পাহাড়ে মেয়ে/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
সুখের ঢেউ।
“আমি পূর্ব্বে একবার ভাবিয়াছিলাম, যদি তিনি আমাকে পরিত্যাগ করেন, তাহা হইলে আমার কি হইবে। কিন্তু এখন দেখিলাম, তাঁহার মৃত্যুর পরও আমার কোনরূপ কষ্ট হইল না, বরং আমার সুখেরই বৃদ্ধি হইতে লাগিল, সম্পদলক্ষ্মী আসিয়া যেন আমাকে আশ্রয় করিতে লাগিলেন।
“পূর্ব্ব হইতেই সোণাগাছি অঞ্চলে জনরব উঠিয়াছিল যে, একটী সুরূপা স্ত্রীলোক ঘর হইতে নূতন বাহির হইয়া আসিয়াছে, এবং সেই সময় হইতেই সোণাগাছি-ভ্রমণকারী অনেক বাবুই আমার নিকট আসিয়া, আমার সহিত প্রেমালাপ করিবার নিমিত্ত বিশেষরূপ চেষ্টা করিয়া আসিতেছিলেন! কিন্তু এতকাল পর্য্যন্ত তাঁহাদিগের মধ্যে কোন ব্যক্তিই তাঁহাদের বাসনা পূর্ণ করিয়া উঠিতে সক্ষম হন নাই; এখন তাঁহাদিগের যাত্রাপথ প্রশস্ত হইল, আমারও অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন হইল। এখন হইতে রাত্রিদিন আমার ঘরে আমোদ-প্রমোদ চলিতে লাগিল, সুখের তরঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে সুরার ঢেউ বহিতে লাগিল। প্রত্যেকেই মনে করিতে লাগিলেন, আমি যদিও কলিকাতার বেশ্যামণ্ডলীর রীত্যনুসারে সকলের সহিত প্রকাশ্যে আমোদ-আহ্লাদ করিয়া থাকি, কিন্তু অন্তরে তাঁহাকে ভিন্ন আর কাহাকেও জানি না। ফলতঃ যাঁহারা আমার ঘরে আসিতেন, তাঁহারা সকলেই আমার মুখের মিষ্ট কথায় ভুলিতেন; কিন্তু আমার অন্তরের ভাব কেহই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেন না; ক্রমে তাঁহারা আপনার আশাকে নিবৃত্ত ও লালসাকে চরিতার্থ করিয়া, আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে লাগিলেন; আমাকে আমার আশাতিরিক্ত অর্থ-সাহায্য করিতেও কেহ কুণ্ঠিত হইলেন না।
“এইরূপ উপায়ে ক্রমে ক্রমে আমার যথেষ্ট সঙ্গতি হইতে লাগিল; সোণায় আমার অঙ্গ ঢাকিয়া গেল। নাকে, কাণে বড় বড় সাদা সাদা মুক্তা ঝুলিতে লাগিল; অঙ্গুলিতেও কোন কোন সুবর্ণময় অলঙ্কারের মধ্যে সাদা, লাল, সবুজ প্রভৃতি বর্ণের বড় বড় পাথর ঝক্মক্ করিতে লাগিল। অধিক কি, কলিকাতার ভিতর নিজের একখানি বড়গোছের তেতলা বাড়ীও হইল; উহার দরজায় ছিটের মির্জাই আঁটা, লাল পাকড়ী বাঁধা, দুইজন দ্বারবানও বসিল, এবং বাটীর ভিতর চারি পাঁচজন দাস-দাসীও ঘুরিতে লাগিল। এক কথায়, এখন আমার সম্পদ দেখে কে, আমার সম্মুখে দাঁড়ায় কে? এবং আমার বাটীর ভিতর সহজে আসেই বা কে? আমি আর কাহাকেও তোষামোদ করি না, কড়া কথা ভিন্ন আর কাহাকেও মিষ্ট কথা বলি না, এবং যে সে ব্যক্তি আসিয়া আমার বিছানায় বসিতেও পারে না; তথাপি আমার পসারের কিছুমাত্র ক্ষতি না হইয়া, ক্রমেই বৃদ্ধি হইতে লাগিল।
