আগমনী

মাঘের বুকে সকৌতুকে কে আজি এলো, তাহা
বুঝিতে পারো তুমি?
শোনোনি কানে, হঠাৎ গানে কহিল, “আহা, আহা,”
সকল বনভূমি?
শুষ্ক জরা পুষ্প-ঝরা,
হিমের বায়ে কাঁপন-ধরা
শিথিল মন্থর;
“কে এলো” বলি’ তরাসি’ উঠে শীতের সহচর।

গোপনে এলো, স্বপনে এলো, এলো সে মায়া-পথে,
পায়ের ধ্বনি নাহি।
ছায়াতে এলো, কায়াতে এলো, এলো সে মনোরথে
দখিন-হাওয়া বাহি’।

অশোক-বনে নবীন পাতা
আকাশ পানে তুলিল মাথা,
কহিল, “এসেছো কি?”
মর্ম্মরিয়া থরথর কাঁপিল আমলকী।

কাহারে চেয়ে উঠিল গেয়ে দোয়েল চাঁপা-শাখে
“শোনো গো, শোনো শোনো।”
শামা না জানে প্রভাতী-গানে কি নামে তা’রে ডাকে
আছে কি নাম কোনো?
কোকিল শুধু মুহুর্মুহু
আপন মনে কুহরে কুহু
ব্যথায় ভরা বাণী।
কপোত বুঝি শুধায় শুধু, “জানি কি, তা’রে জানি?”

আমের বোলে কী কলরোলে সুবাস ওঠে মাতি’
অসহ উচ্ছ্বাসে।
আপন মনে মাধবী ভণে কেবলি দিবারাতি,
“মোরে সে ভালোবাসে।”
অধীর হাওয়া নদীর পারে
ক্ষ্যাপার মতো কহিছে কা’রে
“বলো তো কী যে করি?”
শিহরি’ উঠি’ শিরীষ বলে, “কে ডাকে মরি, মরি!”

কেন যে আজি উঠিল বাজি’ আকাশ-কাঁদা বাঁশী
জানিস তাহা নাকি?
রঙীন যত মেঘের মতো কী যায় মনে ভাসি’
কেন যে থাকি’ থাকি’?
অবুঝ তোরা, তাহারে বুঝি
দূরের পানে ফিরিস খুঁজি’;
বাহিরে আঁখি বাঁধা,
প্রাণের মাঝে চাহিস না যে তাই তো লাগে ধাঁধা।

পুলকে-কাঁপা কনক-চাঁপা বুকের মধু-কোষে
পেয়েছে দ্বার নাড়া,
এমন ক’রে কুঞ্জ ভ’রে সহজে তাই তো সে
দিয়েছে তা’রি সাড়া।
সহসা বন-মল্লিকা যে
পেয়েছে তা’রে আপন মাঝে,
ছুটিয়া দলে দলে
“এই যে তুমি, এই যে তুমি” আঙুল তুলে বলে।

পেয়েছে তা’রা, গেয়েছে তা’রা জেনেছে তা’রা সব
আপন মাঝখানে,
তাই এ শীতে জাগালো গীতে বিপুল কলরব
দ্বিধা-বিহীন তানে।

ওদের সাথে জাগ্‌ রে কবি,
হৃৎকমলে দেখ্ সে ছবি,
ভাঙুক মোহ-ঘোর।
বনের তলে নবীন এলো, মনের তলে তোর।

আলোতে তোরে দিক না ভ’রে ভোরের নব রবি,
বাজ্ রে বীণা, বাজ্।
গগন-কোলে হাওয়ার দোলে ওঠ্ রে দুলে, কবি,
ফুরালো তোর কাজ।
বিদায় নিয়ে যাবার আগে
পড়ুক টান ভিতর বাগে,
বাহিরে পাস ছুটি।
প্রেমের ডোরে বাঁধুক তোরে বাঁধন যাক টুটি’॥


(* মাঘ, ১৩৩০)