পাহাড়ে মেয়ে/প্রথম পরিচ্ছেদ

পাহাড়ে মেয়ে।


প্রথম পরিচ্ছেদ।

◇◇◇◇◇◇

সূচনা।

 রাজকুমারীনাম্নী একটী চরিত্রহীনা স্ত্রীলোককে হত্যা[] করার অপরাধে ত্রৈলোক্যনাম্নী অপর আর একটী স্ত্রীলোক চরম দণ্ডিত হয়। এই হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধানে আমি নিযুক্ত হইবার পূর্ব্বে ইহার বিপক্ষে আমি আরও একটু অনুসন্ধান করিয়াছিলাম। সুতরাং ইহার পূর্ব্ব বৃত্তান্ত আমি বিস্তর অবগত হইতে পারিয়াছিলাম। তথাপি ইহার জীবনচরিত বিশদরূপে জানিবার নিমিত্ত, চরমদণ্ডের আদেশের পর আমি একদিবস কারাগারে গমন করি, এবং তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহি,—“দেখ ত্রৈলোক্য! তোমার উপর যেরূপ ভয়ানক রাজদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, সেরূপ দণ্ড এ দেশীয় অপর কোন হিন্দুরমণী যে আর কখন প্রাপ্ত হইয়ছে, তাহা আমি অবগত নহি। যে মহাপাপের নিমিত্ত তোমাকে এই ভয়ানক দণ্ড গ্রহণ করিতে হইতেছে, সেরূপ মহাপাপ হিন্দুরমণীর মধ্যে বোধ হয়, তুমিই প্রথম প্রবর্ত্তিত করিলে। সে যাহা হউক, তোমার এই অন্তিম সময়ে দুইটী সবিশেষ কার্য্যবশতঃ আজ আমি তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি। প্রথমতঃ, তুমি সবিশেষরূপে অবগত আছ যে, তোমার এই ভয়ানক দণ্ডের মূলীভূত কারণ সকলের অন্যতম কারণই আমি। কারণ, যেরূপ ভাবে আমি এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, সেইরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, যদি আমি এই অনুসন্ধানে লিপ্ত না হইতাম, বা যেরূপ ভাবে আমি তোমাকে প্রতারিত করিয়াছিলাম, সেইরূপ ভাবে তুমি যদি আমা কর্ত্তৃক প্রতারিত না হইতে, তাহা হইলে এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কথা সকল বোধ হয়, কিছুই প্রকাশিত হইয়া পড়িত না; সুতরাং তুমিও এই ভয়ানক দণ্ডে দণ্ডিত হইতে না। কাজেই তোমার এই চরমদণ্ডের মূলীভূত কারণ সকলের অন্যতম কারণই আমি। ইহা আমি নিজ মনে উত্তমরূপে অবগত হইয়া, তোমার জীবনের এই শেষ সময়ে তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিবার মানসে আজ আমি তোমার নিকট উপনীত হইয়াছি। আশা করি, যদি ইহাতে আমার কোনরূপ দোষ থাকে, তাহা হইলে তুমি আমাকে ক্ষমা করিবে। কারণ, নিজ ইচ্ছার বশবর্ত্তী বা কোনরূপ লোভ পরতন্ত্র হইয়া আমি এরূপ জঘন্য কার্য্যে প্রবৃত্ত হই নাই, তাহা তুমি বেশ অবগত আছ। কেবলমাত্র আমার কর্ত্তব্যকর্ম্মের বশবর্ত্তী হইয়াই, আমি তোমার এইরূপ বীভৎস পরিণামের মূলীভূত কারণ সমূহের অন্যতম কারণ হইয়াছি।

 “ত্রৈলোক্য! এখন তুমি বেশ বুঝিতে পারিতেছ যে, তোমার মৃত্যু অতি নিকটবর্ত্তী। বোধ হয়, এক সপ্তাহের মধ্যেই রাজআদেশে তোমার প্রাণ বায়ু বিরামলাভ করিবে। আমার বিশ্বাস, এই অবস্থায় তুমি আর কোনরূপ মিথ্যা কথা বলিয়া তোমার কলুষিত আত্মাকে আরও কলুষিত করিবে না।

