পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/কমলা রাণীর গান

৬। কমলারাণী। (২০৮-২১০ পৃঃ)।

 কমলারাণীর গান সম্পূর্ণ সংগ্রহ হয় নাই। কমলাদেবীর সহিত রাজা জানকীনাথের বিবাহের বিবরণ সম্বলিত প্রথম ও দ্বিতীয় সর্গ পাওয়া যায় নাই। চন্দ্রকুমার ১৯২৫ খৃষ্টাব্দের ৩০শে আগষ্ট তারিখে আমাকে পুর্ব্বোক্ত দুই সর্গের সারাংশ লিখিয়া পাঠান। এই পালাটি এক সময়ে মৈমনসিংহ অঞ্চলে খুব প্রচলিত ছিল; সুতরাং পালাটির অপ্রাপ্ত অংশ উদ্ধার করিবার আশা আমি এখনও ছাড়ি নাই। পালা গানটি ৩৪২ ছত্রে সমাপ্ত; আমি ইহাকে দশটি সর্গে বিভক্ত করিয়াছি।

 পালাগানটিতে একটি বাস্তব কাহিনীকে কল্পনার ছাঁচে ফেলিয়া রচনা করা হইরাছে। আখ্যায়িকায় বর্ণিত সুষং দুর্গাপুরের জমিদার জানকীনাথ মল্লিক, তদীয় পত্নী কমলাদেবী এবং পুত্ত্র রাজা রঘুনাথ সিং ইঁহারা ঐতিহাসিক ব্যক্তি। মৈমনসিংহের অন্তর্গত রামগোপালপুরের বারেন্দ্র জমিদার শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী মহাশয় তাঁহার ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দের ৩রা এপ্রেল তারিখের পত্রে চন্দ্রকুমারকে ইঁহাদের সম্বন্ধে নিম্নলিখিত বিবরণ প্রদান করিয়াছেন। “কমলাদেবী জাহাঙ্গীরের সমসাময়িক। তাঁহার পুত্ত্র রঘুনাথ সিং উক্ত সম্রাটের নিকট হইতে “রাজা” উপাধি লাভ করেন। তিনি সুষং দুর্গাপুরের প্রসিদ্ধ জমিদার জানকীনাথ মল্লিকের পুত্ত্র। স্বামি-দৃষ্ট স্বপ্নানুসারে রাণী কমলদেবী দীঘিটিকে জলপূর্ণ করিবার জন্য প্রাণত্যাগ করেন, এইরূপ প্রবাদ এতদঞ্চলে প্রচলিত আছে। কমলাসাগর নামধেয় দীঘির কিয়দংশ এখনও বর্ত্তমান; অবশিষ্টাংশ সোমেশ্বরী নদী গ্রাস করিয়াছে। জানকীনাথ আকবরের সমসাময়িক। রাজা রঘুনাথসম্বন্ধীয় উল্লেখযোগ্য যাবতীয় ঐতিহাসিক তথ্য মদ্রচিত মৈমনসিংহের বারেন্দ্র জমিদারদিগের ইতিহাসের দ্বিতীয় খণ্ডে পাওয়া যাইবে।” খ্যাতনামা লেথ্‌ব্রিজ সাহেবও তাঁহার ইংরেজীতে লিখিত “The Golden Book of India” পুস্তকে এই রাজা রঘুনাথ সম্বন্ধে লিখিয়াছেন যে তিনি রাজা উপাধি-লাভ এবং গারো প্রজা দমনার্থ দিল্লীর সাহায্য লাভ করিয়া কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ প্রতিবৎসর গারোপাহাড়ে উৎপন্ন চন্দন প্রচুর পরিমাণে দিল্লীতে প্রেরণ করিতেন এবং তিনি “গারো তন্বী মন্‌সবী” এই উপাধিও সম্রাটের নিকট হইতে লাভ করেন।

 পালাগানোক্ত চরিত্রগুলিও যেমন ঐতিহাসিক ব্যক্তি, সেইরূপ মূল আখ্যায়িকার বিষয়ভাগও ঐতিহাসিক ঘটনামূলক। প্রিয়তমা রাণীর নামে উৎসর্গ করিবার সঙ্কল্পে রাজা জানকীনাথ কর্ত্তৃক কমলা-দীঘি খনিত হয়, কিন্তু তাহার ‘শুকোদ্ধার’ অর্থাৎ জলাগম হইল না। দীঘিতে জল না আসিলে দীঘিকারকের চতুর্দ্দশ পুরুষ পর্য্যন্ত নরকগামী হইতে হয়,—এই প্রাচীন সংস্কারের দরুণ রাজা এবং তাঁহার পাত্রমিত্র ও প্রজাবর্গ যখন চিন্তাক্লিষ্ট হইয়া উঠিলেন, তখন রাজা একদিন স্বপ্ন দেখিলেন যে রাণী পুষ্করিণী গর্ভে অবতরণ করিয়া জলসিঞ্চন এবং অপর কয়েকটি প্রক্রিয়া দ্বারা পুষ্করিণীতে জল আনয়ন করিতেছেন। এই স্বপ্নানুসারে রাণী সাধারণের হিতার্থে এবং স্বামীর পিতৃপুরুষদিগকে নিরয়গমন হইতে রক্ষা করিবার জন্য দীঘির জলে জীবন বিসর্জ্জন করেন। কমলারাণীর এই আত্মোৎসর্গ কল্পনামূলক নহে। প্রবাদটি দেশময় বহুকাল হইতে প্রচলিত, এবং সত্য ঘটনা মূলক। প্রাচীন সংস্কার অনুসারে গঙ্গাসাগরে শিশুবিসর্জ্জন প্রভৃতি ব্যাপারের ন্যায় দীঘিতে জল না হইলে নরবলি দেওয়া কিংবা আত্মোৎসর্গ করাও একটা রীতি ছিল। স্থানে স্থানে কবিত্বচ্ছটায় পালাগানটি উজ্জ্বল হইয়াছে। ১০ম খণ্ডে ১—১১ ছত্রে সূর্য্যোদয়ের যে বর্ণনাটি আছে, তাহা এত সুন্দর ও সরল কবিত্বময়, যে পড়িয়া মনে হয় যেন ঋগ্বেদের ঊষার স্তোত্র পাঠ করিতেছি। রমণী কমলার অসামান্য সংযম করুণরসকে নিবিড় করিয়া তুলিয়াছে। তিনি স্নেহশীলতা এবং অপূর্ব্ব ত্যাগ মণ্ডিত হইয়া দেবীর ন্যায় আমাদের ভক্তিপুষ্পাঞ্জলির পাত্রী হইয়াছেন।

