পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/মানিকতারা বা ডাকাইতের পালা
৭। মাণিকতারা। (২৩১—২৭৪পৃঃ)
মাণিকতারা বা ডাকাতের পালা আমাদের অন্যতম গীতিকা-সংগ্রাহক বিহারী লাল রায় মহাশয় মৈমনসিংহ হইতে সংগ্রহ করিয়া গত বৎসর ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখে আমাকে পাঠান। বিহারীবাবু আমাকে লেখেন যে পালাটি তিন খণ্ডে সমাপ্ত; কিন্তু তিনি বহুকষ্টে ইহার প্রথম খণ্ডটি মাত্র সংগ্রহ করিতে পারিয়াছেন। গায়েনেরা দূরবর্ত্তী ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বাস করে বলিয়া পালার অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ বহু শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। বিহারী বাবু ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখে আমাকে এই কথা লিখিয়া ২৫শে তারিখে হঠাৎ হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া রহিত হওয়ায় মৃত্যুমুখে পতিত হন। বিহারীবাবু অনেক পূর্ব্ব হইতেই জ্বরে ভুগিতেছিলেন; জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গাথা সংগ্রহের কার্য্য করিয়া গিয়াছেন। পালার বাকী অংশ আদৌ সংগ্রহ হইবে কিনা, বলিতে পারি না। বিহারী বাবু কোন্ কোন্ স্থান হইতে পালাটি সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহা আমাকে জানাইবার সুবিধা পান নাই! আমি অবশ্য অপ্রাপ্ত অংশের উদ্ধারের আশা একেবারেই ছাড়িয়া দেই নাই।
পালাটি বেশী দিনকার পুরাণা বলিয়া মনে হয় না। ইহাতে খাঁটি গ্রাম্য ও প্রাদেশিক শব্দের প্রাচুর্য্য এবং বিশুদ্ধ শব্দের অভাব থাকিলেও ইহার পয়ার ছন্দ অপেক্ষাকৃত দোষবর্জ্জিত ও আধুনিক, এবং ইহাতে সর্ব্বত্র চতুর্দ্দশ অক্ষরের নিয়ম পালিত না হইলেও, পয়ারের বিরাম ও যতি সম্বন্ধে নিয়মাবলী অনেক পরিমাণে রক্ষিত হইয়াছে। এই সকল কারণ মনে হয়, সংস্কৃতের কিছু প্রভাব এই কৃষক কবিদের গানের উপর অলক্ষিত ভাবে আসিয়া পড়িয়াছে। কিন্তু ইহা যে ইংরেজাগমনের পূর্ব্বে রচিত হইয়াছে, তাহার কোনও সন্দেহ নাই। পালায় বর্ণিত আছে যে বিনিময় প্রথার সাহায্যে, প্রধানতঃ কড়ির বদল দিয়া, বাণিজ্যের আদান প্রদান চলিত। প্রথম সর্গে ৩৭-৪৩ ছত্রে উল্লেখ আছে যে নদী পার হওয়ার পারিশ্রমিক বাবদ মাঝিরা কখন কখনও ১২০০০ কড়ি পর্য্যন্ত যাত্রীদিগের নিকট হইতে আদায় করিত। যদি সাধারণতঃ কোন রূপ মুদ্রার প্রচলন থাকিত, তবে এতগুলি কড়ির ব্যবহার কখনই হইতে পারিত না। নদীপথসমূহ দস্যুতস্করের ভয়ে অত্যন্ত বিপজ্জনক ছিল। এই সমস্ত দস্যুভীতি ও অরাজকতার বর্ণনা ও আনুষঙ্গিক বিবরণ হইতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই পালা ইংরেজাধিকারের কিছু পূর্ব্বে অর্থাৎ মুসলমানাধিকারের অবনতির দিনে রচিত হইয়াছিল; গানটির রচনাকাল সম্ভবতঃ অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ।
স্ত্রীলোকেরা তীর চালনায়, এমন কি মল্লবিদ্যা ও অন্যান্য পুরুষোচিত ব্যায়ামক্রীড়ায় দক্ষতালাভ করিত, পালাগানটিতে ইহার পরিচয় পাওয়া যাইতেছে। সম্ভবতঃ কাব্য রচনা কালে হিন্দু সমাজে এই প্রথা নিম্ন-শ্রেণীর মধ্যে প্রচলিত ছিল। শুধু এই পালায় নহে, ফিরোজ খাঁর পালাতেও আমরা পাইয়াছি যে ১৭শ শতাব্দীতে কেল্লাতাজপুরক্ষেত্রে সখিনা সম্রাট্-বাহিনীর সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন। নৌকার সহিত গুপ্তভাবে কাছি বাঁধিয়া ডাকাতেরা কিরূপে মাঝগাঙ্গে যাত্রীদিগকে নিহত করিয়া ধনরত্ন অপহরণ করিয়া অদৃশ্য হইত, এবং লুণ্ঠিত দ্রব্য কিরূপে ভূগর্ভে প্রোথিত করিয়া সন্দেহের কারণ পর্য্যন্ত অপনোদন করিত, সেই সকল বর্ণনা যেন মুসলমান রাজত্বের শেষ অধ্যায়ের উপর পটোত্তোলন করিয়া দেখাইতেছে, এই বর্ণনাগুলি বাস্তব হইলেও কাব্যরাগরঞ্জিত এবং কৌতুকাবহ।
আমির ও জামাইৎউল্লা নামক দুই ব্যক্তি ভণিতায় পালারচয়িতা বলিয়া একাধিকবার নিজেদের উল্লেখ করিয়াছেন। পালার অধিকাংশই জামাইতের রচনা; কিন্তু আমির রচনাভঙ্গীতে জামাইৎউল্লার এমন সুন্দর অনুকরণ করিয়াছে যে উভয়ের রচনা পৃথক করা কষ্টকর। গায়েনেরা অনেকসময় কবিত্বের দাবী ফাঁদিয়া ভণিতায় নিজেদের নাম ঢুকাইয়া দিতেন; এই ভাবে আমিরের নাম ভণিতায় প্রবেশ লাভ করিয়া থাকিতে পারে। তাহা হইয়া থাকিলে আমির একজন পালাগায়ক মাত্র।
কবিত্বের দিক্ দিয়া পালাটির খুব উচ্চদর দিতে না পারিলেও, ইহা কোন কোন গুণে যে খুব চিত্তাকর্ষক হইয়াছে তাহার সন্দেহ নাই। পারিবারিক ও সমাজিক ঘটনাসমূহের অবিকল ও কৌতূহলপ্রদবর্ণনা পালাটির প্রধান বৈশিষ্ট্য। আখ্যায়িকার কোন কোন অংশ সুদীর্ঘ হইলেও আগাগোড়া এমন একটা কৌতুকের ধারা প্রবাহিত হইয়াছে যে ভাষার দুরূহতা সত্ত্বেও পাঠকের মনে শ্রান্তি বা বিরক্তির সঞ্চার হয় না। ব্যঙ্গরসের অবতারণায় কবির হাত বেশ পটু; তিনকড়ি কবিরাজ প্রদত্ত লাল, নীল ও সাদা তিনটি বড়ি ও তাহা সেবনের অমোঘফলস্বরূপ বাসুর মাতার মৃত্যু ইত্যাদি বর্ণনায় তৎকালের চিকিৎসক-সম্প্রদায়ের উপর কটাক্ষপাত কর হইয়াছে। মুসলমানী আমলের বঙ্গসাহিত্যে অনেক সময়ই চিকিৎসকদিগের প্রতি ব্যঙ্গোক্তি বর্ষিত হইতে দেখা যায়। ষোড়শশতাব্দীর শেষভাগে রচিত চৈতন্যভাগবতে কথিত আছে চৈতন্যদেব মুরারি গুপ্তের গুণগ্রাহী হইয়াও তাঁহার ব্যবসায় লইয়া উপহাস করিতেন। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামও বৈদ্যদিগের যে চিত্র দিয়াছেন তাহাও ক্রুর ব্যঙ্গময়। কবিকঙ্কণের সমকালবর্ত্তী প্রসিদ্ধ ইংরেজ গ্রন্থকার বেকন চিকিৎসকদিগের সম্বন্ধে লিখিয়াছেন যে, মাঝিরা যেরূপ শিষ্ দিয়া মনে করে সেই শিষের জোরে হাওয়া আসিবে, ডাক্তারেরা সেইরূপ ঔষধ দিয়া পুরাতন ব্যারাম ভাল করিতে পারেন বলিয়া বিশ্বাস করেন। প্রাচীন যুগে লোকে সাধারণতঃ স্বাস্থ্যবান থাকিত এবং চিকিৎসকগণের ঔষধ অপেক্ষা স্বাস্থ্যপালনের নিয়মাবলীর প্রতি অধিকতর আস্থা প্রদর্শন করিত, ইহাই সেই সময়ের চিকিৎসাব্যবসায়ের প্রতি উপেক্ষাশীল হওয়ার কারণ বলিয়া মনে হয়। কবিরাজেরা তখন মিঠা বিষ প্রয়োগ করিয়া আপাততঃ রোগীকে রক্ষা করিয়া দর্শণী ও পারিতোষিকাদি লইয়া প্রস্থান করিতেন; পরে রোগীর মৃত্যু হইলেও চিকিৎসকের অপযশ হইত না; যেহেতু বিষ-প্রয়োগের ফলে জ্বর ছাড়িয়া যাইত। মৃতব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন অদৃষ্টের দোহাই দিয়া প্রবোধ মানিতেন।
