পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/সুরৎ জামাল ও অধুয়া

(১২) ছুরত জামাল ও অধুয়াসুন্দরী।

(৩৯১—৪১৩ পৃঃ)

 জন্মান্ধ কবি ফৈজু ফকির এই পালার রচয়িতা; ইহার নাম ভণিতায় পাঁচ বার পাওয়া গিয়াছে। কবির পিতা, মাতা বা ভ্রাতা কেহই জীবিত ছিলেন না, এতদ্ব্যতীত তিনি নিজের আর কোনও পরিচয় দেন নাই। চন্দ্রকুমারও কবির সম্বন্ধে বেশী কিছু তথ্য দিতে পারেন নাই। চন্দ্রকুমার শ্রীহট্টের অন্তঃপাতী বাণিয়াচঙ্গে গিয়া বহু শ্রম সহকারে তিনজন গায়েনের নিকট হইতে পালাটী সংগ্রহ করেন।

 জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ানদিগের ন্যায় বাণিয়াচঙ্গের দেওয়ানেরাও পূর্ব্বে হিন্দু ছিলেন। চতুর্দ্দশ শতাব্দীতে বাণিয়াচঙ্গের ব্রাহ্মণরাজা গোবিন্দ খাঁ ইস্‌লাম ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া হবিব খাঁ নাম ধারণ করেন। বাণিয়াচঙ্গ শ্রীহট্টের একটি গণ্ডগ্রাম; এই গ্রামের লোকসংখ্যা এখনও ত্রিশ হাজার। হবিব খাঁ শুধু বাণিয়াচঙ্গের অধিপতি ছিলেন না; পার্শ্ববর্ত্তী লাউড় পরগণাও তাঁহার অধীনে ছিল। তিনি শ্রীহট্টের ২৪টী পরগণার মালিক ছিলেন। বাণিয়াচঙ্গের অবস্থিতি এইরূপ—উত্তরে ২৪°৩১′, পূর্ব্বে ৯১°২০′। লাউড়ের জঙ্গলে এখনও বাণিয়াচঙ্গ হাব্‌লি নামক দুর্গের ভগ্নাবশেষ বিদ্যমান রহিয়াছে; উহা বাণিয়াচঙ্গের দেওয়ানদিগের লাউড়ের উপর আধিপত্যের সাক্ষ্যপ্রদান করিতেছে। দেওয়ানপরিবারের পূর্ব্ব‌গৌরব এখনও ক্ষীণভাবে বর্ত্তমান রহিয়াছে; দেওয়ান আজমান খাঁ এই প্রসিদ্ধ বংশের বর্ত্তমান প্রতিনিধি।

 এই দেওয়ানদিগের একটি আখ্যায়িকা অবলম্বনে পালাটি রচিত। দেওয়ানদের বংশলতায় আলাল খাঁ, দুলাল খঁ। ও জামাল খাঁ এই তিনটি নাম পাই নাই। ইস্‌লামধর্ম্মে দীক্ষিত হবিব খাঁর পঞ্চম বংশধররূপে আমরা এক জামাল খাঁর নাম পাইতেছি। কিন্তু বংশলতায় জামাল খাঁর পিতার নাম আহম্মদ খাঁ পাওয়া যায়—পালার কথিত আলাল খাঁ নহে। সুতরাং এই দুই জামাল খাঁ একই ব্যক্তি, এরূপ মনে হয় না। তবে দেওয়ানদিগের সাধারণ্যে প্রচলিত নামান্তর থাকিতে পারে এবং কবির পক্ষে সরকারী কাগজপত্রে ব্যবহৃত অপেক্ষাকৃত বড় নামগুলি বর্জ্জন করিয়া সহজ ডাকনাম ব্যবহার করা ও অসম্ভব নহে।

 শ্রীহট্টজেলার মৈনা-কানাইবাজার নিবাসী পণ্ডিত শ্রীযুক্ত অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধি মহাশয়কে আমি এ সম্বন্ধে লিখিয়াছিলাম; শ্রীহট্টের ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁহার উক্তিই অনেকটা প্রামাণ্য—তিনিই এখন এক্ষেত্রে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। বাঙ্গালা ১৩২৯ সালের ১লা অগ্রহায়ণ তত্ত্বনিধি মহাশয় আমার প্রশ্নের জবাবে যে চিঠি দিয়াছিলেন, তাহার কিয়দংশের মর্ম্ম নিম্নে প্রদান করিতেছি।

 “বাণিয়াচঙ্গের আলাল-দুলালকে দিয়া আপনি কি করিবেন? শ্রীহট্টের ইতিহাস সম্বন্ধে আমার গ্রন্থ চার খণ্ডে দুই হাজার পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হইয়াছে। এই গ্রন্থে বাণিয়াচঙ্গের সব কথাই আছে। তবে দেওয়ানদিগের বংশলতায় আলাল-দুলালের নাম নাই। বর্ত্তমান দেওয়ানেরা এসম্বন্ধে কোনও তথ্য দিতে পারেন নাই। ‘আলাল-দুলাল’ নাম দুটি হিন্দু ঘরেরও হইতে পারে। অত্যধিক প্রশ্রয়-প্রাপ্ত ছেলেকে পল্লী গ্রামে “আলালের ঘরের দুলাল” বলিয়া থাকে। সুতরাং ইহাও সম্ভব হইতে পারে, উক্ত নামধারী দেওয়ানদ্বয় বাল্যকালে পিতামাতার অতিরিক্ত আদুরে ছিলেন বলিয়া ‘আলাল-দুলাল’ নামে পরিচিত হইয়াছিলেন। আমার মনে হয় জামাল খাঁ ও কামাল খাঁই সাধারণের নিকট এই নামে পরিচিত ছিলেন। ১৭৪৯ খ্রীষ্টাব্দের একটি দলিলে আদম খাঁর নাম পাওয়া যায়, কিন্তু এই নামে কোনও দেওয়ান ছিলেন, বংশলতায় তাহার আভাস নাই। এই সময়ে যে দুইজন দেওয়ান জীবিত ছিলেন, তাঁহাদের নাম আহম্মদ খাঁ ও মামুদ খাঁ। এই আহম্মদ খাঁরই নামান্তর আদম খাঁ হইবে।

 “জামাল খাঁ ও কামাল খাঁ আলাল-দুলাল নামে পরিচিত ছিলেন, এই সিদ্ধান্তের অপর একটি প্রমাণ মিলিতেছে। এখানে একটি প্রবাদ আছে যে এই দেওয়ানদ্বয় দুবরাজ নামক দক্ষিণভাগের এক রাজার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। দক্ষিণভাগ নামটি এই সময়েরই সৃষ্টি। এই স্থান আসামবেঙ্গল রেলওয়ের একটি স্টেশন—শ্রীহট্ট হইতে তের মাইল দূরে অবস্থিত। বদরপুর হইতে ইহার দূরত্ব প্রায় ৩৬ মাইল এবং রেলওয়ে লাইনের পশ্চিম সীমান্ত হইতে ২১৬ মাইল। দুবরাজের নাম এখন লোক-স্মৃতি হইতে অপসারিত হইলেও এই রাজার সম্বন্ধে অনেক ঐতিহাসিক তথ্য এক সময়ে পল্লীগ্রাম অঞ্চলে বিদিত ছিল। ইহা ২০০ বৎসরের কথা। এই দক্ষিণভাগ নামের সঙ্গে কোনও সামাজিক ঘটনার সংস্রব ছিল।

 “শ্রীহট্টে দুবরাজ নামটি নূতন নহে। শ্রীহট্টে দুবরাজ নাম ধেয় জনৈক বৈষ্ণবকবি ছিলেন। দুইশত বৎসর পূর্ব্বে তিনি “নিমাই সন্ন্যাস” নামে একখানি কাব্য রচনা করেন; এই কাব্য ভক্তি ও করুণরসের উৎসস্বরূপ। চৈতন্য-দেবের জন্মের পূর্ব্বে তাঁহার পিতামাতা শ্রীহট্ট পরিদর্শন করেন, কাব্যে সেই কথা বর্ণিত হইয়াছে। দ্বাদশ বৎসর পূর্ব্বে আমি ইহার একখানি হস্তলিখিত পুঁথি পাইয়াছিলাম। কাব্যখানি এখনও অপ্রকাশিত রহিয়াছে।

 “কবি দুবরাজ বৈষ্ণব-সাধু ছিলেন। এই দুবরাজের চরিত্র-মাহাত্ম্য দেওয়ান কামাল খাঁ ও জামাল খাঁর শ্রদ্ধার উদ্রেক করিয়া থাকিতে পারে। সময়ের দিক্ দিয়া মিল থাকার দরুণ আমার এইরূপ অনুমান হয় যে আপনার কথিত আলাল খাঁ ও দুলাল খাঁ—এই কামাল খাঁ, জামাল খাঁ হইতে অভিন্ন।

 “শ্রীহট্ট এককালে ভট্টদিগের গীতের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল; বিশেষতঃ বাণিয়াচঙ্গের ভাট্‌দিগের খ্যাতি দেশদেশান্তরে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। ভট্টশিরোমণি মকরন্দের গান এখনও শ্রীহট্টবাসীর মুখে শোনা যায়।

 “দেওয়ান আলাল দুলালের দুবরাজের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা আপনাদের কোনও পালাগানে পাইয়াছেন কি? এরূপ পালা পাইয়া থাকিলে তাহার ঐতিহাসিকত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ করিবেন না। আমাদের দেশের বহু ঐতিহাসিক ঘটনা এই সমস্ত অখ্যাতনামা নিরক্ষর পালাকর্ত্তাদিগের গানের মধ্যে লুক্কায়িত আছে”।

 পণ্ডিতপ্রবর শ্রীযুক্ত তত্ত্বনিধি মহাশয় এখনও এই পালাটির সন্ধান জানেন না। তাঁহার লিখিত ঐতিহাসিক মন্তব্যসমূহ সম্বন্ধে আমাদের বিশেষ ব্যক্তব্য কিছু না থাকিলেও এইটুকু স্বীকার করিতে পারি যে তাঁহার শেষ কথাটি বাস্তবিকই সত্য। প্রধান প্রধান ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে এই সমস্ত গ্রাম্য কবি অনেক সময় নূতন গাথা রচনা করিতেন। ইহাঁদের বিবরণ গ্রাম্যতাদোষদুষ্ট হইলেও কোন কোন স্থলে অনেক ঐতিহাসিকদিগের বিবরণ অপেক্ষা অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য। তবে পালার রচয়িতারা অনেক সময় ইতিহাস ও উপকথার সংমিশ্রণ করিয়া ফেলিতেন। বর্ত্তমান পালাটিরও এই দোষ দেখা যায়। অন্ততঃ পালার প্রারম্ভ ভাগট। উপকথা বলিয়াই মনে হয়। জ্যোতিষীদিগের উপদেশানুসারে সদ্যোজাত রাজকুমারদিগকে মৃত্তিকাগর্ভস্থ আবাসে রক্ষা করা এবং অনিশ্চিত বিপদের আশঙ্কায় বহুদিন যাবৎ সন্তানের মুখ সন্দর্শন না করা—এই রূপ ঘটনা-মুলক উপাখ্যান আমরা বহুবার শুনিয়াছি। কিন্তু পালার প্রারম্ভটি কাল্পনিক হইলেও পরবর্ত্তী উপাখ্যানভাগ অর্থাৎ অধুয়াসুন্দরীর জামাল খাঁর প্রতি প্রেমের কাহিনী ও তৎসংসৃষ্ট অপরাপর ঘটনাবলী অবিশ্বাস্য বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া চলে না। কাহিনীর নিশ্চয়ই কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি ছিল। এই সমস্ত আখ্যায়িকার অসার অংশ বর্জ্জন করিয়া সার সঙ্কলন করিলে দেশের প্রকৃত ইতিহাস লিখিত হইতে পারে; এই জন্যই এগুলি মূল্য-হীন নহে।

 মুসলমানেরা অনেক সময় হিন্দু-মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িতেন এবং এই আকর্ষণের ফলে বহু যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হইত; চন্দ্রকুমার সংগৃহীত অনেক পালাগান হইতে এই কথাটি জানিতে পারা যায়। আমি অন্যত্র ইহার কারণ নির্দ্দেশ করিবার প্রয়াস পাইয়াছি; এখানেও তাহার পুনরুক্তি করিব।

 দেওয়ানদের মধ্যে অনেকেই পূর্ব্বে হিন্দু ছিলেন; পরে ইস্‌লামধর্ম্ম গ্রহণ করিলেও তাঁহাদের হিন্দুর সংস্কার ও হিন্দুসমাজের প্রতি অনুরাগ একবারে লুপ্ত হইত না। হিন্দুসমাজ কিন্তু তাঁহাদিগকে ধর্ম্মত্যাগী বলিয়া অস্পৃশ্যবোধে বর্জ্জন করিতেন। সুতরাং প্রভূত ক্ষমতাশালী দেওয়ানেরা বলপ্রয়োগে হিন্দুসমাজের অপমানজনক আচরণের প্রতিশোধ লইবার যে চেষ্টা পাইতেন তাহা স্বাভাবিক। বাণিয়াচঙ্গের দেওয়ানের পূর্ব্বে ব্রাহ্মণ ছিলেন। বৃদ্ধ মন্ত্রী দুবরাজের নিকট হইতে যেরূপ আচরণ পাইয়াছিলেন, তাহাতে পরস্পর সম্বন্ধহীন দুইটী পরিবারের মধ্যেও ভীষণ শত্রুতার সঞ্চার হইতে পারিত। এক্ষেত্রে দুইটি পরিবার একই শাখা হইতে উদ্ভুত; সুতরাং অপমানের গ্লানি আরও তার বোধ হওয়া অঙ্গাভাবিক নহে। সুতরাং জামাল খাঁ অভিযান করিয়া বলপূর্ব্বক তঅধুয়া সুন্দরীকে হরণ করিবেন—ইহাতে আশ্চর্য্যের বিষয় কিছুই নাই।