 জানকীনাথকে নিষ্ঠুরতার অপবাদ দেওয়া যায় না। স্বপ্নের কথা শুনিয়াই রাণী আত্মবিসর্জ্জন করিবেন, ইহা তাঁহার অভিপ্রেত ছিল বলিয়া বোধ হয় না। বিশেষতঃ রাণীর বিচ্ছেদে তাঁহার উন্মত্ত শোকোচ্ছাস ও মর্ম্মস্পর্শী প্রলাপ বর্ণনা করিয়া কবি তাঁহার হৃদয়টির যে চিত্র দিয়াছেন, তাহা স্নেহ-প্রেমে ভরপুর। ধর্ম্মকার্য্যে বাধা দিতে তিনি সাহসী হন নাই—ইহাই তাঁহার দোষ। এ কথাটি ষোড়শ শতাব্দীর মাপকাঠি দিয়া বুঝিতে হইবে।

 ভণিতায় অধরচাঁদ পালারচয়িতা বলিয়া নিজের উল্লেখ করিয়াছেন। পালারচনাকাল গীতোক্ত ঘটনার অব্যবহিত পরে অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ বলিয়া মনে হয়। বর্ত্তমান পালায় পরবর্ত্তী গায়ক সম্প্রদায়ের হস্তে গানের মূল গ্রাম্যভাব ও ভাষার যে বিশেষ পরিবর্ত্তন হইয়াছে তাহা মনে হয় না।

 “মহুয়া,” “দেওয়ান ভাব্‌না,” “ধোপার পাট” প্রভৃতি পালার কবিগণ যেমন বাহুল্যবর্জ্জন ও ভাষাসংযম দেখাইয়াছেন, বর্ত্তমান পালার কবি স্থানে স্থানে তাহার একটু ব্যতয় করিয়াছেন। ষষ্ঠ সর্গ ১৭—২০ ও ২৭—৩৪ ছত্রে এবং সপ্তম সর্গে ৯—১১ ছত্রে বাক্য-পল্লব দ্বারা পাণ্ডিত্য প্রকাশের চেষ্টা কতকটা কাব্য রসের হানি করিয়াছে; মাঝে মাঝে কবি দার্শনিক গবেষণা দ্বারা গ্রাম্যগীতির সরলতা নষ্ট করিয়াছেন। কিন্তু গানের মুখ্য বর্ণনীয় বিষয় অর্থাৎ কমলারাণীর মহান্ আত্মোৎসর্গের চিত্রের নিকট এই সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দোষ ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে।


কমলারাণীর গান

 প্রথম খণ্ডে পূর্ব্বরাগ ও রাজার সঙ্গে কমলারাণীর বিবাহ। এই খণ্ডটি পাওয়া যাইতেছে না। দ্বিতীয় খণ্ডের কতকটা কথার ভাবে বলিয়া যাওয়ার পরে গীত আরম্ভ। গায়কের কথ্য ভাষায় এই স্থান লিখিত হইল।

 রাজা ও রাণী এই ভাবে আছুন। দুইজনে মনে মনে খুব মিল। এক দিন রাণী বল্লেন, “রাজা! তুমি যে আমাকে অত ভালবাস, আমি মরিয়া গেলে তার কি চিন্[১] থাকিবে?” রাজা বলিলেন, “তুমি যা বল আমি তাই করিব।” রাণী কহিলেন, “আমি এক টাকুয়া[২] সুতা সাত দিন সাত রাইত ভরিয়া কাটিব। সেই সুতায় যত জায়গা বেড়ে, তার মধ্যে তুমি এক পুষ্কুন্নী কাটিয়া আমার নামে তার নাম রাখিবা।” রাণী সাত দিন সাত রাইত ভরিয়া এক টাকুয়া সুতা কাটিলেন। রাজা সেই সুতার পরমাণে[৩] পুষ্কুন্নী কাটাইলেন। কিন্তু পুষ্কুন্নীতে শুকুদ্বার[৪] হয় না, শুকুদ্বার না হইলে চৌদ্দপুরুষ নরকে যান। রাজা ভারী চিন্তায় পড়িলেন। একদিকে কামুলাগণ[৫] ভয়ে পলাইয়া গেল। রাজা তখন একদিন স্বপ্ন দেখিলেন; সে বড় আচরিত কথা।

(১)

“শুইয়া আছলাইন[৬] ধার্ম্মিক রাজা রাজা আরে বারবাংলার ঘরে।
কি স্বপন দেখিলাইন রাজা রাত্রর নিশাকালে॥
(আরে ভালা) কোথায় জ্বলে আন্ধাইর মাণিক আর হীরমণের[৭] হার।
কোন দেশ হইতে ভাস্যা না আইসেরে ভালা লিলুয়া বয়ার[৮]

কোথায় ডাকে সোণার কুইলরে[৯] রজনী পোষায়।
রাত্রির নিশাকালে কেরে ডালে বস্যা গায়॥

(রাজা)

“উঠ উঠ রাণী আগও আলো রাণী কত নিদ্রা নাই[১০] সে যাও।
শিওরে বস্যা যে ডাকি ভালা আখি মেইল্যা চাও॥
কিবা স্বপন দেখিলাম রাণী না যায় পাশরা।
রাইতের নিশি অন্ধকারে আমার ডুবল চান্দ তারা॥১০
পুষ্কুন্নী যে কাডাইছি[১১] রাণী আরে তোমার লাগিয়া।
শুকোদ্বার না অইল রে রাণী কিসের লাগিয়॥১২
আজু রাত্রি দেখলাম স্বপন রাণী বড় আচুম্বিত।
স্বপনের কথা কিছু কহিতে উচিত॥১৪
উবুরায়[১২] ডাকুইন[১৩] রাজাগো শিয়রে বসিয়া।
চান্দের সমান রাণী আছুইন শুইয়া॥১৬
সেজে[১৪] পইরা ঘুমায় শিশু পুণ্ণুমাসীর চান্।
একবার[১৫] নেহালে রাজা শিশুর বয়ান॥১৮

(১—১৮)

(২)

(আরে ভালা) ঘুম হইতে জাগ্যা রাণী আখি মেইল্যা চায়।
জাগ্যা বস্যা আছে পরাণের পতি ভালা[১৬] শিয়রে দেখা যায়॥
নিশি রাইতের কাঞ্চা ঘুমরে ঢুলে দুই আখি রইয়া[১৭]
ধীরে ধীরে কইল কথা গো রাণী রাজার মুখ চাইয়া[১৮]
“শুন শুন পরাণের পতি আরে কহি যে তোমারে।
কি লাগ্যা কান্দিছ নিশা না রাইতে, আরে ভালা, বইসা না শিয়রে॥”

