পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/দেওয়ান ইশা খাঁ মসনদালি

ইশা খাঁ। (৩৪৭—৩৯০)

 দেওয়ান ইশাখাঁ মসনদ আলি সম্বন্ধে তথ্যসংগ্রহের জন্য সর্ব্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় গ্রন্থ—আবুলফজলকৃত আইন-ই-আকবরী। আবুল ফজল লিখিয়াছেন, ইশাখাঁর পিতা বঙ্গদেশের সেলিমখাঁ ও তাজখাঁ কর্ত্তৃক নিহত হন, এবং তাঁহার পুত্রদ্বয় অর্থাৎ ইশমাইল এবং ইশা বাল্যাবস্থায় ক্রীতদাসরূপে বিক্রীত হইয়াছিলেন; কিন্তু পরে ইশার পিতৃব্য কুতুবুদ্দিন তুরাণ অঞ্চল হইতে তাহাদিগকে উদ্ধার করিয়া বঙ্গদেশে আনয়ন করেন। অতঃপর ইশা ভাটি-অঞ্চলের শাসন-কর্ত্তৃত্ব এবং দ্বাদশ ভূম্যধিকারীর অধিনায়কত্ব লাভ করেন। এইজন্য আবুল ফজল তাঁহাকে “মজবন্ ভাটি” আখ্যায় আখ্যাত করিয়াছেন। ইশাখাঁ নানাভাবে মোগল সম্রাটকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিলেন। (আইন ই-আকবরী, ১ম খণ্ড, ৩৪২ পৃঃ)।

 ঢাকার ভূতপূর্ব্ব সিভিল সার্জ্জন, ডাক্তার ওয়াইজ ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের এসিয়াটিক সোসাইটি পত্রিকায় ইশা খাঁ সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন। এই মুসলমান যুবক কিরূপে বর্ত্তমান কিশোরগঞ্জ মহকুমার অধীন জঙ্গলবাড়ীতে প্রথম আবাস স্থাপন করিয়া প্রসিদ্ধ দেওয়ান বংশের প্রতিষ্ঠা সাধন করেন, তাহা উক্ত প্রবন্ধে বিশদভাবে আলোচিত হইয়াছে (২০৯—২১৪ পৃঃ)। উক্ত সনের এসিয়াটিক সোসাইটির জর্ণ্যালে (৩নং পত্রিকার ২০২—২০৩ পৃষ্ঠায়) ওয়াইজ সাহেব বিক্রমপুরের চাঁদরায় ও কেদার রায় সম্বন্ধীয় একটি প্রবন্ধেও ইশাখাঁর সম্বন্ধে কিছু কিছু সংবাদ দিয়াছেন। ১৯০৯ খ্রীষ্টাদের এসিয়াটিক সোসাইটি পত্রিকায় ৩৬৭—৭৫ পৃষ্ঠায় ষ্টেপলটন সাহেব “সপ্তদশ শতাব্দীর সাতটি কামান সম্বন্ধে সমালোচনা” শীর্ষক ইংরেজী প্রবন্ধে দেওয়ানবংশ ও তাঁহাদের পূর্ব্বপরিচয় সম্বন্ধে কতিপয় ঐতিহাসিক প্রশ্নের বিচার করিয়াছেন।

 ঢাকা হইতে ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দে দেওয়ান শোভন দাদখাঁ ও দেওয়ান আজিম দাদখাঁর নিয়োগে লিখিত, “মসনদ আলি ইতিহাসে” গ্রন্থকার মুন্‌সী রাজচন্দ্র ঘোষ ও পণ্ডিত কালীকুমার চক্রবর্ত্তী মহাশয়দ্বয় কালিদাস গজদানীকে ইশাখাঁর পিতা বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া এই গজদানী হইতেই দেওয়ান বংশের ইতিহাসের সূচনা নির্দ্দেশ করিয়াছেন। উক্ত পণ্ডিতদ্বয়ের জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ান পরিবারের রক্ষিত রাজ্যশাসন সংক্রান্ত পুরাতন কাগজপত্র দেখিবার সুযোগ হইয়াছিল; সেই সকল উপকরণের সহিত ইউরোপীয় এবং দেশীয় ঐতিহাসিকদিগের গবেষণামূলক বিবরণ তুলনা করিয়া গ্রন্থকারদ্বয় দেওয়ান পরিবারের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস সঙ্কলন করিয়াছেন।

 ইশাখাঁ এবং তাঁহার বংশধরদিগের কীর্ত্তিকাহিনী অবলম্বনে বিরচিত মোট চারিটি পালাগান আমরা পাইয়াছি। কোনও অজ্ঞাতনামা কবি কর্ত্তৃক সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত একটি পালা সর্ব্বপ্রথমে সংগৃহীত হয়। কিঞ্চিদধিক একশত বৎসর পূর্ব্বে কিশোরগঞ্জ মহকুমার গলাচিপা গ্রামের মুনসী আবদুল করিম রচিত পালাটি আমাদের দ্বিতীয় সংগ্রহ। এই পালাটি অনেকটা কল্পনামূলক বলিয়া মনে হয়। তৃতীয় পালাটি মুখ্যতঃ ইশাখাঁর পৌত্র মনুয়ার খাঁর জীবনী অবলম্বনে রচিত; ইহাতে প্রসঙ্গক্রমে ইশাখাঁর কথা আছে। চতুর্থটি এক অজ্ঞাতনামা মুসলমান লেখক-বিরচিত; পালার নাম “দেওয়ান ফিরোজ খাঁর গান।”

 দুঃখের বিষয় এই যে পূর্ব্বোক্ত পালাগান সমূহে ইশাখাঁর যে সমস্ত বিবরণ পাই, তাহাদের বর্ণনায় সর্ব্বত্র ঐক্য নাই। এই সমস্ত বিবরণ এবং মুসলমান ও ইউরোপীয় গ্রন্থকার প্রদত্ত ইতিহাসগুলি পর্য্যালোচনা করিয়া আমাদিগকে ইশাখাঁর ইতিহাস উদ্ধার করিতে হইয়াছে। ১৫৮৬ খ্রীষ্টাব্দে র‍্যালফ্ ফিচ্ সোণার গাঁ পরিদর্শন করিয়া লিখিয়া যান, “এই তাঞ্চলের অধিপতি ইশাখাঁ বঙ্গদেশের অপরাপর ভূম্যধিকারীদের অধিনায়ক এবং খ্রীষ্টানদিগের পরমবান্ধব।” আইন-ই-আকবরী হইতে জানা যায় যে ১৫৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ইশাখাঁ সাহবাজ খাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত বিপুল সম্রাট্ বাহিনীর গতিরোধ করেন। ইহাতে মানসিংহের সহিত ইশাখাঁর তুমুল যুদ্ধ, এবং ষোড়শ শতাব্দীতে পূর্ব্ববঙ্গে ইশাখাঁর দোর্দ্দন্ত প্রভাবের বিবরণ পাওয়া যায়। আইন-ই-আকবরীতে ইশাখাঁ কোন কোন স্থানে “বঙ্গদেশের বিভব-শালী ভূস্বামী” বলিয়া উল্লিখিত।

 ইশাখাঁর দীল্লির সেনপতি-গণের সঙ্গে যুদ্ধ এবং তৎকর্ত্তৃক সোণামণি(সুভদ্রা) হরণের কাহিনী পালাগান সমূহে একটু অতিরঞ্জিত ভাবে প্রদত্ত ইইলেও এই সমস্ত বিবরণ ঐতিহাসিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ইশখাঁর বংশাবলী ও পূর্ব্বপরিচয় লইয়া অনেকটা মতদ্বৈধ আছে।

 ওয়াইজ সাহেব ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ান সাহেবদের নিকট ইশাখাঁ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক তত্ত্ব জানিতে চাহিলে তাঁহারা লিখিয়া পাঠান যে ইশাখাঁর পূর্ব্বপুরুষ কালিদাস গজদানী সম্রাট হুসেন সাহের এক কন্যাকে বিবাহ করেন। (১৮৭৪ খ্রীঃ এসিয়াটিক সোসাইটি জর্ণ্যালের ২০৯ পৃঃ)। কিন্তু পরবর্ত্তীকালে জঙ্গলবাড়ীর ইতিহাস লিখিত হইবার সময় দেওয়ান সাহেবেরা নিশ্চয়ই এই মত পরিবর্ত্তন করিয়াছিলেন। কারণ তাঁহাদের পৃষ্ঠপোষিত গ্রন্থকারেরা লিখিয়া গিয়াছেন যে, ১৫৬০ হইতে ১৫৬৩ খ্রীঃ পর্য্যন্ত গিয়াসুদ্দিন বঙ্গাধিপ ছিলেন, তাঁহারই এক কন্যাকে কালিদাস গজদানী বিবাহ করেন। দেওয়ানসাহেবদিগের এইরূপ মত পরিবর্ত্তনের কারণ সম্বন্ধে আমি যাহা অনুমান করিয়াছি, তাহা পরে আলচনা করিব।

 বিবিধ ঐতিহাসিক বিবরণ হইতে আমরা এই কয়েকটি অবিসম্বাদিত সত্য পাইতেছি। প্রথম, ইশাখাঁ কালিদাস গজদানীর পুত্র। দ্বিতীয় অযোধ্যা প্রদেশের বয়েসওয়ারা নামক স্থানের এক রাজপুত আসিয়া বঙ্গদেশে বাস করেন, এবং কালিদাস গজদানী তাঁহারই বংশে উদ্ভুত। তৃতীয়, মুসলমান ধর্ম্মগ্রহণ করিয়া কালিদাস সুলেমান খাঁ নামে পরিচিত হন, এবং বঙ্গদেশের তৎকালিন মুসলমান নরপতির কন্যাকে বিবাহ করেন। এই কয়েকটি বিষয় সমস্ত ঐতিহাসিক বিবরণেই একরূপ পাওয়া যায়। ষ্টেপলটন সাহেব লিখিয়াছেন, “গোণ্ডের ডেপুটি কমিসনার বি, বুরু মহোদয়ের নিকট কালিদাস গজদানীর বংশ পরিচয় জানিতে চাহিলে তিনি তাঁহাকে তথাকার স্থানীয় প্রমাণ বিচার করিয়া লিখিয়াছিলেন যে তাঁহার ধারণা, কালিদাস বাইসওয়ারা বংশের একজন রাজপুত; আশ্চর্য্যের বিষয়, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র লিখিত “মসনদ আলি ইতিহাসে”ও প্রথম পৃষ্ঠার পাদটীকায় এইকথাই উল্লিখিত হইয়াছে। উক্ত ইতিহাসে পাওয়া যায়, ‘সোলেমান খাঁর পূর্ব্বপুরুষগণের আদিনিবাস অযোধ্যা প্রদেশান্তর্গত বয়েসওয়ারা রাজ্যে। (এসিয়াটিক সোসাইটির ১৯১০ সনের অক্টোবর পত্রিকায় ১৭০ পৃষ্ঠা)।

 প্রথম পালাটিতে এসম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য পাওয়া যাইতেছে। তাহা এই, বয়েসওয়ারার রাজা ধনপৎসিং দিল্লীসম্রাটের একজন ক্ষমতাশালী মিত্ররাজা ছিলেন; ভগীরথ নামক তাঁহার এক বংশধর তীর্থ পর্য্যটন উদ্দেশ্যে বঙ্গদেশে আগমন করেন; বঙ্গাধিপ গিয়াসুদ্দিন তাঁহার যথোচিত সংবর্দ্ধনা করেন। কালিদাস গজদানী এই ভগীরথের বংশধর। কালিদাস পরে ইসলাম ধর্ম্ম গ্রহণানন্তর গিয়াসুদ্দিনের তৃতীয়া কন্যার পানিগ্রহণ করিয়া ১৫৬৩ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাটের মৃত্যুর পর সুলেমান কাররাণি উপাধি ধারণ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন।

 পূর্ব্ব-প্রচলিত মতানুসারে, কালিদাস মুসলমানধর্ম্ম গ্রহণ ও সুলেমান কাররাণি উপাধি গ্রহনের পর হুসেন সাহের কন্যাকে বিবাহ করেন। হুসেন সাহ ১৪৯২ হইতে ১৫২০ খ্রীঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। হুসেন সাহের পর নিম্নলিখিত নৃপতিগণ যথাক্রমে বঙ্গসিংহাসনে আরোহণ করেন। নসরৎ সাহ (১৫২০-১৫৩৪ খ্রীঃ); গিয়াসুদ্দিন মহম্মদ সাহ তৃতীয় (১৫৩৪-১৫৩৬); শের সাহ (১৫৩৬-১৫৪৫); মহম্মদ সাহ গাজী (১৫৪৫-১৫৫৬); বাহাদুর সাহ (১৫৫৬-১৫৬০); গিয়াসুদ্দিন জালাল সাহ (১৫৬০—১৫৬৩); সুলেমান কাররাণি (১৫৬৩—১৫৭২)। নেলসন রাইট সাহেবের ‘ইণ্ডিয়ান মিউসিয়মে’ রক্ষিত মুদ্রাসমূহের বিবরণ হইতে সামান্য পরিবর্ত্তন পূর্ব্বক আমি এই তালিকা গ্রহণ করিয়াছি।

 সুলেমান খাঁ এবং ইতিহাস-প্রসিদ্ধ কালাপাহাড় উভয়েই যে একই মুসলমান নরপতির জামাতা ছিলেন, এই বিশ্বাস অনেকস্থলেই প্রচলিত আছে। শ্রীযুক্ত দুর্গাচরণ সান্ন্যাল মহাশয়ের ‘বঙ্গদেশের সামাজিক ইতিহাসে’র বিশেষ ঐতিহাসিক প্রামাণিকতা না থাকিলেও ইহাতে প্রদত্ত বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদিগের বংশতালিকায় দেশ প্রচলিত বহু প্রাচীন সংস্কারের কথা লিপিবদ্ধ আছে। সান্ন্যাল মহাশয় লিখিয়াছেন যে, কালাপাহাড় হুসেন সাহের এক কন্যার পানিগ্রহণ করেন; তিনি এই বিবাহ বর্ণন কালে দম্পতীর পূর্ব্বরাগের একটি চিত্তাকর্ষক বর্ণনা প্রদান করিয়াছেন।

 জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ান দিগের আদেশে বিরচিত ইতিহাস-অনুসারে কালিদাস গজদানী ও কালাপাহাড় উভয়েই তাৎকালিক মুসলমান নরপতির জামাতা বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে প্রচলিত সংস্কারানুসারে, কালাপাহাড় হুসেন সাহেরই এক কন্যার সহিত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। এই বিশ্বাস এক সময়ে দেওয়ান পরিবারেও প্রচলিত ছিল; নতুবা তাঁহারা ওয়াইজ সাহেবের প্রশ্নের সেরূপ উত্তর দিবেন কেন? কিন্তু “মসনদ আলি ইতিহাস” সঙ্কলয়িতারা শেষে খাস গৌড়েশ্বর হইতে দেওয়ান বংশের উৎপত্তি প্রমাণ করিয়া তাঁহাদের গৌরব বৃদ্ধি করিতে বদ্ধ পরিকর হইলেন; তদনুসারে তাঁহারা লিখিলেন যে, ইব্রাহিম মালিকা উলমা বঙ্গাধিপ জালাল সাহের প্রথমা কন্যাকে বিবাহ করেন (১৯০৯ খ্রীঃ এসিয়াটিক সোসাইটি জর্ণ্যালের ৩৭ পৃঃ) এবং কালিদাস গজদানী জালালের তৃতীয় কন্যার পানিগ্রহণ করেন। পূর্ব্বেকার মত, অর্থাৎ সুলেমান হুসেন সাহের কন্যার পানিগ্রহণ করেন,—মানিয়া লইলে সুলেমান খাঁ ও সুলেমান কাররাণির অভিন্নত্ব প্রতিপাদিত হইত না, কারণ সময়ের বিস্তর ব্যবধান ঘটিত। ইহা হইতে স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে দেওয়ানগণের পূর্ব্বপুরুষ বঙ্গাধিপতি ছিলেন, ইহাই প্রমাণ করিবার জন্য দেওয়ান পরিবারের পূর্ব্বপ্রচলিত মত পরিবর্ত্তন করার দরকার হইয়াছিল। দেশে নূতন কোনও ক্ষমতাশালী পরিবারের আগমন ও প্রতিষ্ঠা হইলে উক্ত পরিবারের পৃষ্ঠপোষিত ও আশ্রিতবর্গের পক্ষে সেই পরিবারকে রাজা বা বাদসাহের সঙ্গে সম্বন্ধসূত্রে গ্রথিত করিবার চেষ্টা এ দেশের ইতিহাসের নূতন ঘটনা নহে।

 ইহা নিশ্চিত রূপে জানা যাইতেছে যে, দাউদ খাঁ সুলেমান কাররাণির পুত্র (রাইট সাহেবের তালিকায় ১৮২ পৃঃ দ্রষ্টব্য)। রাম-রাম বসুর প্রতাপাদিত্য চরিতেও একথার উল্লেখ আছে। প্রতাপাদিত্য চরিতকার লিখিয়াছেন যে তাঁহার গ্রন্থ কোনও পারসীক পুস্তক অবলম্বনে লিখিত। প্রতাপাদিত্যের পিতা বিক্রমাদিত্য দাউদ খাঁর মন্ত্রী ছিলেন। দাউদ খাঁ ইশা খাঁর ভ্রাতা হইলে রামরাম বসু নিশ্চয়ই তাহার উল্লেখ করিতেন; কারণ তাঁহার গ্রন্থে দাউদ খাঁ সম্বন্ধে প্রায় সমস্ত জ্ঞাতব্য বিবরণই প্রদত্ত হইয়াছে। আরও আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, আইন-ই-আকবরীতে লিখিত আছে, দাউদ খাঁ খানজাহান কর্ত্তৃক ধৃত ও নিহত হইলে তাঁহার বৃদ্ধা মাতা খান জাহানের কৃপাভিক্ষা করিয়া তাঁহার আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইশা খাঁ তাঁহার অপর পুত্র হইলে এই বৃদ্ধা রমণী কি কখনও এইরূপ পুত্র-হন্তার শরণ লওয়ার হীনতা স্বীকার করিতেন? আইন-ই-আকবরীতে দাউদ খাঁর অনেক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনের নামোল্লেখ আছে, কিন্তু তাহাতে ইশাখাঁর নাম নাই। উক্ত প্রখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থে ইশাখাঁর বংশাবলী, তাঁহার পিতার মৃত্যু, শৈশবে তাঁহার দাসরূপে বিক্রীত হওয়া এবং সেইরূপ হীনভাবে কিছু দিন তুরাণে অবস্থিতি প্রভৃতি বিবরণ পাওয়া যায়। আইন-ই-আকবরির এই বিবরণ পাঠে মনে হয়, ইশাখাঁর বাল্যেতিহাস অন্ধকারাচ্ছন্ন। পরে ইশাখাঁ কিরূপে সম্পদও ক্ষমতার অধিকারী হইলেন, তাহা অপর এক সূত্র হইতে জানা যায়।

 ত্রিপুরার রাজমালা গ্রন্থের প্রথম দিক্‌টা অর্থাৎ যেখানে চন্দ্রবংশীয় যযাতির সহিত ত্রিপুরার রাজবংশের সম্বন্ধ স্থাপন করিবার প্রয়াস হইয়াছে, সেই অংশটুকু বাদ দিলে তৎবর্ণিত অন্যান্য ইতিবৃত্তগুলির অধিকাংশই বিশ্বাসযোগ্য বলিয়াই মনে হয়। ইতিহাস-পূর্ব্ব যুগের বিবরণ কল্পনা মিশ্রিত হইলেও পরবর্ত্তীযুগের শাসনসংক্রান্ত ইতিবৃত্ত রাজসভার ঐতিহাসিকগণ যথাযথভাবে রক্ষা করিয়াছেন। অবশ্য তথাকার রাজন্যবর্গের বীরত্ব প্রতিপাদন করিবার জন্য ঐ পুস্তকে সময়ে সময়ে কাল্পনিক যুদ্ধবিগ্রহ ও জয়-লাভের কাহিনী প্রদত্ত হইয়াছে, কিন্তু তৎসত্ত্বেও পারিবারিক বংশাবলীর ধারা এবং প্রধান প্রধান ঘটনার ইতিাহস তাঁহারা নিশ্চয়ই অবিকৃত রাখিয়াছেন। সারাইল পরগণার ইশাখাঁর সম্রাট্ বাহিনীর সহিত যুদ্ধ-বৃত্তান্ত স্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে। ইশাখাঁ যে কিছু কালের জন্য ত্রিপুর-রাজের সেনাপতি ছিলেন এবং তিনি রাজা অমরমাণিক্যের তুষ্টিসাধনের জন্য নানাবিধ প্রয়াস পাইতেন, ইহাতে সন্দেহ নাই। রাজমালার যে অংশে ইশাখাঁর বিবরণ আছে, আমরা পরে তাহার সক্ষিপ্ত বিবরণ দিব। ত্রিপুরারাজ ইশাখাঁকে ‘মসনদ আলি’ উপাধি প্রদান করিয়াছিলেন, রাজ-কবিদিগের এই উক্তি সম্বন্ধে আমাদের দ্বিধা থাকিলেও রাজমালা প্রদত্ত ইশা খাঁ সম্বন্ধীয় অন্যান্য বিবরণ যথার্থ বলিয়াই মনে হয়।

 জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ানদিগের ইতিহাসগ্রন্থে অথবা পালাগানগুলির কোথায়ও ইশা খাঁর বাল্যেতিহাস দেওয়া হয় নাই। সমস্ত বিবরণেই ইশা খাঁ সুলেমান কাররাণির মৃত্যুর পর প্রবল প্রতাপন্বিত সম্রাট-দ্রোহী বীরাগ্রগণ্য রূণেই আমাদের নিকট উপস্থিত হইয়াছেন। এই কাহিনীগুলিতে ইশা খাঁর জীবনের অখ্যাত অধ্যায়কে সুকৌশলে বাদ দিয়া তাঁহাকে প্রথম হইতেই প্রথিতনামা ভাবে অঙ্কিত করা হইয়াছে। ইশা খাঁর প্রথম জীবনের ঘটনাসমূহের অনুল্লেখদ্বারা বোধ হয় তাঁহাকে সুলেমান কাররাণির পুত্র প্রতিপন্ন করিবার সুবিধা হইয়াছিল। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, প্রথম পালাগানটিতে আছে যে, কালিদাস গজদানীর পূর্ব্বপুরুষ ধনপৎ নামক অযোধ্যার এক ক্ষত্রিয় রাজা। এই পালায় আরও উক্ত হইয়াছে, ধনপতের বংশধর ভগীরথ বঙ্গদেশে আবাস স্থাপন করেন এবং কালিদাস এই ভগীরথের বংশধর। পূর্ব্বোক্ত রাজপুতদিগের মধ্যে কেহ কাহারও পিতা বা পুত্র বলিয়া উল্লিখিত হন নাই। কালিদাসকে ভগীরথের এবং ভগীরথকে ধনপতের বংশধর বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। এই নামগুলি ঐতিহাসিক ইহা বিশ্বাস করিলেও পালাগানের বিবরণ পাঠে আমার মনে হয় যে সময় সক্ষেপ করিবার জন্য বয়েসওয়ারা বংশের অনেকগুলি নাম এই তালিকা হইতে ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে। কালিদাস গজদানী ও সুলেমান কাররানীর অভিন্নত্ব প্রতিপাদন কল্পে তাঁহাকে পর পর তিনজন নরপতির মন্ত্রী বলা হইয়াছে; এবং এই দীর্ঘকালের পরেও তাঁহার আকৃতি এমনই সুদর্শন রহিয়া ছিল বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে যে তৃতীয় নরপতির কনিষ্ঠা কন্যা তাঁহাকে দেখিয়া প্রেমে পড়িয়াছিলেন। ইহাতে জোড়াতালি দিবার একটা চেষ্টা স্পষ্টই ধরা পড়িয়াছে। সুলেমান খাঁকে টানিয়া সুলেমান কাররাণীর সহিত অভিন্ন কল্পনা করা হইয়াছে; উভয়ের নামসাদৃশ্য ও এইরূপ সময়সঙ্ক্ষেপ করিবার সহায়তা করিয়াছে।

