পুনশ্চ/বিচ্ছেদ
বিচ্ছেদ
আজ এই বাদলার দিন,
এ মেঘদূতের দিন নয়।
এ দিন অচলতায় বাঁধা।
মেঘ চলচে না, চল্চে না হাওয়া,
টিপিটিপি বৃষ্টি
ঘোমটার মতো পড়ে আছে
দিনের মুখের উপর।
স::ময়ে যেন স্রোত নেই,
চারদিকে অবারিত আকাশ,
অচঞ্চল অবসর।
যেদিন মেঘদূত লিখেচেন কবি,
সেদিন বিদ্যুৎ চমকাচ্চে নীল পাহাড়ের গায়ে।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছুটেচে মেঘ,
পূবে হাওয়া বয়েচে শ্যামজম্বূ-বনান্তকে দুলিয়ে দিয়ে।
যক্ষনারী বলে উঠেছে
মাগো, পাহাড়সুদ্ধ নিল বুঝি উড়িয়ে।
মেঘদূতে উড়ে চলে যাওয়ার বিরহ,
দুঃখের ভার পড়ল না তার পরে,
সেই বিরহে ব্যথার উপর মুক্তি হয়েচে জয়ী।
সেদিনকার পৃথিবী জেগে উঠেছিল
উচ্ছল ঝরনায়, উদ্বেল নদীস্রোতে,
মুখরিত বন-হিল্লোলে,
তার সঙ্গে দুলে দুলে উঠেচে
মন্দাক্রান্তা ছন্দে বিরহীর বাণী।
একদা যখন মিলনে ছিল না বাধা
তখন ব্যবধান ছিল সমস্ত বিশ্বে,
বিচিত্র পৃথিবীর বেষ্টনী পড়েছিল
নিভৃত বাসককক্ষের বাইরে।
যেদিন এল বিচ্ছেদ
সেদিন বাঁধন-ছাড়া দুঃখ বেরলো
নদী গিরি অরণ্যের উপর দিয়ে।
কোণের কান্না মিলিয়ে গেল পথের উল্লাসে।
অবশেষে ব্যথার রূপ দেখা গেল
যে কৈলাসে যাত্রা হোলো শেষ।
সেখানে অচল ঐশ্বর্য্যের মাঝখানে
প্রতীক্ষার নিশ্চল বেদনা।
অপূর্ণ যখন চলেচে পূর্ণের দিকে
তার বিচ্ছেদের যাত্রাপথে
আনন্দের নব নব পর্য্যায়।
পরিপূর্ণ অপেক্ষা করচে স্থির হয়ে;
নিত্য পুষ্প, নিত্য চন্দ্রালোক,
নিত্যই সে একা, সেই তো একান্ত বিরহী।
যে অভিসারিকা তারই জয়,
আনন্দে সে চলেচে কাঁটা মাড়িয়ে।
ভুল বলা হল বুঝি।
সেও তো নেই স্থির হয়ে যে পরিপূর্ণ,
সে যে বাজায় বাঁশি, প্রতীক্ষার বাঁশি,—
সুর তার এগিয়ে চলে অন্ধকার পথে।
বাঞ্ছিতের আহ্বান আর অভিসারিকার চলা
পদে পদে মিলচে একই তালে।
তাই নদী চলেচে যাত্রার ছন্দে,
সমুদ্র হলচে আহ্বানের সুরে॥
৭ ভাদ্র, ১৩৩৯