রাজা


“আমি যে কান্দিছি রাণী আরে শুন দিয়া মন।
আজি রাত্রে দেখিলাম, ভালা, এক কুস্বপন॥
পুষ্কুন্নী কাডাইছি আমি কত সাধে রাণি।
গয়িন[১৯] হইয়াছে আজু না উঠিল পানি॥১০
তুমি যদি নাম গো রাণী পুষ্কুন্নীর তলে।
ভরিয়া উঠিবে তালাব[২০] পাতালের জলে॥১২
এই স্বপন দেখিলাম যেন আমার কথা শুনি।
ধীরে ধীরে সেই গয়িনে নাম্যা গেলা তুমি॥১৪
সাত পাঁচ স্বপন দেখিলাম রাণী আজি নিশাকালে।
তোমারে ভাসাইয়া নিলরে ভালা পাতালের জলে॥১৬
পার উচ্‌কাইয়া[২১] উঠে পাতাল পানির ফেনা।
মহাশব্দে আইসে জল হইয়া বেজানা[২২]১৮

কি জানি কি হইল রাণী কাঁপিছে পরাণ।
কোন দৈবে কাটাইল দীঘি করিতে হইরাণ[২৩]২০
রাজ্য নাই চাই রাণী আরে ধন নাই সে চাই।
কি অইব রাজ্য ধনেরে ভালা যদি তোমরারে আরাই[২৪]॥” ২২

(৩)

ঘুম হইতে উঠিয়া রাণীরে ভালা কোন কাম করে।
ধীরে ধীরে যাইন[২৫] গো রাণী বার বাংলার ঘরে॥
শুইয়াছিল দাসীগণ ডাকিয়া জাগায়।
“নদীর ঘাটে যাইব ছানে সঙ্গে যাবে আয়॥”

কেউ লইল সোণার কলসীরে ভালা কেউ বা লইল ঝারি।
কেউ বা লইল মেচের গামছা রে[২৬], ভালা, কেউ বা নীলাম্বরী॥
বাড়ী[২৭] ভইরা গন্ধ তৈল কেউ বা লইল হাতে।
সেই গন্ধ ছুটিয়া গেল শতেক যোজন পথে॥
কেউ বা লইয়া গাইষ্ট গিলা চলে নদীর কুল।
সঞ্চা[২৮] ভইরা কেউবা তুইলা লইল ফুল॥১০
কেউবা লইল ধান্যদূর্ব্বা দেবেরে পূজিতে।
ছানের যত আয়োজন কেউবা লইল মাথে॥১২
কালী হাঞ্চী[২৯] রাইতের নিশা গেল নদীর কূল।
আস্‌মান জুইরা[৩০] ফুট্যা আছে সোনার চাম্প ফুল॥১৪

“কেউবা লইল ধানদূর্ব্বা দেবেরে পূজিতে।
ছানের যত আয়োজন কেউবা লইল মাথে॥” ২১৪ পৃঃ

আন্ধাইর পথে সোমাই[৩১] নদী চল্‌ছে উজাইয়া।
সেই কালেতে গেলাইন[৩২] রাণী নদীর কূল চাইয়া॥১৬
চান্দ সুরুজ নাই সে দেখে রাণীর চন্দ্রমুখ।
নিশির ভোরে[৩৩] ঘুমের ঘুরে[৩৪] রাজ্যের যত লোক॥১৮
গাইষ্ট গিলা অঙ্গে মাখ্যা গো রাণীর দিল দাসীগণে।
গন্ধ তৈল দিল কেশেরে ভালা গন্ধের কারণে॥২০
ছান করিতে কমলারাণী নামলাইন[৩৫] নদীর জলে।
ধীরে ধীরে করায় ছান সখীরা সকলে॥২২
ছান হইল ভারা সারা[৩৬] কাম হইল ভারী।
ভিজা কাপড় ছাইড়া পিন্‌লাইন[৩৭] অগ্নিপাটের শাড়ী॥২৪
মেচের গামছা দিয়া অঙ্গ সখীরা মুছায়।
সিনান করিয়া শেষ রাণী বসিলা পূজায়॥২৬
ধান্য লইলা দূর্ব্বা লইলা আর লইলা ফুল।
অঞ্জলি করিয়া পূজে সুমাই নদীর কূল॥২৮
“সাক্ষী অইও সুমাই নদী, সাক্ষী অইও তুমি।
প্রভুর সত্য রাখতে আইজ চলিলাম আমি॥৩০
সাক্ষী অইও[৩৮] নদীর পারের যত গাছ গাছালি।
সাক্ষী অইও চন্দ্রসূর্য্য তোমরারে[৩৯] যে বলি॥৩২
সাক্ষী অইও দেব ধরম কারে আর বা মানি।
প্রভুর সত্য রাখিতে আইজ যাইবাম আপনি॥
পুষ্কুন্নী শুকাইয়া গেল না উঠিল পানি॥৩৫

চৌদ্দ পুরুষের অইব নরকেতে বসতি॥
রক্ষা কর দেবতা গো সবার অগতি[৪০]৩৭
ফুল বিল্ব দিলা রাণী দেবের চরণে॥
বর মাগে কমলা রাণী প্রভুর কারণে।৩৮
পূজাসন্ধি[৪১] কইরা রাণী কোন কাম করিল॥
ভরা কলসী কাঙ্ক্ষে তুইল্যা বাড়ীর মেলা দিল[৪২]৪১
রাজ্যের লোক নাইসে জানে নিশিরাইতে ছান॥
এহি মতে গেল নিশারে, ভালা, হইল বিয়ান[৪৩]৪৩
বাড়ীতে আসিয়া রাণী আরে কোন কাম করিল।
পালঙ্কে শুইয়া আসিল পুত্ত্রু ধন কোলে তুইল্যা লইল॥৪৫
শতেক চুমু দিল সে মায় বদন-কমলে।
অঝ্‌ঝর[৪৪] নয়ানে কান্দে ছাওয়াল লইয়া কোলে॥৪৭
শুন শুন পুত্ত্রু, আরে, অন্ধের সে লড়ি
আজি হইতে তোমা ধনে যাইবাম ছাড়ি॥৪৯
স্তন্য দুগ্ধ দিলাইন মাওগো মুখেতে তুলিয়া।
আর না দেখবাম চান্দ মুখ নয়ান মেলিয়া॥৫১
কান্দুইন কমলারাণী মুখে নাই সে রা[৪৫]
বুকেতে বাজিল মায়ের ছক্তিশেল[৪৬] ঘা॥৫৩

১-৫৩

(৪)

