারও আভাস আমরা পূর্ব্বে দিয়াছি। আধুনিক যুগে এই বিষয়টি পক্ষিপালকের কেবলমাত্র খেয়ালের জিনিস নহে; পক্ষিবিজ্ঞানের চেষ্টা এখন এইরূপ অবাধ সম্মিলনে পাখীর আকার ও প্রকৃতির তারতম্য হইল কিনা এবং তাহাকে কোনও নিয়মে বিধিবদ্ধ করা যায় কিনা তাহাই স্থির করা। তাই পাশ্চাত্য ভূখণ্ডে, অনেক জায়গায় বৎসরে বৎসরে এমন কি মাসে মাসে যে সব পক্ষিপ্রদর্শনীর ব্যবস্থা আছে তাহাতে বর্ণসঙ্কর উৎপাদনে কে কত কৃতিত্ব দেখাইয়াছে তাহা লইয়া সুন্দর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইয়া থাকে। বিচারকেরা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণসঙ্করগুলির আকারগত বৈচিত্র্য নিরীক্ষণ করিয়া থাকেন;—যেরূপ লক্ষণাক্রান্ত হইলে খাঁটি বর্ণসঙ্কর বলা যাইতে পারে সেই সব লক্ষণ কে কতটা ফুটাইয়া তুলিতে পারিয়াছে প্রদর্শনীক্ষেত্রে তাহাই বিচার্য্য। যে কারণেই হউক, এমনই করিয়া পক্ষিজাতি সম্বন্ধে ক্রমশঃ নূতন নূতন তত্ত্ব আবিষ্কারের সম্ভাবনা হইতেছে।

 খাঁচার মধ্যে বর্ণসঙ্কর পাখী উৎপন্ন করা যে খুব সহজ ব্যাপার তাহা কেহ যেন মনে না করেন; যতটা অয়াস স্বীকার করিতে হয়, তদনুরূপ ফলপ্রাপ্তি হইলে পক্ষিপালকের আনন্দবর্দ্ধনের ও পক্ষিবিজ্ঞানের নূতন তথ্য আবিষ্কারের সুবিধা হইতে পারে। বড় পক্ষিগৃহ না হইলে যে চলিবে না এমন নহে; তবে বিভিন্নজাতীয় বিহঙ্গ সংমিশ্রণের যতটা সুযোগ বৃহৎ aviaryতে হইতে পারে, ততটা অপেক্ষাকৃত অল্পপরিসর পিঞ্জরে সম্ভবপর নহে। এক্ষেত্রেও যে যে পাখীকে সঙ্গত করান হইবে তাহাদের বাছাই আবশ্যক; বিশেষতঃ পক্ষিণী ও পক্ষীর বর্ণ, আকার, প্রকৃতি ও কণ্ঠস্বরের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া নির্ব্বাচন করিতে হইবে। যে পক্ষিগৃহে নির্ব্বাচিত পক্ষিণীকে রাখা হইল, তথায় অবশ্যই সেই জাতীয় পুংপক্ষীর প্রবেশ নিষিদ্ধ, কারণ তাহা না হইলে, উক্ত স্ত্রীপক্ষী স্বজাতীয় পুংপক্ষীর সহিত মিলিত হইব, অন্য কাহারও সহিত নহে। আকার ও বর্ণ প্রভৃতির বৈষম্য সত্ত্বেও বিভিন্ন শ্রেণীর একাধিক পুংপক্ষীকে ঐ পক্ষিগৃহ মধ্যে ছাড়িয়া দিতে হয়। অনেক সময়ে ভাল ফল পাইবার আশায় আমাদের পক্ষিভবনে অনেকগুলি বিভিন্ন জাতীয় পক্ষী ও পক্ষিণী বর্ণসঙ্কর উৎপাদনের উদ্দেশ্যে রক্ষিত হয়। যে ঋতুতে সাধারণতঃ পাখীরা শাবকেৎপাদন করে, সেই breeding seasonএ এইরূপ ব্যবস্থা করা আবশ্যক, কারণ অন্য সময়ে কোন ফল পাইবার আশা নাই; তবে কিছু আগে হইতে নির্ব্বাচিত বিভিন্নজাতীয় পক্ষী পক্ষিণীকে