“এইরূপে প্রায় দশ পনর বৎসর অতীত হইয়া গেল; যৌবন জোয়ারে ভরা নদীর উপর সুখের ঢেউ বহিতে লাগিল। মনে করিলাম, পূর্ণ জোয়ারে এইরূপ চিরকাল সাঁতার দিব, সুখের তরঙ্গে এইরূপ হেলিতে দুলিতে জীবন-নদী পার হইব।
“যখন আমার জীবনে এইরূপ সুখের তরঙ্গ উঠিতেছে, সেই সময় কালীবাবু নামক একটী বাবুর সহিত আমার বড়ই প্রণয় জন্মিয়াছিল। কালীবাবু বড় লোক ছিলেন না, গরিবের ছেলে, সামান্য দালালী করিয়া আপনার জীবিকা নির্ব্বাহ করিতেন; কিন্তু দেখিতে অতি সুপুরুষ ছিলেন। একদিবস একটি বাবুর সহিত তিনি সর্ব্বপ্রথম আমার বাড়িতে আসিয়াছিলেন, আমিও সেইদিবস তাঁহাকে প্রথম দেখিয়াছিলাম; কিন্তু তাঁহাকে যে কি ক্ষণে দেখিয়াছিলাম, তাহা বলিতে পারি না। সেই প্রথম দর্শনই আমার সর্ব্বনাশ করিয়াছিল; সেই দিবস হইতেই কালীবাবুর যে ছায়া আমার হৃদয়পটে অঙ্কিত হইয়াছিল, সে ছায়া আর কখনও আমার হৃদয় হইতে অন্তর্হিত হইল না; বরং ক্রমেই উহা আমার হৃদয়ের স্তরে স্তরে প্রবেশলাভ করিল? ক্রমে কালীবাবুর উপর আমার এরূপ হইয়া উঠিল যে, এক মুহূর্ত্তের নিমিত্ত আমি তাঁহাকে আমার নয়নের অন্তরাল করিতে পারিতাম না। অতি অল্প সময়ের নিমিত্তও তিনি কোন স্থানে গমন করিলে, আমার হৃদয় ব্যাকুল হইয়া পড়িত, মন অস্থির হইত; যতক্ষণ তিনি প্রত্যাবর্তন না করিতেন, ততক্ষণ কোনক্রমেই সুস্থ হইতে পারিতাম না। কালীবাবু যে দালালী কার্য্য করিতেন, ক্রমে তাঁহার সেই দালালী কার্য্য করা বন্ধ করিয়া দিলাম। ইতিপূর্ব্বে কালীবাবু কখনও আমাকে এক পয়সা প্রদান করেন নাই, এখন তাঁহার নিজের সমস্ত খরচ পত্র পর্য্যন্ত আমি বহন করিতে লাগিলাম। কেবল তাহা নহে, তাঁহার পরিবারের খরচের নিমিত্তও আমি প্রত্যেক মাসে তাঁহাকে কিছু কিছু পাঠাইয়া দিতে লাগিলাম। কালীবাবুও অন্য কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া রাত্রিদিন আমারই নিকট থাকিতে লাগিলেন, এবং আমারই হৃদয়ের উপর তাঁহার নিজের কর্ত্তৃত্ব স্থাপন করিয়া পরম সুখে দিনযাপন করিতে লাগিলেন।
“ক্রমে কালীবাবুই আমার সর্ব্বময় কর্ত্তা হইয়া পড়িলেন। দেনা-পাওনার হিসাব, খরচের টাকা, আলমারি-বাক্সের চাবি প্রভৃতি সমস্তই ক্রমে তাঁহার হস্তে পড়িল। আমার নিজের খরচপত্র প্রভৃতিও সমস্তই তাঁহারই ইচ্ছমত হইতে লাগিল। এইরূপে কিছুদিবস অতীত হইয়া গেল।”