রাণী

“শুন শুন পরাণের পতি গো পতি আগ[৪৭] কইযে তোমারে।
আমার বুকের ধন সইপ্যা যাই তোমারে॥

বাপের বাড়ীর সুয়া দাসী কইয়া বুঝাই তোরে।
আমার না বুকের ধন সইপ্যা যাই তোমারে॥
বাপের বাড়ীর শ্যাম শুক পাখী তোমারে যে বলি।
পুত্ত্রু রে শিখাইও আমায় ঐ না মা মা বুলি[৪৮]
ক্ষিদা পাইলে কান্‌ব[৪৯] বাছা মাও মাও বলিয়া।
পরবোধ[৫০] করিও বাছায় মিঠা বুলি কইয়া॥
শুন শুন ধাই ঝিগো কই যে সকলে।
আমার না বুকের ধন সইপ্যা যাই তোমরারে[৫১]১০
পইরা রইল রাজ্যপাট এ সবে নাই খেদ।
এই পুত্ত্র রাখ্যা যাই পরাণ অইল ভেদ[৫২]১২

কান্দিয়া কাটিয়া মায় কোন কাম করিল।
অঞ্চলের নিধি দেখ সুয়ার কুলে[৫৩] দিল॥১৪
দাসদাসী শুনে দেখ কাইন্দা জারে জারে[৫৪]
কি জানি ঘটাইল দৈবে বুঝন সাধ্য কারে॥১৬
পরে ত কমলারাণী কোন কাম করিল।
ভরা সোণার কলসী কাঙ্কে[৫৫] তুল্যা নিল॥১৮
ধান্য দূর্ব্বা লইলা রাণী গিষ্ঠাতে[৫৬] বান্ধিয়া।
পুষ্কুণীর পারে রাণী দাখিল হইলা গিয়া॥২০
চারি পার ভইরা লোক করিয়াছে মেলা।
ভোর বিয়াণে পাটেশ্বরী পুষ্কুণ্ণীতে গেলা॥২২

সিন্দুর বরণ মেঘারে মধ্যে মধ্যে বা।
শুকুনা ডালেতে বস্যা কাগায়[৫৭] করে রা॥২৪
কাগায় বলে “কাগীরে মনে বড় দুখ।
কাইল নিশি পোহাইয়া আর না দেখবাম্ রাণীর মুখ॥২৬
রাজ্য অইব অন্ধকারা পাট অইব খালি।
এই দেশ ছাড়িয়া চল অন্য দেশে চলি॥”২৮
এই কথা কহিয়া কাগ্যা শূন্যে মাইল উরা।
তামাসা দেখিছে লোকে পারে থাক্যা খারা॥৩০
কেউ বা করে হায় হায় কেউবা থাকে চাইয়া।
কেউ বা কহে ধার্ম্মিক রাজা গেল বাউরা[৫৮] হইয়া॥৩২
স্বপন দেখিয়া দেখ রাণীরে পাঠায়।
কি জানি জন্মের লাগ্যা রাণীরে হারায়॥৩৪
কিসের দীঘি কিসের স্বপ্ন নাই সে উঠুক পানি।
এই গয়িনে লাম্‌তে যে নাই সে যাউন রাণী[৫৯]৩৬

(৫)

ধীরে ধীরে তবে রাণী কোন কাম করিলা।
গয়িন গম্ভীরে রাণী তলায় নামিলা॥
গিষ্ঠে ছিল ধান্য দূর্ব্বা ছিটাইয়া ফালায়।
পারেতে তাকাইয়া লোক করে হায় হায়॥
“যদি আমি সতী হই মনে ধরম থাকে।
শুকুনা পুষ্কুণ্ণীর জল উঠুক পাকে পাকে[৬০]

যদি আমি সতী হই ধর্ম্মে থাকে মন।
পারে পারে উঠুক পানি দেখুক সর্বজন॥
যদি আমি সতী হই প্রভুর বাঞ্ছা পুরে।
আমারে ভাসাইয়া পুরে লও পাতাল পুরে॥”১০
হস্ত উড়াইয়া[৬১] রাণী ঢালে কলসীর পানি।
কত জল ধরে কলসী কিছুই না জানি॥১২
ঢালিতে ঢালিতে জল ভিজে বসুমাতা।
ঢালিতে ঢালিতে জল ডুবে পায়ের পাতা॥১৪
(আরে ভাইরে) ঢালিতে ঢালিতে জল হইল হাটু পানি।
ঢালিতে ঢালিতে জল হইল কোমর পানি॥১৬
ঢালিতে ঢালিতে জলরে হইল গলা পানি।
ঢালিতে ঢালিতে জল ডুবিলেন রাণী॥১৮
কেশ ছাপাইয়া জল পারে মাইল লাড়া[৬২]
শিবের জডা[৬৩] বাইয়া ছুটে জাহ্নবীর ধারা॥২০
পাটের শাড়ীর আইঞ্চল দেখ ঢেউয়েতে মিশায়।২১
উচ্‌কাইয়া উঠে পানি ফেনা লইয়া মুখে।

হায় হায় বলিয়া কান্দে পারে থাক্যা লোকে॥২৩
দেখিতে দেখিতে হইল পারে পারে পানি।
কোথা হইতে আইসে জল কিছুই না জানি॥২৫
মহাশব্দে আইল জলরে আথাল পাথাল খাইয়া[৬৪]
কোন বা দেশে গেলাইন[৬৫] রাণী কেউ না দেখে চাইয়া॥২৭

১-২৭

(৬)

হায় হায় করিয়া রাজা কাইন্দা ভূমিত পড়ে।
রাজার কান্দনে দেখ বৃক্ষের পাতা না ঝুরে॥
গোয়াইলতে গরু কান্দে গাছে পউখ[৬৬] পাখালী।
আত্তি ঘোড়া[৬৭] কান্দে দেখ সহিত রাখুয়ালী[৬৮]
বনে কান্দে বনেলারা[৬৯] গিরেতে কৈতরা[৭০]
পাত্রমিত্র সবে কান্দে হইয়া সে বাউরা॥
দাসদাসী কান্দে দেখ কানাছে[৭১] বসিয়া।
মায়ত ঝুরিয়া কান্দন করে কোলের ছাওয়াল থৈয়া[৭২]
সতী কান্দে পতির আগে নাহি বান্ধে চুল।
(আর দেখ) বাগবাগিচায় পুষ্প না কলি মলিন হইল॥১০
কান্দ্যা যাওরে সোমাই নদী কইও বনে বনে।
রাজ্যের না আছিলাইন[৭৩] লক্ষ্মী ছার্‌লাইন এত দিনে॥১২
কান্দ্যা যাওরে জলের ঢেউ কইও পারে পারে।
রাণীরে ভাসাইয়া নিল দারুণ কালা পানির সুতে[৭৪]১৪
হায় রাজ্যের যত লোক কান্দন এহি মতে।
কিরে দারুণা দশমী আইল দেবীরে লইতে॥১৬