কবি জামাইৎউল্লা কখন কখনও হিন্দুদিগের প্রচলিত বিশ্বাস ও প্রথাসমূহের প্রতি বিদ্রূপ করিয়াছেন; ৬ষ্ঠ খণ্ডে ২৪-৩০ ছত্রে কবি কন্যা-জামাতার বিদায়কালীন একটি স্ত্রী-আচারের প্রতি কটাক্ষ করিয়াছেন।
পঞ্চম খণ্ডে ২৬-১০৮ ছত্রে যে পূর্ব্বরাগের বর্ণনা আছে, তাহাতে কবি কোথায়ও অসংযত ভাব প্রকাশ অথবা নারীচরিত্রের স্বাভাবিক মাধুর্য্য ও বিশুদ্ধতার হানি করেন নাই; অথচ বর্ণনাটি কবিত্বপূর্ণ ও মনোরম হইয়াছে। পালার বর্ণিত বাসু, কানু প্রভৃতি চরিত্রগুলি দস্যুতা ও যথেচ্ছাচার দোষে দুষ্ট হইলেও পুরুষোচিত সাহস ও শৌর্য্যবীর্য্যে উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। মাণিকতারার চিত্র শেষের দিকে যে ভাবে কবি আঁকিয়াছেন, তাহাতে মনে হয় বুদ্ধিপ্রখরতা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে এই নারী কাব্যের শেষাংশে বিশেষরূপ প্রতিভাময়ী হইয়া উঠিয়াছিলেন। তাঁহার ন্যায়পরতা ও ধর্ম্মজ্ঞান সম্বন্ধে সংশয় থাকিলেও তাঁহার অদ্ভুত প্রতিভায় কাহারও অবিশ্বাস হইবে না। পালাটি অনেক স্থলে মাণিকতারার নামে প্রচলিত থাকায় মনে হয়, মাণিকতারাই এই পালার মুখ্য চরিত্র। শেষের দিকেই এই চিত্র বিশেষরূপ ফুটিয়াছিল বলিয়া বোধ হয়, কিন্তু আমরা তাহা পাই নাই।
ডাকাতি এবং অত্যাচার উৎপীড়নের বিবরণে পালা পাঠ করিবার সময় সাময়িক বিতৃষ্ণা জন্মিলেও বাসুর মাতার চরিত্রে সেই দোষ কতকটা অপনোদিত হইয়াছে। বাসু হৃতসর্ব্বস্বা বিধবার ‘সবে ধন নীলমণি’ হইলেও তিনি যখন শুনিলেন যে পুত্ত্র বাসু ব্রহ্মহত্যা করিয়া ধনরত্ন আহরণ করিয়াছে, তখন তিনি তাঁহার সেই একমাত্র পুত্ত্রের মৃত্যুকামনা করিয়াছিলেন। পুত্ত্রের এই দুষ্কৃতির জন্য নিদারুণ মনোব্যথা পাইয়াই তিনি প্রাণ-ত্যাগ করেন।
পালাটি ৮৩২ ছত্রে সমাপ্ত; আমি ইহাকে দশটি সর্গে বিভক্ত করিয়াছি।
মাণিকতারা বা ডাকাতের পালা
(১)
মাও গুরু বাপ গুরু আর গুরু ওস্তাদ জোন[১]।
তা হতে অধিক গুরু দেব নিরঞ্জন॥
সেই নিরঞ্জনের পায় পরথমে[২] বন্দম[৩]।
মেহেরবণী কর আল্লা মই[৪] বড় অধম॥৪
তার পরে বন্দম আমি পীর পেগম্বর
মস্তক পাতিয়া বন্দম এই সোণার আসর॥
হস্ত তুইলা সেলাম করি যত মমিন[৫] গোণ।
বয়স গেছে বাইড়া আমার বুদ্ধি আছে কোম॥
ক্ষেমা দিবাইন গুণাগারী[৬] আমার গাহানে[৭] নাইঙ্কা[৮] রস।
আল্লার কুদ্রতে[৯] পাই যে দশো জনার[১০] যশ॥১০
ইদেশের[১১] উত্তর মাথালে[১২] আছে নদী বরাবর।
নদী নয়রে সাত সমুদ্দুর দেখতে ভয়ঙ্কর॥
দেশের নোকে ডাকে তারে বরমপুত্তুর[১৩] কয়।
আওয়াজ করে বরমদৈত্য পানির তলে রয়॥
ধুয়া—
হায়রে গাঙ্গের কি বাহার।
হায়রে গাঙ্গের কি বাহার।
ও তার ইপার আছে ওপার নাইঙ্কা[১৪] চোক্কে মালুম
দেয় না কার[১৫]।
ও তার পাণির তলে পাক পইরাছে দেখ্তে নাগে চমৎকার॥১৪
বাও চালাইলে তুফান ছোটে নাও ছাড়ে না কণ্ণধার।
চালি[১৬] সোমান গড়ান ভাঙ্গে ফ্যানা ওঠে মুখে তার॥
(কত) শিশু[১৭] ঘইরাল[১৮] বাসা ছাড়ে চক্কে দ্যাহে অন্দিকার।
গাছ বিরিক্ষি চুবন খাইয়া[১৯] ভাইসা যায়রে পুব পাহাড়॥১৮
হায়রে গাঙ্গের কি বাহার।
হায়রে গাঙ্গের কি বাহার॥
এহিতো তেলেছ মাত[২০] নদী যহন[২১] পায় না বাতাস বাও।
মাটীর মোতন পইড়া থাকে মুখে নাইরে রাও॥২০
বাও নাই বাতাস নাই, নাই নদীর ডাক।
ত্যাল ত্যালাইয়া যায়[২২] দরিয়া পাক্ ফালায় বাক্[২৩]॥
ডিঙ্গা পান্সী ছাইড়া দিয়া নাইয়া লোকে দেয় পাড়ী।
ব্যাহুস[২৪] নোক যে ডুইবা মরে প্যাকের তিন ঢেউএর খায়্যা বাড়ী॥২৪
ভাতের থালি যেমুন ভাইরে সোমান থাকে তলি।
এন্নি মোতন থাকে নদী বাও বাতাস না পাইলি[২৫]॥
এহিতো দরিয়ার পারে গো আছে গোঞ্জের ঘাট।
সাতো দিনের মধ্যে বইসে তিন দিন গোঞ্জের হাট॥২৮
গোঞ্জের হাটে বেচা কিনি মোনের মোত হয়।
এহি জাগাতে খেওয়া পড়ে[২৬] মানুষ জড় হয়॥
হাটের জিনিষ কিনা মাইন্সে রুশাই[২৭] কইরা খায়।
ঘরে থাইকা ভারা দিয়া রাইত পোষাইলে[২৮] যায়॥৩২
শতে শতে খেওয়া ডিঙ্গিগো আরও জাইলা মান্দাইর[২৯] নাও।
মানুষ নইয়া পাড়ি দেয়রে ভুইলা বাপ আর মাও॥
বিষ্টিবাতাস বাও মানে না তুফান মাইরা চলে।
নছিব[৩০] মোন্দ হইলে ভাইরে তলায়[৩১] পানির তলে॥৩৬
খেওয়া নাওয়ের দেয় আজুরা[৩২] কড়ির পাহাড় গুইণা[৩৩]।
হিসাব কইরা দিমু আমি তাক্ নাগ্বাইন্[৩৪] শুইনা॥
চাইর কুড়ি কড়ি গুইণা নইলে হয়রে পোণ।
ষোল পোণ কড়ি হইলে হয়রে ভাই কাহোন॥৪০
দশো কাহোণ কড়ি দিয়া গুদারায় হয়রে পার।
কেউবান[৩৫] মরে কেউবান বাঁচে দিশা নাই যে তার॥
বরমপুত্তর পাড়ি দিয়া দশ কাহোণ দিচে কড়ি।
মাটী পাইয়া নোকে কইতো আল্লা রসুল হরি[৩৬]॥৪৪
দশ কাহণে পারের নাগুল পাইয়া সেরপুর গিরাম[৩৭]।
সেই জন্যে হইয়াছে ভাইরে “দশকাউণা” নাম॥
এহি নদী না পাড়ি দিতে মরত কত জোন।