 এই সমস্ত মুসলমান যদি পারস্য অথবা অন্য কোন পাশ্চাত্য প্রদেশ হইতে আসিয়া এদেশে হিন্দুদের প্রতিবেশীরূপে বসবাস করিতেন, তাহা হইলে বোধ হয় হিন্দুদের সঙ্গে এরূপ বিবাদের সৃষ্টি হইত না; হিন্দুমহিলাদিগের প্রতিও হয়ত তাঁহাদের এরূপ লুব্ধ দৃষ্টি পড়িত না। রাজপুতানার ইতিহাসে অবশ্য এই নিয়মের অন্যথা হইতে দেখা গিয়াছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ইহা বলা যায় যে বিক্রেতা পাঠানেরা নানাভাবে হিন্দুকে নির্জ্জিত ও পদানত করিবার জন্যই এইরূপ অত্যাচার করিতেন; অন্য উদ্দেশ্যে নহে। উদার রাষ্ট্র নীতির বশবর্ত্তী হইয়া আকবর হিন্দুদের সঙ্গে আত্মীয়তা করার প্রয়াসী ছিলেন।

 কিন্তু বঙ্গদেশে এইরূপ ব্যাপারের অন্য কারণ ছিল। উভয় সম্প্রদায় মূলতঃ একই জাতি এবং সেইজন্য একই প্রকারের রুচি ও সংস্কারের বশবর্ত্তী ছিলেন, ইহাই বোধ হয় এইরূপ সঙ্ঘর্ষের কারণ হইত। সুতরাং এদেশে হিন্দুকন্যাদিগের প্রতি মুসলমানের আসক্তি কতকটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।

 এই পালাটিতে ফার্সী অথবা উর্দ্দূ শব্দের প্রয়োগ অপেক্ষাকৃত অধিক। কিন্তু তাহা হইলেও ইহার ভাষ। বটতলা-প্রকাশিত মুসলমানী পুথির অনুরূপ “মুসলমানী বাঙ্গালা” নহে। বাঙ্গালী মুসলমানেরা কথাবার্ত্তায় যে পরিমাণে উর্দ্দূ শব্দের প্রয়োগ করিয়া থাকেন, এই পালাটিতে উর্দ্দূ শব্দের প্রয়োগ সেইরূপই—তাহা অপেক্ষা বেশী নহে। হিন্দু পাঠকের নিকট বিসদৃশ এবং দুর্ব্বোধ্য ঠেকিতে পারে, এই পালাগানটিতে এরূপ শব্দ বেশী ব্যবহৃত হয় নাই। বস্তুতঃ, যে সমস্ত উর্দ্দূ শব্দ আমাদের কথাবার্ত্তার ভাষায় আসিয়া পড়িয়াছে এবং যাহা বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমান উভয়েই বুঝেন—লিখিত ভাষায় সে গুলির প্রচলন হওয়া অসঙ্গত নহে। কারণ ইহাতে বাঙ্গালা ভাষা হিন্দুমুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশের শক্তি অর্জ্জন করিতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে সংস্কৃতাভিমানিগণ কথাবার্ত্তায় প্রচুর পরিমাণে উর্দ্দূশব্দের ব্যবহার করিলেও লেখার সময় যথাসাধ্য উর্দ্দূ পরিহার করিয়া থাকেন। নিম্নলিখিত শব্দগুলি এই শ্রেণীভুক্ত—যথা, সল্লা, বখ্‌শিষ্, লাখেরাজ, গোলাম, আপশোষ, দুষমণ, বাঁদী, শয়তান, বদনাম, মুস্কিল, ওস্তাদ, দুনিয়া, আস্‌মান, জমিন্‌, আছান, আখের, দরিয়া, বেইমান, বেইজ্জত ইত্যাদি। পালাগানে এইরূপ অসংখ্য শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। এ সম্বন্ধে “মৈমনসিংহগীতিকা” প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় আমরা বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করিয়াছি।

 এসম্বন্ধে আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করিবার আছে। বর্ত্তমান পালার অন্ধ কবি এবং নিরক্ষর গায়ক সম্প্রদায় স্বাভাবিক উচ্চারণ বজায় রাখিয়া কথ্যভাষায় ব্যবহৃত শব্দগুলি প্রয়োগ করিয়াছেন। ভাষাতত্ত্ববিদ্‌গণ এ বিষয়টি লক্ষ্য করিতে পারেন। শব্দের লিখিত আকৃতির সহিত অন্ধ অথবা নিরক্ষর কবিগণের পরিচয় না থাকার দরুণ তাঁহারা শুধু শ্রুতিশক্তির দ্বারা শব্দের ধ্বনি উপলব্ধি করেন, এবং প্রয়োগকালে অবিকল তাহাই ব্যবহার করেন। এইজন্যই বর্ত্তমান পালা-রচক অন্ধ কবি শব্দের কথ্যভাষায় ব্যবহৃত উচ্চারণ বজায় রাখিয়াছেন এবং নিরক্ষর গায়েনেরাও কবির ব্যবহৃত কথিতভাষা অবিকৃত ভাবে রক্ষা করিয়া কবির কথাতেই পালাগানগুলি গাহিয়া গিয়াছেন। যে ক্ষেত্রে পালা-রচকের সামান্য পরিমাণেও অক্ষর-বোধ থাকিত, সে স্থানে তৎকর্ত্তৃক লিখিত ভাষার অনুযায়ী উচ্চারণ অনুসরণ করিবার প্রয়াস করা স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে নিরক্ষর অন্ধ কবি ও নিরভিমান মূর্খ গায়েনের হাতে স্বাভাবিক উচ্চারণের বিকৃতি ঘটে নাই। সুতরাং পালাগানে “ছোট”কে “ছুডু”, “প্রজা”কে “পরজা”, “চাঁদ”কে “চান্‌”, “হইবে”কে “অইব”, “শোন”, “শোক”, “সভা” ও “সাহেব”কে যথাক্রমে “ছোন”, “ছোক”, “ছভা”, “ছাহেব”, “দুঃখু”কে “দুষ্কু”, “বৃদ্ধ”কে “বির্দ্ধ”, “সূর্য্য”কে “সুরুজ”—ইত্যাদি আকৃতিতে ব্যবহার করা হইয়াছে।

 চন্দ্রকুমারের সংগৃহীত অন্যান্য পালাগানের তুলনায় এই পালাটি কবিত্ব সমৃদ্ধিতে গণনীয় নহে। বর্ণনাগুলি কৌতূহলপ্রদ হইলেও পালার কোথায়ও বর্ণনা-মাধুরী ও সরলতা নাই। পালায় বহুল পরিমাণে কথ্যভাষার প্রয়োগ করিলেও স্থানে স্থানে, বিশেষতঃ নারীগণের সৌন্দর্য্যবর্ণনা প্রসঙ্গে কবি সংস্কৃতশব্দের উৎকট অনুকরণের দ্বারা পাণ্ডিত্যপ্রকাশের লোভ সংবরণ করিতে পারেন নাই। কিন্তু কবির সংস্কৃত শব্দতন্ত্রে আদৌ অধিকার না থাকায় ভাষা অনেক স্থলে হাস্যোদ্দীপক হইয়া পড়িয়াছে। “মহুয়া” “মলুয়া”, “চন্দ্রাবতী”তে যে সহজ সরল সৌন্দর্য্য ও ভাষার অবাধ গতি পাই, ইহাতে তাহা দৃষ্ট হয় না। সেখ ফৈজুর বর্ণনা অনেক স্থলে একঘেঁয়ে ও বাহুল্যদোষ-দুষ্ট হইয়া পড়িয়াছে। বিশেষতঃ বিভিন্ন অধ্যায়ে পরস্পর বিরোধী বর্ণনা দ্বারা কবি সামঞ্জস্য বোধের অভাবের পরিচয় দিয়াছেন। তিনি একস্থলে বলিয়াছেন, বানিয়াচঙ্গ হইতে দক্ষিণ ভাগ সাত দিনের পথ, অন্যত্র পাঁচ দিনের পথ, আবার শেষের দিকে বলিয়াছেন, দেওয়ান আলাল দক্ষিণভাগের রাজাকে বার ঘণ্টার মধ্যে হাজির করিবার জন্য আদেশ দিতেছেন। একস্থলে মক্ক। সহরকে বাণিয়াচঙ্গ হইবে ছয় মাসের পথ, অন্যত্র দিল্লীনগরীকেও সমান ব্যবধানে অবস্থিত, বলা হইয়াছে। তবে এই সমস্ত উক্তি মূর্খ গায়েনের স্মৃতি ভ্রংশের দরুণ ভুলও হইতে পারে; একটা বৃহৎ পালার রচয়িতার পক্ষে এরূপ প্রমাদ কতকট। অস্বাভাবিক বলিয়া মনে হয়।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি, আখ্যানটির প্রারম্ভ-ভাগ সম্ভবতঃ উপকথা হইতে গৃহীত, এবং পালাটি উপকথা ও ইতিহাসের সংমিশ্রনে রচিত। কিন্তু উপকথা রচনাতেও সম্পুর্ণ স্বেচ্ছাচার চলে না। এক জায়গায় কথিত হইয়াছে, তেড়া-লেঙ্গড়া একদিনে “হাইলাবনে” চলিয়া গিয়াছিল; আবার এই “হাইলাবন”ই ছ’মাসের পথ, বলিয়া অন্যত্র উক্ত হইয়াছে। এইরূপ গরমিল উপকথায়ও অমার্জ্জনীয়। তবে সর্ব্বদাই আমাদের মনে রাখিতে হইবে যে এই পালাগান গুলি নিরক্ষর কৃষক কবির রচিত এবং অক্ষর জ্ঞানহীন গায়েনের দ্বারা গীত হইত। সুতরাং অসামঞ্জস্য গুলি অস্বাভাবিক নহে।

 কবির আর একটি দোষ, পুনরুক্তি,—একই ভাবের কথার পুনঃ পুনঃ অবতারণা করা। যথা, কোনও দুর্ঘটনা ঘটিলে সমস্ত রাজ্যে একটা শোকের উচ্ছ্বাস হওয়া চাই। স্ত্রীপুরুষ সকলকেই আর্ত্তনাদ করিয়া কাঁদিতে হইব। পক্ষীরা পর্য্যন্ত কাকলী দ্বারা শোক প্রকাশ করিবে; অশ্বশালায় অশ্ব এবং হস্তিশালায় হস্তীও নীরবে অশ্রুবিসর্জ্জন করিবে। এইরূপ বর্ণনা আলালের মক্কাযাত্রা কালে একবার পাওয়া যায়, তরুণ জামালকে দিল্লী প্রেরণ কালেও এইরূপ শোকোচ্ছাস-বর্ণনা আছে। আবার আখ্যায়িকা পরিসমাপ্তির দিকে আলালের চিরতরে নগর পরিত্যাগ কালে এই একই দৃশ্যেরই অবতারণা করা হইয়াছে।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি, মৈমনসিংহের অন্যান্য পালাগানের মত এই রচনায় তেমন কবিত্ব সম্পদ নাই। তবে ঐতিহাসিকতার দিক্ দিয়া বিচার করিলে এই পালাটির কতকটা মূল্য আছে; মুসলমান আমলের সমাজ সম্বন্ধে অনেক কথার সন্ধান আমরা এই পালার ভিতর দিয়া পাইতেছি। পালার যে সমস্ত নিষ্ঠুর র শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা উল্লিখিত হইয়াছে, তাহা অতিরঞ্জিত নহে। স্বল্পকারণে নগর ও গ্রাম ধ্বংসকরণ এবং অধিবাসীদিগকে হত্যা করার আদেশ প্রদান হইতে আমর। বুঝিতে পারি, সেকালে স্বেচ্ছাচারী শাসনকর্ত্তাদের হস্তে দেশ কিরূপ নিঃসহায় ছিল। সাধারণের রাজ্যশাসন ব্যাপারে কোনই হাত ছিলনা। সুতরাং বহু অত্যাচার উৎপীড়ন সাধারণকে নীরবে সহ্য করিতে হইত। দুই এক স্থলে নিতান্ত অসহ্য হইলে একটা আশ্রয় পাইলে তাহারা ভয়ে ভয়ে রাজার বিদ্রোহাচরণ করিয়াছে।

 চন্দ্রকুমার পালাকর্ত্তা ফৈজু ফকিরের বিরূদ্ধে অভিযোগ করিয়াছেন যে তিনি হিন্দু-কন্যাকে মুসলমানের প্রণয়াকাঙ্ক্ষিণীরূপে বর্ণনা করিয়া অন্যায় করিয়াছেন। কিন্তু কবি এখানে হিন্দুবিদ্বেষের দ্বারা পরিচালিত হইয়া একথা লিখিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। জামাল খাঁ হিন্দু রাজকন্যাকে বিবাহ করিবার প্রস্তাব করায় হিন্দুরাজার যে ক্রোধের বর্ণনা আছে, তাহাতে আদৌ মুসলমানীভাবের চিহ্ন নাই, নিরপেক্ষ লেখকের মতই কবি উভয় শ্রেণীর কথাগুলি বলিয়া গিয়াছেন। অধুয়া সুন্দরীর নিকট জামাল যে প্রেমপত্র প্রেরণ করেন, তাহার ভাষাও শিষ্টতানুমোদিত ও সংযত। পালারম্ভে কবি হিন্দু মুসলমান উভয়েরই মঙ্গল কামনা করিয়াছেন; সুতরাং হিন্দুকন্যার মুসলমানের প্রতি প্রণয়-কাহিণী বর্ণনা করিয়া তিনি হিন্দুবিদ্বেষের পরিচয় দেন নাই। অনঙ্গদেবের রাজত্বে জাতি ও ধর্ম্মগত ব্যবধানের কোনও মূল্য নাই, কবির কথায় শুধু ইহাই প্রমাণিত হইয়াছে।

