পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/ভেলুয়া

৫। ভেলুয়া। (১৩৯―২০৭ পৃঃ)

 “ভেলুয়ার” পালাটি পাঁচখণ্ডে সমাপ্ত। প্রথম খণ্ডে শঙ্খপুরের মদন সাধুর কাঞ্চননগরযাত্রা ও তথায় ভেলুয়ার প্রতি অনুরাগসঞ্চার; এই অনুরাগের ফলে উভয়ের মিলন। মদন সাধুর গৃহে প্রত্যাগমন এবং বন্ধুদের নিকট হৃদয়ভাব প্রকাশ; তাহার পিতা সমস্ত জানিতে পারিয়া কাঞ্চননগরে ঘটক প্রেরণ করেন। কৌলীন্যগর্বে ভেলুয়ার পিতা বিবাহ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

 দ্বিতীয় খণ্ডে মদনের পুনরায় কাঞ্চননগরযাত্রা এবং ভেলুয়াকে গোপনে শঙ্খপুরে লইয়া আসা। মদনের পিতা মুরাই সাধু এই অপহরণের বৃত্তান্ত জ্ঞাত হইয়া মদনকে গৃহবহিষ্কৃত করিয়া দেন। অতঃপর মদনের ভেলুয়াসহ রাংচাপুরে গমন এবং তথায় তাহাদের প্রতি আবুরাজার দৌরাত্ম্য।

 তৃতীয় এবং চতুর্থ খণ্ডে আবুাজার দৌরাত্ম্যের বিস্তৃত বিবরণ। আবুরাজাকর্ত্তৃক ভেলুয়াকে স্বীয় অন্তঃপুরে আনয়ন। ভেলুয়া তাঁহার নির্বাসিত স্বামীর উপদেশানুসারে বন্ধু হিরণ সাধুর দেশে গমন করেন। বন্ধুর ভেলুয়ার প্রতি লোলুপ দৃষ্টি। হিরণ সাধুর ভগিনী মেনকার সহিত ভেলুয়ার পলায়ন, বিশাল নদী বক্ষে আবুরাজার লোক এবং ভেলুয়ার স্বজনগণের জাহাজদর্শনে ভীতা ভেলুয়া ও মেনকার জলে পতন। একটি সাধুচরিত্র বৃদ্ধবণিক কর্তৃক তাঁহাদের উদ্ধার। মদন সাধুর বিরুদ্ধে হিরণের ষড়যন্ত্র। মেনকার পরামর্শে মদন সাধুর উদ্ধার। বৃদ্ধ সাধুর আশ্রয় হইতে আবুরাজার পুনয়ার ভেলুয়াকে আক্রমণ ও স্বীয় অন্তঃপুরে অবরোধ।

 পঞ্চম খণ্ডে সমস্ত বিপদ উত্তীর্ণ হইয়া চৌগঙ্গায় মদন সাধুর আত্মীয়স্বজনের সাহায্যে ভেলুয়াকে উদ্ধার এবং ভেলুয়ার সহিত বিবাহ। আবুরাজাকে উপযুক্ত শাস্তিপ্রদান।

 আবুরাজা কোনও ঐতিহাসিক ব্যক্তি কিনা বলা যায় না; রাংচাপুর মৈমনসিংহ গীতিকায় প্রথম ভাগ-সংলগ্ন মানচিত্রে প্রদর্শিত হইয়াছে।

 এই পালার গানটিতে বিশেষ কোনও কবিত্ব-সম্পদ আছে বলিয়া মনে হয় না। তবে এই কাহিনীতে প্রসঙ্গ ক্রমে বাণিজ্যের যে সকল বর্ণনা আছে, তাহাতে এই দেশ যে এক কালে কত সমৃদ্ধ ছিল তাহার আভাস পাওয়া যায়। বঙ্গদেশে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড নদ-নদী থাকার দরুণ তাহাদের ভঙ্গপ্রবণ তীরদেশে বৃহৎ প্রস্তর বা ইষ্টকালয় নির্ম্মাণ নিরাপদ নহে। এই জন্যই বঙ্গীয় শিল্পীরা তাহাদের মনের মত করিয়া “বাঙ্গালা” ঘর রচনা করিত। এই বাঙ্গালা ঘরে চূড়ান্ত কারুকার্য্য প্রদশিত হইত এবং ইহার এক এক খানির জন্য গৃহস্বামীরা যে অর্থ ব্যয় করিতেন, তাহাতে হয়তঃ ক্কচিৎ বিশাল প্রস্তরপুরী নির্ম্মিত হইতে পারিত। কোনও বৃহৎ প্রকোষ্ঠে সময় সময় ৫২টি পর্য্যন্ত দরজা থাকিত। (১৪৩ পৃষ্ঠা, ৩-৪ ছত্র)। গৃহের কড়িবর্গা খাটি সোণার মোড়া হইত। (১ পৃঃ, ২ ছত্র)। চাদগুলি মাছরাঙ্গা পাখী এবং ময়ূরের পালকে আবৃত হইয়া সূর্য্য কিরণে ছবির ন্যায় ঝলমল করিত। ছাদ কখন কখনও মণিমুক্তাখচিত সুবর্ণ পত্রে মোড়া হইত এবং তাহাতে স্থানে স্থানে অভ্রখণ্ড সংলগ্ন করা হইত। অবশ্য কবির এই সকল বিবরণের উপর আমরা আস্থা স্থাপন করিতে পারি না; কিন্তু অনেক বাদ সাদা দিয়া এই সকল আখ্যান গ্রহণ করিলেও যে দেশের একটা বিশাল সমৃদ্ধির ধারণা হয়, তাহা একেবারে মনঃকল্পিত বলিয়া বোধ হয় না। জাহাজের মাস্তলগুলি খাটি সোণার পাতে আবৃত থাকিত এবং তাহার উপরে স্বর্ণসূত্রে গ্রথিত সমুজ্জ্বল পতাকা উড্ডীন হইত। বণিক কন্যারা রাজকন্যার মত সম্মান পাইতেন। সাধারণতঃ তাঁহদের এক এক জনের বারটি করিয়া সখী থাকিত (১৪৫ পূঃ ১ ছত্র)। খাদ্য দ্রব্যাদির জন্য স্বর্ণ পাত্র ব্যবহৃত হইত। রাজরাজড়ারা সাত লক্ষ টাকা আয়ের জমিদারী উপহার দিয়া প্রণয়িণীর মনোরঞ্জন করিতেন (১৭৫ পৃঃ, ৭২ ছত্র)। যখন কোনও জাহাজ সমুদ্র যাত্রা হইতে ফিরিয়া আসিত, তখন বণিকবধূরা নানারূপ ধর্ম্মানুষ্ঠান করিয়া সেই জাহাজ নদীর তীরে বরণ করিয়া বাণিজ্যের দ্রব্যাদি গৃহে লইতেন। যতই কেন অতিরঞ্জন না থাকুক, এই সকল কথা আমরা যখন বাঙ্গালার ব্রতকথা, রূপকথা এবং পালাগান সর্ব্বত্রই প্রায় এক ভাবে পাইতেছি, তখন কবিরা যে নিতান্ত আকাশ-কুসুম কল্পনা করেন নাই, তাহা অনুমান করা যায়। [শ্রীযুক্ত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুদারের ঠাকুরদাদার ঝুলির ৬৪ হইতে ৬৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।]

 সমাজের যে চিত্র ভেলুয়াতে পাওয়া যাইতেছে, তাহা আমাদের ব্রাহ্মণশাসিত বর্ত্তমান হিন্দু সমাজের মত আদৌ নহে। ইহা ব্রাহ্মণাধিকারের পূর্ব্ববর্ত্তী চিত্র কিংবা মগদিগের সমাজের প্রতিচ্ছায়া, তাহা ঠিক বোঝা যাইতেছে না। রাজবংশী, কোচ প্রভৃতি জাতিদের উপরে মগদিগের প্রভাব কম ছিল না। সুতরাং এই চিত্রগুলি মগ প্রভাবের দ্বারা চিহ্নিত বলিয়া সময়ে সময়ে মনে হয়। এই পালাগানটিতে বাণিজ্যসংক্রান্ত সে সকল কথা আছে, তাহা স্পষ্টতঃ এই দেশের খুব প্রাচীন কালের, সুতরাং পালাগানটি খুব প্রাচীন বলিয়া বোধ হয়। ইহার মধ্যে আদৌ মুসলমানী প্রভাব নাই।

 বিবাহের নিয়ম অত্যন্ত শিথিল ছিল। মদন সাধু ও ভেলুয়া বহুকাল স্বামী-স্ত্রীভাবে বসবাস করার পর ধনঞ্জয় সাধু তাহার পুত্ত্র হিরণ সাধুর সঙ্গে ভেলুয়ার বিবাহ অনুমোদন করিতেছেন (১৭৩ পৃঃ ১৩-১৬ ছত্র)। একটি পলাতকা কুমারী সপ্তদর্শবর্ষ বয়সের সময় প্রণয়ীর সঙ্গে বহুস্থলে পর্য্যটন করিয়া এবং নানাস্থানে অত্যাচারী ব্যক্তিদিের অন্তঃপুরে আবদ্ধ থাকার পর যখন পিত্রালয়ে ফিরিয়া আসিলেন, তখন তিনি সদয় ভাবে গৃহীত হইলেন। ইহা কি খুব বিচিত্র প্রথা নহে? ভেলুয়া এবং মেনকা উভয়েই সপ্তদশবর্ষ অতিক্রম করিয়া প্রণয়ি-মনোনয়ন করিতেছেন (১৩৪ পৃঃ, ৩য় ছত্র)। এই সমাজে ব্রাহ্মণদিগের বিশেষ কোন গৌরবজনক স্থান ছিল বলিয়া মনে হয় না। বিবাহ ব্যাপারটা প্রায় সমস্তই স্ত্রী-আচার। বিবাহোৎসবে যে দান এবং ভোজনাদি ব্যাপারের বর্ণনা আছে, তাহাতে দরিদ্রভোজনের উল্লেখ আছে, কিন্তু ব্রাহ্মণভোজনের কথা নাই (২০৬ পৃঃ, ১০৩ ছত্র)।

 যদিও স্ত্রী স্বাধীনতার ভূরি ভূরি প্রমাণ প্রায় প্রতি পত্রেই পাওয়া যায়, তথাপি এইটিই খুব সুখের বিষয় যে কোন স্থানেই হিন্দুরমনীর অনাবিল পবিত্রতার ব্যত্যয় হয় নাই। সহস্র উৎপীড়ন এবং উৎকট পরীক্ষা সত্ত্বেও সাধ্বী নায়িকারা তাঁহাদের নারীধর্ম্ম অটুট রাখিয়াছেন। যাহা সমাজের নিতান্ত ব্যাভিচার বলিয়া নিন্দনীয় হইতে পারিত, এই শুভ্র পবিত্রতার আলোকে তাহা একান্তরূপে উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। বিবাহের সমাজনীতি এই নায়িকারা উল্লঙ্ঘন করিয়াছেন; কিন্তু হৃদয়ের একনিষ্ঠ প্রেমে তাঁহাদের তিলমাত্রও দোষ বর্ত্তে নাই।

 এই পালাগানটির রচনা অত্যন্ত শিথিল; পয়ারের নিয়ম প্রায়ই রক্ষিত হয় নাই। এবং পূর্ব্বেই বলিয়াছি ইহাতে কবিত্বেরও তেমন কোনও নিদর্শন নাই। তথাপি ঘটনার কৌশলময় পর পর সন্নিবেশের দরুণ পাঠকের কৌতূহল সর্ব্বত্র পরিতৃপ্ত হইয়াছে। বিশেষতঃ চৌগঙ্গায় যখন আবুরাজা অপ্রত্যাশিতভাবে নানাদিক্ হইতে শত্রুদের জাহাজ কর্ত্তৃক পরিবৃত হইলেন, তখনকার দৃশ্য নাট্যকলা-নিপুণতায় বিচিত্র হইয়া উঠিয়াছে।

 চাটগাঁ হইতে বহুদিন পূর্ব্বে “ভেলুয়া” সুন্দরী নামক কাব্য হামিদুল্লা নামক জনৈক মুসলমান লেখক প্রকাশ করিয়াছিলেন। আমার “বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে” তাহার উল্লেখ করিয়াছি। ভেলুয়ার আরও একটি পালা আমরা পাইয়াছি; উহা এই গান হইতে সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র। মুসলমান এবং হিন্দু উভয় শ্রেণীর লোকেই অনেক পালা গান বাজারে প্রকাশ করিতেছেন, কিন্তু এই অর্দ্ধশিক্ষিত প্রকাশকগণ পালাগানের ভাষা পরিবর্ত্তন করিয়া এবং তন্মধ্যে ভারতচন্দ্রী রূপবর্ণনা এবং অশ্লীলতা ঢুকাইয়া দিয়া তাহা এমন বিকৃত করিয়া ফেলেন যে তাহাতে কৃষককবিদের সরল হৃদয়ের মাধুর্য্য, পবিত্রতা এবং অশিক্ষিত রচনাভঙ্গীর সৌন্দর্য্য আর কিছুই থাকে না। কৃষকদের ভাটিয়াল সুর যখন নিয়মাবদ্ধ পয়ারে পরিণত করা হয়, তখন তাহা একেবারে উৎকট হইয়া উঠে।

 চন্দ্রকুমার এই পালাটি বাণিয়াচঙ্গ হইতে সংগ্রহ করিয়াছেন।

ভেলুয়া

আরম্ভ।

মদন সাধুর পরিচয়।

(১)

উজানী নদীর পারেরে আরে ভালা মুরাই সাধু নাম
এইখান হইতে সভাজন শুন তার বিবারণ ২
শঙ্খপুরে আছিল তার ধাম রে।
(দিশা) প্রাণ—ভেলুয়ারে॥ ৪
(আরে ভাইরে)
কুঠীয়াল[] সাধুবর    শঙ্খপুরে ছিল ঘর
ধনরত্নের সীমা তার নাই। ৬
করিয়া শনির পূজা    মুরাই হইল রাজা ৭
এমন ধনী ত্রিভূবনে নাইরে।
(দিশা) প্রাণ—ভেলুয়ারে॥ ৯
কাঠায় মাপ্যা[] তুলে ধনরে আচরিত[] কথা
বড় বড় ঘর তার আটচালা চৌচালা আর ১১
সোণা দিয়া মুড়াইয়াছে মাথা রে।
(দিশা) প্রাণ—ভেলুয়ারে॥১৩
রূপাতে দিয়াছে ঠুনি[]  সোনার পাতে দিছে ছানি[]
টুইয়ের[] মধ্যে রত্ন অলঙ্কার। ১৫



হাজার বাণিজ্য নায়[]   সাগর বাহিয়া যায় ১৬
দেখিতে অতি চমৎকার রে।
(দিশা) প্রাণ—ভেলুয়ারে॥ ১৮
সোনার মাস্তুল তার আসমানেতে উঠে
সোনার বৈঠা সোনার নাও সোনার নিশান তায়। ২০
বান্ধা থাকে মুড়াই সাধুর ঘাটেরে।
(দিশা) প্রাণ—ভেলুয়ারে॥ ২২
উজান পানি ভাইটাল পানিরে সাধু বাইয়া
উত্তরে জৈন্তার পাড়[] কথা তার চমৎকার ২৪
তথা সাধু ডিঙ্গা বাইয়া যায়রে।
(দিশা) প্রাণ—ভেলুয়ারে॥ ২৬
করিয়া শনির পূজারে সাধু পাইল এক ধন
মদন তাহার নাম যেন পুন্নুমাসীর চান[]। ২৮
এক পুত্র প্রথম যৈবন রে।
(দিশা) প্রাণ—ভেলুয়ারে॥
(আরে ভাইরে)
অপরূপ রূপ তার রে দেখিতে সুন্দর,
কাঞ্চা[১০] সোনার তনু পরভাত কালের ভানু, ৩২
নাম তার মদন সদাগর রে।
(দিশা) প্রাণ—ভেলুয়ারে॥ ৩৪
কুড়ি না বচ্ছরের বাছারে একুশেতে পড়ে,
মায়ে বাপে চিত্তে আর বিয়ের সময় হইল পার, ৩৬
মুরাই সাধু ভ্রমে দেশান্তরে রে[১১]
(দিশা) প্রাণ—ভেলুয়ারে॥ ৩৮



এইখানে সভাজন   থইয়া[১২] তার বিবরণ
ভেলুয়া-কাহিনী কথা শুন। ৪০
যে দেশে জন্মিল নারী   জিনিয়া সুন্দর পরী ৪১
মন দিয়া শুন রূপ গুণ রে।
(দিশা) প্রাণ—ভেলুয়ারে॥ ৪৩


ভেলুয়ার পরিচয়

(২)

পাঁচ খণ্ডি[১৩] ভেলুয়ার কথা অতি চমৎকার।
মন দিয়া শুন সবে বিবরণ তার॥
(ভাইরে ভাই)  কাঞ্চন নগরে ছিল মানিক সদাগর।
এত বড় ধনী নাই সংসার ভিতর॥ ৪
পাঁচ খণ্ড বাড়ী তার সোনাতে বান্ধিয়া।
বড় বড় ঘর সাধু রাখ্যাছে ছান্দিয়া[১৪]
বায়ান্ন দুয়াইরা ঘর আভে দিছে ছানি[১৫]
মধ্যে মধ্যে বসাইয়াছে সাধু যত মুক্তামণি॥ ৮
চান্দের সমান পুরী ঝিলমিল করে।
যেই জন দেখে পুরী বাখানে সাধুরে॥
বড় বড় পুষ্কুণী[১৬] রূপায় বান্ধা ঘাট।
পুরীর মধ্যে আছে সাধুর পাতা লক্ষ্মীর পাট[১৭]॥ ১২

চান্দ সদাগরের বংশ জাতিতে কুলীন।
বংশের গৈরবে সাধু অন্যে ভাবে হীন॥
পাঁচ পুত্র আছে সাধুর ঘরের পাঁচ বাতি।
এক কন্যা আছে তার যেমন মদনের রতি॥ ১৬
রূপেতে রূপসী কন্যা অগ্নি যেমন জ্বলে।
রূপের তুলনা তার সংসারে না মিলে॥
মেঘের বরণ কেশ কন্যার তারার বরণ আঁখি।
এমন সুন্দর রূপ সংসারে না দেখি॥ ২০
পরথম যৌবন কন্যার সোণার বরণ তনু।
কপালেতে আঁইক্যা[১৮] রাখছে শ্রীরামের ধনু॥
হাঁটিতে ভাঙ্গিয়া পড়ে অঙ্গের লাবনি[১৯]
চাঁদ জিনিয়া কন্যার চন্দ্রমুখ খানি॥ ২৪
চলিতে চাঁচর কেশ কন্যার মাটিতে লুঠায়।
দাসীগণ ধইর। রাখে না দেখে উপায়॥
আসমানেতে কাল মেঘ চান্দে ঢাইক্যা রাখে।
ভাঙ্গা কেশ পড়ে যখন রে সুন্দর কন্যার মুখে॥ ২৮
বাপের আছে ধনরত্ন সীমা সংখ্যা নাই তায়।
রত্ন অলঙ্কার কন্যার চরণে লুঠায়॥
রূপেতে উজালা কন্যার কাঞ্চন নগরী।
আদর কইরা নাম রাখছে (বাপ মায়) ভেলুয়া সুন্দরী॥ ৩২