 দেওয়ান দিগের দোহাই দিয়া ভিন্ন ভিন্ন সময়ে যে সকল পালা গান ও ঐতিহাসিক বিবরণ রচিত হইয়াছে তাহাতে আদৌ বর্ণনা-সাম্য নাই। কোন কোন পালাগানে দেওয়ান দিগকে বাড়াইবার জন্য উপহাসাস্পদ ভাবে কল্পনার লীলা খেলা প্রদত্ত হইয়াছে, তাহাতে ভারতবর্ষের ইতিহাসের ভিত্তি কাঁপিরা উঠিয়াছে। দেওয়ানদিগের অনুগৃহীত গলাচিপা নিবাসী আবদুল করিম তাঁহার পালা গানে লিখিয়াছেন যে মোগলসাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের এক কন্যাকে ইশাখাঁ বিবাহ করিয়াছিলেন। পালারচয়িতা দেওয়ান বংশের গৌরব ঘোষণার জন্য কল্পনার অবাধলীলা সহকারে বর্ণনা করিয়াছেন যে, হুমায়ুনের সিংহাসনারোহণ উপলক্ষে যে দরবার হইয়াছিল সেই দরবারের দিন ইশাখাঁ সমাগত সামন্তবর্গের সমক্ষে স্বয়ং সিংহাসনে উপবেশন করিলে হুমায়ুন ভগিনীপতির এই বলদৃপ্ত ব্যবহারে ভীত ও সন্ত্রস্ত হইয়া তাঁহার সহিত এই মর্ম্মে সন্ধি করিলেন, যে তিনি তাঁহাকে সর্ব্বপ্রধান সামন্তরাজারূপে গ্রহণ করিবেন। এই আজগুবি কাহিনী সম্বন্ধে আমাদের বিশেষ কিছু লিখিবার প্রয়োজন নাই।

 ইশাখাঁকে দায়ুদের ভ্রাতা বলিয়া স্বীকার করিবার আমাদের অপর আপত্তি এই যে, ইশাখাঁ পূর্ব্বঙ্গের স্বাধীন নরপতি বলিয়া পরিগণিত হইলেও পূর্ব্বপুরুষাগত ‘দেওয়ান’ উপাধিই নামের সহিত সংযোগ করিয়া নিজেকে ‘দেওয়ান মসনদ আলি’ বলিয়া আখ্যাত করিতেন। দাউদ খাঁ ইশাখাঁর ভ্রাতা হইলে অপরাপর দেওয়ানদিগের ন্যায় তিনিও নিজেকে দেওয়ান দাউদ খাঁ বলিয়া পরিচিত করিতেন। কিন্তু “দেওয়ান দায়ুদ খাঁ” কোথায়ও পাওয়া যায় না; দায়ুদখাঁর মুদ্রায় পর্য্যন্ত তাঁহার ‘কাররাণি’ উপাধি দৃষ্ট হয়। অপরপক্ষে, ইশাখাঁকে কোথায়ও ‘কাররাণি’-উপাধি ভূষিত বলিয়া পাওয়া যায় নাই। দেওয়ান পরিবারের ইতিবৃত্ত ছাড়া কোথায়ও দায়ুদ খাঁর ‘ইসমাইল’ নাম পাওয়া যায় না। ইশাখাঁর ইসমাইল নামক এক ভ্রাতা ছিল; আইন ই আকবরীতেও তাহাই পাওয়া যাইতেছে। পরবর্ত্তী ঐতিহাসিকগণ দায়ুদকে ইশাখাঁর ভ্রাতা প্রমাণ করিবার জন্য তাঁহার ইসমাইল নাম দিয়া আর একটা জোড়া-তালি দিয়াছেন।

 ইশাখাঁর তিনটি বিভিন্ন বংশতালিকা পর্য্যালোচনা করিয়া আমরা তাহার মধ্যে নিম্নলিখিত বৈষম্য পাইতেছি। দেওয়ানদিগের প্রদত্ত বিবরণ অনুসারে ওয়াইজ় সাহেব লিখিতেছেন, ইশাখাঁর পিতা হুসেন সাহের কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। দেওয়ানদিগের ব্যয়ে প্রকাশিত “মসনদ আলি ইতিহাসে” পাওয়া যায় যে, ইশাখাঁর পিতা গিয়াসুদ্দিনের কন্যাকে বিবাহ করেন। দেওয়ানদের কাহারও কাহারও আদেশে বিরচিত আবদুল করিমের পালাগানে পাইতেছি যে ইশাখাঁ বাবরের জামাতা! এক হয় তিনটি বিবরণই অবিশ্বাস্য বলিয়া গ্রহণ উড়াইয়া দিতে হয়, নতুবা প্রথমটিকে অপেক্ষাকৃত প্রামাণ্য বলিয়া গ্রহণ করিতে হয়; কারণ ইহার সপক্ষে আনুষঙ্গিক কতকগুলি প্রবাণ প্রদর্শিত হইয়াছে। তবে একথা অবিসম্বাদিত সত্য যে, কালিদাস গজদানী মুসলমান ধর্ম্ম গ্রহণ করেন এবং সুলেমান খাঁ নাম ধারণ করিয়া সমসাময়িক কোন মুসলমান নরপতির কন্যার পাণি গ্রহণ করেন। এই সম্বন্ধে তিনটি পালাগানে ও অপরাপর বিবরনী সমূহে ঐক্য দৃষ্ট হইতেছে, এ বিষয়ে আমরা পূর্ব্বেই লিখিয়াছি।

 বংশলতার এই বৈষম্য বাদ দিলে ‘মসনদ আলি ইতিহাস’ এবং অন্যান্য পালাগানগুলিতে ইশাখাঁর জীবনবৃত্তান্ত সম্বন্ধীয় অপরাপর প্রায় সমস্ত ঘটনার ঐক্য দেখা যায়। অবশ্য তাহাতে কবিকল্পনা এবং অবান্তর কথাও অনেকটা আছে। এই সমস্তের কোনটিতেই ঈশাখাঁর বাল্যজীবনী নাই। সুতরাং এ সম্বন্ধে আইন-ই-আকবরী ও রাজমালায় যে বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে তাহাই গ্রহণযোগ্য।

 অমর মাণিক্যের রাজত্বকালে ১৫৭৮ খ্রীঃ হইতে ত্রিপুরারাজ্যে ইশা খাঁ যাহা কিছু করিয়াছিলেন, আমরা তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতেছি; এই বিবরণ রাজমালা হইতে গ্রহণ করিলাম।

 ইশাখাঁ তুরাণ অঞ্চল হইতে প্রত্যাবর্ত্তনের অব্যবহিত পরেই যে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন, এরূপ মনে হয় না। তিনি প্রথমতঃ সৈন্যসংগ্রহ করিয়া ত্রিপুরা জেলার সারাইল পরগণায় অবস্থিতি করেন।

 অমর মাণিক্য ১৫০৪ শক অর্থাৎ ১৪৮২ খ্রীষ্টাব্দে উদয়পুর পাহাড়ের পশ্চিমে চৌদ্দগ্রামে “অমরদীঘি” নামক একটি প্রকাণ্ড দীঘিকা খনন করিয়া ছিলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি হরিশ্চন্দ্রের পুত্ত্র সুবুদ্ধিনারায়ণকে জিজ্ঞাসা করেন,—তাঁহার মিত্র ও সামন্ত ভূস্বামীদিগের মধ্যে কে খনন কার্য্যের জন্য কত জন কুলী দিয়া সাহায্য করিয়াছেন।

 সুবুদ্ধিনারায়ণ উত্তরে বলিলেন, “বিক্রমপুরের ভূম্যধিকারী চাঁদরায় সাতশত কুলী দিয়াছেন; তাঁহার লোকেরা পরিশ্রমী ও সুচতুর। বাক্‌লা পরগণার বসু সাতশত এবং ভাওয়ালের রাজা এক হাজার লোক দিয়াছেন। অষ্টগ্রাম হইতে পাঁচ শত এবং শ্রীহট্ট বাণিয়াচং হইতে আমরা আট শত মজুর পাইয়াছি। রণ-ভাওয়ালের রাজা এবং সারাইল পরগণার ইশাখাঁ ইহাদের প্রত্যেকে আমাদিগকে এক হাজার করিয়া লোক দিয়াছেন। ভুলুয়ার বলরাম শূরও হাজার লোক দিয়াছেন। ............সুতরাং বাহির হইতে মোট ৭১০০ সাতহাজার একশত মজুর পাওয়া গিয়াছে। রাজা এবং জমিদারদিগের কেহ ভয়ে, কেহ ভালবাসার খাতিরে, কেহ বা সম্মান প্রদর্শনের জন্য ত্রিপুরারাজের কার্য্যে লোক সরবরাহ করিয়াছেন। বারভুঞাদের প্রত্যেকেই লোক দিয়াছেন; দেন নাই কেবল তরপের রাজা।”

 তরপের ঔদ্ধত্যে অমর মাণিক্য কুপিত হইয়া তরপরাজ ফতেখাঁকে দমন করিবার জন্য যুবরাজ রাজধরের নেতৃত্বে বাইশ হাজার সৈন্য প্রেরণ করেন। রাজধর তরপ-সেনাপতি শোভারাম ও তাহার পুত্রকে পরাস্ত করিয়া পিঞ্জরাবদ্ধভাবে উদয়পুর রাজধানীতে প্রেরণ করেন। অতঃপর ত্রিপুর-সৈন্য তরপের পাঠান রাজা ফতেখাঁকে দমন করিবার জন্য অগ্রসর হয়। এই সময় ত্রিপুরারাজের নৌসেনার অধিনায়ক ছিলেন ইসাখাঁ। অমর মাণিক্যের আদেশে বাঙ্গালী সেনাগণ ইশাখাঁর অধীনে যুদ্ধযাত্রা করে; তাহারা সুরমাই নদীবাহিয়া শ্রীহট্টে উপস্থিত হয়।

 অতঃপর আফগানরাজা ফতেখাঁ কিরূপে যুবরাজ রাজধর ও ইশাখাঁ কর্ত্তৃক পরাজিত হন, রাজমালার তাহার বিস্তৃত বিবরণ আছে। তাঁহাদের অধীনে যে সমস্ত বাঙ্গালী সেনানায়ক যুদ্ধ করিয়াছিলেন, এই বিবরণে তাঁহাদের নাম ও গুণপনার বিষয়ও বর্ণিত হইয়াছে। ফতেখাঁ আত্মসমর্পণ করিলে তাঁহাকে ১৫০৪ শকের ১লা মাঘ তারিখে অর্থাৎ ১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি উদয়পুর আনা হয়। রাজা ইশাখাঁকে সম্মানিত করিবার জন্য একটি দরবার আহ্বান করিয়া প্রকাশ্যভাবে তাঁহার বীরত্বের প্রশংসা করেন এবং জামাতা দয়াবন্ত নারায়ণের বাম দিকে তাঁহাকে আসন প্রদান করেন।

 ইহার কিছুদিন পরে দিল্লী সাম্রটের একজন আমির (সম্ভবতঃ সাহবাজখাঁ) পূর্ব্ব-বঙ্গের পথে এক বিপুল বাহিনী সহ অভিযান করিয়া ইশাখাঁকে আক্রমণ করেন। ইশাখাঁ এই সময় নিশ্চয়ই সারাইল পরগণায় সুপ্রতিষ্টিত হইয়াছিলেন। এই বিপদে সামান্য হটিয়া গিয়া ইশাখাঁ অমর মাণিক্যের সাহায্য প্রার্থনা করেন।

 কিরূপে ত্রিপুরারাজের সাহায্য লাভ করা যাইবে, এ সম্বন্ধে ইশাখাঁ তাজখাঁ ও বাজখাঁ নামক ত্রিপুরার সেনাপতিদ্বয়ের পরামর্শ চাহিলে তাঁহারা ইশাখাঁকে রাণী অমরাবতীর শরণাপন্ন হইতে উপদেশ দেন। তাঁহারা বলিলেন যে রাজা সমস্ত ব্যাপারেই রাণীর পরামর্শ মানিয়া চলেন। ইশাখাঁ রাণী অমরাবতীকে মাতৃসম্বোধন করিয়া এক আবেদন পত্র প্রেরণ করেন। মাতৃসম্বোধনে বাঙ্গালী রমনীর হৃদয় না গলিয়া পারে না; ইশাখাঁর প্রার্থনায় রাণী তাঁহার স্তন-ধৌত জল ইশাখাঁকে পান করিতে দেন। ইশা শ্রদ্ধা সহকারে তাহা পান করেন। ইহ। স্তন্যপানের তুল্য বলিয়া বিবেচিত হইল এবং তদবধি ইশাখাঁ রাণীর পালিত পুত্ররূপে গৃহীত হইলেন। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, লং সাহেব রাজমালার সংক্ষিপ্ত ইংরেজী অনুবাদে এই ঘটনার যে বর্ণনা দিয়াছেন, তাহার মর্ম্ম এইরূপ—“ইশাখাঁ রাণীর স্নেহ অর্জ্জন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। রাণী গাত্রধৌত করিয়া সেইজল ইশাখাঁকে পান করিতে দিয়া তাঁহার ভক্তির পরীক্ষা করেন। ইশাখাঁ সেই জল পান করেন।” বৈদেশিক লেখকের পক্ষে ‘স্তনের’ জায়গায় ‘গাত্র’ লেখা হয়তঃ বা মার্জ্জনীয়। কিন্তু শ্রীযুক্ত কৈলাস চন্দ্র সিংহ মহাশয়ের ন্যায় বাঙ্গালী পণ্ডিত কিরূপে এই বিবরণটি নিম্নলিখিত ভাবে বিকৃত করিলেন, তাহাই আশ্চর্য্যের বিষয়, তাঁহার লেখা এইরূপ “অমর মাণিক্যের রাজ্ঞীও ইষাখাঁকে পাদোদক প্রেরণ করিয়া বলিয়া পাঠাইলেন”—ইত্যাদি। তিনি হয়ত বিলাতী শিষ্টতা ও রুচির খাতিরে স্তন ধৌত করিবার ব্যাপার উল্লেখ করিতে লজ্জা পাইয়া তৎস্থলে ‘পাদোদক’ ব্যবহার দ্বারা মার্জ্জিত রুচির পরিচয় দিয়াছেন। কিন্তু আমাদের দেশে মাতৃস্তনের উল্লেখে যে কোনই দোষ হইতে পারেনা, পরন্তু তাহা যে পবিত্র ভাবই বহন করে, ইহা বোধ হয় সিংহ মহাশর ভুলিয়া গিয়াছিলেন।

 ইশাখাঁর প্রতি রাজা অমরমাণিক্য পূর্ব্ব হইতেই সন্তুষ্ট ছিলেন; এই ব্যাপারে আরও প্রীতিলাভ করিয়া তাঁহাকে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য দিয়া সাহায্য করেন। ইশাখাঁ সৈন্য সমভিব্যাহারে সার পরগণায় উপস্থিত হইলেই দিল্লীসেনাপতি অবিলম্বে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিলেন। কথিত আছে, ইশাখাঁ রাজানুগ্রহের নিদর্শন স্বরূপ বহু উপঢৌকন প্রাপ্ত হন। কিন্তু রাজমালাকার
ইশা খাঁর নামাঙ্কিত কামান—পৃঃ ৫৩ (ভূমিকা)
যে লিখিয়াছেন, অমরমাণিক্য ‘মচলন্দানি’ উপাধি ইশাখাঁকে প্রদান করিয়াছিলেন, ইহা সম্ভবতঃ ত্রিপুরারাজের মনোরঞ্জনের জন্য। কিন্তু এ সম্বন্ধে আমরা বেশী কিছু বলিতে চাই না; আমাদের বক্তব্য সংক্ষেপে পাদটীকায় লিখিত হইল।[১]

 রাজমালার বিবরণে পাওয়া যাইতেছে যে, ইশাখাঁ এখন বায়ান্ন হাজার সৈন্যের অধিকারী হইলেন।’ সম্ভবতঃ এই সময় হইতেই তিনি স্বাধীনতালাভের চেষ্টা করিতে থাকিবেন। সারাইল পরগণায় থাকিয়া তাঁহার এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের কোনই সম্ভাবনা ছিলনা। কারণ সেখানে তিনি ত্রিপুরা রাজের করদ বা সামন্ত রাজা বলিয়াই পরিগণিত হইতেন। ইহা ছাড়া আরও কতকগুলি কারণের জন্য ইশাখাঁর পক্ষে সারাইল পরগণায় অবস্থিতি বিশেষ বাঞ্ছনীয় ছিল না। যুবরাজ রাজধর একবার শিকারে বহির্গত হইয়া দেখিলেন যে সারাইল পরগণার জঙ্গলাকীর্ণ স্থান সমূহ বহুবিধ বন্যমহিষ, ব্যাঘ্র ভল্লুক এবং মৃগ প্রভৃতির আবাসস্থল। শিকারের লোভে আকৃষ্ট হইয়া যুবরাজ তিতাশ নদী পার হইয়া এই পরগণার অন্তঃপাতী বনমধ্যস্থ ৪২টি গ্রামের মধ্যে বিচরণ করিতে করিতে সারালাইল পরগণায় একটি বিশ্রামাবাস নির্ম্মাণের কল্পনা করিতে লাগিলেন। সেই আবাসস্থানটিকে কেন্দ্র করিয়া শিকারে বহির্গত হওয়ায় সুবিধা হইবে এবং তাহা ছাড়া বন কাটিয়া রাজ্যের পরিসর বৃদ্ধি করিবারও সুযোগ হইবে, ইহাও তাহার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। (রাজমালা ১৯৩ পৃষ্ঠা)।

 এদিকে সাহবাজ খাঁ পরাস্ত হইয়া প্রতিশোধ লইবার জন্য প্রস্তুত হইতে ছিলেন। ইশাখাঁও বিপুল সৈন্যের অধীশ্বর হইয়া এমন একটি স্থান খুঁজিতে ছিলেন, যেখানে দিল্লীশ্বরের আক্রোশ হইতে নিরাপদ হইয়া তিনি নূতন নূতন রাজ্য জয় করিয়া নিজের ক্ষমতাবৃদ্ধির চেষ্টা করিতে পারেন। পালাগানগুলির কোন কোনটিতে সম্রাট সেনার সহিত ইশাখাঁর যুদ্ধ এবং পলায়নের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। এই সময়েই অর্থাৎ ১৫৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ইশাখাঁ নিরপরাধ কোচ-পতি রামহাজরা ও লক্ষ্মণহাজরা ভ্রাতৃদ্বয়কে রাত্রি-কালে আক্রমণ করেন। তাঁহারা একটি সুড়ঙ্গপথে প্রাসাদ হইতে পলায়ন করিয়া প্রাণ রক্ষা করিয়াছিলেন। তাঁহাদের প্রাসাদের চিহ্ন এখনও বিদ্যমান। কোচরাজাদিগের রাজধানী জঙ্গলবাড়ীই ইশাখাঁর পরিবারের মুখ্য-আবাসে পরিণত হইয়াছিল।

 ইশাখাঁর পৌত্র মনুয়ার খাঁর পালায় তৎ-কর্ত্তৃক ঢাকায় নির্ম্মিত প্রাসাদের উল্লেখ আছে। এই বিশাল সৌধ যেখানে শোভা পাইত, সেই স্থানটিকে এখন “দেওয়ান বাগ” বলে।[২] ইহা নারায়ণগঞ্জের উত্তর পূর্ব্বদিকে
লক্ষ্মণ হাজরার রাজধানী জলাশয়ে পরিণত—পৃঃ ৫৪ (ভূমিকা)
ইশা খাঁর অব্যবহিত বংশধরগণের মসজিদ ও আবাস স্থানের ধ্বংসাবশেষ—পৃঃ ৫৪ (ভূমিকা)
সাত মাইল দূরে আকালিয়া খাল এবং শীতলাক্ষার সঙ্গমস্থল হইতে অনতিদূরে অবস্থিত। এই দেওয়ানবাগে ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে মৃত্তিকাখননকালে সাতটি কামান প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল। ঢাকার তদানীন্তন ম্যাজিষ্ট্রেট এস, ই, ষ্টিন্‌টন্‌ সাহেব এই কামানের বর্ণনা লিখিবার জন্য টেপলটন্ সাহেবের হস্তে উহা প্রদান করেন। ষ্টেপলটন্ সাহেব ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের এসিয়াটিক সোসাইটি-পত্রিকায় অক্টোবর সংখ্যায় এই কামানগুলির বিস্তৃত বিবরণ প্রদান করিয়াছেন। এই কামানগুলির প্রথমটি ব্যাঘ্রমুখাকৃতি এবং শের সাহের নামাঙ্কিত। ইহাতে ৯৪৯ হিজরী সন (১৫৪২ খ্রীঃ) উৎকীর্ণ। দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থটি অনেকটা একই ধরণের এবং উপরিভাগে ব্যাঘ্রমুখের ন্যায় আকৃতিবিশিষ্ট। এই ব্যাঘ্র (শের) শের-সাহের রাজ-চিহ্ন বলিয়াই মনে হয়। অপর তিনটি কামান নিশ্চয়ই ইশাখাঁর। প্রথমটি তাঁহার নামাঙ্কিত; ২য়, ৩য়টিও একই রকমের। এই সাতটি কামান দেওয়ানদিগেরই সম্পত্তি ছিল। প্রথম কামানটিতে উৎকীর্ণ রহিয়াছে যে শের সাহ ১৫৪২ খ্রীষ্টাব্দে ইহা প্রস্তুত করান। কিন্তু ইহাও প্রণিধানযোগ্য যে কামানের বিপরীতদিকে ভগ্নস্থানের নিম্নে বাঙ্গালা ভাষায় “তরপ-রাজ” কথাটি লিখিত রহিয়াছে।

 আমরা পূর্ব্বেই রাজমালা হইতে দেখাইয়াছি যে ইশাখাঁ এবং যুবরাজ রাজধর তরপের পাঠানরাজা ফতেখাঁর বিরুদ্ধে অভিযান করিয়া তাঁহাকে পরাজিত করেন। এই ফতেখাঁ নিশ্চয়ই উত্তরাধিকারসূত্রে অথবা অন্য কোন উপায়ে শের সাহের নিকট হইতে এই কামান সাতটি লাভ করিয়া তাহার অপরপার্শ্বে বাঙ্গালায় “তরপ-রাজ” এই কথাকয়টি উৎকীর্ণ করিয়া থাকিবেন। শের সাহ্ উত্তরপশ্চিমাঞ্চল হইতে আসেন; এই জন্য তাঁহার নাম ফরাসীভাষায় উৎকীর্ণ হইয়াছে। তখন ফার্সী দিল্লী ও পশ্চিমভারতের অন্যান্য মুসলমানাধিকৃত প্রদেশ সমূহের রাজভাষা ছিল। কিন্তু পূর্ব্ববঙ্গে শ্রীহট্ট, ত্রিপুরা ও আসামাঞ্চলে ১৪শ হইতে ১৮শ শতাব্দী পর্য্যন্ত সর্ব্বত্র রাজভাষা বাঙ্গালাই ছিল। এই জন্যই পঞ্চম কামানটিতে ইশাখাঁর নাম বাঙ্গালায় উৎকীর্ণ দেখা যায়। সুতরাং শের সাহের চারিটি কামান কিরূপে ইশাখাঁর হস্তগত হয়, আমরা তাহার একটা আভাস পাইতেছি। শের সাহ্ আফগান ছিলেন; তরপ-রাজ ফতে খাঁও আফগান। সুতরাং ফতে খাঁ যে উত্তরাধিকারসূত্রে অথবা অন্যভাবে শের সাহের কামানগুলি পাইয়া থাকিবেন, ইহা কিছুই বিচিত্র নহে। ইশাখাঁ ফতে খাঁকে যুদ্ধে পরাজয় করিয়া এইগুলি অর্জ্জন করেন। অবশিষ্ট কামানগুলি ইশাখাঁর নিজের; সুতরাং সে সম্বন্ধে গবেষণা নিষ্প্রয়োজন। তবে শেষোক্ত কামানগুলির একটিতে বাঙ্গালায় উৎকীর্ণ সন তারিখ সম্বন্ধে কিছু বলিবার আছে। ইহা ১০০২ হিজরী সনে, অর্থাৎ ১৫৯৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রস্তুত করা হইয়াছিল। এই বৎসর মানসিংহ ইশাখাঁকে দমন করিবার জন্য দিল্লী হইতে প্রেরিত হন। সুতরাং আকবর সাহের দেশবিশ্রুত সেনাপতির সহিত যুদ্ধ করিবার জন্যই সম্ভবতঃ ইশাখাঁ এই বৎসর যে সকল কামান নির্ম্মান করিয়াছিলেন, এই তিনটি তাহাদের অন্যতম।