 এই প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় বলিতে চাই। ‘তেড়ালেঙ্গড়া’ নামটি সংস্কৃত প্রভান্বিতযুগের পূর্ব্বকার বাঙ্গালা সাহিত্যে সচরাচর দৃষ্ট হয়। ময়নামতীরগান, ধর্ম্মমঙ্গল, এমন কি কোন কোন মনসামঙ্গলেও এই নামটা পাওয়া যায়। এই নামের দ্বারা বোধ হয় এমন এক শ্রেণীর অনুচরদিগকে বুঝাইত, যাহাদের অন্তঃপুরে স্বচ্ছন্দ-গতায়াত ছিল। তেড়া (টেরা) শব্দটী সম্ভবত কুটিল দৃষ্টি, (চক্ষু রোগ বিশিষ্ট) ব্যক্তির প্রতি ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ‘লেংড়া’ অর্থ খঞ্জ। মুসলমান অন্তঃপুরে খোজা প্রহরী রক্ষিত হইবার প্রথা ছিল। হিন্দুরা হয়ত এই খোজা করার প্রথার মধ্যে যে নিষ্ঠুরতা আছে তাহা পরিহার করিয়া স্বভাবতঃ বিকলাঙ্গ লোকদিগকেই অন্তঃপুরচারী সংবাদবহ করিয়া নিয়োগ করিতেন। বর্ত্তমান পালার ‘তেড়ালেঙ্গড়া’ একজন গৃহ নির্ম্মাণকারী শিল্পী, অন্তঃপুরে ইহার অবাধ গতি ছিল। রাজ-অন্তঃপুরে যে সকল পরিচারকের অবাধ গতিবিধি ছিল, তাহারা এইভাবে বিকৃতাঙ্গ হইত, এবং পরিচারিকাদের মধ্যেও যাহারা ঘরেবাইরে আনাগোনা করিতে অধিকারী ছিল, তাহারা “কুব্জা” বা অন্য কোন রূপে বিকলাঙ্গী হইলেই তাহাদিগকে মনোনীত করা হইত।




সুরৎ জামাল ও অধুয়া

(বন্দনা)

পরথমে বন্দিনু আমি আল্লা নিরঞ্জন
তার পরে বন্দিমু আমি ওস্তাদের চরণ।
দিশা:— গুরু কও কও কও একবার শুনি—
(গুরুগো)  যখন না আছিল আসমান না আছিল জমীন—
না আছিল রবি আর শশী॥
(তখন কোথায় ছিলাম আমি! গুরু কও কও)
(গুরুগো) ধানেতে ধুয়ারা[১] গুরু সর্ষ্যার মধ্যে তেল
ডিম্বার ভিতর বাচ্চা হৈল,—প্রাণী কেমনে গেল।
(গুরু কও কও)
(গুরুগো) এ তিন সংসার মাধ্যে[২] বন্ধু কেউ নাই
সার কেবল আল্লার নাম অসার দুনিয়াই॥
হিন্দু ভাই মইরা গেলে নিব গাঙ্গের ভাটি[৩]
মুছুলমান মইরা গেলে পাইড়া[৪] দিব মাটি।
আসমান কালা জমীন্ কালা কালা দরিয়ার পানি
সকল থাক্যা অধিক কালা আখের বেইমানি[৫]
ফইজু ফকীর কহে আল্লা আমি দীন হীন
জন্ম থাক্যা কল্লা[৬] আল্লা আমার আক্ষি হীন[৭]

নাহি বন্ধু ভাই নাহি বাপ মাও
দুনিয়া আখেরে[৮] আল্লা দিয়ো দুটী পাও॥১৭

(আলাল খাঁ ও দুলাল খাঁ দেওয়ানের কথা)


দিশা:— মিছা দুন্যাই কর বন্দারে—।
বানিয়া চঙ্গ্ মুল্লুকে ছিল তাই দুই জন
এইবার তাদের কথা শুন দিয়া মন।
আলাল খাঁ দেওয়ান বড় ছুডু[৯] দুলাল ভাই
দেওয়ান গিরি করে দুইএ সভাতে জানাই॥
ধার্ম্মিক সুজন আলাল গুণে আলিছান[১০]
পরজাগণে পালন করে রুস্তম সমান।
হাতেমের সমান দাতা গুণের সীমা নাই
কত বা কইবাম কথা কইবার সাধ্য নাই॥

তার বিবি ফতেমা যে যেন হুর পরী
আন্দেসে[১১] ছুরত তার কইতে নাহি পারি।
এক দিন ফতেমা যে কুয়াবে[১২] দেখিল
পুন্নুমাসীর চান্ যেন কুলেতে[১৩] লইল॥১২
কুয়াব দেখিয়া বিবি উঠিয়া বসিল
কুয়াবের কথা যত পতিরে কহিল।
(আর ভাইরে) এই কথা শুনিয়া আলাল কহিল বিবিরে
অইবে[১৪] সুন্দর পুত্র তোমার উদরে॥১৬
(আরে ভালা) এক মাস দুই মাস তিন মাস গেল
আল্লার কুদ্রতে[১৫] দেখ রক্ত মাংস হইল।

গণকে আনিয়া রাজা গণা গণাইল।
গুণিয়া বাছিয়া গণক ছাহেবে জানাইল॥২০
তোমার কুলেতে অইব একটী নন্দন
গুণিয়া গণক কয় শুন ছাহেবন।
রূপেতে অইব পুত্র ছুরৎ জামাল
বাপের চমান[১৬] বেটা বংশের দুলাল॥২৪

এই কথা বলিয়া গণক লাগে গণিবারে
গণিয়া বাছিয়া ফির কহে ছাহেবেরে।
এক কথা ছুন ছাহেব কইতে লাগে ডর
হইবে তুমার পুত্র ছাহা হেকান্দর[১৭]২৮
যদি কুড়ি বছরের মধ্যে দেখ পুত্রের মুখ
পুত্রের কারণে তুমি পাইবা বড় ছোক।
রাজ্যের যতেক লোক যে দেখে তাহারে
তাহার কারণে তোমার পুত্র যাইব মরে॥৩২

এই কথা আলাল খাঁ দেওয়ান যখনে শুনিল
কান্দিয়া জারজার ছাহেব ভূমিতে বসিল।
গুণের ভাই দুলালে ডাক্যা কহিছে দেওয়ান
পাত্রমিত্র ডাক্যা ছাহেব সভাতে বইছান[১৮]৩৬
উজীর নাজীর আর যত কোটালিরা
ছল্লা করেন ছাহেব চভারে[১৯] লইয়া।

(আরে ভাইরে ছল্লা করিয়া ছাহেব কি কাম করিল
তেরা লেংড়া[২০] কামেলারে[২১] ডাকিয়া আনিল॥৪০

ছাহেবের ডাকে লেংড়া আসে তাড়াতাড়ি
দুই পায়ে গোদ তার কলাগাছের গুড়ি[২২]
নাতি পুতি[২৩] বার হাজার ঝিএর জামাই
এইছা মাফিক্[২৪] কামেলা দেখ তির্‌ভুবনে নাই॥৪৪

(আরে ভালা) আসিয়া কামেলাগণে ছেলাম জানাইল
বানিয়া চঙ্গ্ মুল্লুক তারা বেড়িয়া বসিল।
চৈদ্দ[২৫] মন গাঞ্জা[২৬] ভরিয়া কল্কিৎ[২৭] টান মাইল[২৮]
বানিয়া চঙ্গ মুল্লুক জুইড়া ধুওয়া বান[২৯] লাগল॥৪৮
আলাল খাঁয় কহে লেংড়া কর এক কাম
খোদার হুকুমে তুমি ছালেমত[৩০] জোয়ান।
দশমাস পূন্নু[৩১] হইতে ছয়দিন আছে
আজিকার দিন দেখ চলিয়া গিয়াছে॥৫২
রাত্রি পুষাইলে[৩২] তুমি যাও হাইলা বন
সেইখানে যাইয়া তুমি কর এক কাম।
জমীন খুদিয়া এক পুরী তৈয়ার কর
সানেতে বান্দিয়া[৩৩] দেও যেমন পাথর॥৫৬
একদিনের মধ্যে তুমি কাম করবা শেষ
বকশিষ দিয়াম[৩৪] যত চাও অবশেষ।

রজনী পুহাইলে লেংরা কি কাম করিল
নাতি পুতি লইয়া লেংরা হাইলা জঙ্গলেরে গেল॥৬০

ছয়মাসের পথ জঙ্গল হাঁটিয়া না হয় পাড়ি[৩৫]
কামেলা সহিত লেংরা চলে তাড়াতাড়ি।
বার হাজার কুদালিয়ার কাটিয়া ফালায় মাডি[৩৬]
সাণেতে বান্দিয়া লেংরা বানাইল কুডী॥৬৪
পাথর বিছাইয়া দিল সিড়ির উপরে
পুরী তৈয়ার করা লেংরা ফিরে নিজ ঘরে।
বাইশ পুরা জমিন লেংরা লাখেরাজ পাইয়া
সুখে বাস করে লেংরা নাতি পুতি লইয়া॥৬৮

এদিকে হইল কিবা শুন দিয়া মন
বিবিরে পাঠাইলা সাহেব সেই হাইলা বন।
কুড়ি বছরের খান্ খুড়াকী[৩৭] সঙ্গে তার দিয়া
এক বান্দী সঙ্গে বিবিরি রাখিল আসিয়া॥৭২

(২)

দিশা:— মিছা দুন্যাই কর বন্দারে।

উজীর নাজীর লইয়া দেওয়ান রাজত্বি যে করে
বিবিরে পাঠাইয়া দেওয়ান বনে কুন্[৩৮] কাম করে।
ঘর আন্দাইর[৩৯] বাড়ী আন্দাইর যেই দিগেতে চায়
কান্দ্যা জারজার ছাহেব শান্তি নাই সে পায়॥
একদিন আলাল খাঁ দেওয়ান কহে ভাইয়ের স্থানে
দেওয়ানকি করিতে আমার নাহি লয় আর মনে।
রাজ্য রইল পরজা রইল রইল বাড়ী ঘর
সকল ছাড়িয়া আমি যাইবাম ছফর[৪০]

এ দেওয়ান গিরী যত মোর কি কামে আসিবে
মডিলে কড়ার চিজ্[৪১] সঙ্গে না যাইবে।
আন্দাইর কবরে ভাইরে মরিব পঁচিয়া
কীরাতে[৪২] খাইবে গুস্ত[৪৩] টানিয়া টানিয়া॥১২
যত দেখ কইন্যা পুত্র[৪৪] আর বন্ধু ভাই
কামাই[৪৫] কর্‌লে খাউরা[৪৬] আছে সঙ্গে যাইবার নাই।
যে জন বানাইছে এই এ-তিন সংসার
ফকীর হইব আমি নামের তাহার[৪৭]১৬
ফকীর হইয়া আমি যাইবাম মক্কার স্থানে
হজরত আল্লার পাঁড়া[৪৮] পইড়াছে[৪৯] সেখানে।
কুড়ি বছর আমার নামে কর দেওয়ানগিরি
কুড়ি বচ্ছর বাঁচি যদি ফিরিবাম বাড়ী২০

একদিন আলালখাঁ দেওয়ান আশা[৫০] লইয়া হাতে
আল্লার নামেতে তসবী(র) বান্ধি লইল মাথে।
একলা চলিল দেওয়ান ছাইড়িয়া[৫১] বাড়ী ঘর
রাজ্যের যতেক লোক কাঁন্দিয়া জরজর[৫২]২৪

উজীর নাজীর কান্দে কান্দে যত ভাই
হস্তী ঘোড়া কান্দে যত লেখা জুখা নাই।
সকলে বলিল সাহেব আমরা সাথে যাই
গোলাম হইলাম আমরা তোমাকে জানাই॥২৮

আলাল খাঁ বলেন আমি একা চল্যা যাব
রাজ্যের কড়ার চিজ্ সঙ্গে না লইব।
এইরূপে আলাল খাঁ দেওয়ান কি কাম করিল
ফকীর হইয়া ভবে দেওয়ান মক্কায় চলিল॥৩২

এক বান্দী সঙ্গে বিবি থাকেন জঙ্গলে
তাহার বৃত্তান্ত কহি শুন সকলে ৷
দশ মাস দশ দিন পূর্ণ সে হইল।
বিষের জ্বালায়[৫৩] বিবি অচৈতন্য হইল॥
সোনার পালঙ্কে সেবা শুইয়া নিদ্রাযায়।
কপালের দোষে সেই মাটিতে ঘুমায়।
বান্দী দাসী ছিল যার লেখা জুখা নাই
হেন বিবি একা থাকে কেমনে জানি তাই॥
এক মাত্র বান্দী আছে সাথের সঙ্গিনী
খিদায় জুগায়[৫৪] খানা পিয়াসেতে পানি।
দুঃখে দুঃখে ছয়দিন গত হইয়া গেল
পূর্ণমাসীর চান্ বিবি কেলেতে পাইল॥১২

পুত্র পাইয়া বিবির মন হইল খুসী
ভুলিল রাজ্যের কথা আর বান্দী দাসী।
আজি যদি দেওয়ান সাহেব এই কথা শুনিত
আপচুষ[৫৫] মিটাইয়া কত ধন বিলাইত॥১৬

অন্ধকারে কাঞ্চা[৫৬] সোনা জ্বলিল মানিক
কি কইব দুঃখের কথা মনের হইল ধিক[৫৭]
গলার হীরার হার বিবি যতনে খুলিয়া
বান্দীর গলায় বিবি দিলাইন পরাইয়া॥২০
তুমি আমার মা বাপ তুমি যে বহিন
তোমার কুদ্রতে[৫৮] আমি তরি দরিয়া গহিন[৫৯]
এক মাস দুই মাস তিন মাস গেল
পূন্নিমার চান্দ শিশু বাড়িতে লাগিল।২৪
খদার কুদ্রতে দেখ এক বচ্ছর যায়
হামখুর[৬০] দিয়া হাঁটে শিশু কান্দ্যা ডাকে মায়।
আন্ধাইরে মানিক বাছা কলিজার সাল[৬১]
মায়েত রাখিল নাম ছুরত জামাল॥২৮