ষোল বছর গিয়া কন্যার সতরতে পড়িল।
কন্যারে দেখিয়া সাধু চিন্তিত হইল॥
নানা দেশে যায় সাধু বানিজ্যি কারণ।
মন দিয়া চিন্তে সাধু ভেলুয়ার বিবরণ[২০]॥ ৩৬

এক মিলে আর নাই বংশে হয় খাট।
এমন বিয়া দিয়া কেন কুল করি ঘাট[২১]
চন্দ্র হেন কন্যা আমার সূর্য্য হেন পতি[২২]
বিয়ার লাগ্যা মানিক সাধু ভাবে দিবা রাতি॥ ৪০
ভাবিয়া চিন্তিয়া সাধু-এক যুক্তি করে।
পাঁচ পুত্র পাঠাইল বর খুঁজিবারে॥
আপনি লইয়া ডিঙ্গা ফিরে নানা দেশে।
বর খুঁজিবারে সাধু ফিরে নানা দেশে॥ 88
কিসের বাণিজ্য সাধুর কিসের বাড়ী ঘর।
যত দিন না পাইবাম কন্যার যোগ্য বর॥ ১-৪৬

* * * * *

(৩)



(স্নানের ঘাটে ভেলুয়া ও মদন সাধুর সাক্ষাৎ)


সোনার বাটায় গাইষ্ঠ্য গিলা[২৩] রূপায় বাটায় পান।
ছান[২৪] করিতে যায় কন্যা অগ্নির সমান॥ ২
পাঞ্চ[২৫] ভাইয়ের বউ সঙ্গে চল্যা ঘাটে যায়।
ভেলুয়ার বার দাসী সঙ্গে সঙ্গে যায়॥ ৪
গন্ধ তৈলে মাখা কেশ বাতোসে উড়ায়।
অঙ্গের সুগন্ধে কন্যার বসন্ত লাজ পায়॥
গন্ধেতে উড়িয়া আইসে ভ্রমর ভ্রমরী।
নদীর ঘাটে গেল কন্যা ভেলুয়া সুন্দরী॥ ৮

দৈবেতে ঘটাইল যাহা শুন দিয়া মন।
বিধাতা লেখ্যাছে যাহা কপাল-লিখন॥
চৌদ্দ ডিঙ্গা বাহি তথা মুরাই নন্দন।
কাঞ্চনা নগরীর ঘাটে দিলা দরিশন॥ ১২
নদীর কিনারে পুরী দেখিয়া সুন্দর।
সেই খানে বান্ধে ডিঙ্গা মদন সদাগর॥
এমন সময় দৈবযোগে ভেলুয়া সুন্দরী।
ছান করিতে আইল ঘাটে লইয়া সহচরী॥ ১৬
জলেতে নামিয়া কন্যা করে জলকেলি।
পঞ্চ ভাইয়ের বউএ দেখ্যা হাসে খল খলি॥
কেউবা সাঁতার দিয়া সাঁতার জলে[২৬] যায়।
ভেলুয়া সুন্দরী থাক্যা দেখে কিনারায়। ২০

আচানক[২৭] সাধুর ডিঙ্গা কোথা হইতে আইল।
না জানি কোন্ দেশে কাইল রজনী পোষাইল[২৮]
কোথা হইতে আইল সাধু কোথায় বাড়ীঘর।
কারে বা জিজ্ঞাসা করি কে দেয় উত্তর॥ ২৪
কোন্ বা দেশে যাইব সাধু বাণিজ্য কারণ।
এই মত নানা কথা কন্যা ভাবে মনে মনে॥
জলের ঘাটে ছান করে যত সহচরী।
কিবা দেখ্যা এমন হইল ভেলুয়া সুন্দরী॥ ২৮

সাঁতার নাহি দিল কন্য। হাসি নাই মুখে।
মনের যত কথা কন্যা মনে লুইক্যা[২৯] রাখে॥

কি জানি ভিন্ দেশী সাধু কোথা হইতে চায়।
বস্ত্র সম্বরিয়া কন্যা ঢাইক্যা রাখে গায়॥ ৩২
হাঁটু জল হইতে কন্যা নামে গলা জলে।
আউলাইয়া মাথার কেশ কন্যা ভাসে নদীর জলে॥
চান্দের সমান মুখ মেঘেতে ঢাকিল।
এমন সময় মদন সাধু বাইর অইয়া আসিল॥ ৩৬
আইজ কিরে পরভাতের ভানু ডিঙ্গা বাইয়া যায়।
সাধুর পানেতে কন্যা আড় নয়নে চায়॥
জলেতে ভাসিয়া যায় পুন্নুমাসীর চান।
কন্যারে দেখিয়া সাধু হারাইল জ্ঞান॥ ৪০

এই দেখা পরথম দেখা জলের ঘাটে অইল।
উভেতে উভেরে[৩০] দেখ্যা পাগল অইয়া গেল॥
চান্দ সূরুষে যেমন হইল মিলন।
মনের যতেক কথা কহিল নয়ন॥ ৪৪
চলিতে না চলে পাও সঙ্গে সখীগণ।
উপরে উঠিল কন্যা বিরস বদন॥
উপরে উঠিয়া কন্যা আড়নয়নে চায়।
কি জানি মনের কথা কেউ জানতে পায়॥ ৪৮
পরাণে না মানে কন্যা চলিতে না পারে।
পাও যদি চলে কন্যার মন নাহি সরে॥
আবার হইল কথা নয়নে নয়নে।
বুঝিতে না পারে কথা হইল গোপনে॥ ৫২
ডিঙ্গাতে থাকিয়া সাধু উঁকি ঝুঁকি চায়।
মনের যতেক কথা নয়নে বুঝায়॥

মনেতে বিদায় মাগি কন্যা চলে নিজ ঘরে।
ভিজা কেশের ভারে কন্যা চলিতে না পারে॥ ৫৬

দাসীরা ধরিয়া নেয় কন্যার ভিজা কেশ।
সম্বরিয়া চলে কন্যা আপনার বেশ॥
এমন সময় মদন সাধু কি কাম করিল।
সঙ্গের সাথী শুক পংখী উড়াইয়া দিল॥ ৬০
উড়িতে উড়িতে শুষ্ক কাঞ্চন নগরে।
একবারে বইল[৩১] গিয়া কন্যার মন্দিরে॥ ১—৬২

(৪)



কোথা হইতে আইলারে পাখী কোথায় বাড়ী ঘর।
কি নাম রাখ্যাছে তোমার সাধু সদাগর॥
কোন্ দেশ হইতে আইল সাধু কোন্ বা দেশে গেল।
কি ক্ষণে স্থানের ঘাটে চক্ষের দেখা হইল॥ ৪
দেখিতে সুন্দর কুমার চান্দের সমান।
বাপে মায়ে রাইখ্যাছে সাধুর কিবা নাম॥
বাণিজ্য করিতে যায় সাউধের[৩২] নন্দন।
ছানের ঘাটে হইরা[৩৩] নিল অবলার মন॥ ৮
মন নিল জীবন নিল আর নিল যৈবন।
সঙ্গে কইরা নাই সে নিল কুটীল দুষমন[৩৪]
মুখখানি হাসি খুসী মন খানি বিষ।
আড়নয়নে চাইয়া মোরে করলে হার-দিশ[৩৫]॥ ১২
ঘরে নাহি থাকে মন নাহি মানে মানা।
এখনে যৈবন নদী বহিল উজানা[৩৬]

জান যদি কওরে পংখী হইয়া খবইরা[৩৭]
বাণিজ্যে গিয়াছে সাধু কবে আইব ফিইরা[৩৮]॥ ১৬

শুক।



“উজানি নদীর পারে শঙ্খপুর গেরাম।
তথায় বৈসে মহাজন মুরারী সাধু নাম॥
সেইত সাধুর পুত নামটী মদন।
আমার রাখ্যাছে নাম সেই হীরামন॥২০
বাণিজ্য করিতে সাধু গেছে পর দেশে।
জলের ঘাটে কন্যা তুমি থাক আশার আশে"॥

মুরুখ বনেলা[৩৯] পাখী অধিক কইতে নারে।
এই কথা মদন সাধু শিখায়েছে তারে॥ ২৪
আর বার সুধায় কন্যা কইরা কাণাকাণি।
এক কথ। বলে পাখী পরিচয়-বাণী॥ ২৬

* * * * *


রাতি হইল গরল বিষ যৈবন হইল কালি[৪০]
উঠি বসি করে কন্যা বুক হইল খালি॥
ছাড়িয়া পিঞ্জরার শারী মিলায় দুজন।
এই মতে আসিবেনি সাধুর নন্দন[৪১]॥ ৩০

* * * * *


দিশাঃ পাষাণ হৈয়াছে সাধু বৈদেশে।
কোন্ বা দেশে গেল সাধু তরীখানি বাইয়া।
নিশি দিন থাকে কন্যা পথের পানে চাইয়া॥

একদিন দুই দিন তিন দিন যায়।
গণিতে গনার দিন আর না ফুরায়॥ ৩৪
সাধুর লাগিয়া কন্যা আছে আশার আশে।
পাষাণ হইয়া সাধু গিয়াছে বৈদেশে॥
বস্ত্র[৪২] নাহি পরে কন্যা নাহি বান্ধে কেশ।
দিনে দিনে হইল কন্যার পাগলিনীর বেশ॥ ৩৮
আছিল সোনার তনু মৈলান[৪৩] হইল।
মদন সাধুর লাগ্যা কন্যা কত বা কান্দিল॥
মেঘের বরণ কেশ কন্যার হইল পিঙ্গল ছটা।
তৈল নাহি দেয় কন্যা কেশে বান্ধল জটা॥ ৪২
উন্মত্ত[৪৪] যৌবনে কন্যা সাজিল যোগিনী।
তারে দেখ্যা পাড়াপড়শী করে কানাকানি॥
কপাট খাটিয়া[৪৫] কন্যা একেলা মন্দিরে।
পুষ্পের পালঙ্কে শুইয়া খালি চিন্তা করে॥ ৪৬
সাধুর লাগিয়া কন্যা আছে আশার আশে।
পাষাণ হইয়া সাধু গিয়াছে বৈদেশে॥ ৪৮
সেওত পুষ্পের পালঙ্ক কাঁটা বন হইল।
পালঙ্ক ছাড়িয়া কন্যা আইঞ্চল পাত্যা[৪৬] শুইল॥
ঘুমাইয়া স্বপন দেখে সাধু আইল ফিরি।
স্বপন দেখিয়া কন্যা উঠে তাড়াতাড়ি॥ ৫২
উইড়া যাওরে শ্যাম শুক অইনা কোন্ দেশে।
যেখানে গিয়াছে সাধু বাণিজ্যের আশে
উদাসী হইয়া কন্যা পক্ষীরে সুধায়।
উইড়া গিয়া খবর কও বন্ধুর তথায়॥ ৫৬

সই সঙ্গতীরা[৪৭] সবে করে কানাকানি।
সাধুর কুমারী কন্যা হইল পাগলিনী॥
সাধুর লাগিয়া কন্যা আছে আশার আশে।
পাষাণ দিয়াছে সাধু বৈদেশে॥ ৬০

(৫)


একদিনের কথা সবে শুন দিয়া মন।
বৈদেশ হইতে ফিরে সাধুর নন্দন।
সোনার নৌকায় লাল নিশান ঐ যে দেখা যায়।
দূর হইতে আইসে সাধু শব্দ[৪৮] শোনা যায়॥ ৪
কাছারে ঢেউএর বাড়ি[৪৯] পাড়ায় পড়ল সারা।
সাধুরে দেখিতে সবে পারে হইল খাড়া॥

শুনিয়া সাধুর কথা ভেলুয়া সুন্দরী।
মনে মনে ভাবে অখন কিবা উপায় করি॥ ৮
যদি মোর প্রাণ পিয়া এই না তরী বাইয়া।
বাপের দেশে আইস্যা থাকে আমার লাগিয়া॥
কেমনে যাই জলের ঘাটে কেবা যায় সাথে।
কোন দেশেতে যাইব আমি ঐনা জলের পথে॥ ১২
মনে হইল চিন্তা ভারী নিশি স্বপ্ন প্রায়।
ভাবিতে চিন্তিতে কথা আর না ফুরায়।
কত সাধু আইসে যায় কত ডিঙ্গা বাইয়া।
নানাদেশে যায় তারা এই পথ দিয়া॥ ১৬
কত সাধু আইল আর কত সাধু গেল।
অভাগীর কপালের দুঃখু আর না ঘুচিল॥

নিশির স্বপ্নের কথা হয় বা না হয়[৫০]
এই ডিঙ্গায় যে আইছে সাধু কি তার পরতয়[৫১]॥২০
মুখেতে চান্নিমার পর[৫২] মৈলান হইয়া গেল।
শুকের গলা ধইরা কন্য কান্দিতে লাগিল।
শুকেরে জিগায় কন্যা দুস্থের বিবরণ।
এই ডিঙ্গায় আইছে নি কও সাধুর নন্দন॥ ২৪
মূরুখ বনিয়ালা পাখী এক কথা কয়।
সেই কথা কন্যার কাছে সাধুর পরিচয়॥ ২৬

দরবারে বসিয়া আছে মানিক সদাগর।
চাইর দিকে সাইসঙ্গত[৫৩] কত বহুতর॥
হেন কালে মদন সাধু কোন্ কাম করে।
হীরামন মাণিক্য লইয়া ভেটাইল সাধুরে॥ ৩০
মাণিক সাধু কয় আরে সাধু সদাগর।
কি কাজে আইসাছ তুমি কোন্‌বা দেশে ঘর॥
চান্দের সমান রূপ নাহি দেখি আর।
কিবা নাম মাতা পিতার কিবা নাম তোমার॥ ৩৪

আমার বাপের নাম মুরারী সদাগর।
উজানি নদীর পারে শঙ্খপুরে ঘর।
বাণিজ্য কারণে ঘুরি আমি তাহার নন্দন।
বাপমায় নাম মোর রাইখ্যাছে মদন॥
বড় দাগা পাইয়া আইসাছি তোমার কাছে।
বিধাতা লেপ্যাছে দুস্থ কপালে ফল্যাছে[৫৪]

সাগর মোর ঘর বাড়ী সাগর বাইয়া যাই।
চৌদ্দ ডিঙ্গা ধন থইয়া শুকেরে হারাই[৫৫]॥ ৪২
প্রাণ-সম শুক মোর নিশায় গেল উইড়া।
তাহার লাগিয়া আমি হইয়াছি বাউরা[৫৬]
কত দেশে গেছি আমি'কত সাধুর স্থানে।
হীরামন শুক মোর পাইনি সন্ধানে॥ ৪৬
কোথাও না পাইলাম পাখী দিন যায় বৈয়া।
আইলাম তোমার দেশে খবর পাইয়া॥
খবইরা কইয়াছে খবর আমার বির্দ্দমানে[৫৭]
এক শুক আইছে উইড়া তোমার ভবনে। ৫০
আছয়ে তোমার কন্যা ভেলুয়া সুন্দরী।
এক শুক পালিতেছে অতি যতন করি॥

এই কথা শুনিয়া সাধু কোন্ কাম করে।
খবইরা পাঠাইল সাধু ভেলুয়ার গোচরে॥ ৫৪
থাকে যদি শুক পক্ষী পিঞ্জিরায় কইরা আন।
হুকুম শুনিয়া খুসী সাধুর নন্দন॥
খবইরা আনিল শুক পিঞ্জিরায় করিয়া।
পক্ষী নিলে[৫৮] নিবা তুমি পরিচয় দিয়া॥ ৫৮
সাধু বলে পরিচয় আমি নাহি দিব।
আপন পরিচয় পক্ষী নিজে কইয়া দিব॥

শিখান্য বানাইন্য[৫৯] পক্ষী কহে পরিচয়।
যে গান শিখায়েছিল সাধু মহাশয়॥ ৬২
উজানি নদীর পারে শঙ্খপুর গেরাম।
তথায় আছে মহাজন মুৱাই সাধু নাম॥
সেই সাধুর এক পুত্র নাম তার মদন।
আমার রাখিল নাম সেই হীরামন॥ ৬৬

পরিচয় শুইন্যা সাধু আশ্চর্য লাগিল।
পিঞ্জিরা সহিতে শুক সাধুর কাছে দিল॥
হীরামন মানিক্য দিল সাধুর নন্দনে।
বিদায় হইয়া যায় সাধু আপনার স্থানে॥ ৭০

ডিঙ্গায় উঠিল সাধু শুক পক্ষী লইয়া।
এক বাঁক পানি সাধু গেল যে বাহিয়া॥
সন্ধ্যা গোঁয়াইয়া গেল আইলা রজনী।
ভাবিয়া চিন্তিয়া সাধু ফিরায় তরণী॥ ৭৪
আর বার ঘাটে আইস্যা সাধুর নন্দন।
শুকেরে শিখায় সাধু করিয়া যতন॥

শুকের পাঠ।


“উঠ উঠ কন্যা তুমি কত নিদ্রা যাও।
আমি ডাকি শুক পক্ষী আঁখি মেইল্যা চাও॥ ৭৮
পুষ্প কাননে তোমার পুষ্প গেল চুরি।
উঠলো প্রাণের কন্যা নিশা হইল ভারী[৬০]॥”

মধ্য না নিশায় সাধু কোন্ কাম করে।
উড়াইয়া দিল পক্ষী ভেলুয়ার গোচরে॥ ৮২

উড়িতে উড়িতে পক্ষী ভেলুয়ার মন্দিরে।
নিশাকালে কয় কথা ডাকিয়া কন্যারে॥
“উঠ উঠ-কন্যা তুমি কত নিদ্রা যাও।
আমি ডাকি শুক পক্ষী আঁখি মেইল্যা চাও॥ ৮৬
পুষ্প কাননে তোমার পুষ্প গেল চুরি।
উঠলো প্রাণের কন্যা নিশা হইল ভারী॥”

আঁখিতে নাই নিদ্র লেশ করে ছট ফটি।
শুকের ডাকনে[৬১] কন্যা বসিলেক উঠি॥ ৯০
কপাট খুলিয়া কন্যা আসিল বাহিরে।
তারা যে ভাসিয়া যায় আসমান সায়রে[৬২]
মাইঝ[৬৩] আকাশে চাঁদ উঠে দুপুর রাতি যায়।
মাথায় হাত দিয়া কন্যা চিন্তয়ে উপায়॥ ৯৪
সাই সঙ্গতীরে কন্যা কিছু না কহিল।
একেলা পুষ্পের বনে পরবেশ করিল॥
গোপন করিয়া কন্যা শারী লইল সাথে।
শ্যাম শুক উইড়া বইল কন্যার শিরেতে॥ ৯৮
ডাইল[৬৪] নোয়াইয়া কন্যা পুষ্প তুলতে চায়।
সম্মুখে চাহিয়া দেখে কিসে দেখা যায়॥
চান্দ কি নামিয়া আইল পুষ্পের কাননে।
দুইজনে দেখা হইল নিশীথে গোপনে॥