হাতের টেহা জহর পাতি খাইতো চোরাগোণ॥৪৮
কেউবান ভালা কেউবান মোন্দ থাক্তো নায়ের মাঝি।
দিন দুপুরে মারত ছুরি হায়রে এমুন পাজি॥
নুইটা[৩৮] নিত কাইড়া ছিড়া জহরপাতি যত।
ঐরাণ[৩৯] জোঙ্গলে নিয়া নেঙ্টা ছাইড়া দিত॥৫২
কেউবান মাথায় কুড়াল মারে কেউবান কাটে গলা।
হস্তপদ বন্দন কইরা দেয়রে পানির তলা॥
খুইলা নিতো জেহারপাতি ওয়া অঙ্গে পইরাছে।
ঝাপি টোপ্লা খুইলা নিতো, দিতো ওস্তাদের হাতে॥৫৬
(২)
গোঞ্জের ঘাটে থাইকতো বিশু নাই[৪০]।
ঘরে আছে নাপতানী আর জোন পাঁচেক পোনাই[৪১]॥
হাতে নাইরে খাবার কড়ি ঘরে নাইরে ছোন[৪২]।
বেড়ায় দিবার নাইরে তার জোঙ্গলা আড়া বোন॥৪
গিন্নি পোনাই নইয়া বিশু ভিক্ষা মাইঙ্গা খায়।
দিন খাটুনি খাটে তেমু ব্যবসায় না কুলায়॥৬
পাঁচ ছাওয়ালের বড় ছাইলা বাসু হইল নাম।
বয়েস বার বচ্ছর হইল কিছুই শেখে নাই কাম ৷
তার ছোট কুশাই মৈল নদীর জলে পইড়া।
তার ছোট যে দাসুক খাইল ঘাটের কুমীরে ধইরা॥১০
আর একটা পৈড়া মৈল ভাইঙ্গা বিরিক্ষির[৪৩] ডাল।
ছোটকা মৈল বেরাম ভুইগা ফুরাইল জঞ্জাল॥
বিশু কাইন্দা অন্ধ হয় বিদিক[৪৪] ডাইকা কয়,
এহিতো লেইখাচে দারুণ বিধিরে।১৪
না দিলারে কড়া কড়ি, না খাইয়া পরাণে মরি,
এহি দুঃখে দিব গলায় দড়ি॥
হাতে দিলা চন্দ্র গুইণা পঞ্চমুখে কতা শুইনা,[৪৫]
যাইতো মোনের জ্বালারে।১৮
ক্যারমে ক্যারমে[৪৬] সব খাইলা একবাতি ঘরে থুইলা,
না জানি কি দুঃখু দিবারে॥২০
এক বাসু পেটী তেল কাইত অইলেই সব গেল[৪৭],
মাও বাপের অন্দলের নড়িরে[৪৮]।
দয়া করি যুদি দিলা আবার ক্যানে হইরা নিলা,
না দেখিলা বুড়া বুড়ীরে॥২৪
আর না ফিরিমু ঘরে ই পরাণ দিমু তরে,
মোনের জ্বালায় জলে দিমু ঝাপরে।
দুঃখে আমার অঙ্গ জ্বলে শীতল না হইব মইলে,
নিয়া যাও পরাণ হইরারে॥২৮
কান্দিতে লাগিল বিশু চাপের[৪৯] উপর বৈসা।
জলের টানে অম্নি চাপ নদীতে পৈল খৈসা॥
ডুইবা মৈল বিশু নাই দেখ্ল না আর কেউ।
বাসুর মাও তার মাথা দেখ্ল দেখল নদীর ঢেউ[৫০]॥৩২
পতির মরণ দেইখা কান্দে বাসুর মাও।
চরণের দাসী থুইয়া কোথায় চইলা যাও॥
দুঃখু জ্বালা সইয়া থাকি সোয়ামী পুত্ত্রু নইয়া।
আমার সেও সুখে যে হইরা নিল বিধি বাদী হইয়া॥৩৬
একা ঘরে বাসুক নইয়া[৫১] ক্যামনে আমি থাকি।
দুষ্কের জ্বালায় পুইড়া মরি পরাণ ক্যামনে রাখি॥
মোনে বলে জুড়াই জ্বালা বুকে দেইরে ছুরি।
ঐরাণ জোঙ্গলে যাইয়। গলায় দিমু দড়ি॥৪০
আর না হইলে আমি জলে ঝাপ দিব।
শীতল জলেতে আমি ডুইবা মরিব॥”
এহি কতা না বলিয়া নারী মরিবার যায়।
পাছে থনে[৫২] ‘মা’ ‘মা’ বুইলা বাসু ডাকে মায়॥৪৪
ফিরা চাইয়া বাসুর মাও দেখল সোণার মুখ।
সোন্তানের মোমতা আইসা ছাইয়া নিল বুক[৫৩]॥
ভুইলা গেল পতির কতা আর পেটের জ্বালা।
আমির[৫৪] কয় আর মইরবা ক্যানে চক্ষু মুইছা ফালা॥৪৮
বাসুক নইয়া বাসুর মাও মাইঙ্গা দিবে পাড়া।
কেউবান কিছু দেয় খাইতে দয়াল আছে যারা॥
এক বাসুক নইয়া নারী কুইড়া ঘর না ছাড়ে।
পংখী যেমুন পাংখার তলে বাচ্ছা পহর পাড়ে[৫৫]॥ ৫২
(৩)
বাড়ীর কাছে জাইলাপাড়া আর আছে কোচার।
ইষ্টিকুটুম সরিক সরাত কেউ নাইঙ্কা তার॥
ভাই বেরাদার বাপ মইরাছে মাথা গোঞ্জার নাই যে ঠাঁই।
বাসুর মাও মোনে ভাবে কোথায় চইলে যাই॥৪
অনাথ হইলে জগদিষ্ট[৫৬] ইষ্ট করে যে তার।
কুচ্নী পাড়ার কানাইর মা যে নইল[৫৭] তাহার ভার॥
কানুর মাও সই পাতাইল বাসুর মায়ের সাতে।
বাসুর মাও তার দয়া দেইখ্যা সগ্গ পাইল হাতে॥৮
কানুর বয়েস বাসুর বয়েস এক রহমই[৫৮] হয়।
বছর তিনেক বড় কানু বেশী বড় নয়॥
বিশ বছরের হইল কানু মোছের দিল রেখা।
কানুর বশে চলে বাসু যে পথ দেখে বেকা[৫৯]॥১২
মায় কইরাছে নিষদ[৬০] কত বাসু মানে না।
পেটের জ্বালায় কানুর মায় রে কবার পারে না।
কানুর মাও যে দয়াল্ ভারী বাসুর মাও তার জান।
নিত্তি দিত খাওয়ার কিছু এম্নি সইয়ের টান॥১৬
গামছাত বাইন্দা চাইল ডাইল নিত আর পুটি ত্যাল।
বাগুন মরিচ ফল ফলান্তি আর বেন্দুর গোটা ব্যাল।
ঘরের পাছে মইষের বাথান দুগ্ধ যে পানায়[৬১]।
চুঙ্গা[৬২] ভইরা নইয়া কানুর মা সইয়ের বাড়ী যায়॥২০
বাসুর মাও বৈসা খায়না গতর খাটাইয়া খায়।
মানের গোড়ায় ছাই ঢাইলাছে লজ্জা নাই যে তায়॥
জাইলা-গোরে সুতা কাটে ঢেকিত বানে বারা[৬৩]।
দুইডা চাইড্ডা মচ্ছ আনে আর আনে ক্ষুদ কুড়া॥২৪
দিন কাটায় বাসুর মাও আর ভাবে মোনে মোনে।
কবে কানু ডাঙ্গর হব সেই কতাডি[৬৪] গোণে॥
জাইত ব্যবসা করব বাসু যাব মোনের দুখ।
পেটের জ্বালা যাব দূরে দেখমু সুখের মুখ॥২৮
বিশ বচ্ছইরা জুয়ান হইয়া বাসু অইল ওরা[৬৫]।
পাড়ায় পাড়ায় ঝোপ জঙ্গলে নাফায়[৬৬] জানি ঘোড়া॥৩০
সাকরিদ[৬৭] হইল বাসু নাই[৬৮] ওস্তাদ কানু কোচ।
মানুষ গরু কেউ মানেনা ফুলাইয়া ফিরে মোছ্[৬৯]॥
বাসুর ঘরের পাছে আছে বট বিরিক্ষি গাছ।
দেও বিরিক্ষি[৭০] বুইলা কেউ যায় না তার কাছ॥৩৪
নিশা রাইতে বাসুর মাও শুইয়া নিদ্রা যায়।
ঘুমের চোখে আচম্বিতে শুনিতে যে পায়॥
“ওঠ ওঠ বাসুর মাওগো আছমানের দিরি[৭১] চাও।
হাইরা কোণায়[৭২] সাইজাছে দেওয়া আইল তুফান বাও॥৩৮
ঘরে দিচ প্যালা গুইঞ্জা[৭৩] বেড়াত দিচ তার পাতা।
এক সাপটে উড়ায়া নিব কোনে থোবা মাথা॥”
নাপিতানী শুনিয়া কতা পাইল মোনে ভয়।
বাসুক[৭৪] জড়াইয়া ধইরা সাহস কইরা কয়॥৪২
“ঘরের পাছে বইসা ডাক এই না নিশার কালে।
বাও বাতাসে উড়ায়া নিবো আমার নছিব মোন্দ অইলে॥৪৪
আহারে দারুণ বিধি আমার কপাল পুইরাছে।
কোলের ছাইলা গাঙ্গে নিয়া হাড় চাবাইয়া খাইচে॥
ভাঙ্গা ঘরে থাকি আমি ভাঙ্গা নছিব নইয়া।
দুঃখু দেইখা তাম্সা কর আমার বাড়ীতে বইয়া[৭৫]॥”৪৮
“গোসা কইল্লা নাপিত মাসী আমি হইলাম যে ছাইলা।
বাসু আমাক ডাকে যে মাসী কানু দাদা বুইলা॥