এই দিকে হইল কিবা শুন বলি সবে
দেওয়ান গিরি করে দুলাল বান্যাচন্দ মুল্লুকে।
এক দিন দুলাল খাঁ কি কাম করিল
লোকে লস্কক লইয়া সাহেব শিকারেতে গেল॥৩২
আগে পাছে চলে লোক তুফান যেমন
হইলা বনেতে যাইয়া দিলা দরিশন॥
কাঠ কাটে কাঠুরিয়া পুলাপুতি[৬২] সাথে।
সেইখানে দুলাল খাঁ দেওয়ান দেখে আস্মাতে॥৩৬
কাঠুরিয়া বালক যত পন্থে করে মেলা।
সেই পথে দুলাল খাঁ দেওয়ান করিলেক মেলা॥

পূর্ণমাসীর চান যেন ছুরত জামাল।
চিচরানী[৬৩] খেলে যত বনের রাখাল॥৪০
সুন্দর কুমার দেখে লাগিলেক তাক্[৬৪]
না জানি এ কার ছাল্যা[৬৫] কেবা মাও বাপ॥
আলাল খাঁর মুখের মত দেখিয়া আকির্ত্তি[৬৬]
মনে মনে দুলালখাঁ যে হইল চিন্তিত॥৪৪
বনেতে এমন পুত্র আর বা হবে কার।
চান্দের সমান শিশু বিবি ফতেমার॥
সাত বছরের শিশু দেখিতে সুন্দর।
এমন ছুরৎ নাই দুনিয়া ভিতর॥৪৮
আন্দেসা[৬৭] করিয়া সাহেব মনেতে ভাবিল।
সাত বছরের কালে জংলায় দেখা হইল॥
(হায় আল্লা) কুড়ি বছরের মধ্যে হইল দরশন।
গনক গনিল গনা না জানি কেমন॥৫২
কিস্‌মতে[৬৮] যা থাকে সাহেব এইমতে ভাবিয়া।
মুল্লুকে চলিয়া যাইন[৬৯] লোক লস্কর লইয়া॥৫৪

(8)

তবে ত দুলালখাঁ দেওয়ান কি কাম করিল।
উজীর নাজীর সবে ডাকিয়া আনিল।
সিতাবী ধাইয়া আইল বৃদ্ধা[৭০] যে উজীর।
আইল কারকুন মুন্সী আরাহি[৭১] নাজীর॥

(আরএ ভালা) উজীর নাজীর দেওয়ান ডাকিয়া কহিল।
জঙ্গলার যত কথা সব শুনাইল॥
যতেক শয়তান মিলি আর সল্লা[৭২] করে।
কিরূপে জামাল খাঁ শিশু[৭৩] মারিব[৭৪] তাহারে॥

তুমিত মুল্লুকের দেওয়ান কহি যে তোমায়।
এসব রাজত্বির সুখ সব তোমার দায়॥
বুড়া হইয়া তোমার ভাই বৈদেশেতে গেছে।
কি জানি এতেক কাল আছে কি মইরাছে[৭৫]১২
সুখেতে দেওয়ানি কর বাঁচ যত কাল।
কাটিয়া উজার কর দুষমনিয়া শাল[৭৬]

তবে ত কহিল দুলাল আরে পাত্র মিত্রগণ।
কেমন করিয়া শিশু মারিবাম এখন॥১৬
শুনিয়া নাজীর মুন্সী সবে যুক্তি দিল।
তেরা লেংরা আনিবারে লোক পাঠাইল॥

(আর ভাইরে) দরবারে আসিয়া লেংরা জানাইল সেলাম।
কি লাগ্যা ডাক্যাছ সাহেব আছে কোন্ কাম॥২০
দুলাল খাঁ কহিল লেংরা তুমি মোর ভাই।
তুমি না করিলে আছান্[৭৭] আর রক্ষা নাই॥
আজাব[৭৮] মুস্কিলে আমি পড়িয়াছি বড়।
সীতাবি যাইয়া তুমি এক কাম কর॥২৪

যতেক হামেলা বন সব উথারিয়া[৭৯]
সুখে বাস কর তুমি ঘর বাড়ী বান্ধিয়া।
আর বিবি ফতেমার সেথা বান্ধ্যা দিছ্‌লা[৮০] ঘর
মাটি চাপিয়া দিবে তাহার উপর॥২৮
বাহির না হইতে পারে মাটি চাপা দিয়া
কবরের মাধ্যে তারে আসিবে রাখিয়া।

এই কথা বৃদ্ধ উজীর যখনি শুনিল
ভাসিয়া চক্ষের পানি জমীনে পড়িল॥৩২
চল্লিশ পুড়া জমীনরে ভাই খাজনা খিরাজ নাই
ধাইয়া চলল লেংরা ছাথে লিয়া[৮১] ভাই।
ঘোড়ায় চাবুক মারি বৃদ্ধ সে উজীর
হামিলা বনেতে যাইয়া হইল হাজির॥৩৬

(আরে ভাইরে) বইয়া আছুইন্‌[৮২] ফাতেমা বিবি বান্দীরে লইয়া
মনের কথা কয় উজীর কান্দিয়া কান্দিয়া।
কি কর কি কর বিবি কি কর বসিয়া
সুখের দিন দিকি[৮৩] তোমার গিয়াছে ভাসিয়া॥৪০
দুষ্‌মন দুলাল খাঁ দেখ কি কামনা করে
পুত্রের সহিত তোমায় চায় মারিবারে।
দশ হাজার লোক লইয়া লেংরা আসিছে ধাইয়া
মাটি চাপা দিবে তোমায় ঘরেতে রাখিয়॥৪৪

এই কথা ফতেমা বিবি যখন শুনিল
ব্যাকুল হইয়া বিবি কান্দিতে লাগিল।

(আর ভাইরে) জংলা হইতে দেত্তয়ান খেলা যে করিয়া
আইল মায়ের কাছে ক্ষুধা যে লাগিয়া॥৪৮
আইসা দেখে কান্দে মায় মুণ্ডে দিয়া হাত
কান্দিয়া দাসীরে জামাল পুছিলেক[৮৪] বাৎ[৮৫]
ভিন্ন পুরুষ দেখি ঘরে কিসের কারণ
কি লাগ্যা কান্দে মায় কহ বিবরণ॥৫২

ব্যাকুল হইয়া বিবি পুত্র লইয়া কুলে
চুম্বন করিয়া পুত্রে বসাইল কুলে।
আহা রে প্রাণের পুত্র কি বলিব তোমারে
ফাটিয়া যাইছে বুক কলিজা বিদরে॥৫৬
রাজ্য ছাড়িয়া আমি আইলাম বনে
বরাতে আছিল দুঃখ খণ্ডাই কেমনে।
দুষ্‌মন হইয়া তোর চাচা এমন করিল
তোর বাপের বৃদ্ধ উজীর খবর আনিল॥৬০

উজীরে ছেলাম করি ছুরৎ জামাল
মায়েরে পুছিল বার্ত্তা হইয়া বোকাল[৮৬]
(আর মাগো) আপন বল্‌তে যার কেউ নাই দুনিয়া ভিতরে
কান্দিতে সৃজিলা বিধি অভাগী মায়েরে॥৬২
কেবা বাপ কেবা ভাই কোথায় বাড়ী ঘর
ফুইদ্[৮৭] করিলে মায় না দেয় উত্তর।
তুমি যদি কহ সেই পূর্ব্বু[৮৮] ছমাচার[৮৯]
উজীরের কাছে জামাল জিজ্ঞাসে আবার॥৬৮

শুনিয়া উজীর তবে কি কাম করিল
বেদ বির্ত্তান্ত[৯০] যত সকল শুনাইল।
আরও ছুনাইল[৯১] তার বাপের মক্কা যাওয়ার কথা
গণকে গণিল যাহা আজব[৯২] বারতা॥৭২
বনেতে কুঠরি বান্ধি তোমারি লাগিয়া
মন দুঃখে বাপ গেছে বৈদেশী হইয়া।
(আর ভাইরে) দুযমন হইয়া চাচা কুতল[৯৩] করিতে
লেংরারে পাঠাইয়াদিছে হামিলা বনেতে॥৭৬
জংলা ছাইড়া আজি রাইতের মধ্যেতে
জংলা ছাইড়া যাও আইজের নিশীতে[৯৪]
শুনিয়া জামাল খাঁ তবে লাগে কান্দিবারে
এদেশে দরদী নাই দুষ্কু বলি কারে॥৮০
মায়ে পুতে[৯৫] কান্দে তবে গলা যে ধরিয়া
চক্ষের পানিতে গেল জমীন ভাসিয়া।
জামাল খাঁ কহিল মাও কোন্ দেশে যাই
মা বলে আল্লা বিনে আর গতি নাই॥৮৪

বারতা পুছিল বৃদ্ধ উজীরের স্থানে
উজীর কহিয়া দিল খুঁজিয়া আনমানে[৯৬]
তোমার বাপের ছিল দুস্ত[৯৭] পশ্চিম ভাগ সরে
দুবরাজ নামেতে রাজা কহিয়া যাই তোমারে॥৮৮

আজি রাত্রির মাঝে তোমরা যাও সেই খানে
হাটিয়া যাইবে দূরে সকাল বিয়ানে[৯৮]
পরিচয় কথা কইয়া বুঝাইব আমি
সঙ্গেতে চলিলা উজীর আদাব পর্‌দানি[৯৯]৯২

(৫)

পাছে পইড়া রইল বন কাঠুরিয়া ভাই
প্রাণের ভয়ে জামাল চলে অন্য ঠাঁই।
(আর ভাইরে) পালকী তাঞ্জামে সেই বিবি চড়িয়া যায়
স্থাটিয়া চলিল বিবি দুষমনের দায়[১০০]
কিছু কিছু হাঁটে বিবি খানেক[১০১] গিয়া বইসে
সাত দিনে উথারিল[১০২] ব্রাহ্মণ রাজার দেশে।

আসমানে হইল বেলা দ্বিতীয় প্রহর
লাগ্যা দারুণ ক্ষিদা জ্বল্যা যায় অন্তর॥
উজীর যাইতে জামাল চলে আপন মনে
পর্‌বেশ করিল গিয়া রাজার ভবনে।
পরীর মুল্লুক যেন দেখিতে সুন্দর
দুবরাজ রাজার পুরী তেঁই[১০৩] মনহর॥১২
বইসা আছে বামন[১০৪] রাজা পালঙ্ক উপর
উজীর সহিতে জামাল সামনে হইল খাড়া।
দুইজনে রাজারে তবে ছেলাম জানায়
জামালকে দেখিয়া রাজা করে হায় হায়॥১৬

ফুইদ করে কার পুত্র কোন্ বা দেশে বাড়ী।
কিসের লাগ্যা আইলা এথা কহ শিঘ্রী করি॥
বির্দ্দ[১০৫] উজীর তখন কান্দ্যা কহিল।
আক্ষির মুছিয়া পানি তবে চিন্য[১০৬] দিল॥২০

(আরে ভাইরে) তোমার যে দুস্ত হয় আলাল খাঁ দেওয়ান।
তার পুত্রু জামাল খাঁ হাচা[১০৭] কহিলাম॥
বড় দুষ্কু পাইয়া মিয়া আইল তোমার কাছে।
ফতেমা বিবি দেখ সঙ্গেতে আইসাছে[১০৮]২৪
দুষমন হইয়া চাচা কোন্ কাম করে।
জঙ্গলায় পাঠাইল ফৌজ জামালে মারিবারে॥

এহাত[১০৯] হুনিয়া[১১০] রাজা কি কাম করিল।
জামালে ধরিয়া রাজা পালঙ্কে বসাইল॥২৮
বাছা বাছা চিজ্ তারে খাইবারে দিল।
আতর গোলাপ তার অঙ্গে ছিডাইল[১১১]
বার দুয়াইরা ঘর বান্ধে রাজ্যের ভিতর।
তাহাতে রহিল জামাল সঙ্গেতে উজীর॥৩২
দাসী বান্দী দিল কত লেখাজুখা নাই।
বামনদেশে[১১২] থাক্যা জামাল শুন মমীন ভাই॥
সেই দেশে থাক্যা জামাল দেখে এক চিত্তে।
এক দিন গেল জামাল দক্ষিণ দিকেতে॥৩৬
সানেতে বান্ধিয়া দিছে ঘাট চারি খান।
ঘাটে ঘাটে উড়িতেছে সোনার নিশান॥

(আরে ভালা) রাজার বাড়ীতে জামাল আছে মনের সুখে।
এক দিন মায়ের কাছে কয় মনের দুখে॥৪০

শুন শুন মা জননী বলি যে তোমারে।
ফকীর হইয়া যাইবাম আমি বান্যাচঙ্গ সহরে॥
বাপের রাজত্বি আইয়াম[১১৩] চক্ষেতে দেখিয়া।
বিদায় দেউখাইন মা জননী অরষিত[১১৪] হইয়া॥৪৪
এই কথা শুন্যা বিবি কান্দ্যাজার জার জার।
এত দুঃখ দিলা খোদা নছিবে আমার॥
(আরে পুত্রু) তোমারে লইয়া আমি ভিক্ষা মাগ্যা[১১৫] খাব।
দুষ্‌মনের দেশে তোমারে যাইতে নাহি দিব॥৪৮
কত কথা কইয়া জামাল মায়েরে বুঝায়।
পর্‌বোধ না মানে মায় কান্দে হায় হায়॥
তবে ত জামাল খাঁ দেওয়ান কি কাম করিল।
রাত্রি নিশাকালে একদিন ঘরের বাইরি[১১৬] হৈল॥৫২
সই সাবুদ[১১৭] দুস্ত কত সঙ্গেতে লইয়া।
পর্‌থমে হাইলার বনে দাখিল অইল গিয়া॥
গিয়া দেখে হাইলা বনে গাছ বিরিখ[১১৮] নাই।
বন জঙ্গলা কাট্যা[১১৯] লেংরা কইরাছে সরাই॥৫৬
জঙ্গলা কাট্যা করছে আবাদী[১২০] জমিন।
তাহাতে বসতি করে কমজাত কমিন[১২১]