ফইল্যা[৬৫] গেল নিশির স্বপ্ন তারা দুই জনে।
নিরীলা বসিল গিয়া পুষ্পের কাননে॥ ১০২
“কোন্ পথে আইলা তুমি কেবা দিল কইয়া।
তোমার লাগ্যা ফিরি আমি পাগল হইয়া॥

সাধুর নন্দন হইয়া পেশা পুষ্প চুরি।
তোমারে দেইখ্যা পাগল আমি হইয়াছি সুন্দরী॥”১০৬

“যে দিন দেখ্যাছি তোমায় ঐ না জলের ঘাটে।
বিদেশে বাণিজ্যে কন্যা মন নাহি উঠে॥”

মাণিক্যের অঙ্গুরী সাধু লইল খুলিয়া।
ভেলুয়ার আঙ্গুলে সাধু দিল পরাইয়া॥১১০
মালতীর মালা কন্যা করিয়া যতন।
রতি যেন সাজায় কন্যা আপন মদন॥

“বিদায় দেওল প্রাণ প্রেয়সী নিশি হইল ভারী।
কেউ না দেখিতে আজি ফিরিবাম বাড়ী॥”১১৪

“তোমারে ছাড়িতে বন্ধু প্রাণ নাহি ধরে।
চল যাইরে প্রাণের বন্ধু আপন মন্দিরে॥
কেউ না দেখিব তোমায় চাইপ্যা[৬৬] রাখ্‌ব কেশে[৬৭]
তোমারে লইয়া আমি ফিরবাম নানা দেশে॥১১৮
বাপ ছাড়বাম মাও ছাড়বাম ছাড়বাম পঞ্চ ভাই।
তোমার সঙ্গে যাইবাম আমি অন্য চিন্তা নাই॥
কেমন কইরা ছাইড়া দিবাম বুক করিয়া খালি।
প্রাণের বন্ধু ছাইড়া গেলে হইবাম পাগলী॥১২২
নিতান্ত যাইলে বন্ধু ডিঙ্গায় কইরা লও।
আমারে ছাড়িয়া গেলে মোর মাথা খাও॥
তুমি যদি ছাইড়া যাও প্রাণে নাহি বাঁচিব।
চুম্বিয়া হীরার বিষ পরাণ ত্যজিব॥”১২৬

গলেতে ধরিয়া মদন কন্যারে বুঝায়।
কেমনে হইবে বিয়া চিন্তে সে উপায়॥

“আগেত যাইব আমি বাপের সদনে।
শান্ত হইয়া থাক কন্যা আপন ভবনে॥১৩০
কয়দিন থাক কন্যা চিত্ত স্থির করি।
বিদায় দেও প্রাণের কন্যা যাই নিজ বাড়ী॥”

“যাও যদি প্রাণের বন্ধু কই যে তোমারে।
শুক পক্ষী রাইখ্যা[৬৮] যাইবা আমার মন্দিরে॥”১৩৪

“এই শুক পক্ষীর দাম সাত মানিক কড়ি।
মূল্য দিয়া কিন যদি তবে দিতে পারি॥”

“তোমার আছে শুক পক্ষী আমার আছে শারী।
শুক পক্ষী রাইখ্যা আমি শারী বদল করি॥”১৩৮

সাধুর নন্দন কহে আর দিবা ধন।
কন্য। কহে দিলাম আমার নবীন যৈবন॥
জীবন দিলাম যৈবন দিলাম আরও দিলাম শারী।
বিদায় দেওগো প্রাণ প্রেয়সী যাই নিজের বাড়ী॥

নিশি শেষ হইল প্রায় ভোমরায় রোল করে।
ডিঙ্গায় উঠিয়া সাধু ভাসিল সায়রে॥১৪৪
ছয়মাসের পথ সাধু এক মাসে যায়।
শঙ্খপুর গ্রাম খানি সামনে দেখা যায়॥
আর্গিয়া পুছিয়া[৬৯] মায় ডিঙ্গার যত ধন।
আঞ্চলে ঢাকিয়া লইল বাছাই নন্দন॥[৭০]
জয়াদি জোকার[৭১] দিয়া ঘরে লইয়া যায়।
বাণিজ্যের কুশল-বার্ত্তা বাপে যে জিগায়॥১৫০

(৬)

বিরয়[৭২] বিচ্ছেদে সাধুর মলিন সোনার তনু
মেঘে ঢাইক্যা রাখছে যেমন পরভাত কালের ভানু॥
চিন্তা জ্বর আইল অঙ্গে বড় বিষম দায়।
অন্তর ব্যাধি হইল না বুঝে বাপ মায়॥
সাইসঙ্গতীরা সবে করে কানাকানি।
কেন যে এমন হইল কিছুই না জানি॥
এক দুই করি কথা সকলে শুনিল।
শেষ মেশ্[৭৩] যত কথা মুরাইর কানে গেল॥

মুরারী সাধুর বিবাহের প্রস্তাবসহ ঘটক প্রেরণ।


হিরামন মানিক্য আর চৌদ্দ ডিঙ্গা ধন
ঘটক পাঠাইল সাধু বিবাহের কারণ॥
কাঞ্চন নগরে ঘটক চৌদ্দ ডিঙ্গা লইয়া।
বিয়ার কারণে যায় সায়র বাহিয়॥১২

ঘটক কহিল গিয়া সাধুর বির্দ্দমানে।
যে কারণে আইছি আমি তোমার ভবনে॥
এক কন্যা আছে তোমার পরমা সুন্দরী।
হইল বিয়ার কারণ তার আইলাম তোমার পুরী[৭৪]১৬
উজানি নদীর পারে শঙ্খপুর গেরাম।
তথায় আছে মহাজন মুরাই সাধু নাম॥
সেই সাধুর এক পুত্র নাম তার মদন।
আমারে পাঠাইল সাধু বিয়ার কারণ॥২০

দেখিতে সুন্দর রূপ কার্তিক কুমার[৭৫]
রূপে গুণে যোগ্য বর কন্যার তোমার॥
এই কথা শুন্যা সাধু ভাবে মনে মনে।
ঘটকেরে কহে সাধু সবার বির্দ্দমানে॥২৪
“আমার বংশের কথা কইতে উচিত হয়।
আগেত কহিব কথা শুন মহাশয়॥
বংশের ঠাকুর মোর চান্দ সদাগর।
সাপেতে খাইল যার পুত্র লক্ষ্মীন্দর॥২৮
বণিক বংশেতে আমি সবার কুলীন।
অকুলীনে কন্যা দিলে জাতি হইবে হীন॥
বণিক-সমাজে আমি খাই সোণার থালে[৭৬]
পরধান পিরিতে[৭৭] আমি বইসি সভাস্থলে॥৩২
আমার বংশের কাছে সবের মাথা হেট্।
কুলে মানে ধনে বংশে আমি সবার শেঠ[৭৮]
বিশেষ কন্যার বিয়া বংশ চাইয়া দিব।
অকুলীনে কন্যা দিয়আ জাতি না ঘাটিব[৭৯]৩৬
চন্দ্রের সমান বংশ জাতে কালি নাই।
দেইখ্যা শুইন্যা কেমন কইরা সাগরে ভাসাই॥
কত সব আইল গেল মন নাহি উঠে।
এই বংশে কন্যা দিলে মোর বংশ টোটে[৮০]৪০

বিদায় হইয়া ঘটক গেল নিজের স্থানে।
মুরাই এবে কহে কথা বসিয়া গোপনে॥

শুনিয়া মুরাই সাধু দুঃখিত হইল।
পুত্রের বিয়ার লাইগ্যা অপমান পাইল॥৪৪
এই কথা মদন সাধু যখন শুনিল।
বুকেতে নির্ঘাত তার শিরে ঠাডা[৮১] পইল্ল॥
ঘরে নাহি বসে মন মায়ে বাপে কয়।
ফিরাবার[৮২] বাণিজ্যে যায় সাধুর তনয়॥৪৮
গণকে বাছিল দিল ভাল দিন চাইয়া।
চৌদ্দ ডিঙ্গা ভরে সাধু নানা দ্রব্য দিয়া॥
কন্যার দেওয়া শারী মদন সঙ্গেতে লইল।
মায়ে বাপের আগে গিয়া দরিশন দিল॥৫২
পন্নাম করিয়া সাধু কয় বাপ মায়।
বৈদেশে যাইতে মোরে করহ বিদায়॥
“আরেক কথা মোর যতনে পালিবা।
সলুকা দাসীরে মোর সঙ্গে কইরা দিবা॥”৫৬

ভাল দিন ভাল ক্ষণ ভাল সময় চাইয়া।
ডিঙ্গায় উঠিল সাধু সলুকারে লইয়া॥
বাহিয়া সায়র পথ মদন সাধু যায়।
সম্মুখে কাঞ্চন নগর ঐ না দেখা যায়॥৬০
ভাইটাল[৮৩] বাকে থইয়া[৮৪] ডিঙ্গা কোন কাম করে।
পরাণের কতক কথা কহে সলুকারে॥

“হীরা মুক্তা দিয়াম যত রত্ন অলঙ্কার।
পরাণী বাছাইতে[৮৫] ধাই[৮৬] উচিত তোমার॥৬৪
এই শারী লইয়া যাও কাঞ্চন নগরে।
শারীরে বিকাইয়া[৮৭] আইস কই যে তোমারে॥

বিনামূল্যে যেই জন রাখে এই শারী।
সেই জন জাইন্যো প্রাণের ভেলুয়া সুন্দরী॥৬৮
নিরালা[৮৮] আনিয়া তারে এই কথা কইও।
কন্যার প্রাণের শারী কন্যার কাছে দিও॥
সায়রের জলে মোর ভাসাইব জীবন।
না পাই কন্যারে যদি জন্মের মতন॥৭২
ভাইটাল বাকে আছি আমি চৌদ্দ ডিঙ্গা লইয়া।
গোপনে কন্যারে তুমি আনিও কহিয়া॥
ভালা যদি বাসে মোরে রাত্র নিশাকালে।
পুষ্পবনে হইবে দেখা নিশীথে নিরালে॥৭৬
পিঞ্জরা সহিতে শারী সলুকা লইল।
কাঞ্চন নগরে গিয়া দরিশন দিল॥
শাড়ী বেচিতে সাধুর অন্দরেতে যায়।
কেহ নাহি রাখে শারী ঘুরিয়া বেড়ায়॥৮০

আওলাইয়া[৮৯] মাথার কেশ আপন মন্দিরে।
শুইয়া আছে সুন্দর কন্যা পালঙ্ক উপরে॥
তথায় সলুকা গিয়া পিঞ্জর নামাইল।
শারীরে দেখিয়া কন্যা তখনি চিনিল॥৮৪
সলুকারে কয় কন্যা খাও মোর মাথা।
এমন সোণার শারী তুমি পাইলা কোথা॥
সলুকা কহিছে আমি দেশে দেশে যাই।
নগরে নগরে ঘুরি পক্ষী বেইচ্যা খাই॥৮৮
বনেতে আছিল এই শুক আর শারী।
দৈবের নির্ব্বন্ধ কথা শুন লো সুন্দরী॥

তুফানে[৯০] গজারী বন ভাইঞ্জা নাশ হইল।
শারীরে রাখিয়া শুক কোন বা দেশে গেল॥৯২
উড়িতে উড়িতে শারী মোরে দিল ধরা।
পিঞ্জরে ভরিয়া আমি করিতেছি ফিরা[৯১]

* * * * *

হীরা মণি মুক্তা দিব রত্ন অলঙ্কার।
জানিয়া খবর ধাই কও যদি তার॥৯৬
পূর্ব্বপর কথা ধাই তুমি সব জান।
পরিচয় দিয়া ধাই বাচাও পরাণ॥
গলা হইতে খুলে কন্যা হীরামণ হার।
পরথমে সলুকারে কন্যা দিল পুরস্কার॥১০০
শারী যে কিনিব ধাই কিবা মূল্য চাও।
সত্য কথা বল ধাই মোরে না ভাবাও॥

* * * * *

সলুকা কহিছে কথা শুনহে সুন্দরী।
বিনামূল্যে যেই কিনে বিকাইব শারী॥১০৪

* * * * *

গোপনে গাছের তলে নিরালে[৯২] নিবিলে[৯৩]
ভেলুয়ার কাছে কথা চুপি চুপি বলে॥
ভাইটাল বাকে আছে নাগর[৯৪] চৌদ্দ ডিঙ্গা লইয়া।
গোপন কথা তোমার কাছে যাইযে কহিয়া॥১০৮
ভাল যদি বাস তারে রাত্র নিশাকালে।
পুষ্পবনে কইবা কথা নিশিথে নিরালে॥

এই কথা বলিয়া সলুকা বিদায় হইল।
ভাইটাল বাঁকে গিযা ত্বরা ডিঙ্গায় উঠিল॥১১২

* * * * *

দিন না ফুরায় কন্যার রাত্র নাহি আসে।
অন্ন নাহি রোচে কন্যার নাহি বান্ধে কেশে॥
সাঁইজ[৯৫] গোঞ্জারিল[৯৬] আইলা রজনী।
মন্দিরে শুইয়ে কন্যা ভাবে একাকিনী॥১১৬
ভাবিয়া চিন্তিয়া কন্যা কোন কাম করিল।
মনমত করি কন্যা লোটন[৯৭] বাঁধিল॥
বান্ধিয়া পরিল কন্যা মালতীর মালা।
তাম্বুল খাইয়া কন্যা ঠোট করল লালা॥১২০
ভাইট্যাল নদীতে যেন আইল জোয়ার।
নাগরের মোইতে[৯৮] ও রূপ ধরে চমৎকার॥
সাজিতে পরিতে রাত্রি এক প্রহর যায়।
আর এক প্রহর কাটে কন্যা বিভুলা নিদ্রায়॥১২৪
শেষ রাত্রিতে কন্যা পুষ্পের কানলে[৯৯]
সাধুর লাগিয়া কন্যা চলিল নিরালে॥
ডালে ফুইটা রইছে মল্লিকা মালতী।
ফুইট্যা রইছে গন্ধরাজ টগর যে যূতী॥১২৮
টুনা[১০০] ভইরা তুলে ফুল একেলা বসিয়া।
নিরালে গাথিল মালা যতন করিয়া॥

* * * * *


গাছের পাত। মরমরি[১০১] খইস্যা পড়ে ভূমে।
বসন পাতিয়া কন্যা মজে কাল ঘুমে॥১৩২
দূরেতে দেখিয়া কন্যা কাছ বিলে[১০২] চায়।
ঘুমাইন্যা[১০৩] নাগরে কন্যা ডাকিয়া জাগায়॥
উঠ উঠ সদাগর কত নিদ্রা যাও।
অভাগী ভেলুয়া ডাকে আঁখি মেইল্যা চাও॥১৩৬
পুবে কি পঁসর[১০৪] দিল উঠে ভানুশ্বর[১০৫]
রজনী হইলে সাঙ্গ ঘটিবে বিপদ॥

স্বপনে শুনিয়া ডাক জাগিয়া উঠিল।
নিদ্রার আবেশে আঁখি ঢলিতে লাগিল৷১৪০
আলিঙ্গন করি কন্যায় বসাইয়া কোলে।
কন্যারে সুধায় কথা মিঠা মিঠা বোলে॥
কি করিয়া প্রাণ-প্রেয়সী কি করিবা তুমি ৷
জীবনের মায়া বাস্‌না[১০৬] ছাইড়া দিছি আমি১৪৪
তোমায় যদি নাহি পাই ভরা নদীর জলে।
চৌদ্দ ডিঙ্গা ডুবাইয়া মারিতাম অকালে।
(হায়রে হায়) নিশিত পোহাইল প্রায় কন্যালো আগে বান্ধ হিয়া।
যাইবা যদি প্রাণ প্রেয়সী মাও বাপ ছাড়িয়া॥১৪৬
বেশী কথা বেশী বার্তার লো সময় যে আর নাই।
তোমায় লইয়া চৌদ্দ ডিঙ্গা সায়রে ভাসাই॥

* * * * *

সাক্ষী অইও চান্দ সুরুজরে আর বনের তরুলতা।
মাও বাপে ছাড়লামরে আমি ছাড়্‌লাম পঞ্চ ভ্রাতা॥

১৫২

কাঞ্চন নগর ছাড়লামরে ছাড়্‌লাম সঙ্গী সাই[১০৭]
বন্ধুয়ারে পিরীতে মঞ্জি দেশান্তরে যাই॥
বিদায় দাওরে পউখ পাখালী[১০৮] বনের তরুলতা॥
মায়ের কাছে না কইও মোর কলঙ্কের কথা॥১৫৬
কোথায় ভেলুয়া আইসা মায় সুধায় যদি কারে।
(কইও) প্রাণ ভেলুয়া ডুইব্যা মরছে সাগর নিয়ারে[১০৯]
বাপে ভাইয়ে নাই যে কইলাম কুলে দিলাম কালি।
বন্ধুর লাগিয়া হইলাম আমি উন্মুক্ত পাগলী॥১৬০
কাঞ্চন নগর মাঝে যত বন্ধুজনে।
সবার কাছে মাগি বিদায় নিশীথ গোপনে॥
সই সাঙ্গাতির[১১০] কাছে মাগি যে বিদায়।
সব ছাইড়া যাই আমি প্রাণ যেখানে যায়॥১৬৪

* * * * *

চৌদ্দ ডিঙ্গা বাহি সাধু ভেলুয়ারে লইয়া।
শঙ্খপুর গ্রামের ঘাটে দেখা দিল গিয়া॥
জয়াদি জোকার[১১১] পড়ে শঙ্খপুর গ্রামে।
অর্গিতে[১১২] আসিল মা ঘাট বিদ্যমানে॥১৬৮
খুড়ী জেঠী আসে যত ধান্য দূর্ব্বা লইয়া।
আচম্বিত বার্ত্তা উঠে নগর জুইর‍্যা॥
আচানক[১১৩] কন্যা এক পরমা সুন্দরী।
কোথা হইতে সাধুর বেটা আন্‌ছে চুরি করি॥১৭২

শিরের দিঘল কেশ পায়ে তার পড়ে।
এমত সুন্দর কন্যা নাহি কারো ঘরে॥
এই কথা শুনিয়া তবে মুরাই সদাগর।
পুত্ত্রেরে জিজ্ঞাসে ডাকি জানিতে উত্তর॥১৭৬
বাণিজ্য করিয়া বাপু কি ধন আনিলা।
সঙ্গের সুন্দরী কন্যা কোথায় পাইলা॥
মদন শুনিয়া বাপে দিল পরিচয়।
একে একে কয় কথা যত সমুদয়॥১৮০