 তাহা হইলে, ঈশাখাঁ যখন ত্রিপুরাধিপতির অধীনস্থ ভূম্যধিকারী হিসাবে এক হাজার মজুর দিয়া ‘অমরদীঘি’ খনন কার্য্যে অমরমাণিক্যকে সাহায্য করেন, সেই সময় হইতে তাহার মানসিংহের সহিত যুদ্ধ, এগারসিন্দুরিয়ার দুর্গে আত্মসমর্পণ এবং তাঁহার বীরত্বকাহিনী শ্রবণে সন্তুষ্ট হইয়া সম্রাট্ আকবর কর্ত্তৃক তাঁহার মুক্তিসহ ২২টি পরগণার অধিকার প্রদান পর্য্যন্ত—অর্থাৎ ১৫৭৮ খ্রীঃ হইতে ১৫৯৩ খ্রীঃ পর্য্যন্ত তদীয় জীবনের ১৫।১৬ বৎসরের একটা ধারাবাহিক ইতিহাস আমরা পাইতেছি। জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ানদিগের নিযুক্ত কবি ও ঐতিহাসিকেরা তাঁহার জীবনের প্রথম অধ্যায়টা বাদ দিয়া গিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার পরবর্ত্তী জীবনেতিহাস সম্বন্ধে এই সমস্ত ইতিহাসগ্রন্থে ও পালাগানগুলিতে যথেষ্ট উপাদান পাওয়া যাইতেছে। অবশ্য একথা পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে এই সমস্ত বিবরণের সকলগুলিই পাঠক নির্ব্বিচারে গ্রহণ করিতে পারিবেন না।

 দেওয়ান সরকারের কাগজপত্র এবং তন্মতানুসারী ডাক্তার ওয়াইজের বিবরণে উক্ত হইতেছে যে কালিদাস গজদানী সমসাময়িক মুসলমান নরপতির সভাস্থ অমাত্যের ধর্ম্মব্যাখার ফলে ইস্‌লামধর্ম্মের শ্রেষ্ঠত্ব হৃদয়ঙ্গম করিয়া স্বধর্ম্ম পরিত্যাগ পূর্ব্বক মুসলমান ধর্ম্মে দীক্ষিত হন। কিন্তু তিনি জনৈক মুসলমান রাজকুমারীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন, এই কথা যখন সকল দিক হইতেই
ইশা খাঁর কামান—পৃঃ ৫৬ (ভূমিকা)
শের শাহের কামান—পৃঃ ৫৬ (ভূমিকা)
প্রমাণিত হইতেছে, তখন মনে হয়, এই রাজকুমারীর প্রতি অনুরাগই তাঁহার ধর্ম্মান্তর গ্রহণের প্রধান কারণ। তিনি পুর্ব্বে একজন নিষ্ঠাবান্ হিন্দু ছিলেন এবং প্রত্যহ একটি করিয়া স্বর্ণ-হস্তী ব্রাহ্মণকে দান করিয়া ‘গজদানী’ উপাধি লাভ করেন, (হস্তীটি অবশ্য জীবন্ত হস্তীর অনুকরণে ক্ষুদ্রায়তন করিয়া নির্ম্মিত হইত) এইরূপ আচারপরায়ণ একজন হিন্দু যে রাজমন্ত্রীর ধর্ম্মব্যাখ্যাশ্রবণে স্বধর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, একথা বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হয় না; বিশেষতঃ ধর্ম্মব্যাখ্যাতা মন্ত্রিপ্রবর পীর-পয়গম্বর শ্রেণীর কেহ ছিলেন না। ইতিহাসের অনেক স্থলেই দেখা যায়, কামদেব ধর্ম্মযাজকদের দক্ষিণ হস্ত ও অগ্রদূত, সুতরাং তাঁহারই অমোঘ শরবিদ্ধ হইয়াই যে গজদানী ইসলাম ধর্ম্ম গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, এই অনুমানই অধিকতর সঙ্গত বলিয়া মনে হয়! দেওয়ান পরিবারের কাগজপত্রে গজদানীর ধর্ম্মত্যাগের যে কারণ প্রদর্শিত হইয়াছে, তাহারও একটি উদ্দেশ্য থাকিতে পারে। যাহাতে পারিবারিক মর্য্যাদার হানি হয়, অথবা যে বিবরণ কোনরূপ কুৎসা বা গ্লানিজনক হয়, তাহা অপ্রকাশিত রাখিবার অথবা পরিবর্তিত আকারে প্রচার করিবার চেষ্টা স্বাভাবিক। অপরপক্ষে, পালাগান সমূহে প্রদত্ত বিবরণের বিরুদ্ধেও ইহা বলা চলে যে পালা-রচয়িতারা সুবিধা পাইলেই আখ্যানভাগের মধ্যে প্রেমের কাহিনী ঢুকাইয়া দিয়া থাকেন। আমরা দুইটি মতেরই সপক্ষে এবং বিরুদ্ধে এইমাত্র বলিয়া প্রকৃত ব্যাপার নির্ণয়ের ভার পাঠকের বিচার বুদ্ধির উপর দিতেছি। জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ানেরা একসময়ে পূর্ববঙ্গ অঞ্চলে অত্যন্ত প্রতিপত্তিশালী হইয়া উঠিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও উত্তরপশ্চিমাগত গোঁড়া মুসলমানেরা দেওয়ান পরিবারকে ততটা শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতেন না। দেওয়ান ফিরোজ খাঁর পালায় আছে, কেল্লাতাজপুরের রাজকন্যার সহিত ফিরোজ খাঁ বিবাহ প্রস্তাব প্রেরণ করিলে উক্ত কন্যার পিতা ওমর খাঁ অবজ্ঞা সহকারে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন। ওমর খাঁ জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ান পরিবারকে কাফের ও হিন্দুভাবাপন্ন বলিতেন, এবং তাঁহাদিগের ধমণীতে হিন্দু শোণিত প্রবাহিত ছিল বলিয়াই তাঁহাদিগকে ঘৃণা করিতেন।

 পালাগানে কেদার রায়ের কন্যার নাম সুভদ্রা বলিয়া উল্লিখিত কিন্তু হিন্দু দিগের সংস্কার অনুসারে ঐ কন্যা সোণা অথবা সোণামণি নামে পরিচিতা হইয়া আসিতেছেন। কোন কোন লেখক সোণামণি শব্দটিকে বিশুদ্ধ করিয়া স্বর্ণময়ীতে পরিণত করিয়াছেন। ইহাতে মনে হয়, ঐ কন্যা প্রথমে আত্মীয়স্বজনের নিকট নিজের আদুরে নামে অর্থাৎ সোণা বা সোণামণি বলিয়া পরিচিত। ছিলেন; কিন্তু তাঁহার যে পোষাকী নামটি ছিল, মুসলমান অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া তিনি অধিকতর মর্য্যদাজ্ঞাপক মনে করিয়া সেই নামে আত্মপরিচয় দিয়াছিলেন। পালাগান সমূহে অনেক সময় নাম লইয়া এইরূপ গোলমাল ঘটিয়াছে। রাজদরবারের কাগজ পত্রে যে নাম ব্যবহৃত হইয়াছে, সাধারণের নিকট প্রচলিত পালাগান গুলিতে সেই নাম না দিয়া অনেক সময় সহজ এবং ছোট নামগুলি ব্যবহৃত দেখা যায়। মুসলমান অন্তঃপুরে নূতন লোকজনের মধ্যে আসিয়া সোণার পক্ষে ছোট-বেলার আদুরে নাম ত্যাগ করিয়া তাঁহার পোষাকী সুভদ্রানামে পরিচয় প্রদান কিছুই অস্বাভাবিক নহে। তবে তাঁহার মুসলমানী নাম যে “নিয়ামৎ জান” হইয়াছিল, এসম্বন্ধে সমস্ত বিবরণগুলিরই এক মত। সম্প্রতি আর একটি পালাগান মুন্‌সী জসীমুদ্দীন পাঠাইয়াছেন; তাহা মুসলমানের রচনা। উহাতে ‘সোণাই’ নামই পাওয়া গিয়াছে।

 ‘মসনদ আলি ইতিহাস’ কিংবা ষ্টেপল্‌টন প্রদত্ত দেওয়ান পরিবারের বংশতালিকা, ইহাদের কোনটিতেই সুভদ্রার পুত্রগণের নাম নাই। কিন্তু অধিকাংশস্থলেই মুসলমান-লেখক-বিরচিত দেওয়ান পরিবারের ইতিবৃত্তমুলক পালাগান গুলিতে আদম ও বিরাম এই দুইটি নাম সুপরিচিত এবং সচরাচর ব্যবহৃত। তাঁহাদের জীবনের ঘটনাসমূহের বিবরণও অনেক পালাগানে পাওয়া যাইতেছে। ইশাখাঁর যে হিন্দু-পত্নীর গর্ভে আদম ও বিরাম নামক দুইটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে, ইহাতে সন্দেহ করিবার কোনও কারণ দেখিনা। অবশ্য আদম ও বিরাম তাঁহাদের সর্ব্বজন পরিচিত ডাক নাম হইতে পারে; তাঁহাদের হয়ত মর্য্যাদাসূচক ভিন্ন নামও ছিল; কিন্তু আমরা এপর্য্যন্ত তাঁহাদের অপর কোনও নাম পাই নাই। ইশাখাঁর মৃত্যুর পর সোণামণি অথবা সুভদ্রার পিতৃ-গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন এবং ধর্ম্মত্যাগিনী হইলেও ব্রহ্মচারিণীভাবে অবস্থিতির বিষয় দুর্গাচরণ সান্ন্যাল মহাশয় লিখিয়াছেন। তিনি বলেন হৈবৎপুরের দেওয়ানেরা ইশাখাঁর হিন্দু বেগমের গর্ভজাত পুত্ত্রদ্বয় হইতে উৎপন্ন।[৩] এই বিবরণ কতদূর সত্য, জানি না। গোঁড়া মুসলমান লেখক একটি সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারকে হিন্দু সংস্রবদুষ্ট বলিয়া স্বীকার করিতে না চাহিতে পারেন; এই জন্যই হয়ত দেওয়ান পরিবারের বংশতালিক। হইতে কায়স্থ রাজকন্যার নামগন্ধ পর্য্যন্ত উঠাইয়া দেওয়ার চেষ্টা হইয়াছে। জাহাঙ্গীর যে যোধবাঈয়ের গর্ভজাত সন্তান, ইহা সকলেই জানেন। ভারতেতিহাসে বিশিষ্ট মুসলমান পরিবারের মধ্যে এরূপ হিন্দুর সহিত বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনের দৃষ্টান্ত বিরল নহে। কিন্তু দিল্লী-সম্রাট নিন্দাসমালোচনার অনেক উপরে; তাঁহার পক্ষে হিন্দু সংস্পর্শে কোন দোষ ঘটিতে না পারে। বিশেষতঃ, যে কথা অবিসম্বাদিত ঐতিহাসিক সত্য, তাহা না মানিয়া উপায় কি? কিন্তু অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র পরিবারের পক্ষে এরূপ বিধর্ম্মীর সহিত সম্বন্ধ অস্বীকার করিবার চেষ্টা স্বাভাবিক। হিন্দুরমণী হইতে উৎপন্ন মুসলমান ওমরাহেরা তাঁহাদের সমাজে একটু হেয় হইয়া পড়িতেন। কিন্তু দেওয়ান পরিবারের বিভিন্ন শাখার মধ্যে কোন্ শাখা কখন শ্রীপুরের রাজকন্যার নাম ইচ্ছাপূর্ব্বক লোপ করিয়া দিয়াছেন, তাহার কোনও সন্ধান আমরা দিতে পারিতেছি না। হৈবৎপুরের শাখা সোণামণির সহিত সম্বন্ধগ্রথিত, দুর্গাচরণ সান্ন্যাল মহাশয়ের এই কথা আমরা মানিয়া লইতে পারিতেছি না; কারণ সান্ন্যাল মহাশয় তাঁহার মতের পরিপোষক কোনও প্রমাণ প্রয়োগ করেন নাই। ওয়াইজ সাহেব লিখিয়াছেন যে, ত্রিপুরার হরিশপুরে দেওয়ানদিগের যে শাখা আছে, তাহাতে জমিদারের জ্যেষ্ঠপুত্রের নামের সহিত “ঠাকুর” উপাধি যোগ করিবার প্রথা আছে। ইহাতে মনে হয়, এই পরিবারে হিন্দু-প্রভাবান্বিত। ইহাও বলা আবশ্যক যে, বঙ্গদেশে “ঠাকুর” উপাধি শুধু ব্রাহ্মণদিগেরই একচেটিয়া নহে, কায়স্থ এবং অন্যান্য দুই একটি উচ্চ জাতিও ইহা ব্যবহার করিয়া থাকেন। এই উপাধির সহিত রাজকন্যা সোণাইর কোনও সম্বন্ধ আছে কিনা, জানি না। ত্রিপুরারাজের অধীনস্থ উক্ত দেওয়ান পরিবারের এই উপাধি গ্রহণের অন্য কারণও থাকিতে পারে। ত্রিপুরারাজের জ্যেষ্ঠপুত্র ‘যুবরাজ’ এবং দ্বিতীয় পুত্ত্র ‘ঠাকুর’ উপাধিতে পরিচিত হন। তাঁহাদের অধীনস্থ দেওয়ান পরিবার এই প্রথার অনুকরণ করিয়া থাকিতে পারেন।

 এ সম্বন্ধে আমার অপর একটি অনুমান আছে, তাহার সপক্ষে কোনও ঐতিহাসিক যুক্তি দিতে না পারিলেও আমি অনুমানটি সাধারণের গোচর করিতেছি।

 সকলেই অবগত আছেন, ইশাখাঁর বখতিয়ারপুরের প্রাসাদবাটী ৫৮৩ খ্রীষ্টাব্দে সাহবাজখাঁর পরিচালিত সম্রাট্ বাহিনী কর্ত্তৃক ধ্বংসীভূত হয়। ওয়াইজ সাহেব তাঁহার পূর্ব্বোক্ত প্রবন্ধে এ বিষয় উল্লেখ করিয়াছেন। ইশাখাঁর সম্বন্ধীয় দ্বিতায় পালাগানটিতে নিম্নলিখিত বিস্ময়কর কাহিনীটি পাওয়া যাইতেছে। মোগল সৈনিকেরা একদা ইশাখাঁর বংশধরদের অন্তঃপুর দর্শন করায় সেই বংশধর নাকি অপমান বোধ করিয়া স্বয়ং জঙ্গলবাড়ীর প্রাসাদে অগ্নিসংযোগ পূর্ব্বক স্বীয় পরিবার ধ্বংস করিয়া ফেলেন। পালাগানের এই কথা সত্য হইলে এই দেওয়ানের পারিবারিক মর্য্যাদাবোধ উন্মত্ততায় পরিণত হইয়াছিল। কিন্তু এই ব্যাপারটি আমার নিকট কল্পনামূলক বলিয়া মনে হয়। নিরক্ষর কৃষক রচিত পালাগানগুলির বিবরণ সাধারণতঃ সত্য হয়; অন্ততঃ তাহাদের ভ্রম-প্রমাদ গুলি সরল বিশ্বাসানুমোদিত, কিন্তু অর্দ্ধশিক্ষিত গ্রাম্য লেখক যখন নিজের পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের জন্য গল্প প্রণয়ন করেন, তখন তাহাতে তাঁহার কল্পনার উদ্দামলীলা অনেক সময় উৎকট হইয়া উঠে। দ্বিতীয় পালাটির রচয়িতা শেষোক্ত শ্রেণীর বলিয়া মনে হয়। তিনি লিখিয়াছেন যে, দেওয়ান আবদুল যখন শুনিতে পাইলেন, দিল্লীর সৈনিকেরা বাঁশের সিড়ি প্রস্তুত করিয়া তাহার সাহায্যে দেওয়ান-অন্তঃপুরে উঁকি মারিয়া দেখিয়াছে, তখন তাঁহার এতদূর গ্লানি ও অপমান বোধ হইল যে তিনি তৎক্ষণাৎ প্রাসাদের সমস্ত দ্বার রুদ্ধ করিবার আদেশ প্রদান করিয়া ইহাতে অগ্নিসংযোগ পূর্ব্বক স্বীয় পরিবারবর্গকে দগ্ধ করিয়া ফেলিলেন। একটি মাত্র প্রাণী রক্ষা পাইয়াছিল; সেটী ছয়মাসের শিশু মাচুম খাঁ। অন্তঃপুর হইতে একটি পরিচারিকা বাহিরের এক ধীবর রমণীর চুপড়িতে উক্ত শিশুকে নিক্ষেপ করিয়া উহার প্রাণরক্ষা করে। দেওয়ান সাহেব এইরূপে নিজের পরিবার ধ্বংস করিয়া দিল্লীসৈনিকদের উপর প্রতিহিংস। লইলেন এবং স্বীয় মর্য্যদাবোধের একটা অদ্বিতীয় উদাহরণ প্রদান করিলেন!

 ব্যাপারটি আগাগোড়াই কাল্পনিক বলিয়া মনে হয়। তবে ইহার উল্লেখ করিবার আমার একটি কারণ আছে। দিল্লীর সম্রাট্‌বাহিনী এক সময় জঙ্গলবাড়ী প্রাসাদের বিরুদ্ধে অভিযান করিয়া উহার সম্পূর্ণ ধ্বংস সাধন করেন—এইরূপ কোনও ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতি কি এই ব্যাপার সঙ্কেত করিতেছে না? আদম ও বিরাম কেদার রায়ের কন্যাদ্বয়ের পাণিগ্রহণ করিয়া গৃহপ্রত্যাবর্ততনের পর এই ঘটনা ঘটিয়াছিল, এইরূপ লিখিত হইয়াছে। সুতরাং এই কাহিনীতে যদি সত্যের লেশমাত্রও থাকে, তাহা হইলে মনে হয় রাজকুমারেরা নিশ্চয়ই এই শোচনীয় দুর্ঘটনায় প্রাণত্যাগ করেন। মোগল সেনাক কর্ত্তৃক জঙ্গলবাড়ীর প্রাসাদধ্বংস এবং ফলে দেওয়ান পরিবারের বহু লোকের প্রাণনাশ সম্বন্ধে একটি লৌকিক বিশ্বাস প্রচলিত আছে। এইরূপ লোমহর্ষক ঘটনা বাস্তবিকই ঘটিয়া থাকিলে নিশ্চয়ই তাহা সাধারণের মনের উপর আঘাত করিয়া গিয়াছে। কিন্তু যে পালারচয়িতা ইশাখাঁর কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে এইরূপ অদ্ভুত বিবরণ পর্য্যন্ত দিয়া গিয়াছেন যে তিনি হুমায়ুনের সমক্ষে সিংহাসনে উপবেশন করিয়া তাঁহাকে ভীত ও স্তম্ভিত করিয়াছিলেন, সেই পালার রচয়িতা কিরূপে মোগলদের হস্তে দেওয়ানপরিবারের এইরূপ ধ্বংসের কাহিনী লিপিবদ্ধ করিবেন? দেওয়ানদিগের পারিবারিক মর্য্যাদাবুদ্ধি কত বেশী, ইহারই একটী অতিরঞ্জিত পাড়াগেঁয়ে কল্পনা দ্বারা পরিচালিত হইয়া পালাগানরচক সম্ভবতঃ এই অপরূপ কাহিনীটি লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। বহিঃ শত্রুর আক্রমণে প্রাসাদধ্বংস হয় নাই—দেওয়ানেরা নিজেই তাঁহাদের পারিবারিক মর্য্যাদার এইরূপ সমুচ্চ ধারণার বশবর্ত্তী হইয়া নিজেদের ঘরে আগুণ লাগাইয়া ছিলেন, এইরূপ একটা অত্যুৎকট কল্পনা দ্বারা গ্রাম্যকবি হয়ত সত্যগোপন করিবার চেষ্টা পাইয়া থাকিবেন।

 পালারচয়িতা আরও লিখিয়াছেন যে মোগল-সৈন্য সংখ্যায় সহস্র-পরিমিত ছিল এবং ছয় মাস যাবৎ দেওয়ান সাহেবই তাঁহাদের ব্যয়সঙ্কুলান করিয়াছিলেন। ইহাতে মনে হয়, হঠাৎ মোগল সৈন্যের সহিত দেওয়ানদিগের কোনও বিবাদ উপস্থিত হওয়ায় তাহার। উত্তেজিত হইয়া প্রাসাদে অগ্নিসংযোগ করিয়া দেওয়ান পরিবারের বহুলোকের প্রাণবিনাশ করে। পালায় কথিত হইয়াছে যে চৌদ্দ বৎসর পর্য্যন্ত, জঙ্গলবাড়ী প্রাসাদ এই রূপ পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে এবং মাচুম খাঁ চতুর্দ্দশবর্ষ বয়স্ক হইলে স্থানীয় প্রজাবৃন্দ তাঁহাকে রাজ্যভার গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ করে; সেই সময় মাচুম খাঁ পূর্ব্বপুরুষের গদীতে আরোহণ করিতে কৃতসংকল্প হইয়া জীর্ণ প্রাসাদের সংস্কার সাধন করেন।

 সাহবাজ খাঁ কর্ত্তৃক ১৫৮৩ খ্রীষ্টাব্দে ইশাখাঁর বখ্‌তিয়ারপুরের আবাসধ্বংসের কথা আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। দেওয়ান পরিবারের এইরূপ দুর্ঘটনা ও বিপৎপাতের মধ্য দিয়া আমরা সুভদ্রার পুত্ত্রদ্বয়ের বিষাদময় জীবনাবসানের একটি চিত্র অনুমান করিয়া লইতে পারি। ইহাও সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখিতে হইবে যে, আমরা এপর্য্যন্ত দেওয়ান পরিবারের যে সমস্ত বংশতালিকা পাইয়াছি, তাহার কোনটীই সম্পূর্ণ নহে। ওয়াইজের তালিকায় পাওয়া যায়, হৈবৎনগরের শাখা ইশাখাঁর এক ভ্রাতা হইতে উদ্ভুত। কিন্তু ষ্টেপলটণ প্রদত্ত তালিকায় এবং ‘মসনদ আলি ইতিহাসে’ এই শাখা ইশাখাঁ হইতেই উদ্ভুত হওয়ার কথা লিখিত হইয়াছে। এইরূপ বৈষম্য যে শুধু লিখিত বংশাবলীতেই পাওয়া যাইতেছে, তাহা নহে; তালিকা বহির্ভূত মৈমনসিংহের বহু মুসলমান পরিবার ইশাখাঁর বংশজাত বলিয়া দাবী করিয়া থাকেন। এই সমস্ত পরিবারের কোন কোনটি “নজর মরিচার ছেলে” হইতে উৎপন্ন হইতে পারেন। দেওয়ানেরা বিবাহের উপর “নজর মরিচা” নামক যে কর বসাইয়াছিলেন, সেই কর প্রদানে অসমর্থ হিন্দু প্রজাগণের নবপরিণাতা সুন্দরী ভার্য্যারা দেওয়ান অন্তঃপুরে আনীত হইতেন। এসম্বন্ধে আমি মৈমনসিংহগীতিকায় প্রথম খণ্ডে ভূমিকায় সবিস্তারে আলোচনা করিয়াছি। এই “নজর মরিচার ছেলেরা” যে শুধু পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারী হইতেন, তাহ। নহে,—শিষ্টাচারের অনুরোধে তাঁহাদিগকে “দেওয়ান” উপাধিও দেওয়া হইত। এই সমস্ত পরিবারের কোনটিই এখন হিন্দুরমণী হইতে বংশসূচনার বৃত্তান্ত স্বীকার করিবেন না। দেওয়ান পরিবারের যে সমস্ত শাখা দৈন্য এবং হীনতাক্লিষ্ট হইয়া অখ্যাতদশায় উপনীত হইয়া মুল পরিবারের সহিত সম্বন্ধবিচ্ছিন্ন হইয়াছেন, এখন সেই সমস্ত পরিবারের বংশতালিকা সংগ্রহ করা সম্ভবপর নহে। সুরতাং যদি আদম ও বিরামের কোনও সন্তানসন্ততি জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে, তাহা হইলেও পূর্ব্বোক্ত অসুবিধার জন্য তাঁহাদের বংশধরদিগের নাম ও পরিচয় সংগ্রহ করা এখন কতকটা দুঃসাধ্য দাঁড়াইয়াছে। কিন্তু আমি পূর্ব্বেও বলিয়াছি একথা সত্য যে, আদম ও বিরাম ইশাখাঁর সোণামণির গর্ভজাত সন্তান এবং তাঁহাদের মাতা মুসলমান কর্ত্তৃক অপহৃতা হইয়া জহরব্রতপালন অথবা অন্য উপায়ে আত্মহত্যা না করায় তাঁহাদের মাতামহ কেদার রায় ক্রুদ্ধ হইয়া নিরপরাধ বালকদিগের প্রতি আজীবন বিদ্বেষভাব পোষণ এবং তাঁহাদিগের প্রতি প্রতিহিংসা সাধনের বহু চেষ্টা করিয়ছিলেন।[৪]

