পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/ফিরোজ খাঁ দেওয়ান
১৩। ফিরোজ খাঁ দেওয়ান। (৪৩৩—৪৭৮ পৃঃ)
ফিরোজ খাঁর পালাটির রচয়িতার নাম পাওয়া যায় নাই; তবে তিনি যে মুসলমান ছিলেন, তৎ বিষয়ে সন্দেহ নাই।
দেওয়ানদিগের যে বংশলতা পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে ফিরোজ খাঁর নাম নাই। পালাগানোক্ত অনেক স্থলেই যখন এইরূপ নাম-বিপর্য্যয়ের উদাহরণ পাইতেছি, তখন এই ধারণা আমাদের বদ্ধমূল হইয়াছে যে মুসলমান দেওয়ানেরা শাসনকর্ত্তৃত্ব গ্রহণ করার পর পূর্ব্বের নাম পরিবর্ত্তন করিয়া অধিকতর মর্য্যাদাজ্ঞাপক নাম ও উপাধি ধারণ করিতেন। এ প্রথা সর্ব্বত্রই ইতিহাসে দৃষ্ট হইয়া থাকে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও পালাগানে এই সকল দেওয়ান ও রাজগণের লোক প্রচলিত সহজ নামগুলিই ব্যবহৃত হইত। জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ানদিগের সম্বন্ধীয় অন্যান্য পালাগানের ন্যায় এইটিরও যে যথেষ্ট ঐতিহাসিক মূল্য আছে, একথা অস্বীকার করা যায় না।
ফিরোজ খাঁ বোধ হয় দেওয়ান ইশাখাঁর বহুদূরবর্ত্তী বংশধর নহেন; তিনি ইশাখাঁর পৌত্রদেরই একজন হইবেন। বংশলতা ও দেওয়ান-সরকারের কাগজপত্র হইতে জানা যায় যে দেওয়ান পরিবার পরে বহুধা বিভক্ত হইয়া বৃত্তিভোগী জমিদার গোষ্ঠির সৃষ্টি করিয়াছিল; দেওয়ান পরিবারস্থ এই ভূম্যধিকারিগণের কেহই পরবর্ত্তীকালে দিল্লীর বাদসাহের সহিত বিরোধ করিয়া স্বাধীনতা অর্জ্জনের চেষ্টা করিবার মতন ক্ষমতাশালী ছিলেন না।
কিন্তু পালাগানটিতে পাওয়া যায়, ফিরোজ খাঁ স্বীয় পূর্ব্ব পুরুষদিগের গৌরবে গৌরবান্বিত একজন সাহসী বীরপুরুষ ছিলেন। তিনি ইশাখাঁর বংশধর, এবং ইশাখাঁর মতনই স্বাধীন এবং যশস্বী দেশনায়ক হইবেন, পূর্ব্ব হইতেই এই আশা মনে মনে পোষন করিয়াছিলেন। “তিনি ইশাখাঁর বংশে জন্মগ্রহণ করেন” একথ। স্পষ্টই উক্ত হইয়াছে; সুতরাং ইশাখাঁর পুত্র হইলে তাঁহার সম্বন্ধে এরূপ উল্লেখ হইত না। অথচ যিনি দিল্লীশ্বরের সঙ্গে বিরোধ করিতে ইচ্ছুক, তিনি কখনই ইশাখাঁর দূরবর্ত্তী বংশধর নহেন।
ইশাখাঁর দুই পুত্র ছিল, মুশাখাঁ ও মহম্মদ খাঁ। মুশাখাঁর পুত্র মাচুম খাঁ। এবং মহম্মদের পুত্ত্র এনোয়াজ মহম্মদ। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, ফিরোজ খাঁকে আমরা দেওয়ানপরিবারের বংশতালিকায় এই শেষোক্ত নাম দুইটির অধস্তন বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না। দেওয়ানদিগের যে বংশতালিকা আমর। পাইয়াছি, তাহা অসম্পুর্ণ,—এবং সব জায়গায় বিশ্বাস-যোগ্যও নহে। আমরা একটি বংশাবলীতে ইশাখাঁর পুত্র শুধু আবদুল খাঁর নামই পাই নাই, আদম ও বিরাম নামক শ্রীপুর-রাজকন্যার গর্ভজাত তাঁহার অপর দুই পুত্র ছিল, তাহারও উল্লেখ পাইয়াছি।
ভিন্ন এক গোষ্ঠী দেওয়ানের আবাস ছিল কেল্লাতাজপুরে; এই দেওয়ানেরা বোধ হয় উত্তর পশ্চিম অঞ্চল হইতে আগত। কেল্লাতাজপুরের বিস্তীর্ণ ময়দান পাতয়ারা নদীর তীরে নেত্রকোণার দক্ষিণে অবস্থিত। এই স্থলে পরিখা ও প্রাচীন প্রাসাদের ইষ্টক এখনও দৃষ্ট হয়।
চন্দ্রকুমার (১) রাজীবপুরের সাহরালী গায়েন (২) চন্দ্রতলার সদীর গায়েন এবং (৩) কাটিখালির রহমন গায়েনের নিকট হইতে এই পালাটি সংগ্রহ করেন। ইহার কিয়দংশ তিনি ন’পাড়া নিবাসী জনৈক অন্ধ ভিক্ষাজীবী ফকিরের নিকটে প্রাপ্ত হয়েন। উপরিলিখিত তিনজন গায়েন নাসির-উজিয়ান পরগণার অন্তঃপাতী কবি চন্দ্রপুরের সুবিখ্যাত আজিম গায়েনের শিষ্য। এই আজিম গায়েনের শিক্ষাদাতা হয়ং পরগণার বড়ইবাড়ী জিগাতলানিবাসী জগীর গায়েনের নাম মৈমনসিংহ অঞ্চলে বিশেষ পরিচিত। মদন ব্যাপারী নামক অপর একজন গায়েন এই পালার বিকৃত একটি রূপান্তর গাহিয়া থাকেন। তিনি ইহাঁতে প্রাচীন উপকথার অনেক উপকরণ সন্নিবিষ্ট করিয়াছেন, এবং সখিনাকে দিয়া তান্ত্রিক সিদ্ধা অথবা ‘দ্রুইদ’ পুরোহিতের ন্যায় অসাধ্য সাধন, এমন কি ৮০ আশী মণ ওজনের গদ। লইয়া যুদ্ধ পর্য্যন্ত করাইতে দ্বিধা করেন নাই।
পালাটি কবিত্ব পূর্ণ না হইলেও আগাগোড়া কৌতূহলোদ্দীপক। শেষের দৃশ্যটীর দ্বারা পূর্ববর্ত্তী অধ্যায়সমূহের নীরসতার কলঙ্ক অনেকটা ঘুচিয়া গিয়াছে; এই দৃশ্য অপূর্ব্ব কবিত্বচ্ছটায় করুণ ও উজ্জ্বল হইয়াছে। রণপ্রত্যাগত বিজয়ী স্বামীর গলে জয়মাল্য পরাইয়া তাঁহার অভিনন্দন করিবেন, এই আশায় উৎফুল্লহৃদয়া সখিনাকে দরিয়া সঙ্কোচ ও দ্বিধার সঙ্গে যুদ্ধসম্বন্ধীয় নিষ্টুর সংবাদটি প্রদান করিয়া অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছিল। পরক্ষণেই সখিনা সাম্রাজ্ঞীর মত ধৈর্য্য সহকারে স্বামীর বন্দীদশার প্রতিশোধকল্পে পুরুষের পরিচ্ছদ ধারণ পূর্ব্বক তিন দিন অবিরাম যুদ্ধ করিয়া যে অলৌকিক শৌর্য্যপ্রদর্শন করিয়াছিলেন, তাহা শুধু তাঁহার বীরত্বের নহে পরন্তু রমনীহৃদয়ে প্রেমের অমোঘ-শক্তির নিদর্শন। নারীর হৃদয় যতই দৃঢ় হউক না কেন, তাহার একটি স্থান এমন সুকোমল যাহা কুসুমের মৃদু আঘাতটি পর্য্যন্ত সহ্য করিতে পারে না। স্বামীকে উদ্ধার করিবার পণ করিয়া তিনি শত্রুর আগ্নেয়াস্ত্রের সম্মুখীন হইয়া সিংহীর ন্যায় বিক্রমে রাত্রিদিন অবিরাম যুদ্ধ করিয়াছিলেন, কিন্তু স্বামী শত্রুর সঙ্গে সন্ধি করিয়া তাঁহাকে বর্জ্জন করিয়াছেন, এই সংবাদ বহন করিয়া দূত যখন তাঁহার হস্তে সেই তালাক্নামাটি এবং সন্ধিপত্র প্রদান করিল, তখন বীরাঙ্গনার হৃদয়ের সেই কুসুমকোমল স্থানটিতে যে আঘাত লাগিল, তাহা তিনি সহ্য করিতে পারিলেন না। মুহূর্ত্তমাত্র স্তব্ধ থাকিয়া যেন অবিশ্বাসের চক্ষে স্বামীর নামমুদ্রাঙ্কিত বর্জ্জনপত্রের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া ভগ্নহৃদয়া সখিনা সংজ্ঞাশূন্যা হইয়া ভূতলে পতিত হইলেন। তাঁহার পুরুষের ছদ্মবেশ অঙ্গ হইতে খসিয়া পড়িল পড়িল, এবং দৃঢ়বদ্ধ কেশপাশ মুক্ত ও আলুলায়িত হইয়া তাঁহাকে চিনাইয়া দিল। তখন রাজ্ঞী আর জীবিত ছিলেন না।
পালাগানটিতে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগের ঘটনা বর্ণিত হইয়াছে; সুতরাং উহার রচনার কাল তাহার অব্যবহিত পরেই হইবে বলিয়া মনে হয়।
ফিরোজ খাঁ দেওয়ান
(১)
বন্দনা।
দিশা—রূপের মূরতি পাঠানরে—।
পরথমে আল্লাজীর নামটী করিয়া সুরণ[১]
জঙ্গল বাড়ীর কথা সবে শুন দিয়া মনরে।
গোষ্টীর পর্ধান[২] বেটা কালিয়া গজদানী[৩]
যার ভয়ে বাঘে ভৈষে[৪] এক ঘাটে খায় পানি রে॥৪
(আরে ভাইরে) পরথমে আছিলাইন্[৫] তানি[৬] আল্লার পরজন[৭]
আগিয়ার[৮] কথা তাই শুনখাইন[৯] দিয়া মন।
যতেক ফকীর আর পীর পেগাম্বর
বরাহ্মণ[১০] পণ্ডিত রইছে[১১] তার সভার ভিতর॥৮
সোনা দিয়া বান্ধাইয়া হাতী বরাহ্মণে করে দান
তার লাগ্যা হইল তার গজদানী নাম।
আল্লা নিরাঞ্জন[১২] লইয়া সভার ভিতর
পীর বরাহ্মণে দেখায় যুক্তি বহুতর রে॥১২
কুবুদ্ধি ঘুচিয়া দেওয়ানের সুবুদ্ধি হইল
কাফের আছিল দেওয়ান মুছুলমান হইল রে।
দুই বেটা ছিল তার শুন দিয়া মন
ইশা খাঁর কথা সবে কহিব এখন॥১৬
(আরে ভাইরে) দিল্লীর বাদশার সঙ্গে জঙ্গ যে করিয়া
রাজত্বি করিছে দেওয়ান দিল্ খুসী হইয়ারে।