আমার মাও যে সই পাতাইল তুমি হইলা মাও।
ছাইলার সঙ্গে গোসা কইরা ক্যামনে কইল্লা রাও॥৫২
নিশাকালে কাম পইড়াছে বাসুক নইয়া যামু।
খাওয়ার দিব্য[৭৬] পাইয়াছি মাসী দুই ভাইয়ে বইয়া খামু॥
উইড়া গেল কাইলা দেওয়া[৭৭] পাইয়াছে আল্গা বাও।
হাইরা তুফান উইরা গেল বাসুক জাগাইয়া দেও॥”৫৬
নাপতানী চিনিয়া তহন ভাবে মোনে মোনে।
সইয়ের বেটা কানু অইচে দুঃখু দিলাম মোনে॥
নিজের কথা ফিরাইয়া নিয়া বিনয় কইরা কয়।
“তুমি যে আইসাছ কানু আমার জানা নয়॥৬০
এত রাইতে আইচরে কানু আমার কাণে মালুম নাই[৭৮]।
ঘুমের আলিস্যি চোক্কে নাগ্চে মুখে আইল ছাই[৭৯]॥
ক্ষেমা দিবা কানু বাবা গোসা কইরবানা।
আমার বুকের বাসুক নিশাকালে যাইবার দিমুনা॥৬৪
এক বাসুক যে কইলজা আমার অন্দলের নাটী[৮০]।
ঐ সোণার চান্ বদন দেইখা পথে পথে হাটি॥
রাইতে পোষাইলে নইয়া যাবা রাইখ দিনের বেলা।
রাইতে আমি বাসুক নইয়া জুড়াই মোনের জ্বালা॥”৬৮
চেতন পাইয়া বাসু কৈল শুন ওহে মাও।
নিশাকালে কারবান[৮১] সাতে কর তুমি রাও॥
বাসুর মাও কৈল বাপু কানু আইসাছে।
দেও বিরিক্ষির তলে কানু বইসা রইয়াছে॥৭২
লম্ফ দিয়া উঠ্ল বাসু মায়ের হস্ত ঠেইলা।
ঘরের থোনে[৮২] বাহির হৈল ঘরের কেওয়ার[৮৩] খুইলা॥
নোড়ায়া[৮৪] যায়া কানু দাদার জড়ায়া ধল্ল গলা।
এত রাতে কি কামে দাদা আমার বাড়ী আইলা॥৭৬
কানু বলে “তোমাক আমি নিবার আইচিলাম।
তোমার মাও যে ছাইড়া দেয়না মস্কিলে পইলাম॥”
বাসু কৈল “ভাইব না দাদা তোমার সাতে যামু।
খাওয়ার যা পাইয়াছ তুমি তোমার সাতে খামু॥”৮০
মায়রে কৈল[৮৫] “উইঠা মাগো ঘরের কেওয়ার মার[৮৬]।
ভাইয়ের সাথে ভাই চইলাছে চিন্তা ক্যান মা কর॥
কালুর সাথে বাসু গেল মাও রইল তার ঘরে।
এক মরে পোলার জ্বালায় আর যে মরে ডরে॥৮৪
মোনে মোনে পাইয়া ভয় বাসুর মাও যে কাইন্দা কয়
দুষ্মণ হৈয়া ক্যানে ঘরে আইচিলি।
একমুখ দেইখা থাকি বুকে তরে ঢাইকা রাখি,
পোক পাকালী বুইনার[৮৭] মোত আমারে খেদাইলি॥৮৮
দোয়াই দেই[৮৮] বুড়া ঠাইরাইন[৮৯] আমার বাসুক ভালা রাইখাইন,
ভাইজা দিমু ছাতু গুরা চাইল।
দোয়াই মাগো সুবুচুনী বাসু ভালা থাকে জানি,
গুয়াপান দিমু তারে কাইল॥
পেচার ডাক শুইনা নারী অমনি কয় ত্বরাতরি,
ডাইক নারে কালপেচা আর
বোয়াল মাছে ভাইজা দিমু শৈল মাছ পুইড়া দিমু,
বুকের সোণা বুকে দেও আমার॥৯৬
মোনের দুঃখু কইয়া যত বাসুর মাও যে কান্ল কত,
সেহি কথা ক্যাম্নে কৈরবরে বর্ণন।
কাল নিশি পোষাইল কাহা কাহা[৯০] কাক ডাকিল
বাসুর মাও হৈল নিদ্রায় অচৈতন॥১০০
(8)
আধা পথে আইসারে কানু গাছের তলে বইল।
মোনের যত গোপন কথা বাসুক ভাইঙ্গা কৈল॥
“ওপাইরা ভারাইটা[৯১] নিচি ঠাকুর আর ঠাইরাইন[৯২]।
রাইত না পোহাইতে তারা ওপারে যাইবাইন॥৪
পার কইরা দিমু আমি সোণা মাঝির নায়।
তুমি নি হইবারে সাথী রাইত পোহাইয়া যায়॥”
বাসু কৈল “সোণা মাঝি আপন ভারা রাইখা[৯৩]।
তোমাকে দিল নৈকাখান কোন সুবিত।[৯৪] দেইখা॥”৮
কানু কৈল “সোণা মাঝি জ্বরে কাইপা সারা।
দিন চারি পাচ নায়ের লগি মাটিত থাক্ব গারা[৯৫]॥
নৈকাতে তুলিয়া আমি ঠাকুর ঠাইরাইণ নিব।
গোঞ্জের ঘাটের পাকে নিয়া ডুবাইয়া মারিব॥১২
টাকা মোহর জোহারপাতি আছে মোনের মোত।
সন্ধ্যাবেলা দেইখাছিরে তোমাক কমু কত॥”
বাসু কৈল “কও কি দাদা পাকে ডুবাইবা।
পাকের থনে ক্যামন কইরা আমাকে বাঁচাইবা॥১৬
বিষম দরিয়ার পাক কেই যে বাঁচে না।
ক্যামনে বাঁচিব বল আমরা দুইজনা॥”
কানু কৈল “ভাব ক্যানে শোন বালু ভাই।
শম্ভু জাইলার কাছি[৯৬] আইনাছি আগার নিগার[৯৭] নাই॥২০
এক মাথা তার বান্দা থাকব শিমুল গাছের গোড়ে।
আর এক মাথা বান্দা থাকবো ভুরার[৯৮] উপুরে॥
ভুরা যাব[৯৯] নায়ের পাছে আল্গা পাইয়া দড়ি।
মোনের আশা পূণ্ণু হইলে ফিরমু ভুরায় চড়ি॥২৪
জেহার পাতি খুইলা নিয়া নায় দিমু কুড়াল।
নুইটা নিয়া ডুবাইয়া তুলমু যত মালামাল॥
দাইড়া ঠাকুর দাড়ি নাড়ব ছাগল যেমুন নাড়ে[১০০]।
ভুরার দড়ি টাইনা আমরা আইসমু নদীর পারে॥২৮
ঠাকুর ঠাইরাইণ মইরা গেলে আর কি মোনে ভয়।
কাছি দিমু শম্ভুর বাড়ী কোন বেটা কি কয়॥
মোনের মোত বেসাত দিমু মায়ের হস্তে নিয়া।
সেই বেসাতে দুই ভাই মিলা পরে করমু বিয়া॥”৩২
বাসু কানু কোমর বাইন্দা চল্ল গোঞ্জের হাটে।
ঠাকুর ঠাইরাণ নইয়া গেল বরমপুত্তুর ঘাটে॥
যেমুন কতা তেমুন কায্য নাইরে ভয় মোনে।
ভুরা টাইনা বেসাত নিয়া আইল দুইজোনে॥৩৬
বাসু কানু দুই জোনে বাড়ীতে আসিল।
চিল কাইয়া[১০১] আর পোক[১০২] পাকালি[১০৩] ডাইকা যে উঠিল॥
বাসু আইসা দিল ডাক “ওঠ মা জননী গো।
রাইত পোহাইয়া যায় তেমু কত নিদ্রা যাওগো॥৪০
আর দুঃখু হৈব না মা দুঃখ গেল কাইটা গো।
আইজ আইনাছি তোমার যত মোনের মত জিনিষ গো॥
দুই হস্তে খাবি তুই আর আমারে খাওয়াবি গো।
চোক্কের জল আর না ফালাবি এম্নি সুখে থাক্বি গো॥”৪৪
বাসুর মাও কৈল “বাসু কিবা আইনাছ।
এক দিনের এই খাওয়ার দিব্যে[১০৪] কয় দিনের সুখ দিছ॥
বাসু কৈল খুইলা দেখ্ মা খাওয়ার দিব্য নয়।
এক দিনে নয় জর্ম্ম[১০৫] ভইরা খাবি সমুদায়॥”৪৮
কতা শুইনা বাসুর মাও টোপলা[১০৬] যে খুলিল।
আন্দাইর[১০৭] ঘর আলো কইরা চক্কু ভইরা গেল॥
বেসর আছে ঝুমকা আছে আর আছে নাইরকল ফুল।
চিক রইয়াছে সিতি আছে আর কণ্ণফুল॥৫২
সোণার মালা বাজু আছে আর আছে বুকের পাটা।
সোণার হাসা গাথা আছে কাণখোচানী কাটা॥
নতে আছে চুনী মণি আর মুক্তা ঝুলমুল।
গোণ্ডা বাইশেক তাবিচ আছে আর যে বকফুল॥৫৬
চন্দ্রহার সুরজহার রূপার বাক খারু।
চরণপদ্মে বান্দা রইচে গুঞ্জরী দুইগাছ সরু॥
সুলতানী মোহর আছে বাদসাই গোরে টেকা।
আর আছে ছোট বড় সোণারূপার চাকা॥৬০
খইরকা মুষ্টি আর আচিল[১০৮] আগুণপাটের শাড়ী।
