পাহাড়ে মেয়ে/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।


বাল্য-পরিচয়।

 আমার নাম শ্রীমতী ত্রৈলোক্যতারিণী দেবী। বর্ধমান জেলাস্থিত একটী ক্ষুদ্র পল্লীতে ব্রাহ্মণবংশে আমার জন্ম হয়। কোন্ গ্রামে আমার জন্ম, এবং আমার পিতা পিতামহ প্রভৃতির নাম কি, তাহা প্রকাশ করিয়া, সেই বংশের আর মুখোজ্জ্বল করিব না। কিন্তু যাঁহারা আমার পরিচিত, এবং আমি কোন্ বংশ-সম্ভূতা, তাহা যাঁহারা সহজে অনুমান করিয়া লইতে পারিবেন, তাঁহাদিগের নিকট আমার নিবেদন, তারা অনুগ্রহ-পূর্ব্বক উহা প্রকাশ না করিয়া, আপনাপন মনের মধ্যেই যেন গুপ্তভাবে রক্ষা করেন।

 “আমার পিতা একজন প্রসিদ্ধ ‘স্বভাব কুলীন’ ব্রাহ্মণ ছিলেন। আমি তাহারই একমাত্র দুহিতা। তিনিই আমার নাম রাখিয়াছিলেন, ত্রৈলোক্যতারিণী। বাল্যকালে আমি অতিশয় সুরূপা ছিলাম। গ্রামের ভিতর কোন সুন্দরী কন্যার কথা উঠিলে, প্রথমেই আমার নাম হইত। কিন্তু পরিশেষে সেই রূপই আমার কাল হইয়াছিল।

 “আমি লেখা-পড়া জানিতাম না। আজকাল মেয়েদের মধ্যে অনেকেই লেখা-পড়ায় যেমন অল্প-পরিমাণে শিক্ষিতা হয়, আমার অদৃষ্টে তাহা ঘটে নাই। আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময় আমাদিগের পাড়াগাঁয়ের মেয়েরা লেখাপড়ার নাম পর্য্যন্ত শ্রবণ করে নাই।

 “আমার বাল্যকাল ক্রমে অতীত হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে ক্রমে আমি বার বৎসরে উপনীত হইলাম। আমাদিগের দেশের প্রথা-অনুসারে বালিকাগণের দশ বৎসর বয়ঃক্রম হইতে না হইতেই প্রায় বিবাহ হইয়া থাকে। কিন্তু আমার পিতা মাতা আমার বার বৎসর বয়ঃক্রমের মধ্যেও আমার বিবাহের কোনরূপ বন্দোবস্ত করিয়া উঠিতে পারিলেন না। কারণ, আমাদিগের সমান ঘরে সহজে বর পাওয়া দায় হইয়া উঠিল। পিতা গোঁড়া কুলীন ছিলেন। সুতরাং আমাদিগের সমান ঘরের পরিবর্ত্তে অপর কোন ঘরে বা কিছু নীচ ঘরে আমার বিবাহ দিতে পারিলেন না। ক্রমে আরও এক বৎসর অতীত হইয়া গেল। আমি তের বৎসরে উপনীত হইলাম। পিতা মাতা আর আমাকে কোন প্রকারেই অবিবাহিতা রাখিতে পারেন না। সুতরাং পিতা খুঁজিয়া খুঁজিয়া পূর্ব্ববঙ্গ হইতে পঞ্চাশ বৎসর বয়স্ক এক জন 'স্বঘর-স্বভাব’ কুলীনকে আনিয়া, তাঁহারই সহিত আমার পরিণয়-কার্য্য সম্পন্ন করিয়া দিলেন।

 “স্বামীর মুখ দেখিয়াই হৃদয় জ্বলিয়া উঠল। বহুদিবস সঞ্চিত পরিণয়ের সুখ-পিপাসা মিটিয়া গেল। কিন্তু পিতা মাতা বা অপর গুরুজনের মধ্যে কাহারও নিকট আপন মনের কথা প্রকাশ করিতে পারিলাম না। হৃদয়ের ভিতর মুখ লুকাইয়া কেবল কাঁদিয়া কাঁদিয়াই দিন অতিবাহিত করিতে লাগিলাম।

 “আমার স্বামী কেবল যে বৃদ্ধ, তাহা নহেন তিনি আরও দশ বারটী বনিতার স্বামী। এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, পিতা যে কিরূপে আমার সহিত তাঁহার বিবাহ দিলেন, তাহা ভাবিয়া চিন্তিয়া আমি কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পরিলাম না। বিবাহ-ব্যবসায়জীবি স্বামী আমার বিবাহের পুর্ব্বেই তাঁহার পাওনাগণ্ডা বুঝিয়া লইয়াছিলেন। তথাপি বিবাহের পর আরও দুই তিন দিবস আমাদিগের বাড়ীতে অবস্থান পূর্ব্বক আরও যাহা কিছু পাইলেন, তাহা গ্রহণ করিয়া আমাকে আমার পিতৃভবনে রাখিয়া আপন দেশাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। দুই তিন বৎসর আর তাঁহার কোন সন্ধানই পাইলাম না। চারি বৎসর পরে একদিন শুনিতে পাইলাম যে, আমার স্বামী অসিয়ছেন। সেই বৃদ্ধ স্বামীর সন্নিকটে গমন করিতে আমার প্রবৃত্তি হইল না, দূর হইতে তাঁহাকে একবার দেখিলাম মাত্র; কিন্তু চিনিতে পারিলাম না। বাড়ীতে থাকিলে, পাছে তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে হয়, এই ভয়ে সেই দিবস আমি আমাদিগের বাড়ী পরিত্যাগ করিলাম, এবং আমাদিগের বাড়ীর সংলগ্ন তারা বৈষ্ণবীর বাড়ীতে গিয়া লুকাইয়া রহিলাম। বলা বাহুল্য, রাত্রিকালও তারাদিদির সহিত তাহারই বাড়ীতে কাটিয়া গেল। আমার স্বামীও, কি জানি, কি ভাবিয়া, তাঁহার পাথেয় খরচ বুঝিয়া লইয়া, পরদিবস প্রত্যুষেই আমাদিগের বাড়ী হইতে চলিয়া গেলেন।