যেখানে থাকিত জামাল মায়ের সহিতে।
মাটি চাপা দিছে লেংরা তার উপরেতে॥৬০
চল্লিশপুড়া জমি লেংরা নাখেরাজ পাইয়া।
হাইলা বনে থাকে লেংরা পুতি নাতি লইয়া॥

এই দেখ্যা জামাল খাঁ দেওয়ান মেলা যে করিল।
বান্ন্যাচঙ্গ মুল্লুকে গিয়া দাখিল হইল॥৬৪
উজার মুল্লুক দেখে যত প্রজাগণ।
হাহাকারে কান্দে সবে বড় দুক্ষু মন[১২২]

দুষমন্‌ দুলাল খাঁ দেখ কোন্ কাম করে।
পরজারে আনিয়া যত বে-ইজ্জত করে॥৬৮
খিরাজের লাগ্যা কার কার কাটে বা গর্দ্দান।
তাওয়াই[১২৩] হইল রাজ্যি না পায় আছান॥
শিঙ্গের পাগাড়ে[১২৪] লোকে রাখে বাছাইয়া।
মরিচের ধুমা দেয় দাঁড়িতে বান্ধিয়া॥৭২
আওরাত জননী সবে বে-ইজ্জত করে
দুষ্কু পাইয়া দেশের লোক বাড়ী ঘর ছাড়ে।৭৪

এই সব দেখিয়া জামাল কি কাম করিল
আসিয়া মায়ের আগে বার্ত্তা জানাইল।
ষোল বচ্ছর কালে জামাল কোন্ কাম করে
ফৌজ লইয়া গেল লড়াই শিখিবারে॥

ঢাল তলোয়ার আর হাতের চালান
বামন দেশেতে হইল বড়ই সুনাম।
কুড়ি না বচ্ছরের কালে কি কাম করিল
শিকারে যাইবে বল্যা মায়ের আগে গেল॥

বিদায় দেওগো মা জননী বিদায় দেউখাইন[১২৫] মোরে
হামেলা বনেতে আমি যাইবাম শিকারে।
রাজারে কহিয়া আমি লইয়াছি লস্কর
হাতি ঘোড়া লইয়াছি লোক বহুতর॥১২
পায়ে ধরি মা জননী রাখ মোর কথা
যাইব শিকারে আমি না হইব অন্যথা।
জামালের কথা শুনি বিবি কোন্ কাম করে
কান্দিয়া কান্দিয়া রাণী জামাল খাঁরে বলে॥১৬

দুষ্কিণীর[১২৬] ধন বাছা অন্ধের লৌড়ি[১২৭]
আল্লায় রাখুন বাছা এহি দুয়া[১২৮] করি।
একদিন জামাল খাঁ দেওয়ান যাত্রা যে করিল
হামিলার বনে গিয়া দরিশন দিল॥২০
লেংরার যতেক লোক করে মার মার
ফৌজ লইয়া জামাল হইল আগুসার।
ধরিয়া যতেক লোকের গর্দ্দানা কাটিল
দশহাজার নাতি পুতি পলাইয়া গেল॥২৪
লেংরারে ধরিয়া জামাল কোন্ কাম করে
হাতে গলায় বন্ধ্যা লয়[১২৯] বানিয়া চঙ্গ সহরে।

তবেত চলিল জামাল বানিয়া চঙ্গ মুল্লুকে
রাজ্যের যতেক পরজা উবু[১৩০] হইয়া দেখে॥২৮
হাতী ঘোড়া কত চলে নাই লেখা জোখা
কোন্ পালোয়ান আইল করিবারে দেখা।
ঘোড়ারে চাবুক মারে ধুলা উড়া যায়
বানিয়া চঙ্গ মুল্লুকের প্রজা চাইয়া দেখে তায়॥৩২
আইসাছে জামাল খাঁ যখন তাহারা শুনিল
ফৌজের সঙ্গেতে যত প্রজা যোগ দিল।
হাউলী করিল বন্দী যত ফৌজ লইয়া
দুষমন দুলাল খাঁ দেওয়ান গেল পলাইয়া॥৩৬
বাপের রাজত্বি দেওয়ান দখল করিল
বির্দ্দ উজীরে তবে সম্বাদ যে দিল।

(আরে ভাইরে) তাঞ্জাম পাঠাইয়া দিল মায়ের লাগিয়া
আসিলা ফতেমা বিবি দুলায়[১৩১] চড়িয়া॥৪০
কথা শুন্যা বামন রাজা খুসী হৈল মনে।
জামাল খাঁ রাজত্বি করে অতি সাবধানে॥

ফৈজু ফকীর কয় আল্লার কেরামত
দুনিয়ার কে জানে ভাই আল্লার কুদ্রত॥৪৪
বনের ফকীর দেখ জামাল আছিল
হৈয়া আপন চাচা দুষমনি করিল।
জারী[১৩২] গাও খেলুয়ার ভাইরে তালে রাখিও পাও
এই দিশা[১৩৩] ছাইড়া তোমরা অন্য দিশা গাও॥৪৮

সভা কইরা বইসা আছ যত মমীনগণ
অধুয়া সুন্দরীর কথা শুন দিয়া মন।৫০

(৭)

অধুয়া সুন্দরীর কথা।

দুবরাজ রাজার কন্যা অধুয়া সুন্দরী
তার রূপে লাজ পায় যত হুর পরী।
আসমানের দিকে কন্যা চক্ষু মেল্যা চায়
সরমে সূরুয্ গিয়া আবেতে[১৩৪] লুকায়॥
(আরে ভাইরে) বাপের দুলালী[১৩৫] কন্যা মায়ের পরাণি।
পাঁচ না ভাইয়ের সেই আদুরিয়া ভগিনী॥
সোনার পালঙ্কে কন্যা শুইয়া নিদ্রা যায়।
গোলাপী পানের বিরি[১৩৬] শুইয়া শুইয়া খায়॥
পাঁচ না ভাইয়ের বউ আবের কাঁকই[১৩৭] লইয়া।
অধুয়ার লুটন[১৩৮] খানি দেয় ত বান্ধিয়া॥

(আরে ভাইরে) আসমানের কালা মেঘ দরিয়ার কাল পানি।
যেই দেখে ভুলে সেই কন্যার চাওনি॥১২
গঙ্গাজল শাড়ী পরে অধুয়া সুন্দরী।
দেখিয়া সুন্দর রূপ হার মানে পরী॥
হাঁটিয়া যাইতে কেশ জমিনে লুটায়।
দেখিয়া কন্যার রূপ ভুলন না যায়॥১৬

যোল বৎসরের কন্যা পরথম যৈবতী।
দক্ষিণা বাগেতে নাই এমন সুন্দরী॥
একদিন অধুয়া যে ফুল তুল্‌তে যায়।
চাঁন্দের সমান জামাল খাঁরে পন্থে দেখতে পায়॥২০
জামালের রূপ কন্যা চক্ষেতে দেখিয়া।
মনে মনে চিন্তা করে পাগল হইয়া॥
(আরে ভাইরে) কিবা রূপ অপরূপ আহা মরিমরি।
না দেখি এমন রূপ তিরভূবন জুরি’॥২৪
দাঁড়াইয়া অধুয়া যে চক্ষু মেলি হেরে।
কোটিশশী জিনিরূপ ঝলমল করে॥

একদিন দুইদিন তিন দিন গেল।
ভাবিয়া চিন্তিয়া কন্যা শয্যায় শুইল॥২৮
পাঁচ ভাইয়ের বধু কয় শুন গো ননদিনী।
এমন হইল কেন কিছুই না জানি॥
কি সাপে দংশিল তোর কোমল পরাণি।
কিরূপ দেখিয়া তুই হইলি পাগলিনী॥৩২
বিয়া না হইতে বুঝি ধরিয়াছ নাগর।
একেলা বিরহে তার হইয়াছ কাতর॥
মায়ে বুঝায় বাপে বুঝায় বুঝায় পঞ্চ ভাইয়ে।
বুঝাইলে না বুঝে কন্যা সদা থাকে শুইয়ে॥৩৬
ফুফাইয়া[১৩৯] কান্দে কন্যা একাকিনী থাকিয়া।
স্বপ্নে দেখে জামাল খাঁরে মায়ের কোলে শুইয়া॥

ফজরের[১৪০] কালে কন্যা কি কাম করিল।
তুলিয়া বাগের[১৪১] ফুল মালা যে গাঁথিল॥৪০

গোপনে লিখিল পত্র অধুয়া সুন্দরী।
মুছিয়া আঁখির জল দেখিলেক পড়ি।
স্বপন দাসীরে ডাক্যা কহিল সুন্দরী।
রাখহ আমার কথা এহি ভিক্ষা করি॥৪৪
আজি দিনে যাও তুমি বানিয়াচং সহরে।
এহি ত গলার হার দিলাম তোমারে॥
এই পত্র নিয়া তুমি জামাল্ খাঁরে দিও।
আমার মনের দুঃখু তাহারে জানাইও॥৪৮

পত্র লইয়া স্বপন যে করিল গমন।
সাত রোজে উতারিল সহর বান্যা চঙ্গ॥
ঘোড়ায় চড়িয়া জামাল চৌঘরি খেলায়[১৪২]
হাঁটিয়া যাইতে স্বপন পন্থে লাগল পায়॥৫২
(আরে ভাইরে) মালা পত্র দিয়া ধাই ছেলাম করিল।
যাহার কারণে ধাই সহরে আসিল॥
শুন শুন শুন সাহেব বলি যে তোমারে।
আমি ত ভিন্‌দেশী নারী জানাই তোমারে॥৫৬
দক্ষিণ বাগ সহর মধ্যে অধুয়া সুন্দরী।
দেখিয়া তাহার রূপ লাজ পায় পরী॥
পরথম যুবতী কন্যা রূপেতে আগল[১৪৩]
দেখিয়া তোমারে সাহেব হইয়াছে পাগল।৬০

আঠার বচ্ছর রৈলে দক্ষিণ বাগ সহরে
রাজত্বি পাইয়া সুখে মনে নাই তারে।
পুরুষ বেইমান বড় জানিলাম সার
অধুয়া পাঠাইছে লিখন এই সমাচার॥৬৪

(আরে সাহেব) একদিন যাও তুমি দক্ষিণবাগ সহরে
পরাণ ভরিয়া কন্যা দেখিবে তোমারে।
দক্ষিণ বাগেতে যত বাছা বাছা ফুলে
মালা গাঁথ্যা দিল কন্যা আসিবার কালে॥৬৮
এতেক বলিয়া ধাই পত্রখানি দিল
পত্র পাইয়া সাহেব পড়বার[১৪৪] লাগিল।
সাপের বিষেতে অঙ্গ অবস হইল
মায়ে না বলিল কিছু কেহ না জানিল॥৭২
(স্বপনে বিদায় করে দেওয়ান চলিল নগরে।)৭৩

(৮)

ঘাটেতে আছিল বাঁধা রঙ্গের ভাওয়ালিয়া[১৪৫]
পরভাতে উঠিল তায় মাঝি মাল্লা লইয়া।
উজান বাতাসে ভাই ভরা পাল উঠে
তিন দিনে গেল জামাল অধুয়ার ঘাটে॥
ভাওয়ালিয়া বান্ধিয়া জামাল বসিল উপরে
সূরুয সমান রূপ ঝিল মিল করে।
প্রভাতে অধুয়া উঠ্যা[১৪৬] কিকাম করিল
দাসী বান্দী লইয়া বিবি ঘাটেতে চলিল॥১২০

পাঁচ না ভাইয়ের বউ চলিল সহিতে
বালিকা সকলে চলে হাসিতে হাসিতে।
সুগন্ধি ফুলের তৈল কেশেতে মাখিয়া
সোনার কলসী কাংকে[১৪৭] লইল উঠাইয়া॥১২

কোন সখী যায় দেখ হেলিয়া ঢলিয়া
যৌবনের ভারে ভাঙ্গে আটখান হইয়া।
লোটন[১৪৮] বান্ধিছে কেহ কার কেশ খোলা
কাহার গলায় গাঁথা চাম্পা ফুলের মালা॥১৬
আঁখিতে কাজল কারও কপালে সিন্দুর
কাঁকলে বাজিছে কারও রতন ঘুঙ্ঘুর।
কারও পিন্ধন পাটের শাড়ী কারও নীলাম্বরী
আইল জলের ঘাটে যতেক সুন্দরী॥২০

তার মধ্যে অধুয়া যে দেখিতে কেমন
তারার মধ্যেতে যেন চান্দের কিরণ।
ভাবিয়া ভাবিয়া অঙ্গ হইয়াছে মৈলান
তবু অঙ্গে জ্বলে রূপ অগ্নির সমান॥২৪
তৈল কাঁকাই বিনে চুল হইয়াছে জটা
তবু ত জিনিয়া রূপ যেন চান্দের ছটা।
জলের ঘাটেতে কন্যা দেখে দাঁড়াইয়া
ঘাটেতে আছে বান্ধা রঙ্গ ভাওয়ালিয়া॥২৮
তাহার উপরে জামাল দেখিতে কেমন
রাত্রি পোষাইলে ভানু দেখিতে যেমন॥