সোণার বাটী আবের কাকই সোণার আছাড়ী[১০৯]॥
বাসুর মাও দেইখা বলে “কি বান কইরাছ[১১০]।
রাজা বাদসার বেসাত তুমি কোথায় পাইয়াছ॥”৬৪
বাসু তহন ভাইঙ্গা চুইরা কৈল এক এক দাপে।
কতা শুইনা বাসুর মাও থরথরাইয়া কাঁপে॥
“কি কর্ম্ম কইরাছ বাসু হইল সর্ব্বনাশ।
বরমবধ[১১১] কইরা তুই বাড়াইলি তরাস॥৬৮
চক্কে আর দেখমু নারে বউ কুটুম নাতী।
বরমশাপে কেই থাকে না বংশে দিবার বাতি॥
হৈয়া ক্যানে না মরলিরে হৈতনা এত জ্বালা।
এমন দুষ্মণের হায়রে ডুইবা মরণ ভালা॥”৭২
কাইন্দা কাইন্দা বাসুর মাও চক্কের মোছে জল।
বাহু তহন বেসাত নিয়া কল্ল মাটির তল[১১২]॥
দিন ভইরা খাইল না কিছু কাইন্দা বাসুর মাও।
পোলার সাথে গোসা কইরা কইল না আর রাও॥৭৬
রাইত পোষাইলে বালুর মার চক্কু হৈল ঘোলা।
হাড় কাপাইনা জরে ধইরা শরীর ক’ল্ল কালা॥
দিন চারি পাঁচ পৈড়া রৈল বিছানের উপুরে।
পাড়া পরশী আর বাসু দেইখা মোনে ভাবনা করে॥৮০
আশ্যি পশ্যি[১১৩] কৈল “বাসু কবিরাজ ডাইকা আন।
মাও যে তোমার দুঃখী বড় ভালা কইরা টান॥”
পহর তিনি হাইটা[১১৪] বাসু যায় যে ত্বরাতরি।
তিনকড়ি যে মস্ত বৈদ্য পাইল তাহার বাড়ী॥৮৪
হাক ছাড়িয়া ডাকে বাসু কবিরাজ মশয়।
“আমার মাও যে য়্যাহন ত্যাহন[১১৫] তোমাকে যাইতে হয়॥
তিনকড়ি কবিরাজ শুইনা ধুতি চাদ্দর লইল।
চাদ্দরের খুটির মধ্যে দাঐ[১১৬] বাইন্দা নইল॥৮২
হাতে নইল বাগা নাঠি[১১৭] কান্দে লইল ছাতি।
তুলসী তলায় যাইয়া বৈদ্য ঠেকাইল তার মাথি॥
কিষ্ট বর্ণ শরীলখানি ত্যাল ত্যালা তার গাও।
খাটাখুটা[১১৮] নাফা গোফা[১১৯] ফাটা ফাটা পাও॥৯২
কুতকুতিয়া চায় কবিরাজ গুরগুরাইয়া যায়।
পাছে পাছে বাসু নাই উপ্তা হোচট খায়॥
বাসুর বাড়ী যাইয়া বলে “বৈদ্য তিনকড়ি।
তোমার মাও যে ভাল হব খাইলে তিনবড়ী॥৯৬
আইজকা দিবা ব্যালের ছাল আর নিমের পাতার ঝোল।
কাইলকা দিবা গরম কইরা সজভিজাইনা জল॥
পশ্যু দিবা নাল বড়ীডা কাঞ্জী[১২০] দিয়া গুইলা।
তশ্যু[১২১] দিবা নীল বড়ীডা কুয়ার পানি তুইলা॥১০০
শেষামেশি দিবা বাসু এই না ধল বড়ী।
আরাম হইব তোমার মাও থাকবনা জ্বরজ্বারি॥
চাকুইল ধানের ভাত খিলাইও শরীলে ঢাইল জল।
ধলা বড়ী খাওয়াইলে দিও তেতুইলের অম্বল॥”১০৪
কবিরাজের কতা শুইনা বাসু নিল বড়ী।
বিদায় হবার সোময় হয় যে কৈল তিনকড়ি॥
এক কুলা চাইল দিল ডাইল যে এক ডালা।
গাছের থনে তুইলা দিল বাগুণ মরিচ কলা॥১০৮
হল্দী দিল লবন দিল পেটী ভইরা তেল।
বিদায় পাইয়া কবিরাজ মশয় হাস্তে হাস্তে গেল॥
সন্ধ্যা বেলা বাসুর মাও যে চক্ষু মেইলা চাইল।
জর্ম্মের মোত বাসুক থুইয়া সগ্যে চইলা গেল॥১১২
(৫)
মায়ের মরা কান্দে নইয়া[১২২] নদীর পাড়ে গেল।
মুখে আগুন দিয়া তারে জলে ভাসাইয়া দিল॥
ঘরে আইয়া বাসু নাই কান্দিতে লাগিল।
দুনিয়া বিচে এক মাও তাও ছাইড়া গেল॥৪
ই দ্যাশে আর থাক্মু নারে বৈদেশ চইলা যামু।
নগরে নগরে যে মাঙ্গিয়া যে খামু॥
আমার দোষে মৈল মাও ই দুষ্কু না সয়।
মায়ের শোকে হৈব আমার ইপিণ্ডার[১২৩] ক্ষয়॥৮
দিন চারি পাঁচ কাইন্দা বাসু ঘরে বৈসা থাকে।
কানু আর কানুর মাও বুজ মানাইয়া রাখে॥
ক্যারমে ক্যারমে[১২৪] আবার বাসু কামে নাইগা গেল।
মাইনষের মাথায় বাড়ী দিয়া তফিলগুণ বার নৈল[১২৫]॥
কানুর সাতে বিশু নাই যে চলে দিন রাইতে।
রুশাই কইরা আপন হাতে খায়রে সন্ধ্যাকালে॥১২
দিন দেইখা কানুর মাও কানুক দিল বিয়া।
বাসুক কৈল জোগাড় কইরা ঘরে আন মাইয়া॥
“হস্ত পুইড়া খাওয়ে বাসু খাওরে কাইঠা চিড়া[১২৬]।
দ্যাহের মাংস শুক্না হৈল কৈলজা জিরজিরা॥১৬
মাইন্দা গিরাম আছে বাপু কোরোশ তিনি ঘাটা[১২৭]।
সেহি গেরামের সাধুশীল ভাঁল মাইন্ষের বেটা॥
খোঁজ পাইয়াছি তাহার আছে ঘরে বান্দা পরী।
‘মাণিকতারা’ নাম কন্যার পরম সোন্দরী॥২০
সেই খানেতে যাইয়া তুমি বিয়ার প্রেস্তাব কর।
নিরবন্দে জোটাইলে তুমি খুসী হৈবা বড়॥
কানুর মাও চইলা গেলে বাসু ভাবে মোনে।
ই যুক্তিডা মোন্দ নয় যামু যে বিহানে॥২৪
রাইত পোষাইলে বাসু নাই ধুতি চাদ্দর নইয়া।
চৈত মাইসা রৈদ পেইলা যায় মাথাত চাদ্দর দিয়া॥
বাসু গেল মাইন্দা গায় পহর তিনি বেলা।
মাথার ঘম্ম পায় পইরাছে রৈদের বিষম জ্বালা॥২৮
ছামনে পৈল টলটলা[১২৮] খাল কলকলাইয়া চলে।
ওপারকার মাইয়া মানুষ কলসী ভরে জলে॥
সাইরে সাইরে ওপার বাড়ী ইপার বাড়ী নাই।
বাসু যাইয়া শিমইল তলায় বৈশা পৈল তাই॥৩২
হাপুস হুপুস নিয়াস[১২৯] পরে জলের দিরে[১৩০] চায়।
ইচ্ছা হৈল মোনের মোত আজইল ভইরা[১৩১] খায়॥
এইনা ভাইবা বাসু নাই ঘাটের পারে গেল।
ওপারকার বাড়ীত থিক্কা মাইয়া একটা আইল॥৩৬
সামাইল গামছা বুকে রইচে ছাইড়া দিচে চুল।
সেহি চুলে পায়ের পাতা পাইছে যে নাগুল॥
মাটীর দিরি চাইয়া কন্যা জলেতে নামিল।
বাসু নাই যে ওপার রৈচে দেখবার না পাইল॥৪০
আজুইল ভইরা জল খায় আর বাসু দেখল চাইয়া।
ছামনে যেমুন বিদ্যাধরী রূপে নিচে ছাইয়া॥
বাসু আছাল সোণার কান্ত রূপে মনোহর।
সেহি কন্যা বাসুর কাছে নাগিল সোন্দর॥৪৪
ছামনে চাইয়া কন্যা দ্যাহে বাসুর ছুরত।
অন্তরে যে জ্বইলা উঠল মৌঢালা[১৩২] পিরীত॥
জল খাইয়া বাসু নাই গেল গাছের তলে।
টেরা চক্কে চাইয়া দ্যাহে বাইলা খালির জ্বলে॥৪৮
বাসু ভাবে কাহার কন্যা নইব পরিচয়।
ই ত কন্যা মানুষ নয়রে পইরাণী[১৩৩] নিশ্চয়॥
এহি না ভাবিয়া বাসু সামাল সুরে কয়।
ওপার থিকা কন্যা শুইনা মোনে খুসী হয়॥৫২
“কে রমণী রসমতী,
জলে নাইমাছ।
মুখখানি পূন্নিমার চন্দ্র,
রৈদে ঘাইমাছ॥৫৬
বাইলা খালির টলটলা জল,
আঁচল ধৈরা টানে।
অঙ্গের বর্ণক[১৩৪] দেইখা,
লৌ ছোটে জানে[১৩৫]॥৬০
মস্তকের কেশ যেমুন,
কুইজের মাথায় কালা।
জোড়া ভুরু দেখ্লে হায়রে।
যায়রে মোনের জ্বালা॥৬৪