দিল্লী হইতে ফৌজ আইল, আইল ভারে ভারে[১৩]
লড়াই হইল বড় দেশে চমৎকার রে॥২০
বাদশার ফৌজের লগে জঙ্গে কেবা আটে[১৪]
রণে হারলাইন[১৫] ইশা খাঁ যে দোয়জের ঘাটেরে।
জইন্তার পাড়েতে[১৬] দেওয়ান পলাইয়া যায়
শের মাফিক[১৭] বাদশার ফৌজ পাছে পাছে ধায়রে॥২৪
জঙ্গলায় পলাইল দেওয়ান লাগ[১৮] নাহি পায়
জঙ্গলায় থাকিয়া ভাবে কি হইবে উপায়॥
ফৌজ লইয়া দেওয়ান উজান পানি বাইয়া
জঙ্গল বাড়ীর ঘাটে দেওয়ান দাখিল হইল গিয়া রে॥২৮
রাম লক্ষ্মণ দুই ভাই জঙ্গলবাড়ী সরে[১৯]
জঙ্গলার পুরেতে তারা রাজত্বি যে করে॥
ভাটী গাং বাইয়া দেওয়ান উঠে নিশাকালে
পুরী খান ঘেরিল দেওয়ান ফৌজের জাঙ্গাল রে[২০]॥৩২
(আরে ভাইরে) রাম লক্ষ্মণ দুই ভাই গেল পলাইয়া
দুই ভাইয়ের রাজত্বি দেওয়ান লইল কাডিয়া রে।
পরেতে হইল কিবা শুন বিবরণ
সেই খানে রাজত্বি করে যত দেওয়ানগণ রে॥৩৬
(আরে ভাইরে) কিঞ্চিৎ কহিব আমি জঙ্গলবাড়ীর কথা
বড় বড় পালোয়ানে যারে নোয়ায় মাথা।
চল্লিশ পুরা জমিরে ভাই জঙ্গল কাটিয়া
পুরী খানি বান্ধে দেওয়ান যতন করিয়া রে॥৪০
বড় বড় দীঘি কাটায় সানে[২১] বান্ধা ঘাট
বার বাংলার[২২] ঘরে লাগায় সোনার কপাট।
ছোট বড় খেড়কী তার করে ঝিলিমিলি
আয়না লাগাইয়া করে সুন্দর খুরলী[২৩]॥৪৪
ফুলের বাগান তথায় করে সারি সারি
পরীর মুল্লুক জিনি হইল জঙ্গলবাড়ী রে।
ফটিকের খাম্বা[২৪] দিয়া করে যত ঘর
সোনা দিয়া বেড়িয়াছে জঙ্গলবাড়ীর সর॥৪৮
টুইয়ের[২৫] উপর উড়ে সোনার নিশান
পাথরে বান্ধাইয়া দিছে দীঘল পইঠান[২৬]।
চান্দের সমান পুরী আবেতে[২৭] রাঙ্গিয়া
দেওয়ানগিরি করে সবে তথায় বসিয়া॥৫২
সে হিনা বংশের বেটা ফিরোজ খাঁ দেওয়ান
দুনিয়া জুড়িয়া হয় যাহার খুস্ নাম রে।
সভা কইরা বইছরে[২৮] ভাই যত মমীন গণ
তার কথা কহি সবে শুনখাইন্ দিয়া মন॥৫৬
বইসা[২৯] আছে ফিরোজ খাঁ দেওয়ান বারবাংলার ঘরে
উজীর নাজীর সব বইল[৩০] সভা কইরে রে।
উজীরে নাজীরে দেওয়ান কহিতে লাগিল
পূর্ব্বের বির্তান্ত[৩১] কথা সুরণ হইল॥৬০
বড় বংশের বেটা আমি শুন সাহেবগণ
বাদশার সহিতে যারা কইরাছিল রণ।
বংশের পরধান দেখ ইশা খাঁ দেওয়ান
যার কাছে বাদশার ফৌজ পাইল অপমান॥৬৪
এমন বংশেতে আমি লইয়াছি জনম
এখন উচিত মোর শুনখান্ দিয়া মন।
আল্লাতাল্লা পয়দা করলাইন্[৩২] দুনিয়া ভিতরে
মরজী কইরা পাঠাইলাইন জঙ্গলবাড়ীর সরে॥৬৮
যতেক খিরাজ[৩৩] পাই তার আধা আধি
দিল্লীতে পাঠাইয়া আমি রাখিয়াছি গদি।
এমন গদিতে আমার নাহি প্রয়োজন
আমার মনের কথা শুন সাহেবগণ॥৭২
আর না পাঠাইবাম্ খিরাজ দিল্লীর সহরে
আর না যাইবাম্ আমি বাদ্শার দরবারে।
যা করে বাদশার ফৌজ করুক আমারে
লড়িয়া মরিবাম আমি খদার কুস্তরে[৩৪]॥৭৬
যা থাকে নছিবে মোর শুন মিয়াগণ
খিরাজ বান্ধিয়া[৩৫] আমি ডাকাইবাম্[৩৬] মরণ।
এমন সময় ভাইরে কোন্ কাম হইল
আন্দর[৩৭] হইতে বান্দী দরবারে আসিল॥৮০
হাউলীর[৩৮]খবর শুন সাহেব বলি যে তোমারে
মা জননীর হুকুম হইল যাইতে আন্দরে।
সেলায় জানাইয়া বান্দী এই কথা কহিল
উজীরে নাজীরে দেওয়ান কহিতে লাগিল॥৮৪
শুন শুন মিয়াগণ কহি যে তোমরারে
মায়ে ত পাঠাইল বান্দী যাইতে আন্দরে।
আইজের দরবার রইল কই লাগাৎ[৩৯] হইয়া
কালুকা[৪০] করিব ঠিক সভারে লইয়া॥৮৮
(২)
এই কথা বলিয়া সাহেব উঠ্যা মেলা করে
সীতাবি[৪১] দাখিল হইল মায়ের গোচরে।
মায়ের হুকুম পাইয়া যত বান্দীগণ
সর্বত আনিয়া দাখিল করিল তখন॥৪
ঠাণ্ডা হইয়া বৈলা সাহেব পালঙ্ক উপরে
আবের পাংখা লইয়া বান্দী বাতাস যে করে॥
চান্দ ছুরত রূপ ঝলমল করে
দেখিয়া মজগ্ল্[৪২] হইল মায়ের অন্তর রে॥৮
ছেলাম্ জানাইয়া সাহেব কহেন মায়ের কাছে
কি মরজি করিয়া মাও ডাক মোরে কাছে।
মাও বলে পুত্রধন শুন আমার কথা
আর না অভাগী মায়ে দেও মন ব্যথা॥১২
পরাণে দরদ লাগে দেখি তোর মুখ
বুড়া বয়সে বড় পাইতেছি দুখ্।
এমন বয়সে তুমি না করিলা বিয়া
না রাখিলা মায়ের কথা দিন যায় বৈয়া॥১৬
কবরে শুইবাম আমি বেসী বাকি নাই
বউএর মুখ দেখ্যা গেলে বড় সুখ পাই।
এই কথা শুনিয়া দেওয়ান কোন্ কাম করিল
মনের যতেক কথা মায়েরে কহিলরে॥২০
শুন শুন মাও জননী আরজ[৪৩] আমার
আমার বংশের কথা কহিতে চমৎকার।
গোষ্ঠীর পর্ধান বেটা ইশা খাঁ দেওয়ান
যার হাতে দিল্লীর ফৌজ পাইল অপমান॥২৪
বাদশা পাঠাইল ফৌজ ধরিতে ইশায়
ইশা খাঁর পর্তাপে সিপাই পলাইয়া যায়।
বাদশার দূতরে ইশা রাখিল পরাণে
খিরাজ না দিল তারে করিয়া অপমান রে॥২৮
হয়রাণ হইয়া বাদশা করিল খাতির
বংশেতে জন্মিল মোর কত কত বীর॥
পর্তিজ্ঞা করিয়াছি মাও মনেতে ভাবিয়া
এইত জীবনে আর না করিবাম্ বিয়া॥৩২
সাদি না করিবাম আমি থাকবাম আবিয়াইৎ
রাজ্যের যতেক চিন্তা করি দিন রাইত।
আর না পাঠাইবাম খিরাজ দিল্লীর সহরে
আর না যাইবাম আমি দিল্লীর দরবারে॥৩৬
এই কথা শুনিয়া বিবি দিলে[৪৪] দুঃখু পাইল
মিন্নতি করিয়া পুত্রে কহিতে লাগিল রে।
হেন কালে শুন মিয়া কোন্ কাম হইল
একঅ[৪৫] তসবীরওয়ালী আন্দরে আসিল॥৪০
মায়ে পুতে[৪৬] যুক্তি করে আন্দরে বসিয়া
হেন কালে তসবীরওয়ালী দাখিল হইল গিয়া।
(আরে ভাইরে) তসবীরওয়ালী ঘরে আসিতে না আসিতে
এক বান্দী দিল একখান খাট বসিতে॥৪৪
খাটেতে বসিয়া পরে তসবীর খুলিল
বান্দীরা সকলে তারে ঘিরিয়া বসিল।
তসবীরওয়ালী তসবীর দেখায় থরে থরে
হেন কালে মা জননী কহেন সাহেবে রে॥৪৮
শুন শুন পুত্র ধন রে বাছিয়া গুছিয়া
তসবীর রাখহ এক দিল্ খুসী যইয়া।
আমি ত দিবাম্ এর কিম্মত[৪৭] যত লাগে
বাসিয়া তসবীর এক রাখ তুমি আগে॥৫২
এতেক শুনিয়া মিয়া বাচিয়া গুচিয়া
মনের মতন তসবীর লইল তুলিয়া।
হাতে লইয়া মিয়া পুছে[৪৮] তসবীরওয়ালীরে
কোন্ পরীর তসবীর এই সীতাবি কও মোরে॥
লালপরী, নীলপরী যত পরীগণে
সকল তসবীরে আমি দেখ্যাছি নয়নে।
কও কও তসবীরওয়ালী কও মোর কাছে
এহিত পরীর বল কিবা নাম আছে॥৬০
এহিত পরীর বল কোন্ দেশে ঘর
কার লগে করে খেলা কহ সুবিস্তর।
শুনিয়া তসবীরওয়ালী কয় মিয়ার আগে
খুলিয়া কহিগো মিয়া যাহা মনে জাগে॥৬৪
শুনখাইন[৪৯] সাহেব নাহি[৫০] পরী এই জন
এহিত সুন্দরী কন্যা শুনখাইন দিয়া মন।
এই কন্যা পয়দা হইছে উমর খাঁর ঘরে
দেওয়ানগিরি করে যেই কেল্লাতাজপুর সরে॥৬৮
বয়স হইল কন্যার না হইল সাদি
কর্ত বিয়া মনের মতন খসম পায় যদি।
পছন্দ করিয়া মিয়া কয় মায়ের স্থানে
এহিত তসবীর আমি রাখবাম করছি মনে॥৭২
তসবীরওয়ালী যখন কিম্মত চাহিল
দিল খুসী হইয়া মাও গলার হার দিল।
কিম্মত গলার হার হস্তেতে তুলিয়া
পান গুয়া খাইয়া গেল বিদায় হইয়া॥৭৬
(৩)
দিশা—“প্রেমের নদী উজান হইয়া যায়,
আরে যায় মনরে”———————।
তসবীর রাখিয়া দিয়া মায়ের গোচরে
সীতাবি চলিয়া যায় বিরাম-খানা[৫১] ঘরে।
পালঙ্কে শুইয়া পরে ভাবে মনে মন
এমন ছলিকার[৫২] তসবীর দেখি নাই কখন॥৪
আদমের[৫৩] এইরূপ না দেখি হইতে
পরদা করছুইন আল্লাতাল্লা বইসা নিরালাতে রে॥
হেন রূপ পয়দা করছুইন্ পরীরে জিনিয়া
কি মর্জ্জি করিয়া অল্লা দিলা পাঠাইয়া॥৮
হাত পাও গড়িয়াছে যেমন বেলাইনে[৫৪] মাঞ্জিয়া[৫৫]
চিকচিকা কালা[৫৬] কেশ আঠু ভারাইয়া[৫৭]।
শরীরের রং যেমন পাক্না[৫৮] সবরী কলা
তার উপরে জেয়র পাতি[৫৯] করিয়াছে আলা॥১২