শুনিয়া মুরাই সাধু গোসা[১১৪] হইল ভারী।
“বিলম্ব না কর তুমি ছাড় মোর পুরী॥
ঘটক পাঠাইলাম আমি পাইলাম অপমান।
সেই কন্যা কর চুরি বংশের বদ্‌নাম॥১৮৪
পুত্ত্র নাহি চাহি আমি অপুত্ত্রক ভালা।
তোমার জন্মেতে মোর বংশ হইল কালা॥
ছাড়িলাম তোমার আশা মন কইরাছি স্থির।
জহ্লাদে ডাকিয়া আমি কাটাইতাম শির॥১৮৮
যার কন্যা তার কাছে শীঘ্র যাও লইয়া।
শঙ্খপুরে না আর নইলে আইস বাহুরিয়া”[১১৫]

মায় কান্দে বইনে কান্দে পাড়ার নরনারী।
ডিঙ্গায় তুলিয়া লইল ভেলুয়া সুন্দরী॥১৯২
সমুদ্র বাহিয়া সাধু যায় দুঃখ মনে।
রাংচাপুরে দাখিল হইলে আবু রাজার স্থানে॥
বদ্‌নামি ডাকাইত রাজা বংশের কুড়াল।
তার কাছে গেলা সাধু লইয়া মালামাল॥১৯৬

হীরামণ মাণিক দিয়া রাজারে ভুলায়।
বাড়ী বাইন্ধ্যা দিল রাজ়া থাকিতে তথায়॥
ভেলুয়ারে লইয়া সাধু এইখানে রয়।
পরের যতেক কথা কহি সমুদয়॥২০০
দুই খণ্ড শেষ হইল শুন সভাজন।
তিন খণ্ডি বিবরণ শুন দিয়া মন॥২০২

(৬)

রাংচাপুরে আবু রাজা তার গুণ গাই।
ধন দৌলতের সীমা তার নাই॥
দুরন্ত দুইষ্মন্যা[১১৬] রাজা হগলেতে[১১৭] ডরাই।
তার ডরে বাঘে ভইষে[১১৮] এক কুয়ায় জল খায়॥
পঞ্চশত সুন্দর নারী আছে তার ঘরে।
পরের ঘরের সুন্দর নারী তেও[১১৯] চুরি করে।
যেইখানে শুনে আবু রাজা আছে সুন্দর নারী।
চরলোক পাঠাইয়া আনে তারে ধরি॥
লোকের দুষ্‌মণ রাজা দেবতায় না মানে।
ধন দৌলত পরের নারী চুরি কইরা আনে॥
তার স্থানে রইল মদন ভেলুয়ারে লইয়া।
পরেতে হইল কিবা শুন মন দিয়া॥১২

কৌশল্যা নাপতানী ছিল রাংচাপুরে বাড়ী।
একদিন কামাইতে গেল মদন সাধুর পুরী॥
পুরীর মধ্যে দেখে নানা রত্ন অলঙ্কার।
মদন সাধুর বাড়ী খানা অতি চমৎকার॥১৬

তার মধ্যে দেখে সেই নাপিতের নারী।
রত্নের মধ্যে বাড়া রত্ন ভেলুয়া সুন্দরী॥
এমন সুন্দর নারী না দেইখ্যাছে আর।
দেখিতে ভেলুয়ার রূপ চান্দের আকার॥২০
নাপতানী আসিয়া কয় নাপিতের কাছে।
মদন সাধুর ঘরে এক মাণিক আছে॥
সাত রাজার ধন সে কহিতে না পারি।
আচনেক[১২০] রূপ তার ভেলুয়া সুন্দরী॥২৪
কিবা কহিবাম তার রূপের বাখান।
মুখখানি দেখি তার পূর্ণিমার চান্[১২১]
পরথম যৌবনে কন্যা পালঙ্কে নিদ্রা যায়।
মেঘের বরণ কেশ কন্যার পায়েতে লুটায়॥২৮
এমন দীঘল কেশ আর নাহি দেখি।
সোণার বরণ তনু তার তারার বরণ আঁখি॥
আজি যদি যাও তুমি রাজার দরবার।
কহিও তাঁহার কাছে ভেলুয়ার সমাচার॥৩২
এই বার্ত্তা দিলে রাজা সুখী যে হইয়া।
ধন রত্ন দিবে রাজা কাঠায় মাপিয়া॥

নাপিত বলে নাপতানী কহিয়াছ ভাল কথা।
এই কথা মিছা হইলে কাটা যাবে মাথা॥৩৬
কইয়াছ দীঘল কেশ পরমা সুন্দরী।
তির ভুবনে[১২২] নাহি শুনি এমন সুন্দর নারী॥
এক গাছি কেশ যদি তার আনি দেখাও।
রাজার কাছে যাইথাম[১২৩] আমি যদি না ভাড়াও॥৪০

নাপিতানী শুনিয়া কথা অছিলা[১২৪] ধরিয়া।
মদন সাধুর বাড়ী সান্ধাইল[১২৫] গিয়া॥
শুইয়া আছে সুন্দর কন্যা পালঙ্ক উপর।
রতিরে জিনিয়া কন্যা পরম সুন্দর॥88
কাছ মাইলে[১২৬] খাড়াইয়া[১২৭] কুট্‌নী করে কোন কাম।
অগ্রেতে করিল ভেলুয়ার রূপের বাখান॥
শরীরে বুলাইয়া হাত পায়ে নামাইল।
রূপের বাখান তার করিতে লাগিল॥৪৮
তোমার পায়ে নোখ্[১২৮] চন্দ্রের রূপ হারে।
না জানি কি দিয়া বিধি বানাইল তোমারে॥
এমন দীঘল কালা কেশ না দেইখ্যাছি আর।
চান্ মইলান[১২৯] হয় দেইখ্যা তোমার রূপের বাহার॥৫২
সোণার বরণ তনু তোমার তারার বরণ আখি।
এমন সুন্দর রূপ আখিতে না দেখি॥
পঞ্চশত নারী আছে আবু রাজার ঘরে।
তোমার দাসীর যোগ্য নাহি দেখি কারে॥৫৬
যেমন মদন সাধু মদন সমান।
তার ঘরে সমান নারী সমানে সমান॥
গাও টিপে পাও টিপে করে হাহুতাশ।
আবের[১৩০] পাঙ্খা লইয়া করে অঙ্গেতে বাতাস॥৬০

“তুমি যদি হইতে লো কন্যা রাজার পাটরাণী।
সর্ব্বাঙ্গে পরাইয়া দিত হীরা মুক্তা মণি॥
তুমি যদি থাক্‌তে লো কন্যা কোন রাজার ঘরে।
পায়ের গোলাম হইয়া সদা পূজিত তোমারে॥”৬৪

বাতাসে মুন্দিল[১৩১] আঁখি অঙ্গ হইল ভারী[১৩২]
নিদ্রায় ঢলিয়া পড়ে ভেলুয়া সুন্দরী।
হেনকালে নাপ তানি কোন কাম করিল।
হাতে ধান্য লইয়া নারী শিওরে বসিল॥৬৮
লোটন খুলিয়া কন্যার হাতের ধান্য লইয়া।
এক গাছি কেশ শিরের লইল তুলিয়া॥
কার্যসিদ্ধি করিয়া তবে নাপিতের নারী।
অঞ্চলে বান্ধিয়া কেশ চলে নিজের বাড়ী॥
ভেলুয়ার দীঘল কেশ নাপিতে দেখায়।
দেখিয়া নাপিত তবে করে হায় হায়[১৩৩]
ছোট বেলা দেখ্‌ছিলাম স্বপ্ন আজি সাজ হইল[১৩৪]
কোন মুল্লুক হইতে সাধু এমন কন্যারে আনিল॥৭৬

হাতে কেশ লইয়া নাপিত যায় রাজার বাড়ী।
আবার কামাইতে যায় লইয়া নরুণ খুরী[১৩৫]
রাজা বলে নাপিত তুমি আইসাছ আবারে।
এইবারে[১৩৬] কামাইতে খনায়[১৩৭] মানা করে॥৮০

নাপিত বলে কামাইতে খনার মানা নাই।
কুয়ার[১৩৮] দেইখ্যাছি আমি সেই কারণে আই॥

আবু রাজা কয় কিবা দেইখাছ স্বপনে।
নাপিত বলে,আগে যাই মন্দিরে গোপনে॥৮৪
গোপনে মন্দিরে রাজা পরবেশ করিল।
ভেলুয়ার যতেক কথা রাজারে শুনাইল॥
কন্যার দীঘল কেশ রাজার হাতে দিল।
তাহা দেখে আবু রাজা পাগল হইল॥৮৮
নাপিতের সঙ্গে যুক্তি করিয়া গোপনে।
সাধুরে ডাকিয়া আনে আপন ভবনে॥

“শুন শুন মদন সাধু কহি যে তোমারে।
পঞ্চশত সুন্দর নারী আছে আমার ঘরে॥৯২
পঞ্চ শ’ রাণী থাক্‌তে পাটরাণী নাই।
আমার দুষ্কের[১৩৯] কথা তোমারে জানাই॥
সনকাঁইচ[১৪০] বরণ কন্যা যেই দেশে পাও।
ডিঙ্গা বাহিয়া সাধু তথায় শীঘ্র চইল্যা যাও॥৯৬
আমার যে ভিন্নদেশী এক সদাগর।
এমন এক সুন্দর কন্যা দিয়াছে খবর॥
পরখাই[১৪১] করিতে রূপ সেই সদাগরে।
কন্যার দীঘল কেশ দিয়াছে আমারে॥১০০
পরখাইয়ের কেশ লইয়া দেশে দেশে যাও।
কেশের পরমাণ লইয়া কন্যার আমারে জানাও॥
এইমত লম্বা কেশ সনকাঁইচ বরণ তনু।
তাহারে পাইলে আমি করতাম পাটরাণী।১০৪
মনের মত নারী যদি আইন্যা দিতে পার।
সোনাতে বান্ধাইয়া দিবাম তোমার বাড়ীঘর॥

বাইশ পুড়া জমি দিবাম তোমারে লেখিয়া।
সুন্দর নারী দেইখ্যা তোমার করাইবাম বিয়া॥”১০৮
হাতেতে লইয়া কেশ মদন সদাগর।
দুষ্কিত[১৪২] হইয়া ফিরে আপনার ঘর॥১১০

* * * *
* * * *

(৮)

শুন শুন প্রাণ ভেলুয়া কইয়া বুঝাই তরে[১৪৩]
আস্‌মান ভাইঙ্গা পড়ল আমার মাথার উপরে।
আইজ হইতে উজান নদী ভাইটাল বহিল।
চৌদ্দডিঙ্গা আজি হৈতে সায়রে ডুবিল॥
আবেতে[১৪৪] ঘিরিয়া লইল পূর্ণমাসির চান্নি[১৪৫]
সুখের ঘরেতে তোমার লাগিল আগুনি॥
বাপে খেদাইল মোরে তুমি ভেলুয়ার তরে।
তোমারে লইয়া কন্যা ভাসিলাম সায়রে॥
ভাসিতে ভাসিতে আইলাম রাক্ষসের দেশে।
এইখানে মজিলাম আমি আপন কর্ম্মদোষে।
বাপ হৈল কাল তোমার যৌবন হৈল বৈরী।
তোমার লাগ্যা কন্যা আমি হইলাম দেশান্তরী॥১২
সেও মোর আছিল ভাল সুখে কার্য্য নাই।
সেও সুখে বাধিল সাধ বিন্ধাতা গোঁসাই॥
শিরেতে দীঘল কেশ কাটিয়া ফেলাও।
সোণার যৌবনে তোমার কালিয়া[১৪৬] মাখাও॥১৬
দুরন্ত দুষ্‌মন্ রাজা আদেশ করিল।
তোমারে ছাড়িয়া কন্যা বিদেশ যাইতে হইল।

এই কথা শুইন্যা ভেলুয়ার মাথায় পড়ে ঠাডা[১৪৭]
কাঁপিয়া উঠিল বুক লোমে দেয় কাঁডা[১৪৮]২০
পূর্ব্বপর যত কথা ভেলুয়ারে কইয়া।
যুক্তি করে মদন সাধু ভেলুয়ারে লইয়া॥
দিনের মধ্যে মোর ছাড়ন লাগব বাড়ী[১৪৯]
সকল কথা কইয়া যাই ভেলুয়া সুন্দরী॥২৪
তোমায় যদি লইয়া যাই না ছাড়িব মোরে।
তোমার লাগ্যা রাজা আমায় পাঠায় দেশান্তরে!
জানিয়া তোমার কথা কুটুনীর কাছে।
আমারে পাঠায় রাজা যাইতে বিদেশে॥২৮
এক কথা ভেলুয়ারে কইয়া যাই তোরে।
হীরণ সাধু বন্ধুমোর আছে জৈতাশ্বরে॥
ঘাটে আছে পবন ডিঙ্গা মালদহর বৈঠালী।
তাহারে থুইয়া গেলাম রাত্রিকালের পরি।৩২
কালিকা যাইব আমি বইদেশ[১৫০] নগরে।
বিদায় কালে এই কথাটি কইয়া যাই তোমারে॥
শুক লইয়া যাইবাম আমি থাক শারী লইয়া।
বিপদে থাকিও তুমি শ্রীদুর্গা স্মরিয়া॥৩৬
পবন ডিঙ্গা লইয়া যদি পলাইতে পার।
বন্ধুর বাড়ী যাইও তুমি সেই যে জৈতাশ্বর॥
পলাইতে না পার যদি কইয়া যাই আমি।
হীরার বিষ খাইয়া তুমি ত্যজিও পরাণী॥৪০
চৌদ্দডিঙ্গা লইয়া আমি ডুবিলাম সায়রে।
এই মুখ না দেখাইবাম ফিরিয়া নগরে॥

ঊষাকালে যাত্রা করে ভবানী স্মরিয়া।
চলিল মদন সাধু চৌদ্দ ডিঙ্গা বাইয়া॥৪৪
লোক লস্কর লইয়া আবু কোন কাম করে।
সদাগরের বাড়ী যেমন পিপড়ায় ঘিরে॥
অন্দরে ঢুকিয়া রাজা ভেলুয়ারে দেখিল।
দেখিয়া ভেলুয়ার রূপ অচৈতন্য হইল॥৪৮
সেইত দীঘল কেশ সনকাঁইচ বরণ।
সামনে খাড়া সুন্দর কন্যা চন্দ্রের মতন॥
আবু রাজা কয় কন্যা আইস আমার পুরী।
পায়ের গোলাম হইয়া থাকবাম চরণেতে পড়ি॥৫২
পঞ্চশত নারী আছে আমার মন্দিরে।
তোমার পায়ের দাসী করবাম সবারে॥

ভেলুয়া কয় ধর্ম্মের রাজা দোহাই তোমারে।
আমার নালিশ কহি তোমার গোচরে॥৫৬
দুষ্‌মন মদন সাধু সয়তানী করিল।
বাপের ঘর হইতে মোরে হরিয়া আনিল॥
নিশিকালে পুষ্পবনে আমি অভাগিনী।
নিদ্রায় ঢলিয়াছিলাম মুঞি একাকিনী॥৬০
কাল ঘুম কাল হইল ডিঙ্গায় তুলিয়া।
আমারে লইয়া সাধু আইল পলাইয়া॥
বাপ মাও ঘরে আছে আছে পাঞ্চভাই।
সবারে ছাড়িয়া আমি ভাসিয়া বেড়াই॥৬৪
আর না দেখিব আমি মা বাপের মুখ।
পাঞ্চ ভাইয়ের বউ দেইখ্যা না পাইলাম সুখ॥
না জানিয়া লোকে মোরে কইবে কলঙ্কিনী।
হীরার বিষ খাইয়া আমি ত্যজিব পরাণী॥৬৮

কি কর কি কর কন্যা আমার মাথা খাও।
হীরার বিষ খাইয়া কেন জীবন হারাও।

সাত লাখের জমিদারী তোমারে লেইখ্যা দিব।
পায়ের গোলাম হইয়া তোমার চরণে থাকিব॥৭২
কাঠগরা[১৫১] কুইপ্যাছি[১৫২] আমি রক্ষাকালীর বাড়ী।
মদন সাধু আইলে তায় দিবাম নরবলি॥
ঘরে আছে খাট পালঙ্ক তাতে নিদ্রা যাও।
রাজত্বি বদলে দিব যেই সুখ চাও॥৭৬
ধন দিব দৌলত দিব দিবাম হীরামণি।
বিয়া কইর‍্যা সুখে থাকবা হইয়া পাটরাণী॥

“মাও আছে বাপ আছে গর্ভ সোদর ভাই”।
কেমন কইর‍্যা বিয়া করি তারে না জানাই॥৮০
কাঞ্চন নগরে বাপ মাণিক সদাগর।
খবইরা[১৫৩] পাঠাও তথা হইয়া সত্বর॥
বাপ আইব মাও আইব আইব পাঞ্চ ভাই।
পরেতে হইবে বিয়া তোমারে জানাই॥৮৪
এই কয় দিন তুমি না আইস মোর ঘরে।
এই কয়দিন রাজা তুমি থাক্য নিজ পুরে॥
কথা যদি লড়ে চড়ে না পাইবা তুমি।
হীরার বিষ খাইয়া আমি ত্যজিব পরাণী॥”৮৮

খুসী রাজা আবু রাজা কোন কাম করে।
খবইরা পাঠাইয়া দিল কাঞ্চন নগরে॥
সলুকারে লইয়া ভেলুয়া যুক্তি স্থির করে।
কেমন কইর‍্যা যাইবে কন্যা সেই না জৈতাশ্বরে॥৯২
পিঞ্জরের পক্ষী যেমন ঠোঁটে কাটে শলী[১৫৪]
কামড়ে ছিড়িতে চায় পায়ের শিকলী॥

এক দিন দুই দিন তিন দিন গেল।
বাতি ভাসাইতে কন্যা নদীর ঘাটে আইল[১৫৫]৯৬
শারী সলুকারে লইয়া কন্যা পবন ডিঙ্গায় উঠে।
মালদহর বৈঠালী[১৫৬] বৈঠা ধরিল কপটে॥
অন্ধকাইরা রাত্রির নদী সাঁ সাঁ করে পানি।
তার উপরে ভাসে ভাইরে পবন ডিঙ্গা খানি॥১০০
বায়ু হইল খরতর পাল হইল ভারা[১৫৭]
সায়র ডিঙ্গাইয়া নৌকা ছুটে যেন তারা॥
বৈঠালী বাহিল নাও উদ্দিশ না পায়।
তিন দিনের পথ তারা এক আধনে[১৫৮] যায়॥১০৪
পইরা রইল রাংচাপুর আবু রাজার ঘর।
পবন ডিঙ্গা দেখা দিল জৈতার সহর॥১০৬

* * * * *
* * * * *

(৯)

ঘাটেতে লাগাইয়া ডিঙ্গা ভেলুয়া সুন্দরী।
সলুকারে লইয়া যায় হীরণ সাধুর পুরী॥
হীরণ সাধুর কাছে গিয়া পরিচয় দিল।
ভেলুয়ারে দেখিয়া সাধু পাগল হইল॥
ফুল যেমন উইড়্যা আইল ভ্রমর উদ্দিশে।
বেড়ায় খাইল ক্ষেত আপন কর্ম্মদোষে[১৫৯]