 “স্বামী আমাদিগের বাড়ী হইতে প্রস্থান করিলে পর, পিতামাতা আমাকে তারাদিদির বাড়ী হইতে ডাকাইয়া আনাইয়া আমাকে সহস্র গালি প্রদান করিলেন, ও পরিশেষে দুই এক ঘা প্রহার করিতেও ক্রটি করিলেন না। রাত্রিবাসের নিমিত্ত তারাদিদি আমাকে তাহার গৃহে স্থান দিয়াছিল বলিয়া, তাহারও অপমানের কিছু বাকী রহিল না। পিতামাতা কর্ত্তৃক এইরূপ অবমানিত হইয়া আমি মনে মনে স্থির করিলাম, আত্মহত্যা করিয়া পিতামাতার দুর্ব্বাক্য হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিব; কিন্তু তারাদিদির পরামর্শে তাহা আর করিতে পারিলাম না। কেমন এক মোহিনীশক্তি অবলম্বন করিয়া তারাদিদি আমার মনের গতি ফিরাইয়া দিল। এই সময় হইতে তারাদিদির সহিত আমার প্রণয় জন্মিতে লাগিল। আমার বেশ অনুমান হইতে লাগিল যে, তারাদিদিও আমাকে ভালবাসিতে আরম্ভ করিয়াছে; সুতরাং আমিও প্রাণের সহিত তাহাকে ভালবাসিতে আরম্ভ করিলাম। এইরূপে প্রায় এক বৎসরকাল অতীত হইতে না হইতেই বঙ্গদেশ হইতে সংবাদ অসিল, আমার স্বামীর মৃত্যু হইয়াছে। আমি বিধবা হইলাম।

 “আমি বিধবা হইলাম সত্য; কিন্তু হিন্দু-বিধবার ধর্ম্ম কিছুই আমাকে প্রতিপালন করিতে হইল না। জানি না, তারাদিদি আমার পিতামাতাকে কি বুঝাইয়া দিল, তাঁহারাও তারাদিদির কথা শুনিয়া তাহারই পরামর্শমত কার্য্য করিলেন। আমার পরিহিত শাটী বা অলঙ্কার প্রভৃতি কিছুই পরিত্যাগ বা পরিবর্ত্তন করিতে হইল না। সধবা অবস্থায় যেরূপ সাজে আমি সজ্জিত থাকিতাম, বিধবা অবস্থাতেও আমি সেইরূপ সাজে সজ্জিত থাকিতে লাগিলাম।

 “আমি বিধবা হইলাম সত্য; কিন্তু বৈধব্যযন্ত্রণা যে কি প্রকার, তাহার কিছুই অনুভব করিতে পারিলাম না। সধবাবস্থা ও বিধবাবস্থা উভয় অবস্থাই আমার পক্ষে সমান বোধ হইতে লাগিল। সধবা অবস্থায় আমার মনে যেরূপ সুখ বা দুঃখ ছিল, বিধবা অবস্থাতেও ঠিক সেইরূপই অনুভব করিতে লাগিলাম, তাহার কিছুমাত্র তারতম্য বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। আহারীয় দ্রব্যের মধ্যে কেবল মৎস্য মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ হইল, এবং এক সন্ধ্যা ব্যতীত অন্নাহার করিতে পারিতাম না। তাহাও অতি সামান্য দিবসের নিমিত্ত; বোধ হয়, এক বৎসরের অধিক আমাকে সেই নিয়ম প্রতিপালন করিতে হয় নাই।

 “আমার সধবা অবস্থায় তারাদিদি আমাকে যেরূপ ভালবাসিত, বিধবা অবস্থায় যেন তাহার অপেক্ষা অধিক পরিমাণে ভালবাসিতে আরম্ভ করিল, এবং প্রাণের সহিত আমাকে যত্ন করিতে লাগিল। পরিশেষে এরূপ হইয়া উঠিল যে, আমাকে একদণ্ড না দেখিতে পাইলে সে অস্থির হইয়া পড়িত। আমারও ভালবাসা ক্রমে তাহার উপর বদ্ধমূল হইয়া আসিতে লাগিল। আমার মনের সুখ, আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা প্রভৃতি সমস্তই তারাদিদির নিকট বলিলে, মন যেন সন্তোষের উদয় হইত, এবং তাহার কথা শুনিতে, তাহার নিকট উপদেশ ও পরামর্শ গ্রহণ করিতে মন যেন সর্ব্বদাই ব্যস্ত থাকিত। আমি তারাদিদির কথায় দিন দিন কেন এরূপ ভাবে বশীভূত হইয়া পড়িতে লাগিলাম, তাহা কিন্তু আমি নিজেই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না, বা বুঝিবার চেষ্টাও করিলাম না। তারাদিদি যে কে, তাহার চরিত্রই বা কি প্রকার, তাহার একটু সংক্ষিপ্ত পরিচয় এই স্থানে প্রদান করা, বোধ হয়, নিতান্ত আবশ্যক। আমি তাহার চরিত্র সম্বন্ধে সমস্ত কথা অবগত না থাকিলেও যতদূর অবগত আছি, তাহাই এই স্থানে বর্ণন করিতেছিমাত্র। ইহাতেই আপনারা বুঝিতে পরিবেন, তারদিদির চরিত্র কি প্রকার।”