 দেওয়ানদিগের প্রদত্ত বিবরণে পাওয়া যায় যে, মানসিংহের পত্নী সাশ্রুনেত্রে ইশাখাঁকে তাঁহার স্বামীর সহিত দিল্লী যাইতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। তাহার কারণ এই যে ইশাখাঁ যাইতে সম্মত না হইলে সম্রাটের হস্তে মানসিংহের শিরশ্ছেদ অপরিহার্য্য। ইহাতে মানসিংহের পত্নীর প্রতি কারুণ্য বশতঃ সমাটের ক্রোধ হইতে মানসিংহকে রক্ষা করিবার জন্য ইশাখাঁ বন্দিভাবে দিল্লী যাইতে স্বীকৃত হইয়া স্বেচ্ছায় কারাবাস বরণ করিয়া লইলেন। এই বিবরণ দ্বারা সেনাপতি মানসিংহকে অপদার্থ প্রতিপন্ন করিয়া ইশাখাঁর মহানুভবতা ও বীরত্ব প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা হইয়াছে। ডাক্তার ওয়াইজ এই গল্পে বিশ্বাস করিয়াছেন। কিন্তু একজন মুসলমান পালারচয়িতা এই ঘটনার ভিন্ন রূপ বিবরণ দিয়াছেন এবং তাঁহাই বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া মনে হয়। তাহাতে মানসিংহকে খাট না করিয়া ইশাখাঁকে বড় করা হইয়াছে। উক্ত পালায় কথিত হইয়াছে যে, ইশাখাঁ এগারসিন্দুরের দুর্গে প্রবেশ করিয়া মানসিংহের আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করেন। মানসিংহ ইশাখাঁকে বন্দী করিবার জন্য যে সমস্ত কৌশল প্রয়োগ করেন, পালাগানে সে বিবরণও পাওয়া যায়। এই বিবরণটিতে মানসিংহ বা ইশাখাঁ কাহারও গৌরবহানি না করিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে উভয়ের কৃতিত্ব প্রদর্শন দেখান হইয়াছে। পরিশেষে ইশাখাঁর দিল্লী কারাগার হইতে মুক্তি এবং গুণগ্রাহী মানসিংহের অনুরোধে ইশাখাঁর প্রতি সমাটের সম্মান প্রদর্শনের কথাও প্রদত্ত হইয়াছে।

 ইশাখাঁকে ছাড়া অপর একজন ভূঞার কথাও প্রাসঙ্গিক ভাবে এই পালাগানটিতে আছে। কোন কোন ঐতিহাসিক লিখিয়াছেন যে কেদার রায় মানসিংহের সহিত যুদ্ধকালে একটি আঘাত প্রাপ্ত হন এবং তাহার ফলে তাঁহার মৃত্যু হয়। পালাগানটিতে কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে। মানসিংহ কতিপয় বিদ্রোহীকে দমন করিবার জন্য বঙ্গদেশে আগমন করেন এবং তিনি কেদাররায়ের সহিতও যুদ্ধ করিয়াছিলেন। কেদার রায় মানসিংহের সহিত যুদ্ধে আহত হইয়াছিলেন, ইহা অসম্ভব নহে। পালার বিবরণ অনুসারে যদি করিমুল্লাই বাস্তবিক কেদার রায়কে নিহত করিয়া থাকেন, তাহা হইলেও দিল্লীসম্রাটের নিকট মানসিংহই কেদাররায় বিজয়ী বলিয়া সম্ভবতঃ প্রতিষ্ঠার দাবী করিয়াছিলেন, যেহেতু গ্রাম্য-বীর করিমুল্লার কীর্ত্তি বোধ হয় বাঙ্গালার বাহিরে পঁহুছিতে পারে নাই। মনুয়ার খাঁর পালায় পাওয়া যাইতেছে যে, দিল্লীসেনার সাহায্যে জঙ্গলবাড়ীর সৈন্যকর্ত্তৃক শ্রীপুর ধ্বংস হইয়াছিল, সুতরাং করিমুল্লার বীরত্ব ও শৌর্য্যের কথা মোগল সেনাপতিরা চাপা দিয়া এই ব্যাপারের সমস্ত গৌরব নিজেরাই আত্মসাৎ করিয়াছিলেন, ইহা কিছুই বিচিত্র নহে।

 মুসলমানী ইতিবৃত্তসমূহে পাওয়া যায়, ইশাখাঁর রাজা ঘোড়াঘাট হইতে সমুদ্র পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তবে একথা সত্য যে, বাঙ্গালার অন্যান্য কেদার রায়, চাঁদ রায়, ভুঞারা তাঁহাকে মণ্ডলাধিপতি বলিয়া মানিতেন। প্রতাপাদিত্য প্রভৃতি ভূঞা রাজারা তাঁহার প্রতিদ্বন্দী ছিলেন।

 এই পর্য্যন্ত বলা যাইতে পারে যে, ইশাখাঁ তাঁহাদের কাহারও কাহারও অপেক্ষা বলশালী ছিলেন। কেদার রায় পদ্মাতীরস্থ শ্রীপুরে রাজত্ব করিতেন, এই পদ্মার তীরেই ইশাখাঁর পূর্ব্বতন রাজধানী খিজিরপুর অবস্থিত ছিল। শ্রীপুররাজের ঐশ্বর্য্যের কথা অনেক গ্রন্থে পাওয়া যায়; কেদার রায় এক সময় শ্রীপুর হইতে ঢাকা পর্য্যন্ত প্রশস্ত জনপদে স্বীয় ক্ষমতা পরিচালনা করিতেন। কেদার রায় এবং চাঁদরায়ের বিক্রমপুর পরগণার উপরেও একাধিপত্য ছিল। পদ্মার অপর পারে খিজিরপুরে ইশাখাঁ রাজত্ব করিতেন, এবং ইশাখাঁর সহিত চাঁদরায়-কেদাররায় ভ্রাতৃদ্বয়ের সর্ব্বদা যুদ্ধবিগ্রহ হইত। রাজবাড়ীর যে বিখ্যাত মন্দির বাঙ্গালাদেশের স্থাপত্যশিল্পের একটি শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন ছিল, এবং ওয়াইজ় সাহেব সবিস্তারে যে মন্দিরের বিবরণ দিয়াছেন, তাহা সম্প্রতি করাল পদ্মাগর্ভে বিলীন হইয়াছে। লৌকিক সংস্কারে এই মন্দির কেদাররায়ের নামের সহিত বিজড়িত। কিন্তু এই মন্দিরে মুসলমানী আমলের পূর্ব্বেকার—বৌদ্ধযুগের শিল্পেরও স্পষ্ট নিদর্শন ছিল। ওয়াইজ সাহেব কেদার রায়কে উহার স্থাপন-কর্ত্তা বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া লিখিতেছেন—“দেওয়াল গুলি এগার ইঞ্চি পুরু, এবং সেই সময়কার মুসলমানী আমলের এমারৎসমূহের দেওয়াল অপেক্ষা বৃহত্তর।” এই সুদৃঢ় দেওয়ালগুলি ইস্‌লাম-যুগের পূর্ব্ববর্ত্তী বলিয়া মনে হয়; এবং মন্দিরের সামনে “কেশবের মার দীঘি” বলিয়া যে প্রকাণ্ড জলাশয় দৃষ্ট হয়, উহাতে বোধ হয় উক্ত নামের কোন মহিলার আদেশেই দীঘি ও মন্দির উভয়ই প্রস্তুত হইয়াছিল। একটি গ্রাম্য প্রবাদের উপর নির্ভর করিয়া ওরাইজ সাহেব লিখিয়াছেন, উক্ত দীঘি কেদাররায়ের জনৈক দাসীকর্ত্তৃক নির্ম্মিত হইয়াছিল। একথা আমরা গ্রহণ করিতে পারিনা। মন্দির এবং তৎসংলগ্ন দীঘি সাধারণতঃ একই ব্যক্তির দ্বারা নির্ম্মিত হইয়া থাকে। “কেশোর মা” কথাটার মধ্যে হয়ত একটা নিম্ন শ্রেণীর গন্ধ পাইয়া তাঁহারা ঐরূপ প্রবাদ রচনা করিয়া থাকিবেন। কিন্তু পূর্ব্বকালে সকল শ্রেণীর লোকেরাই প্রাকৃত নামে অভিহিত হইতেন; তখনও শুদ্ধ সংস্কৃত শব্দের দেশময় প্রচলন হয় নাই। আমার অনুমান, মন্দিরটি বৌদ্ধযুগের। চাদঁরায় এবং কেদার রায় উহার সংস্কার সাধন করিয়া সম্ভবতঃ উহাতে নিজেদের নাম সংযোগ করিয়া থাকিবেন। মন্দিরের নির্ম্মাণ কৌশল এবং স্থাপত্যের বিশেষজ্ঞ অনুসারে আমরা এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি। এই মন্দিরের ধ্বংসে পূর্ব্ববঙ্গে বৌদ্ধযুগের একটি বিশিষ্ট স্থাপত্যকীর্ত্তি লুপ্ত হইয়াছে।

 কথিত আছে আকবরের রাজত্বকালে বঙ্গদেশ জরিপ হওয়ার পর ইশাখাঁ পূর্ব্ববঙ্গে বাইশটি পরগণা দখল করেন। পালা গানটিতে এই পরগণাগুলির নাম দেখিতে পাওয়া যায়। দেওয়ানপরিবারের আদি-নিবাস অযোধ্যা জেলার বাইশওয়ারী নামক স্থান বলিয়া উক্ত হইয়াছে। স্টেপল্‌টন বলেন, “বাইশ” এবং “য়ারা” “ও” অক্ষরের উভয় পার্শ্বে ফাঁক না দিয়া লিখিত হইয়া বাইশওয়ারায় পরিণত হইয়াছে। রাজপুতাধিকৃত বাইশটি পরগণার সহিত বাইশওয়ারা নামের সম্বন্ধ আছে। ইশাখাঁ যে পূর্ব্ববঙ্গে বাইশটি পরগণার আধিপত্য লাভ করেন, এই কথাটিও বাইশওয়ারা রাজপুতবংশের পূর্ব্ব বৈভবের চিরাগত সংস্কারের আভাস প্রদান করিতেছে।

 পালাগানগুলিতে ষোড়শ শতাব্দীতে প্রচলিত পূর্ব্ববঙ্গের আচার ব্যবহার যথাযথভাবে প্রদত্ত হইয়াছে। সেই যুগে মৈমনসিংহে যে সমস্ত “বাঙ্গালা” ঘর নির্ম্মিত হইত, তাহার বিস্তৃত বিবরণ এই গানগুলির অনেক স্থলেই পাওয়া যায়। ময়ুর, সারস ও মাছরাঙ্গা পাখীর পালকে ছাদগুলি সাজান হইত, আমীর ওমরাহদিগের প্রাসাদের স্ফটিকের স্তম্ভ নির্ম্মাণ করা একটা প্রথা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। মজলিস্ জেলালের প্রাসাদ সমূহের দেউড়িতে এখনও সেইরূপ স্তম্ভ গুলির ভগ্নাবশেষ দৃষ্ট হয়। বড় বড় নৌকাকে “কোশা” বলা হইত, পালায় ইহার উল্লেখ পাই। “কোশা” নাম এখনও প্রচলিত আছে। পালা-গানগুলিতে কথিত হইয়াছে যে যুদ্ধে ব্যবহৃত নৌশ্রেণীর বহর এক ক্রোশ পর্য্যন্ত বিস্তৃত থাকিত। অবশ্য ইশাখাঁর “কোশা” খুব বড় হইলেও, অতি প্রাচীন কালের হিন্দুদিগের বিপুলায়তন ডিঙ্গার মত ছিল না। প্রাচীন কালে খুব বড় ডিঙ্গা তৈয়ারী হইত। বাবিলন ও মিসরবাসিগণ সুবৃহৎ সৌধনির্ম্মাণে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন; ভারতবর্ষেও বহুদিন পর্য্যন্ত বিশাল সৌধ ও প্রকাণ্ড মূর্তি নির্ম্মাণের প্রথা প্রচলিত ছিল। চৈনিক পরিব্রাজক হুয়েন সাং উত্তর ভারতে অক্টারলোনি মনুমেণ্টের মত উচ্চ, অতিকায় বুদ্ধমূর্ত্তি দেখিয়া গিয়াছিলেন; সে ত মাত্র সপ্তম শতাব্দীর কথা।

 পালাগানে পাইতেছি, উচ্চপদস্থ মুসলমান মহিলাগণ পার্সী সাড়ী পরিতেন এবং সম্ভ্রান্ত মুসলমান যুবকেরা মিশরে প্রস্তুত জামা পছন্দ করিতেন। তাঁহারা আরবের টুপী এবং পার্সী শিল্পিনির্ম্মিত মণিমুক্তা খচিত পাদুকা ব্যবহার করিতেন।

 ওয়াইজ সাহেব জঙ্গলবাড়ী দেওয়ান পরিবারে রক্ষিত তিনটি সনদের উল্লেখ করিয়াছেন।

 প্রথমটি সাহসুজা প্রদত্ত, উহার তারিখ ২১ জুলাস, সন ১০৭ সাহজাহান অর্থাৎ ১৬৪৭ খ্রীঃ। ইহাতে দেওয়ান পরিবারের আহম্মদ ও ইওয়ার মহম্মদ উভয়কে এক সহযোগে ইৎকুইদ খাঁর নিকট সরকারের রাজস্ব প্রদান করিবার আদেশ প্রদত্ত হইয়াছে। ইহাতে

 দ্বিতীয় সনদের কাল ১০৫৯ হিজয়ী অর্থাৎ ১৬৪৯ খৃঃ। ইহাতে রাজকীয় মনসবদার এবং অন্যান্য কর্ম্মচারিদিগের উপর সরকারের নির্ম্মিত কয়েকটি জাহাজঘাটা সমর্পণ করিবার আদেশ লিপিবদ্ধ হইয়াছে; ইহাও সাহসুজা প্রদত্ত।

 তৃতীয় সনদের তারিখ ১৭০০ খ্রীঃ। ইহাতে দিল্লীশ্বরের প্রতিনিধি আজিমউসখাঁ হিবৎমহম্মদকে ৩৭ খানি “কোশা” এবং প্রতি “কোশায়” ৩২ জন করিয়া লোক প্রস্তুত রাখিবার জন্য এবং বুদক্‌হাল প্রভৃতি পরগণার রাজস্ব স্বরূপ ১০২৬৭৭, টাকা প্রদান করিবার আদেশ দিতেছেন।

 মনুয়ারখাঁর পালাগানটিতে গ্রাম্যগীতির স্বাভাবিক সৌন্দর্য্য এবং সরলতার অভাব দৃষ্ট হয়। এই গানটি পাণ্ডিত্যাভিমানী পাড়া গেঁয়ে কবির অজ্ঞতা এবং ভারতচন্দ্রীয় যুগের রুচি বিকারের দ্বারা বিড়ম্বিত হইয়াছে। ভারতচন্দ্রের শব্দসম্পদ ও ছন্দোবৈচিত্র যেরূপ তাঁহার অশ্লীলতাদোষকে কতক পরিমাণে ঢাকিয়া রাখিয়াছে, তাঁহার অনুকরণকারীদিগের সেইরূপ পাণ্ডিত্য ও প্রয়োগচাতুর্য্য কিছুমাত্র না থাকায় তাঁহাদের দোষসমূহ পাঠকের সমক্ষে নগ্ন অবস্থায় উপস্থিত হইয়া থাকে। এই পালাগানটিতে এরূপ দোষ যথেষ্ট পরিমাণে থাকিলেও ইহাতে মনুয়ার খাঁর সহিত সাহসুজার কলহ ও মিত্রতাসূচক নানা ব্যাপার ঘটিত অনেক ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যাইতেছে। তাহা হইতে বিড়ম্বিত রাজকুমার সাহসুজার অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনেতিহাসের শেষ অধ্যায়ের উপর কতকটা আলোপাত হইয়াছে। এই পালাগানটির বিবরণ এবং মুসলমান কবি আওয়ালের গ্রন্থাবলী হইতেই সাহসুজার শেষ জীবনের ইতিহাসের কতকটা উপাদান পাওয়া যাইতে পারে। মানুয়ারের গান আমরা বারান্তরে প্রকাশ করিব।

 এই সমস্ত ঐতিহাসিক পালাগানে যে কবিত্বের বিশেষ নিদর্শন পাওয়া যাইবে, ইহা আশা করা যায় না। কিন্তু ফিরোজখাঁর পালার শেষদিকে সাখিনার মৃত্যুর যে চিত্র প্রদর্শিত হইয়াছে, তাহা এই মহীয়সী রমণীর অদ্ভুত প্রেম ও ত্যাগের মহিমায় এবং গ্রাম্যকবির সরল বর্ণনাভঙ্গীতে সমুজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে।

 অমরা প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় ইহার বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছি। এই পালাগান সমূহে কবিত্ব না থাকিলেও যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় আছে। এই সকল বর্ণনায় পাঠক এমন একটা সহজ স্বচ্ছন্দ বর্ণনা-ক্রম পাইবেন, যাহা আধুনিক যুগের কোন কোন লেখকের আড়ম্বরপূর্ণ ও শব্দবহুল রচনায় পাওয়া যাইবে না। অনাড়ম্বর সরল রচনা-ভঙ্গী এই বর্ণনাগুলির একটি বিশেষত্ব; যেখানে এক কথায় ভাবপ্রকাশ হইতে পারে, পালারচয়িতা কখনও সেখানে একাধিক শব্দ প্রয়োগ করিয়া রচনার কলেবর বৃদ্ধি করেন নাই।

দেওয়ান পরিবারের বংশলতা।

রাজা ধনপৎ সিং (বাইশ-ওয়ারা রাজপুত, অযোধ্যা)
রাজা ভগীরথ সিং
(১) কালিদাস গজদানী (সুলেমান খাঁ)
(২) দায়ুদ খাঁ(২) ইশাখাঁ
(৩) মুশা খাঁ(৩) মহহ্মদ খাঁ
(৪) মাচুমখাঁ(৪) এওয়াজ মামুদ খাঁ
(১০৫৯-১০৭৮ খ্রীঃ)
(৫) মনুয়ার খাঁ(৫) হৈয়ৎ খাঁ
(৬) সেরিফ খাঁ(৬) মহাবৎ খাঁ(৬) আদম খাঁ(৬) হৈবৎ খাঁ
(মনাই খাঁ)
(৭) আছালত খাঁ(৭) মোলায়েম খাঁ(৭) মুল্‌তফ্ খাঁ(৭) এওয়াজ মহম্মদ(৭) আবদুল্লা খাঁ
(৮) আলুর খাঁ(৮) মনরুদ খাঁ
(৯) জোলকরণ খাঁ
(১০) সোণা নেওয়াজ খাঁ
(বাং ১২৪৭)
(১১) খোদা নেওয়াজ খাঁ (১২৬৬ বাং)(১১) নবি নেওয়াজ খাঁ
(সাচিপণ দরিপা, ঢাকা)
(১২) রহিম নেওয়াজ খাঁ(১২) এলাহা নেওয়াজ খাঁ
(বাং ১২৭৯, ১৮৭২ খ্রীঃ)

দেওয়ানদিগের সম্বন্ধে আরও কতকগুলি জ্ঞাতব্য বিষয়ে নিম্নে প্রদত্ত হইল।

 (১) স্বর্ণাক্ষরে লিখিত, সম্রাট্ সাজাহান কর্ত্তৃক দেওয়ান এওয়াজ মহম্মদকে প্রদত্ত দুইটি সনদ এওয়াজ মহম্মাদের বংশধরদিগের নিকট আছে।

 (২) জঙ্গলবাড়ীর ছয় মাইল দূরে দেওয়ান হৈবৎ খাঁ হৈবনগর নামক একটি নগর স্থাপিত করেন।

 (৩) দেওয়ান সাহনেওয়াজ খাঁ দেওয়ানপরিবারের অনেক মূল্যবান্ কাগজপত্র নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছিলেন।

 (৪) দেওয়ান খোদা নেওয়াজ খাঁ কিছু দিনের জন্য ফকির হইয়া পরে আবার বিষয়কর্ম্মে মনোনিবেশ করিয়াছিলেন।

 (৫) দেওয়ান ইব্রাহিম খাঁ জনৈক উপযুক্ত পণ্ডিতের দ্বারা সমগ্র মহাভারতের আবৃত্তি ও ব্যাখ্যা করাইয়া মৈমনসিংহবাসীদিগকে শুনাইয়াছিলেন; এই উদ্দেশ্যে তিনি পঞ্চ সহস্র মুদ্রা ব্যয় করেন।

 (৬) দেওয়ান রহিমদাদ খাঁর আদেশে প্রথমতঃ দেওয়ানপরিবারের ইতিহাস লিখিত হইয়াছিল। তিনি অত্যন্ত প্রতিভাশালী ব্যক্তি ছিলেন, এবং তাঁহার বিবিধ সদ্‌গুণ——বিশেষতঃ কলাবিদ্যানৈপুণ্যের প্রশংসা এখনও অনেকের মুখে শোনা যায়। তিনি স্বহস্তে সুন্দর হস্তিদন্তের মূর্ত্তি নির্মাণ করিতে পারিতেন। তিনি নিজে সেতার, এস্রাজ, বীণ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন এবং স্বয়ং সঙ্গীতশাস্ত্রবিশারদ ছিলেন। লেখ্যবিদ্যায়ও তাঁহার অসাধারণ দক্ষতা ছিল; মৈমনসিংহের বহু স্থানে তাঁহার লিপিদক্ষতার নিদর্শন এখনও বিদ্যমান রহিয়াছে।

 এই প্রসিদ্ধবংশের দেওয়ান রহিমদাদের ভ্রাতা দেওয়ান আজিমদাদ খাঁ। তিনি সচ্চরিত্র এবং প্রতিভাসম্পন্ন যুবক।

 দেওয়ানেরা পূর্ব্বে ময়মনসিংহের হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজেরই শীর্ষস্থানীয় ছিলেন। এমন কি তাঁহাদের বিনানুমতিতে হিন্দুগৃহেও দোল, দুর্গোৎসব প্রভৃতি পূজার অনুষ্ঠান হইত না। লোকের রুচি ও আদবকায়দার প্রতিও তাঁহাদের লক্ষ্য ও কর্ত্তৃত্ব ছিল। কোন কোন অলঙ্কার এবং পরিচ্ছদ ধারণ করিতে হইলে তাঁহাদের অনুমতি লইতে হইত। এখনও স্থানীয় নিম্নশ্রেণীস্থ লোকেরা গৃহবিশেষ নির্ম্মাণ করিবার জন্য দেওয়ানদের অনুমতি লইয়া থাকে।