 “আমি যে দুইটী কার্য্যের নিমিত্ত আজ তোমার নিকট আগমন করিয়াছি, তাহার প্রথম কার্য্যের বিষয় তোমার নিকট বিবৃত করিলাম। দ্বিতীয় কার্য্যটী যে কি, তাহাই এখন তোমাকে শুনিতে হইবে। কেবল শ্রবণ নহে,—আজ তোমাকে আমার প্রার্থনা পূর্ণ করিতে হইবে। অদ্য আমি তোমার নিকট যে প্রার্থনা করতে আসিয়াছি, তাহাই তোমার নিকট আমার শেষ প্রার্থনা। আশা করি, আমার এই শেষ প্রার্থনা পূর্ণ করিতে তুমি কোনরূপেই কুষ্ঠিত হইবে না; বরং আমার প্রার্থিত বিষয় বর্ণন করিয়া, অপর অনেকের উৎকণ্ঠা দূর করিবে। আমার সেই শেষ প্রার্থনা আর কিছুই নহে, কেবল তোমার জীবনের মূল স্থূল ঘটনাগুলি জানিবার ইচ্ছা মাত্র। আমি জানি, তোমার জীবনের অনেক অংশ ভয়ানক বিভীষিকাময় কার্য্যে পরিপূর্ণ। যে সকল মহাপাপের ফল তুমি আজ প্রাপ্ত হইয়াছ, তাহার অনেক বিষয় আমি অবগত আছি; কিন্তু সমস্ত বিষয় সম্পূর্ণরূপ জানিব বলিয়াই, আজ তোমার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। এখন তুমি আমার প্রার্থনা পূর্ণ করিয়া একদিকে আমার কৌতূহল পরিতৃপ্ত কর,—অপর দিকে স্ত্রীলোকমাত্রকেই জানাইয়া দাও যে, পাপ-পথে পদার্পণ করিলে, তাহার ভবিষ্যৎ ফল কি হইতে পারে।”

 আমার কথা শ্রবণ করিয়া ত্রৈলোক্য কহিল, “মহাশয়। আমি আমার জীবনের যৌবনাবস্থা হইতে আরম্ভ করিয়া, দিন দিন যেরূপ রাশি রাশি ভয়ানক পাপ উপার্জ্জন করিয়াছি, তাহার উপযুক্ত দণ্ড আমি প্রাপ্ত হই নাই! এখন আমি জানিতে পারিলাম, ইংরাজ রাজত্বে ভয়ানক পাপীর উপযুক্ত দণ্ড বিধান হয় না। ইংরাজ আইনে মহাপাপীর মহাদণ্ডের বিধান নাই!

 “আমি আমার যৌবনকাল হইতে আরম্ভ করিয়া, কত মহাপাপের প্রশ্রয় দিয়াছি, এবং এ পর্য্যন্ত কত লোকের প্রাণহত্যা করিয়া, মহাপাপের সঞ্চয় করিয়া আসিয়াছি, তাহার উচিত দণ্ড কি প্রাপ্ত হইলাম? আমার এই সামান্য পাপ-প্রাণকে হত্যা করিলেই কি, আমার কৃত মহাপাপ সকলের দণ্ড হইল? আমার এই দেহের ভিতর যদি সহস্র প্রাণ থাকিত, এবং সেই সকল প্রাণকে লক্ষ লক্ষ প্রকার যন্ত্রণা দিয়া যদি হত্যা করা হইত, তাহা হইলেও আমার কৃত পাপরাশির সহস্রাংশের কিয়ৎপরিমাণে দণ্ড হইত কি না, বলিতে পারি না।

 “আপনি আমার জীবনের স্থূল স্থূল বিবরণ সকল অবগত হইতে চাহিতেছেন, এরূপ অবস্থায় আপনার অনুরোধ রক্ষা করিতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। আমার যতদূর মনে আছে, বা যতদূর মনে করিতে পারিব, তাহার সমস্ত কথা আমি আপনার নিকট বর্ণন করিতেছ। কিন্তু মহাশয়! আমার কৃত মহাপাপ সকলের কাহিনী আপনি শ্রবণ করিবেন কি? কারণ, আমি যে সকল মহাপাপ করিয়া এ পর্য্যন্ত আমার জীবন অতিবাহিত করিয়া আসিয়াছি, সেই সকল কাহিনী কেবলমাত্র শ্রবণ করিলেও যে পাপ হয়, তাহারও প্রায়শ্চিত্ত বোধ হয়, এ জগতে নাই। মৃত্যুকালে আমার আর লোক-লজ্জার ভয় কি? আমার জীবনের কাহিনী আমার যতদূর স্মরণ আছে, এবং যতদূর স্মরণ করিয়া বলিতে পারিব, তাহা বলিতেছি। আপনি হউন, বা অপর যে কেউ হউন, যিনি শুনিতে চাহেন, শুনুন।”


  1. এই হত্যার যথাযথ বিবরণ, তাহার অনুসন্ধান প্রভৃতি, বিস্তৃত রূপে সপ্তম বৎসরের ৭৮ম সংখ্যক দারোগার দপ্তরে বর্ণিত আছে।