যেই ডালে ভর করি ভাঙ্গে সেই ডাল।
রূপ হইল বৈরী কন্যার যৌবন হইল কাল॥

* * * *

* * * *

এক দিন দুই দিন তিন দিন যায়।
জৈতাশ্বরে আছে কন্যা না দেখি উপায়॥
এই দিকে হীরণ সাধু কোন কাম করে।
লোক লস্কর লইয়া সাধু যুক্তি স্থির করে॥১২
ভেলুয়ারে করিব বিয়া যুক্তি করি মনে।
বাপের কাছে কয় কথা অতিক্যা[১৬০] গোপনে॥
পুত্রের রাখিতে মন বাপ ধনঞ্জয়।
বিয়ার দিন ঠিক করে সাধু দেখিয়া সময়॥১৬
এই কথা নাহি জানে ভেলুয়া সুন্দরী।
মদন সাধুর কথা ভাবে দিবা রাইত্র করি[১৬১]

* * * *

হীরণ সাধুর ভগ্নী মেনকা সুন্দরী।
সবার কাছেতে তার পরিচয় করি॥২০
পরমা সুন্দরী কন্যা প্রথমা যৈবন।
ধনঞ্জয়ের ঘরে নাই এর তুল্য ধন॥
আসমানে চাহিলে কন্যা তারা পরে খসি।
দেখিয়া সুন্দর রূপ মৈলান[১৬২] হয় শশী॥২৪
ষোল বছরের কন্যা সতরে দিয়াছে পারা।
আঁখিতে বান্ধিয়া রাখছে পরভাতিয়া[১৬৩] তারা॥

এক দিন মদন সাধু বন্ধুর বাড়ী আইল।
কন্যারে দেখিয়া সাধু হইল পাগল॥২৮

সেই হতে মনে মনে মেনকা সুন্দরী।
নিরালা বসিয়া চিন্তা করে একেশ্বরী॥
দুইজনে মনে প্রাণে মেশামেশি হয়।
দুইজনে মনের কথা নিরালাতে কয়॥৩২
কিছু কিছু বিয়ার কথা উঠে কাণাকাণি।
মেনকার বিয়ার কথা শুনি বা না শুনি॥
এর মধ্যে ভেলুয়া আসি ঘটাইল জঞ্জাল।
না হইল মেনকার বিয়া পড়িল অকাল॥৩৬

* * * *

যেই দিন হইতে কন্যা আইল জৈতাশ্বরে।
মেনকা পাইয়াছে যেমন আপন নাগরে॥
যেখানে পইরাছে মণি আইব তথা নাগ[১৬৪]
মেনকা সুন্দরী পাইব মদনের লাগ॥৪০
দুঃখিনী ভেলুয়া মেনকা বিরহিনী।
দুইজনে শুনে দুইয়ের দুঃখের কাহিনী॥
দুইয়ের মনের কথা দুয়েতে বুঝিল।
দুই জনে মনে প্রাণে এক হয়ে গেল॥৪৪
খাইতে শুইতে কন্যা হইল সহচরী।
ভেলুয়া বিনে নাহি বুঝে মেনকা সুন্দরী॥
এক শয্যার দুই জনে করয়ে শয়ন।
এক ত নদীর ঘাটে করে দুইয়ে ছান॥৪৮
এক থালায় বইয়া[১৬৫] দুইয়ে বাড়া ভাত খায়।
এক অঙ্গ হইল যেমন তারা দুইজনায়॥
গণার দিন[১৬৬] কাছাইল[১৬৭] বিয়ার বাদ্য বাজে।
জৈতাশ্বরের যত লোক নানারঙ্গে সাজে॥৫২

এরে শুইন্যা এক দিন মেনকা সুন্দরী।
ভেলুয়ার কাছেতে আইসা বইসে একেশ্বরী॥
শুন শুন প্রাণ সই কহি যে তোমারে।
তোমার বিয়ার বাদ্য আজি বাজিছে নগরে॥৫৬
দুরন্ত দুষ্‌মণ্ ভাই রূপেতে মজিল।
করিতে তোমারে বিয়া পাগল হইল॥
বুড়াকালে বাপ মোর হইল বাহাত্তরা।
পুত্ত্রের রাখিতে মন অইল জ্ঞান আরা[১৬৮]৬০

আছার খাইয়া পরে কন্যা জমিন উপরে।
বন্ধুর বাড়ী আইলাম শেষে বিপদেতে পরে॥
গাছের ছায়ে আইলাম ছায়া পাইবার আশে।
পত্র ছেইদ্যা[১৬৯] রৌদ্র লাগে আপন কর্ম্মদোষে॥৬৪
ঘরেতে পাতিলাম শয্যা নিদ্রার কারণ।
সেই ঘরে লাগিল আগুণ কপালে লিখন॥[১৭০]
ভেলুয়ারে সান্ত্বনা করে মেনকা সুন্দরী।
আমার কথা শুন সই এক যুক্তি করি॥৬৮
ভাইয়েরে ডাকিয়া কও সকল বিবরণ।
তিন মাসের আশ্রা[১৭১] লও বিয়ার কারণ॥
বিপদ যাইব দূরে কইলাম বিশেষে।
তিন মাসের মধ্যে সাধু ফিইরা যদি আসে॥৭২
রাঙ্গচাপুরে না যাইব সাধু সদাগর।
অবশ্যি আসিবে সাধু এই জৈতার সর॥
তিন মাস মধ্যে সাধু না আইয়ে ফিরিয়া।
দুইজনে ত্যজিব পরাণ জলেতে ডুবিয়া॥৭৬

এই কথা শুইন্যা তবে ভেলুয়া সুন্দরী।
হীরণ সাধুরে ডাইক্যা আনে নিজ পুরী॥

শুন শুন সাধু আরে কহি যে তোমারে।
আমারে করিও বিয়া তিন মাস পরে॥৮০
বাণিজ্যি করিতে সাধু গিয়াছে বিদেশে।
কি জানি পরাণে বাইচ্যা আছে বা না আছে॥
তিন মাস গেলে বিয়া করিব তোমায়।
এই তিন মাস তুমি থাক এই ভায়[১৭২]৮৪
যদ্যপি আমার কথা নাহি রাখ তুমি।
হীরার বিষ খাইয়া আমি ত্যজিব পরাণী।

* * * * *

এই কথা শুনিয়া সাধু লোকজন লইয়া।
সল্লা[১৭৩] করে হীরণ সাধু গোপন করিয়া॥৮৮
বিদেশে যাইবে সাধু বাণিজ্যের কারণ।
যেইখানে গিয়াছে সেই দুষমণ মদন॥
পথেতে হইলে দেখা পরাণে মারিব।
এই যুক্তি স্থির করি বাণিজ্যে যাইব॥৯২
সল্লা করিয়া স্থির হীরণ সদাগর।
ভেলুয়ার নিকটে গেল লইতে বিদায়॥

শুন শুন ভেলুয়ারে কহি যে তোমারে।
বাণিজ্য করিতে যাইবাম বৈদেশ নগরে॥৯৬
যদি সে প্রাণের বন্ধুর পন্থে নাগাল পাই।
সঙ্গে কইরা লইয়া আইবাম তোমাকে জানাই॥
দুই দিন বাকী আছে বাণিজ্যে যাইতে।
আইলাম তোমার কাছে বিদায় লইতে॥১০০

মনে বিষ মুখে মধু এতেক কহিয়া।
ভেলুয়ার নিকট গেল বিদায় মাগিয়া॥

* * * * *

যত সলা করে সাধু নিরালা বসিয়া।
মেনকা সুন্দরী আইল সকল শুনিয়া॥১০৪
সকল গোপন কথা কয় ভেলুয়ার স্থানে।
দুষ্‌মণে করিল ফন্দি বসিয়া গোপনে॥
এই কথা শুনি ভেলুয়া হইল পাগলিনী।
শারীরে শিখায় গান দুষ্কের কাহিনী॥১০৮
আবু রাজার কথা যত সব শিখাইল।
পবন ডিঙ্গা বাইয়া কন্যা জৈতাশ্বরে আইল॥
একে একে শুনায় কন্যা হীরণ সাধুর কথা।
শারীরে কান্দিয়া কয় প্রাণের যত ব্যথা॥১১২
তোমারে মারিতে সাধু বন্ধু তোমার আশে।
পরাণ লইয়া তুমি যাও নিজ দেশে॥
আমি যে বন্দিনী প্রিয়া ঐনা জৈতাশ্বরে।
বনেলা[১৭৪] পঙ্খিনী যেমন পইড়াছে পিঞ্জরে॥১১৬
দুষ্কিণী ভেলুয়ার কথা না ভাবিও আর।
আগুণে পুড়াইয়া তনু করবাম ছারখার॥
গলে দিবাম হীরার কাতি[১৭৫] ডুবিবাম সায়রে।
বাচিলে না আইস বন্ধু এই জৈতাশ্বরে॥১২০
এখানে আসিলে তোমার অবশ্য মরণ।
রূপ হইল বৈরী আমার কাল হৈল যৈবন॥

* * * * *

হীরণ সাধুরে ভেলুয়া ডাকিয়া আনিল।
এই শারী সঙ্গে লইতে মাথার কিরা দিল॥১২৪

এই শারী লইয়া তুমি বিদেশেতে যাও।
এক কথা বলি তোমায় যদি না হারাও॥
যেখানে যেখানে যাইবা বাণিজ্য কারণ
ফরমাইসি আনিবা মোর এক এক রতন॥১২৮
কোন দ্রব্য আনিবা তা সারি দিবে কৈয়া।
কিনিয়া আনিবা তুমি ডিঙ্গা ভরিয়া॥
ভেলুয়ার কথা সাধু শিরেতে বান্ধিল।
শারীরে লইয়া সাধু ডিঙ্গায় উঠিল॥১৩২

ভাইট্যাল পানি বাইয়া সাধু উজান দেশে যায়।
সাত দিনের পথ গিয়া সাধুর নাগাল পায়॥
ছান করে মদন সাধু ডিঙ্গা লাগাইয়া।
হীরণ সাধু গেল তথা শারীরে লইয়া॥১৩৬
দুই বন্ধু কোলাকুলি অনেক দিনের পর।
দুইজনে থাকে সুখে ডিঙ্গার ভিতর॥
বন্ধুরে মারিতে সাধু ভাবিছে উপায়।
এমন সময় শারী গিয়া ঘটাইলা দায়॥১৪০
মদন সাধু কহে বন্ধু নানাদেশে যাও।
কোন দেশেতে যাইয়া এমন শারী পাও॥
চিনিল মদন সাধু দেইখ্যা সেই শারী।
আপন ডিঙ্গায় রাখে অতি যতন করি॥১৪৪

* * * * *

নিশাকালে মদন সাধু শারীরে বুঝায়।
কও কও প্রাণের পঙ্খী কও সমুদায়॥
ভেলুয়া সুন্দরী তোমায় কিবা শিখাইল।
আসিবার কালে কন্যা কিবা না কইয়া দিল॥১৪৮
যে গান গাইল শারী ভেলুয়ার শিখান।
শুনিয়া মদন সাধু আরাইল[১৭৬] গিয়ান[১৭৭]

একে একে গাইয়া শারী আবু রাজার কথা।
পলাইয়া আইল কন্যা জান্যা এ বারতা॥১৫২
পবন ডিঙ্গা বাইয়া কন্যা আইল জিত্বাশ্বরে।
হীরণ সাধু পাগল অইল[১৭৮] দেইখ্যা কন্যারে॥
তোমারে মারিতে সাধু বন্ধু তোমার আশে।
পরাণ লইয়া তুমি যাও নিজ দেশে॥১৫৬
আমি যে বন্দিনী প্রিয়া ঐ না জিত্বাশ্বরে॥
বনেলা পঙ্খিনী যেমন পইরাছি পিঞ্জরে।
দুষ্কিনী ভেলুয়ার কথা না ভাবিও আর।
আগুনে পুড়াইয়া তনু করবাম ছারখার॥১৬০
গলে দিবাম হীরার কাতি ডুবিবাম সাগরে।
বাঁচিলে না আইস বন্ধু এই জৈতাশ্বরে॥
এখানে আসিলে তোমার অবশ্য মরণ।
রূপ হইল বৈরী আমার কাল হইল যৈবন॥১৬৪

ভেলুয়ার কান্দন কথা সাধু যখন শুনিল।
শুনিয়া মদন সাধু কান্দিতে লাগিল॥
দুই প্রহর রাত্রি গেছে আছে এক প্রহর।
নিদ্রা যায় হীরণ সাধু ডিঙ্গার উপর॥১৬৮
নিদ্রা যায় হীরণ সাধু হয়ে হারা দিশ[১৭৯]
বন্ধুরে মারিবে কাইল পানে দিয়া বিষ॥
আক্ষিতে নাহি ঘুম পরাণে বেদন।
দুপরিয়া[১৮০] রাত্রিকালে জাগিল মদন॥১৭২
কাটিল ডিঙ্গার কাছি উড়াইল পাল।
উজান নদীতে ডিঙ্গা যায় ভাটিয়াল॥
এক মাসের পথ সাধু চারি দিনে যায়।
বন্ধুর বাড়ী জৈতাশ্বর আগে দেখা যায়॥১৭৬

ভাইটাল বাকে থুইয়া নৌকা উপরে উঠিল।
বেচুনীয়ার[১৮১] বেশ ধইর‍্যা শারী হাতে নৈল॥
সুধাইতে সুধাইতে গেল হীরণ সাধুর বাড়ী।
কেউনে রাখিবে কিইন্যা মোর এই শারী॥১৮০
আন্দরে খবর গেল লইয়া গেল শারী।
শারী দেইখ্যা চিন্‌ল তবে ভেলুয়া সুন্দরী॥
হস্তের আঙ্গুরী ভেলুয়া বেচনীরে দিয়া।
আপনার শারী নেয় আপনি কিনিয়া॥১৮৪

* * * * *

শুনরে প্রাণের পঙ্খী কইয়া বুঝাই তরে।
কোথ। আছে মদন সাধু কইয়া দে মোরে॥
কত দেশে থুইয়া আইলা কত বা নগরে।
কোথা নি দেইখ্যাছ মোর প্রাণের পিয়ারে॥১৮৮
ভেলুয়ার যতেক কথা শারী যখন শুনিল।
এক গান শারী তখন গাহিতে লাগিল॥

* * * * *

দেইখ্যাছি দেইখ্যাছি সাধু তোমার প্রাণের পিয়া।
তোমার লাইগ্যা ঘুরে সে বেচুনী হইয়া॥১৯২
পাগল হইয়াছে সাধু তোমার কারণে।
দিন যায় উপবাসে নিশি জাগরণে॥
ভাইট্যাল বাকে আছে সাধু চৌদ্দ ডিঙ্গা লইয়া।
সেইখানে কইন্যা তুমি যাও পলাইয়া॥১৯৬

* * * * *

মেনকার গলা ধইর‍্যা ভেলুয়া সুন্দরী।
বিস্তার কান্দিল কন্যা পূর্ব্ব কথা স্মরি॥
বিদায় মাগিল কন্যা মেনকার পাশে।
কান্দিতে কান্দিতে কন্যায় আখি জলে ভাসে॥২০০

রাত্রি নিশাকালে কন্যা শারীরে লইয়া।
ভাইট্যাল বাকেতে কন্যা যায় পলাইয়া॥
জৈতার সহরে আর কেহ নাহি জানে।
মেনকা সুন্দরী কথা জানে মনে মনে॥২০৪

* * * * *

কাটিল ডিঙ্গার কাছি উড়াইল পাল।
উজান নদীতে নৌকা ধরে ভাটিয়াল॥
কতদূর যাইয়া নৌকা ধরিল উজান।
মদন পাইল যেমন পূন্নমাসির চান॥২০৮
আলিঙ্গন কইর‍্যা সাধু ভেলুয়ারে ধরে।
দুইজনে চক্ষের জলে দেখিতে না পারে॥
দুইজনে হইল পুন মধুর মিলন।
কি জানি ঘটায় দৈবে পুন বিড়ম্বন॥২১২
দিন গেল নিশি গেল পুন দিবা আইল।
সম্মুখে কাউচার বাক দেখাইয়ে দিল॥

কোথা হইতে আসে কেবা উড়াইয়া নিশান।
ডিঙ্গা দেখি মদন সাধুর উড়িল পরাণ॥২১৬
এই ডিঙ্গায় বাহি আসি মাণিক সদাগর।
সঙ্গেতে লইয়া ভেলুয়ার পঞ্চ সহোদর॥
ডিঙ্গা দেখি মদন সাধু চিনিতে পারিল।
বাক ফিরাইয়া নৌকা ভাইট্যাল ধরিল॥২২০

কতদূর যায় সাধু ডিঙ্গা ফিরাইয়া।
সামনে দেখিল সাধু নজর করিয়া॥
নিশান দেখিয়া সাধুর উড়িল পরাণ।
আসিতেছে আবু রাজা পাইয়া সন্ধান॥২২৪
হেও[১৮২] বাক ফিরাইয়া অন্য বাকে যায়।
নৈক্ষত্র ছুটিল দেখা যায় বা না যায়॥

কতদূর যাইয়া সাধু নজর কইর‍্যা চায়।
হেও বাকে সাধুর ডিঙ্গা আইসে দেখা যায়॥২২৮
লোকজন সঙ্গে আর মেনকা সুন্দরী।
আসে সাধু ধনঞ্জয় চৌদ্দ ডিঙ্গা ভরি॥

সেও বাক ফিরাইয়া ত্বরিতে গমন।
চৌগঙ্গার বাকে সাধু দিলা দরশন॥২৩২
তিন বাকে ফিইরা সাধু আরেক বাকে যায়।
কতদূর যাইয়া সাধু দেখিবারে পায়।
পাল নিশান দেখি চিনিল মদন॥
আইসাছে হীরণ সাধু ত্বরিত গমন॥২৩৬
ডিঙ্গা ফিরাইয়া সাধু চৌগঙ্গায় পড়ে।
চাইর বাক দিয়া ডিঙ্গা ঘিরিল সাধুরে॥

উপায় না দেখি সাধু ভাবে মনে মন।
দৈবেতে ঘটাইল দুঃখ অবশ্য মরণ॥২৪০
আওলাইয়া মাথার কেশ পাগলিনী প্রায়।
পরথম যৈবন কন্যা সায়রে ভাসায়[১৮৩]
মেঘের বরণ কেশ জলেতে ডুবিল।
তা দেখি মেনকা জলে ঝাপাইয়া পড়িল॥২৪৪
ধরিল ভেলুয়ার কেশ মেনকা সুন্দরী।
দুইজনেতে সায়র জলে করে গড়াগড়ি॥