একত্র রাখিলে তাহাদের পরস্পর জাতিগত বিরোধের ভাব তিরোহিত হইয়া মিলনের সুবিধা ঘটাইয়া দেয়;—সদ্যধৃত বন্য বিহঙ্গ সম্বন্ধে এইরূপ পূর্ব্বাহ্নে চেষ্টা বিশেষ ফলবতী হয়। পক্ষিপালক লক্ষ্য রাখিবেন যেন রক্ষিত পাখীগুলির মধ্যে কেহ হিংস্রস্বভাব বা দ্বন্দ্বকলহপটু না হয়। একত্র বিভিন্ন জাতীয় অনেকগুলি পাখীকে রক্ষা করা সম্বন্ধে যে যে সদুপায় অবলম্বন করা আবশ্যক তাহা পূর্ব্বে বর্ণিত হইয়াছে; এক্ষেত্রেও সেই সদুপায়গুলি অবলম্বন করিতে হইবে। নীড় রচনার উপযুক্ত উপকরণ সংগৃহীত হওয়া চাই; প্রচুর খাদ্য সামগ্রীর আয়োজন করিতে হইবে; পক্ষিগৃহ লতায় পাতায় বৃক্ষশাখায় সুসজ্জিত হইলে, সেই কুঞ্জভবনে বিহগ বিহগীর সঙ্কোচ ক্রমশঃ তিরোহিত হইয়া মিলনের বাধা সম্পূর্ণরূপে অপসারিত হয়। কেনেরি (canary) ও ফিঞ্চ (finch) জাতীয় নানা পাখী লইয়া বিলাতে অনেক দিন হইতে বর্ণসঙ্কর উৎপাদনের যে চেষ্টা হইতেছে তাহাতে পালকগণ যথেষ্ট সফলপ্রযত্ন হইয়াছেন;—অধিকন্তু অনেকগুলি নূতন তথ্য আবিষ্কৃত হইয়াছে। স্ত্রী পক্ষীটির অবয়ব, রূপের ভঙ্গি প্রভৃতির উপর শাবকের আকৃতি ও সৌন্দর্য্য অধিক পরিমাণে নির্ভর করে; কিন্তু ফিঞ্চজাতীয় খাঁটি ব্রিটিশ পাখী লইয়া সুফল পাইতে হইলে, শাবকের জনক জননী উভয়ের অঙ্গসৌষ্ঠবের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার ফলে শাবকের বর্ণের তারতম্য কতকটা মানুষের ইচ্ছাধীন হইয়াছে। কৃত্রিম খাদ্যসাহায্যে কেমন করিয়া বিহঙ্গের বর্ণের উজ্জ্বলতা বর্দ্ধিত করিতে পারা যায়, তাহার উল্লেখ পূর্ব্বে করিয়াছি। বর্ণসঙ্করের দেহের এই ঔজ্জ্বল্য দর্শকের চক্ষে বড়ই মনোরম; তাই পাশ্চাত্য প্রদর্শনীতে কৃত্রিম উপায়ে পাখীর কে কেমন রং ফুটাইতে পারিয়াছে তাহা লইয়া পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইয়া থাকে। পক্ষান্তরে কখনও কখনও বিহগ বিহগী এমন সতর্কতার সহিত নির্ব্বাচিত হয় যে তাহাদের সন্তান সন্ততির বর্ণ উক্ত জনক জননীর বর্ণ হইতে পৃথক হইয়া দাঁড়ায়। কৃত্রিম খাদ্য-সাহায্যে এই সমস্ত নবজাত শাবকের রং অধিকতর চিত্তাকর্ষক হইয়া থাকে। টিয়া-জাতীয় নীল বজ্‌রিগার্ (Blue Budgerigar) এইরূপ পক্ষিগৃহে পরীক্ষার আধুনিক উৎপত্তি। মিঃ জন্ মারস্‌ডেন (John W. Marsden) উপর্য্যুপরি তিন বৎসর বজ্‌রিগার্ পক্ষীর শাবকোৎপাদন বিষয়ে মনোনিবেশ করিয়াছিলেন। সাধারণতঃ উক্ত পক্ষীর দেহের বর্ণ সবুজ; আন্তর্জাতিক মিশ্রনের ফলে আমাদের দেশের টিয়া পাখীর ন্যায় ইহাদের বর্ণ কখনও কখনও পীতরেখা সমন্বিত, কখন বা সম্পূর্ণ পীতবর্ণ হইয়া যায়। এই পীতবর্ণের শাবককে কৃত্রিম বর্ণোৎপাদক আহার যোগাইয়া য়ুরোপীয় পক্ষিব্যবসায়িগণ নূতন বর্ণবৈচিত্র্য সঙ্ঘটিত করায়। লণ্ডন জুয়োলজিক্যাল সোসাইটির স্বনামখ্যাত ফেলো মিঃ মারস্‌ডেন কিন্তু পীতবর্ণকে উড়াইয়া দিয়া নীলবর্ণের সৃষ্টি করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। একাগ্রভাবে পুনঃপুনঃ চেষ্টার ফলে তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছেন তাহা সম্প্রতি লিপিবদ্ধ করিয়াছেন[]। তিনি বলেন যে নীল রং ফুটাইতে হইলে ঈষৎ পীতাভ পক্ষিমিথুন বাছিয়া লইতে হইবে। ইহার কারণ এই যে যখন পীতের সহিত নীলের সমাবেশে সবুজের উৎপত্তি, তখন সহজেই অনুমান করা যায় যে সবুজ হইতে পীতকে বাদ দিতে পারিলেই নীলবর্ণকে জাগাইয়া তুলিতে পারা যাইবে। অতএব গোড়াতেই যদি এমন এক জোড়া পাখী বাছা যায়, যাহাদের গায়ের রংএ হরিদ্বর্ণের প্রাধান্য এবং হরিদ্রাবণের ঈষৎ আভাসমাত্র বিদ্যমান তাহা হইলে নীলবর্ণের শাবক পাইবার সম্ভাবনা সহজ হয়;—উক্ত মিথুনের সন্তানসন্ততি একেবারেই নীলবর্ণ না হইতে পারে, কিন্তু পুনরায় উক্ত শাবকগুলির মধ্য হইতে পূর্ব্ববর্ণিত উপায়ে নির্ব্বাচিত নবীন পক্ষিমিথুন লইয়া যথা সময়ে যৌনসম্মিলনে বাঞ্ছিত ফল নিশ্চয়ই পাওয়া যায়।

 উপরে যে রং ফলান বা রংবদ্‌লান ব্যাপার বর্ণিত হইল তাহা পাঠ করিলে বুঝিতে পারা যাইবে যে, একই জাতীয় সম-শ্রেণীর মধ্য হইতে সাবধানে নির্ব্বাচিত বিহঙ্গমিথুনের মিশ্রণে যে বর্ণবিপর্য্যয় পাওয়া গেল তাহার সহিত বর্ণসঙ্কর-সমস্যার বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক না থাকিলেও ইহার দ্বারা সপ্রমাণিত করা যায় যে বিভিন্ন-জাতীয় অথবা একই জাতির অন্তর্গত বিভিন্ন শ্রেণীর স্ত্রীপুং পক্ষীর সম্মিলনজাত বর্ণসঙ্করের আকার, প্রকার ও বর্ণ নূতনতর ও অধিকতর বৈচিত্র্যময় হইবে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতের হাতে কেনেরি (Canary) পাখীর যে নব নব রূপান্তর সম্ভাবিত হইয়াছে তাহাও এইরূপ জাতি ও শ্রেণীগত আকার ও বর্ণের সাম্য ও বৈষম্যের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া সুনিপুণ পক্ষিপালকের নির্ব্বাচনের ফল।

