পুনশ্চ/শিশুতীর্থ
শিশুতীর্থ
রাত কত হোলো?
উত্তর মেলেনা।
কেননা, অন্ধ কাল যুগ-যুগান্তরের গোলকধাঁধায় ঘোরে,
পথ অজানা,
পথের শেষ কোথায় খেয়াল নেই।
পাহাড়তলীতে অন্ধকার মৃত রাক্ষসের চক্ষুকোটরের মতো;
স্তূপে স্তূপে মেঘ আকাশের বুক চেপে ধরেচে;
পুঞ্জ পুঞ্জ কালিমা গুহায় গর্ত্তে সংলগ্ন,
মনে হয় নিশীথ রাত্রের ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ:
দিগন্তে একটা আগ্নেয় উগ্রতা
ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে আর নেভে;
ওকি কোনো অজ্ঞানা দুষ্টগ্রহের চোখ-রাঙানি,
ওকি কোনো অনাদি ক্ষুধার লেলিহ লোল জিহ্বা।
বিক্ষিপ্ত বস্তুগুলো যেন বিকারের প্রলাপ,
অসম্পূর্ণ জীবলীলার ধূলিবিলীন উচ্ছিষ্ট;
তারা অমিতাচারী দৃপ্ত প্রতাপের ভগ্ন তোরণ,
লুপ্ত নদীর বিস্মৃতিবিলগ্ন জীর্ণ সেতু,
দেবতাহীন দেউলের সর্পবিবরছিদ্রিত বেদী,
অসমাপ্ত দীর্ণ সোপানপংক্তি শূন্যতায় অবসিত।
অকস্মাৎ উচ্চণ্ড কলরব আকাশে আবর্তিত আলোড়িত হতে থাকে,
ও কি বন্দী বন্যা-বারির গুহা-বিদারণের রলরোল?
ও কি ঘূর্ণ্যতাণ্ডবী উম্মাদ সাধকের রুদ্র মন্ত্র উচ্চারণ?
ও কি দাবাগ্নিবেষ্টিত মহারণ্যের আত্মঘাতী প্রলয়-নিনাদ?
এই ভীষণ কোলাহলের তলে তলে একটা অস্ফুট ধ্বনিধারা বিসর্পিত—
যেন অগ্নিগিরিনিঃসৃত গদগদ-কলমুখর পঙ্কস্রোত;
তাতে একত্রে মিলেচে পরশ্রীকাতরের কানাকানি, কুৎসিত জনশ্রুতি,
অবজ্ঞার কর্কশহাস্য।
সেখানে মানুষগুলো সব ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতো,
ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্চে,
মশালের আলোয় ছায়ায় তাদের মুখে
বিভীষিকার উল্কি পরানো।
কোনো এক সময়ে অকারণ সন্দেহে কোনো এক পাগল
তার প্রতিবেশীকে হঠাৎ মারে,
দেখ্তে দেখ্তে নির্ব্বিচার বিবাদ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে দিকে দিকে।
কোনো নারী আর্ত্তস্বরে বিলাপ করে,
বলে, হায় হায়, আমাদের দিশাহারা সন্তান উচ্ছন্ন গেল।
কোনো কামিনী যৌবনমদবিলসিত নগ্ন দেহে অট্টহাস্য করে,
বলে, কিছুতে কিছু আসে যায় না॥
২
ঊর্দ্ধে গিরিচূড়ায় বসে আছে ভক্ত, তুষারশুভ্র নীরবতার মধ্যে;—
আকাশে তার নিদ্রাহীন চক্ষু খোঁজে আলোকের ইঙ্গিত।
মেঘ যখন ঘনীভূত, নিশাচর পাখী চিৎকার শব্দে যখন উড়ে যায়,
সে বলে, ভয় নেই ভাই, মানবকে মহান্ ব’লে জেনো।
ওরা শোনেনা, বলে, পশুশক্তিই আদ্যাশক্তি, বলে পশুই শাশ্বত;
বলে সাধুতা তলে তলে আত্মপ্রবঞ্চক।
যখন ওরা আঘাত পায়, বিলাপ ক’রে বলে, “ভাই তুমি কোথায়?”