পরথম যৈবন কন্যা অঙ্গ ঢল ঢল
বয়ান শোভিছে যেমন ফুটা পউদের[৬০] ফুল।
তসবীরে বসিয়া যেমন পুন্নু মাসীর চান
একবার দেখিলে নাই সে জুড়ায় নয়ান॥১৬
তস্বীর নকল জিনি যত পরীগণ[৬১]
আসল কন্যার জ়ানি দেখিতে কেমন॥
এমন রূপের মেলা দেখিয়া নয়ানে
পাগল হইল মন পর্বোধ না মানে রে॥২০
যাহার তস্বীর এমন দুনিয়া উজালা
না জানি নছিবে কার লেখছে খোদাতালা।
তবে ত ফিরোজ খাঁ দেওয়ান ভাবুইন[৬২] মনে মনে
দেওয়ানি না করুইন সাহেব রহিন গুয়ানে[৬৩]॥২৪
(আরে ভাইরে) যত সব উজীর নাজীর ভাবে মনে মন
এমন হইলা সাহেব কিসের কারণ॥
গুছুল না করে সাহেব নাহি খায় খানা
পাগল হইল সাহেব জহর[৬৪] ভাবনা॥২৮
খিরাজ পড়িল বাকি বাদশার দরবারে
তবেত ফিরোজ খাঁ দেওয়ান কোন্ কাম করে রে॥
এই কথা উজীর গিয়া জানায় দেওয়ানেরে
ভাবিয়া সাহেব জানায় উজীরে॥৩২
শুন শুন উজীর আরে বলিয়ে তোমায়
দেওয়ানী করিতে আমার মন নাহি যায়॥
ফরছুৎ[৬৫] লইয়া আমি থাকবাম কিছু দিন
দেওয়ানগিরি কর তুমি না হইয়ো বিদিন[৬৬] রে॥৩৬
লোক লস্করে সবে পাল মন দিয়া
সিগারেতে[৬৭] যাইবাম আমি মায়েরে কহিয়া॥
তবে ত ফিরোজ খাঁ দেওয়ান কি কাম করিল
বিদায় লইতে দেওয়ান মার কাছে গেল॥৩৮
শুন শুন মাও ওগো শুন দিয়া মন
সিগারে যাইবাম আমি সুনাইকান্দার বন।
সুনাইকান্দার বন মাগো বাঘ ভালুকে ঘেরা
বছর বচ্ছর মানুষ গরু তাতে যায় যে মারা॥৪২
রাজ্যের যতেক পরজা ডয়েতে পলায়
জঙ্গলী ভৈষে কারে মারিয়া ফালায়।
(আরে মাও) বড় দুঃখে আছে পরজা কহিনু তোমারে
বিদায় দেও মা জননী বিদায় দেও গো মোরে॥৪৬
সিগারে যাইবা যদি কয় মা জননী
তোমারে ছাড়িয়া যাদু কেমনে রইব প্রানী[৬৮]।
তুমি আমার আক্ষির তারা আন্ধাইর ঘরে বাতি
কেমনে কাটিবে আমার একলা দিন রাতি॥৫০
তুমি ত সিগারে গেলে দুন্যাই[৬৯] অন্ধকার
এত বলি মুছে মাও দুই নয়নের ধার।
পঞ্চ না বেঞ্জুনের ভাত রান্ধিলেক মায়
খেজমত[৭০] করিয়া মায় পুত্রেরে খাওয়ায়॥৫৪
তবে ত ফিরোজ খাঁ দেওয়ান কোন্ কাম করে
লোক লস্কর লইয়া পন্থে মেলা করে রে।
পন্থে মেলা করে মিয়া উড়ে পন্থের ধুলা
সিগার শুনিয়া ফৌজ হইলা পাগলা॥৫৮
ছাউনি করিয়া মিয়া ভাটীয়াল নদীর[৭১] পারে
তাম্বু গাড়িয়া মিয়া রহিলা সুস্থরে[৭২]।
কিসের সিগার মিয়া ভাবে মনে মনে
কোন পথে যাইবে মিয়া কেল্লাতাজপুর স্থানে॥৬২
ফৌজদারে ডাকিয়া মিয়া কৈলা গোপন কথা
শুন শুন ফৌজদার রে বলি মনের কথা।
এক রাত্রি এক দিন আমারে না পাও[৭৩]
ফৌজ লইয়া তুমি তরে নিরালা গুয়াও[৭৪]॥ ৬৬
সেলাম করিয়া ফৌজদার গেলা আপন স্থানে
সখিনার কথা মিয়া ভাবে মনে মনে।
রাত্রি দুপর কালে মিয়া কোন্ কাম করে
আল্লার নাম লইয়া মিয়া ফকীরের সাজ ধরে রে॥৭০
ফকীরের সাজেতে সাহেব দশপাঞ্জা[৭৫] হাতে
পন্থে চলিল তসবী[৭৬] জপিতে জপিতে।
দিনের যে পথ মিয়া চলে এক পরে[৭৭]
পরেত দাখিল হইল কেল্লাতাজপুর সরে রে॥৭৮
কেল্লাতাজপুর সরে মিয়া কোন্ কাম করে
আলাও[৭৮] করিয়া গাছ তলায় বাসা করে।
পন্থের পথিক যত ফকীরে দেখিয়া
গাছ তলায় আসি বসে ফকীরে ঘিরিয়া॥৭৮
দাওয়াই[৭৯] চাহয়ে কেউ কেউ দেখায় হাত
নছিবে কি লেখ্ছে আল্লা কেমন বরাত॥
কেউ চায় পুত্র কন্যা সিন্নি মানিয়া
গালাগালি করে কেউ ঠগ বলিয়া॥৮২
কেউ দেখিবারে আসে নবীন ফকীর
কোন্ খেজালতে[৮০] হইলা চেংড়া[৮১] বয়সে পীর।
কেল্লাতাজপুর সরে করে উমর খাঁ বসতি
দেওয়ান গিরি করে মিয়া উজীর নাজীর সতি[৮২]।৮৬
তাহার যে কন্যা হয় সখিনা সুন্দরী
যাহার রূপেতে পসর কেল্লাতাজপুর পুরী।
যাহার লাগিয়া কত বাদশা পুত্রগণ
পাগল হইয়া আইলা সাদির কারণ॥৯০
না পছন্দ করে সবে সুন্দরী সখিনা
দিলে দুঃখু পাইল সার হইল আনাগোনা।
তাহার তস্বীর দেখি পাগল হইয়া
ফকীর ফিরোজ আইলা দেওয়ানি ছাড়িয়া রে॥৯৪
তার পরে মমীন সবে শুন দিয়া মন
পড়িল কঠিন বেমারে[৮৩] উমর খাঁ দেওয়ান।
হাকিম ফকীর কত দেখিয়া তাহারে
বেমারে করিছে কাবিল[৮৪] আরাম করতে নারে॥৯৮
ফিরোজ ফকীরের কথা দেওয়ান শুনিয়া
ফকীরে আনিতে লোক দিল পাঠাইয়া॥
এহিত খবর যখন ফিরোজ খাঁ শুনিল
আন্দরে যাইতে দেওয়ান উছিল্লা[৮৫] পাইল॥১০২
ফকীর দরবেশ লোক নাহি জানা শুনা
বাদশার আন্দরে যাইতে নাহি তার মানা।
খবর পাইয়া ফকীর দেওয়ান কোন কাম করিল
উমর খাঁ দেওয়ানের আন্দরেতে চলিল॥১০৬
সখিনা সুন্দরী দেখ এমন সময়ে
দীঘির পাড়েতে আইলা কিসের লাগিয়ে॥
তার পরে বসিয়া কন্যা সানে বান্ধা ঘাটে
পায়ের মেন্দী[৮৬] মাঞ্জ্যা তুলে জলের যে ঘাটে॥১১০
জলের যে ঘাট তাতে হইল পশর
চান্দ যেমন ঝিলমিল করে পানির ভিতর রে।
দেখিয়া ফিরোজ সাহেব সখিনায় চিনিল
তস্বীর আর মানুষে আসমান পাতাল লাগিল[৮৭]॥১১৪
তস্বীরে এমন রূপ আঁকা নাহি যায়
অঙ্গের লাবনি যার মাটি বইয়া যায়[৮৮]॥
আইলা ফিরোজ যখন ঘাটের সাম্নে
সখিনা ফিরিয়া তারে দেখিল নয়ানে॥১২৮
দেখিয়া ফিরোজে কন্যা পলক না মারে
হায়রে কঠিন আল্লা ফালাইলা কি ফেরে।
এমন সুন্দর কুমার নবীন বয়সে
কিসের লাগ্যা ফকীর হইয়া ফিরে দেশে দেশে॥১২২
এই কথা ভাবিয়া কন্যা নিকটে আসিয়া
জিজ্ঞাস যে করে তার সাম্নে খাড়া হইয়া॥
সেলাম জানাইয়া ফকীর তোমার চরণে
মনের কথা জিজ্ঞাস করি মোর লয় মনে॥১২৬
কও তোমার পরিচয় কির্পা যে করিয়া
কোন্ খেজালতে পীর ফকীর হইয়া॥
চেংড়া বয়সে কেবা কও ফকীরি লয়
তোমারে দেখিয়া মোর দিলে দরদ হয় রে॥১৩০
কোন্ পরাণে ছাড়্যা দিছে তোমার বাপ মাও
না আইল পাছে পাছে হইয়া উধাও[৮৯]॥
কিসের লাগিয়া আইলা আন্দর ভিতরে
সকল খুলিয়া মোরে কও সুস্তরে[৯০] রে॥১৩৪
এত শুনি ফিরোজ কয় কন্যার গোচরে
তোমার বাপজান পড়িয়াছে কঠিন বেমারে।
আমারে ডাকিলা দেওয়ান সেই সে কারণে
ভালা করিতে আইলাম তাহার সদনে॥১৩৮
(হারে কন্যা) নছিবের লেখা কেউ করে বাদসাগিরি
আল্লায় বানাইছে ফকীর দেশে দেশে ফিরি॥
(8)
বাড়ীতে ফিরিয়া মিয়া বসিয়া নিরালা
সখিনা সুন্দরীর কথা ভাবয়ে একলা।
দরবারে দেওয়ানগিরিতে নাহি দেয় মন
সখিনা বিবির লাগি মন উচাটন॥৪
বিরামখানা ঘরে থাক্যা কোন্ কাম করে
শীঘ্র কইরা ডাইক্যা আনে দরিয়া বান্দীরে॥
আইল দরিয়া বান্দী হাসি খুসী মন
নবীন বয়স তার নবীন যৈবন॥৮
পায়ে দিছে বেঁক্খাড়ু গলায় হাঁসুলী
চল্তে মাইজা[৯৫] ভাঙ্গা পড়ে হাসে খলখলি।
কিবা বেমার হইয়া বান্দী জিগায় দেওয়ানে
এমন কাঞ্চা[৯৬] বাঁশে হায়রে কেমনে ধর্ল ঘুণে॥১২
মনের মতন জনে সাদি কর তুমি
সংসার ঘুরিয়া দুলাইন[৯৭] আন্যা দিব আমি।
ভ্রমরা[৯৮] হইয়া তুমি ফুলের মধু খাও
যৈবনে পড়িয়া কেনে[৯৯] মনেরে ভাড়াও॥
এহি কথা বান্দী যখন দেওয়ানে কহিল
তবে ত ফিরোজ খাঁ দেওয়ান কহিতে লাগিল।
শুন শুন দরিয়া আরে কহি তোমার ঠাঁই
তোমার মতন দরদী মোর দুনিয়ামে[১০০] নাই॥২০
ছোট বেলা হইতে তোরে বাসি বড় ভালা
বিয়ার কথা ভাব্যা আমার যৈবন হইল কালা॥
গোপন কথা আইজ দরিয়া কইবাম তোমার কাছে
কাম হাসিল্[১০১] হইলে দরিয়া বক্সীষ, পাইবা পাছে॥২৪
ভালা খসম্ দেখ্যা তোমার আর দিবাম সাদি
সঙ্গে কইরা দিবাম তোমার আর পাঁচ বান্দী।
ফিরুলীর[১০২] বেশে তুমি তসবীর লইয়া
কেল্লাতাজপুর সহর মধ্যে দাখিল হওরে গিয়া॥
কোন কাম করিবা তথা কই তোমার কাছে
সখিনা নামেতে কন্যা সেই সরে আছে॥