দেখ শূন্যের[৭৫] শোভা পউখ পাখালী শূন্যে মারে উড়া।
আস্‌মানের শোভা দেখ হয় সে চন্দ্রতারা॥১৮

(আরে ভাইরে) বাড়ীর শোভা বাগবাগিচা জলের শোভা তরী।
দেখ আন্ধাইর ঘরে প্রদীম শোভা পুরুষের শোভা নারী॥২০
সেই নারী হারাইয়া রাজা হইলা বাউরা।
সোণার পিন্‌রা[৭৬] খালি সে কৈরা পঙ্খী দিছে উড়া॥২২
সেই রাণী আড়াইয়া[৭৭] রাজা হইলা বাউল।
দিবা নাই সে নিশা সে পইরা কান্দে ঐ না দীঘির কূল॥২৪
পাত্রমিত্রগণে যত রাজারে বুঝায়।
যতই বুঝায় রাজা করে হায় হায়॥২৬
পরদীম ছাড়া গির যেমন সদায় নৈরাকার[৭৮]
পুষ্পছাড়া হইলে বুডা[৭৯] দেখ মূল নাই সে তার[৮০]২৮
পাণি ছাড়া পুষ্কুণ্ণী শূন্য প্রাণী ছাড়া দেহ।
নারী ছাড়া সংসার শূন্য ভাবিয়া সে দেখ॥৩০
কৈতরা উইড়া গেলে যেমন খোপ হয়রে খালি।
নারী ছাড়া পুরুষ শূন্য কিসের গিরস্থালী॥৩১
জোড়ের পঙ্খিনী কেবা শরেতে মারিল।
বুকের না মাণিক আমার কেবা হইরা নিল॥৩৪
কিসের রাজ্য কিসের ধন শূন্য যেমন ঘড়া।
সাত রাজার ধন আমার শূন্য বুক জোড়া॥৩৬
এই মতে কান্দুইন[৮১] সে রাজা হইয়া পাগল।
অন্ন নাই সে খাইন গো না পিয়ুন জল[৮২]৩৮
অধর চান্দে গায় গীত গো দুষ্কের কাইনী।
রাজার কান্দনে দেখ পাষাণ গল্যা পানি[৮৩]৪০

হায় মনে মনে কাইন্দ্যা গো রাজা বনে বনে ফিরে।
সাত পাঁচ দিন গেল বইয়া রাণী নাই সে ফিরে॥৪২
কার লাগিল বান্ধিলাম আমি জোড়মন্দির ঘর[৮৪]
কার লাগিল বান্ধিলাম আমি বারদুয়ারী ঘর॥৪৪
হায় জলটুঙ্গী[৮৫] ঘর মোর খালি সে পড়িল।
এক মাস যায় রাণী ফিইরা নাই সে আইল॥৪৬
যেমন ছিল দীঘির কালাপানি সেহি মতন আছে।
ঐনা পানি ছেদিয়া রাণী পাতাল পুরে গেছে॥৪৮

“লামরে ডুবুরীগণ আস্তে ফালাও জাল।
দুষ্মণ সায়র দেখ আমার হইল কাল॥৫০
কোন দৈবে কাটাইলরে দীঘি কিছুই না জানি।
সেওত[৮৬] ফালাইয়া তোমরা হিচ্যা[৮৭] তুল পানি॥”৫২
রাজার হুকুম পাইয়া নাই সে যতে কামুলায়।
দীঘির না কালা না পানি তারা সিচে ফালায়॥৫৪
পাঁচ কাউন[৮৮] কামেলারে সিচিতে লাগিল।
সিচিতে সিচিতে জল নয় দিন হইল॥৫৬
রাইত নাই সে দিন নাই সে তারা সিচে পানি।
সিচনে না কমে জল গো চুল পরমাণি[৮৯]৫৮
যেই ছিল ভরা ভরা সেই সে আছে।
হইরাণ অইয়া কামুলা পলাইয়া গেছে॥৬০

(আরে) নদীয়ে না ধরে গো পানি নালায় নাই সে আটে[৯০]
সিঞ্চা পানি উঠ্‌ল গিয়া সোমাই নদীর চড়ে॥৬২
ঘর বাড়ী অইল তল পর্‌জারা পলায়।
তবুও সেই কালা না পানি সিচিলে ফুরায়॥৬৪
ভাটি ছিল সোমাই নদী উজান বহিয়া না যায়।
পানির ফেনা উঠ্‌ল দেখ গাছের আগায়॥৬৬

১-৬৬

(৭)

(হায়) এন কালে অইল কিবা শুন দিয়া মন।
আর বার দেখে রাজা আশ্চর্য্য স্বপন॥
বার বাংলার ঘরে ত রাজা আছিল শুইয়া।
নিশি রাইতে দেখে রাজা আচরিত[৯১] হইয়া॥
আধ জাগে আধেক ঘুমেগো রাজা স্বপন দেখিল।
শিয়রে বসিয়া রাণী কহিতে লাগিল॥

রাণী


“শুন শুন পরাণের পতিগো কহি যে তোমারে।
বড় দুষ্কে আছি আমিগো ঐ সে পাতাল পুরে॥
হায় চিত্তির সুখে নিত্তিরে ভালা গভীর সুখে ঘুম[৯২]
কোলের সুখ পুত্ত্রু ছাওয়াল সকল সুখের দুন[৯৩]১০
শয্যার সুখ শীতলরে পাটি আন্ধাইরে সুখ বাতী।
মনের সুখ হাসনকান্দন নারীর সুখ পতি॥১২

সেই পতিপুত্র হারা হইয়া আমিগো হইছি রাউরা।
বনেলা পঙ্খিনী যেমন পিঞ্জর ভাইঙ্গা উড়া॥১৪
মনে নাই সে পরবোধ মানে রে নাই সে মানে প্রাণে।
এমন ছাওয়াল থইয়া[৯৪] আমি থাকিবাম কেমনে॥১৬
শুন শুন প্রাণের পতিগো কহি যে তোমারে।
ঘরখানি বাইন্ধা দেওগো ঐ পুষ্কুণ্ণীর পারে।১৮
বাপের বাড়ীর শুয়া দাসীরে ছাওয়াল লইয়া।
ঐ ঘরে থাকিবে রাইত গো আমার লাগিয়া[৯৫]২০
তিত ফরিঙ্গে[৯৬] না সে জানে গো রাজ্যের যত লোক।
নিশি রাইতে আইস্যা দেখবাম ছাওয়ালের মুখ॥২২
মুখে তুল্যা দিয়াম গো স্তন্যের দুগ্ধকুটী।
এক বচ্ছর তুমি পতি গো ছাড় কান্দন কাটি॥২৪
এক বছর পরে অইব দুইজনে মিলন।
তোমার স্বপনের কথা নাহি জানে কেহ॥২৬
এই এক বচ্ছর যদি করি দুগ্ধ দান।
তবেত হইব ছাওয়ালগো ইন্দ্রের সমান॥”২৮

