বৈতরণী

ওগো বৈতরণী,
তরল খড়্গের মতো ধারা তব, নাই তা’র ধ্বনি,
নাই তার তরঙ্গ-ভঙ্গিমা;
নাই রূপ, নাই স্পর্শ, ছন্দে তা’র নাই কোনো সীমা;
অমাবস্যা রজনীর
সুপ্তি - সুগম্ভীর
মৌনী প্রহরের মত
নিরাকার পদচারে শূন্যে শূন্যে ধায় অবিরত।
প্রাণের অরণ্য-তট হ’তে
দণ্ড পল খ’সে খ’সে পড়ে তব অন্ধকার স্রোতে।
রূপের না থাকে চিহ্ন, নাহি থাকে বর্ণের বর্ণনা,
বাণীর না থাকে এক কণা।

ওগো বৈতরণী,
কতবার খেয়ার তরণী
এসেছিলো এই ঘাটে আমার এ বিশ্বের আলোতে।
নিয়ে গেলো কালহীন তোমার কালোতে
কত মোর উৎসবের বাতি,
আমার প্রাণের আশা, আমার গানের কত সাথী,

দিবসেরে রিক্ত করি’, তিক্ত করি’ আমার রাত্রিরে।
সেই হ’তে চিত্ত মোর নিয়েছে আশ্রয় তব তীরে।

ওগো বৈতরণী,
অদৃশ্যের উপকূলে থেমে গেছে যেথায় ধরণী
সেথায় নির্জ্জনে
দেখি আমি আপনার মনে
তোমার অরূপ-তলে সব রূপ পূর্ণ হ’য়ে ফুটে,
সব গান দীপ্ত হ’য়ে উঠে
শ্রবণের পর-পারে।
তব নিঃশব্দের কণ্ঠহারে
যে সুন্দর ব’সেছিলো মোর পাশে এসে
ক্ষণিকের ক্ষীণ ছদ্মবেশে,
যে চির-মধুর
দ্রুতপদে চ’লে গেলো নিমেষের বাজায়ে নূপুর,
প্রলয়ের অন্তরালে গাহে তা’রা অনন্তের সুর।
চোখের জলের মতো
একটি বর্ষণে যারা হ’য়ে গেছে গত,
চিত্তের নিশীথ রাত্রে গাঁথে তা’রা নক্ষত্র-মালিকা;
অনির্ব্বাণ আলোকেতে সাজায় অক্ষয় দীপালিকা॥


বুয়েনােস্ এয়ারিস্, ২৭ নভেম্বর, ১৯২৪।