চাইর দিগে ফুট্যা রইছে নানান্ রঙ্গের ফুল
তাহার উপরে দেখ ভ্রমরার রুল[১৪৯]৩২
ভাওয়ালিয়া হইতে জামাল অধুয়ারে দেখে
দেখিয়া কন্যার রূপ তাক্ লাগি থাকে।
কন্যারে দেখ্যা জামাল পাগল হইল
লৈয়া খোদার নাম ভাওয়ালিয়া ছাড়িল॥৩৬

চারি চক্ষু এক হইল যাইবার কালে
ভ্রমরা উড়িয়া যায় ছাইড়া যেন ফুলে।
ছিনান করিয়া কন্যা সঙ্গে সখীগণ
মন্দিরে পর্‌বেশ কৈল কন্যা বিরস বদন॥৪০

জামাল দেখ্যা কন্যা পাগল হইল
ব্যাকুল হইয়া কন্যা কান্দিতে লাগিল।
কন্যারে লইয়া কোলে জিজ্ঞাসেন রাণী
কি কারণ কান্দ মাগো কও কও শুনি॥৪৪
পালঙ্ক ছাড়িয়া কেন শুইলে ধরায়
দেখিয়া তোমার দুষ্কু বুক ফাটিয়া যায়।
তুমিত গুণের ঝি আঞ্চলের ধন
প্রাণের অধিক মোর যত্নের রতন॥৪৮
পাঁচ না ভাইয়ের মধ্যে তুমি আদরিণী
যেন কালে[১৫০] ডাক মোরে বলিয়া জননী।
অন্তর জুড়ায় মাগো তোমার ডাকেতে
দুঃখু কেলেশ[১৫১] মাগো পালায় দূরেতে॥৫২
কি কারণে কান্দ মাগো কও একবার
খুলিয়া মনের কথা দেহ সমাচার।
জিন্ পরী কিছু নাকি দেখিছ নয়নে
রাত্র নিশাকালে কিছু দেখিছ স্বপন॥৫৬
কি দোষ কর‍্যাছি আমি বুঝিতে না পারি
অন্তরের কথা মাগো কও শীঘ্র করি।
ফৈজু ফকীর কহে দোষ তোমার নাই
পীরিতি কর‍্যাছে কন্যা পীরিত বালাই॥৬০

(৯)

বাড়ীতে আসিয়া জামাল কি কাম করিল
বৃদ্ধ উজ্জীরে তবে ডাকিয়া কহিল।
এই পত্র লিয়া[১৫২] যাও দক্ষিন বাগ সহরে
যথায় দুবরাজ রাজা বাস্তব্যি[১৫৩] করে॥
আছয়ে তাহার কন্যা অধুয়া সুন্দরী
দেখিয়া তাহার রূপ লাজ পায় পরী।
সভাতে বসিয়া তুমি পত্র খানি দিবা
কিছু কিছু সমাচার রাজারে কহিবা॥
হিন্দু মুসলমান দেখ আছে দুনিয়ায়
এক আল্লার সর্‌জন[১৫৪] জানাইয়ো সভায়।
জামাল খাঁ করিতে বিয়া পাঠাইল তারে
অধুয়া সুন্দরী কন্যা বিয়া দেও তারে॥১২

পত্র লইয়া বির্দ্দ উজীর গমন করিল
হস্তী ঘোড়া জহরত সঙ্গেতে লইল।
পাঁচ দিনে উতারিল দক্ষিন বাগ সহরে
সাতে বসিয়া উজীর কোন্ কাম করে॥১৬
আতর মাখাইয়া পত্র দিল রাজার স্থানে
কন্যার বিয়ার কথা কহে সেই ক্ষনে।১৮

(১০)

এতেক বামুন রাজা শুনিয়া জ্বলিল।
জ্বলন্ত আগুনি যেন ফুল্‌কিয়া উঠিল॥
জহ্লাদ ডাকিয়া রাজা কোন্ কামকরে।
সাত দিন রাখে রাজা অন্ধ কারাগারে॥

বুকেতে পাষাণ দিয়া করিল বন্দনা[১৫৫]
পিপড়া মান্দাইল[১৫৬] সব হইল বিছানা॥
দাড়ি উপাড়িয়া তার মারে বেড়া পাক্[১৫৭]
এক কান কাটিয়া তার করিল বিপাক॥
লোহা পুড়াইয়া তার অঙ্গে দাগ দিল।
গর্দ্দানা ধরিয়া তারে রাজ্যের বাহির কৈল॥

বান্যাচঙ্গ সহরে তবে উজীর পৌঁছিয়া।
জামাল খাঁরে বার্তা জানায় কান্দিয়া কান্দিয়া॥১২
যা ছিল কপালে মোর করিল দুষ্‌মন্।
তোমার লাগিয়া মোর হইল এমন॥
তোমার লাগিয়া মোর কাটা গেল কান।
সভাতে পাইলাম আমি দারুণ অপমান॥১৬

(১১)

বাতাস পাইয়া যেন আগুনি জ্বলিল।
সাজাইতে রণের ঘোড়া আদেশ করিল॥
আল্লাতাল্লা বলি সাজে যত সেনাগণ।
হস্তী ঘোড়া সাজায় কত করিবারে জঙ্গ্॥
তীর বর্শা হাতে লয় ঢাল তরোয়াল।
সাজিয়া চলিল রণে যেন যম কাল॥
উড়িয়া মঞ্চের[১৫৮] বালু আসমানে হইল ধুলা।
যতেক নবীর বংশ পন্থে কৈল মেলা॥

আল্লাতাল্লা বলে সবে করয়ে চীৎকার।
দেখিয়া রাজ্যের লোক লাগে চমৎকার॥
ঘোড়ার উপরে জামাল সোয়ার[১৫৯] হইল।
পাছেতে লস্কর যত কুঁদিয়া[১৬০] চলিল॥১২

(১২)

হেথায় দুলাল খাঁ তবে কোন্ কাম করিল।
ফকীর হইয়া বেটা মক্কায় চলিল।
ছয়মাস ঘুরিয়া মক্কার পন্থে পন্থে।
আলাল খাঁর দেখা পাইল সহর মধ্যেতে॥
গলায় কাপড় বান্ধ্যা উভু[১৬১] হইয়া পড়ে।
কান্দিয়া কহিছে কথা ভইয়ের গোচরে॥

শুনশুন ভাই সাহেব কহি তোমার গোচরে।
তোমার দুষমন্ পুত্র যে[১৬২] করিল মোরে॥
গর্দ্দান ধরিয়া করে রাজ্যের বাহির।
তোমার পুত্রের লাগ্যা আমি হইয়াছি ফকীর॥
রাজ্যের যতেক লোক গেছে পলাইয়া।
যুবতী জননা সবে রাইখাছে বান্ধিয়া॥১২
মান ইজ্জত নাই বান্যাচঙ্গ সহরে।
হেন পুত্র রাখ্যা তুমি আছ মক্কা সহরে।

এই কথা আলাল খাঁ যখন শুনিল।
সর্ব্বাঙ্গে আগুন যেন জ্বলিয়া উঠিল॥১৬
ভাইয়েরে যে লিয়া সাথে ফিরিলেক দেশে।
দক্ষিণবাগ সহরে যে আসিয়া পর্‌বেশে।

দুই দুস্তে কোলাকোলি হইল মিলন।
বহুৎ উমর[১৬৩] পরে এই দরশন॥২০
তবে আলাল খাঁ দোস্তেরে কহিল।
পুত্রের যতেক কথা জিজ্ঞাসা করিল॥
দুষ্‌মন হইয়া দুবরাজ কহে ঝুট্‌বাৎ।
মিথ্যা সাক্ষী দিলা রাজা হইয়া বেমাৎ[১৬৪]২৪

তবেত আলাল খাঁ দেওয়ান কোন্ কাম করে
দুবরাজের সঙ্গে যায় বান্যাচঙ্গ্ সহরে।
পর খাইয়া[১৬৫] লইল সৈন্য হাতী আর ঘোড়া
চলিল যতেক সৈন্য হাতে ঢাল কাড়া॥২৮
চলিল যতেক সৈন্য না যায় গননা
তুফান উঠিল যেমন উতাল বাহানা[১৬৬]
পাহাড় পর্ব্বত ভাইঙ্গা যেন আইসে নদীর পানি
সামনাসাম্‌নি দুই দলে দেখায় কেরদানি[১৬৭]৩২

তবে বানিয়া চঙ্গের লোক যখন শুনিল
আল্লা আল্লা বল্যা সবে কুঁদিয়া উঠিল।
শুনিয়া জামাল খাঁ দেওয়ান কোন্ কাম করিল
হাতে ছিল ঢাল তরোয়াল জমীনে রাখিল॥৩৬
হাঁটিয়া চলিল জামাল বাপের সাক্ষাতে
পিতা পুত্রে দেখা হইল সর[১৬৮] জমীনেতে।

শুক্‌না ডালেতে যেমন আগুণে ধরিল
কুমারে বান্ধিতে আলাল হুকুম করিল॥৪০

হাতে গলায় বান্ধ্যা লয় যতেক দুষমনে
চান্দেরে ধরিয়া যেমন খায় রাহুগণে
তবেত আলাল খাঁ দেওয়ান কি কাম করিল
বানিয়া চঙ্গ মুল্লুকে গিয়া উপস্থিত হইল॥৪৪
তবেত আলাল খাঁ দেওয়ান হুকুম করিল
আসিয়া জহ্লাদগণে কারাগারে নিল।
লোহার শিকল দিয়া হাতে পায়ে বান্ধে
বিপাকে পড়িয়া জামাল আল্লা বইলা কান্দে॥৪৮
পাষাণ চাপাইয়া দিল জামালের বুকে
সাত দিন থাকে জামাল এইমত দুখে
সাত দিন পরে হবে বিচার তাহার
আল্লার কুদ্রৎ শুন বলি আর বার॥৫২

(১৩)

ছয় মাসের পথ দিল্লী হঁটিয়া যাইতে
মুল্লুকের বাদশা দেখ রহেন তাহাতে।
লেখিল জরুরী পত্র কিবা সমাচার
কেউনা পড়িতে পারে এবারৎ[১৬৯] তার॥
চিঠির পিষ্ঠেতে দেখে দুই দিক্ সাদা
এরে দেখ্যা আলালের যে লাগিল ধান্ধা।
উজীর নাজীর সবে করে টানাটানি
হরফ্[১৭০] না খুঁজ্যা পায় এমন লিখনি[১৭১]
(হারে ভাইরে) এমন ছলিবার[১৭২] পত্র পাঠাইল কোন্ জনা
বুঝ্যা শুন্যা কাম না কর্‌লে যাইবে গর্দ্দা‌না।

আশ্বি শুনে পশ্বি[১৭৩] শুনে লোক লস্করে
জামাল খাঁ শুনিল ভাইরে থাক্যা কারাগারে॥১২

এই কথা শুন্যা মিঞায় কোন্ কাম করিল
লিখন দেখিতে মিঞা মনোযোগী হইল।
তার বাদে[১৭৪] শুন ভাইরে চিঠির কারণে
বাপের যে ধারে পাঠায় পহরী একজনে।
খবর পাইয়া আলাল পত্র লইয়া সাথে
পাত্র মিত্র দোস্ত গেল তাহার সঙ্গেতে।
আন্ধাইরা ঘরেতে পত্র জামালেরে দিয়া
চেরাগ্ আনিতে এক জন দেয় পাঠাইয়া॥২০

হেনকালে জামাল খাঁ গো কোন্ কাম করিল
চিঠিখানা খুল্যা তার সামনে ধরিল।
আন্ধাইর ঘরেতে আঁখর ঝিলিমিলি করে
জামাল খাঁ পড়িল পত্র বাপের গোচরে॥২৪

শুন শুন বাপজান গো শুন সমাচার
মুল্লুকের বাদশা চায় ফৌজ যে তোমার।
দশ হাজার ফৌজ দিবা আর দিবা ঘোড়া
দিলেতে জানিও কথার নাহি হয় লড়া[১৭৫]২৮
সাত রোজ মধ্যে তথা দাখিল হইবা গিয়া।
আনইলে[১৭৬] গর্দ্দান যাইবা স্ত্রী পুত্র লইয়া॥
এই কথা শুনিয়া আলাল ভাবে মনে মনে।
সাত রোজের মধ্যে আমি কেমনে যাই রণে॥৩২

বাদশার হুকুম যদি করি গো লঙ্ঘনা।
জনবাচ্চা সহিতে হায়রে যাইবে গর্দ্দানা॥৩৪

(১৪)

তোমরা কি কও উজীর দেওয়ান কি বুদ্ধি দেও মোরে।
রণের কারণে কারে পাঠাই দিল্লীর সহরে॥
(ভাইরে) হেনকালেতে ভাবে মনে দুষমন্ দুবরাজ।
জামাল না মরিলে আমার হইবে কোন্ কাজ॥
বিচারে জামালের নাই সে যাইবে পরাণি।
যেমন কইরা পারি তারে পাঠাইব রণি॥

এই কথা চিন্তিয়া দুবরাজ কয় আলালেরে।
ভাবনা কিগো দোস্ত সাহেব পাঠাও জামালেৱে॥
তোমার পুত্র জান্য রণে পরম পণ্ডিত।
জামাল যুদ্ধেতে গেলে হইব তার জিত[১৭৭]
এই কথা শুনিয়া আল্লাল কয় পুত্রের কাছে।
এই কররে জামাল যাতে স্ত্রী পুত্র বাঁচে॥১২

বাপের হুকুম জামাল ধরিয়া তবে শিরে।
ফৌজ লইয়া হইল রওনা দিল্লীর সহরে॥
আন্দর মহলে থাক্যা তবে শুনে মা জননী।
কান্দিয়া উঠিল হায় মায়ের পারাণি॥১৬
(আর ভাইরে) কান্দিয়া খবর তবে পাঠাইল জামালে।
মায়ের কাছেতে জামাল বিদায় হইতে আসে।
হায় পুত্র বল্যা বিবি পড়িলেন ঢলি॥
ধুলায় গড়াইয়া কান্দে পুত্র পুত্র বলি॥২০