আলা নহে ঢিলা নাই[৯৭] উবহু[৯৮] তেমন।
সেহি মত দেখে রাজা সোণার বরণ॥৩০
সেহি মত পিন্ধন দেখে রাজা অগ্নি পাটের শাড়ী।
সর্ব্ব অলঙ্কার অঙ্গে আছে পাটেশ্বরী॥৩২
সেহি মত কেশ বেশ বাতাসেতে উড়ে।
মেঘের মধ্যে তারা যেমন দুই আখ্‌খি জ্বলে॥৩৪

সেহি মত মধুর ডাক গো কোইল করে রা[৯৯]
ঘুমতনে[১০০] উঠিয়া রাজাগো চারিদিকে চায়॥৩৬
একেত বাউরা রাজাগো আর অইল পাগল[১০১]
স্বপনের দেখাশুনা না পায় লাগল[১০২]৩৮

(৮)

(আরে ভাইরে) প্রভাত কালে উঠ্যা না রাজা কোন কাম নাই সে করে
আরে ভালা কোন কাম সে করে।
পাত্রমিত্রগণে রাজা ডাকে সবাস্থরে[১০৩]
তবে ত ডাকিয়া আনে যত কামুলাগণে।
হুকুম দিল রাজ্যের রাজা গির[১০৪] বান্ধিবারে॥
চলিলা কামুলাগণ রাজার হুকুমে।
উত্তম করিয়া ঘর বান্ধে এক দিনে॥
গজারির পালা দিল গো নাই সে উলুয়া ছনে ছানি
(আরে ভালা) উলুয়া ছনে ছানি[১০৫]
শীতল পাটির বেড়া দিয়া বান্ধিল বিছানী॥
মক্ষি না যাইতে পারে ঘরের ভিতরে।
পিপড়া সান্ধাইল কিছু প্রবেশ ত না পারে॥১০
দিনের আলো নিশার গো বাতাস কিছুই না যায়।
এই মত নিরুইদ্যা[১০৬] ঘরগো বান্ধে কামুলায়॥১২

মধ্যখানে রাখে রাজাগো আড়ের পালং[১০৭]
শীতল না পাটী দিয়া শয্যার বরণ[১০৮]১৪
উত্তম বালিসরে দিল আর দিল মশরী।
আবের পাঙ্খ দিলাইন রাজা জলভরা না ঝারি॥১৬
শয়নগৃহের যা যা লাগে দিলাইন[১০৯] এইমতে।
ঘৃতের প্রদীম দিলাইন পসর জ্বালাইতে॥১৮
পরথম প্রহর নিশি রাজা কোন কাম করে॥
ছাওয়াল সঙ্গে সুয়া দাসী পাঠায় সেই ঘরে॥২০
সুগন্ধি চন্দন চুয়াগো বাটাভরা পান।
সেই শয্যা দেখিয়া লাজে দুগ্ধ হয় মৈলান[১১০]২২

এক রাইত যায়গো সুয়া আর রাইত যায়।
একদিন বাউরা রাজাগো সুয়ারে সমজায়[১১১]২৪
“শুন শুন সুয়া দাসীরে কইয়া বুঝাই তরে।
নিশি রাইতে জাগ্য। তুমি কিবা দেখ ঘরে॥”২৬

ধীরে ধীরে কহেত দাসীগো রাইতের বিবরণ।
“নিশি রাইতে আস্যা রাণী ছাওয়ালে দেয় তন[১১২]২৮
আলা নাই সে ঢিলা নাই সে দেখিতে তেমন।
সেইমত দেখি রাণীর সোণার বরণ॥৩০
সেইমত চাচর কেশগো বাতাসেতে উড়ে।
সেহিমত সর্ব্বঅঙ্গ রতনেতে জুড়ে॥৩২
সেহিমত পিন্ধন তার গো অগ্নিপাটের শাড়ী।
সেহিমত দেখি রাজা তোমার সে নারী॥৩৪

রজনী বঞ্চিয়া যায় শিশু লইয়া উড়ে[১১৩]
পোশাই রজনী[১১৪] আর আর না দেখি তারে॥৩৬
ঘর বান্ধা দুয়ার বান্ধা নাই সে দেখা যায়।
কোন বা পথে আইসে রাণী কোন বা পথে যায়॥”৩৮

১—৩৮

(৯)

সুবুদ্ধি আছিল রাজার কুবুদ্ধি গো হইল।
শুনিয়া আচরিত কথা দাসীর আগে কৈল॥
“আইজ যাওরে সুয়া দাসী সকাল করিয়া।
সন্ধ্যাবেলা যাও ঘরে ছাওয়ালে লইয়া॥”
এক বচ্ছরের দেখ এক দিন বাকী।
বরাতে আছিল রাজার দৈবে দিল ফাঁকি।

সোণার বাটায় পান সুপারী চুয়া চন্দন লিয়া।
ছাওয়াল করিয়া কোলে সুয়া দাখিল হইল গিয়া॥
ঘরে গিয়া ঘরের দুয়ার বন্ধন করিল।
পালঙ্ক উপরে সুয়া শিশু লইয়া শুইল॥১০
মাইঝাল[১১৫] রাইতে দেখ হইল কোন কাম।
শয্যায় না শুইয়ে রাজা নিদ্রা নাই নয়ানে॥১২
বার বাংলা ছাইরা রাজা ঘরের বাহির অইল।
আস্‌মানের চান্দ সুরুজ চাইয়া সে রহিল॥১৪
ধীরে ধীরে যাইনগো রাজা পুষ্কুণ্ণীর পাড়ে।
যে পারেতে সুয়ার ঘরগো যাইন সেই পারে॥১৬

মাঝে মাঝে পুষ্পের গাছ নাহি লাড়াচাড়া।
ঘরে ঘুমায় পুরুষ নারী নাই সে জানে তারা॥১৮
রাজ্যের যতেক লোক ঘুমায় এহিমতে।
পাগল অইয়া বাউলা রাজা কান্দে পথে পথে॥২০

গাছে জাগে সোণার কুইলগো পক্ষী ছাড়ে বাসা।
হেন কালেতে বাউরা রাজা হারাইল দিশা[১১৬]২২

১—২২

(১০)

