ঝড়

অন্ধ কেবিন আলোয় আঁধার গোলা,
বন্ধ বাতাস কিসের গন্ধে ঘোলা।
মুখ-ধোবার ঐ ব্যাপারখানা দাঁড়িয়ে আছে সোজা,
ক্লান্ত চোখের বোঝা।
দুল্‌ছে কাপড় pegএ,
বিজ্‌লি-পাখার হাওয়ার ঝাপট্‌ লেগে।
গায়ে গায়ে ঘেঁষে
জিনিষ-পত্র আছে কায়-ক্লেশে।
বিছানাটা কৃপণ-গতিকের,
অনিচ্ছাতে ক্ষণকালের সহায় পথিকের।
ঘরে আছে যে-কটা আস্‌বাব্‌
নিত্য যতই দেখি, ভাবি ওদের মুখের ভাব
নারাজ ভৃত্যসম,
পাশেই থাকে মম,
কোনোমতে করে কেবল কাজ-চলাগোছ সেবা।
এমন ঘরে আঠারো দিন থাকতে পারে কেবা?
কষ্ট ব’লে একটা দানব ছোট্টো খাঁচায় পুরে
নিয়ে চলে আমায় কত দূরে।
নীল আকাশে নীল সাগরে অসীম আছে ব’সে,
কি জানি কোন্ দোষে

ঠেলেঠুলে চেপেচুপে মোরে
সেখান হ’তে ক’রেছে এক-ঘরে।

হেনকালে ক্ষুদ্রদুখের ক্ষুদ্রফাটল্‌ বেয়ে
কেমন ক’রে এলো হঠাৎ ধেয়ে
বিশ্বধরার বক্ষ হ’তে বিপুল দুখের প্রবল বন্যাধারা;
এক নিমেষে আমারে সে ক’র্‌লে আত্মহারা
আনলে আপন বৃহৎ সান্ত্বনারে,
আন্‌লে আপন গর্জ্জনেতে ইন্দ্রলোকের অভয়-ঘোষণারে।
মহাদেবের তপের জটা হ’তে
মুক্তি-মন্দাকিনী এলো কূল-ডোবানো স্রোতে;
ব’ল্‌লে আমার চিত্ত ঘিরে ঘিরে—
ভস্ম আবার ফিরে পাবে জীবন-অগ্নিরে।
ব’ল্‌লে, আমি সুরলোকের অশ্রুজলের দান,
মরুর পাথর গলিয়ে ফেলে ফলাই অমর প্রাণ।
মৃত্যুঞ্জয়ের ডমরু-রব শোনাই কলস্বরে,
মহাকালেব তাণ্ডব-তাল সদাই বাজাই উদ্দাম নির্ঝরে।

স্বপ্নসম টুটে
এই কেবিনের দেওয়াল গেলো ছুটে।
রোগশয্যা মম
হ’লো উদার কৈলাসেরি শৈলশিখর সম।
আমার মন-প্রাণ
উঠল গেয়ে রুদ্রেরি জয়গান:—

সুপ্তির জড়িমা-ঘোরে
তীরে থেকে তোরা ও’রে
ক’রেছিস্‌ ভয়,
যে-ঝড় সহসা কানে
বজ্রের গর্জ্জন আনে—
“নয়, নয়, নয়।”

তোরা ব’লেছিলি তাকে
“বাঁধিয়াছি ঘর।
মিলেছে পাখীর ডাকে
তরুর মর্ম্মর।
পেয়েছি তৃষ্ণার জল,
ফ’লেছে ক্ষুধার ফল,
ভাণ্ডারে হ’য়েছে ভরা লক্ষ্মীর সঞ্চয়।”
ঝড়, বিদ্যুতের ছন্দে
ডেকে ওঠে মেঘ-মন্দ্রে,—
“নয়, নয়, নয়॥”

সমুদ্রে আমার তরী;
আসিয়াছি ছিন্ন করি’
তীরের আশ্রয়।
ঝড় বন্ধু তাই কানে

মাঙ্গল্যের মন্ত্র আনে—
“জয়, জয়, জয়।”

আমি যে সে প্রচণ্ডরে
ক’রেছি বিশ্বাস,—
তরীর পালে সে যে রে
রুদ্রেরি নিঃশ্বাস।
বলে সে বক্ষের কাছে,—
“আছে আছে, পার আছে,
সন্দেহ-বন্ধন ছিঁড়ি’, লহ পরিচয়।”
বলে ঝড় অবিশ্রান্ত—
“তুমি পান্থ, আমি পান্থ,
জয়, জয়, জয়॥”


যায় ছিড়ে, যায় উড়ে,—
ব’লেছিলি মাথা খুঁড়ে,—
“এ দেখি প্রলয়।”
ঝড় বলে, “ভয় নাই,
যাহা দিতে পারো, তাই
রয়, রয়, রয়।”
চ’লেছি সম্মুখ-পানে।
চাহিব না পিছু।

ভাসিল বন্যার টানে
ছিল যত কিছু।
রাখি যাহা, তাই বোঝা,
তা’রে খোওয়া তা’রে খোঁজা,
নিত্যই গণনা তা’রে, তা’রি নিত্য ক্ষয়।
ঝড় বলে, “এ তরঙ্গে
যাহা ফেলে দাও রঙ্গে
রয়, রয়, রয়॥”

এ মোর যাত্রীর বাঁশি
ঝঞ্ঝার উদ্দাম হাসি
নিয়ে গাঁথে সুর—
বলে সে, “বাসনা অন্ধ,
নিশ্চল শৃঙ্খল-বন্ধ
দূর, দূর, দূর।”

গাহে “পশ্চাতের কীর্তি,
সম্মুখের আশা,
তা’র মধ্যে ফেঁদে ভিত্তি
বাঁধিস্‌নে বাসা।
নে তোর মৃদঙ্গে শিখে
তরঙ্গের ছন্দটিকে,
বৈরাগীর নৃত্যভঙ্গী চঞ্চল সিন্ধুর।

যত লোভ, যত শঙ্কা,
দাসত্বের জয়-ডঙ্কা
দূর, দূর, দূর॥”

এসো গো ধ্বংসের নাড়া,
পথ-ভোলা, ঘর-ছাড়া,
এসো গো দুর্জ্জয়।
ঝাপটি মৃত্যুর ডানা
শূন্যে দিয়ে যাও হানা—
“নয়, নয়, নয়।”

আবেশের রসে মত্ত
আরাম-শয্যায়
বিজড়িত যে-জড়ত্ব
মজ্জায় মজ্জায়,—
কার্পণ্যের বন্ধ দ্বারে,
সংগ্রহের অন্ধকারে
যে আত্ম-সঙ্কোচ নিত্য গুপ্ত হ’য়ে রয়,
হানো তা’রে, হে নিঃশঙ্ক,
ঘোষুক তোমার শঙ্খ—
“নয়, নয়, নয়॥”


আণ্ডেস্‌ জাহাজ, ২৪ অক্টোবর, ১৯২৪।