আহা রে পরাণের পুত্র যাইবা কোন্ ঠায়ে।
কি কথা কইয়া যাও অভাগিনী মায়ে।
(আরে পুত্র) আঁখির না তারা তুই পরাণ-পুতলী॥
কেমন কর‍্যা যাইবা পুত্র বুক কর‍্যা খালি॥২৪
আর কি দেখিবাম চক্ষে তোমার চান্ বদন!
আর না শুনিবাম তোর মধুর বচন।
আর না ডাকিবা পুত্র মাও যে বলিয়া ৷
আর না লইবাম তোরে কোলেতে টানিয়া॥২৮
মায় সে জানে মায়ের বেদন আর জানিবে কে।
প্রাণের পুত্র ছাড়া মায়ের আর বা আছে কে॥
কার বা ফলন্ত গাছ ফালিলাম কাটি।
কিসের কারণে হইলাম আমি পুত্র-শোগী[১৭৮]৩২
কারবা ঘরের ধন করিয়াছিলাম চুরি।
কি পাপে হারাই পুত্র বুঝিতে না পারি॥
তুই বিনে মোর আর নাহি অন্য জন।
ঘুম থাক্যা উঠ্যা দেখ্‌বাম কার চান বদন॥৩৬
অঞ্চলের নিধি পুত্র অন্ধের লড়ী।
আইজ হইতে গিরবাস[১৭৯] কারে লইয়া করি॥

এইরূপে কান্দে বিবি আক্ষেপ করিয়া।
তার পর কিবা হইল শুন মন দিয়া॥৪০
মায়ের চরণে জামাল ছেলাম জানাল।
কান্দিয়া মায়ের আগে কহিতে লাগিল॥
শুন শুন মা জননী বিদায় দেও গো মোরে।
জঙ্গেতে যাইবাম আমি বলি যে তোমারে॥৪৪
দুয়া[১৮০] যে করিয়ো মোরে যেন ফিরি।
রণ জিতিয়া আস্যা তোমায় সেলাম করি॥

(আরে ভাইরে) মায়ের পায়ের ধুলা আর চক্ষের পানি।
অঞ্চল না দিয়া মুখ মুছায় মা জননী॥৪৮
রণেতে চলিল জামাল বিদায় হইয়া।
অধুয়া সুন্দরীর কথা শুন মন দিয়া॥৫০

(১৫)

চট্টানে[১৮১] আসিয়া জামাল কি কাম করিল
সঙ্গের যত ফৌজ জামাল জিরাইতে[১৮২] বলিল।
পত্র লিখিল জামাল অধুয়ার কাছে
জামালের কথা কন্যার মনে আছে॥

শুন শুন অধুয়া গো বলি যে তোমারে
জঙ্গেতে[১৮৩] চলিলাম আমি দিল্লীর ছহরে।
নিচিন্ত হইয়া তুমি আছ যে ছুইয়া[১৮৪]
জন্মের মত যাই আমি বিদায় হইয়া॥
আজি হইতে তোমার বুক হইল যে খালি
একদিন না লইলাম তোমায় কোলের মধ্যে তুলি।
নিজের হাতে পানের খিলি তুল্যা নাহি দিবা
দেওয়ানা ফকীরে আর চক্ষে না দেখিবা॥২০
হায় হায় অধুয়া গো ফাট্যা যায় যে বুক
আর না দেখিবাম আমি তোমার চান্দ মুখ।
আর না হইব দেখা কর্ম্মের লিখন
আর না হইব দেখা থাকিতে জীবন॥১৬
বড় আশা ছিল মনে তোমাকে লইয়া
সুখেতে করিব বাস মুন্‌ছ[১৮৫] বান্ধিয়া
যাইবার কালে দেখা না হইল যে আর
আর না হইব দেখা সঙ্গেতে তোমার॥২০

তবে যুদি ফিরা আসি আল্লার ফজলে
তবে ত কোলের ধন লইবাম কোলে।

পত্র না লিখিয়া জামাল মুছে আক্ষির পানি
সাপের জরেতে[১৮৬] যেন ছটকিল[১৮৭] প্রানি॥২৪
হাতের আঙ্গুরী আর পত্রখানি দিয়া
অধুয়ার কাছে জন দিল যে পাঠাইয়া॥

পরে ত চলিল জামাল ফৌজ সাথে
বাহিরিয়া অযাত্রা তবে দেখে পথে পথে॥২৮
যাত্রাকালে হাঁচি তার বামেতে পড়িল
আক্ষির উপরে মাছি উড়িয়া যে বসিল।
চলিতে রণের ঘোড়া উষ্ঠা[১৮৮] খাইল পায়
কাঠুরিয়াগণ দেখে কাঠ লইয়া যায়॥৩২
রহ রহ তিন ডাক পিছনে শুনিল
সামনেতে মরা এক চক্ষেতে দেখিল।
পুরে সে কান্দন শুনে লাগে খেজালত
অযাত্রা দেখিয়া জামাল চলিলেক পথ॥৩৬
চিন্তাযুক্ত হইয়া জামাল ভাবে মনে মনে
কান্দিয়া আরদশ[১৮৯] করে খোদাতাল্লার স্থানে।৩৮

(১৬)

এক মাস দুই মাস তিন মাস গেল
মুল্লুকের বাদশা রে তবে সংবাদ পাঠাইল।
আরজ খুলিয়া তবে আলাল খাঁ দেখিল
পুত্রের মরণ কথা পত্রে লেখা ছিল॥
কাত্যানির বানে[১৯০] যেমন কলা গাছ পড়ে
বিছাইয়া পড়িল দেওয়ান জমীন উপরে।

হায় হায় বলিয়া কান্দে উজীর নাজীরগণ
বহুৎ ক্ষণেতে দেওয়ান পাইল চেতন॥
বানিয়াচঙ্গ্ মুল্লুকে উঠে কান্দনের ধ্বনি
লোক লস্কর কান্দে যত আকুল কাত্রাণি[১৯১]

গজ কান্দে অশ্ব কান্দে কান্দয়ে গোধন
বন জংলায় কান্দে যত পশু পংখীগণ॥১২
মালিয়া[১৯২] মালিনী কান্দে মুখে বলে বুল
ভাবে মনে কার গলে গাঁথ্যা দিবে ফুল।
হাহাকার কর‍্যা পর্‌জা কান্দে ঘরে ঘরে
হাহাকার শব্দ হইল বানিয়াচঙ্গ সহরে॥১৬
ফৈজু ফকীর কহে না কর ক্রন্দন
আল্লার নামেতে সবে শান্ত কর মন।

হাউলীর মধ্যেতে যখন খবর পৌছিল
শুনিয়া ফতেমা বিবি অজ্ঞান হইল॥২০
কাছে ছিল দাসী বান্দী মুখে দেয় পানি
তিন দিন পরে বিবি ত্যজিল পরাণি॥
দারুণ পুত্রের শোক না যায় ভুলন
বিবির মৃত্যুতে আলাল করিছে ক্রন্দন॥২৪

হেন কালে বৃদ্ধ উজীর আসিয়া বলে
তোমার দোষেতে তুমি সকল খুয়াইলে[১৯৩]
(আর ভাইরে) কান্দিয়া কান্দিয়া উজীর কহিতে লাগিল
পূর্ব্বা‌পর ছমাচার যত কিছু ছিল॥২৮
মক্কায় চলিলে ভাই হইল দুষমন
দুলাল খাঁ করিল যত শুন বিবরণ।

লেংরারে পাঠাইল দেখ হামিলা বনেতে
দশ হাজার লস্কর দিয়া জামালে মারিতে॥৩২
আল্লার কুদ্রতে জামাল পরাণে বাঁচিল
পন্থের ফকীর যেমন কান্দিয়া চলিল।
দুবরাজার দেশে জামাল রহে বহুৎ দিন
হাইলা বনে না পাইল জামালের চিন্[১৯৪]৩৬

আঠার বচ্ছর থাকে দুবরাজের দেশে
করিয়া বহুৎ জঙ্গ রাজ্য পায় শেষে।
দুবরাজার কন্যা এক অধুয়া সুন্দরী
দেখিতে তাহার রূপ যেন হুর পরী॥৪০
জামালে দেখিয়া কন্যা অজ্ঞান হইল
আপনি যাচিয়া কন্যা পত্র যে লিখিল॥

লইয়া সঙ্গীর কথা গেলাম রাজার স্থানে
আমার কথা শুন্যা রাজা বলে কোটাল গণে॥৪৪
দুষমন হইয়া রাজা করে অপমান
সেইত দোষেতে[১৯৫] মোর কাট্যা দিল কান।
সেহিত করণে রাজা গোস্বা যে হইয়া
জামালে পাঠায় রণে সল্লা যে করিয়া॥৪৮

এই কথা আলাল খাঁ দেওয়ান যখন শুনিল
পুত্র শোকের আগুন জ্বলিয়া উঠিল।
হুকুম করিলে দেওয়ান লোক জনে ডাকিয়া
রাত্রি মধ্যে দুবরাজেরে আনিবে বান্ধিয়া॥৫২
দক্ষিন বাগ সহর জুর‍্যা আগুন লাগাও
গর্দ্দান কাটিয়া সবে সায়রে ভাসাও।

সেহি দেশের গাছ বিরিখ্ নাহি থাকে মাটি
লাউরের[১৯৬] নদী বহাইয়া দেও লোক জন কাটি॥৫৬
একেত জঙ্গের ফৌজ হুকুম পাইল
জঙ্গলা পুড়াইতে যেন আগুন জ্বলিল।৫৮

(১৭)

জামালের পত্র পাইয়া কন্য। কোন্ কাম করে
শীঘ্র করি চলে কন্যা চণ্ডীর মন্দিরে।
ভিজা চুল দিয়া কন্যা মন্দির মুছিল
পূজার সামগ্রী যত দাসীরা আসিল॥
আতপ তণ্ডুল আর ঘির্ত্ত[১৯৭] কেলা[১৯৮] চিনি
চন্দন সিন্দুর যত সবে দিল আনি।
গলায় কাপড় বান্ধি অধুয়া সুন্দরী
চণ্ডীরে করয়ে পূজা যতন যে করি॥

এন[১৯৯] কালে ফৌজ আসি দক্ষিন বাগেতে
অধুয়ারে বান্ধ্যা লয় বাপের সহিতে।
রজনী পোহাইলে যায় বান্যাচঙ্গ সহরে
পন্থেতে অধুয়া দেখ কোন্ কাম করে॥১২
বান্যাচঙ্গ সহরে শুন্যা প্রজার কান্দন
মনে মনে করে করে কন্যা পতির চিন্তন।
জামালের মৃত্যু কন্যা যখন শুনিল
কেশে বান্ধা বিষের কটুয়া[২০০] খুলিয়া লইল॥১৬

পাল্কীর দুয়ার দেখ খুলি লোক জনে
অধুয়ারে বাইরি[২০১] কৈল দেওয়ানের হুকুমে।

তবে আলাল খাঁ দেওয়ান লোক জনে কয়
আমার ঘোড়ার সহিশ কেরামুল্লা হয়॥২০
অধুয়ারে বিয়া দিয়াম তাহার সহিতে
আমার মনের দুঃখ খাণ্ডবে তাহাতে।
কেশে ধর‍্যা অধুয়ারে বাহির করিল
বিষেতে অবশ অঙ্গ সকলে দেখিল॥২৪

দীঘল, চাচল[২০২] কেশ পড়িছে জমীনে
পূন্নিমার চান্দ যেন ছাড়িয়া আসমানে।
দেখিয়া কন্যার মুখ ফাট্যা যায় বুক
অন্তরে জ্বলিয়া উঠে মরা পুত্র শোক॥২৮
জামাল খাঁর পত্র দেখে কেশে বান্ধা ছিল
এহি পত্র আলাল খাঁ দেওয়ান দেখিতে পাইল।
কন্যার আঙ্গুলে দেখে হীরার আঙ্গুরী
দেখিয়া আলালে কান্দে হাহাকার করি॥৩২

এহিত আঙ্গুরী দেখ জামালের ছিল
সেইত অঙ্গুরী কন্যা কেমনে পাইল।
তবে ত দুবরাজ আস্যা দোস্তেরে জানায়
পূর্ব্বা‌পর সকল কথা কহে সমুদায়॥৩৬

দুই দোস্তে গলাগলি জুড়িল ক্রন্দন
অন্তরে জ্বলিল যেন জ্বলন্ত আগুন।
পুত্র কন্যার শোকে দুইই পাগল হইল
দুলালে ডাকিয়া আলাল কহিতে লাগিল॥৪০

সুখেতে বসিয়া ভাই দেওয়াণ গিরি কর
আবার যাইব আমি হইয়া ফকীর।

আর না আসিব আমি বান্যাচঙ্গ সহরে
পুত্র শোকের আগুন দহিল আমারে॥৪৪
উজীর নাজীর কাছে বিদায় হইয়া
মক্কায় চলিল দেওয়ান ফকীর সাজিয়া।

পাত্র মিত্র কান্দে যত জমীনে পড়িয়া
মুল্লুকের লোকে কান্দে দেওয়ানে ঘিরিয়া॥৪৮
বনে কান্দে পশু পক্ষী জলে ক্যন্দে মাছ
পাগল হইয়া কান্দে যত আর্‌দাছ[২০৩]
বান্দী গোলাম কান্দে মাথা থাপাইয়া[২০৪]
হাতী ঘোড়া না খায় ঘাস তার পানে চাইয়া॥৫২
বান্যাচঙ্গ মুল্লুক জুর‍্যা কান্দে সর্ব্বলোক
শিরে হাত দিয়া কান্দে সবে হেঁট মুখ।