লম্ফ দিয়া মদন সাধু পড়িলেক জলে।
কি করিল প্রাণ ভেলুয়া এমন সময় কালে॥
আকাশ ছাইল কাল মেঘে পাতাল ছাইল জলে।
তুফানে ছিড়িল পাল সায়র উথলে॥২৪৪
বৈঠালি পড়িল জলে না দেইখ্যা উপায়।
লোকজন সহ ডিঙ্গা ডুবে দরিয়ায়॥

চাইর দিকে চাইর ডিঙ্গা সব তল হইল।
চৌগঙ্গার মাঝে সবে ভাসিতে লাগিল॥২৫২
কেবা কারে ধরে আর কেবা কারে তোলে।
সায়রে ভাসিয়া সবে হরি হরি বলে॥
কোথায় গেল মদন সাধু কোথায় আবু রাজা।
ধর্ম্মে[১৮৪] দিল হীরণ সাধুর মনের মত সাজা॥২৫৬
তুফানে ডুবিল ডিঙ্গা সায়রেতে পড়ি।
কোন দেশে ভাসাইয়া নিল (হায়রে) প্রাণের ভেলুয়া সুন্দরী॥২৫৮


(১০)

নাও বাইয়া যায় ধার্ম্মিক সাধু উজান পানি দিয়া।
চারিখণ্ডে ভেলুয়ার কথা শুন মন দিয়া॥
আচানকা সাউধের ডিঙ্গা নানা রত্নে ভরা।
সোনার নায়ে আবের নিশান আশমানে দেয় উড়া[১৮৫]
সেও ত ডিঙ্গা বাইয়া সাধু যায় উজান বাঁকে।
সামনে ছিল বালুর চর তাতে ডিঙ্গা ঠেকে॥
দাড়ি মাঝি অয়রাণ[১৮৬] হইল নামাইয়া পাল।
চড়ায় ঠেকিয়া সাধু মাথায় কুরাল[১৮৭]
এক দিন দুই দিন তিন দিন যায়।
চড়ায় ঠেকিয়া সাধু না দেখে উপায়॥

হেন কালেতে হৈল কিবা শুন দিয়া মন।
ডিঙ্গা ছাইরা চরে উঠে মাঝিমাল্লাগণ॥১২
কত দূরে যাইয়া দেখে চরের উপরে।
চান্দ সুরুজ খইস্যা যেন পরছে বালুর চরে॥
বালুর চরেতে পইর‍্যা যুগলা[১৮৮] রমণী।
দেখাতে পরাণ তার জানি বা না জানি[১৮৯]১৬
আছে বা না আছে পরাণ মরার মতন।
কোন জনে হারাইয়া গেছে গাইষ্টের[১৯০] রতন॥
স্বপন দেইখাছে সাধু কাইল নিশাকালে।
আইজ বুঝি সেই কথা ফলিল কপালে॥২০
দাড়ী মাঝি আইসা কয় শুন সওদাগর।
“চন্দ্র সূর্য্য পইরা রইছে চরের উপর॥”

এই কথা শুনিয়া সাধু কোন কাম করে।
ঝট্‌তি চলিয়া গেল সেই বালুর চড়ে॥২৪
আস্‌মান্ হইতে চান্ সুরুজ্ পইরাছে খসিয়া।
ডিঙ্গায় তুইল্যা লৈল সাধু যতন করিয়া॥
উত্তম বসন দিল রত্ন অলঙ্কার।
আহার করিতে দিল দৈব্য[১৯১] চমৎকার॥২৮
উজান পানি বাইয়া সাধু যায় নিজ দেশে।
তার পর হৈল কিবা শুন সবিশেষে॥

ঘাটে লাগাইল ডিঙ্গা ধার্মিক সদাগর।
জয়াদি জোক্কার পড়ে পুরীর ভিতর॥৩২

ধান্যদূর্ব্বা লইয়া হাতে যত পুরনারী।
অর্ঘিয়া লইতে আসে সাধুর ডিঙ্গা তরী॥
পুষ্প চন্দন দিয়া গলের[১৯২] উপর।
পদ্মা নাম স্মরি সবে নোয়াইল শির॥৩৬
ভারে ভারে তুলে যত রত্নাদি কাঞ্চন।
একে একে তুইল্যা লয় ডিঙ্গার যত ধন॥
আচানকা দুই কন্যা সাধুর নৌকায়
দেখিয়া রাজ্যের লোক করে হায় হায়॥৪০
এমন না দেখি আর এমন না শুনি।
কোথায় পাইল সাধু এমন যুগল কামিনী॥
ঘরণী সুধায় “সাধু কোন দেশে বা গেলা।
কোন বা সোণার পুরী হইতে এধন আনিলা॥৪৪
নাই পুত্ত্রু নাই কন্যা আন্ধার আমার পুরী।
বিধাতা কইরাছে দান কপাল গেছে ফিরি॥”

যুগল ঘৃতের বাতি জ্বালাইয়া মন্দিরে।
দুইয় কন্যা পালে নারী আপন মনে করে॥৪৮
সাউদের[১৯৩] পুরীতে যত রত্ন অলঙ্কার।
হীরা মতি আর যত বাজু বন্ধ তার॥
সব দিয়া সাজাইল যুগলা কামিনী।
আশ্বিন মাসেতে যেন পূজে দূর্গারাণী॥৫২

এন[১৯৪] কালেতে একদিন জিজ্ঞাসে কন্যারে।
“তোমরা যে আছ গো মাও আমার মন্দিরে॥
কোন দেশে বাড়ী তোমার কোন দেশেতে ঘর।
দয়া কইরা কও মাগো প্রশ্নের উত্তর॥৫৬

নানা দেশে যাই আমি বাণিজ্যের কারণ।
তোমাদের মা বাপ দেখিতে কেমন॥
দারুণ কঠিন স্বামী এমত করিল।
মধ্য নদীর চড়ায় আইন্যা নির্ব্বাস যে দিল॥”৬০

এই কথা শুইন্যা তবে যুগলা কামিনী।
দুইজনে কান্দাকুটী চোক্ষে বহে পানি॥
একে একে কয় ভেলুয়া সকল বারতা।
বাপ মার নাম কয় যত ইতিকথা॥৬৪
সেমতে হইল সাধুর সঙ্গেতে মিলন।
মা ও বাপ ছাইরা কন্যা করে পলায়ন॥
শ্বশুরে না দিল স্থান কলঙ্কী জানিয়া।
নানা দেশে ঘুরে সাধু আমারে লইয়া॥৬৮
তার পরে কহে কন্যা আবু রাজার কথা।
এইখানে থাইক্যা কন্যা সানে ভাঙ্গে মাথা[১৯৫]
যেইমতে দুষ্‌মণ রাজা পাষণ্ডী হইল।
ছল কইরা সাধুরে যে বাণিজ্যে পাঠাইল॥৭২
পবন ডিঙ্গায় বহিয়া কন্যায় যায় জৈতাশ্বরে।
একে একে সকল কথা কৈল সওদাগরে॥
এক নদীর চাইর শাখা চউগঙ্গার জলে।
যেইমতে ডুবিল কন্যা দুফর[১৯৬] বেলা কালে॥৭৬
এই কথা শুইন্যা সাধু কান্দিতে লাগিল।
সাধুর কান্দন দেখি সকলে কান্দিল॥

* * * * *

ঘরণীর সঙ্গে সাধু সল্লা যে করিয়া।
যুগলা কামিনী লইল ডিঙ্গায় যে করিয়া॥৮০

কাঞ্চন নগরে যাইব ভেলুয়ারে লইয়া।
রত্ন ধন লয় সাধু ডিঙ্গায় করিয়া॥
তথা হইতে যাইব সাধু সেই জৈতাশ্বরে।
ধনঞ্জয়সাধু যথা বসবাস করে॥৮৪
নিজ নিজ কন্যায় সাধু যারে তারে দিয়া।
বাণিজ্য করিবে সাধু বৈদেশ ঘুরিয়া॥
এক মাস দুই মাস তিন মাস যায়।
ফিরিয়া যাইবে সাউ বাণিজ্যের দায়[১৯৭]
শুভদিনে শুভক্ষণে জয় পদ্মা স্মরি।
পাল উঠাইল সাধু যত ডিঙ্গা তরী॥ ৯০
এইরূপে যায় সাধু কাঞ্চন নগরে।
আবু রাজার কথা তবে শুন অতরপরে[১৯৮]॥৯২

* * * * *

(১১)

দুরন্ত দুষ্‌মণ রাজা মরিয়া না মরে।
পরাণে বাঁচিয়া সে যে গেল নিজ ঘরে॥
পাত্র মিত্র লইয়া রাজা যুক্তি স্থির করে।
প্রহরী রাখিল রাজা ঘাটের উপরে॥
যত সাধু ডিঙ্গা বহিয়া নদী দিয়া যায়।
আবু রাজার ডরে তারা পলাইয়া যায়॥
লাগাল পাইলে ডিঙ্গা দুরন্ত দুষ্‌মণ।
ডিঙ্গা হইতে কাইর‍্যা[১৯৯] লয় যত রত্ন ধন॥

সেই ঘাট দিয়া যায় ধার্ম্মিক সদাগর।
সন্ধানী[২০০] নাগাল পাইল নদীর উপর॥
সন্ধানী ডাকিয়া কয় “শুন সদাগর।
রাজার হুকুমে তরী ভিড়াও সত্বর॥১২
হুকুম না মান যদি আপনার বলে।
চৌদ্দ ডিঙ্গা সহ তোমায় ডুবাইব জলে॥”

এই কথা শুনিয়া সাধু কোন কাম করে।
ঘাটে লাগাইল ডিঙ্গা বাঁচিবার তরে॥১৬
যতেক প্রহরী ছিল ডিঙ্গায় উঠিয়া।
রত্ন ধন ছিল যত লইল লুটিয়া॥

এর মধ্যে দেখে সবে ডিঙ্গার ভিতর।
চান্দ সুরুজ ভরিয়াছে[২০১] সাধু সদাগর॥২০
তাড়াতাড়ি গিয়া তবে যত লোক জনে।
রাজারে খবর দিল আনন্দিত মনে॥

এই কথা শুইন্যা রাজা পাত্রমিত্র লইয়া।
ঘাটেতে আসিল রাজা ঝট্‌তি[২০২] হইয়া॥২৪
আইয়া[২০৩] দেখে জলঘাটে ভেলুয়া সুন্দরী।
দেখিয়া সে আবু রাজা কহে দড়বড়ি[২০৪]
“এতদিনে বিধি মোরে সদয় হইল।
দানের সহিত আসি দক্ষিণা মিলিল॥২৮
এক নারীর লাইগ্যা আমি পাগল হইয়া ফিরি।
ভাগ্যে মিলাইল বিধি দুই সুন্দর নারী॥
দুই দিকে দুই নারী পালঙ্কে লইয়া।
ঘুমাইব নিশা কালে আনন্দিত হইয়া॥৩২
মেঘের বরণ কেশ কন্যার তারার বরণ আখি।
ছয়মাস হইল আমি স্বপন যে দেখি।
রাজ্যধন মোর কাছে বিষের লাড়ু ছিল।
এত দিনে ভাগ্যে বিধি নিধি মিলাইল॥”৩৬

বলেতে ধরিয়া রাজা দুই সুন্দর নারী।
রাংচাপুরে লইয়া গেল আপনার পুরী॥
সাধুর যতেক ধন ভারেতে লইয়া।
রাজার হুকুমে নিল পুরীতে তুলিয়া॥৪০
চৌদ্দ ডিঙ্গা সাধুর ঘাটেতে বান্ধিয়া।
ভাঙ্গা ফাটা[২০৫] ডিঙ্গায় দিল সাধুরে তুলিয়া।
পরের লাগিয়া সাধু কপালের ফেরে।
স্রোতের সেওলা হইয়া ভাসিল সায়রে॥৪৪
এইখানে আবু রাজার কথা খানি থুইয়া।
মদন সাধুর কথা সবে শুন মন দিয়া॥৪৬

* * * * *

(১২)

মালদর বৈঠালী ছিল মদন সাধুর নায়।
পরাণের আশা ছাইরা সাধুরে বাঁচায়।
পবন ডিঙ্গা কইরা সাধু সলুকারে লইয়া।
দেশে দেশে ঘুরে সাধু ভেলুয়ার লাগিয়া॥
সঙ্গে আছে শুক শারী মালদর বৈঠালী।
নানা দেশে যায় সাধু হইয়। আকুলী॥

একদিন নদীর ঘাটে দেখিল চাহিয়া।
ভাঙ্গা ডিঙ্গায় ধার্ম্মিক সাধু আসে যে চলিয়া॥
বাতা বাইয়া পানি উঠে ডুবে ডিঙ্গা খানি।
মদন সাধু উঠ্যা বোলে “এ কার তরণী”

কাছেতে ভিরাইয়া ডিঙ্গা সাধুরে সম্ভাষে।
এই যে ধার্ম্মিক সাধু বসে কোন দেশে॥১২
মাঝি মাল্লা কিছু কিছু পরিচয় দিল।
এন কালেতে ধার্ম্মিক সাধু বাইরে আসিল॥
পবন ডিঙ্গায় উঠে সাধু লোকজন লইয়া।
বাকে পইরা ভাঙ্গা ডিঙ্গা গেল তল হইয়া॥১৬

পবন ডিঙ্গায় উঠ্যা সাধু কহে পরিচয়।
একে একে কহে সাধু যত কথা সমুদয়।
কি মতে চড়ায় পাইল যুগলা কামিনী।
কোথায় ডুবিয়াছিল সাধুর তরণী॥২০
মেঘের বরণ চুল কন্যার তারার বরণ আখি।
সকল কহিল সাধু পবন ডিঙ্গায় থাকি।
শুনিয়া আনচৌক[২০৬] মদন সদাগর।
ধার্ম্মিক সাধুরে তবে কহিল উত্তর॥২৪

“কোথায় পাইলে কন্যা তুমি কোথায় গেলে লইয়া।
এই ভাবেতে আইস কেন ভাঙ্গা ডিঙ্গা বাইয়া॥
অনুমানে বুঝি বিধি নিদারুণ হইল।
সায়র নিয়রে তারা ডুইব্যা কিসে মইল॥”২৮

“নয়রে নয়রে সাধু না ডুইবাছে তরী।
দেশে লইয়া গেলাম আমি যুগলা সুন্দরী॥
ছয়মাস পালিলাম কন্যার মতন।
দৈবেতে ঘটাইল শেষে এই বিরম্বন॥৩২
ভালা কর্ত্তে মন্দ হৈল বিধির নির্ব্বন্ধে।
ধর্ম্মপথে যাইতে শেষে পড়িলাম ফান্দে॥
একদিন দুইজনে পরিচয় কৈল।
বাপের বাড়ী যাইতে দুইয়ে কান্দিতে লাগিল॥৩৬
চৌদ্দ ডিঙ্গা সাজাইয়া লইয়া দুই নারী।
আগেতে চলিয়া যাই কাঞ্চন নগরী॥
পথেতে আছিল সেই দুষ্‌মনিয়া বাঘ।
রাংচাপুরের ঘাটে রাজা মোরে পাইল লাগ॥৪০
ধন রত্ন কাইরা নিল সঙ্গের দুই কন্যায়।
আসমান ভাঙ্গিয়া পড়ে আমার মাথায়॥
চৌদ্দ ডিঙ্গার যত ধন সব লইয়া কাড়ি।
রাক্ষসার পুরে বন্দী আছে দুই নারী॥”৪৪

* * * * *

পবন ডিঙ্গা বাইয়া তবে মদন সদাগর।
ধার্ম্মিক সাধুর দেশে গেল অতঃপর॥
আপনার ঘরে তবে সাধুরে রাখিয়া।
রাংচাপুরে যায় সাধু সলুকারে লইয়া॥৪৮
ভাইট্যাল বাকেতে সাধু ডিঙ্গা যে বান্ধিয়া।
যুক্তি করে সওদাগর সলুকারে লইয়া॥

ডুমুনীর বেশ ধরি সলুকা সুন্দরী।
খারি বিউনী[২০৭] লইয়া যায় আবু রাজার পুরী॥৫২
উবু[২০৮] কইরা বান্দে চুল পিঙ্গলা বরণ।
কাকালে বান্ধিল ধাই[২০৯] আপন বসন॥
এক দুই তিন করি মহল্লা পার হয়।
অন্দরে ঢুকিয়া দিল নিজ পরিচয়॥৫৬

“শঙ্কর আমার ডোম আমি তার নারী।
খারী বিউনী বিকাইয়া দেশে দেশে ফিরি॥”
এইকথা শুইন্যা যত রাজার রাজরাণী।
কেহ খারি কিইন্যা লয় কেহ বা বিউনী॥৬০

সব শেষে ডুমুনী কোন কাম করে।
শেষ বিকাইতে[২১০] গেল ভেলুয়ার মন্দিরে॥
দেখে ভেলুয়া বসিয়াছে মেনকারে লইয়া।
চক্ষের জলেতে গেছে বসন ভিজিয়া॥৬৪
কেবল মেনকা ছাড়া রাক্ষসার পুরে।
এমন সুহৃদ নাই জিজ্ঞাসা যে করে।
মেনকা কান্দিলে ভেলুয়া মোছায় দুনয়ন।
ভেলুয়া কন্দিলে কন্যা করয়ে সান্ত্বন॥৬৮
এইরূপে দুইজনে করে কান্দা কান্দি।
রাবণ রাক্ষসের ধরে সীতা যেন বন্দী॥

সলুকারে দেইখ্যা ভেলুয়ার পরাণ আসিল।
প্রভুর সংবাদ কন্যা পরথমে চাহিল॥৭২

এরে দেইখ্যা মেনকা যে মুখে হাত দিয়া।
মানা করে ভেলুয়ারে যে গোপন করিয়া॥
মেনকা কয় ডুমুনীলো তুই কোন ডোমের নারী।
কোন দেশ হইতে আইলে কোন দেশে বা বাড়ী॥৭৬
এইকথা শুনিয়া সলুকা মুচকি হাসিল।
বড়গলা কইর‍্যা[২১১] কন্যা পরিচয় দিল॥
“শঙ্কর ডোমের নারী উজান দেশে বাড়ী।
খারি বিকাইতে আমি আইলাম তোমার পুরী॥৮০
এক গাছি খারি মোর সাত রাজার ধন।
কিনিলে কিনিয়া লও না সহে বিলম্বন॥”

খুলিয়া কণ্ঠের হার মেনকা যে দিল।
এই মূল্যে খারি বিউনী কিনিয়া লইল।৮৪
ফরমাইস করিল কন্যা বিউনী দুইখানি।
আর দিন লইয়া আসে ডোমের ঘরণী॥
বাটার পান খাইয়া ডুমনী বিদায় হইল।
বিউনীর সহিত পত্র মেনকারে দিল॥৮৮
পত্র পড়ে মেনকা যে গোপন করিয়া।
কি লেখা লিখ্‌ছে সাধু পত্রেতে ভরিয়া॥

“নগরেতে আছি আমি সলুকারে লইয়া।
এক কথা কহি কন্যা শুন মন দিয়া॥৯২
কিরূপে উদ্ধার পাইবা রাক্ষসার ঘরে।
ভাবিয়া উত্তর দিও সলুকার করে॥”৯৪