দেওয়ান ইশাখাঁ মসনদালি

ঈশাখাঁ দেওয়ানের পালা

(১)

দিশা— বাজেরে বাজেরে ডংকা ইশাখাঁর নামে বাজে।
পইছমালিয়া[৫] দেশে ভাইরে শুন দিয়া মন।
ধনপৎ সিং নামে রাজা একজন॥
তালেবর[৬] সেই রাজা ধন অদ্যুনাই[৭]
বান্দি গেলাম কত লেখাজুখা নাই॥
দিল্লীর বাস্‌সার[৮] সাথে দুস্তি[৯] তার ভারী।
আপদে বিপদে থাকে ছেওয়ার[১০] মত ঘেরি॥
তার যে বংশের বেটা রাজা ভগীরথ।
জান্ দিয়া করে মিয়া[১১] পরজার[১২] ইত[১৩]
সেই না দয়াল রাজা শুনখাইন[১৪] দিয়া মন।
হজ কামাইতে[১৫] আইলা বাংলার ভুবন॥
নানান্ জাগা[১৬] ঘুইরা[১৭] আইলা গৌড়ের সরে[১৮]
গয়াসউদ্দিন মিয়া যথায় রাজত্বি করে॥১২

গয়াসউদ্দিন মিয়ার লগে[১৯] দেখা হইল অর।
আদর করিল মিয়া রাজারে অপার॥
বড়র মান বড়য়[২০] জানে অন্যে জানব[২১] কি।
কুত্তায়[২২] না জানে ভাইরে কিবা চিজ্ ঘি॥১৬
ভগীরথে চিন্যা[২৩] ভালা[২৪] কত যতন কইরে[২৫]
খোসামোদ কইরা রাখে গৌড়ের সরে॥
গৌড়ের না[২৬] সরে থাক্যা[২৭] শুন্‌খাইন্ দিয়া মন।
দেওয়ানগিরি করে সুখে সেই সে সুজন॥২০
এমন সুজান দেওয়ান আর নাহি আছে।
পর্‌জা আর পুত্রে নাই ভেদ তার কাছে॥
ডেমাক্[২৮] না করে তেনি[২৯] দেওয়ান বলিয়া।
খুসনাম[৩০] হইল তার পরজারে পালিয়া॥২৪
তার যে বংশের বেটা দেওয়ান কালিদাস।
জৈন উদ্দিনের দেওয়ান হইয়া গৌড়ে করে বাস॥
নাইত সুন্দর ভাইরে পুরুষ এমন।
ঝিলিমিলি করে রূপ জিনিয়া তপন॥২৮
আন্ধাইর[৩১] ঘরেতে যদি থাকে দেওয়ান বইয়া[৩২]
তার আলোতে ঘর যায় পশর[৩৩] হইয়া॥

এমন সুন্দর রূপ না হয় কদাচন।
রূপেতে জিন্যাছে[৩৪] দেওয়ান রতির মদন॥৩২
তার সমান ধার্ম্মিক নাই তির্‌ভুবনে[৩৫]
নিত্যি[৩৬] নিত্যি করে দান দুঃখী ফকিরগণে॥
তার যে মজলিস ভরা পণ্ডিতে ফকিরে।
পরামিশ[৩৭] কইরা করে দেওয়ানি সুস্থরে[৩৮]৩৬
নিত্যি নিত্যি বোনার হাত্তি[৩৯] বাবুনে[৪০] করে দান।
কালিদাস গজদানী[৪১] হইল তার নাম॥
ইন্দু[৪২] মুছুলমান তার ভেদ কিছু নাই।
সগলে[৪৩] সমান দেখে ইংসা[৪৪] তার নাই॥৪০
দোল দুর্গুৎসব[৪৫] হয় পর্‌তি[৪৬] বছর।
পূজা আশ্রা[৪৭] যত কিছু না যায় পাশর[৪৮]
কালিদাস দেওয়ানের বুদ্ধি বড় দড়[৪৯]
এমন চিজ্ নাই দেশে না আছে তার ঘর[৫০]৪৪
কেউ যদি যায় কিনু[৫১] চিজের লাগিয়া।
অরিশ[৫২] অন্তরে দেয় না দেয় ফিরাইয়া॥

পরবাসী মেমান্[৫৩] যদি যায় তার ঘরে।
তারারে[৫৪] খাওয়ায় দেওয়ান অতি যতন কইরে॥৪৮
তারারে না খাওয়াইয়া দেওয়ান নিজে নাই সে খায়।
এমন ধার্ম্মিক হইতে নাই সে দেখা যায়॥
বাহাদুর সাহেব তখন গৌড়ের নবাব।
রোজা নামাজ দানে কামাইল ছওয়াব[৫৫]৫২
বেটা পুত্রু[৫৬] নাইসে অইল[৫৭] দিলে রইল দুখ।
রাজার সংসার ছাইড়া[৫৮] তেনি গেলা বেস্ত[৫৯] লোক।
তারপরে অইল নবব জোলাল উদ্দিন।
তার আমলে ছিলাইন[৬০] কালিদাস দেওয়ান॥৫৬

(২)

মমিনা খাতুন তার কইনা[৬১] একজন।
এমন সুন্দর যেন আসমানের চান্[৬২]
নবাবের বেটা কত আইলা সাদির তরে।
না পছন্দ হইয়া সবে ফির‍্যা[৬৩] গেলা ঘরে॥

কেউনা[৬৪] দিলের সঙ্গে না পড়িল মিশ।
সগলই[৬৫] কইনার চক্ষে অইল যেমন বিষ॥
এমন যে কইনা তার রূপের বাখান।
বাতাইবাম[৬৬] আমি সবে শুনখাইন মিয়াগণ॥
অগুনির লোক্কা[৬৭] যেমন দেখিতে কইনারে।
শিরেতে দীঘল[৬৮] কেশ কমর[৬৯] বাইয়া[৭০] পড়ে॥
মুখখান যেমন তার পুন্নুমাসীর[৭১] চান।
চৌক্‌[৭২] জিনিয়া যেন মিড়কের[৭৩] নয়ান॥১২
পাও দুইখান গোল যেমন কলাগাছ।
পরীগণ হাইর[৭৪] মানে তার রূপের কাছ॥
পর্‌থম[৭৫] যৌবন কন্যা রূপে ঢলঢল।
সাইর বাসীর[৭৬] সঙ্গে রঙ্গে খলখল॥১৬
হাটিতে মাটিতে ভাসে অঙ্গের লাবনি[৭৭]
কোচের[৭৮] ভারেতে কইয়ান সম্‌কে[৭৯] এলায়[৮০] টানি॥
এমন সুন্দর রূপ কার লাগিয়া।
নিরালা বসিয়া আল্লা রাখ্যাচে সির্‌জিয়া[৮১]২০

সেই ত না কইন্যা একদিন গুছুল[৮২] করত যায়।
হবসি[৮৩] সকলে তার চলে পায় পায়॥
উলামেলা[৮৪] কইরা কইনা পন্থে দিল মেলা।
পন্থ মধ্যে কালিদাসে দেখিল একেলা॥২৪
তারে দেইখা কইনা অইল উন্মত্ত পাগল।
নয়ান ভরিয়া তার সর্ব্বাঙ্গ দেখিল॥
সেইদিন অইতে[৮৫] কইনা নাই সে খায় ভাত।
খানা পিনা ছাড়ল নাই সে ঘুম সারা রাইত॥২৮
লিখন পাঠাইল এক ডাকিয়া বান্দীরে।
লিখন লইয়া যাওরে বান্দী কালিদাসের ঘরে॥
লিখনে লিখিল কইনা শুন কালিদাস।
তোমার লাগিয়া আমার অইয়াছে[৮৬] তিরাষ[৮৭]৩২
তোমারে দেখ্যাছি অইতে মোর লয় মনে।
ঘর সংসায় ছাড়্যা যাই তোমার সনে॥
তোমার যে বন্দি অইয়া কাডাই[৮৮] জীবন।
তুমি যে অইয়াছ আমি[৮৯] আমি অন্ধের নয়ান॥৩৬
লিখন লইয়া বান্দী তবে পন্থে দিল মেলা[৯০]
কালিদাসের সমখে গিয়া দাখিল[৯১] অইলা॥
আচল হইতে খুল্যা বান্দী লিখন খানি দিল।
মন দিয়া কালিদাস লিখন পড়িল॥৪০

লিখন পড়িয়া দেওয়ান হাসে মনে মনে।
তার পরে লেখিল উত্তর অতি সঙ্গোপনে॥
শুন কইনা আরজ্[৯২] আমার শুন দিয়া মন।
তোমার লাগিয়া আমার দুঃখিত পরাণ॥৪৪
আমি হই ইন্দু আর তুমি মুছুলমান।
সাদি কেমন হয় নইলে সমানে সমান॥
পরাণ থাকিতে নাই সে মুছুলমান হইব।
রূপের লাগিয়া আমি জাতি নাই সে দিব॥৪৮
দুয়ারে দুয়ারে খাইবাম্ ভিক্ষা মাগিয়া।
ধর্ম্ম না ডুবাইবাম কইরা মুছুলমানে বিয়া[৯৩]
ইন্দু[৯৪] না অইয়া যদি অইতাম মুছুলমান।
তা অইলে পুরাইতাম কইনা তোমার যে কাম॥৫২
ধরম্ যদি ডুবাই কইনা হেলা করিয়া।
সাত জন্ম যাইব আমার দুজক[৯৫] ভুগিয়া॥
শুন শুন কইনা আরে চিত্তে ক্ষেমা দেও।
তোমার যে মনের ভাব ফিরাইয়া লও॥৫৬
লিখন উত্তর লইয়া বান্দী বিদায় হইল।
কইনার বুগল[৯৬] আস্যা দাখিল হইল॥৫৮

(৩)

মমিনা খাতুন লিখন পইড়া[৯৭] পাইল লাজ।
দেওয়ানের কথা শুন্যা পড়ল মাথায় বাজ
ঘুম ছাড়িল কইনা ভাত আর পানি।
দিলেতে কইরাছে পণ তেজিবে পরাণি॥

শেষ চেষ্টা কইরা দেখব ছলে কিবা বলে।
তা পরে যাই ঘটে যা থাকে কপালে॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া কইনা কি কাম করিল।
ছলে কালিদাসের জাতি মার্‌তে যুক্তি কইল[৯৮]
নিরালা ডাকিয়া দেওয়ানের পাকুরিয়া[৯৯] চাকরে।
গোপন মতে দুইজনে ফন্দি যে করে॥
ফন্দি করিল খানা তৈয়ার করিয়া।
এইনা চাকরে দিয়া দিব পাঠাইয়া॥১২
এই না চাকর যদি যায় খানা লইয়া।
ফুইদ্[১০০] না করিব কিছু ফালব খাইয়া॥
এইনা কাম যদি চাকর করিবারে পারে।
এক পুড়া জমী বাড়ী লেখ্যা দিব তারে॥১৬
সুন্দর বউ আন্যা দিব সাদি করাইয়া।
চাকরের দুঃখু তবে যাইব চলিয়া॥
এই কথা শুন্যা চাকর দিল খুসী অইল।
সরমত[১০১] অইয়া পরে বিদায় লইল॥২০
তার পরেত কইনা শুন কোন কাম করে।
ভেড়ার যে গুস্তু দিয়া কাবাব তৈয়ার করে॥
গরুর গুস্তু[১০২] দিয়া আর ছালুন বানাইয়া।
কুর্ম্মা কুপ্তা আর কত দিল পাঠাইয়া॥২৪
চাকরে কয় দিয়া খানা কালিদাস গোচরে।
নতুন রকম খানা আইজ দিলাম তৈয়ার কইরে॥
খানা খাইয়া কালিদাস সুখী অইল মনে।
রজনী গুয়াইল বড় হরষিত মনে॥২৮

পরভাতে উঠিয়া চাকর কয় তার নিকটে।
গরুর গুস্তু কালুকা রাত্রে খাওয়াইল[১০৩] কপটে॥
গরুর গুস্তু দিয়া খাইলা, দেখিয়া নয়ানে।
জাইত[১০৪] মারিলাম তোমার কপট সন্ধানে[১০৫]৩২
গরুর গুস্তু খাইচ তোমার জাত্তি না রইল।
এই না কহিয়া চাকর চম্পট মারিল॥৩৪

(8)

চাকরের কথা শুন্যা কান্দে দেওয়ান কালিদাস।
কার সল্লাতে[১০৬] আমার করল সর্ব্বনাশ॥
মাথা থাপাইয়া[১০৭] দেওয়ান কাঁন্দিতে লাগিল।
কোন্ না আখেজে[১০৮] হায়রে জাত্তি মারিল॥
কান্দিয়া কান্দিয়া দেওয়ান হইল পাগল।
ভাত পানি ছাড়্যা পরে পন্থে মেলা দিল॥
জাইত যাউয়া[১০৯] অইয়া আর না রাখবাম পরাণি।
গলাত[১১০] কলস বান্ধ্যা আমি মরিবাম অখনি॥
জেলাল উদ্দিন নবাব এই কথা শুনিয়া।
পন্থ হইতে কালিদাসে আনে ধরাইয়া॥
বারাৎ[১১১] বসাইয়া তারে মধুর বচনে।
বুঝাইল কত মিয়া ডাক্যা[১১২] সঙ্গোপনে॥১২
খণ্ডানি না যায় দেখ আল্লার বিধান।
নছিবে আছিল তাই অইছ মুছুলমান[১১৩]

পাগলামি করলে কিছু অইব নাহি লাভ।
দিল খুসী অও[১১৪] ছাড়্যা দিলের দুঃখু ভাব॥১৬
মুছুলমান অইছ যদি শুন মন দিয়া।
আমার যে কইনা আছে তারে কর বিয়া॥
খুপছুরত[১১৫] কইনা আমার মমিনা খাতুন।
আমি কই তার সঙ্গে সাদির কারণ॥২০
বেটা পুত্র নাই মোর জান তুমি ভাল[১১৬]
আমি মইলে আমার যত পাইবা সকল॥
ধন দৌলত যত আছে সকল তোমার।
মুছুলমান অইচ তাতে সুখ অইল অপার॥২৪
এই সগল[১১৭] কথা শুন্যা চিন্তে মনে মনে।
পাগলামি করি আমি কিসের কারণে॥
মুছুলমান আইছি আর ইন্দু না অইব।
অমূল্য জীবন নাইসে ছালি[১১৮] করিব॥২৮
সাদি কইরা থাকি আমি গৌড়ের সহরে।
নবাব গিরি[১১৯] করি সুখে নাই যে পড়বাম ফেরে[১২০]
তার পরে শুনিয়া রাখ যত মমিনগণ[১২১]
কালিদাসের নাম রাখে দেওয়ান সোলেমান॥৩২

জেতাচান্দে[১২২] জুম্বা[১২৩] বারে ভালা দিন[১২৪] দেখিয়া।
সোলেমানের মমিনার অইয়া গেল বিয়া॥
লেখ্যা পড়্যা যৈতক[১২৫] দিল যা আছে না আছে।
জেলাল মরিলে সব পাইব তার পাছে॥৩৬
সাদী কইরা সোলেমান চিত্তে খুসী হইয়া।
মমিনা খাতুনের সাথে গেল যে মিলিয়া॥
তার গর্ভে পয়দা অইল পুত্র দুইজন।
বাছিয়া রাখে দাউস আর ইশাখাঁ নাম॥৪০
পনর বছর সোলেমান নবাবী করিয়া।
খোদার আদেশে গেল বেহেস্ত চলিয়া॥
তারপরে দাউদখাঁ গৌড়ের মালীক অইল।
গর্ব্ব‌ কইরা দিল্লীর খেরাজ[১২৬] বন্ধ করিল॥৪৪
খবর পাঠাইল বাস্‌সা খিরাজের লাগিয়া।
বাস্‌সার নফরে দিল অপমান করিয়া॥
বেইজ্জতি অইয়া নফরে[১২৭] কোন্ কাম করে।
বেমালুম আইল পরে দিল্লীর যে সরে॥৪৮
বাস্‌সারে ছেলাম দিয়া কয় তার কাছে।
দাউদখাঁ মার‍্যাছে আমায় জান্[১২৮] খালি আছে॥
সর্ব্বাঙ্গ অইছে অবশ মাইরের চোটে।
এমন শত্রু ডংশ করণ[১২৯] বলে কি কপটে॥৫২
গোসা অইয়া বাস্‌সা ফৌজ পাটায় গৌড়ের সরে।
দিল্লীতে আনিতে বান্ধ্যা দুষ্ট দাউদ খাঁরে॥

জঙ্গ[১৩০] অইল ভারী গৌড়ের ময়দানে।
মরিল দাউদ খাঁ জঙ্গে না রইল পরাণে॥৫৬

(৫)

তার পরে মালীক অইল ইশাখাঁ দেওয়ান।
জান দিয়া পালে পরজা পুত্রের সমান॥
তিন বচ্ছর পরে মিয়া কোন্ কাম করিল।
দিল্লীর খেরাজ মিয়া আটক করিল॥
এই কথা শুন্যা মিয়া কোন্ কাম করে।
পাচ কাহন ফৌজ পাঠায় গৌড়ের সহরে॥
হুকুম করিল বাস্‌সা শুনহ সকলে।
ইশাখারে বান্ধ্যা আনবা ছলে কিবা বলে॥
ফৌজদার শাহবাজখা জানা দেশ বিদেশে।
সেই মিয়া আইল রণে বাস্‌সার আরদেশে[১৩১]
তার সাথে জঙ্গে লড়ে এমন বীর নাই।
আছড়াইয়া মারে বাস্‌সার আপদ বালাই[১৩২]১২
সেই ত না মিয়া যখন জঙ্গেতে নামিল।
অস্র[১৩৩] লইয়া ইশাখাঁ সাম্‌নে খাড়া অইল॥
ইশাখাঁ দেওয়ান কিন্তু মালে মস্তবীর।
জঙ্গেতে লামিলে কেবল ছেওয়ায়[১৩৪] শত্রুর শির॥১৬
সাহবাজ আর ইশাখাঁ সমানে সমান।
লড়িল জঙ্গেতে হাসেন হুসেন সমান॥
ইশাখাঁর ফৌজ যত সকলি মরিল।
একেলা ইশাখাঁ জঙ্গে ফাফর অইল॥২০

উপায় না দেখ্যা মিয়া কোন্ কাম করে।
চম্পট মারিয়া পড়ে রণ থাক্যা সরে॥
বন জঙ্গল নদী নালা কত পারি দিয়া।
শত্রুর হাত অইতে মিয়া গেল পলাইয়া॥২৪
পলাইয়া গেল মিয়া চাটিগা সহরে।
এমন বাপের বেটা নাই তারে যে ধরে॥
চাটিগা অইতে মিয়া ঢাকার সর অইয়া।
জঙ্গলায় জঙ্গলায় কত রইল ঘুরিয়া॥২৮
চাটিগা অইতে মিয়আ বিলাই[১৩৫] আন্যা ছিল।
তার খাইবার কিছু সঙ্গে না আছিল॥
এক জঙ্গলে মিয়া কোন্ কাম করে।
সঙ্গের বিলাই যত জঙ্গল মধ্যে ছাড়ে॥৩২
বিলাইয়ে ধরিতে যায় যখন উন্দুরে[১৩৬]
উন্দুরে ধরিয়া তথা বিলাইয়ে মারে॥
এহা দেখ্যা ইশাখাঁ ভাবে মনে মনে।
অচরিত[১৩৭] কাণ্ড আমি দেখি এই খানে॥৩৬
উন্দূরে বিলাই মারে আর নাই সে দেখি।
এইখান আমার গাট্টি বোচ্‌কা যত রাখি॥
এইখান থাক্‌লে অইব অসাধ্যি সাধন।
এইখান করবাম বাড়ী বাস্তব্যির[১৩৮] কারণ॥৪০
রাম লক্ষ্মণ দুই ভাই কোচের পরধান[১৩৯]
বাস্তব্যি করে এই বলে অইয়া[১৪০] গদিয়ান॥
রাত্রি নিশাকালে ইশা কোন্ কাম করে।
রাম লক্ষ্মণ দুই ভাইরে গেল মারিবারে॥৪৪

টের পাইয়া রাম লক্ষ্মণ গেল পলাইয়া।
নিরুদ্দেশ অইয়া গেল জঙ্গল ছাড়িয়া॥
পরে ত জঙ্গল কাট্যা বানায় জঙ্গল বাড়ী সর।
নক্সা নমুনা[১৪১] কইরা বান্‌ল বাড়ী ঘর॥৪৮
ভিতর আঙ্গিনায় মিয়া যত ঘর বান্ধিল।
মাছুয়া রাঙ্গার পাখ দিয়া ছানি তাতে দিল॥
আয়না দিয়া বেড়িয়াছে যত ঘর খানি।
ঝিলমিল ঝিলমিল করে যত ফটিকের ঠুনি[১৪২]৫২
দুধবগার[১৪৩] পাখে চাইল বাইর আঙ্গিনা।
বাড়ীর চাইর দিগে পরে কাটিছে গাঙ্গিনা॥
বার বাঙ্গলার ঘর ছাইল মউরের পাখে।
দরবারের বেলা মিয়া সেই ঘরে থাকে॥৫৫
বাগান করিল মিয়া কত নমুনার।
কত দিঘী দিছে গোল আর চারিধার[১৪৪]
আছিল জঙ্গল পুরী বাঘ ভালুকের বাসা।
জঙ্গল বাড়ী সর তাতে অইল খোলাসা[১৪৫]৬০
চাঁদের সমান পুরী ঝলমল করে।
এমন সর না অইল দুনিয়া মাঝারে॥
জঙ্গল বাড়ী থাক্যা মিয়া করে কোন্ কাম।
রাজত্বি বাড়াইতে মিয়া দেয় জান প্রাণ॥৬৪
ফৌজ বাড়াইল কত লেখা জুকা নাই।
কিল্লা[১৪৬] করিল কত তার সীমা নাই॥
এই কথা শুনিয়া পরে বাস্‌সা দিল্লীর।
ইশাখাঁরে দিল্লী যাইতে পাঠাইল খবর॥৬৮

এহা ত শুনিয়া ইশা কোন্ কাম করে।
পাথর চাপা দিয়া রাখে বাস্‌সার নফরে॥
এক দুই করা পরে বচ্ছর গোয়াইল।
তত্রাচ নফর নাই সে দিল্লীতে ফিরিল॥৭২
বার চাইয়া বাস্‌সা দিল ফৌজ পাঠাইয়া।
ফৌজের লগে রাজা মানসিংহে দিয়া॥
মানসিংহের সঙ্গে লড়ে এমন বেটা নাই।
কচুগাছ কাটে জঙ্গে দুষমন্ বালাই[১৪৭]৭৬
বুকাই নগরে পরথম জঙ্গ যে অইল।
বুকাই নগর ছাড়্যা ইশা সেরপুরে গেল॥
তারপর গেল মিয়া কেল্লা দেওয়ান বাগে।
সেইখান তনে গেল মিয়া মুড়াপাড়ার আগে॥৮০
এই মতে গেল মিয়া যত কিল্লা আছে।
মানসিংহ যায় কেবল তার পাছে পাছে॥
ধরিতে না পারে রাজা হয়রান হইল।
ছল কইরা ধরতে ইশায় ফন্দি করিল॥৮৪
অবশেষে আশ্রা[১৪৮] লইল এগার সিন্দুরে।
ফৌজ লইয়া মানসিংহ ফিরে দিল্লীর পরে॥
এই কথা শুনিয়া ইশা ফৌজদারগণ সঙ্গে।
উলা মেলা করে রাত্রে বৈসা মন রঙ্গে॥৮৬
হেনকালে মানসিং কোন্ কাম করে।
লোয়ার[১৪৯] পিনরা[১৫০] পাত্যা রাখে কিল্লার দুয়ারে॥
পরতি[১৫১] দুয়ারে পিনরা রাখ্যাচে পাতিয়া।
যে যেখান দিয়া বাইর অয়[১৫২] থাকব বদ্ধ অইয়া॥৯০