বামুন আছিল দুবরাজ কি কাম করিল
মুছলমান হইয়া দুবরাজ মক্কায় চলিল॥৫৬
উজীর নাজীর সবে কান্দ্যা জার জার
মক্কায় চলিল দেওয়ান হইয়া ফকীর।
মুল্লুকের দেওয়ান দেখ ফকীর হইয়া যায়
কান্দিয়া সকল লোক করে হায় হায়॥৬০
ফৈজু ফকীর কহে কান্দলে হবে কি
যার তার নছিবের লেখা লেখছুইন্‌ আল্লাজী।
আল্লা আল্লা বল ভাই পালা হইল সায়[২০৫]
সার কেবল আল্লাজীর নামটী অসার দুনিয়ায়॥৬৬

(সমাপ্ত)


  1. ধুয়ারা=চাউল।
  2. মাধ্যে=মধ্যে।
  3. ভাটি=তীর।
  4. পাইড়া=পাতাইয়া।
  5. আখের বেইমানি=শেষে যে অকৃতজ্ঞতা দেখায়।
  6. কল্লা=করিলেন।
  7. আক্ষি হীন=অন্ধ।
  8. দুনিয়া আখেরে=জীবনান্তে।
  9. ছুডু=ছোট।
  10. আলিছান=মহান্
  11. আন্দেসে=আন্দাজে, অনুমানে
  12. কুয়াব-স্বপ্ন।
  13. কুল=কোল।
  14. অইবে-হইবে।
  15. কুদ্রতে=কৃপাতে।
  16. চমান=সমান। (ছাহেব, ছমান, ছোক, ছুন, ছাহা, ছেকান্দর, ছল্লা ইত্যাদির ‘ছ’ স্থানে স, শ, ষ প্রয়োগ দ্রষ্টব্য)।
  17. হেকান্দর=সেকেন্দর।
  18. বইছান=বসান্।
  19. ছভা=সভা।
  20. তেড়া লেংড়া=ট্যারা ও ল্যাংড়া।
  21. কামেলা=মজুর।
  22. গুড়ি=গোড়া।
  23. নাতিপুতি=পৌত্র প্রপৌত্র।
  24. এইছামাফিক্=এই প্রকারের।
  25. চৈদ্দ=চৌদ্দ
  26. গাঞ্জা=গাঁজা।
  27. কল্কিৎ=কল্কেতে।
  28. মাইল=মারিল।
  29. ধুওয়া বান=ধূমের বন্যা।
  30. ছালেমত=প্রবীণ; শক্তিশালী।
  31. পূন্নু=পূর্ণ।
  32. পুষাইলে=পোহাইলে।
  33. বান্দিয়া=বাঁধিয়া।
  34. দিয়াম=দিব।
  35. পাড়ি=অতিক্রম করা।
  36. মাডি=মাটি, কুডী=কুঠী।
  37. খান্ খোড়াকী=খানা খাদ্য; খোরাক পোষাক।
  38. কুন্=কোন্।
  39. আন্দাইর (আন্ধাইর)=আঁধার।
  40. ছফর=শফর, ভ্রমণ।
  41. কড়ার চিজ্=কড়া প্রমাণ মূল্য যে জিনিসের অর্থাৎ অতি অকিঞ্চিৎকর পদার্থ।
  42. কীরা=কীট।
  43. গুস্ত=মাংস।
  44. কইন্যা পুত্রু=কন্যাপুত্র।
  45. কামাই=রোজকার, উপায়।
  46. খাউরা=খাদক; পোষ্য।
  47. “ফকীর.. তাহার”=যিনি এই ত্রিভূবন সৃষ্টি করিয়াছেন আমি তাঁহারই নামের কাঙ্গাল হইব।
  48. পাঁড়া=পদচিহ্ন।
  49. পইড়াছে=পরিয়াছে; পতিত হইয়াছে।
  50. আশা=দণ্ড, যষ্ঠি।
  51. ছাইড়িয়া=ছাড়িয়া।
  52. জরঞ্জর=জর্জ্জর; অবসন্ন।
  53. বিষের জ্বালায়=প্রসব বেদনায়।
  54. জুগায়=জোগাড় করিয়া দেয়
  55. আপচুষ=আপশোষ্, ক্ষোভ।
  56. কাঞ্চা=কাঁচা।
  57. ‘মনের হইল ধিক্’=মনে ধিক্কার জন্মিল।
  58. কুদ্রতে=কৃপাতে।
  59. গহিন=গভীর।
  60. হামখুর=হামাগুড়ি।
  61. শাল=শলকা।
  62. পুলাগুতি=ছেলেপিলে
  63. চিচরানী=হাডুডুডু; কপাটি খেলা।
  64. লাগিলেক তাক্=আশ্চর্যান্বিত হইল।
  65. ছাল্যা=ছেলে।
  66. আকির্ত্তি=আকৃতি।
  67. আন্দেসা=আন্দাজ।
  68. কিসমত=ভাগ্য।
  69. যাইন=যান।
  70. বৃদ্ধা=বৃদ্ধ।
  71. আরাহি=
  72. সল্লা=ষড়যন্ত্র।
  73. শিশু=শিশু পুত্রকে।
  74. মারিব=মারিবে।
  75. মইরাছে=মরিয়াছে।
  76. দুষমানিয়া শাল=দুষমনিয়া (শত্রু), শাল=শল্য।
  77. আছান=উদ্ধার (আসান্ হইতে)।
  78. আজাব=ঘোরতর; ভয়ঙ্কর।
  79. উথারিয়া=উন্মূলিত করিয়া।
  80. বান্ধ্যা দিছ্‌লা=বাঁধিয়া দিয়াছিলা।
  81. ছাথে লিয়া=সঙ্গে লইয়া।
  82. বইয়া আছুইন=বসিয়া আছেন।
  83. দিকি=দেখি।
  84. পুছিলেক=জিজ্ঞাসা করিল।
  85. বাৎ=কথা।
  86. বোকাল=ব্যাকুল।
  87. ফুইদ্=জিজ্ঞাসা।
  88. পূর্ব্ব=পূর্ব্ব; আগেকার।
  89. ছমাচার=সমাচার।
  90. বেদ বির্ত্তান্ত=আদ্যন্ত সমস্ত কথা।
  91. ছুনাইল=শুনাইল।
  92. আজব=আশ্চর্য্য।
  93. কুতল=খুন।
  94. লাইন ৭৭-৭৮, জংলা·····নিশীতে। রাত্রি থাকিতে থাকিতে এই বন ত্যাগ করিয়া যাও। নিশীতে=নিশীথে।
  95. পুতে=পুত্রে।
  96. আনমানে=অনুমানে।
  97. দুস্ত=বন্ধু।
  98. সকাল বিয়ানে=অতি ভোরে।
  99. আদাব পর্‌দানি=আদাব (সেলাম) পর্‌দানি (প্রদান করিয়া); নমস্কার করিয়া।
  100. দায়=দরুণ।
  101. খানেক=খানিক।
  102. উথারিল=উত্তরিল; উপস্থিত হইল।
  103. তেঁই=সেই জন্যই।
  104. বামন=ব্রাহ্মণ
  105. বির্দ্দ=বৃদ্ধ।
  106. চিন্য=পরিচয়।
  107. হাচা=সাচ্চা সত্য।
  108. আইসাছে=আসিয়াছে।
  109. এহাত=ইহা।
  110. হুনিয়া=শুনিয়া।
  111. ছিডাইল=ছিটাইল।
  112. বামন দেশে=ব্রাহ্মণের দেশে।
  113. আইয়াম=আসিব।
  114. অরষিত=হরষিত।
  115. মাগ্যা=মাগিয়া।
  116. বাইরি=বাহির।
  117. সই সাবুদ=সঙ্গী সাথী
  118. বিরিখ্=বৃক্ষ।
  119. কাট্যা=কাটিয়া।
  120. আবাদী=চাষ করার যোগ্য, ফসল জন্মাইবার উপযুক্ত।
  121. কমজাতকমিন=নীচবংশজাত দুষ্ট প্রকৃতির লোক।
  122. মন—(মনে) কর্ত্তায় অধিকরণ।
  123. তাওয়াই=ধ্বংস; বিনাশ।
  124. শিঙ্গের গাগাড়ে=যে রূপে শিং মাছ রাখা হয়। পূর্ব্বকালে অত্যাচারী ভূম্যধিকারীরা অপরাধী প্রজাগণকে ধরাইয়া আনিয়া শিংমাছের কূপে ছাড়িয়া দিত এবং মনস্কামনা সিদ্ধ না হওয়া পর্য্যন্ত এইরূপ নিষ্ঠুর ভাবে তাহাদিগের উপর অত্যাচার করা হইত। পোড়া লঙ্কার ভাণ্ড দাঁড়িতে বান্ধিয়া, তাহার যন্ত্রণাদায়ক তীব্র গন্ধে হতভাগ্যদিগকে জর্জ্জরিত করার রীতিও জমিদারগণের একটা প্রাচীন দণ্ডবিধি।
  125. দেউখাইন=দিন্।
  126. দুষ্কিনীর=দুঃখিনীর।
  127. লৌড়ি=নড়ি, যষ্ঠি।
  128. দুয়া, দোওয়া=প্রার্থনা।
  129. লয়=লইয়া যায়।
  130. উবু=মুখ বাড়াইয়া উঁচু হইয়া।
  131. দুলা=দোলা) পাল্কী।
  132. জারী=মুসলমানদের গান বিশেষ।
  133. দিশা=গায়কেরা একত্র হইয়া যে গান করে (কোরাস্) তাহাকে ‘দিশা’ বলিত।
  134. আব্=(অভ্র), আভ্
  135. দুলালী=আদরিণী।
  136. গোলাপী পানের বিরি=গোলাপ-গন্ধ-বাসিত পানের খিলি।
  137. কাঁরুই=চিরুণি।
  138. লুটন (লোটন)=খোঁপা-বিশেষ
  139. ফুফাইয়া=ফোঁপাইয়া।
  140. ফজর=প্রভাত।
  141. বাগের=বাগানের।
  142. চৌঘরি খেলায়=ঘোড়া লইয়া একরূপ খেলা।
  143. আগল=অগ্রগণ্য।
  144. পড়বার=পড়িতে।
  145. রঙ্গের ভাওয়ালিয়া=রঙ্গের (রঙ্গীন্); ভাওয়ালিয়া (এক প্রকার পান্‌সী বিশেষ)।
  146. উঠ্যা=উঠিয়া।
  147. কাংকে=কাঁধে।
  148. লোটন=খোপা বিশেষ।
  149. রুল=রোল, ঝঙ্কার, কলরব। ময়মনসিংহ, শ্রীহট্ট ও ত্রিপুরা প্রভৃতি অঞ্চলে অনেক স্থলে ‘ও’কারের উচ্চারণ ‘উ’কারের মত।
  150. কালে=ভবিষ্যতে; চিরদিন।
  151. কেলেশ=ক্লেশ।
  152. লিয়া=লইয়া, নিয়া।
  153. বাস্তব্যি=বসতি।
  154. সর্‌জন্=সৃষ্টি।
  155. বন্দনা=বন্ধন।
  156. মান্দাইল—এক জাতীয় পীপিলিকা, ইহার কামড় অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক।
  157. বেড়া পাকে=দ্রুত ভাবে চতুর্দ্দিকে ঘুর্ণণ।
  158. মঞ্চের=পৃথিবীর।
  159. সোয়ার=আরোহী।
  160. কুদিয়া=ক্রোধবশতঃ তর্জ্জণ গর্জ্জণ করিয়া।
  161. উভু=উপুর।
  162. যে=যাহা।
  163. উমর=বৎসর।
  164. বেমাৎ=ঈর্ষাপরায়ণ।
  165. পরখাইয়া=পরখিয়া; পরীক্ষা করিয়া, বাছাই করিয়া।
  166. বাহানা=ঢেউ।
  167. কেরদানি=কৌশল।
  168. সর=খোলা।
  169. এবারৎ=তত্ত্ব; খবর।
  170. হরফ্=অক্ষর
  171. লিখনি=লিখন-প্রণালী।
  172. ছলিবার=ছলযুক্ত, কৌশলপূর্ণ।
  173. আশ্বি পশ্বি=পাড়া প্রতিবেশী।
  174. বাদে=পরে
  175. লড়া=নড় চর; অন্যথা।
  176. আনইলে=তাহা না হইলে।
  177. জিত=জয়।
  178. পুত্র শোগী=পুত্র-শোকী।
  179. গিরবাস=গৃহবাস।
  180. হুয়া (দোয়া)=আশীর্ব্বাদ।
  181. চট্টানে=খোলা ময়দানে।
  182. জিরাইতে=বিশ্রাম করিতে।
  183. জঙ্গে=যুদ্ধে।
  184. ছুইয়া=শুইয়া।
  185. মুন্‌ছ=মঞ্চ।
  186. জর=বিষ।
  187. ছটকিল=আচ্ছন্ন হইল।
  188. উষ্ঠা=হুচোট।
  189. আরদশ=প্রার্থনা।
  190. কাত্যানির বানে=কার্তিকের ঝড় তুফানে।
  191. কাত্রানি=মর্মান্তিক কষ্ট সূচক শব্দ।
  192. মালিয়া=মালা গাঁথা যাহার ব্যবসায়, মালী।
  193. খুবাইল=বিনষ্ট করিল।
  194. চিন্=চিহ্ন।
  195. সেইত দোষেতে—অধুয়ার সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাবের দরুণ।
  196. লাউড়=শ্রীহট্টের একটি প্রসিদ্ধ নগর।
  197. ঘির্ত্ত=ঘৃতের অপভ্রংশ।
  198. কেলা=কলা। (পূর্ব্ব বঙ্গের মুসলমানগণ, শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্ব্বিশেষে, সকলেই কলাকে কথ্য ভাষায় ‘কেলা’ বলিয়া থাকে)।
  199. এন=হেন
  200. কটুয়া=কৌটা।
  201. বাইরি=বাহির
  202. চাচল=চাঁচর।
  203. আর্‌দাছ=?
  204. থাপাইয়া=চাপড়াইয়া।
  205. সায়=শেষ।