 অসীম ধৈর্য্য ও বৈজ্ঞানিক পর্য্যবেক্ষণের ফলে পক্ষিপালক যে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছেন তাহাতে তিনি অনেক সময়ে যদি দৃঢ়স্বরে কোনও থিওরি (theory) প্রচার করিতে চেষ্টা করেন তাহা পণ্ডিত সমাজে অবজ্ঞার বিষয় হইতে পারে না। ভুলভ্রান্তি, ত্রুটিবিচ্যুতি হয় ’ত ভবিষ্যতে ধরা পড়িতে পারে; কিন্তু যত দিন না বৈজ্ঞানিক আলোক-রশ্মি পক্ষিতত্ত্বের কোনও নূতন তথ্যের উপর নিপতিত হইতেছে তত দিন ঐ সমস্ত জল্পনা কল্পনা বাস্তব সত্যপ্রসূত বলিয়া মানিয়া লইতে আপত্তি করা চলে কি? পক্ষিজীবনে মেণ্ডেলীয়-সূত্র (Mendelism) কতটা পরিস্ফুট হইয়াছে, অর্থাৎ সেই সূত্র অবলম্বন করিয়া পাখীর পুরুষপরম্পরাগত বংশ-পরিচয় ঠিক দিতে পারা যায় কি না; আকৃতি প্রকৃতি ও বর্ণ বহু পূর্ব্বে সম্ভবতঃ কি ছিল ও ভবিষ্যতে কি হইবে তাহা নিশ্চিতরূপে বলা যায় কিনা এই সমস্ত বিষয় লইয়া কেহ কেহ স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন; আবার অনেকে নির্ব্বিবাদে এখনও সেই সকল সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণরূপে অনুমোদন করিতে পারিতেছেন না। কিন্তু সকলের সমবেত চেষ্টায় পক্ষিবিজ্ঞান ক্রমশঃই অধিকতর উন্নত হইতেছে। এই উন্নত পক্ষিবিজ্ঞানের (ornithology) সহিত আধুনিক পক্ষিপালন-প্রথার (aviculture) যে নিবিড় সম্পর্ক রহিয়াছে, একের উন্নতির সহিত অপরের উন্নতির যে নিগূঢ় সম্বন্ধ দাঁড়াইয়াছে তাহা বোধ হয় পাঠকবর্গ কতকটা উপলব্ধি করিতে পারিয়াছেন। বিশ্বপ্রকৃতির তূলিকার উপর মানুষের কারিকুরি, সাধারণ পাখীর নৈসর্গিক জীবনলীলাকে কৃত্রিম উপায়ে পরিবর্ত্তিত করা, অর্থাৎ পাখীর অসবর্ণ বিবাহে পৌরহিত্য করিয়া বর্ণসঙ্কর উৎপাদনের সফল চেষ্টা সাধারণ জীববিদ্যার (Biology) অঙ্গীভূত হইয়াছে।


  1. পক্ষিজাতির মধ্যে বেশী ভাগই passeres সংজ্ঞাভূক্ত; নানা বৈচিত্র্য ও বৈষম্য সত্ত্বেও সব passeres পাখীর পায়ের অঙ্গুলি-পরিচালক পেশীগুলির লক্ষণ একই রকমের; মূর্দ্ধণ্য অস্থির লক্ষণেও বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। কাক, ময়না, সালিক, কৃষ্ণগোকুল, টুনটুনি প্রভৃতি প্রায় হাজার রকম ভারতীয় পক্ষী এই বিভাগে আসিয়া পড়ে। pici বর্গীয় স্বতন্ত্র পক্ষিবিভাগের মধ্যে সকলের অবয়বেও একটা বিশিষ্ট লক্ষণ দৃষ্ট হয়। আমাদের পরিচিত কাটঠোক্‌রা জাতীয় পাখী pici সংজ্ঞাভুক্ত।
  2. সাধারণতঃ য়ুরোপে যে সকল পক্ষী aviary মধ্যে পোষা হয় সেই সকল পাখীর ডিম্বের বর্ণ ও অকৃতি অনুযায়ী অবিকল অনুকরণ চিনামাটি দ্বারা নির্ম্মিত হয় এবং তথায় অতি অল্প মূল্যে এই নকল ডিম্বগুলি পিঞ্জরব্যবসায়িগণ বিক্রয় করে।
  3. Avicultural Magazine, 3rd Series Vol. IX., p. 262.