* * * * *

(১৩)

এক দিনের কথা তবে শুন মন দিয়া।
মেনকা কহিল কথা ভেলুয়ারে আসিয়া॥
এক কথা শুন সই কহি যে তোমারে।
পর্‌তিজ্ঞা করহ তুমি আমার গোচরে॥
যে জনে করিব বিয়া আমি আপনা ভুলিয়া।
সেই ত পুরুষে কন্যা তুমি করবা বিয়া॥
এই পরতিজ্ঞা যদি কর আমার কাছে।
খণ্ডাইব তোমার দুঃখ উদ্ধার কইরা পাছে॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া কন্য। পরতিজ্ঞা করিল।
শুনিয়া মেনকা তবে কহিতে লাগিল॥

“আমি যে করেছি পণ গো মনেতে ভাবিয়া।
এই আবু রাজারে আমি করবাম বিয়া॥১২
সুন্দর সুরুপা রাজা ধনে মানে বড়।
এমন পুরুষ নাই সংসার ভিতর॥
ধন দৌলত রাজার সীমা সংখ্যা নাই।
রাজ্যের ভিতরে পড়ে রাজার দোহাই॥১৬
হীরা মতি পইরা হইবাম রাজরাণী।
তোমারে করিব কন্যা পিয়ার সঙ্গিনী॥”

এই কথা শুইন্যা ভেলুয়া কান্দিতে লাগিল।
কুলটা অসতী বলিয়া কত গালি দিল॥২০
তুমি যদি বাস ভাল তুমি কর বিয়া।
পরাণ ত্যজিব আমি জলেতে ডুবিয়া॥

ঘরেতে হীরার কাতি তাই দিবাম গলে।
আর না দেখাইবাম মুখ নটুয়া মহলে[২১২]॥”২৪

এতেক বলিয়া কন্যা কান্দিয়া আকুলা।
দুই চক্ষে বহে ধারা বসনে মুছিলা॥
মেনকা কহিছে “সই মোর কথা ধর।
কিরূপে উদ্ধার পাবে বিপদে সায়র॥২৮
স্বীকার কর কন্যা তুমি আমার কথা রাখ।
দুষ্‌মণ রাজারে তুমি ভাল চক্ষে দেখ॥
বিবাহ করিবা বলি দেও ত সকতি[২১৩]
তোমারে বরিব[২১৪] রাজা তুমি পরাণ-পতি॥”

আইল আইল আবু রাজা রাত্র নিশাকালে।
দুষমণ আসিয়া তবে ভেলুয়ারে বলে॥৩৪
“হারানিধি পাইয়াছি বিধি মিলাইল।
আমার কথা শুইন্যা কন্যা পরাণ কর মিল॥
গণকে দেখাইয়া আমি দিন করেছি স্থির।
এর মধ্যে বিয়া কইরা হইবাম সুস্থির॥৩৮
আইজ কাইল কইর‍্যা কন্যা না ভাঁড়াইও আর।
তোমার লাইগ্যা করাইয়াছি গজমতি হার॥
তোমারে লইয়া কন্যা জলটুঙ্গি[২১৫] ঘরে।
রাত্রনিশা কাটাইবাম বুকের উপরে॥৪২
কালা দীঘল কেশ তোমার রূপার বরণ আখি।
পাগল হইয়াছি কন্যা তোমার যৈবন দেখি॥

ছয়শত রাণী আছে পুরীর ভিতরে।
তারা সবে দাসী হইয়া সেবিবে তোমারে”॥৪৬

* * * * *

“বিয়া যে করিব তোমায় আছে এক কথা।
ব্রত ভাঙ্গি আমারে না দিও মনোব্যথা॥
আমার ব্রতের কথা মেনকা সই জানে।
তাহারে জিজ্ঞাসা কর আছে এই খানে”॥৫০

* * * * *

মেনকা

“আমার সইয়ের কথা বলিব তোমায়।
কি কি দ্রব্য লাগিবে এ সখীর পূজায়॥
পূর্ব্বাপর পদ্যি[২১৬] আছে কহি যে তোমারে।
শুক শারীর বিয়া দিবা বিয়ার বাসরে॥৫৪
সদাগরের কন্যা মোরা সায়রেতে ঘর।
সায়রের জলেতে গিয়া মিলিবে কন্যা বর।
যত যত বিয়া হয় বণিক বংশেতে।
ডিঙ্গা করিয়া তারা যায় সায়রেতে॥৫৮
সেইখানে হইবে বিয়া সঙ্গেতে তোমার।
সেইখানে পরিবা রাজা তুমি পুষ্পহার॥”
শুভদিন শুভক্ষণ ঠিক যে করিয়া।
এইরূপে আবু রাজা গেল যে চলিয়া॥৬২

* * * * *

“শুন শুন সলুকা লো কহি যে তোমারে।
কাইল আইল আবু রাজা রাত্র নিশাকালে॥

দুষ্‌মণের সঙ্গে বিয়া হইয়াছে স্থির।
সিন্নি মানিয়াছি আমি থাকবেন পীর॥৬৬
দাণ্ডারা[২১৭] পড়িবে কাইল সহরে বাজারে।
শুক শারীর বিয়া হবে কহি যে তোমারে॥
কিনিতে রাজার পাইক যাবে শুকশারী।
প্রভুরে কহিও তোমার এই ছল করি॥৭০
শুক শারীর মূল্য চাইবে এক সাউদের[২১৮] ধন।
চৌদ্দ ডিঙ্গা চাই আরও রত্নাদি কাঞ্চন॥
দুষ্‌মণ কিনিয়া লবে করিবারে বিয়া।
শুক শারী কিন্যা লবে ডিঙ্গাধন দিয়া॥৭৪
চৌদ্দ ডিঙ্গা ধন লইয়া ভাসিব সাগরে।
এইখান হইতে আগে যাইবা ধার্ম্মিক সাধুর পুরে॥
ধনরত্ন দিবা তারে চৌদ্দ ডিঙ্গা ধন।
অভাগীর লাগিয়া হইল তার বিড়ম্বন॥৭৮

“তার পর চলিয়া যাইবা কাঞ্চন নগরে।
ভাটিয়াল বাকের ডিঙ্গা মধ্যে রাখিয়া প্রভুরে॥
তুমি গিয়া কহিও বার্ত্তা সাধু সদাগরে।
তোমার যে কন্যা সাধু ভেলুয়া সুন্দরী॥
ক্ষীরনদীর সাগর জলে ভাসে একেশ্বরী॥৮৩
মাও নাই বাপ নাই ভাসিয়া বেড়ায়।
কান্দিয়া কহিলা মোরে আসিবার দায়॥

“সেইখানেতে চইল্যা যাইবা সেই না শঙ্খপুরে।
তোমার প্রভু সদাগর যথায় বসত করে॥৮৭
কইও কইও তারে তুমি কইও সকল কথা!
প্রভুর লাইগ্যা মাও বাপের মনে আছে ব্যথা॥

তোমার পুত্ত্র ভাইস্যা বেড়ায় ক্ষীর নদীর সাগরে।
লোকজন লইয়া তুমি উদ্ধার কর তারে॥৯১
পাল নাই ভাঙ্গা ডিঙ্গা না জানি বা কবে।
বাও বাতাসে ভাঙ্গিয়া ডিঙ্গা সাগরেতে ডুবে॥
এক পুত্র বিনে তোমার পুরী অন্ধকার।
রাণী হারাইয়াছে এই মাণিকের হার॥৯৫
কান্দিতে কান্দিতে চক্ষে মাকরসা ঝুরে[২১৯]
এই দিন না গেলে পুত্ত্র ডুবিবে সাগরে॥

“তার পর যাইও যত ইষ্ট বন্ধুর বাড়ী।
সবারে আইস গিয়া নিমন্ত্রণ করি॥৯৯
মদন সাধুর বিয়া হবে ভেলুয়ার সনে।
নিমন্ত্রণ কইরা যাই যত সাধু জনে॥

সকল দেশে যাইও নাই সে যাইও জৈতাশ্বর।
আমার ভাইয়ে জানতে পাইলে পড়িয়া যাবে ফেরে॥১০৩
সায়রে ডুবিল তাই আছে কি না আছে।
তবে ত অইব দেখা বাঁচি যদি পাছে॥”
এই কথা শুইন্যা তবে সলুকা সুন্দরী।
প্রভুর কাছে কহে কথা সকল বিস্তারি॥১০৭

* * * *

(১৩)

শুভদিন শুভক্ষণ যখন আইল।
পাত্র মিত্র লইয়া রাজা যাত্রা যে করিল॥
চৌদ্দ ডিঙ্গা লয় রাজা সঙ্গেতে করিয়া।
লোক জন লইল রাজা ঢুলি বাজুনিয়া॥

সিলৈ হাউই আর পানাস পপ্পন।[২২০]
চড়কি বাজি সাথে আর সৈন্যধুম॥
বাজি বারুদ লইল নৌকা যে ভরিয়া।
ডঙ্কা দামামা বাজে সঙ্গেতে বসিয়া॥
ঘন ঘন লোকজনে জয়ধ্বনি করে।
বিয়া করতে যায় রাজা ক্ষীর নদীর সাগরে॥

অমঙ্গল দেইখ্যা রাজা ডিঙ্গায় উঠিল।
যাত্রাকালে কাণা মাছি চক্ষেতে বসিল॥১২
জোরে জোরে হাঁচি পড়ে না ফুটে জোকার।[২২১]
জয়ধ্বনি দিতে লোকে করে হাহাকার॥
শকুনি উড়িয়া বসে মাস্তুল উপরে।
উখেরা[২২২] বাতাসে রাজার ডিঙ্গায় কাছি ছিড়ে॥১৬
ঘাটের মাঝে এক ডিঙ্গা উভে হইল তল।
যতেক মঙ্গল দ্রব্য গেল রসাতল॥
রাণীরা বোঝায় রাজা প্রবোধ না মানে।
পাত্র মিত্র লইয়া রাজা যায় নিজ মনে॥২০

এক ডিঙ্গায় উঠে রাজা পাত্র মিত্র লইয়া।
অন্য ডিঙ্গায় উঠে ভেলুয়া মেনকারে লইয়া॥
নাপিত নাপিতানী লইল বিয়ার পুরোহিত।
যাত্রাকালে অমঙ্গল হিতে বিপরীত॥২৪

এই দিকে মদন সাধু কোন কাম করে।
চৌদ্দ ডিঙ্গা লইয়া গেল ধার্ম্মিক সাধুর পুরে॥

চৌদ্দ ডিঙ্গা ধন দিয়া পরণাম করিল।
সাধুর যতেক ধন সাধুরে বুঝাইল॥২৮
এইখানে দিল আগে বিয়ার নিমন্ত্রণ।
তার পরে চলে সাধু ত্বরিত গমন॥
তথা হইতে যায় সাধু কাঞ্চন নগরে।
আপনি গোমনে[২২৩] থাইক্যা পাঠায় সলুকারে॥৩২
ভেলুয়ার দুঃখের কথা যতেক কাহিনী।
একে একে কয় কন্যা চক্ষে বহে পানি॥
বুঝাইয়া শুনাইয়া কন্যা কয় মাও বাপে।
অন্তর পুইরা যায় সাধুর কন্যার শোক তাপে॥৩৬
পাঁচ ভাইয়ের কাছে কয় সলুকা সুন্দরী।
তোমার বইন ডুব্যা মরে সাগরেতে পড়ি॥
পাঁচ ভাই থাকিতে হয় বইনের মরণ।
সুন্দর ভেলুয়ার ভাগ্যে এই না বিড়ম্বন॥৪০
বার্ত্তা পাইয়া সদাগর কোন কাম করে।
পাঁচ পুত্ত্র লইয়া চলে ক্ষীর নদীর সাগরে॥
তথা হইতে চলে সাধু ত্বরিত গমন।
শঙ্খপুরের ঘাটে গিয়া দিল দরশন॥৪৪
গোপনে থাকিয়া সাধু দূতীরে পাঠায়।
দূতী গিয়া বার্ত্তা কয় তার বাপ মায়॥
একমাত্র পুত্ত্র তোমার শুন সদাগর।
ক্ষীর নদীর সাগরে ভাসে হইয়া কাতর॥৪৮
আছে কি না বাইচ্যা অতদিন যায়।
উচিতে বাঁচাইতে সাধু তাহারে যোয়ায়॥
তথা হৈতে চলে সাধু ত্বরিত গমন।
জ্ঞাতি বন্ধু জনে দিল বিয়ার নিমন্ত্রণ॥৫২

যত যত সদাগর যতদেশে ছিল।
ক্ষীর নদীর সাগরে ডিঙ্গা বাহিয়া চলিল॥
আজি দিন হইল গত কালি হইব বিয়া।
রাজ্যের যত সদাগর মিলিল আসিয়া॥৫৬

চারিদিকে দেখে ডিঙ্গা পর্ব্বত আকার।
দেখিয়া সে আবু রাজার লাগে চমৎকার॥
নাই সে দিলাম নিমন্ত্রণ জ্ঞাতি বন্ধুজনে।
কন্যারে লইয়া হেথা আসিলাম গোপনে॥৬০
কোথা হইতে আইল ডিঙ্গা না জানি ভালমন্দ।
এই না দেইখ্যা আবু রাজার লাইগ্যা গেল দ্বন্দ্ব॥
হুকুম দিল মদন সাধু যত লোক জনে।
আবু রাজায় ধরে সাধুর যত লোক জনে॥৬৪
নাপিতে নাপ্‌তানী ধইরা ডিঙ্গায় তুলিল।
সঙ্গের যতেক লোক বান্ধিয়া লইল॥
রাজার ডিঙ্গা ডুবাইল ক্ষীর নদীর সাগরে।
সকলে ধরিয়া নিল অলঙ্ঘ্যার চরে॥৬৮

অলঙ্ঘ্যার চরের কথা সকলে জানাই।
দশ যোজন পথ ধইর‍্যা গাছ বিরিক্ষ নাই॥
বাড়ীঘর নাই তথা মানুষ মুনিষ।
চড়েতে পড়িলে লোক হয় হারাদিশ॥৭২
বসনে বান্ধিয়া সাধু হাতে আর গলে।
সকলে রাখিল ছান্দি অলঙ্ঘ্যায় চরে॥
নাপিত নাপিতানীরে বান্ধে ডিঙ্গার কাছি দিয়া।
আবু রাজায় কহে সাধু আইস কর বিয়া॥৭৬
ডিঙ্গার কাছে গিয়া সাধু বান্ধে হাতে পায়।
চড়েতে রাখিল তারে উবুতিয়া পায়॥

* * * *

মিন্যতি করিয়া মদন যত সাধু জনে।
দৈব বিড়ম্বন কথা কহে সব স্থানে॥৮০
সবারে লইয়া সাধু যায় শঙ্খপুরে।
পঞ্চ কুটুম্বের সহ লইল শ্বশুরে॥
কতদিন দেখা দিল আরে শঙ্খপুর।
কুলের বড়াই সাধুর হৈয়া গেল দূর॥৮৪

মনে মনে ভাবে সাধু চিন্তা যে করিয়া।
মদনের সঙ্গে দিবে ভেলুয়ার বিয়া॥
গণক ডাকিয়া সাধু দিন করে স্থির।
এইরূপে দিন লগ্ন হইল সুস্থির॥৮৮
সোণার গলৈ ডিঙ্গা পবনের পাল।
জোড়েতে বহিয়া যায় বাতাস উতরাল॥
মালধর বৈঠালীরে ডাইক্যা কহে সদাগর।
শীগ্‌গির কইরা যাও তুমি সেই জৈতাশ্বর॥৯২
বিয়ার নিমন্ত্রণ লইয়া যাও সেইখানে।
এই পত্র দিও তুমি ধনঞ্জয়ের স্থানে॥
পবন ডিঙ্গা বাইয়া তবে মালাধর বৈঠালি।
চলিল প্রভুর কাজে নাহিক শৈথিল্যি॥
শুভদিনে শুভক্ষণে আইল ধনঞ্জয়।
রাজ্যের যত সাধু আইস্যা হইল উদয়॥
দুই কন্যা বিয়া হবে মদন সাধুর সঙ্গে।
শঙ্খপুরের যত লোক মজে মনোরঙ্গে॥১০০
জয়াদি জোকার পড়ে মঙ্গল বাজন।
দরিদ্রে বিলায় সাধু রজত কাঞ্চন॥
এইরূপে ভেলুয়া আর মেনকা সুন্দরী
সোয়ামীর সঙ্গে বঞ্চে দিবস শর্ব্বরী॥১০৪

মনের আকাঙ্ক্ষা যত হৈল পূরণ।
দুইনারী পাইল সাধু মনের মতন।
তিন জনে মেলামিশি পরাণে পরাণ।
সলুকারে দিল সাধু ধনরত্ন দান॥১০৮
রাজ্যের যত সদাগর যার তার দেশে যায়।
ভেলুয়ার কাহিনী কথা এইখানে ফুরায়॥
সভাজনের কাছে মোর এক নিবেদন।
কি গাহিতে কি গাহিয়াছি নাহিক স্মরণ॥১১২
নিজগুণে ক্ষমা মোরে কর সভাপতি।
পাঁচখণ্ডী ভেলুয়ার গান আমি অল্পমতি॥
গান বাদ্যি নাহি জানি নাহি তালমান।
সবার চরণে আমি অধমের ছেলাম॥১১৬
যাঁর তাঁর নিজ স্থানে করুন গমন।
এতদূরে কাহিনী কথা করলাম সমাপন॥
পান দাও তামুক দাও কর্ম্মকর্ত্তা ভাই।
এইখানে গাইয়া গান নিজের বাড়ী যাই॥১২০

(সমাপ্ত)