উমর খাঁ দেওয়ানের কন্যা কেল্লাতাজপুর সরে
তসবীর লইয়া তুমি যাইয়ো আন্দরে॥৩২
এক দুই করি যত তসবীর দেখাও[১০৩]।
ফকীরের এই তস্বীর লইয়া সেলাম জানাও।
সকল দেখাইয়া পরে দেখাও তসবীর
এত বলি ফিরোজ খাঁ যে করিলা হাজির॥৩৬
বেতের পেটেরা ঝাইল কাঁখেতে লইল
তার মধ্যে যতন কইরা তসবীর বান্ধিল।
বিদায় হইতে দরিয়া সেলাম জানায়
হেন কালে দেওয়ান তবে কয় দরিয়ায়॥৪০
এক কথা দরিয়া আরে কইয়া[১০৪] দেই তোরে
ফিরুলীর সাজে যখন যাইবা অন্দরে॥
পালঙ্কে বসিয়া থাকব[১০৫] সখিনা সুন্দরী
যখন থাকিবা[১০৬] সেই কন্যা একাকারী[১০৭]॥৪৪
সেই কালে খুইল্যা তুমি তসবীর দেখাইয়ো
পরিচয় কথা সব সকলি কহিও॥
দরবেশ ফকীরের তসবীর ধইরা দিও কাছে
এই তসবীর দেখ্যা[১০৮] কন্যার মন দেখিও পাছে॥৪৮
এই তসবীর দেখ্যা কন্যা যদি কিছু কয়
তাহারে কহিও তুমি এই পরিচয়॥
কইও কইও এই কথা কন্যার গোচরে
ফিরুলী তসবীর বেচি নাহি চিনি তারে॥৫২
কেবল শুন্যাছি কথা শুন বিবিজান
এই ফকীর আগে ছিল বংশেতে দেওয়ান।
দেশ বিদেশেতে আমি ঘুরিয়া বেড়াই
কত বেচি কত কিনি লেখাজুখা নাই॥৫৬
দিল্লী আগ্রা ঘুইরা আমি আইলাম বাংলা দেশ
পন্থেতে কিনিলাম তসবীর ফকীরের বেশ।
এই দেশে আছে কন্যা সখিনা সুন্দরী
উমর খাঁর কন্যা সে যে কেল্লাতাজপুর বাড়ী॥৬০
তার রূপ দেখ্যা দেওয়ান পাগল হইয়া
দেশে দেশে ঘুরে দেওয়ান ফকীর হইয়া।
এমন যৈবন কালে হইয়াছে দেওয়না
পাগল হইয়া দেশে দেশে করিছে ভর্মনা[১০৯]॥৬৪
এই কথা কহিও তুমি সখিনার কাছে
মনেতে দেখিও কন্যার কোন্ ভাব আছে।
ফিরুলী সাজিল দরিয়া এতেক শুনিয়া
কেল্লাতাজপুর সরে যায় তসবীর লইয়া॥৬৮
কেল্লাতাজপুর সর দেখ তিন দিনের পথ
এক্লা চলিল দরিয়া চিনিয়া যে পথ।
সোনা দিয়া বান্ধিয়াছে কেল্লাতাজপুর সর
সমুজ[১১০] গুম্বজ বড় দেখতে মনোহর॥৬২
দেড়পুড়া জমীন্ লইয়া সহর পত্তন
এমন সুন্দর সর না দেখি কখন।
হাতী ঘোড়া চড়ে আর মাহুতে হাঁকায়
এই সকলি দেখ্যা দরিয়া পন্থে চল্যা যায়॥৭৬
এই সকলি দেখ্যা দরিয়া পন্থে মেলা দিল
কেল্লাতাজপুর সরে গিয়া দাখিল হইল।
সহরে উঠিয়া দরিয়া সামায়[১১১] আন্দরে
একবারে দাখিল হইল কন্যার গোচরে॥৮০
বইয়া আছে সখিনা বিবি পালঙ্ক উপর
চান্দ জিনিয়া রূপ দেখিতে সুন্দর।
মেঘ ভাঙ্গা চুল কন্যার পালঙ্কে লুঠায়
সেই রূপ দেখ্যা দরিয়া করে হায় হায়॥৮৪
পুরুষ হইয়া দেওয়ান রূপেতে মজিল
নারী হইয়া দেখ্যা মন পাগল হইল।
এমন সুন্দর রূপ না দেখি কখন
চান্দ জিনিয়া কন্যার চান্দ বয়ান॥৮৮
হুরীর মুল্লুকে শুনি আছে পরী
তা হইতে সখিনা বিবি বহুৎ সুন্দরী।
মেন্দী দিয়াছে কন্যা বাটিয়া চরণে
সুর্মা[১১২] দিয়া আঁকিয়াছে দুইটী নয়নে॥৯২
সেইত নয়ানে কন্যা যার পানে চায়
আদম পুরুষ নারী পাগল হইয়া যায়।
ছেলাম জানায় দরিয়া সখিনার কাছে
তসবীর খুলিয়া তবে দেখাইল পাছে॥৯৬
আগেত দেখাইল দরিয়া যতেক তসবীর
দেওয়ান বাদশা কত আর মাল[১১৩] মস্তবীর।
তবেত দেখায় দরিয়া নবাব বেগমে
সকল দেখাইল দরিয়া বসি সেই খানে॥১০০
ফকীরের তসবীর দরিয়া যতন করিয়া
পালঙ্ক উপরে রাখে ঝারিয়া পুঁছিয়া॥
মেন্দিতে রাঙ্গিয়া কন্যা রাখিছে চরণ
তার কাছে রাখে তসবীর করিয়া যতন॥১০৪
স্বপনে সোনার ধুন্দল[১১৪] পাইলেক হাতে
আৎকা[১১৫] দরদী দুস্ত[১১৬] পাইলা দেখা পথে।
সেই মত সখিনা বিবি চমকিয়া উঠিল
ফিরুলীর কাছে কন্যা কহিতে লাগিল॥১০৮
শুন গো ফিরুলী আরে কহি তোমার স্থানে
এই তসবীর তুমি পাইলা কোন্ খানে।
দেশ বিদেশ তুমি ঘুরিয়া বেড়াও
এই ত তসবীর তুমি কোন্ দেশে পাও॥১১২
কোন্ জনা আঁকিল তসবীর কারে বা দেখিয়া
কোন্ দেশে পাইয়া তসবীর আনিলা কিনিয়া।
সাচা[১১৭] কথা ফিরুলী যে কহ ত আমারে
আগে যেন দেখিয়াছি এই ত ফকীরে॥১১৬
শুনিয়া ফিরুলী তবে কহিতে লাগিল
সখিনার পায়ে সাত সেলাম জানাইল।
সাচা কথা কহি আমি শুন বিবিজান
দেশ বিদেশেতে ঘুরি করিয়া ফিরান[১১৮]॥১২০
আগ্রা দিল্লীর পথে করি আনা গোনা
কতদেশে যাই আমি তার নাই জানা।
ঘুরিতে ঘুরিতে আইলাম জঙ্গলবাড়ী সরে
এই তসবীর বেচ্ল মোরে এক সদাগরে॥১২৪
কিনিলাম এই তসবীর উৎযোগী[১১৯] হইয়া
সদাগরের কাছে বার্ত্তা জানিলাম পুছিয়া।
পুছিলাম সদাগয়ে শুন দিয়া মন
আসল তসবীর এই শুন বিবরন॥১২৮
জঙ্গলবাড়ী সরে আছে ফিরোজ খাঁ দেওয়ান
তাহার তসবীর এই শুন বিবিজান।
নবীন বয়সে দেওয়ান ফকীর সাজিয়া
দেশে দেশে ঘুরে দেওয়ান পাগল হইয়া॥১৩২
সোনার জঙ্গলবাড়ী হইছে ছার খার
কান্দিয়া সকল লোক হইল জার জার[১২০]।
কয়বরে[১২১] ঘিরিয়াছে দেশ লোকের হাহাকার
মিছিল গুছিল সব হইছে অন্ধকার॥১৩৬
উজীর নাজীর কান্দে এই সে কারণ
বেওয়া বিধুবা[১২২] কান্দে কান্দে পর্জাগণ।
এই কথা শুনিয়া কন্যা দরিয়ার আগে
ভিন্[১২৩] দেশী ফিরুলীর কথায় দিলে দরদ লাগে॥১৪০
শুন শুন ফিরুলী লো কহি যে তোমারে
কোথায়নি দেখ্যাছ তুমি এই ত ফকীরে।
কিসের লাগ্যা ফকীর হইল এই মহাজন
আগপাছ[১২৪] কথা তুমি কও বিবরণ॥১৪৪
গলার হার দিয়া আমি কিনিলাম তসবীর
শুনিয়া তোমার কথা মন নহে স্থির।
এতেক শুনিয়া দরিয়া কহে কন্যার কাছে
বলিব সকল কথা মনে মোর আছে॥১৪৮
সাত সেলাম আর বার ফিরুলী জানায়
ফিরোজের কথা বলি কন্যারে ভাড়ায়।
কেবল শুন্যাছি কথা শুন বিবিজান
এই না ফকীর বংশে আছিল দেওয়ান॥১৫২
এই দেশে আছে নাকি সখিনা সুন্দরী
উমর খাঁর কন্যা সে যে কেল্লাতাজপুর বাড়ী।
তার রূপ দেখ্যা দেওয়ান পাগল হইয়া
দেশে দেশে ঘুরে দেওয়ান ফকীর হইয়া॥১৫৬
এমন যৈবন কালে হইয়াছে দেওয়ানা
পাগল হইয়া দেশে করিছে ভরমনা।
এই কথা শুনিয়া তবে সুন্দরী সখিনা
ফকীরের লাগি কন্যা হইল দেওয়ানা[১২৫]॥১৬০
অঞ্চল ধরিয়া কন্যা মুছে চক্ষের পানি
পিরীতে মজিল মন কাতর হইল প্রাণি।
লাখ টাকার কিম্মত যে গলার হাসুলী
তাহা দিয়া বিদায় কন্যা করিল ফিরুলী॥১৬৪
তসবীর লইয়া কন্যা বুকেতে ধরিল
পন্থের ফকীর কন্যা মনেতে সাজিল[১২৬]॥
(৫)
দেওয়ানা ভাব দেখি পুত্রের ফিরোজা সুন্দরী
ফিরোজে ডাকিয়া কাছে আনে তরিঘরি[১৩০]।
শুন শুন পুত্র আরে কহি আরবার
সাদি করাইতাম তোমায় মনেতে আমার॥৪
সাদি না করিলে দেখ বংশ না থাকিবে
তোমার যে পরে ভিটায় বাতি না জ্বলিবে।
এমন সোনার দেওয়ানি যাইবে ছারখারে
ডুবাইয়োনা সোনার সংসায় অকুল সায়রে॥৮
তোমার যেমন খুসি তেমন কর সাদি
তোমার ইচ্ছায় কেউ না হইব বাদি।
শুন শুন পুত্রধন রাখ মায়ের কথা
বৃদ্ধ মায়ের প্রাণে দিয়ো না আর ব্যথা॥১২
সাদির কথায় আইজ বিরোধী না হইল
মনোযোগে সকল কথা বসিয়া শুনিল।
মায়ের কথায় সাহেব দিল্ খুসী হইয়া
বিরাম-খানা ঘরে গেল উজীরে লইয়া॥১৬
উজীরে ডাকিয়া কয় শুন উজীর রে
আজুকা মনের কথা কহি যে তোমারে॥
অনুরাগী হইলাইন[১৩১] মাও সাদির কারণ
তাহারে জানাও মোর এই নিবেদন॥২০
সাদি না করিবাম আমার আছিল যে মনে
পর্তিজ্ঞা ভাঙ্গিলাম আইজ মায়ের কারণে॥
কইও কইও এই কথা তাঁহার গোচরে
উমর খাঁ দেওয়ান থাকে কেল্লাতাজপুর সরে॥২৪
তাহার যে কন্যা আছে সখিনা সুন্দরী
তাহারে আনিয়া দিলে আমি সাদি করি॥
আনইলে[১৩২] আল্লাজী সাদি না লেখছুইন[১৩৩] কপালে
দিলের যে দুঃখ যত থাক্যা যাইব[১৩৪] দিলে॥২৮
এই কথা শুনিয়া উজীর চলিল আন্দরে