কোন পাহারে জ্বলে মাণিকরে এই মত তেজল[১১৭]
এক মাণিকে চৌদ্দভুবন করিল উজ্জ্বল॥
কোন জনে জ্বালাইল বাতিরে এমন আন্ধাইর ঘরে।
এক ঘরে জ্বালাইলে বাতি সকল উজল করে॥
পূব সায়রে লাইম্যা ভানুরে ভোরের ছান করে।
ঐস্যা রথে উঠ্যা ভানু যাইবাইন[১১৮] নিজ পুরে॥
দুধের বরণ ঘোড়া গোটা আগুণবরণ পাখা।
(আরে) বাতাসের আগে ছুটে ঘোড়া নাই সে যায় দেখা॥
আবের বাড়ী আবের ঘর করে ঝিলিমিলি।

* * * * *

ঐ ঘরে যাইতে ঠাকুর উঠ্যা রইলাইন[১১৯] রথে।
ঊষার সঙ্গে অইব[১২০] মিলন পূব পাহারের পথে[১২১]১১

হেন কালেতে বাউরা রাজাগো কোন কাম করিল
আলু ঝালু[১২২] মাথায় কেশগো দুয়ারে দাঁড়াইল॥১৩
“দুয়ার খোল সুয়া দাসী প্রাণে বাঁচাও মোরে।
রজনী হইল ভোর দেখাও রাণীরে॥”১৫

হাওট[১২৩] পাইয়া রাণী কোন কাম করিল।
দুয়ার খুলিয়া দেখ সাম্‌নে দাঁড়াইল॥১৭
হায় হায় করিয়া রাজাগো ধরে সাপুটিয়া[১২৪]
রাজার কান্দনে গলে পাষাণের হিয়া॥১৯

রাণী


“ছাইড়া দেও প্রাণের পতিগো ছাইড়া দেও আমারে
ওগো ছাইড়া দেও আমারে।
শাপত হইল মোচন[১২৫] যাইবাম দেবপুরে॥”২২

এই কথা বলিয়া রাণীগো শূন্যে গেল উড়ি।
হস্তেতে ছিড়িয়া রইল রাজার অগ্নি পাটের শাড়ী॥২৪
অধরচান্দে কাইন্দা কয় রাজা করিলে কি কাম।
তা না হইলে অইত পুত্ত্রু ইন্দ্রের সমান॥২৬

১—২৬

(সমাপ্ত)