উত্তরে শুন্তে পায়, “আমি তোমার পাশেই।”
অন্ধকারে দেখতে পায় না, তর্ক করে, “এ বাণী ভয়ার্ত্তের মায়া-সৃষ্টি,
আত্মসান্ত্বনার বিড়ম্বনা।”
বলে, “মানুষ চিরদিন কেবল সংগ্রাম করবে,
মরীচিকার অধিকার নিয়ে
হিংসা-কণ্টকিত অন্তহীন মরুভূমির মধ্যে॥”
৩
মেঘ সরে গেল।
শুকতারা দেখা দিল পূর্ব্বদিগন্তে,
পৃথিবীর বক্ষ থেকে উঠ্ল আরামের দীর্ঘনিশ্বাস,
পল্লবমর্ম্মর বন পথে পথে হিল্লোলিত,
পাখী ডাক দিল শাখায় শাখায়।
ভক্ত বল্লে, সময় এসেচে।
কিসের সময়?
যাত্রার।
ওরা বসে ভাব্লে।
অর্থ বুঝ্লে না, আপন আপন মনের মতো করে অর্থ বানিয়ে নিলে।
ভোরের স্পর্শ নাম্ল মাটির গভীরে,
বিশ্বসত্তার শিকড়ে শিকড়ে কেঁপে উঠল প্রাণের চাঞ্চল্য।
কে জানে কোথা হতে একটি অতি সূক্ষ্মস্বর
সবার কানে কানে বললে,
চলো সার্থকতার তীর্থে।
এই বাণী জনতার কণ্ঠে কণ্ঠে মিলিত হয়ে
একটি মহৎ প্রেরণায় বেগবান হয়ে উঠল।
পুরুষেরা উপরের দিকে চোখ তুল্লে,
জোড় হাত মাথায় ঠেকালে মেয়েরা।
শিশুরা করতালি দিয়ে হেসে উঠল।
প্রভাতের প্রথম আলো ভক্তের মাথায় সোনার রঙের চন্দন পরালে,
সবাই বলে উঠল, “ভাই, আমরা তোমার বন্দনা করি।”
৪
যাত্রীরা চারিদিক থেকে বেরিয়ে পড়ল—
সমুদ্র পেরিয়ে, পর্ব্বত ডিঙিয়ে, পথহীন প্রান্তর উত্তীর্ণ হয়ে।—
এল নীল নদীর দেশ থেকে, গঙ্গার তীর থেকে,
তিব্বতের হিমমজ্জিত অধিত্যকা থেকে;
প্রাকাররক্ষিত নগরের সিংহদ্বার দিয়ে,
লতাজালজটিল অরণ্যে পথ কেটে।
কেউ আসে পায়ে হেঁটে, কেউ উটে, কেউ ঘোড়ায়, কেউ হাতীতে,
কেউ রথে চীনাংশুকের পতাকা উড়িয়ে।
নানা ধর্ম্মের পূজারী চল্ল ধূপ জ্বালিয়ে, মন্ত্র পড়ে;
রাজা চল্ল, অনুচরদের বর্ষা-ফলক রৌদ্রে দীপ্যমান,
ভেরী বাজে গুরু গুরু মেঘমন্দ্রে।
ভিক্ষু আসে ছিন্ন কন্থ। পরে,
আর রাজ-অমাত্যের দল স্বর্ণলাঞ্ছন-খচিত উজ্জ্বল বেশে;—
জ্ঞানগরিমা ও বয়সের ভারে মন্থর অধ্যাপককে ঠেলে দিয়ে চলে
চটুলগতি বিদ্যার্থী যুবক।
মেয়েরা চলেচে কলহাস্থ্যে, কত মাতা, কুমারী, কত বধূ;
থাল’য় তাদের শ্বেতচন্দন, ঝারিতে গন্ধসলিল।
বেশ্যাও চলেচে সেই সঙ্গে, তীক্ষ্ণ তাদের কণ্ঠস্বর,
অতি-প্রকট তাদের প্রসাধন।
চলেচে পঙ্গু খঞ্জ, অন্ধ আতুর,
আর সাধুবেশী ধর্মব্যবসায়ী,
দেবতাকে হাটে হাটে বিক্রয় করা যাদের জীবিকা।
সার্থকতা!