দুই নয়ানে রইয়াছেরে,
কালা দুডী তারা
কামান খিচা মানুষ মারে,[১৩৬]
অঙ্গ দিয়া নাড়া॥৬৮
সার্থক জন্যম ওরে,
বাইলা খালির জল।
এইনা চান বুকে নইয়া
পাওরে কত বল॥৭২
ধৈন্য হৈলা শিমূল তলা,
বাইচা থাক তুমি।
ধান দূব্বা আর মইলকা দিয়া,
পূজা করমু আমি॥৭৬
ভূত পিচাশ না বৈশ্যাল[১৩৭] নারে,
নয়য়ে পরী জিন।
চান্ বদন দেইখা আমি
পাইয়াছি যে চিন॥৮০
দেইখাছি গোঞ্জের ঘাটে,
আইজ দেখ্লাম খালে।
আমার দ্যাপ্তা[১৩৮] আইচে ঘরে,
আমার কপালে॥”৮৪
ঐ আহারে মরিরে ঐ আহারে মরিরে।
“কিবা নাম ধর কন্যা কে হয় তোমার পিতা।
আচম্বিতে চাইয়া দেইখা খাইলা আমার মাথা॥
আমি যে অধমজনা আমার দুইকুলে কেই নাই।
বাপ মাও ভাই খাইয়াছি আমি মুখে পড়ল ছাই॥৮৮
গোঞ্জের ঘাটে দেইখাছরে কিবা কর্ম্মে যাইয়া।
আজি না দেখিলাম হায়রে সোণার মাণিক পাইয়া॥”
“বিদির নেখা বিদি নেখে মাইন্ষে খায় তার ফল।
তোমার কদর চায়নারে হায় বিদি এমুন খল॥৯২
বাপ মাওয়ের সাথে আমি যাইয়া তোমার ঘরে।
পথ চলিতে দেইখা আইলাম রইচ তুমি ঘরে॥
ফুলবাতাসা দিয়া খাইলাম বিন্নিধানের খই।
তোমার মাও যে আইনা দিল ছিকাত তোলা দই॥৯৬
তোমার মাও কৈল হাইসা আমাক কোলে নইয়া।
আমার ঘরে আইস মাও ঘরের লক্ষ্মী হইয়া॥
আমার নামডি মাণিকতারা বাপ যে সাধুশীল।
কুটুম্বিতা হবার পারে খুসী থাকলে দিল[১৩৯]॥”১০০
“ওপার যাওয়ার ঘাটা[১৪০] আমি জানিনা সোন্দরী।
কোন ঘাটাতে যাব আমি কোন বা তোমার বাড়ী॥”
“পূবের ঘাটে ঘাটা আছে সেইখানে হও পার।
ঐ যে একডা চণ্ডীঘর ঐ বাড়ী বাবার॥”১০৪
মাণিকতারা জলে রৈল বাসু গেল বাড়ী।
বাড়ীতে কে আছুইন বুইলা ডাক্ল তাড়াতাড়ি॥
চান কইরা আইসাছে সাধু ডাক শুনবার পাইল।
অন্দল ছাড়িয়া সে যে বাহিরে চলিল॥১০৮
ছাম্নে আইসা বাসু নাই ক’ল্ল দণ্ডবত।
সাধু নাইও হাতের মদ্যে দিল নাকে খত॥
সাধু কৈল তোমাক বাপু চিন্বার পাল্লামনা।
কারবান্ বেটা কিবা নাম কোন খানে আস্তানা॥১১২
“গোঞ্জের ঘাটে বাড়ী আমার বিশুশীল অয় বাপ।
বাপ মাও ভাই বন্ধু মৈরা হৈচে সাফ্॥”
সাধুশীল চিন্বার পাইয়া সঙ্গে নইয়া তারে।
বৈসপার দিল পাটী পাইরা চণ্ডী মোণ্টপ ঘরে॥১১৬
অন্দলে যাইয়া সাধু গিন্নিক ডাইকা কয়।
বিশু নাইয়ের ছাইলা আইচে কিবা এহন হয়॥
গিন্নি কৈল কোন কামে বান্ আইল বাসু নাই।
সাধু কৈল সেহ কতা যে জিজ্ঞাস করি নাই॥১২০
বালিস একডা হাতে নইয়া বাসুর কাছে গেল।
কি কারণে আইচ বাসু জিজ্ঞাস করিল॥
মাটির দিরি চাইয়া বিশু মিহিসুরে কয়।
“একলা ঘরে থাকি আমি জানুইন্ সমুদায়॥১২৪
কুটুম নাই বয়েস অইল ঘরের মানুষ চাই।
জানের দোসর বিচরাইবার নিল বাহির হৈচি তাই॥
আপনার ঘরে আছে কন্যা শুইনাছি লোক-মুখে।
সেহি কারণে দেখ্তে আইলাম সাহস বাইন্দা বুকে॥
আপনে যদি কের্পা কইরা বান্দেন আমার ঘর[১৪১]।
জীবমানে[১৪২] থাকুম আমি হইয়া নফর॥”
বাসুর কতা শুইনা সাধু মোনে খুসী হৈল।
গিন্নিরে শুনাইতে সাধু অন্দলে চলিল॥১৩২
হাইসা হাইসা সাধু যে কয় গিন্নিরে খবর।
মাণিক তারার জুটি[১৪৩] আইচে চণ্ডীমোণ্টব ঘর॥
গিন্নি কৈল ভালাই সেডা পাত্র বড় ভাল।
খাবার জোগাড় কৈরা এখন চুলায় আগুন জ্বাল॥১৩৬
সাধু নাইয়ের তিনডা ছেইলা কেউ নাইঙ্কা বাড়ী।
কেউবান গেছে মাছ ধরিতে, একা বুড়া বেটার চিন্তা অইল ভারী॥
গিন্নি কৈল মাইজান বউ তুমি রুশাই কর।
বড় বউ আর ছোট বউ ত্বরাতরি নড়॥১৪০
দেড় পহইরা বেলা হৈচে অতিথরে দেও ত্যাল্।
ত্যাল্ মাখিয়া বাসু নাই চান্ করিবার গেল॥
মাইজান বউ রুশাই করে যোগান দেয় দুই বউ।
এমুন সময় বড় পোলা মাইরা আন্ল রুই॥১৪৪
মাঝার পোলা মাইরা আইন্চে খৈলসা পুটি কই।
ছোট পোলা সাগ আইনাছে আর মোটা চই॥
বাসু নাই চান্ কইরাছে খাইতে দিল জল।
নুল ত্যাল্ দিয়া হুরুম্ মাইখা দিল যে নাইরকল॥১৪৮
গুর বাতাসা দিল আইনা দিল চিরার মোয়া।
পাক্কা ডউয়া ভাইঙ্গা দিল মস্ত মস্ত কোয়া॥
তিলের নাড়ু উপর দিল আর দিল কলা।
এক বাটী দুগ্ধ দিল দিল চিনির দলা॥১৫২
মোনের সুখে খাইয়া বাসু গেল চণ্ডী ঘরে।
মোনের মোত খাওয়া পাই জবর ঘুম[১৪৪] পারে॥
মাইজান[১৪৫] বউ যে আহার উপুর চড়াইয়া দিচে ডাইল।
বাড়ীর মানুষ শুইনা কত দিবার লাগ্ছে গাইল॥১৫৬
দেওর ভাসুর তামুক খাইয়া করবার গেল চান্।
চান্ কইরা আইসা তারা পাইল না আছান[১৪৬]॥
বউনা তহন ডাইলে জোরে দিল কাটা।
তেমু[১৪৭] ডাইল গলে নারে পাইয়া এমুন ঘাটা॥১৬০
বড় বউ মচ্ছ কোটে পাইডা বৈসা বটী।
ছোট বউ ত্বরাতরি চাইল ধুবার যায় গুটি॥
বড় বউয়ের হাতে হায়রে শিংএ দিল গালি।
হউড়ি[১৪৮] দিল মরিচ বাইটা গালির উপুর তালি[১৪৯]॥১৬৪
বেলা হইল দুপুর গেল ডাইল গলে না হায়।
নতুন ইষ্টির[১৫০] ছামনে এহন ক্যামনে দেওয়া যায়॥
ত্যক্ত অইয়া মাইজান বউ ডাইলে মারে ঘাও।
চরকা যেমুন ঘ্যাগর ঘ্যাগর করবার নইল রাও॥১৬৮
অ’ ডাইল গলবি কিনা রে ডাইল সকালে।
খিদায় আকুল হৈল সকলে॥
ভাসুরে করে কিচির মিচির দেওরে করে রাগ।
ফোটা তিলক কাইটা হউড় সাইজা রৈচে বাঘ[১৫১]॥১৭২
খিদার জ্বালায় জ্বইলা মৈল অঙ্গ কুটি কুটি।
সোয়ামী আইসা রাগ কইরা ধ’ল্ল চুলের মুঠি॥
মায় আইয়া বউ ছাড়াইল নিল হাতে ধইরা।
জলপান করিতে দিল তিন পোলারে বাইড়া॥১৭৬
ডাল হৈল মচ্ছ হৈল হৈল তড়াতড়ি।
বড় ঘরের মাইজালেতে[১৫২] পৈড়া গেল পিড়ি॥
বাসু আর তিন পুত্ত্র নইয়া সাধু সাথে।
ভোজন করিতে বৈল যে যার পিড়ীতে॥১৮০
পঞ্চজোনের সুম্কে আইনা দিল পঞ্চথাল।
বাসুর থাল চাইয়া দেইখা সাধুর চক্কু হৈল নাল[১৫৩]॥
গিন্নি আর বউয়ের উপুর দিল হাম্বি তাড়া[১৫৪]।
বাসুর পাতে কিসের নিগা দিলা ভাজা পোড়া॥১৮৪
মাইয়া নোক হৈয়া তোমরা না জান সোংসার।
অনাছারে আমার বাড়ী কর বা ছারখার॥
পুরী[১৫৫] আমার সব্বগুণে হয় যে বলিহারী।