কহিতে সকল কথা বিবির গোচরে॥
আন্দর ভিতরে বিবি উজীরে দেখিয়া
জিগায় উজীরে আইলা কিসের লাগিয়া॥৩২
সেলাম জানাইয়া উজীর কয় বিবির কাছে
কুসময়ে[১৩৫] আন্দর বাড়ী কোন্ কাজে আইছে॥
শুনখাইন সাহেবানী মোর কথা দিয়া মন
কুমার কহিছে কিবা সাদির কারণ॥৩৬
উমর খাঁ দেওয়ান আছে কেল্লাতাজপুর সরে
সখিনা সুন্দরী কন্যা জন্মিল তার ঘরে।
সেই সে কন্যারে হইলে সাদি করিব
আনইলে আয়াৎ[১৩৬] থাক্তে সাদি না করিব॥৪০
এই কথা শুনিয়া বিবি কয় উজীরেরে
শুনরে উজীর আমি পড়িলাম ফেরে[১৩৭]॥
তাজপুরের দেওয়ান যত আমার যে বৈরী
তাহার কন্যার সাদির কেমনে আলাপ[১৩৮] করি॥৪৪
পুত্রে সাদি কেমনে করাই দুষ্মনের কন্যারে।
এই কথা বুঝাইয়া কও পুত্রের গোচরে॥
সখিনা বিবির থাক্যা সুন্দর দেখিয়া
আনিয়া পুত্রেরে আমি করাই তবে বিয়া॥৪৮
এই বিয়া করাইতে মোর নাহি লয় দিলে
খয়ের[১৩৯] না হইব জান্য[১৪০] এই বিয়া করাইলে॥
সিতাবি যাওরে উজীয় জিগাও কুমারে
এই বিয়া ছাড়া নি[১৪১] সে অন্য বিয়া করে॥৫২
তার পরে চলিল গো উজীর কুমার যথায় আছে
কুমারে দেখিয়া পরে কয় তার কাছে॥
মায়ের সকল কথা পুত্রেরে জানায়
এই নি সাদি ছাড়া মিয়া অন্য সাদি চায়॥৫৬
এই ত দুষ্মনের কন্যা সাদি করিলে
মান ইজ্জত সব যাইবে বিফলে॥
এতেক শুনিয়া কুমার কয় উজীরেরে
তবে নাই সে করবাম বিয়া কইওত মায়েরে॥৬০
তাহার লাগিয়া আমি হইলাম দেওয়ানা
তাহারে না কর্লে সাদি হইবাম আমি ফানা[১৪২]।
এই সাদি ছাড়া মোর মনে নাই সে লাগে
সখিনার চান্দমুখ সদায় মনে জাগে॥৬৪
তাহার লাগিয়া আমি ছাড়লাম দেওয়ান-গিরি
তারে ছাড়া অন্য কন্যা কেমন সাদি করি।
সেই কন্যা হইয়াছে আমার নয়নের মণি
সেই কন্যা হইয়াছে আমার পিয়াসের পানি॥৬৮
সেই কন্যা হইয়াছে আমার গলার যে মালা
তারে সাদি কর্লে হইব আন্ধাইর মন উজালা।
কহিয়ো মনের কথা মায়ের গোচর
এই সাদি না হইলে আমি ছাড়বাম বাড়ী ঘর॥৭২
এই কথা শুনিয়া উজীর মায়ের কাছে গিয়া
পুত্রের সকল কথা আসিল বলিয়া॥
পুত্রের দিলের দুঃখ বুঝিয়া জননী
পুত্রের লাগিয়া মাও হইলা উদাসিণী॥৭৬
ফিরোজ যে পুত্র মোর নয়নের তারা
এক লহমা[১৪৩] না বাঁচিবাম হৈলে তারে হারা॥
এমন পুত্রের দিল খুসীর কারণ
ছাড়িবারে পারি আমি এছার জীবন॥৮০
পুত্র যদি খুসী হয় করাইলে এই সাদি
আমি নাই সে হইব আর এই বিয়ার বাদি॥
এই কথা চিন্তিয়া বিবি উজীরে ডাকিয়া
বুঝাইয়া শুনাইয়া তারে দিল যে পাঠাইয়া॥৮৪
পাঠাইয়া দিল তারে কেল্লাতাজপুর সরে
সাদির কারণে উমর খাঁয়ের গোচরে।
তিন দিনের পরে উজীর কেল্লাতাজপুর সরে
দাখিল যে হইল উজীর উমর খাঁর গোচরে॥৮৮
জিগায় উমর খাঁ দেওয়ান উজীরের কাছে
কোন্ দেশতনে[১৪৪] আইলা মিয়া কিবা কাম আছে।
সেলাম জানাইয়া উজীর কয় মিয়ার ঠাঁই
জঙ্গলবাড়ীর উজীর আমি সাহেবে জানাই॥৯২
শুনখাইন সাহেব আরে শুনখাইন দিয়া মন
পাঠাইলা ফিরোজা বিবি কিসের কারণ॥
পয়দা যে হইছে কন্যা আপনের ঘরে
সুন্দরী সখিনার কথা জানা ঘরে ঘরে॥৯৬
ফিরোজা বিবির হয় ফিরোজ কুমার
রূপেগুণে পরধান হইল দুনিয়া মাঝার।
ফিরোজ সখিনার সঙ্গে সাদির কারণে
পাঠাইলা ফিরোজা বিবি আপনার সদনে॥১০০
এই কথা গুনিয়া মিয়া গোসা[১৪৫] হইল মনে
কহিতে লাগিল পরে সভার সদনে॥
কাফেরের গোষ্ঠী জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ান
রোজা নমাজ ছাড়া যেই না মুছুলমান॥১০৪
না মুছুলমান পাঠাইল সাদির কারণ
এই নি দুঃখু সয় দেখ উজীর নাজীর গণ।
বেইজ্জত করিলা আমায় সেইত কাফেরে।
উচিত শাস্তি দিবাম আমি ভাব্যা চিন্ত্যা তারে॥১০৮
গর্জ্জিয়া পরে ত মিয়া ডাকিল নফরে
নফর আইলে পরে কয় যে তাহারে॥
গর্দ্দনায়[১৪৬] ধরিয়া তুমি এই উজীরেরে
সিতাবী খেদাইয়া দেও দরবারের বাইরে॥১১২
এই কথা শুনিয়া নফর উৎযোগ হইয়া
গর্দ্দানে ধরিয়া দিল বাইর করিয়া॥
তার পরে উজীর দেখ বেইজ্জত হইয়া
মনের দুঃখেতে আইল বাড়ীতে ফিরিয়া॥১১৬
(৬)
এই কথা উজীর জানায় দেওয়ান ফিরোজেরে
আগুন জ্বলিল যেমন সমুদ্দুর ভিতরে॥
এই কথা শুনিয়া মিয়া গোসা হইল ভারি
সহরে বাজারে ডঙ্কা মারে তাড়াতাড়ি॥৪
ডঙ্কা মারিল দেওয়ান ফৌজের কারণ
কালুকা যাইতে হইব করিবারে রণ॥
ফৌজদারগণ যত এই কথা শুনিয়া।
পলকে আইল যত ফৌজ যে লইয়া॥৮
সাজাইয়া রণের ঘোড়া হইল সোয়ার।
পন্থে মেলা দিল সবে করি মার মার।
পরের দিনেতে সাহেব ফৌজ যে লইয়া
কেল্লা তাজপুর সরে মিয়া দাখিল হৈল গিয়া॥১২
দেওয়ানের বাড়ী ফৌজে ঘিরিয়া লইল।
ঘেটিতে[১৪৭] ধরিয়া মিয়া দেওয়ানে খেদাইল॥
খেদাইল উজীর নাজীর যত লোক জন
তার পরে আন্দর বাড়ী করিল গমন॥১৬
সখিনা সুন্দরী আছিল পালঙ্কে শুইয়া
পালঙ্ক হইতে মিয়া আনিল ধরিয়া।
কয়েদ করিয়া আনে জঙ্গলবাড়ী সরে
দিল্ খুসী হইয়া মিয়া তারে সাদি করে॥২০
সাদি করিয়া দোয়ে[১৪৮] খুসী হইল মনে
এক সাথে থাকে দোয়ে উঠনে বৈসনে[১৪৯]।
এক জনের দিলের দরদ অন্যে নেয় কাড়ি[১৫০]
পীরিতে মজিয়া দোয়ে দিল খুসী ভারি॥২৪
সাদির কথা এইখানে নিরবধি লইয়া[১৫১]
উমর খাঁ দেওয়ানের কথা শুন মন দিয়া।২৮
(৭)
বেইজ্জতি হইয়া[১৫২] উমর কোন্ কাম করিল
বাদসার দরবারে যাইতে পন্থে মেলা দিল।
সভা কইরা বইছে বাদসা উজীর নাজীর লইয়া
এমন সময় মিয়া দাখিল হইল গিয়া॥৪
বাদশা জিগায় শুন উমর খাঁ দেওয়ান
অচম্বিত[১৫৩] আইলা তুমি কিসের কারণ।
অঙ্গের যে বেশ দেখি হইয়াছে মৈলান
কালা কেসইরাতা[১৫৪] তোমার হইয়াছে বয়ান॥৮
কও কও কও মিয়া কিবা দুঃখু পাইয়া
অত মীন্নত[১৫৫] কইরা আইলা দরবারে চলিয়া।
সেলাম করিয়া মিয়া কয় বাদশার কাছে
আমার যে নালিশ এক দরবারেতে আছে॥১২
শুনখাইন মন দিয়া শুনখাইন বাদশা-নন্দন।
জঙ্গলবাড়ী সরে থাকে ফিরোজ খাঁ দেওয়ান॥
কাফেরের বংশে বেটা পয়দা যে হইয়া
উজীরে পাঠাইল আমার কন্যা দিতাম[১৫৬] বিয়া॥১৬
উজীর ফিরিয়া যায় জঙ্গলবাড়ী সরে
শুনখাইন সকলে ফিরোজ কোন্ কাম করে।
ষাইট হাজার ফৌজ সঙ্গে বাড়ী যে ঘিরিল
জনবাচ্চা সহিতে মোরে বেইজ্জত করিল॥২০
তার পরে শুনখাইন বলি দিলের বেদনা
আন্দর হইতে খেদায় আন্দরের জননা[১৫৭]।
সুন্দর সখিনা কন্যায় কয়েদ করিয়া
জঙ্গলবাড়ী সরে বেটা দাখিল হইল গিয়া॥২৪
জঙ্গলবাড়ী সরে কেউ না হইল বাদী
জোর কইরা করিল মোর কন্যারে যে সাদি॥
সেহিত কারণে সাহেব দিলে দুঃখু পাইয়া
পাগল হইয়া আইলাম দরবারে চলিয়া॥২৮
হুজুর করখাইন[১৫৮] এর উচিত বিচার
পরাণে মরিবাম নইলে ঘরে আপনার।
অপমান পাইলাম কাফেরের হাতে
উচিত না হয় বাস এই দুনিয়াতে॥৩২
এই কথা শুনিয়া বাদশা গোসা যে হইল
গর্জ্জন করিয়া পরে সভাতে বলিল।
জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ান বড় হইল সেয়ানা
বান্ধিয়া রাখিছে[১৫৯] দেখ বাদসার খাজানা॥৩৬
যাই খুসী করে বড় মুখ হইছে তার।
জন বাচ্চা সহিতে তারে করবাম উজার।
শুন শুন উজীর নাজীর শুন ফৌজদারগণ
যত ফৌজ আছে ডাক রণের কারণ।৪০
তিন দিনের আরি[১৬০] যাও জঙ্গলবাড়ী সরে
উজার করিয়া সর[১৬১] বান্ধ দেওয়ানেরে।
সিতাবি বান্ধিয়া আন আমার গোচরে
উচিত যা শাস্তি আমি করবাম তাহারে॥৪৪
যাও যাও উমর খাঁ দেওয়ান ফৌজ যে লইয়া
দিলের দুঃখ কর দূর পর্তিশোধ লইয়া।
পিল ঘোড়া সাজে কত সাজে ফৌজগণ
