পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
বিজ্ঞান কলেজ
১৯১৬ সালে পূজার ছুটীর পর আমি বিজ্ঞান কলেজে যোগদান করিলাম। তীক্ষ্ণদৃষ্টি আশুতোষ মুখোপাধ্যায় দেখিলেন, জ্ঞান ঘোষ, জ্ঞান মুখার্জী, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বসু প্রত্যেকেই যথাযোগ্য সুযোগ পাইলে বিজ্ঞান জগতে খ্যাতিলাভ করিবেন। তাঁহাদিগকে নূতন প্রতিষ্ঠানের সহকারী অধ্যাপক রূপে আহ্বান করা হইল। কিন্তু প্রথমেই একটা গুরুতর বাধা দেখা দিল।
ঘোষ ও পালিত বৃত্তির সর্ত অনুসারে বৃত্তির আসল টাকা বা মূলধন খরচ করিবার উপায় ছিল না। সর্তে স্পষ্ট লিখিত ছিল যে লেবরেটরির ইমারত, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি এবং উহার সংস্কার ও রক্ষা করিবার ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে হইবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের স্বচ্ছলতা ছিল না। রসায়নবিভাগে আমি অজৈব রসায়নের ভার লইয়াছিলাম এবং আমার সহকর্মী অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র মিত্র জৈব রসায়নের ভার লইয়াছিলেন। যে সব যন্ত্রপাতি ছিল, তাহা দিয়াই আমরা কাজ চালাইতাম। কিন্তু ফিজিক্যাল কেমিষ্ট্রি ও ফিজিক্স বিভাগে কার্যতঃ কোন যন্ত্রপাতি ছিল না। ওদিকে, ইউরোপে যুদ্ধ চলিতেছিল বলিয়া সেখান হইতে কোন যন্ত্রপাতি আমদানী করাও অসম্ভব ছিল।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিব্রত হইয়া পড়িলেন। পরীক্ষার্থিগণের নিকট ‘ফি’-এর টাকার উদ্বৃত্ত অংশ গত ২৫ বৎসর ধরিয়া জমাইয়া একটা ফণ্ড করা হইয়াছিল। কিন্তু বিজ্ঞান কলেজের জন্য গৃহনির্মাণ করিতেই তাহা ব্যয় হইয়া গেল। এ যেন তাঁহার উপর মালমশলা ব্যতীত ইঁট তৈরী করিবার ভার পড়িল। কিন্তু আশুতোষ পশ্চাৎপদ হইবার পাত্র নহেন। তিনি জানিতে পারিলেন যে, কাশীমবাজারের মহারাজা স্যার মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী তাঁহার বহরমপুরস্থিত নিজের কলেজে পদার্থবিদ্যায় ‘অনার্স কোর্স’ খুলিবার জন্য কতকগুলি মূল্যবান যন্ত্রপাতি কিনিয়াছিলেন, কিন্তু শেষে ঐ প্রস্তাব পরিত্যক্ত হইয়াছে। আশুতোষের অনুরোধে মহারাজা তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ঔদার্যের সহিত সমস্ত যন্ত্রপাতি বিজ্ঞান কলেজের জন্য দান করিয়াছিলেন। শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক ব্রুলও কিছু যন্ত্রপাতি ধার দিলেন। আমি নিজে সেণ্ট জেভিয়ার্স কলেজ হইতে একটি “কনডাক্টিভিটি” যন্ত্র ধার লইলাম।
এইরূপে সামান্য যন্ত্রপাতি লইয়া, ফিজিক্স ও ফিজিক্যাল কেমিস্ত্রীর দুই বিভাগ খোলা হইল। কিন্তু অধ্যাপকগণ পদে পদে বাধা অনুভব করিতে লাগিলেন, নিজেদের কোন মৌলিক গবেষণা করাও তাঁহাদের পক্ষে কঠিন হইল। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা গিয়াছে যে, মৌলিক প্রতিভার অধিকারী কোন ব্যক্তিকে যদি বাহিরের সাহায্য হইতে বঞ্চিত হইয়া সম্পূর্ণরূপে নিজের উপরে নির্ভর করিতে হয়, তবে জ্ঞানজগতে সম্পূর্ণ নূতন জিনিষ দিবার সৌভাগ্য তাঁহার ঘটে। জন বুনিয়ানের কোন সাহিত্যিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি ছিল না। কিন্তু বেডফোর্ডের কারাগারে বসিয়া তিনি তাঁহার অমর গ্রন্থ The Pilgrim’s Progress লিখিয়াছিলেন। নিউটনের বয়স যখন মাত্র ২৩ বৎসর