সেহি কন্যার তোমরা মিলা মাথায় দিবা বাড়ী॥১৮৮
পয়লা ভোগে জামাইর পাতে দিলে ভাজাপোড়া।
হউর বাড়ী পুরী যাইয়া হয়ে আধামরা॥
জামাই ভাজে হউড়ী ভাজে, ভাজে নোন্দগোণ[১৫৬]।
দেওরে কেউরে ভাজে ভাজে ঐষ্টক্ষণ[১৫৭]॥১৯২
এহি কতা শুইনা গিন্নি থালি নইল হাতে।
যা দিছিল ভাজাপোড়া তুইলা নিল তাতে॥
বাসু ভাবে হায় কি অইল এই না কম্মে ছিল।
মস্ত মস্ত কই ভাজা আর বাগুণ পোড়া গেল॥১৯৬
আলু ভাজা বাগুনভাজা ভাজা তিলের বড়া।
বেসম দেওয়া উল্কিভাজা চাপ্টি কড় কড়া॥
মোনের মত জিনিষ পাইয়া খাবার না পাইলাম।
বিয়া হব ভাব দেইখা মোনে খুসী হইলাম॥২০০
কইমাছের মুড়ীঘণ্ট কলাই সাগ্ দিয়া।
ছোট বউ আইনা দিল অধিক করিয়া॥
শুক্তানি মুক্তানি দিল দিল নাইয়ের বিশুরী।
তার পরে আইনা দিল খইল্সা পুটীর চর্চরী॥২০৪
আধা ফোটা মাসের ডাইল দিল বাটী ভইরা।
খাইলানারে বাসু নাই রৈল অম্নি পৈড়া॥
মুগের ডাইলে বোয়াল মাছের মুড়া কাটা পাইয়া।
ভরা বাটী ঢাইলা নইল ভাত গেল ওরাইয়া[১৫৮]॥২০৮
ঝোল দিল বাটী ভইরা বোয়াল মাছের পেটী।
বিষম ঝাল টক্টকা নাল খাইতে কিটি মিটি॥
রউ মাছের আমান ফিছা পেটী পঞ্চ খান।
ঝোল হুদ্দা বাসু খাইল পেটে পৈল টান॥২১২
রঊ মাছের মুড়িঘণ্ট বাসু হাইসা খায়।
মুখের নালুচে[১৫৯] খাইয়া পাতের ভাত ফুরায়॥
তার পরে আনিয়া দিল কাঞ্চা আম্নির আম্বল।
বাসু খায়রে চুমুক পাইড়া যেমুন খায়রে জল॥২১৬
এক বাটী ঘোন দুধ আর এক বাটী দই।
সাপুর সুপুর খাইল বাসু মাখাইয়া নইয়া খই॥
বাসুর খাওয়া দেইখা সাধু খুসী হৈল মনে।
এহি ছাইলা পরাণে বাইচা থাক্ব অধিক দিনে॥২২০
ইহারে দিবরে কন্যা মোনের অবিলাস।
যা করেন গোসাই ঠাকুর করমুনা পরকাশ॥
পঞ্চজোনে উইঠা গেল মুখ ধুইবার খালে।
বাসু গেল আচ্পোন করবার আচ পোইনা শালে[১৬০]॥২২৪
তিন পুত্ত্র নইয়া সাধু বস্ল মোণ্টব[১৬১] ঘরে।
ধীরে ধীরে সাধু শীল বাসুক জিজ্ঞাস করে॥
শোন বাপু বাসুদ্যাব আমার যে পুরী।
কি কমু তার গুণের কতা[১৬২] সব্ব গুণধারী॥
ঘরে বাইরে কায্য করে পুষ্যের নাগে তাক্[১৬৩]।
তার উপর হাত ঘুড়াইলে কাইটা রাখে নাক[১৬৪]॥
পরম সুন্দরী কন্যা যাব যে কার ঘরে।
বিদাতার নির্ব্বন্ধের কতা কেবান কইবার পারে॥২৩২
বাপ নাই মাও নাই কেই নাই ঘরে।
আমাদের চান্[১৬৫] আমরা ক্যামনে দেই তোমারে॥
তোমার ঘরে যাইয়া মানিক কার দিরি[১৬৬] বান্ চাব।
কাঞ্চা বসে[১৬৭] ক্যাম্নে হায়রে যোগার কৈরা খাব॥২৩৬
রাইতের কামে যাওরে যুদি খালি বর ঘর।
মাণিকতারা ক্যাম্নে থাকে তাইযে আমার ডর॥
সাধুর ছাইলা তিন জোনের পছন্দ হইয়াছে।
তারা কৈল ক্যান্গো বাবা ভাব্না কি আছে॥২৪০
দিদির বেটী পঞ্চ আছে বিদপা[১৬৮] সোংসারে।
উদরের চিন্তা কইরা সদাই’ ভাইবা মরে॥
বাসু কৈল হেই[১৬৯] যাব খুসী হৈয়া নিব।
জন্যম ভরিয়া আমি অন্নবস্ত্র দিব॥২৪৪
বাসুর কতা শুইনা সাধু মোনে বল পাইল।
মাণিকতারার বিয়ার কতায় আধামত[১৭০] দিল॥
তিনবৌয়ের মত অইয়াছে গিন্নিও মত দিল।
বৈশাখ মাসের পরথম ভাগেই বিয়ার কতা হৈল॥২৪৮
বিয়াল[১৭১] বেলা খাইল বাসু দুগ্ধ আর চিড়া।
ধুতি ছাদ্দৱ নইয়া বাসু বাড়ীত আইল ফিরা॥২৫০
(৬)
সাধু তখন গোণক আইনা বিয়ার দেখ্ল দিন।
ভাগ্যে যা থাকে হব বিদাতার অধীন॥
বৈশাখ মাসের পাঁচই তারিখ দিন বাছ্না হৈল।
সাধুশীল তার পুত্ত্র নইয়া জোগার আরম্ভ কল্ল॥৪
বাসুর কাছে সাধু নৈল তিনশ টেহা[১৭২] পোণ।
পাঁচই তারিখ বিয়ার কাজু হৈল সোমাপন॥
বিয়ার রাইতে তিন বউ আর পাড়ার যত মাইয়া।
মোনের মোত আমোদ কল্ল নানান গাহান[১৭৩] গাইয়া॥৮
পরের দিন্কা বাসী বয়ার খাওয়ান দাওয়ান হৈল।
মাণিকতারাক সোঙ্গে নইয়া বাসু বাড়ীত চইলা গেল॥
যাওয়ার কালে মাণিকতারা মায়রে ডাইকা কয়।
পঞ্চ দিদিক খবর দিয়া আনান জানি অয়[১৭৪]॥১২
কাহিল পরচে[১৭৫] আইলনা সে মোনের দুঃখু রৈল।
বাড়ীত আইলে আমার কাছে তারে যাবার বইল॥
যাওয়ার কালে বাসু তারা ফিরাত অইল খাড়া।
ধান দূব্বা আর জোকার দিল বাড়ীর বৌয়েরা॥১৬
মায় দিল আশীর্বাদ জোন্মায়স্তী[১৭৬] যাক।
একা ঘরে যাইতেছ মাও নিজের শরীল দেইখ॥
মাণিকতারা কান্দে খালি মুখে কতা নাই।
হরি ঠাকুর ভালা রাহুক আবার আইস্মু মাই॥২০
তারার পাছে খাড়াইল মাও টোনা[১৭৭] যে পাতিল।
দুইহস্তে এন্দুরের[১৭৮] মাটী মাণিকতারা দিল॥
এত দিনের যা খাইয়াচিলাম মা ফিরাইয়া দিলাম তাই।
জর্ম্মের মোতন ঋণশোধ অইল আমি এহন যাই॥২৪
সেক বয়াতি জামাত উল্লা হাইসা হাইসা কয়।
কতা শুইনা দুঃখে মরি এইবা কি আর অয়।
মায়ের বুকের এক ফোটা দুধ হয়রে মহা ঋণ।
দুনিয়ার কেই পারেনা শুইজবার[১৭৯] সেহি ঋণ॥
হেন্দুর শাস্ত্র মহাশাস্ত্র এই কতা কি খাটি।
বেবাক ঋণ শুইজা গেল দিয়া এন্দুর মাটি[১৮০]॥৩০
(৭)
বাসু আইল মাণিকতারাক নইয়া গোঞ্জর ঘাটে।
একা ঘরে যাইয়া তারা বৈস্ল বিছান পাটে॥
কানুর মাও কানু আইল আইল পশ্যি জোন[১৮১]।
জাইলা পাড়ার মাইয়া ছাইলা দেখ্ল বউ ক্যামুন॥৪
বউ দেইকা তারা কৈল বাইড়া জুটি[১৮২] হৈচে।
যেমুন পোনাই তেমনি পুরী ভালাই মিলা গেচে[১৮৩]॥
একো দিন দুইও দিন গেলরে দিন পোনর।
বাসু শীল তারাক থুইয়া ছাল্লনা যে ঘর[১৮৪]॥
একদিন বাসু দুপুর কালে উঠ্ল ভাত খাইয়া।
ঘামের দরদে গাছের তলে বাসু বৈল যাইয়া॥
ঘামের উপুর বাতাস চলে বিরিক্ষির পাতা নড়ে।
তাপিত অঙ্গ শীতল হৈল ঘর্ম্ম না আর পড়ে॥১২
ভোজন করিয়া তারা আপন ঘরে গেল।
ইদিক্ উদিক্ চাইয়া যে সে পতিক না পাইল॥
পান বানাইয়া নিজে খাইল আর নিল হাতে।
স্বামীরে বিচ্রাইল[১৮৫] তারা কাঞ্চি কোণাতে[১৮৬]॥১৬
বাইর দুয়ারে আইসা তারা গাছের তলে চায়।
সেহিখানে দেইখা তারা স্বামীর কাছে যায়॥
দুইপর ভইরা ঘুইরা মইলাম আমার হস্তে নইয়া পান।