সাজ সাজ রব হইল রণের কারণ॥৪৮
এক লক্ষ ফৌজ যখন পন্থে মেলা দিল
আসমান ছাইয়া পন্থের ধুলা উড়িল।
কেউ সোয়ার হইল পিলে কেউবা ঘোড়াতে
কেউবা হাঁটিয়া চলে দাপটে রণেতে॥৫২
উমর চলয়ে আগে ফৌজের সর্দ্দার
তার কথায় চলে ফৌজ করে মার মার।
এই মতে যত ফৌজ পন্থে মেলা দিয়া
জঙ্গলবাড়ীর সীমানায় দাখিল হইল গিয়া॥৫৬
এই কথা যখন দেওয়ান ফিরোজ শুনিল
ডঙ্কায় বাড়ি দিয়া যত ফৌজদারে ডাকিল।
রণের কারণে দেখ যত ফৌজদারগণ
সিপাই লইয়া আইল দেওয়ানের সদন॥৬০
তার পরে ফিরোজ দেওয়ান রণের সাজ লইয়া
মায়ের নিকটে গেল বিদায়ের লাগিয়া॥৬২
(৮)
দিশা——
ফিরোজ খাঁ রণে গেল।
বিনায়া[১৬২] কান্দে মায় বুকে রইল ছেল[১৬৩]॥
সেলাম জানাইয়া কয় মায়ের চরণে
বিদায় দেওখাইন[১৬৪] মা জননী যাইবাম আমি রণে।
সিতাবি বিদায় দেওখাইন দিয়া পায়ের ধুলা
জঙ্গলবাড়ী সর মাগো ফৌজে যে ঘিরিলা॥৪
উমর খাঁ দেওয়ান মাগো বাদশার ফৌজ লইয়া
পর্তি শোধ লইতে দাখিল হইল আসিয়া।
দেরী না সয় যে মাও শুন দিয়া মন
বিলম্ব করিলে নাহি আশা জিতি রণ॥৮
এই কথা শুনিয়া মাও কয় যে পুত্রেরে
না যাও পরাণের পুত্র তুমিত রণেরে॥
আন ডাকাইয়া আছে যত ফৌজদারগণ
সকলে পাঠাও তুমি করিবারে রণ॥১২
তুমি পুত্র কলিজার লৌ[১৬৫] যে আমার
কেমনে থাক্বাম না দেখিয়া চান্দমুখ তোমার।
তোমারে পাঠাইতে রণে ডরে কাঁপে বুক
আইজ হইতে ভাঙ্গে যেমন জনমের সুখ॥১৬
এই কথা শুনিয়া কয় মায়ের গোচরে
আর দেরী না সয় মাগো বিদায় দেওখাইন মোরে॥
আমি ছাড়া ফৌজগণ জঙ্গে না পারিব[১৬৬]
আমি সঙ্গে গেলে মাগো রণে জিতিব॥২০
আমারে দেখিলে তারা চিত্তে সুখী হইব
পিষ্ঠে পরাণে[১৬৭] মাগো রণ করিব।
খুসী হইয়া ফৌজগণ রণ করিলে
রণ জিত্যা আইবাম[১৬৮] জান্য তোমার যে কোলে॥২৪
আমি যদি না যাই রণে গই সই[১৬৯] করিয়া
জঙ্গলবাড়ী লইব[১৭০] মা গো দুষ্মণে জিনিয়া।
এই কথা কহিয়া মায়ে সেলাম করিল
পায়ের ধুলা লইয়া শিরে বিদায় হইল॥২৮
তার পরে চলিল সাহেব সখিনার ঘরে
জঙ্গে যাইবারে সাহেব আরে বিদায় লইবারে।
শুন গো সখিনা বিবি শুন দিয়া মন
ফৌজ লইয়া তোমার বাপজান আইছে কর্তে রণ॥৩২
সেই ত রণেতে যাইতাম[১৭১] বিদায় দেও আমারে
সাবধানে থাকা কন্যা বলি যে তোমারে।
মায়েরে বুঝাইয়া রাখ্য আন্দরে বসিয়া
শীঘ্র কইরা দেও কন্যা বিদায় করিয়া॥৩৬
এই কথা শুনিয়া বিবি কি কাম করিল
পাঞ্চ পীরের[১৭২] মাটী আন্যা শিরে তুল্যা দিল॥
আরজ জানাইল কন্যা কুমার গোচরে
জঙ্গ জিনিয়া শীঘ্র আইও[১৭৩] সাহেব ঘরে॥৪০
তার পরে কহেত কুমার খোদার ফজলে[১৭৪]
এক দিনে জিত্যা রণ ফিরবাম সকলে॥
এই কথা বলিয়া কুমার বিদায় হইল
পন্থপানে সখিনা গো চাহিয়া রহিল॥
দুই চক্ষু ভইরা[১৭৫] পানি পড়ে দরদরি
পাষাণে বান্ধিয়া মন দিলাম বিদায় করি॥
ফৌজগণ সঙ্গে কুমার জঙ্গেতে আসিয়া
দুই দিন বান্ধ্যা[১৭৬] গেল রণ করিয়া॥৪৮
দুই দলে সমান যে ফৌজ মরিল
কেউ নাহি জিতে রণে কেউ না হারিল॥
তিন দিনের দিনে হায়রে কি কাম হইল
ফিরোজখাঁ দেওয়ান ভাইরে বান্ধা পড়িল॥৫২
বান্ধিয়া আনিল মিয়ায় কেল্লাতাজপুর শরে
জঙ্গল বাড়ীর ফৌজ যত হায় হায় করে॥
দিশা——
ঘোড়ার পিষ্ঠেতে দেখি লৌএর নিশান
খালি ঘোড়া দেখ্যা বিবির উড়িল পরাণ॥
(দরিয়ার গলায় ধইরা কান্দে সখিনা)।
শুইয়া আছিল সখিনা বিবি পালঙ্ক উপরে
এমন সময় দরিয়া আস্যা দখিল হইল ঘরে॥
দরিয়ারে দেখিয়া বিবি কহিতে লাগিল
কালুক। বিয়ানে[১৭৭] স্বামী রণ করিতে গেল॥৫৮
শুনশুন দরিয়া আরে কহি যে তোমারে
তুল্যা আন চাম্পা গোলাপ মালা গাঁথিবারে।
লড়াই জিত্যা আইলে স্বামী মালা দিবাম গলে
অজুর[১৭৮] পানি তুল্যা রাখ সোনার গুইছালে[১৭৯]॥৬২
আবের পাঙ্খা আন্যা রাখ শয্যার উপরে
রণ জিত্যা আইলে স্বামী বাতাস করবাম তারে॥
ভাণ্ডে আছে আতর গোলাপ রাখত আনিয়া
সোনার বাটায় সাজাও পান পতির লাগিয়া॥৬৬
পাঁচ পীরেরে নারী সেলাম জানাইল
হাসিমুখে বিবিজান কহিতে লাগিল॥
আইজ কেন দরিয়া তোর হাসি নাইলো মুখে
রণ জিত্যা আইব[১৮০] স্বামী দেখ্বা মনের সুখে॥৭০
কান্দিয়া দরিয়া বান্দী কহিতে লাগিল
এতদিনে কন্যা তোমার নছিব বোরা[১৮১] হইল॥
ছুট্যা[১৮২] আইল রণের ঘোড়া লৌএর নিশান লইয়া
কি কর সখিনা বিবি পালঙ্কে বসিয়া॥৭৪
শিরসের[১৮৩] সিন্দুর বিবি কানের সোনাদানা
পালঙ্ক ছাড়িয়া কর জমিনে বিছানা।
পিন্ধন শাড়ী খুল্যা ফালাও কাট্যা[১৮৪] ফালাও কেশ
আইজ হইতে ধর কন্যা দিগম্বরী বেশ॥৭৮
বাহু হইতে খুল কন্যা বাজুবন্ধ তার
গলা হইতে খুল কন্যা হীরামনের হার।
পাও হইতে থূল কন্যা নোউর[১৮৫] পাঞ্জনী[১৮৬]
কোমর হইতে খুল কন্যা ঘুংঘুর ঝুন্ঝুনি॥৮২
গৈরব[১৮৭] না শোভে কন্যা সোনার ঠোঁটে হাসি
ছুরৎ যৈবন তোমার হইয়া গেছে বাসি।
বিয়ানে ফুটিয়া ফুল হাঞ্জা[১৮৮] বেলা ঝরে
আর নাহি সাজে কন্যা পালঙ্ক উপরে॥৮৬
শোন শোন বিবি আরে কহি যে তোমারে
তোমার স্বামী হইল বন্দী কেল্লাতাজপুর সরে।
এই কথা শুনিয়া বিবি উঠ্যা খাড়া হইল
আসমান ভাঙ্গিয়া যেমন শিরেতে পড়িল॥৯০
মরণ ঠাডা[১৮৯] পড়িল যেমন গোলাপের বাগে
মিলাইল ঠোঁঠের হাসি পরাণে দরদ লাগে॥
আউলাইয়া[১৯০] শিরের কেশ জমিনে লুটায়
তারে দেখ্যা বন্দীগণ করে হায় হায়॥৯৪
দরিয়ারে ডাক্যা বিবি কহিতে লাগিল
আজি হইতে দরিয়া মোর কপাল ভাঙ্গিল।
যে হউক সে হউক দরিয়া আমার কথা ধর
শীঘ্র করি রণের ঘোড়া আন্যা খাড়া কর॥৯৮
আমার স্বামী বন্দী করে শরীলের[১৯১] কত জোর
সাজাও দেখি রণের ঘোড়া গেল কতদুর॥
সিপাই তীরন্দাজে সীতাব কওত ডাকিয়া
রণেতে যাইবাম ঘোড়ায় সোয়ার হইয়া॥১০২
আওরাত[১৯২] হইয়া আমি যাইবাম রণে
এই কথা দরিয়া তুমি রাখিও গোপনে।
লোকে যদি জিজ্ঞাস করে কইয়া বুঝাও তারে
দেওয়ানের মামানী[১৯৩] ভাই যাইব রণেরে॥১০৬
পিল সাজে ঘোড়া সাজে সাজে ফৌজগণ
সাজ সাজ রব হইল রণের কারণ।
তবে ত সখিনা বিবি কোন কাম করিল।
বিদায় লইতে বিবি শাউরীর[১৯৪] কাছে গেল॥১১০
পালঙ্ক ছাড়িয়া বিবি জমিনে লুঠায়
দরদী মায়েরে বিবি কইয়া বুঝায়।
মলিন হইল শিরের কেশ চক্ষে বহে পানি
জমিন ছাড়িয়া উঠ আমার মা জননী॥১১৪
বিদায় দেও মা জননী বিদায় দেও মোরে
রণ করিতে যাইবাম আমি কেল্লাতাজপুর সরে।
আমার স্বামী বন্দী করে কেমন বুকের পাটা
জঙ্গেতে বুঝিবাম তারে কেমন বাপের বেটা॥১১৬
দোওয়া[১৯৫] কর মা জননী দোওয়া কর মোরে
রণে জিত্যা পুত্র তোমার আন্যা দিবাম ঘরে।
চক্ষের পানি মুছ্যা বিবি কয় সখিনার আগে
তোমার কথা শুন্যা মা গো দিলে দরদ লাগে॥১২০
মরদ হইয়া পুত্র আমার রণে বন্দী হইল
এমন রণে যাইতে তোমায় কেবা সল্লা দিল।
আন্ধ্যাইর ঘরের বাতি তুমি অন্ধের যে লড়ী[১৯৬]
লহমার ল্যাগ্যা তোমায় ছাড়িতে না পারি॥১২৪
পাউরিবাম[১৯৭] পুত্র শোক তোমার মুখ দেখিয়া
জঙ্গেতে যাইতে তোমায় না দিবাম ছাড়িয়া।
এই কথা শুনিয়া কন্যা কহিতে লাগিল
আর বার রণে যাইতে বিদায় চাহিল॥১২৮
মানা না করিয়ো মা গো বিদায় দেও মোরে
রণে জিত্যা স্বামী লইয়া আইবাম আমি ঘরে।
নছিব যদি বোরা হয় মা রণে যদি মরি
স্বামীর লাগ্যা রণে মরতে দুঃখু নাই সে করি॥১৩২
সোয়ামীর লাগ্যা আমি তেজিবাম জান্
বিদায় কালেতে মা গো জানাই ছেলাম।
শাউরী বউএ কান্দে দুয়ে গলা ধরাধরি