তারপরে কিল্লার মধ্যে অগুনি ধরাইল।
ভিতরের লোক যত বাইর অইতে লাগল॥
এই মতে ইশাখাঁ অইল যে বন্ধ।
বন্দী অইয়া ইশাখাঁ যে অইয়া গেল ধুন্ধ[১৫৩]৯৪
জিনরা সমেত পরে দেওয়ান ঈশা খাঁরে।
আত্তির[১৫৪] উপরে কইরা তারে পাঠায় দিল্লীর সরে[১৫৫]
এক দুই কইরা পরে হপ্তা খানিক গেল।
বন্দী দেওয়ানেরে কেউ ফুইদ[১৫৬] না করিল॥৯৮
সিঙ্গি[১৫৭] যেমন বদ্ধ অইয়া থাকে খোয়ারের মাঝে।
সেই মত ইশা খাঁ যে বদ্ধ অইয়া আছে॥
পেট ভরা ভাত পাণি না দেয় মিয়ারে
খানা পিনার কষ্টে মিয়া পড়িল ফাঁপরে॥১০২
মনে মনে কয় মিয়া যদি ছুটতাম পারি।
দেখাইবাম কেমন বেটায় করে বাস্‌সা গিরি॥
একদিন ত না আকবর সা উজির নাজির লইয়া।
দরবারে বইল বাস্‌সা মানসিংহে ডাকিয়া॥১০৬
আকবর সা জিজ্ঞাস করে জঙ্গের বারতা।
খুসী অইয়া মানসিংহ কয় সেই কথা॥
কত জঙ্গে লড়লাম্ কত পালওয়ান সনে।
ইশা খাঁর মতন বীর না পাইলাম রণে॥১১০
এমন বীর নাই আর দুনিয়া মাঝারে।
তারে বাধ্য রাখলে কাম অইব আখেরে[১৫৮]

খাওন বেগর কষ্ট[১৫৯] দিয়া রাখছুইন্‌[১৬০] এমন জনে।
এমন সোনার অঙ্গ ভইরাছে[১৬১] মৈলানে[১৬২]১১৪
দুষমনের লগে করলে ভালা আচরণ।
একদিন না একদিন সে বুঝব আপনার মন॥
ইশাখাঁ সামান্যি নয় জানা চরাচরে।
যদি ছুট্‌তো পারে তবে ফালব বড় ফেরে॥১১৮
শুনখাইন[১৬৩] বলি তারে নিজে ফুইদ কইরা।
উভের মনের কালি দেউখাইন[১৬৪] দূর কইরা॥
মানসিংহের কথা শুন্যা বাস্‌সা নন্দন।
কারাগারের কাছে গেল ইশাখা সদন॥১২২
তার পরে ইশা খাঁরে সাহেব জিজ্ঞাসে।
বড় দুঃখু পাইলাম আমি তোমার মৈলান বেশে॥
তোমার যে দুঃখু আর বরদাস্ত না মানে।
দিলের দুঃখু করি দূর তোমায় মুক্তি দানে॥১২৬
এই কথা বলিয়া সাহেব কোন্ কাম করে।
নিজ হাতে ইশাখাঁরে দিল মুক্ত কইরে॥
মুক্তি পাইয়া ইশা বাস্‌সার চরণ ধরিল।
ভূমিতে পড়িয়া পরে ক্ষেমা ভিক্ষা চাইল॥১৩০
ঈশা খাঁর আচরণে সন্তুষ্ট অইয়া।
কুলাকুলি করে দুইয়ে যতন করিয়া॥
মসনদে বুয়াইয়া[১৬৫] বাস্‌সা নিজের যে পাশে।
সম্মান করিল কত মনের হরষে॥

১৩৪

মসনদ আলী খিতাব দিয়া দিল বাইশ পরগণা
বাইশ পরগণার মালিকী দিল দশ হাজার টাকা খাজানা
সেরপুর, জোয়ানসাহী আর আলাপসিং
জয়রে সাই, নসিরুজ্যাল আর ময়মনসিং॥১৩৮
খাল্যাজুড়ি, গঙ্গামণ্ডল আর পাইট কাড়া
বরদাখাত, স্বর্ণগ্রাম, বরদাখাতমনরা।
হুশেমসাহী, ভাওয়াল আর মহেশ্বরদী
কাট্‌রার, কুড়িখাই আর সিংধা, হাজরাদি॥১৪২
আর দিল দরজীবাজু, জোয়ার হুশেনপুর
ছন্নদ[১৬৬] লইয়া ইশা খা যায় জঙ্গল বাড়ী ঘর।
এক নাও[১৬৭] দিল্লীর সরে করিল নিরমাণ
দেশে বৈদেশে যার হইল বাখান॥১৪৬
সাড়ে সাত হাজার হাত দীর্ঘ তার ছিল
ফাড়ে[১৬৮] হাজার হাত উচা পঞ্চাশ দিল।
দুই হাজার দাড়ি আছিল সেই নায়ের।
মাঝি আছিল সাধন[১৬৯] পদ্মার পাড়ের॥
পবনের মতন কোশা চলে দাঁড়ের টানে
কখন চলিত কোশা শুকনা জমীনে॥১৫৪
সেইত না কোশাখান একদিন সাজাইয়া
কোশাতে উঠিয়া ইশা চলে মেলা দিয়া।
মেলা দিয়া যায় মিয়া জঙ্গল বাড়ী সরে
দিল্লীর বাস্‌সা বারজন আমলা দিল তারে॥১৫৮
কুলাকুলি কইরা পরে বিদায় অইল।
পবনের মতন কোশা চলিতে লাগিল॥

ষোল হাজার দাঁড়ের টানে শূন্যে দিল উড়া
খাল বিল কত গেল পলকেতে ছাইড়া॥১৬২
তার পরে পড়িল কোশা পদ্মার মাঝেতে।
ভাটি গাঙ্গে চলে কোশা আর বাদামেতে॥
পদ্মা বাইয়া কোশা পরে কত দূর যায়।
শ্রীপুরের সর এক সামনে দেখা যায়॥১৬৬
কেদার রায়ের বাড়ী সেইত শ্রীপুরে
সেই না দেশে রাজা সবে মান্য করে।
পাত্রমিত্র আছে কত হাজার হাজার।
ধন রত্ন দাসদাসী গণা নাই তার॥১৭০
দলান মঠ দিয়া বাড়ী কর‍্যাচে নিরমান।
পদ্মার পাড়ে ঘাট বান্‌চে দিয়া পাথর সান[১৭০]
আথারে পাথারে[১৭১] কত নানা রঙ্গের ঘর।
তেমলা[১৭২] চৌমলা দালান আছয়ে বিস্তর॥১৭৪
ভাটি বাইয়া আইল কোশা শ্রীপুরের ঘাটে।
ধীরে ধীরে চালাইয়া কোশা সবে মিল্যা দেখে॥১৭৬

(৬)

নজর করিল দেওয়ান তেমলার উপরে।
কাইচ[১৭৩] গোটার বরণ এক কইনা খেলা করে॥
তার আলোকে অইল তেমলা পশর।
দেওয়ান না দেখ্‌ছে এমন কুমারী সুন্দর॥
এক দিষ্টে চাইয়া রইল তার যে পানে।
কখন নি দেখা অয় নয়ানে নয়ানে॥

সখীগণের সাথে কইনা পলাবুজি[১৭৪] খেলে
আৎকা[১৭৫] নজর পড়ল পদ্মার যে জলে॥
কোশাতে দেখিল কইনা সুন্দর দেওয়ানে।
এক ধ্যানে[১৭৬] চাইয়া কইনা রইল তার পানে
নয়ানে নয়ানে ভালা অইল মিলন।
এইমতে অইল দোহার প্রেমের জনম॥১২
এইমতে চাইর চক্ষের অইল মিলন।
কিবা অইল পরে তোমরা শুন সভাজন॥
সখীগণে দেখে কোশা সুন্দর কেমন।
দাঁঘে ফাড়ে জুইড়া রইছে সমস্ত ভুবন॥১৬
সখীগণে দেখে কোশা কইনা তো দেওয়ানে।
মদনের বাণ তার খেলিছে নয়ানে॥
তার পরেত কইনা শুন কোন্ কাম করে।
শীতাবী[১৭৭] চলিয়া গেল শয়ন মন্দিরে॥২০
গোপনে লিখিয়া লিখন ফুলাতে ভড়িয়া।
সখীগণ সঙ্গে যায় ঘাটেতে চলিয়া॥
গুছল করিতে যায় জলের ঘাটেতে।
যেই খানে কোশা বান্ধা তাহার কাছেতে॥২৪
সখীগণ করে কত কোশার বাখান।
কইনা দেখিছে কোথা আছয়ে দেওয়ান।
মাধ্যি নাও অইতে[১৭৮] যখন বাইরি অইল।
চাইর চক্ষের পুনর্চয়[১৭৯] মিলন অইল॥২৮

চক্ষে চক্ষে চাইয়া কইনা সুলা[১৮০] ভাসায় জলে
দেওয়ান দেখিল কইনা কিবা ভাসাইলে।
ভাসিতে ভাসিতে সুলা যায় কোশার কাছে
আত[১৮১] তুল্যা লইল সুলা দেওয়ান যে পাছে॥৩২
লিখন খুলিয়া দেওয়ান পড়িতে লাগিল
এরে দেখ্যা কইনা পরে বাড়ীতে ফিরিল।

লিখনে লিখিছে কইনা শুনরে কুমার
তোমারে দেখিয়া মন পাগল আমার॥৩৮
আমারেও দেখ্যা তুমি নাই কর এলা[১৮২]
তোমার লাগ্যা মন আমার অইল উতলা।
তুমি আমার ধরম করম তুমি আমার ফুল
তুমি যদি কির্‌পা কইরা রাখ বজায় কুল॥৪০
যত মীতাবি[১৮৩] পার কর দুহে মিলন
তোমার লাগ্যা ছটফট করে আমার মন।
চৈত না মাসেরে কুমার অষ্টমী তিথিতে
ছিনান করিতে আইবাম পদ্মার ঘাটেতে॥৪৪
ফৌজ লইয়া আইও তুমি কোশা সাজাইয়া
জলের ঘাট অইতে আমায় লইও তুলিয়া।
বেশী কইরা দাড়ি আন্য কোশার লাগিয়া
কোশা যেমনে যাইতে পারে শূন্যে উড়া দিয়া॥৪৮
আমার ভাইয়ে যদি পারে কোশা ধরিবার
তা অইলে জান্য মনে না থাকব নিস্তার।
লিখন পড়্যা দেওয়ান গেল আপন দেশেতে
মন খান রাখ্যা গেল শ্রীপুরের ঘাটেতে॥৫২

* * * *

(৭)

* * * *
অষ্টমী তিথিতে দেওয়ান কোশা সাজাইয়া

ফৌজ পাইক লইয়া আসিল চলিয়া।
বান্ধিল যে কোশাখান পদ্মার ঘাটেতে
বসিয়া রহিল দেওয়ান কন্যার অপেক্ষাতে॥
তার পরে আইল ধনী ছান[১৮৪] করিবারে
রৈতে না যে পারে মন ছটফট করে।
সরসী[১৮৫] আছয়ে যত লইয়া সঙ্গেতে
আইল পদ্মার জলে ছিনান করিতে॥

কাপড়ের ঘিরাট[১৮৬] এক চারি দিকে দিয়া
জল খেলা করে যত সরসী মিলিয়া।
জল খেইল কইনার না লয় পরাণে
চিন্তে কেবল কোন্ সময় পাইব দেওয়ানে॥১২
কোশাৎ থাক্যা তার পরে দেখিল দেওয়ান
কাপড়ের আম্বারিতে[১৮৭] লাগ্যাছে আগুন।

পরে ত চিনিল সাহেব সেই সে কন্যারে
কোশা ত্থনে[১৮৮] লাম্যা দেওয়ান আইল ধীরে ধীরে॥১৬
সরসীর সঙ্গে কইনায় পাথাইর কুল[১৮৯] লইয়া
এক লাফে যায় দেওয়ান কোশাতে ধাইয়া।
কোশাতে উঠিলে যখন দাড়ে দিল টান
শূন্যে উড়া কর্‌ল যেমন সেই কোশাখান॥২০

“আইলা পদ্মার ঘাটে সিনান করিতে।” ৩৭০ পৃঃ

এইত না খবর যখন শুনে কেদার রায়
শতেক ফৌজের নাও পাছে পাছে ধায়।
দাড়ের টানে কোশা যেন পংখী উড়া করে
কেদার রায়ের ফৌজের নাও এক কোশ দূরে॥২৪
ধরিতে না পারে রায় ঠেকল বিষম দায়
বইনে নিল চুরি কইরা হইল নিরুপায়।

দেওয়ানে ডাকিয়া কয় কেদার রায় পরে
থাকিবা দেওয়ান তুমি কোন্ না সহরে॥২৮
এক দিন পড় যদি আমার হাতে
দেওয়ান গিরি ছুটাইবাম লাত্থি[১৯০] মাইরা মাথে।
থাকহ আসমানে যদি কিবা পানিতে
ধরবাম তোমারে আমি পাই যেখানেতে॥৩২
তরে[১৯১] যদি না পাই বংশ পাইবাম তর
লইবাম মনের দাদ[১৯২] সেই সময় মোর।
উসল করিবাম মনের দাদ যেই সময় পারি
পর্‌তিশোধ[১৯৩] না লইয়া তোমারে না ছাড়ি॥৩৬

এই কথা কইয়া পরে গেল যে চলিয়া
ইশা খাঁও জঙ্গল বাড়ী দাখিল অইল গিয়া।
তার পরে করল সাদি সেই সে কুমারী
যার নাম আছিল আগে সুভদ্রা সুন্দরী॥৪০
নিয়ামতজান নাম রাখিল পইরছাতে[১৯৪]
প্রেম আলাপন মিয়া করে তার সাথে।

রাইত[১৯৫] দিন থাকে কাছে নাহি দেয় ক্ষেমা[১৯৬]
এহি[১৯৭] মত শুন সবে প্রেমের মহিমা॥৪৪
গর্ভ দেখা দিল সতীর তিন বছর পরে
এই কথা শুন্যা লোকে কানাকানি করে।
দশ মাস দশ দিন যখন পূন্নিত[১৯৮] অইল
সেই না সতীর ঘরে ছাওয়াল[১৯৯] জর্‌মিল[২০০]৪৮

মায়ের কোলেতে পুত্র চান্দের সমান
এমন সুন্দর রূপ না যায় বাখান।
ঝলমল করে যেমন আসমানের তারা
কি সুন্দর পুত্র অইল মায়ের কোল জোড়া॥
নাম রাখে আদম খাঁ মসনদ আলী
এই মতে কতদিন গেল আর চলি।
আর এক পুত্র অইল তিন বচ্ছর[২০১] পরে
আদমের মতন সুন্দর দেখিতে তাহারে॥৫৬
বিরাম দেওয়ান নাম রাখিল যে তার
মন দিয়া শুন সবে বিবরণ আর।৫৮

(৮)

পনর না বছরের আদম অইল যখন
ইশা খাঁ দেওয়ান গেল বেস্তের ভুবন।
অসার দুনিয়া ভাইরে কেউ কার নয়
মরণ কালে সঙ্গের সাথী কেই নাই সে হয়॥
স্ত্রী বল পুত্ত্র‌ বল গর্ভসোদর ভাই।
আন্যা[২০২] দিলে খাউরা[২০৩] আছে সঙ্গে যাউরা[২০৪] নাই॥

দুনিয়ার যত চিজ সব মিছা হয়।
জর্‌মিলে মরণ সেই অইব নিশ্চয়॥
জঙ্গল বাড়ী শূন্য কইরা ইশা খাঁ যে গেল।
এই কথা দেশে দেশে পরচার[২০৫] অইল॥

যেই শুনে এই কথা সেই আপশোষ করে।
এই কথা গেল পরে কেদার রায় গোচরে॥১২
কেদার রায়ের কথা শুন দিয়া মন।
পাইয়া সময় দুষ্ট কি করে তখন॥
ভাওয়ালিয়া[২০৬] চৌদ্দখান ভালা[২০৭] সাজাইয়া।
নানা ইতি খাদ্য বস্তু সকলি ভরিয়া॥১৬
দাখিল অইল পরে জঙ্গল বাড়ী সরে।
একে একে উঠে গিয়। ইশাখাঁর ঘরে॥

কেদার রায় গেল পরে বইনের[২০৮] কাছেতে।
বিছানা পাতিয়া দিল কেদারে বসিতে॥২০
ভাইয়েরে দেখিয়া বইনের মনে সুখ অইল।
মিষ্টি মিষ্টি কথা দুহে কহিতে লাগিল॥

শুন বইন তুমি বড় আছহ সুখেতে।
না আছে তোমার মত সুখী দুনিয়াতে॥২৪
তোমার কপাল ভালা দিয়াছিলা জাতি[২০৯]
আমার থাক্যা[২১০] দেওয়ান ইশা সুখী ছিল অতি॥

দুই পুত্ত্র অইল তোমার সুখী অইলাম মনে
বড় দুঃখু পাইলাম বইন ইশাখাঁর মরণে॥২৮
তাহারে দেখিবাম মনে বড় সাধ ছিল।
আমার বরাতে বিধি বিমুখ করিল।
দুই কইনা জগদীশ দিয়াছে আমারে।
ভালা বর নাই যে পাই বিয়া দিবার তরে॥৩২
কইনা লইয়া পড়িলাম আমি বড় ফেরে।
তোমরার মতন ভালা ঘর না পাই সংসারে॥
আশা কইরা আইলাম নিকটে তোমার
কইনা বিয়া দিতে মোর কাছে ভাগিনার॥৩৬
দুই ভাগিনার কাছে দিতাম[২১১] দুই কইনা বিয়া।
বিয়া করাইতাম[২১২] আমার নিজ বাড়ী নিয়া॥
কিবা কও বইন তোমার কি মত এহাতে[২১৩]
শুনিয়া বইনের পরাণ লাগিল কাঁপিতে॥

এই ত না ভাই মোর দুঃখুর দোসর।
সর্ব্বনাশ করিতে যে আইল আমার॥
অপমানের পরতিশোধ লইবার লাগিয়া।
ভুলাইবার চায় মোরে ছলকথা কইয়া॥৪৪
কপট করিয়া আমার পুত্ত্রে দিব বলি।
দিলে দাগা দিব ছিড়্যা[২১৪] পরাণের কলি॥
পরাণ কাঁপিল মায়ের এই কথা শুনিয়া।
পরাণের পুত্ত্রে কেমনে রাখিবাম বাঁচাইয়া॥৪৮

তার পরে কয় সতী শুন বিবরণ।
তুমি যে আইলা পুত্ত্রের সাদির কারণ।

তোমার কইনা করব বিয়া ইথে নাই মানা।
কেমনে বিয়া দিবা তারা তোমার ভাগিনা॥৫২

এতেক শুনিয়া রায় কয় ধীরে ধীরে।
মুছুলমানে মামার কইনা সাদি করত[২১৫] পারে॥
এতে তুমি মনে কিছু না কর সংশয়।
দোষ এতে নাই যে কিছু নাহি কর ভয়॥৫৬
এতেক শুনিয়া সতী কয় মনে মনে।
কিবা ছল কইরা খেদাই এইনা[২১৬] দুষমনে॥

তারপরে কয় সতী শুন ভাই ধন।
কহিছ তোমার বাড়ীত[২১৭] বিয়ার কারণ॥৬০
বাড়ী ছাড়া সাদি নাই পদ্দিতে[২১৮] আমার।
সাদি না করিয়া নাই সে যাইব তোমার ঘর[২১৯]

এহা শুনি কহে রায় শুনগো ভগিনী।
তোমার পুত্রে দেখবার যে চায় মা জননী॥৬৪
বিয়া তোমার বাড়ীৎ অইলে নাই যে কিছু দুখ।
বিয়ার আগে দেখ্যা মায়ের জুড়াউক যে বুক॥
পরেত কহিল সতী শুন ভাই ধন।
তোমার বাড়ীৎ পাঠাইতে পুত্রে দেখি অলক্ষণ॥৬৮
তোমার বাড়ীৎ গেলে অইব কিবা জানি দুখ।
সেই সে কারণে আমার জ্বল্যা[২২০] যায় বুক॥ ৭০

(৯)

বইনের ছলতাম্[২২১] রায় বুঝিতে পারিয়া।
বিদায় লইয়া যায় ভাওল্যায় চলিয়া॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া রায় কোন্ কাম করে।
জঙ্গল বাড়ীর যত লোকে জেফৎ[২২২] যে করে॥
উজীর নাজির যত কটুয়াল[২২৩] মিরদার।
পরজা, নফর আর ফৌজ, ফৌজদার॥
দুই ভাগিনায় করল জেফত[২২৪] সুবিস্তরে।
আর করল জেফত করিমুল্লা বীরে॥
একে একে যতজন খাইয়া নিমন্তন।
বাড়ীতে চলিয়া আইল খুসী অইয়া মন॥
দুষ্ট কেদার রায় দুই ভাগিনায় লইয়া।
কত রঙ্গের আলাপ করে ভাওয়ালিয়ায় বসিয়া॥১২
মামার আদরে তারা বড় খুসী হইল।
বাড়ীত যাইবার কথা ভুলিয়া যে গেল॥

তার পরে গেল দেখ হান্‌জা গুজুরী[২২৫]
তখনও আলাপ করে ভাওয়ালিয়ার উপরি॥১৬
আলাপ করিয়া অইল রাইত একপর[২২৬]
ভাগিনারা চিন্তে কেমনে যাইব নিজ ঘর॥
পরে দুষ্টু কেদার রায় কহিতে লাগিল।
অস্থান নহে ত এহা কিবা চিন্তা বল॥২০

“কত রঙ্গের আলাপ করে ভাওয়ালিয়ায় বসিয়া।” ৩৭৬ পৃঃ

আমারে ভাব্যাছ তোমরা অতই পর[২২৭]
একদিন না থাকতা পার আমার গোচর॥
চিন্তা নাই সে কর তোমরা থাক মোর সনে।
নিজ বাড়ী চল্যা যাইও কালুকা বিয়ানে[২২৮]২৪

মামার আদরে তারা গেল যে ভুলিয়া।
রাত্রিতে রহিল দুহে নাওয়েতে[২২৯] শুইয়া॥
রাত্রি নিশাকালে যখন তারা ঘুমাইল।
রায়ের ইঙ্গিতে মাল্লা নাও ছাড়িল॥২৮
বাদামের[২৩০] নাও চলে সাঁ সাঁ করিয়া।
মাঝি মাল্লা বায়[২৩১] যত পারে জোর দিয়া॥
বাদামের নাও চলে পাগল অইয়া।
তিন দিনের পথ যায় একদিনে বাইয়া॥৩২

(১০)

বিয়ানে আদম বিরাম ঘুম অইতে উঠিয়া।
ফুইদ্ করে মামা তুমি কোন্‌খান যাও চল্যা॥
আমরারে[২৩২] তুল্যা[২৩৩] দিয়া কেন নাই সে যাও।
না দেখিয়া আমরারে চিন্তা করব মাও[২৩৪]
ছল কইরা কেদার রায় কয় ভাগিনার কাছে।
এক বাঁক ছাড়াইয়া তোমার মইয়ের[২৩৫] বাড়ী আছে॥

সেহিখানে যাই তারে দেখবাম্ আসিয়া[২৩৬]
এই মতে ছল কইরা যায় তারারে[২৩৭] লইয়া॥
আড়াই দিন পরে নাও শ্রীপুরেতে যায়।
কেদার রায়ের ঘাটে ভাওয়ালিয়া লাগায়[২৩৮]
আসিয়া কেদার রায় ভাগিনার নিকটে।
দুই জনে বন্দী করে সেই সে কপটে॥১২
অস্তেতে[২৩৯] লোয়ার[২৪০] ছিকল[২৪১] পায়ে দিল বেড়ি।
আন্ধাইর[২৪২] চোর কুটীতে[২৪৩] পরে নেয় তরাতরি[২৪৪]
বন্দীখানা ঘরে সকলের সমকে[২৪৫]
মা বাপ তুল্যা[২৪৬] কত তারারে যে বকে[২৪৭]১৬
কইনা বিয়া দিতে আন্‌লাম এইখান তরারে।
ভাল কন্যা বিয়। দেই দেখ সুবিস্তরে॥