স্পষ্ট করে কিছু বলে না,—কেবল নিজের লোভকে মহৎ নাম ও
বৃহৎ মূল্য দিয়ে ঐ শব্দটার ব্যাখ্যা করে,
আর শাস্তিশঙ্কাহীন চৌর্যাবৃত্তির অনন্ত সুযোগ ও আপন মলিন
ক্লিন্ন দেহমাংসের অক্লান্ত লোলুপতা দিয়ে কল্পস্বর্গ রচনা করে।
৫
দয়াহীন দুর্গমপথ উপলখণ্ডে আকীর্ণ।
ভক্ত চলেচে, তার পশ্চাতে বলিষ্ঠ এবং শীর্ণ,
তরুণ এবং জরা-জর্জ্জর, পৃথিবী শাসন করে যারা,
আর যারা অর্দ্ধাশনের মূল্যে মাটি চাষ করে।
কেউ বা ক্লান্ত বিক্ষতচরণ, কারো মনে ক্রোধ, কারো মনে সন্দেহ।
তারা প্রতি পদক্ষেপ গণনা করে আর শুধায়, কত পথ বাকি।
তার উত্তরে ভক্ত শুধু গান গায়।
শুনে তাদের ভ্রূ কুটিল হয়, কিন্তু ফিরতে পারে না,
চলমান জনপিণ্ডের বেগ এবং অনতিব্যক্ত আশার তাড়না
তাদের ঠেলে নিয়ে যায়।
ঘুম তাদের কমে এল, বিশ্রাম তারা সংক্ষিপ্ত করলে,
পরস্পরকে ছাড়িয়ে চলবার প্রতিযোগিতায় তারা ব্যগ্র,
ভয়, পাছে বিলম্ব করে বঞ্চিত হয়।
দিনের পর দিন গেল।
দিগন্তের পর দিগন্ত আসে,
অজ্ঞাতের আমন্ত্রণ অদৃশ্য সঙ্কেতে ইঙ্গিত করে।
ওদের মুখের ভাব ক্রমেই কঠিন
আর ওদের গঞ্জনা উগ্রতর হোতে থাকে।
৬
রাত হয়েচে।
পথিকেরা বটতলায় আসন বিছিয়ে বস্ল।
একটা দমকা হাওয়ায় প্রদীপ গেল নিবে, অন্ধকার নিবিড়,
যেন নিদ্রা ঘনিয়ে উঠ্ল মূর্চ্ছায়।
জনতার মধ্য থেকে কে একজন হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে
অধিনেতার দিকে আঙুল তুলে বল্লে,
“মিথ্যাবাদী, আমাদের প্রবঞ্চনা করেচ।”
ভর্ৎসনা এক কণ্ঠ থেকে আরেক কণ্ঠে উদগ্র হতে থাকল।
তীব্র হল মেয়েদের বিদ্বেষ, প্রবল হল পুরুষদের তর্জ্জন।
অবশেষে একজন সাহসিক উঠে দাঁড়িয়ে
হঠাৎ তাকে মারলে প্রচণ্ড বেগে।
অন্ধকারে তার মুখ দেখা গেল না।
একজনের পর একজন উঠ্ল, আঘাতের পর আঘাত করলে,
তার প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়্ল।
রাত্রি নিস্তব্ধ।
ঝর্নার কলশব্দ দূর থেকে ক্ষীণ হয়ে আসচে।
বাতাসে যূথীর মৃদু গন্ধ।
৭
যাত্রীদের মন শঙ্কায় অভিভূত।
মেয়েরা কাঁদচে, পুরুষেরা উত্যক্ত হয়ে ভর্ৎসনা করচে, চুপ করো।
কুকুর ডেকে ওঠে, চাবুক খেয়ে আর্ন্ত কাকূতিতে তার ডাক থেমে যায়।
রাত্রি পোহাতে চায় না।
অপরাধের অভিযোগ নিয়ে মেয়ে পুরুষে তর্ক তীব্র হতে থাকে।
সবাই চীৎকার করে, গর্জ্জন করে,
শেষে যখন খাপ থেকে ছুরি বেরোতে চায়
এমন সময় অন্ধকার ক্ষীণ হোলো,
প্রভাতের আলো গিরিশৃঙ্গ ছাপিয়ে আকাশ ভরে দিলে।
হঠাৎ সকলে স্তব্ধ;
সূর্য্যরশ্মির তর্জ্জনী এসে স্পর্শ করল
রক্তাক্ত মৃত মানুষের শান্ত ললাট।
মেয়েরা ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠ্ল, পুরুষেরা মুখ ঢাক্ল দুই হাতে।
কেউ বা অলক্ষিতে পালিয়ে যেতে চায়, পারে না;
অপরাধের শৃঙ্খলে আপন বলির কাছে তারা বাঁধা।
পরস্পরকে তারা শুধায়, “কে আমাদের পথ দেখাবে?”