  1. চিন=চিহ্ন।
  2. টাকুয়া=একটা কাঠীতে যতটা সূতা গুটান থাকে।
  3. পরমাণে=প্রমাণ।
  4. শুকোদ্ধার=জল উঠা (শুষ্কোদ্ধার)।
  5. কামুলা = মজুর।
  6. আছলাইন=আছিলেন, ছিলেন।
  7. হীরামণের=হীরামণির।
  8. শীলুয়া বয়ার=ক্রীড়াশীল বাতাস।
  9. কুইল=কোকিল।
  10. এই গানের প্রায় সর্ব্বত্রই ‘নাই’ বা ‘না’ কথাটি কেবল অর্থের উপয় জোর দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে—তাহা আদৌ নিষেধার্থ-জ্ঞাপক নহে। “কত নাই নিদ্রা যাও।” অর্থ “কত ঘুম না ঘুমাইতেছ”=অনেকটা ঘুমাইয়াছ।
  11. কাডাইছি=কাটাইয়াছি।
  12. উবুরায়=(উবু= উচ্চ; রায়=রব) উচ্চৈঃস্বরে।
  13. ডাকুইন=ডাকিতে লাগিলেন।
  14. সেজে = শয্যায়।
  15. একবার=এক একবার।
  16. ভালা=গানের মধ্যে মধ্যে “ভালা” (ভাল) কথাটা সর্ব্বত্র ব্যবহৃত হয়। ইহার কোন অর্থ নাই।
  17. রইয়া=থাকিয়া থাকিয়া।
  18. চাইয়া=চাহিয়া। (রাজার মুখের দিকে চাহিয়া)
  19. গয়িন=গভীর
  20. তলাব=পুকুর, দীঘি।
  21. উচকাইয়া=ছাপাইয়া।
  22. বেজানা=অজ্ঞাত স্থান হইতে, অনির্দিষ্ট ভাবে।
  23. হইরাণ=হয়রাণ। কোন দেবতা আমাকে কষ্ট দিবার জন্য এই দীঘি কাটাইতে আমাকে প্রবৃত্ত করিল।
  24. আরাই=হারাই।
  25. যাইন=গেলেন।
  26. মেচের গামছা=আসামের মেচ জাতীয় শিল্পীর নির্ম্মিত গামছা।
  27. বাড়ী= বাটী পাত্র।
  28. সঞ্চা=ফুলের সাজি।
  29. কালী হাঞ্চী=পূর্ব্ব বঙ্গে এখনও ‘কালা আঞ্জি’ কথা প্রচলিত আছে। অঞ্জনের ন্যায় কালো।
  30. জুইরা=জুড়িয়া। আকাশ ব্যাপিয়া সোনার চাঁপাফুল (নক্ষত্রগুলি) ফুটিয়া আছে।
  31. সোমাই=সোমেশ্বরী নদী।
  32. গেলাইন=গেলেন।
  33. নিশির ভোরে=রাত্রির শেষ যামে।
  34. ঘুরে=ঘোরে।
  35. নামলাইন=নামিলেন।
  36. ভারা সারা=শেষ, সমাধা।
  37. পিনলাইন=পিন্ধন করিলেন, পরিলেন
  38. অইও=হইও।
  39. তোমরারে=তোমাদিগকে
  40. রক্ষা...অগতি=সবাইকে অগতি (দুর্গতি) হইতে রক্ষা কর।
  41. পূজা সন্ধি=পূজা-সন্ধ্যা।
  42. বাড়ীর মেলা দিল=বাড়ীর দিকে রওনা হইল।
  43. বিয়ান=প্রভাত
  44. অঝ্‌ঝর=অজস্র অশ্রুপূর্ণ।
  45. রা=শব্দ।
  46. ছক্তিশেল=শক্তিশেল।
  47. আগ=হ্যাগো।
  48. ঐ না মা মা বুলি=সেই মা মা বুলি তাকে শিখাইও, ‘না’ শব্দ নিরর্থক।
  49. কান্‌ব=কান্দিবে।
  50. পরবোধ=প্রবোধ।
  51. তোমরারে=তোমাদেরে।
  52. পরাণে—ভেদ=প্রাণ যেন দ্বিধা বিভক্ত হইল।
  53. কুলে=কোলে।
  54. জারে জারে=কাঁদিয়া বিহ্বল হইল।
  55. কাঙ্কে=কক্ষে।
  56. গিষ্ঠাতে=গিঠে, আঁচলের কোণে।
  57. কাগায়=কাকে।
  58. বাউরা=বাউল, পাগল। (‘বাতুল’ হইতে)
  59. এই গয়িনে......রাণী=এই গভীর পুকুরে রাণী যেন নামিতে না যান।
  60. পাকে পাকে=ক্রমে ক্রমে।
  61. উড়াইয়া=উঁচু করিয়া।
  62. পারে মাইল লাড়া=রাণীর কেশরাশি ডুবাইয়া ফেলিয়া জল পারের দিকে ছুটিল।
  63. জডা=জটা।
  64. আথাল পাথাল খাইয়া=উচ্ছৃঙ্খল ভাবে।
  65. গেলাইন=গেলেন।
  66. পাউখ=পাখী।
  67. আত্তিঘোড়া=হাতীঘোড়া।
  68. রাখুয়ালী=রাখাল; এখানে সহিশ্ ও মাহুত।
  69. বনেলারা=বন্যজন্তুরা।
  70. গিরে=গৃহে। কৈতরা=পায়রা, কবুতর।
  71. কানাছে=কোণে।
  72. মায়ত......থৈয়া=কোলের ছেলে ফেলিয়া রাখিয়া মায়েরা অজস্র অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন।
  73. আছিলাইন=ছিলেন।
  74. সুতে=স্রোতে।
  75. শূন্যের=আকাশের।
  76. পিন্‌রা=পিঞ্জর।
  77. আড়াইয়া=হারাইয়া
  78. নৈরাকার=অন্ধকার।
  79. বুডা=বোটা।
  80. মূল.......তার=তার কোন মূল্য নাই।
  81. কান্দুইন=কান্দিতে লাগিলেন।
  82. না পিয়ুন জল=জল পান করেন না।
  83. পাযাণ......পানি=প্রস্তর গলিয়া জল হয়।
  84. কার লাগিল......ঘর। অবিকল এই ছত্রটি ময়নামতীর গানে পাওয়া গিয়াছে। লাগিল=লাগিয়া, জন্য।
  85. জলটুঙ্গি=পুষ্করণীর মধ্যে উত্থিত আরামগৃহ।
  86. সেওত=জল সেঁচিবার একরকম পাত্র।
  87. হিচ্যা=সেঁচিয়া।
  88. পাঁচ কাউন, কাহন ১২৮০, সুতরাং পাঁচ কাহন মজুর অর্থাৎ=৬৪০০
    লোক।
  89. কমে......পরমাণি=চুলপ্রমাণ জলও কমিল না।
  90. নদীয়ে····আটে=সেই পুকুর (কমলাসায়র) হইতে সেঁচা জল নদী ও নালায় পড়িয়া উপ্‌চিয়া নদীর চর ডুবাইয়া ফেলিল
  91. আচরিত=আশ্চর্য্য।
  92. চিত্তির......ঘুম=নিত্য চিত্তের সুখ থাকিলে যে গভীর নিদ্রা হয়, তাহা বড় সুখের।
  93. দুন=দ্বিগুণ।
  94. থইয়া=থুইয়া, ফেলিয়া
  95. লাগিয়া=প্রতীক্ষা করিয়া।
  96. তিত ফড়িঙ্গ=ক্ষুদ্র পতঙ্গটিও যেন।
  97. আলা নহে ঢিলা নহে=হালেও নাই ঢলেও নাই, যেমন ছিল তেমন।
  98. উবহু=হুবহু, অবিকল।
  99. কইলে করে রা=সেইরূপ মধুর কথা, যেন কোকিল ডাকিতেছে
  100. ঘুমতনে=ঘুম থেকে।
  101. একেত বাউরা......পাগল=একেই
    ত’রাজা আধ ক্ষেপা (বাউরা) হইয়াছিলেন, এবার সম্পূর্ণ পাগল হইলেন
  102. লাগল=তাহার ‘লাগল’ (সাক্ষাৎ) পাওয়া গেল না।
  103. সবাস্থরে=সভাস্থলে।
  104. গির=গৃহ।
  105. উলুয়া ছনের ছানী=উলুখড়ের ছাউনী।
  106. নিরুইদ্যা=রৌদ্রপ্রবেশের রন্ধ্র হীন, নিরুদ্ধ।
  107. আড়ের পালং=(হাতীর) হাড়ের নির্ম্মিত পালঙ্ক।
  108. বরণ=আবরণ, আচ্ছাদন।
  109. দিলাইন=দিলেন।
  110. মৈলান=মলিন, ম্লান।
  111. সমজায়=জিজ্ঞাসা করে।
  112. তন=স্তন।
  113. উড়ে=বক্ষে; উরঃস্থলে।
  114. পোশাই..তারে=রাত্রি পোহাইয়া গেলে আর তাঁহাকে দেখিতে পাই না।
  115. মাইঝাল=মধ্য।
  116. হারাইল দিশা=দিশা হারা হইল।
  117. তেজল=তেজোবিশিষ্ট।
  118. যাইবাইন =যাইবেন।
  119. রইলাইন = রহিলেন।
  120. অইব=হইবে।
  121. মেরু পাহাড়ের উপর যে আলো জ্বলিয়া উঠে, এমন উজ্জল মাণিক আর কোথায় পাওয়া যাইবে। সে মাণিকের আলোতে চৌদ্দভুবন উজ্জ্বল হয়। এমন প্রদীপ কে দেখিয়াছে! এক ঘরে প্রদীপ জ্বালাইলে জগতের সমস্ত ঘর আলোকিত হয়। এই বিশ্ব-আলোকারী উজ্জ্বল মাণিক, এই চৌদ্দ ব্রহ্মাণ্ডের আঁধারনাশী প্রদীপবৎ ভানুদেব পূব সাগরে স্নান করিয়া উঠিলেন, সম্মুখে তাঁহার রথ—তাহার অশ্বগুলি তুষারশুভ্র, কিন্তু পাখাগুলি অগ্নির ন্যায় উজ্জ্বল। পূর্ব্ব সাগরে অবগাহনান্তে সূর্য্যদেব উষার সঙ্গে মিলিত হইবার জন্য পূর্ব্ব পাহাড়ের পথে এই রথে চাপিলেন। এই উষার বর্ণনায় ঋগ্বেদের উষার কথা মনে পড়িবে।
  122. আলু ঝালু=এলোমেলো।
  123. হাওট=পদশব্দ। কেহ আসিতেছে বা আসিয়াছে, এইরূপ সঙ্কেতকে ‘আওট’ বা ‘হাওট’ বলা হয়।
  124. সাপুটিয়া=আড়াইয়া।
  125. শাপত....মোচন=আমার শাপ মোচন হইয়াছে।