এই কথা বলিয়া দুঁহে চিৎ করাইয়া।
আধমনি দুই পাখর দিল বুকেতে তুলিয়া॥২০
আল্লা বল্যা কান্দে ভাই দুই জনে।
পাত্থর গলিয়া যায় তারার কাঁন্দনে॥

শুনে যদি মা জননী দারুণ খবর।
মরিব[২৪৮] পরাণে হায়রে শোকেতে পুত্রের॥২৪
দুই পুত্র মোরা তার লৌ[২৪৯] কলিজার।
কারে দেখ্যা জুড়াইব পরাণ তাহার॥
কান্দিতে কান্দিতে দুঁহে হইল জার জার[২৫০]
কার বুকে দরদ লাগব[২৫১] কেবা আপনার॥২৮
শুনত যদি করিমুল্লা দুঃখের দোসর ভাই।
গদা দিয়া পাঠাইত দুষ্টে যমের যে ঠাঁই॥
হায়রে দারুণ আল্লা কি লেখ্‌লা[২৫২] কপালে।
বিপাকে[২৫৩]পড়িয়া মারা গেলাম অকালে॥৩২

* * * * * *

শ্রীপুরের কথা যত নিরবধি থইয়া[২৫৪]
জঙ্গল বাড়ীর কথা যত শুন্‌খাইন মন দিয়া॥
জেফৎ খাইয়া সবে আইল নিজ ঘরে।
নিয়ামতজান বিচরায়[২৫৫] আপন পুত্রেরে॥৩৬
বার চাইতে চাইতে[২৫৬] পরে নিশি ভোর অইল।
পুত্রে না দেখি মায়ের পরাণ উড়িল॥
দুই পুত্র এক সঙ্গে গেল কোন্ পথে।
অবশ্য কেদার রায় ফেল্যাছে বিপদে॥৪০

করিমুল্লা বীরের কাছে কহিছে কান্দিয়া।
জেফত খাইয়া পুত্রেরা মোর না আইল ফিরিয়া।
করিমুল্লা শুন্যা বিবির কাছে বিবরণ।
চিন্তিত অইল বড় এহার[২৫৭] কারণ॥৪৪

নফরে ডাকিয়া এক দিল পাঠাইয়া।
কিবা অইল তারার যে আইও[২৫৮] জানিয়া॥
ঘাটেতে গিয়া যে নফর কিছু নাই সে দেখে।
শূন্য ময়দান পইড়া আছে তিন চাইর বাঁকে॥৪৮
নাহি আদম নাহি বিরাম নাহি কেদার রায়।
চইদ্দ[২৫৯] ভাওয়ালিয়া তার নাই সে দেখা যায়॥
এই কথা নফর আস্যা যখম শুনাইল।
হায় পুত্র বল্যা বিবি ভূমিতে পড়িল॥৫২
পুত্রের লাগিয়া বিবি কান্দে ঘন ঘন।
হারাইলাম পুত্রে হায়রে কি দোষের কারণ॥

সহিতে না পারি পরে বিবির কান্দন।
গর্জ্জিয়া করিমুল্লা বীর কয় ততক্ষণ[২৬০]৫৬
না কান্দ না কান্দ বিবি দুঃখু কর দূর।
তোমারে আন্যা দিবাম্ কেদারের শির॥
তোমার পুত্র আন্যা দিবাম ছাড়হ কান্দন।
তোমার পুত্র না লইয়া না ফিরবাম কখন॥৬০

এই না করিমুল্লা বীর জানা[২৬১] তির্‌সংসারে[২৬২]
কেউ নাহি জানে মিয়া জঙ্গেতে[২৬৩] যে হারে॥

“না কান্দ না কান্দ বিবি দুঃখ কর দূর।
তোমারে আনিয়া দিবাম কেদারের শির॥” ৩৮০ পৃঃ

হাজারে বিজারে[২৬৪] যদি সাম্‌নে খাড়া অয়।
গদার বাড়ি[২৬৫]তে সবে পাঠায় যমালয়॥৬৪
কালা বন্ন[২৬৬] দেহ তার পর্ব্ব‌ত সমান।
আগুনির তেজ ছাড়ে তাহার নয়ান॥
আত[২৬৭], পায়ের গোছা যেমন গজারের ঠুনি[২৬৮]
কান্ধেতে[২৬৯] আছয়ে মিয়ার গদা বিশমণি॥৬৮
সেই ত না গদাখান কান্ধেতে লইয়া।
সেই সময় চলে বীর পন্থপানে ধাইয়া॥
যেইখানে পাইবাম আজ দুষ্টু কেদারে।
গদার বাড়িতে মাথা দিলাম চূন[২৭০] কইরে॥৭২

চলিতে চলিতে বীর তিন দিনের পরে।
দাখিল অইল পরে শ্রীপুরের সরে॥
দুই ভাইয়ের কান্দন যখন কানেতে শুনিল।
মনের দুঃখেতে বীর পাগল অইল॥৭৬
যারে পায় তারে মারে সমুখে তাহার।
দেখিয়া কেদার রায় করে হাহাকার॥
সেই সময় যত ফৌজে খবর যে দিল।
মার মার কর‍্যা সবে করিমে ঘিরিল॥৮০
পারে যত মারে বীর না কুলায় জোরে।
ফৌজের পালের সঙ্গে একলা কত লড়ে[২৭১]

তারপরে দেখ্যা বীর হেন নিরুপায়।
চম্পট মারিয়া বীর পরাণ বাঁচায়॥৮৪
দৌড় দিয়া আইল পরে পদ্মার ঘাটেতে।
ফৌজগণে দৌড়ায় তার পিছেতে পিছেতে॥

পদ্মায় আসিয়া বীর ডুব যে মারিয়া।
ভরা নদী তিন ডুবে আইল পাড়ি দিয়া॥৮৮
কুমইরে[২৭২] খাইয়াছে বলি সকলে কহিল।
জলের ঘাট অইতে যত ফৌজেরা ফিরিল॥

সেইত না করিম মিয়া কোন্ কাম করে।
চলিতে লাগিল মিয়া পদ্মার পারে পারে॥৯২
পদ্মার পাড়েতে অয়[২৭৩] সাধন মাঝির বাড়ী।
রাত্রি নিশাকালে[২৭৪] গিয়া ডাকে তাড়াতাড়ি॥
শুনিয়া সাধন মাঝি উঠিয়া আসিল।
করিমুল্লা মিয়া যত বিবরণ কইল[২৭৫]৯৬
আগান্ত বাগান্ত[২৭৬] কথা সকল শুনিয়া।
খাওয়াইল মিয়ারে যে যতন করিয়া॥
এক মন চিড়া দিল পনর সের চিনি।
আর দিল দুই মন দই কিন্যা[২৭৭] আনি॥১০০
লবন সমুখে দিল এক সের আনিয়া।
এরে[২৭৮] দিয়া খাইল বীর পেট ভরিয়া॥
জাল বাইবার ডিঙ্গিতে মিয়ারে লইয়া।
এক রাইতে জঙ্গল বাড়ী গেল যে চলিরা॥১০৪

জঙ্গল বাড়ী গিয়া মিয়া কোন্ কাম করে।
জঙ্গল বাড়ীর যত ফৌজ কোশাতে[২৭৯] যে ভরে॥
কোশাতে করিয়া দিল শ্রীপুরেতে মেলা।
পবনের মত কোশা পংখী উড়া দিলা॥১০৮

* * * * *

শ্রীপুরেতে কিবা পরে শুনবিবরণ।
বিয়া দিবার ছলে আন্‌ছে কুমার দুইজন॥
ছল কইরা তারারে না বান্ধিয়া রাখিছে।
এই কথা গেল রায়ের দুই কইনার কাছে॥১১২

একত্রে বসিয়া দুই বইনে সল্লা[২৮০] করে।
কুমারেরা আইছে[২৮১] কেবল আমরার মানত[২৮২] কইরে॥
আমরার উচিত অয় তারার সেবন।
সেবা করিবাম আমরা তারার চরণ॥১১৬
চিরদিন থাকবাম্ তারার দাসী অইয়া।
এর লাগ্যা বাপ মাও দেউক ছাড়িয়া॥
বিয়া দিবার ছলে যখন আন্যাছে কুমারে।
বিয়া নাই সে দিলে পরে ঠকিব আখেরে॥১২০
তারা না বুঝিল এহা ক্রোধে মত্ত অইয়া।
আমরার উচিত বাঁচাই উতযোগ[২৮৩] অইয়া॥

দুই বইনে সোনার থালে ভাত বাড়িয়া।
বাটী ভরিয়া কত বেনুন্ সাজাইয়া॥১২৪

নিশাকালে যখন সবে করিল শয়ন।
চোর কুটীর দুয়ারে আস্যা দিলা দরিশন[২৮৪]

মিনতি করিয়া কয় কুমার দুইজনে।
ছল কইরা আন্‌ল পিতা তোমরারে এইখানে॥১২৮
বিয়া দিব দুই বইনে দুই ভাইয়ের সঙ্গে।
এহাতে[২৮৫] আসিলা তোমার বড় মন রঙ্গে॥
আমরাও কর্‌ছিলাম মনে যদি বিয়া অয়।
দাসী অইয়া থাকবাম তোমরার, দুই বইন নিরচয়[২৮৬]১৩২
বাপে করুক্ তার যা লয় মনে।
বৈরী না করবাম্ আমরা তোমরার সনে॥
রাখ বা না রাখ পায় মন কইরাছি দড়।
গলা কাটিলে নাই সে করবাম অন্য ঘর[২৮৭]১৩৬
তোমরারে কইরাছি আমরা পরাণের দেবতা।
তোমরার লাগ্যা ছাড়্‌তে রাজী বাপ আর মাতা॥

এই কথা শুনিয়া আদম বিরাম দুইটী ভাই।
কহিতে লাগিল পরে দুই কইনার ঠাঁই॥১৪০
চুরি কইরা বিয়া নাই সে করিবাম আমরা।
শীঘ্র কইরা ফিরা যাও ঘরেতে তোমরা॥
সকলের সামনে বিয়া করবাম তোমরারে।
তোমরার আতের ভাত খাইবাম সুস্থরে[২৮৮]১৪৪

খানা লইয়া ফির‍্যা যাও কই যে তোমরারে।
আতের ভাত খাইবাম যেদিন আল্লা মর্‌জি করে॥
এই কথা শুন্যা তারা দুঃখিত অন্তরে।
আইল ফিরিয়া দুইবইন অন্দর ভিতরে॥১৪৮
সেই দিন অইতে ঘরে জ্বলিল আগুনি।
সেই না আগুনে পুড়ে কেদার রায় ধনী॥১৫০

(১১)

তিন দিন পরে কোশা শ্রীপুরে পৌছিল।
ফৌজগণ সঙ্গে করিম পারেতে নামিল॥
মার মার করি যত ফৌজগণ ধায়।
যেখানে বসতি করে দুষ্ট কেদার রায়॥
জঙ্গল বাড়ীর ফৌজগণ দাখিল[২৮৯] অইল।
দেখিয়া কেদার রায় বুঝিতে পারিল॥
নিরুপায় ভাব্যা দুষ্টু কোন্ কাম করে।
কুমাররারে[২৯০] কালী বাড়ীত্[২৯১] নিতে হুকুম করে॥
কালী বাড়ীত্ নিয়া পরে দিত[২৯২] তারারে বলি।
কুমাররারে লইয়া পাইক জল্‌দি যায় চলি॥
খবর পাইয়া কেদারের সেই দুই কইনায়[২৯৩]
ঘরে থাইক্যা সেই ত না খবর যে পায়॥১২
খবর না পাইয়া তারা পাগল অইয়া।
কালী বাড়ীত যায় দুয়ে খাণ্ডা আত লইয়া॥
গিয়া দেখে কুমারেরা কাঠগড়ার[২৯৪] উপরে।
বলিকার তারার উপরে বল্‌ছিরা[২৯৫] যে ছাড়ে॥১৬

এমন সময় কইনারা কোন্ কাম করিল।
খাণ্ডার বাড়ি দিয়া তারে ভূমিৎ ফালাইল॥
বলিকারে মারল পরে মারে আর জনে।
এরে দেখ্যা পলায় লোক জঙ্গলায় আর বনে॥২০
এই মতে দুই বইনে কুমারে বাঁচাইয়া।
খাণ্ডা আতে[২৯৬] দরজার মধ্যে থাকে খাড়া অইয়া॥
যেই যায় কুমারগণের বধের কারণে।
খাণ্ডার বাড়ী দিয়া তারে মারয়ে পরাণে॥২৪

জঙ্গলবাড়ীর ফৌজগণ শ্রীপুর ঘিরিল।
সর[২৯৭] ছাইয়া[২৯৮] যত ফৌজ খাড়া যে হইল॥
তার পরে ঘরে ঘরে আগুন জ্বালাইয়া।
সোণার শ্রীপুর সর দিল ছারখার করিয়া॥২৮
পলায় পরাণের ভয়ে যত লোকজন।
শ্রীপুরের লোক গেল যমের ভবন॥

এইমতে শ্রীপুর ছারকার হইল।
দুষ্টু কেদার রায় কোন্‌খানে পলাইল॥৩২
করিমুল্লা বিচরাইয়া[২৯৯] তারে নাইযে পায়।
তখন ভাবয়ে মিয়া কি অইব[৩০০] উপায়॥
এই দুষ্টু থাকে যদি দুনিয়া মাঝারে।
আর কোন দিন গিয়া ফালায় কোন্ ফেরে[৩০১]৩৬
পরাণে রাখিয়া নাই সে দেশে ফিরিবাম।
যেখানে পাইবাম তারে নিরচয়[৩০২] মারিবাম॥

এই কথা শুন্যা পরে কেদারের মেইয়া[৩০৩]
কুমাররারে লইয়া পরে আইল যে ধাইয়া॥৪০

দেখিয়া কুমারগণে সর্ব্বলোক জন।
আর দেখ্যা কইনারারে[৩০৪] আনন্দিত মন॥
কয় দুই মেইয়া পরে শুন করিম বীর।
এমন শত্রু না রাখিবা যদি হয় সে পীর[৩০৫]৪৪
এই শত্রু যদি থাকে দুনিয়ার মাঝারে।
কোন্ দিন সর্ব্বনাশ করে আর কারে॥
আমরা জানি কোথায় দুষ্টু আছে পলাইয়া।
নিজ আতে গিয়া তুমি আসহ মারিয়া॥

শত্রু আইলে সেই দুষ্টু না থাকে জমীনে।
পাতালে এক বাড়ী আছে খসুয়ার বনে॥৫২
উপরে জঙ্গল নীচে সুন্দর দলান।
তার মধ্যে থাক্যা দুষ্টু বাঁচায় পরাণ॥
সুরঙ্গ আছয়ে এক বনের ধারেতে।
তার মাঝ দিয়া যাও দলান মাঝেতে॥৫৬
সেইখানে দেখ্‌বা এক ন দুয়াইরা[৩০৬] ঘর।
সেইখান থাকে দুষ্টু পালঙ্ক উপর॥

এই কথা শুন্যা করিম দিল খুসী অইয়া।
খসুয়ার বনে মিয়া দাখিল অইল গিয়া॥৬০
শ্রীপুর অইতে খসুয়া পাঁচ রশি দূর।
ঝাউগড়ে[৩০৭] বেড়িয়াছে তাহার উপুর॥
দক্ষিণ ধারেতে মিয়া সুরঙ্গ পাইয়া।
সর বরাসর[৩০৮] গেল ভিতরে চলিয়া॥৬৪

সেইখানে গিয়া দেখে ন দুয়ারিয়া ঘর।
খুসী অইয়া গেল মিয়া তার ভিতর॥
ভিতরেতে গিয়া দেখে পালঙ্ক উপরে।
নিরচিন্ত[৩০৯] অইয়া রায় ঘুমায় অঘোরে[৩১০]৬৮
করিমুল্লা গিয়া তথা করিল গর্জ্জন
সেই ত গর্জ্জনে রায়ের অইল চেতন।
চেতন অইয়া দুষ্টে কোন্ কাম করে।
কাছে আছিল খাণ্ডাখান তারে আতে ধরে॥৭২

ধরিতে না ধরিতে পরে করিমুল্লা মিয়া
গদার বাড়িতে দিল তারে সাঙ্গ দিয়া।
গলা কটিয়া মিয়া কোন্ কাম করে
আতে লইয়া শির পরে আইল শ্রীপুরে॥৭৬

দেখিয়া সবার মন খুসী অইল ভারী
তার পরে কোশাত চড়্যা যায় জঙ্গল বাড়ী।
জঙ্গল বাড়ী গিয়া করে সাদির আয়োজন
অরচিত[৩১১] অইয়া শুন সাদির বিবরণ॥৮০

জেতা চান্দে[৩১২] ভালা দিন মৌলবী দেখিয়া
সুস্থির কইরা দিল—অইত[৩১৩] সেই দিন বিয়া।
নানা রকম সাজে সাজায় জঙ্গল বাড়ী সর
স্বর্গ পুরী এন[৩১৪] অইল[৩১৫] দেখিতে সুন্দর॥ ৮৪

হাওই বন্দুক ছাড়ে নাই তার সীমা
লাখে লাখে মেমান[৩১৬] অইল কত যে মহিমা।
সাদির দিনেত দেখ গুছুল[৩১৭] করাইয়া
নানা বস্তু অলঙ্কারে দিল সাজাইয়া॥৮৮
কইনারে পড়াইল ইরাণের[৩১৮] শাড়ী
সাজিল দুই বইন আর কত জেওর[৩১৯] পড়ি।
সাজনে পরীর রূপ পিছ[৩২০] মান্যা[৩২১] যায়
আদম বিরাম সাজে কিবা মরি হায়॥৯২
মিশরের কুর্ত্তা গায় দিল ত তাদের
টুপি পরাইল আনি আরব দেশের।
পারশীর জুতি পরে দিল তারা পায়
কস্তুরী কুঙ্কুম আতর কত যে ছিটায়।৯৬
সাজিয়া যখন তারা কইনা সাথে বইল[৩২২]
তাদের রূপেতে পুরী আলা অইয়া গেল।

তখন উকীল আস্যা[৩২৩] জিগায়[৩২৪] বসিয়া
আদম বিরাম সাথে অইব নাকি[৩২৫] বিয়া॥১০০
উকীলের কাছে কইনারা করিল স্বীকার
আদম বিরাম পরে করে অঙ্গীকার।