পূর্ব্ব দেশের বৃদ্ধ বল্লে,
“আমরা যাকে মেরেচি সেই দেখাবে।”
সবাই নিরুত্তর ও নতশির।
বৃদ্ধ আবার বল্লে, “সংশয়ে তাকে আমরা অস্বীকার করেচি,
ক্রোধে তাকে আমরা হনন করেচি,
প্রেমে এখন আমরা তাকে গ্রহণ করব,
কেননা, মৃত্যুর দ্বারা সে আমাদের সকলের জীবনের মধ্যে সঞ্জীবিত
সেই মহা মৃত্যুঞ্জয়।”
সকলে দাঁড়িয়ে উঠল, কণ্ঠ মিলিয়ে গান করলে,
“জয় মৃত্যুঞ্জয়ের জয়।”
৮
তরুণের দল ডাক দিল, “চলো যাত্রা করি,
প্রেমের তীর্থে, শক্তির তীর্থে,”
হাজার কণ্ঠের ধ্বনি-নির্ঝরে ঘোষিত হোলো—
“আমরা ইহলোক জয় করব এবং লোকান্তর।”
উদ্দেশ্য সকলের কাছে স্পষ্ট নয়, কেবল আগ্রহে সকলে এক,
মৃত্যুবিপদকে তুচ্ছ করেচে
সকলের সম্মিলিত সঞ্চলমান ইচ্ছার বেগ।
তারা আর পথ শুধায় না, তাদের মনে নেই সংশয়,
চরণে নেই ক্লান্তি।
মৃত অধিনেতার আত্মা তাদের অন্তরে বাহিরে;
সে-যে মৃত্যুকে উত্তীর্ণ হয়েচে
এবং জীবনের সীমাকে করেচে অতিক্রম।
তারা সেই ক্ষেত্র দিয়ে চলেচে যেখানে বীজ বোনা হল,
সেই ভাণ্ডারের পাশ দিয়ে, যেখানে শস্য হয়েচে সঞ্চিত,
সেই অনুর্ব্বর ভূমির উপর দিয়ে
যেখানে কঙ্কালসার দেহ বসে আছে প্রাণের কাঙাল।
তারা চলেচে প্রজাবহুল নগরের পথ দিয়ে,
চলেচে জনশূন্যতার মধ্যে দিয়ে
যেখানে বোবা অতীত তার ভাঙা কীর্ত্তি কোলে নিয়ে নিস্তব্ধ;
চলেচে লক্ষ্মীছাড়াদের জীর্ণ বসতি বেয়ে
আশ্রয় যেখানে আশ্রিতকে বিদ্রূপ করে।
রৌদ্রদগ্ধ বৈশাখের দীর্ঘ প্রহর কাট্ল পথে পথে।
সন্ধ্যাবেলায় আলোক যখন ম্লান তখন তারা কালজ্ঞকে শুধায়,
“ঐ কি দেখা যায় আমাদের চরম আশার তোরণ-চূড়া?”