  1. কুঠীয়াল =যাহার কুঠি আছে।
  2. মাপ্যা = মাপিয়া।
  3. আচরিত = আশ্চর্য্য।
  4. ঠুনি = খুঁটি।
  5. ছানি = আচ্ছাদন, ছাউনি।
  6. টুই= ঘরের উপরে সে স্থানে দুই দিক হইতে দুইটী চালকে একত্রিত করিয়া জোরা দেওয়া হয় সেই স্থানটীকে ঘরের টুই বলা হয়।
  7. নায়, নাও= নৌকা, জাহাজ।
  8. জৈত্তার পাড় = জয়ন্তী পাহাড়। শ্রীহট্ট জিলার উত্তর সীমানায় খাসিয়া ‘জয়ন্তী' পাহাড় অবস্থিত।
  9. পুন্নু মাসীর চান = পূর্ণমাসীর চাঁদ।
  10. কাঞ্চা = কাঁচা।
  11. এই গানটি একটা সুদীর্ঘ ভাটিয়াল সুরে গ্রথিত হইয়াছে। প্রথম ছত্রটির সঙ্গে দ্বিতীয় ছত্রের মিল নাই— তৃতীয় ছত্রটির সঙ্গে প্রথম ছত্রের মিল। দ্বিতীয় ছত্রটি তৃতীয়ের সঙ্গে এক সুরে পড়িয়া শেষ করিতে হইবে, তবেই মিল টের পাওয়া যাইবে। মাঝে মাঝে ত্রিপদী ছন্দের দুই একটি কবিতা আছে।
  12. থইয়া খুইয়া=রাখিয়া,ত্যাগ করিয়া।
  13. খণ্ডি=খণ্ড।
  14. ছান্দিয়া = তৈরী করিয়া।
  15. আভে...ছানি = অস্ত্রদ্বারা ছাউনি দিয়াছে।
  16. পুষ্কুণী = পুষ্করিণী।
  17. পাট = আসন।
  18. আঁইক্যা=অঙ্কিত করিয়া জোড়া ভুরু রামধমুর মত যেন আঁকিয়া রাখিয়াছে।
  19. Cf. “ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণী অবণী বহিয়া যায়”—চণ্ডীদাস।
  20. বিবরণ = বিষয়।
  21. ঘাট=নীচু করা, হীন করা।
  22. ‘চন্দ্র…………….পতি’ = আমার কন্যা চন্দ্রের ন্যায় সুন্দরী, এবং তাহাব স্বামী সূর্য্যতুল্য তেজস্বী হউক।
  23. গাইষ্ঠ্য গিলা=গাইষ্ঠ্য ও গিল। ক্ষারগুণসম্পন্ন বনজ ফল বিশেষ। ইহাদের শাঁস (আঁটি) বাটিয়া তদ্বারা অঙ্গ-মার্জ্জনা করিলে শরীর পরিষ্কার ও কান্তিযুক্ত হয়।
  24. ছান =স্নান।
  25. পাঞ্চ = পাঁচ।
  26. ‘সাঁতার জলে’ = গভীর জল, যেখানে সাঁতার দেওয়া ভিন্ন উপায় নাই।
  27. আচানক = আশ্চর্য্য।
  28. কাইল রজনী পোষাইল = কল্যকার রাত্রি যাপন করিল।
  29. লুইক্যা = লুকাইয়া।
  30. উভেতে উভেরে = উভয়ে উভয়কে।
  31. বইল = বসিল।
  32. সাউধ=সাধু।
  33. হইরা = হরণ করিয়া।
  34. মন......দুষমন = মন ও জীবন যৌবনের যাহা শ্রেষ্ঠ সুখ, তাহা হরণ করিয়া নিল, কিন্তু সে শত্রু ও কুটিল, তাহা না হইলে সকল সার জিনিষ হরণ করিয়া লইয়া এই অসার দেহটাকে ফেলিয়া গেল কেন?
  35. হার-দিশ == দিশাহারা; আত্ম-বিস্মৃত।
  36. ‘এখনে....উজানা'—এখন যৌবনের গতি উজান দিকে বহিতেছে অর্থাৎ এতকাল যাহা ভাবিয়াছি এখনকার ভাবনা উল্টা দিকের।
  37. খবইরা = বার্তাবহ।
  38. আইব ফিরিয়া = ফিরিয়া আসিবে।
  39. মুরুখ =মুর্খ। বনেলা = বন্য।
  40. যৈবন হইল কালি = যৌবন শ্রীতে কালিমা পড়িয়াছে।
  41. ছাড়িয়া......নন্দন = নিজ পিঞ্জরের শারীকে আনিয়া তাহার সহিত শুককে আনিয়া মিলাইয়া দেখে সাধুর পুত্রের সঙ্গে তার কি সেইরূপ মিলন হইবে, এই চিন্তা করে।
  42. বস্ত্র = মূল্যবান ভাল শাড়ী।
  43. মৈলান = মলিন।
  44. উন্মত্ত = প্রমত্ত, যৌবনের প্রথম উদ্যমেই
  45. কপাট খাটিয়া = কপাট বন্ধ করিয়া।
  46. আইঞ্চল পাত্যা = আঁচল বিছাইয়া।
  47. সই সঙ্গতীরা = সই সাথীরা। সঙ্গতী = সঙ্গে সঙ্গে থাকে যে॥
  48. শব্দ শোনা যায় =লোকে বলাবলি করিতেছে।
  49. কাছাড়ে ঢেউয়ের বাড়ি = কাছার (নদীর তীরদেশ), বাড়ি আঘাত। সাধুর নৌকা-বেগে ঢেউগুলি নদীর তটদেশে আছড়াইয়া পড়িতেছে।
  50. হয় বা না হয় = সত্য বা মিথ্যা কে বলিতে পারে।
  51. পরতয় = প্রত্যয়, বিশ্বাস।
  52. চান্নিমার পর = চাঁদের কিরণ। ‘পর’ শব্দের অর্থ বোধ হয় 'আলো', ‘পশর' শব্দের অপভ্রংশ।
  53. সাই সঙ্গত = সাথী ও বন্ধু, সঙ্গত = বাহারা সঙ্গে থাকে।
  54. ফল্যাছে = ফলিয়াছে।
  55. সাগর......হারাই = সমুদ্রই আমার ঘর বাড়ীর মত, আমি সর্ব্বদা সমুদ্রে ঘুরি ফিরি কিন্তু অদৃষ্টের দোষে, চৌদ্দ ডিঙ্গ। ধন রহিয়া গেল, কিন্তু তদপেক্ষাও আমি যাহা বেশী মূল্যবান মনে করিতাম আমার সেই শুক পাখীটিকে হারাইয়াছি।
  56. বাউরা = উন্মত্ত।
  57. বির্দ্দমানে = বিদ্যমানে।
  58. নিলে = যদি নিতে হয়।
  59. শিখান্য বানাইন্য = শিখানো ও তৈরী করা।
  60. ভারী = গভীর।
  61. ডাকনে = ডাকে।
  62. তারা......সায়রে = আকাশরূপ সমুদ্রে তারা ফুলের মতন ভাসিয়া যাইতেছে।
  63. মাইঝ = মধ্য।
  64. ডাইল = ডাল।
  65. ফইল্যা = ফলিয়া।
  66. চাইপ্যা=চাপিয়া, ঢাকিয়া।
  67. Cf. “ফুল নও যে কেশের কর্‌ব বেশ” লোচন দাস।
  68. কৈরা, ছাইড়া, রাইখ্যা = করিয়া, ছাড়িয়া, রাখিয়া।
  69. আর্গিয়া পুছিয়া = অর্ঘ্য প্রদান ও সমাদরে গ্রহন করিয়া।
  70. বাছাই = সম্ভবতঃ কোন ব্যক্তির নাম, তাহার পুত্র।
  71. জয়াদি জোকার = যে উলুধ্বনির আদিতে জয় সূচিত হইতেছে।
  72. বিরয় = বিরহ।
  73. শেষ মেশ্ = সর্ব্ব শেষে।
  74. হইল......পুরী = তাহার বিবাহ প্রস্তাবই, আমার, তোমার পুরীতে আসার
    কারণ।
  75. কার্তিক কুমার = দেব সেনাপতির ন্যায় সুরূপ।
  76. বণিক......থালে = বণিকদের সামাজিক নিমন্ত্রনে আমার কৌলিন্য-মর্য্যাদার জন্য আমাকে সোনার থালায় ভাত দেওয়া হয়।
  77. পরধান পিরিতে = প্রধান আসনে।
  78. শেঠ = শ্রেষ্ঠ।
  79. ঘাটিব = দোষযুক্ত করিব। ঘাট = দোষ।
  80. টোটে = ন্যূন হয়।
  81. ঠাডা = বাজ, বজ্র।
  82. ফিরাবার = পুনরায়
  83. ভাইটাল = ভাটির।
  84. থইয়া = থুইয়া, রাখিয়া।
  85. পরাণী বাছাইতে = প্রাণ বাঁচাইতে।
  86. ধাই = ধাত্রী, সলুকার প্রতি।
  87. বিকাইয়া = বিক্রয় করিয়া।
  88. নিরালা = নির্জ্জন স্থান।
  89. আওলাইয়া = এলাইয়া, আলুলায়িত করিয়া।
  90. তুফান অর্থ ঝড়, এস্থলে ঢেউ নহে।
  91. ফিরা=ফেরি।
  92. নিরালে = নির্জ্জন স্থানে।
  93. নিবিলে =নিবিড়ে, সঙ্গোপনে।
  94. নাগর = প্রেমিক।
  95. সাঁইজ=সাঁঝের বেলা, সন্ধ্যা।
  96. গোঞ্জারিল=গোঁঞাইল, অতীত হইল।
  97. লোটন=একরকম খোঁপা।
  98. মোইতে=মোহিত করিতে।
  99. কানলে=কাননে।
  100. টুনা=ফুলের সাঁজি।
  101. মরমরি = মর্ম্মর শব্দ করিয়া।
  102. কাছ বিলে=কাছে। বিলে = ভিতে, ভিতরে।
  103. ঘুমাইন্যা=ঘুমন্ত, নিদ্রিত।
  104. পঁসর=আলো।
  105. ভানুশ্বর=সূর্য্য।
  106. বাস্‌না=বাসনা।
  107. সাই=সাথী।
  108. পউখ পাখালী=পক্ষী। ‘পাখালী’ বোধ হয় ‘পক্ষালু’ শব্দের অপভ্রংশ। পক্ষালু—শব্দ চন্দ্রিকা।
  109. নিয়ারে=নীরে, জলে।
  110. সই সাঙ্গাতি=সাথী সঙ্গিনী।
  111. জয়াদি জোকার=জয় জয়কার।
  112. অর্গিতে=অর্ঘ্য দ্বারা নৌকাবরণ করিতে।
  113. আচানক=অপূর্ব্ব
  114. গোসা = ক্রোধ।
  115. শঙ্খপুরে......বাহুরিয়া = তাহা না হইলে শঙ্খপুরে আর ফিরিয়া এস না।
  116. দুইষ্মন্যা=দুষমণ, শত্রুতাপ্রিয়।
  117. হগলেতে=সকলে।
  118. ভইষে=মহিষে।
  119. তেও=তবুও
  120. আচনেক = আশ্চর্য্য।
  121. চান্ =চন্দ্র।
  122. তির ভুবনে = ত্রিভুবনে।
  123. যাইথাম= যাইব।
  124. অছিলা=ছুতা; ছল।
  125. সান্ধাইল=প্রবেশ করিল।
  126. কাছ মাইলে=কাছে।
  127. খাড়াইয়া=দাঁড়াইয়া।
  128. নোখ্=নখ।
  129. মইলান=মলিন।
  130. আবের = অভ্রের।
  131. বাতাসে মুন্দিল=হাওয়া খাইতে খাইতে চোখ মুদিয়া আসিল।
  132. ঘুমে শরীর অবশ (ভারি) হইল।
  133. করে হায় হায়=আশ্চর্য্য বোধক শব্দ উচ্চারণ।
  134. ছোটবেলা যে স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম, আজ তাহা সত্য হইল। শিশুকালে গল্প শুনিয়া পরীদের দীর্ঘ চুলের কল্পনা করিতাম, আজ তাহা প্রত্যক্ষ করিলাম। সাজ=সত্য, সাচ্চা।
  135. খুরী=ক্ষুর॥
  136. এইবারে=এই সময়ে।
  137. খনায়=খনার বচনে আজ যে বার তাহাতে কামান নিষিদ্ধ।
  138. কুয়ার=কুস্বপ্ন।
  139. দুষ্কের=দুঃখের।
  140. সনকাঁইচ=স্বর্ণবর্ণ কাঁচপোকা। কোথাও কুঁজ ফলকেও সনকাঁইচ বলিয়া থাকে।
  141. পরখাই=পরখ, পরীক্ষা।
  142. দুষ্কিত=দুঃখিত।
  143. তরে=তোরে, তোমাকে।
  144. আবেতে=অভ্রে, মেঘে।
  145. পূর্ণমাসির চান্নি=পূর্ণিমার চন্দ্র।
  146. কালিয়া=কালি, মসী
  147. ঠাডা=বজ্র।
  148. কাঁডা=কাঁটা
  149. ছাড়ন লাগব বাড়ী=আজকার দিনের মধ্যেই বাড়ী ছাড়িতে হইবে।
  150. বইদেশ=বিদেশ।
  151. কাঠগরা=হাড়িকাঠ।
  152. কুইপ্যাছি=পুতিয়াছি।
  153. খবইরা=সংবাদ বাহক।
  154. শলী=শলাকা।
  155. বাতি...আইল=মেয়েরা বৎসরের কোন কোন দিনে নদীতে দীপ ভাসাইয়া উৎসব করে।
  156. মালদহর বৈঠালী=বুঝা যাইতেছে সেই সময় মালদহের মাঝিরা বৈঠা
    বাহিতে সুদক্ষ ছিল।
  157. ভারা=ভার, অর্থাৎ পাল বায়ুদ্বারা স্ফীত হইল।
  158. আধনে=অর্দ্ধদিনে। (অথবা অর্দ্ধ দণ্ডে?)
  159. যে বেড়া দিয়া ক্ষেত রক্ষা করিবে, সেই বেড়াই যেন ক্ষেতের শস্য খাইয়া ফেলিল।
  160. অতিক্যা=অতিশয়।
  161. দিন রাত্রি (করিয়া) মদন সাধুর কথা ভাবিতে লাগিল।
  162. মৈলান=মলিন।
  163. পরভাতিয়া = প্রভাতের, প্রাভাতিক।
  164. যেখানে মাথার মণি পড়িয়াছে, সেখানে সাপ আসিবেই আসিবে।
  165. বইয়া=বসিয়া।
  166. লগ্নাচার্য্য গণনা করিয়া যে দিন স্থির করিয়াছিলেন।
  167. কাছাইল=নিকটবর্ত্তী হইল।
  168. আরা=হারা।
  169. ছেইছ্যা=ছেদ করিয়া, ভেদিয়া।
  170. পত্র ছেইদ্যা....লিখন=এই সকল পদে চণ্ডীদাসের “অচল বলিয়া উচলে চড়িলু, পড়িলু অগাধ জলে” প্রভৃতির ভাব আছে।
  171. আশ্রা=অবসর বা সময়।
  172. ভায়=ভাবে।
  173. সল্লা = পরামর্শ; সাধারণতঃ কু-পরামর্শ।
  174. বনেলা = বন্য।
  175. কাতি = কাস্তে (সং-কর্ত্তরী)।
  176. আরাইল=হারাইল।
  177. গিয়ান = জ্ঞান।
  178. অইল = হইল।
  179. হারাদিশ = দিশাহারা।
  180. দুপরিয়া = দ্বিপ্রহর।
  181. বেচুনীয়া = বিক্রেতা।
  182. হেও = সেও।
  183. পরথম......ভাসায়=প্রথম যৌবনে কন্যা নিজকে সাগরে ভাসাইয়া দিল
  184. ধর্ম্মে····সাজা=ধর্ম্মরাজ হীরণসাধুকে মনের মত সাজা দিলেন।
  185. মলুয়া—“দেয় পঙ্খী উড়া” (মৈমনসিংহগীতিকা, ১ম খণ্ড, ৬৮ পৃষ্ঠা)।
  186. অয়রাণ=হয়রাণ।
  187. মাথায় কুরাল=এরূপ বিপদে পড়িল যে, নিজের মাথায় নিজে কুড়ুল মারিবার প্রবৃত্তি হইল।
  188. যুগলা=যুগল।
  189. দেখিতে এরূপ বোধ হয় যে, প্রাণ আছে কি নাই তাহা বুঝিতে পারা যায় না।
  190. গাইষ্টের=গিঠের।
  191. দৈব্য = দ্রব্য।
  192. গলের=গলুইএর উপর।
  193. সাউদের=সাধুর।
  194. এন = হেন, এই।
  195. দুঃখের কথা বলিতে যাইয়া সুন্দরী নিজের মাথা পাথরে ভাঙ্গিতে চাহিল।
  196. দুফর=দ্বিপ্রহর।
  197. দায় = জন্য।
  198. ইহার পরে গায়নের একটা নিবেদন আছে, তাহা নিম্ন-শ্রেণীর আসরের যোগ্য। তথাপি তাহা উদ্ধৃত করিতেছি:—

    [পান নাই তামুক নাইরে নিশা হইল ভারী।

    গান গাইতে আইলাম ভাইরে বক্ষিলের (কৃপণের) বাড়ী॥
    পান দিল গুয়া দিল নাই সে দিল চূণ।
    কত বা গাইবাম আমি বক্ষিলের গুণ॥
    খায় না ধন দৌলত রাখ্যাছে বান্ধিয়া।
    বক্ষিলেরে বাইন্ধ্যা রাখে যমে উবুত করিয়া॥
    পুলি পুরী জনে যদি পিঠা খাইতে চায়।
    এক মাস দুই মাস কইর‍্যা কেবল সে ভাঁড়ায়॥
    এক যে বক্ষিলের কথা শুন দিয়া মন।

    এইখানে কইবাম আমিরে ভালা তাহার বিবরণ॥]
  199. কাইর‍্যা=কাড়িয়া
  200. সন্ধানী=যে সন্ধান দেয়, গুপ্তচর। অন্যত্র “খবইরা”।
  201. চান্দ····ভরিয়াছে=নৌকার মধ্যে চন্দ্র ও সূর্য্য পুরিয়াছে।
  202. ঝট্‌তি=শীঘ্র করিয়া।
  203. আইয়া=আসিয়া।
  204. দড়বড়ি=তাড়াতাড়ি।
  205. ভাঙ্গা ফাটা=জীর্ণ ও ভগ্ন।
  206. আনচৌক=আকস্মিক ভাবে।
  207. পদ্মাপুরাণে অনেকস্থানেই “বেউনী” শব্দ পাওয়া যায়। “বিউনী” অর্থ
    পাখা (ব্যজনী)।
  208. উবু=উঁচু।
  209. ধাই=ধাত্রী
  210. বিকাইতে=বিক্রয় করিতে।
  211. বড়গলা কইর‍্যা=উচ্চৈঃস্বরে। এই পরিচয়টা খুব উচ্চৈঃস্বরে দিল যাহাতে সকলে বুঝিতে পারে যে প্রকৃতই সে ডোম-কন্যা।
  212. নাটুয়া মহলে=নাটমন্দিরে।
  213. সকতি=স্বীকৃতি।
  214. বরিব=বরণ করিব, বর বলিয়া গ্রহণ করিব।
  215. জলটুঙ্গি=পুকুর বা দীঘির মধ্যে পূর্ব্বে ঘর নির্ম্মিত হইত। বড়লোকেরা গ্রীষ্মকালে তাহাতে রাত্রিযাপন করিত।
  216. পদ্যি=পদ্ধতি।
  217. দাণ্ডারা=ঢেঁড়া।
  218. সাউদের = সাধুর।
  219. চক্ষের অশ্রু মাকড়সার জালের মত সতত চক্ষে লাগিয়া আছে।
  220. এ সকল বাজীর নাম।
  221. জোরে......জোকার=খুব শব্দ করিয়া হাঁচি পড়িতে লাগিল ও মেয়েদের জয় জয়কারের শব্দ মুখে ফুটিল না।
  222. উখেরা=উল্টাদিকের।
  223. গোমনে = গোপনে।