এই মতে উভয়ের সাদি অইয়া গেল
সুচারু খাদ্য বস্তুতে খায়ন হইল॥১০৪

* * * *
* * * *

  1. ইশাখাঁর কামানের উপর যে উপাধি লিখিত হইয়াছে, তাহা মসনদালি নহে। প্রথম অক্ষরটি স্পষ্ট নহে (ইহা দাগমাত্র হইতে পারে)। ষ্টেপলটন সাহেব ও একটি জিজ্ঞাসার চিহ্ন (?) সংযোগ করিয়া এটিকে “ব” পড়িয়াছেন। যাহা হউক, এটিকে বাদ দিয়া পরিলে শব্দটি “মসনন্দাল্বি” হয়। ষ্টেপলটন-ধৃত “ব-মস-দীফি” পাঠ কোনমতেই স্বীকার করা যাইতে পারে না। “মচলন্দালি” পদটি কামানে উৎকীর্ণ “মসনন্দাল্বি” পদের অনেকটা অনুরূপ।  ইহাই কি ‘মসনদালি’ শব্দের বাঙ্গালা ভাষায় লিখিত রূপান্তর। আমি যতদূর জানি দেওয়ান পরিবারের কাগজ পত্র ছাড়া অন্য কোথাও এই উপাধি দিল্লীশ্বরের প্রদত্ত, একথার প্রমাণ পাওয়া যায় না। দিল্লীর সম্রাট্‌ দিগের সহিত জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ান পরিবারের সম্বন্ধ স্থাপনের চেষ্টা আমরা পূর্ব্বাপর দেখিয়া আসিতেছি বলিয়া তাঁহাদের মত গ্রহণ করিতে আমাদের একটু সন্দেহ হয়। দেওয়ানদিগের প্রেরণায় লিখিত বিবরণগুলিতে ত্রিপুরারাজ অমর মাণিক্যের সহিত ইশাখাঁর সমস্ত সংস্রব লোপ করিবার চেষ্টার কারণ কি? আকবর সাহ কর্ত্তৃক এই খিলাত প্রদত্ত হইলেও দেওয়ান পরিবারে বংশপরম্পরায় তাহ রক্ষিত হয় নাই, ইহাও লক্ষ্য করিবার বিষয়। ত্রিপুরার সংস্রব স্বীকার করিলে ইশাখাঁ কতকটা হীন হইয়া পড়েন এবং তাঁহার সহিত দিল্লীশ্বর ও গৌড়েশ্বরদের ধারাবাহিক আত্মীয়তাস্থাপনের চেষ্টার কতকটা বিঘ্ন হয় বলিয়াই কি তাঁহারা ঈশাখাঁর জীবনের এই গৌরব হীন প্রথম অধ্যায় লুপ্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন? অথচ রাজমালার প্রমাণ ছাড়াও সারাইল পরগণার বহুবিধ প্রমাণ আছে, যাহাতে ইশাখাঁ এক সময়ে সে সেই অঞ্চলে যুদ্ধবিগ্রহ করিয়াছিলেন, একথা স্পষ্টই প্রতিপন্ন হয়।
  2. ডাক্তার ওয়াইজের মতে, এই উদ্যানবাটিকার বর্গায়তন ১৬৯ একার পরিমিত ভূমি ছিল। ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের এসিয়াটিক সোসাইটি-পত্রিকার “খিজিরপুরের ইশাখাঁ মসনদালি” শীর্ষক প্রবন্ধ (২০৯-২১৪ পৃঃ) দ্রষ্টব্য।
  3. মুদ্রিত সংস্করণে “সাহবৎপুর” লিখিত। কিন্তু লেখক আমাকে যে কাপি উপহার দিয়াছেন, তাহাতে স্বহস্তে “সাহবৎপুর” কাটিয়া “হৈবৎপুর” লিখিয়া দিয়াছেন। সান্ন্যালের ইতিহাস, ৪৪৩ পৃঃ)।
  4. স্বরূপচন্দ্র রায় মহাশয় তাঁহার ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দের প্রকাশিত সুবর্ণগ্রামের ইতিহাসে সোণামণির সম্বন্ধে এক কৌতূহলজনক বিবরণ দিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, চাঁদ রায়ের কোনও বিশ্বাসঘাতক কর্ম্মচারী ইশাখাঁর নিকট হইতে উৎকোচগ্রহণ করিয়া সোণামণিকে হরণ করিতে তাঁহাকে সাহায্য করে। রায় মহাশয় লিখিয়াছেন, এই ব্যাপার লইয়া চাঁদ রায়ের ইশাখাঁর সহিত বহু যুদ্ধ ও রক্তপাত সঙ্ঘটিত হয়। চাঁদ রায় ইশাখাঁর কলাইগাছি দুর্গ ও তাঁহার পূর্ব্বতন রাজধানী খিজিরপুর সহরের ধ্বংস করেন। ইহাতে আরও লিখিত হইয়াছে যে, ইশাখাঁর মৃত্যুর পর চাঁদ রায় জঙ্গলবাড়ী নগর আক্রমণ করেন এবং নানাবিধ উপায়ে দেওয়ান পরিবারের প্রতি প্রতিহিংসা সাধনের প্রয়াস পাইয়াছিলেন। উক্ত ইতিহাস বলিতেছেন যে সোণামণির জীবনান্তের ইতিহাসটি বিষাদময়। ব্রহ্মদেশীয়গণ তাঁহার রাজত্ব আক্রমণ করিলে তিনি হাজিপুর দুর্গে অশ্রিয় গ্রহণ করেন; আক্রমণকারীরা সেই দুর্গ ও অবরোধ করেন, তিনি তাঁহাদিগের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করেন; কিন্তু আত্মরক্ষার উপায় নাই দেখিয়া শত্রুহস্তে পতিত হইবার আশঙ্কায় অগ্নিপ্রবেশ করেন। রায় মহাশরের মতে, ত্রিপুরারাজ এবং বিক্রমপুরের কেদার রায়—ইশাখাঁর মৃত্যুর পর এই জঙ্গলবাড়ী আক্রমণ ও লুণ্ঠন ব্যাপারে ব্রহ্মদেশীয়দিগের সহিত যোগদান করেন। আমরা রাজমালার উক্তি হইতে প্রমাণ করিয়াছি, ইশাখাঁ এক সময়ে রাজা অমরমাণিক্যের প্রধান মিত্রশক্তি ছিলেন। পরে ইশাখাঁ এবং ত্রিপুরারাজের মধ্যে মনোমালিন্য ঘটিয়াছিল। তাহার একটি বিশেষ প্রমাণ এই যে,—ইশাখাঁ এক সময়ে ত্রিপুরারাজের সপক্ষে যে তুমুল সংগ্রাম করিয়াছিলেন, ময়মনসিংহের পালারচকগণ সে কথার আদৌ উল্লেখ করেন নাই; তাঁহারা ইশাখাঁর সহিত ত্রিপুরা রাজের সমস্ত সম্বন্ধই বিলোপ করিবার চেষ্টা পাইয়াছেন। সুবর্ণগ্রামের ইতিহাসের মতে, আদম ও বিরামের কোনও সন্তানসন্ততি হয় নাই। অন্যান্য দুই একটি ঐতিহাসিক বিবরণের ন্যায়। এই ইতিহাসেও পাইতেছি, সোনামণি চাদ রায়ের কন্যা ছিলেন, ভগ্নী নহেন।
  5. পইছমালিয়া=পশ্চিম।
  6. তালেবর=ঐশ্বর্য্যশালী, পরাক্রান্ত।
  7. অদুন্যাই (অবধি নাই অথবা আদি নাই অপভ্রংশ)=প্রচুর।
  8. বাস্‌সা=বাদ্‌সা।
  9. দুস্তি=বন্ধুত্ব।
  10. ছেওয়া=ছায়া।
  11. মিয়া=মুসলমানী শব্দ—‘সম্ভ্রান্ত’বাচক।
  12. পরজা=প্রজা।
  13. ইত=হিত। (পূর্ব্ব ময়মনসিংহ, শ্রীহট্ট, কুমিল্লা, নোয়াখালি ও ঢাকা প্রভৃতি স্থানে ‘হ’ কে সময় সময় ‘অ’ বা ‘ঘ’ দিয়া উচ্চারণ করা হয়)
  14. শুনখাইন=শুনুন।
  15. হজ্ কামাইতে=পুণ্য অর্জ্জন করিতে—তীর্থদর্শন করিতে।
  16. জাগ্যা=স্থান; জায়গা।
  17. ঘুর‍্যা=ঘুরিয়া।
  18. সরে=সহরে।
  19. লগে=সঙ্গে।
  20. বড়য়=বড় (মহৎ) জনে।
  21. জানব=জানিবে।
  22. কুত্তায়=কুকুর কর্ত্তৃকারক
  23. চিন্যা=চিনিয়া
  24. ভালা=ভাল।
  25. কইরে=করিয়া, ‘কইরা’ শব্দের অর্থও তাহাই!
  26. “না”=এখানে “হাঁ” বাচক, না শব্দটি অনেক স্থলেই নিষেধার্থক নহে, ইহা কোন কথাকে বেশী জোর দিয়া বলার অর্থে ব্যবহৃত হয়।
  27. থাক্যা=থাকিয়া।
  28. ডেমাক=দেমাক, গর্ব্ব।
  29. তেনি=তিনি।
  30. খুসনাম=সুনাম, যশ।
  31. আন্ধাইর=আঁধার, অন্ধকার।
  32. বইয়া=বসিয়া।
  33. পশর=ফরসা, আলোকিত।
  34. জিন্যাছে=জিনিয়াছে।
  35. তির্‌ভূবনে=ত্রিভূবনে।
  36. নিত্যি=‘নিত্য’র অপভ্রংশ প্রত্যহ।
  37. পরামিশ=পরামর্শ।
  38. সুস্থরে=সুবিস্তারে, সর্ব্ববিষয়ে।
  39. হাত্তি=হাতি।
  40. বাবুনে=ব্রাহ্মণকে।
  41. গজদানী=যিনি গজ দান করেন। cp অগ্রদানী।
  42. ইন্দু=হিন্দু।
  43. সগলে=সকলে।
  44. ইংসা=হিংসা।
  45. দুর্গৎছব=দুর্গোৎসব।
  46. পর্‌তি=প্রতি, প্রত্যেক অর্থে।
  47. আশ্রা=(আর্চ্চা) পার্ব্বনাদি।
  48. পাশর=ভুলিয়া যাওয়া, “পাশরিতে চাই তারে পাশরা না যায় গো” cp চণ্ডীদাস।
  49. দড়=শক্ত এখানে তীক্ষ্ণ।
  50. ঘর=ঘরে অর্থে।
  51. কিনু=কোনও।
  52. অরিশ=হরিষ, হর্ষ।
  53. মেমান=পণ্ডিত; মমীন।
  54. তারারে=তাহাদের, তাহাদিগকে।
  55. ছওয়াব=
  56. পুত্রু=পুত্র।
  57. অইল=হইল।
  58. ছাইড়া=ছাড়িয়া।
  59. বেস্ত=বেহেস্ত, স্বর্গ।
  60. ছিলাইন=ছিলেন।
  61. কইনা=কন্যা।
  62. চান্=চাঁদ।
  63. ফির‍্যা=ফিরিয়া।
  64. কেউনা=কাহারও।
  65. সগলই=সকলেই।
  66. বাতাইবাম্=বলিব (বাৎ—কথা হইতে)
  67. অগুনির লোক্কা—লোক্কা=হাল্কা, স্ফুলিঙ্গ অগ্নির জিহ্বা।
  68. দীঘল=দীর্ঘ।
  69. কমর=কোমর।
  70. বাইয়া=বাহিয়া।
  71. পুন্নুমাসী=পৌর্ণমাসী।
  72. চৌক্‌=চক্ষু।
  73. মিডকের=মৃগের, হরিণের।
  74. হাইর=হা’র, পরাজয়।
  75. পরথম=প্রথম।
  76. সাইরবেশী=প্রতিবেশী, সাথী, যথা মলুয়ায় “সাইর সরসীরে বিনোদ কিছু না জানায়”।
  77. elo “ঢল ঢল অঙ্গের লাবনী অবনী বহিয়া যায়"—জ্ঞানদাস।
  78. কোচের=কুচের।
  79. সম্‌কে=সম্মুখের দিকে।
  80. এলায়=হেলায়, হেলিয়া পড়ে।
  81. সির্‌জিয়া=সৃজন করিয়া॥
  82. গুছুল=স্নান।
  83. হবসি=স্ববয়সী, সমবয়স্কা।
  84. উলামেলা=এলোমেলো ভাবে আনন্দের আতিশয্যে শৃঙ্খলা না মানিয়া।
  85. অইতে=হইতে।
  86. অইয়াছে=হইয়াছে।
  87. তিরাষ=তৃষ্ণা, আকাঙ্ক্ষা।
  88. কাডাই=কাটাই।
  89. আমি (ষষ্ঠীকারক, আমার)
  90. মেলা দেওয়া=রওনা হওয়া, এখনও পূর্ব্ববঙ্গে ব্যবহৃত।
  91. দাখিল=উপস্থিত।
  92. আরজ=প্রার্থনা।
  93. বিয়া=বিবাহ।
  94. ইন্দু=হিন্দু।
  95. দুজক=নরক।
  96. বুগল=নিকট।
  97. পইড়া=পড়িয়া।
  98. কইল=করিল।
  99. পাকুরিয়া=যে পাক করে, রন্ধনকারী। (কখন ও কখনও জিজ্ঞাসা অর্থে ব্যবহৃত হয়)
  100. ফুইদ=দ্বিধা, ফাঁক।
  101. সরমত=সম্মত।
  102. গুস্ত=মাংস।
  103. খাওয়াইল=খাওয়াইয়াছিল।
  104. জাইত=জাতি।
  105. সন্ধানে=চক্রান্তে।
  106. সল্লা=কুপরামশ।
  107. থাপাইয়া=থাপড়াইয়া।
  108. আখেজ=শত্রুতা।
  109. জাইত যাউয়া=জাতি-নাশা।
  110. গলাত=গলাতে (সপ্তমী)
  111. বারাৎ=নিকটে।
  112. ডাক্যা=ডাকিয়া আনিয়া
  113. গরু খাইলেই তখনকার দিনে মুসলমান হইল—এই ধারণা ছিল।
  114. অও=হও।
  115. খুপছুরত=সুন্দরী।
  116. “মসনদালি ইতিহাস” নামক হইতে জানা যায়, যে এই বাদসাহের একটি মাত্র পুত্র হইয়াছিল, সেটি অতি অল্প বয়সে মারা যায়, আর তিনটি কন্যা ছিল, ১মটি সৈয়দ ইব্রাহিম ওল ওলমার সঙ্গে, দ্বিতীয়টি সুবিখ্যাত ‘কালাপাহাড়ের’ সঙ্গে তৃতীয় (মমিনা খাতুন) কালিদাস গজদানীর সঙ্গে বিবাহিতা হয়। কালিদাস দীর্ঘকাল দেওয়ানী করার দরুণ রাজ্যটি তাহার হাতেই ছিল,—মমিনা খাতুনকে বিবাহ করিয়া ইনি একরূপ ঘর জামাই হইয়া সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন।
  117. সগলি=সকল।
  118. ছালি=ছাই, ভস্ম, এখনও পূর্ব্ব বঙ্গের কোন কোন স্থলে এই শব্দ ছাই অর্থে ব্যবহৃত হয়।
  119. নবাবগিরি=নবাবী।
  120. ফেরে=মুস্কিলে, গোলমালে, বিপদে।
  121. মমিন=বিদ্বান্।
  122. জেতাচাঁদে=শুক্লপক্ষে।
  123. জুম্বা=শুক্রবার।
  124. ভাল দিন=ভাল ক্ষণ, দিন অর্থ এখানে ‘ক্ষণ'।
  125. যৈতক=যৌতুক।
  126. খেতাজ=রাজস্ব
  127. নফরে=চাকরকে, যে রাজস্বের জন্য তাগিদ দিতে এসেছিল।
  128. জান খালি=শুধু প্রাণটি।
  129. ডংশ করণ=ধ্বংস করুণ।
  130. জঙ্গ=যুদ্ধ।
  131. আরদেশে=আদেশে।
  132. আপদ বালাই=শত্রুদিগকে॥
  133. অস্র=অস্ত্র।
  134. ছেওয়ায়=ছেদ করে।
  135. বিলাই=বেড়াল।
  136. উন্দুরে=ইন্দুরে।
  137. অচরিত=আশ্চর্য্য, অপূর্ব্ব।
  138. বাস্তব্যির=বাস করিবার।
  139. পরধান=প্রধান।
  140. অইয়া=হইয়া।
  141. নক্‌সা নমুনা=মানচিত্র, খস্‌ড়া।
  142. ঠুনি=স্তম্ভ
  143. দুধবগার=দুগ্ধবর্ণ বক।
  144. কত দীঘি...চারিধার=গোল এবং চতুষ্কোণ দীঘি অনেকগুলি দিয়াছে।
  145. খোলাসা=পরিস্কার
  146. কিল্লা=দুর্গ।
  147. “কচুগাছ·······বালাই”=শত্রুদিগকে যুদ্ধে কচুগাছের ন্যায় কাটিতে থাকে।
  148. আশ্রা=আশ্রয়।
  149. লোয়ার=লৌহের।
  150. পিন্‌রা=পিঞ্জর।
  151. পরতি=প্রতি।
  152. অয়=হয়।
  153. ধুন্ধ=বিস্মিত, ভয়াকুল।
  154. আত্তির=হাতীর।
  155. সরে=সহরে।
  156. ফুইদ=জিজ্ঞাসা।
  157. সিঙ্গি=সিংহ
  158. তারে..... আখেরে=তারে বাধ্য রাখিলে পরিণামে (আখেরে) কাজ পাওয়া যাইবে।
  159. “খাওন......কষ্ট”=খাইবার বেজায় কষ্ট।
  160. রাখছুইন=রাখিয়াছেন।
  161. ভইরাছে=ভরিয়াছে।
  162. মৈলানে=ময়লায়।
  163. শুইখাইন=শুনুন।
  164. দেউখাইন=দিউন।
  165. বুয়াইয়া=বসাইয়া।
  166. ছন্নদ=সনদ।
  167. নাও=নৌকা।
  168. ফাডে=বিস্তৃতিতে।
  169. এই সাধন মাঝির উল্লেখ আমরা পরে ও পাইতেছি, এই মাঝি করিমুল্লাকে খুব আতিথ্য দেখাইয়াছিল।
  170. পাথর সান=প্রস্তর ও সান।
  171. আথারে পাথারে=এদিকে ওদিকে। Cf. “আথাইলের ধনকড়ি পাথাইলে শুকায়” ময়নামতী।
  172. তেমলা=তিনমহল।
  173. কাইচ=সন্‌ কাইচ; স্বর্ণবর্ণ কাঁচ পোকা।
  174. পলাবুজি=লুকোচুরি।
  175. আৎকা=অকস্মাৎ।
  176. একধ্যানে=একদৃষ্টে
  177. শীতাবি=শীঘ্র।
  178. অইতে=হইতে।
  179. পুনর্চয়=পুনশ্চ, পুনরায়।
  180. সুলা=সোলা।
  181. আত=হাতে।
  182. এলা=হেলা।
  183. মীতাবি=(?)
  184. ছান=স্নান।
  185. সরসী=সাথী।
  186. ঘিরাট=ঘেরাও, আবৃত।
  187. আম্বারিতে=অন্তরালে।
  188. ত্থনে=হইতে।
  189. পাথাইয় কুল=পাথালী কোলে। কন্যার মস্তক এক হস্তের উপর, এবং অপর হস্তে তার পা দুখানি রাখিয়া কোলে করিয়া লইল। “পাথালিয়া কোল” এই অর্থে এখন ও পূর্ব্ব বঙ্গে ব্যবহৃত হয়।
  190. লাত্থি=লাথি।
  191. তরে=তোরে।
  192. দাদ=প্রতিশোধ।
  193. পরতিশোধ=প্রতি শোধ।
  194. পইরছাতে=পশ্চাতে, পরে।
  195. রাইত=রাত্রি।
  196. ক্ষেমা=ছাড়ান, অবসর, ত্যাগ।
  197. এহি=এই।
  198. পূন্নিত=পূর্ণ।
  199. ছাওয়াল=ছেলে।
  200. জরমিল=জন্মিল, জন্মগ্রহণ করিল।
  201. বচ্ছর=বছর।
  202. আন্যা=আনিয়া।
  203. খাউরা=ভক্ষণকারী; খাওয়ার লোক।
  204. যাউরা=যাওয়ার লোক; ‘সঙ্গে যাউরা’=সাথী, সঙ্গের লোক।
  205. পরচার=প্রচার, রাষ্ট্র।
  206. ভাওয়ালিয়া=নৌকা বিশেষ।
  207. ভালা=উত্তমরূপে।
  208. বইন=ভগ্নী।
  209. ‘দিয়াছিলা জাতি’=জাতি দিয়াছিলা অর্থাৎ জাতি ত্যাগ করিয়াছিল জাতি—কর্ম্মকারক।
  210. থাক্যা=চেয়ে, অপেক্ষা।
  211. দিব
  212. করাইতাম=করাইব।
  213. এহাতে=ইহাতে, এ সম্বন্ধে।
  214. ছিড়্যা=ছিন্ন করিয়া, ছিড়িয়া।
  215. করত=করিতে।
  216. ‘না’—এখানে “যে” অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে; এই না=এই যে।
  217. বাড়ীত, বাড়ীৎ=বাড়ীতে। সপ্তমী বিভক্তি।
  218. পদ্দিতে=বংশানুক্রমিক পদ্ধতি।
  219. ‘সাদি..ঘর’ = ছেলেকে কন্যার বাড়ী গিরা বিবাহ করা আমার বংশের প্রথা নহে, অতএব আমার ছেলেরা (নিজ বাড়ীতে) বিবাহ সম্পন্ন না করিয়া তোমার গৃহে যাইতে পারিবে না।
  220. জ্বল্যা=জলিয়া; অন্তরে ব্যথা লাগে।
  221. ছলতাম্=ছলনার ভাব।
  222. জেফত (জেফৎ)=নিমন্ত্রণ।
  223. কটুয়াল=কোটাল।
  224. সুবিস্তরে=বিস্তারিত ভাবে, সকলকেই।
  225. ‘হান্‌জা গুজুরি’=হান্‌জা=সাঁঝ, সন্ধ্যা। গুজুরি=অতিক্রম করিয়া।
  226. পর=প্রহর।
  227. অতইপর=এত পর (অনাত্মীয়)।
  228. কালুকা বিয়ানে=কাল সকালে।
  229. নাওয়েতে=নৌকাতে।
  230. বাদামের=পাল খাটাইয়া।
  231. বায়=বাহিয়া যায়।
  232. আমরারে=আমাদিগকে।
  233. তুল্যা=নৌকা হইতে তীরে নামাইয়া দিয়া।
  234. মাও=মায়।
  235. মইয়ের=মাসীর (পূর্ব্ব ময়মনসিংহের নিম্নশ্রেণীর মুসলমানগণ মাসীকে “মঈ” বলিয়া থাকে)
  236. দেখবাম্ আসিয়া।=সেখানে গিয়া দেখিবার নিমিত্ত।
  237. তারারে=তাহাদিগকে।
  238. লাগায়=(নৌকা) ভিড়ায়।
  239. অস্তেতে=হাতে
  240. লোয়া=লোহা।
  241. ছিকল=শিকল, শৃঙ্খল।
  242. আন্ধাইর=অন্ধকার।
  243. চোর কুটীতে=পূর্ব্বকালে বড় লোকদিগের বাড়ীতে দুই প্রকারের ঘর থাকিত, তাহা প্রায়ই মৃত্তিকার নিম্নে নির্ম্মাণ করা হইত। এইরূপ এক শ্রেণীর ঘরে ডাকাতদের ভয়ে অর্থ গুপ্তভাবে রাখা হইত; অপর শ্রেণীর ঘরে কোন দণ্ডিত ব্যক্তিকে গুরুতর শাস্তি দেওয়া হইত, এই গৃহগুলি লোক দৃষ্টির অন্তরালে থাকিত এবং সাধারণত: “চোরা কুঠরী” বা “চোরকুটি” নামে অভিহিত হইত।
  244. তরাতরি=তাড়াতাড়ি।
  245. সমকে (সম্‌খে, সমুখে)=সাম্‌নে, সম্মুখে।
  246. তুল্যা=ধরিয়া।
  247. বকে=গালি দেয়, বকুনি দেয়।
  248. মরিব=মরিবে।
  249. লৌ=রক্ত।
  250. জারজার=জর্জ্জর, অবসন্ন।
  251. দরদ লাগব=সহানুভূতি বোধ করিবে
  252. লেখ্‌লা=লিখিয়ািছ। ‘কি লেখলা কপালে’=অদৃষ্টে কি লিখিয়াছ!
  253. বিপাকে=বিপদে।
  254. ‘নিরবধি থইয়া’=(সম্প্রতি) আদ্যন্ত বাদ দিয়া।
  255. বিচরায়=অনুসন্ধান করে।
  256. ‘বার চাইতে চাইতে’=অপেক্ষা করিতে করিতে; বার চাওয়া=প্রতীক্ষায় থাক।”— অদ্যাপি ময়মনসিংহে এই কথাটী কথ্যভাষায় ব্যবহৃত হইয়া থাকে।
  257. এহার=ইহার।
  258. আইও=এসো।
  259. চইদ্দ=চৌদ্দ।
  260. ততক্ষণ=তখন।
  261. জানা=বিখ্যাত
  262. তিরসংসারে=ত্রিসংসারে।
  263. জঙ্গ=যুদ্ধ।
  264. হাজারে বিজারে=অসংখ্য পরিমাণে।
  265. বাড়ি=আঘাত, প্রহার
  266. বন্ন=বর্ণ, রং।
  267. আত=হাত।
  268. গজারের ঠুনি=গজার, একপ্রকার বৃক্ষ। ঠুনি=কাঠের খণ্ড বিশেষ, যাহা অন্য কোন ভারীজিনিষকে আটকাইয়া রাখিবার জন্য ব্যবহৃত হয়।
  269. কান্ধ=কাঁধ, ‘স্কন্ধের’ অপভ্রংশ।
  270. চূন=চূর্ণ।
  271. লড়ে=যুদ্ধ করিতে পারে।
  272. কুমইর=কুমীর।
  273. অয়=হয়, আছে।
  274. ‘রাত্রি নিশাকালে’=নিশীথ রাত্রে; ‘গভীর রাত্রি’ অর্থে নিশাকাল শব্দের ব্যবহার হইয়া থাকে।
  275. কইল=কহিল।
  276. আগান্ত বাগান্ত=আদ্যন্ত
  277. কিন্যা=কিনিয়া, ক্রয় করিয়া।
  278. এরে=ইহা।
  279. কোশা=একক্রোশ ব্যাপী লম্বা নৌকা।
  280. সল্লা=পরামর্শ
  281. আইছে=আসিয়াছে
  282. মানত=মানস, ইচ্ছা।
  283. উতযোগ=উদ্যোগী
  284. দরিশন=দর্শন; দেখা। দর্শন পদ্যে দরশন ও দরিশন উভয় প্রকারেই ব্যবহৃত হয়। বর্ষণ শব্দটীও তদ্রূপ বরিষণ ও বরষণ রূপ ধারণ করে। যথা, “এস হে এস সজল ঘন বাদল বরিষণে” রবীন্দ্রনাথ।
  285. এহাতে=এই জন্য।
  286. নিরচয়=নিশ্চয়।
  287. ঘর শব্দটী—বিবাহ অর্থে কখন কখন ব্যবহার হয়। কপালকুণ্ডলা নবকুমার জিজ্ঞাসিত হইয়াছিলেন “আপনার কয় ঘর?” অর্থাৎ আপনি কয়টী বিবাহ করিয়াছেন?
  288. সুস্থর=ধীরে সুস্থে।
  289. দাখিল=উপস্থিত।
  290. কুমাররারে=কুমারদিগকে।
  291. বাড়ীৎ=বাড়ীতে।
  292. দিত=দেবে।
  293. কইনায়=কন্যায়। (কন্যারা)।
  294. কাঠ-গড়া=যূপকাষ্ঠ।
  295. বলছিরা=খড়্গ।
  296. আতে=হাতে।
  297. সর=সহর।
  298. ছাইয়া=পূর্ণ করিয়া।
  299. বিচরাইয়া=খুঁজিয়া।
  300. অইব=হইবে।
  301. ফেরে=বিপদে।
  302. নিয়চয়=নিশ্চয়।
  303. মেইয়া=মেয়ে।
  304. কইনারারে=কন্যাদ্বয়েরে।
  305. এমন......পীর=এই শত্রু যদি পীর (সাধু) ও হয়, তবে ও ইহাকে রাখা উচিত হইবে না।
  306. ন দুয়াইরা=নবদ্বার যুক্ত।
  307. ঝাউগড়ে=ঝাউসমূহ।
  308. সরবরাসর=সোজাসুজি, সরাসর।
  309. নিরচিন্ত=নিশ্চিন্ত।
  310. অঘোরে=একান্তভাবে। (“সুন্দর পুরুষ এক অঘোরে ঘুমায়” মলুয়া)।
  311. অরচিত=হরষিত।
  312. জেতাচাঁদে=শুক্লপক্ষে।
  313. অইত=হবে।
  314. এন=হেন।
  315. অইল=হইল।
  316. মেমান=বিদ্বান; মমীন।
  317. গুছুল=স্নান।
  318. ইরাণের=পারস্যদেশের।
  319. জেওর=অলঙ্কার; জহর।
  320. পিছ=পরাজয়, পশ্চাৎ।
  321. মান্যা=মানিয়া।
  322. বইল=বসিল।
  323. আস্যা=আসিয়া
  324. জিগায়=জিজ্ঞাসা করে। (পূর্ব্ব ময়মনসিংহ ও শ্রীহট্টের স্থান বিশেষে এই শব্দটীর ব্যবহার দেখা যায়)।
  325. অইব নাকি=হইবে কিনা?