আন্ধাইরে ঘিরিয়া লইল সোনার জঙ্গলবাড়ী॥১৩৬
সাজ্যা পাইরা[১৯৮] দুলাল[১৯৯] ঘোড়া দুয়ারে হইল খাড়া
সোয়ার হইলে বিবি, শূন্যে দিল উড়া॥
সিপাই ফৌজদার যত আগে পাছে যায়
পায় পাছানিতে[২০০] ধুলা আসমানে উড়ায়॥১৪০
আসমানেতে চান্দ সূরুয, ধুলায় ঢাকিল
বাসা ছাইড়। পশু পংখী উড়িয়া মেলা দিল।
দিনের পথ বাইয়া তারা এক দণ্ডে যায়
এই না সে কেল্লাতাজপুর সামনে দেখা যায়॥১৪৪
বাপ হইয়া দেখ দুষমন হইল,
ঘেরাও করিতে কেল্লা বিবি হুকম দিল।
আড়াই দিন হইল রণ কেউ না জিতে হারে
আগুন লাগাইল বিবি কেল্লাতাজপুর সরে॥১৪৮
বড় বড় ঘর দরজা পুইড়া[২০১] হইল ছাই
রণে হারে বাদশার ফৌজ সরমের সীমা নাই ৷
দিনের দুপর গোঁয়াইল হালিয়া[২০২] পড়ে বেলা
ঘোড়ার উপর থাক্যা বিবি লড়িছে একেলা॥১৫২
এমন সময় শুন সবে কোন কাম হইল
তাজপুর তনে আয়া নফর সেলাম জানাইল॥
হানিপা[২০৩] জিনিয়া তুমি বড় পলোয়ান
এতেক বলিয়া নফর জানাইল সেলাম॥১৫৬
দুষমনে করিল নাশ সোনার জঙ্গলবাড়ী
কে তুমি দরদী আইলা বুঝিতে না পারি।
আপোষনামা লইয়া আইলাম দেখা করিবারে
জঙ্গল বাড়ীর নফর আমি জানাই যে তোমারে॥১৬০
ফিরোজ খাঁ দেওয়ান মোরে দিলাইন পাঠাইয়া
খবর কহিতে তোমায় শুন মন দিয়া॥
যার লাগ্যা জ্বলে আগুন জঙ্গলবাড়ী সরে
তালাক্[২০৪] দিয়াছে দেওয়ান সেই সখিনারে॥১৬৪
বাকি যত বাদশার খেরাজ হপ্তার[২০৫] মধ্যে দিবে
লড়াই হইছে সাঙ্গ খবর জানিবে॥
এত বলি তালাকনামা তুল্যা দিল হাতে
পাঞ্জামরের[২০৬] চিহ্ন কন্যা দেখিলেক তাতে॥১৬৮
তালাকনামা পড়ে বিরি ঘোড়ার উপরে
সাপেতে ডংশিল[২০৭] যেমন বিবির যে শিরে।
ঘোড়ার পিষ্ঠ হইতে বিবি ঢলিয়া পড়িল
সিপাই লস্করে যত চৌদিকে ঘিরিল॥১৭২
শিরে বান্ধা সোনার তাজ ভাঙ্গ্যা হইল গুড়া
রণ থলাতে[২০৮] তারে দেখ্যা কান্দে দুলাল ঘোড়া।
সিপাই লস্কর সবে করে হায় হায়
ঘোড়ার পিষ্ঠ ছাড়া বিবি জমিতে লুঠায়॥১৭৬
আসমান হইতে খুলে তারা খস্যা[২০৯] জমিনে পড়িল
অত দিনে জঙ্গলবাড়ী অন্ধকার হইল॥
আউলাইয়া পড়িল বিবির মাথার দীঘল কেশ
পিন্ধন হইতে খুলে কন্যার পুরুষের বেশ॥১৮০
সিপাই লস্কর সবে দেখিয়া চিনিল
হায় হায় করিয়া সবে কান্দিতে লাগিল।
তবেত পৌঁছিল খবর কেল্লাতাজপুর গিয়া
ফিরোজ খাঁ দেওয়ান আইল উমর খাঁরে লইয়া॥১৮৪
আস্যা দেখে সোনার চাঁদ জমীনে লুঠায়
তারে দেখ্যা উমর খাঁ করে হায় হায়॥
ভাঙ্গা পুতলা[২১০] লইয়া কোলে ছাওয়াল[২১১] যেমন কান্দে
অত দিনে ঘুচ্যা[২১২] গেল আমার মনের সন্দে[২১৩]॥১৮৮
আগে যদি জানতাম মাগো হইব এমন
যাচ্যা[২১৪] দিতাম সাদি তোমার সুখের কারণ।
আগে যদি জানতাম মাও এমন হইব পরে
ফিরোজ খাঁরে লেখ্যা দিতাম কেল্লাতাজপুর সরে[২১৫]॥১৯২
আগে যদি জানতাম মাও যাইবে ছাড়িয়া
জঙ্গলবাড়ী যাইতাম আমি তোমারে লইয়া।
উমর খাঁর কান্দনেতে নদী নালা ভাসে
আসমান হইতে সূরুয্ চান্দ যেমন খসে॥১৯৬
ফিরোজ খাঁ দেওয়ান কান্দে কন্যা কোলে লইয়া
আমারে ছাড়িয়া গেলে কোন্ দোষ পাইয়া।
ফকীর হইলাম আমি তোমার কারণ
দেওয়ানা হইয়া আমি ঘুর্লাম জঙ্গল বন॥২০০
কি কইয়া বুঝাইব আমি অভাগী মায়েরে
আর নাহি যাইবাম আমার জঙ্গলবাড়ী সরে।
দেওয়ানকি[২১৬] তে কাজ নাই ফকীর হইব
তোমার গান পাইয়া আমি ভিক্ষা মাগ্যা খাইব॥২০৪
আজি হইতে তোমার পুত্র হইয়াছে ফকীর
না যাইব জঙ্গলবাড়ী মন কইরাছি স্থির।
ক্য়বরে শুইবাম আমি সখিনারে লইয়া
কি করিলে মনের দুঃখ যাইবে ঘুচিয়া॥২০৮
উজীর কান্দে নাজির কান্দে কান্দে যতজন
বনের পশু পংখী সবে জুইরাছে[২১৭] কান্দন!
রণথলার[২১৮] লোক লস্কর কান্দে জার জার
জঙ্গলবাড়ী সরে গেল এই সমাচার॥২১২
বাইশ জন কোদালিয়া মাটি যে কাটিল
জনাজা[২১৯] পড়িয়া তারে কবরে শুয়াইল।
কবর যে দিয়া সবে বুকে দুঃখ লইয়া
যার তার বাড়ীতে গেল যে চলিয়া॥২১৬
তামাম্ শোধ[২২০] হইল পালা শুন সর্ব্বজন
যার যার নিজ স্থানে করুন গমন।
(সমাপ্ত)
বাঁচ্যা যদি থাকি সাহেবগণ ফিরা বচ্ছর[২২১] আইয়া
নয়া নবিলা[২২২] পালা যাইবাম শুনাইয়া॥২২০
তাল যন্ত্র নাই মোর নানা দোষে দোষী
গান গাইয়া আমি হইলাম অপযশী॥
কি গান গাইব আমি কি মুরাদ[২২৩] আমার
সভার জনাবে ছেলাম জানাই আমার॥২২৪
আন্যাছি নতূন খেউরাল[২২৪] নয়া তালিমদার[২২৫]
বেতালা লাগাইয়া গানে করিছে হর্দ্দার[২২৬]।
এত দোষ ক্ষেমা মোরে দেও সভাপতি।
সভার চরণে আমি জানাই মিন্নতি॥২২৮
কর্ম্ম কর্ত্তা রঙ্গ্ মিয়া করলাইন্ নাম জারি[২২৭]
খাদে মস্ত[২২৮] মিয়া তার কাজলকোনা বাড়ী।
মরমের চান্দে[২২৯] আমরা আইলাম তার বাড়ী
ফিরোজ খাঁর পালা গাইয়া পাইছি পরিস্কারি[২৩০]॥২৩২
ধুতি পাইছি চাদর পাইছি আর পাইছি ধান
রাঙ্গ্ মিয়ার গোচরে আমি জানাই ছেলাম।
ধন পুত্র বাড়ুক তার নাতি পুতি
সরু শস্যি[২৩১] ভইরা উঠুক তার চইদ্দ আড়া খেতি[২৩২]॥ ২৩৬
দোয়া[২৩৩] দিয়া বাড়ীৎ যাই শুন মিয়াগণ
যার যে কামনা আল্লা করকাইন[২৩৪] পূরণ॥২৩৮
পালা শেষ (আল্লহু-আক্বর)।
- ↑ সুরণ=স্মরণ।
- ↑ পর্ধান=প্রধান।
- ↑ কালিয়া গজদানী=কালিদাস গজদানী।
- ↑ ভৈষে=মহিষে।
- ↑ আছিলাইন=ছিলেন।
- ↑ তানি=তিনি।
- ↑ পরজন=স্বগণের বিপরীত, অনাত্মীয়।
- ↑ আগিয়ার=আগে কার
- ↑ শুনখাইন=শুনুন।
- ↑ বরাহ্মণ=ব্রাহ্মণ।
- ↑ রইছে=রহিয়াছে; আছে।
- ↑ নিরাঞ্জন=নিরঞ্জন।
- ↑ ভারে ভারে=বহু সংখ্যক করিয়া। দলে দলে।
- ↑ লগে জঙ্গে কেবা আটে=দেওয়ান ইশা খাঁ মসনদালি দ্রষ্টব্য।
- ↑ হারলাইন=হারিলেন।
- ↑ জইন্তার পাড়েতে=জয়ন্তীয়া পাহাড়ে।
- ↑ শের মাফিক=শের (ব্যাঘ্র) মাফিক (প্রমান)=বাঘের ন্যায়।
- ↑ লাগ=নাগাল।
- ↑ সরে=সহরে।
- ↑ জাঙ্গাল=সারি।
- ↑ সান=পাষানে।
- ↑ বারবাংলা=বারটী দুয়ার সংযুক্ত বাংলা ঘর।
- ↑ খুরলী=কোটর, এখানে জানেলা।
- ↑ খাম্বা=স্তম্ভ।
- ↑ টুই=ঘরের অগ্রভাগ।
- ↑ পইঠান=সিড়ি।
- ↑ আব=অভ্র।
- ↑ বইছ=বসিয়াছে।
- ↑ বইসা=বসিয়া।
- ↑ বইল=বসিল।
- ↑ বির্তান্ত=বৃত্তান্ত।
- ↑ করলাইন্=করিলেন।
- ↑ খিরাজ (খেরাজ্)=খাজানা।
- ↑ খদার কুস্তরে=খদা (খোদা=ঈশ্বর) অনুগ্রহে। কুস্তর=কৃপায়।
- ↑ বান্ধিয়া=বন্ধ করিয়া।
- ↑ ডাকাইবাম=ডাকিয়া আনিব।
- ↑ আন্দর=অন্দর।
- ↑ হাউলী=হাবেলী, অন্তঃপুর
- ↑ লাগাৎ=লাগায়, অবধি।
- ↑ কালুকা=কল্য।
- ↑ সীতাবি=তৎক্ষণাৎ, বিলম্ব না করিয়া।
- ↑ মজগ্ল্=মস্গুল। অতিশয় আহ্লাদিত
- ↑ আরজ=নিবেদন।
- ↑ দিলে=হৃদয়ে।
- ↑ একঅ=জনৈক।
- ↑ পুত=পুত্র।
- ↑ কিম্মত=মূল্য।
- ↑ পুছে=জিজ্ঞাসা করে।
- ↑ শুনখাইন=শুনুন।
- ↑ নাহি=নহে।
- ↑ বিরাম খানা=বিশ্রাম গৃহ।
- ↑ ছলিকার=সুন্দর।
- ↑ আদমের=মনুষ্যের।
- ↑ বেলাইন=ময়দা ছানিবার গোল কাষ্ঠ-খণ্ড বিশেষ।
- ↑ মাঞ্জিয়া=মাজিয়া।
- ↑ চিকচিকা কালা=চকচকে কাল।
- ↑ আঠু ভারাইয়া=হাঁটু পর্য্যন্ত।
- ↑ পাক্না=পাকা।
- ↑ জেয়রপাতি=জহরপাঁতি, অলঙ্কারাদি।
- ↑ ফুটা পউদ=ফোটা পদ্ম।
- ↑ তস্বীর·····গণ=ছবি তো আসল নহে, উহা আসলের নকল। কিন্তু সেই নলই সমস্ত পরীকে হার মানাইয়াছে।
- ↑ ভাবুইন=ভাবেন।
- ↑ রহিন গুয়ানে=রহিন (রহেন), গুয়ানে (গোপনে)=প্রকাশ্যে বাহির হয়েন না।
- ↑ জহর=(জর্জ্জর) তীব্র।
- ↑ ফরছুৎ (ফুরসত)=অবসর।
- ↑ বিদিন=নির্দ্দয়।
- ↑ সিগার=শিকার।