সে বলে, “না, ও যে সন্ধ্যাভ্রশিখরে
অস্তগামী সূর্য্যের বিলীয়মান আভা।”
তরুণ বলে “থেমো না, বন্ধু, অন্ধ তমিস্র রাত্রির মধ্য দিয়ে
আমাদের পৌঁছতে হবে মৃত্যুহীন জ্যোতির্লোকে।”
অন্ধকারে তারা চলে।
পথ যেন নিজের অর্থ নিজে জানে,
পায়ের তলার ধূলিও যেন নীরব স্পর্শে দিক চিনিয়ে দেয়।
স্বর্গপথযাত্রী নক্ষত্রের দল মূক সঙ্গীতে বলে, “সাথী, অগ্রসর হও।”
অধিনেতার আকাশবাণী কানে আসে, “আর বিলম্ব নেই।”
৯
প্রত্যুষের প্রথম আভা
অরণ্যের শিশিরবর্ষী পল্লবে পল্লবে ঝলমল করে উঠ্ল।
নক্ষত্রসঙ্কেতবিদ জ্যোতিষী বল্লে “বন্ধু আমরা এসেচি।”
পথের দুইধারে দিক্প্রান্ত অবধি
পরিণত শস্যশীর্ষ স্নিগ্ধ বায়ুহিল্লোলে দোলায়মান,—
আকাশের স্বর্ণলিপির উত্তরে ধরণীর আনন্দবাণী।
গিরিপদবর্ত্তী গ্রাম থেকে নদীতলবর্ত্তী গ্রাম পর্যন্ত
প্রতিদিনের লোকযাত্রা শান্ত গতিতে প্রবহমান।
কুমোরের চাকা ঘুরচে গুঞ্জনস্বরে,
কাঠুরিয়া হাটে আনচে কাঠের ভার,
রাখাল ধেনু নিয়ে চলেচে মাঠে,
বধূরা নদী থেকে ঘট ভরে যায় ছায়াপথ দিয়ে।
কিন্তু কোথায় রাজার দুর্গ, সোনার খনি,
মারণ উচাটন মন্ত্রের পুরাতন পুঁথি?
জ্যোতিষী বললে, “নক্ষত্রের ইঙ্গিতে ভুল হতে পারে না
তাদের সঙ্কেত এইখানেই এসে থেমেচে।”
এই বলে ভক্তি-নম্রশিরে
পথপ্রান্তে একটি উৎসের কাছে গিয়ে সে দাঁড়ালে॥
সেই উৎস থেকে জলস্রোত উঠ্চে যেন তরল আলোক,
প্রভাত যেন হাসি-অশ্রুর গলিত-মিলিত গীতধারায় সমুচ্ছল।
নিকটে তালি-কুঞ্জতলে একটি পর্ণকুটীর
অনির্ব্বচনীয় স্তব্ধতায় পরিবেষ্টিত।
দ্বারে অপরিচিত সিন্ধুতীরের কবি গান গেয়ে বল্চে,
“মাতা, দ্বার খোলো।”
১০
প্রভাতের একটি রবিরশ্মি রুদ্ধদ্বারের নিম্ন প্রান্তে
তির্যক্ হয়ে পড়েছে।
সম্মিলিত জন-সংঘ আপন নাড়ীতে নাড়ীতে যেন শুন্তে পেলে
সৃষ্টির সেই প্রথম পরমবাণী, “মাতা, দ্বার খোলো।”
দ্বার খুলে গেল।
মা বসে আছেন তৃণশয্যায়, কোলে তাঁর শিশু,
ঊষার কোলে যেন শুকতারা।
দ্বারপ্রান্তে প্রতীক্ষাপরায়ণ সূর্য্যরশ্মি শিশুর মাথায় এসে পড়ল।
কবি দিল আপন বীণার তারে ঝঙ্কার, গান উঠল আকাশে,
“জয় হোক্ মানুষের, ঐ নব জাতকের, ঐ চিরজীবিতের।”
সকলে জানু পেতে বসল, রাজা এবং ভিক্ষু, সাধু এবং পাপী,
জ্ঞানী এবং মূঢ়—
উচ্চস্বরে ঘোষণা করলে, “জয় হোক্ মানুষের,
ঐ নব জাতকের, ঐ চিরজীবিতের॥”
শ্রাবণ, ১৩৩৮