- ↑ প্রানী=প্রাণ।
- ↑ দুন্যাই=দুনিয়া।
- ↑ খেজমত=মুসলমানি ‘খেদমত’ শব্দের অপভ্রংশ; আদর-আপ্যায়ণ
- ↑ ভাটীয়াল নদী=যে নদী ভাটী বহিয়া চলিয়াছে।
- ↑ সুস্থরে=সুস্থির ভাবে।
- ↑ ‘আমারে না পাও’=আমাকে পাইবে না।
- ↑ নিরালা গুয়াও=একাকী সময় যাপন কর।
- ↑ দশ পাঞ্জা=পরিচয়-জ্ঞাপক হস্তাবরণ বিশেষ।
- ↑ তসবী=জপমালা।
- ↑ পরে=প্রহরে।
- ↑ আলাও=আলোকিত।
- ↑ দাওয়াই=ঔষধ।
- ↑ খেজালত=দুঃখ।
- ↑ চেংড়া=অল্প বয়স।
- ↑ সতি=সহিত।
- ↑ বেমার=ব্যারাম।
- ↑ কাবিল=(কাবু) কাহিল।
- ↑ উছিল্লা=অছিলা, অজুহাৎ, সুযোগ। নাহি জানা শুনা=জানা শুনা না থাকিলেও।
- ↑ মেন্দী=এক প্রকার ছোট গাছ; ইহা পত্র-বহুল; এই গাছের পাতার রস লাল। ইহা মুসলমান রমণীদের অলক্তক স্বরূপ। মুন্সী মৌলবীরা ইহা দ্বারা দাড়ি রঙ্গাইয়া থাকেন। এই রীতি অ্যাপি পূর্ব্বরঙ্গে চলিত আছে। মাঞ্জ্যা=মাজিয়া, ঘসিয়া উঠাইল।
- ↑ আসমান পাতাল লাগিল=আকাশ-পাতাল প্রভেদ বোধ হইল।
- ↑ “অঙ্গের..........লাবনী যায়=“ঢলঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণী অবনী বহিয়া যায়” জ্ঞানদাস। ‘দেওয়ান ভাবনা’, “ঈশাখাঁ” প্রভৃতি পালায় ও এই ভাবের পদ আছে।
- ↑ না......উধাও=তাঁহারা কেন তোমার পাছে পাছে উড়িয়া আসিলেন না।
- ↑ সুস্তরে=সুবিস্তারে, বিস্তৃতভাবে।
- ↑ গেলাইন=গেলেন।
- ↑ তাবিজ=কবচ।
- ↑ তেনালা=তে (তিন) নালা (খাল) তিনটী খাল; অথবা তিনটী খাল একত্রে মিলিত হইয়াছে যেখানে। তেমোহনা।
- ↑ উতার=মন্ত্রঃপূত জল। সাধারণ লোকের বিশ্বাস যে ‘উতারে’ রোগ দূর হয়।
- ↑ মাইজা=মধ্যম ভাগ; কটিদেশ।
- ↑ কাঞ্চা=কাঁচা।
- ↑ দুলাইন্=বিবাহের পাত্রী, দুলালী।
- ↑ ভ্রমরা=কথ্য ভাষায় কখন কখন ‘ভ্রমর’কে ভ্রমরা বলিতে দেখা যায়।
- ↑ কেনে=কেন।
- ↑ দুনিয়ামে=পৃথিবীতে।
- ↑ হাসিল্=সম্পন্ন।
- ↑ ফিরুলী=ফেরিওয়ালী।
- ↑ দেখাও=দেখাইও।
- ↑ কইয়া=কহিয়া।
- ↑ থাকব=থাকিবে।
- ↑ থাকিবা=থাকিবে।
- ↑ একাকারী=একাকিনী।
- ↑ দেখ্যা=দেখাইয়া; দেখিয়া।
- ↑ ভর্মনা=(ভ্রমনা) ভ্রমন।
- ↑ সমুজ=সমুচ্চ।
- ↑ সামায়=প্রবেশ করে।
- ↑ সুর্মা=মুসলমানগণের ব্যবহৃত কাজল বিশেষ।
- ↑ মাল=পালোয়ান (মল্ল হইতে)।
- ↑ ধুন্দল=শশাজাতীয় এক প্রকার ফল।
- ↑ আৎকা=হঠাৎ; অপ্রত্যাশিত ভাবে।
- ↑ দুস্ত=বন্ধু। স্বপ্নে যেন কেহ সোনার ফল হাতে পাইলে, কিম্বা অপ্রত্যাশিত ভাবে কোন দরদী বন্ধুর সঙ্গে দেখা হইল। সেই তস বীর দেখিয়া সুখিনা তেমনই সুখী হইল।
- ↑ সাচা=(সাচ্চা, সত্য।
- ↑ ফিরান=ফেরি।
- ↑ উৎযোগী=উদ্যোগী।
- ↑ জারজার=(জর্জ্জর হইতে); অবসন্ন। দেওয়ানের বিরহে লোক মরিয়া যাইতেছে।
- ↑ কয়বর=কব্বর।
- ↑ বেওয়া বিধুরা=অনাথা বিধবারা
- ↑ ভিন্=ভিন্ন।
- ↑ আগপাছ=অগ্রপশ্চাৎ সমুদয়।
- ↑ দেওয়ানা=পাগল।
- ↑ “পন্থের·····সাজিল।” ফকীর বেশী ফিরোজের প্রণয়ে মুগ্ধা সখিনা মনে মনে নিজেও পথের ফকীর সাজিল।
- ↑ গুছুল পৈরাণ=স্নান ও বেশভূষা।
- ↑ বিছান=বিছানা, শয্যা।
- ↑ তাবেদার=শরীর রক্ষী; আদেশবাহী।
- ↑ তরিঘরি=তাড়াতাড়ি।
- ↑ হইলাইন=হইলেন।
- ↑ আনইলে=আর, না হইলে; আর যদি তাহা না হয়।
- ↑ না লেখছুইন্=লিখেন নাই।
- ↑ থাক্যা যাইব=থাকিয়া যাইবে
- ↑ কুসময়ে=অসময়ে।
- ↑ আয়াৎ=আয়ু।
- ↑ ফেরে=মুস্কিলে।
- ↑ আলাপ=প্রস্তাব।
- ↑ খয়ের=মঙ্গল।
- ↑ জান্য=জানিয়ো। যদি এই বিবাহ করান হয় তবে জানিয়ো, ইহা মঙ্গল-জনক হইবে না।
- ↑ নি=কিনা।
- ↑ ফানা=পাগল।
- ↑ লহমা=মুহুর্ত্ত
- ↑ তনে=হইতে। এখনও পূর্ব্ববঙ্গে “থনে” শব্দের প্রচলন আছে
- ↑ গোসা=রাগ।
- ↑ গর্দ্দানা=ঘাড়।
- ↑ ঘেটি=ঘাড়।
- ↑ দোয়ে=দুইজনে
- ↑ উঠনে বৈসনে=উঠিতে বসিতে।
- ↑ একজনের...... কাড়ি=একজনের মনের কষ্ট অপরে বাটিয়া লইয়া তাহা লঘু করে।
- ↑ নিরবধি লইয়া=বিদায় লইয়া, ইতি করিয়া, অবধি করিয়া।
- ↑ বেইজ্জতি হইয়া=অপমানিত হইয়া।
- ↑ অচম্বিত=আচম্বিতের অপভ্রংশ। হঠাৎ।
- ↑ কালা কেসইরতা=ইহা এক প্রকার কাল রঙ্গের ঘাস, কাল রঙ্গের ‘কেসর’ নামক একরূপ জলজ ফল আছে, তাহাও হইতে পারে।
- ↑ মীন্নত=মেহনতের অপভ্রংশ; পরিশ্রম।
- ↑ দিতাম=দিবার জন্য।
- ↑ জননা=স্ত্রীলোক।
- ↑ করখাইন=করুন।
- ↑ বান্ধিয়া রাখিছে=বন্ধ করিয়া রাখিয়াছে।
- ↑ আরি=তফাৎ।
- ↑ সর=সহর।
- ↑ বিনায়া=বিনাইয়া, বিলাপ করিয়া।
- ↑ ছেল=শেল।
- ↑ দেওখাইন=দিউন, দিন
- ↑ লৌ=(‘লহুর’ অপভ্রংশ), রক্ত।
- ↑ ‘জঙ্গে না পারিব’=যুদ্ধে জয়লাভ করিতে পারিবে না।
- ↑ পিষ্ঠে পরাণে=আপ্রাণ চেষ্টায়।
- ↑ জিত্যা আইবাম=জিতিয়া আসিব।
- ↑ গই গই করিয়া=গড়িমসি করিয়া।
- ↑ লইব=লইবে।
- ↑ যাইতাম=যাইব।
- ↑ পাঞ্চ পীরের মাটি=পাঁচজন সাধু ব্যক্তির কবরের ধুলা।
- ↑ আইও=আসিও ৷
- ↑ ফজলে=ইচ্ছায়, কৃপায়।
- ↑ ভইরা=ভরিয়া।
- ↑ বান্ধ্যা=ব্যাপিয়া, ধরিয়া।
- ↑ বিয়ানে=(বিহান); প্রভাতে। এক দিনের মধ্যে রণজয় করিয়া ফিরিবেন, ফিরোজ খাঁ এই আশ্বাস দিয়া গিয়াছেন।
- ↑ আজু=হাতমুখ ধোয়ার জল।
- ↑ গুইছাল গোছলখানা=স্নানাগার।
- ↑ আইব=আসিবে।
- ↑ বোরা=খারাপ, মন্দ।
- ↑ ছুট্যা=ছুটিয়া।
- ↑ শিরসের=মাথার।
- ↑ কাট্যা=কাটিয়া।
- ↑ নোউর=নুপুরের অপভ্রংশ।
- ↑ পাঞ্জনী=পায়ের অলঙ্কার বিশেষ, ইহা অদ্যাপি নর্তকীরা ব্যবহার করে, পায়জোড়।
- ↑ গৈরব=গরিমা; গৌরবের অপভ্রংশ।
- ↑ হাঞ্জা=সাঁঝ সন্ধ্যা।
- ↑ ঠাডা=বজ্র।
- ↑ আউলাইয়া=এলোমেলো করিয়া; অবিন্যস্ত অবস্থায়।
- ↑ শরীলের=শরীরের। “জোর” শব্দের দেশীয় উচ্চারণ “জুর”।
- ↑ আওরাত=স্ত্রীলোক।
- ↑ মামানী=মামাতো।
- ↑ শাউড়ী=শাশুড়ী।
- ↑ দোওয়া=আশীর্ব্বাদ।
- ↑ লড়ী=যষ্টি।
- ↑ পাউরিবাম=পাশরিব; ভুলিব।
- ↑ সাজ্যা পাইয়া=সাজিয়া পরিয়া।
- ↑ দুলাল=ঘোড়ার নাম।
- ↑ পায়পাছানিতে=চলা ফেরার দরুণ পদদলনে।
- ↑ পুইড়া=পুড়িয়া।
- ↑ হালিয়া=হেলিয়া।
- ↑ হানি্ফা=একজন মুসলমান বীর, মোস্লেম পৌরানিক গ্রন্থে এই বীরের আসন অতি উচ্চে।
- ↑ তালাক্=পরিত্যাগ।
- ↑ হপ্তা=সপ্তাহ।
- ↑ পাঞ্জামর=গাঞ্জা ও মোহর।
- ↑ ডংশিল=‘দংশিল’র অপভ্রংশ।
- ↑ থলা=স্থল।
- ↑ খস্যা=খসিয়া।
- ↑ পুতলা=পুতুল।
- ↑ ছাওয়াল=ছেলে পিলে।
- ↑ ঘুচ্যা=ঘুচিয়া।
- ↑ সন্দে=সন্দেহ।
- ↑ যাচ্যা=যাচিয়া।
- ↑ ফিরোজ খাঁরে......সরে=ফিরোজ খাঁকে কেল্লাতাজপুর সহরের অধিকার লিখিয়া দিতাম।
- ↑ দেওয়ানকি=দেওয়ানগিরি।
- ↑ জুইরাছে=আরম্ভ করিয়াছে।
- ↑ রণথালার=রণস্থলের।
- ↑ জনাজা=অন্তিম প্রার্থণা। স্বর্গগত আত্মার শান্তি ও সদগতির জন্য ঈশ্বর সমীপে প্রার্থণা।
- ↑ তামাম্ শোধ=সম্পূর্ণ
- ↑ ফিরা বচ্ছর=আগামী বার।
- ↑ নবিলা=নূতন নূতন।
- ↑ মুরাদ=ক্ষমতা, উপযুক্ততা।
- ↑ খেউরাল=ক্রীড়ক, খেলোয়াড়।
- ↑ নয়া তালিমদার=নয়া (নূতন) শিক্ষা নবিস্।
- ↑ হর্দ্দার=হদ্দ, গোলমাল।
- ↑ জারি=প্রকাশ, প্রচার।
- ↑ খাদেমস্ত=বড় লোক।
- ↑ মরমের চান্দে=মহ্রমের শুক্ল পক্ষে
- ↑ পরিস্কারি=পুরস্কার।
- ↑ সরু শস্যি=(১) উত্তম শস্যাদিতে। (২) সর্ষে এবং অন্যান্য শস্যে।
- ↑ আড়া খেতি (ক্ষিতি)=চৌদ্দ আড়া জমি।
- ↑ দোয়া=ঈশ্বরের নিকট শুভ প্রার্থনা।
- ↑ করকাইন=করুন্।