খালি ঘরে থুইয়া আইসা দেখ্তাছ আস্মান॥২০
কি কতা পইরাচে মোনে কিসে অইলাম দূষী।
কার পিরীতে মইজাছ পতি আগে আমাকে দেও ফাঁসী॥
কি বান্ কতা কইল তারা হইলা যে পাগল।
তুইন আমার কৈলজার নহু[১৮৭] দুই চঙ্কের[১৮৮] কাজল॥২৪
ঘরে রইচে মিঠা পানি মুখের কাছে ঘোরে।
সরপত্ ফালাইয়া বিষে চুমুক দিমু ফিরে॥[১৮৯]
কি দেইখাছ কওনা হারে আছ্মানের উপুর।
কোনবান্ ভাবনা ভাইবা চাইলা আছমানের উপুর॥২৮
কি কারণে চাইয়া আছি তোমাকে বলি তাই।
হইরকাল[১৯০] পংখীর ফাটক[১৯১] পাইতা আটক করবার চাই॥
বার মাসে বার পংখী এই বৃক্ষে বানায় বাসা।
হইরকাল পংখীর মাংস খাইতে আইজ কইরাছি আশা॥৩২
ভাইবা পাইনা বুদ্ধি পাইনা জ্বইলা মরি মোনে।
(আমার) মোনের আশা জাইগাছে মোনে মিটাইবান কেমুনে॥
হইরকালের মাংস আমাক না ক্যান কৈলা।
পংখী ধরার যত হেকমত[১৯২] আমি দিতাম বইলা॥৩৬
আমার বাপের বাড়ীত যাইয়া কইও বাপের ঠাই।
তারামণির ধুন্কী বাটেল[১৯৩] সাইঞ্জার[১৯৪] আগে চাই॥
বাসু গেল হশুড় বাড়ী হৈরকাল খাবার আশা।
তারামণির তীর বানাইল আপন ঘরে বৈসা॥৪০
বাটাইলের মাটীর গুল্লি বানাইল গোণ্ডা পাঁচ।
মধ্যে মধ্যে চাইয়া দ্যাহে হৈরকাল পংখীর গাছ।
আইগ বাড়াইয়া নেওগ তারা বাটেল আইনাছি।
ধুন্কী বাটেল কে চালাব সেই ভাবনায় পইরাছি॥৪৪
আমার ধুনকী আমার বাটেল আমি যে চালাব।
কয়[১৯৫] হরিকাল পাইলে তোমার মোনের আশা যাব।
ওস্তাদি দেখিব আগে দুই হরিকাল মার।
দিনে দিনে গোণ্ডা দিও যুদি মাইবরার পার॥৪৮
এক বাটুলে দুই গুল্লি তারা যে বসাইল।
দুই হরিকাল মাটিত পৈড়া আছার পিছার নইল[১৯৬]॥
বাসু কৈল মাণিকতারা নাগাইলা যে মাত্[১৯৭]।
এক বাটুইলে দুই শিগার এমুন পাকা হাত॥৫২
তারা কৈল এক ধুন্কির চাইর তারে মারি চাইর জোন।
এক বাটুলে পঞ্চ শিগার[১৯৮] মারি যে কখন॥
দারু আর সুমারু কোচ থাক্ত রাজার বাড়ী।
শত দুষ্মণ[১৯৯] তীর বাটেলে যাইত যমের বাড়ী॥৫৬
ওস্তাদ হইচিল তারা আমি সাকরিদ হৈয়া।
আমি যে শিখাছি কত তাদের কথা নইয়া॥
শতেক দুষ্মণ যদি ছামনে খাড়া হয়।
এক মাণিকতারার তীরে পাব তারা ক্ষয়॥৬০
তারার কতা শুইনা বাসু ভাবে মোনে মোনে।
তারা আমার সঙ্গী হইলে বইতাম সিঙ্গা সোনে[২০০]॥
আমার ব্যবসা ক্যামনে কৈরব মাণিকতারার কাছে।
সরমে পইরাছি বড় তারা কি কয় পাছে॥৬৪
তারা কৈল সোণামুখ ক্যান কইরাছ ভার।
আমার কতা শুইনা মোনে জাইগাছে কি দুঃখু তোমার॥
বাসু কৈল আমার মোনে কোন দুঃখু নাই।
একডি কথা গোপন রাখছি কহিতে ডরাই॥৬৮
মাণিকতারা উইঠা আইসা ধ’ল্ল বাসুর হাত।
আমারে না শুনাইলে কতা খাইব না আর ভাত॥
আইজ হইকবান্ কাইল হইক শুন্বে মাণিকতারা।
গিরস্তালী চ’ল্বে নারে তর সাইথা ছাড়া[২০১]॥৭২
সেহি কতাডি কওনা পতি আমি তোমার দাসী।
আমারে কহিতে ডরাও আমি কি অন্বিশ্বাসী[২০২]॥
বাসু কৈল তুমি আমার গোপন কতার মালিক।
তোমার কাছে বল্ব সকল ভোজন হইয়া যাউক॥৭৬
ব্যঞ্জন রান্ধিল তারা সুমিষ্ট করিয়া।
বাসু খাইল মোনের মত উদর ভরিয়া॥
ভোজন করিয়ে দুইয়ে গেল আপন ঘরে।
মাইজার মাটী খুইজা বাসু পাতিল বাহির করে॥৮০
সেই পাতিলে বেসাত পাতি সোনার মহর দেইখা।
সপ্ন দেইখা মানুষ যেমুন ওঠেরে চমুইকা॥
মাণিক সেমনি উঠ্ল চক্ষু দুইডী মেইলা।
পতির দিরি চাই কৈল ইসব কোথা পাইলা॥৮৪
সেই কতা কইতে আমি করি আনছান[২০৩]।
না জানি কি কওগো তুমি দুঃখু পাব তর[২০৪] জান[২০৫]॥
সইমার বেটা কানু দাদা কি পত্তি দেহ তারে[২০৬]।
মাও আর ভাই হইয়া পাইলাছে আমারে॥৮৮
মাও কত দুঃখু কইরা গায় মাইঙ্গা খায়।
সেহি কষ্ট হইরাছিল কানু দাদার মায়॥
কানু অইল সাথের সাথী আমী অইলাম চেলা।
চুরি কইরা খাইচি কত করচি কত খেলা॥৯২
বয়েস বাইল্ল[২০৭] ডাঙ্গর অইলাম শিখ্লাম ডাকাইতি।
পরের মাথায় বারি দিয়া আন্লাম যে বেসাতি॥
বিশো বাইশো দিন গেল আমি বৈয়া ঘরে।
ঘরের পাওনা বাইরে নিলাম আমি তারার ডরে[২০৮]॥৯৬
মাণিকতারা হাইসা কৈল এই কারণে ডর।
আমি অইব পতি তোমার দোসর॥
নারীর ইষ্ট দেখ অইল পতি মহাজোন।
বিনা কতায় নারী করব তার পথে গোমন॥১০০
সোয়ামী থাক্লে ভাঙ্গা ঘরে আর গাছের তলে।
নারী যায় পাছে পাছে দুঃখে পৈড়া মৈলে॥
কুকামে পতির যুদি যাবার নয়রে[২০৯] প্রাণ।
ঘরের নারী দেখ্ব তারে দিয়া আপন জান॥১০৪
আমি হব তোমার সাথী ভাবনা নজ্জা নাই।
আমার কাছে আছে যা জানেন তা গোসাই॥
এহি কতা না শুইনা বাসু মোনে পাইল বল।
মাণিক তারার কাছে তহন কৈল সে সগল॥১০৮
আমার যে মহাশত্রু খইরার খালুচোরা।
তার সাতে না পাইরা উঠি যেমুন শঙ্খিনীর কাছে ধোরা[২১০]॥
বারে বারে হায়রে নছিব[২১১] হৈচি অপমান।
মেহেরবাণী কৈরা খালি থুইয়া গেচে জান॥১১২
কাইলকা যায় নাটের খুতি বোল পাহাড়ী দিয়া।
আমার দলে লুইটা নিব তাই রৈচি বৈয়া॥
রাখাল রাজার দীঘির কাছে তোড়া মাইরা নিব।
ভাবনা আছে বিপদ আইলে উপায় কি করিব॥১১৬
তুমি থাক্বা একা ঘরে আমি ক্যাম্নে যাই।
একা নারী থাকবা ঘরে মোনেতে ডরাই॥
সগল কতা শুইনা তারা পতিরে যে কইল।
একা ঘরে থাক্মু বুইলা কি ভাবনা হৈল॥১২০
মোনে মোনে জাইন আমি একা শতেক নারী।
বিশাস জোয়ানের[২১২] আমি মাথা খাইতে পারি॥
কতা শুইনা বাসুর মোনে হৈল বড় সুখ।
অন্তরায় যে ভাবনা চিন্তা গেল সে সব দুঃখ॥১২৪
জেহার পাতি খুইলা বাসু তারারে পড়াইল।
আছমান থিকা পরী যেমুন ঘরে উইড়া আইল॥
পতি যেমন আন্দাইর ঘরের প্রদীপ অইয়া জ্বলে।
সাপের মাথায় মাণিক পতি সতীর কপালে॥১২৮
নারীর কাছে পতি যেমুন অন্দলের[২১৩] নয়ন।
পতি অইল চাইকের মধু[২১৪] বিরিক্ষিতে যেমুন॥
পতির ভালবাসা পাইলে জুড়ায় নারীর বুক্
পতির কাছে আদর পাইলে নারীর হয় যে সুখ॥১৩২
গয়না গাটি পইড়া তারা মোনে সুখ পাইল।
বাসুর চরণের ধুলা মাথায় তুইলা দিল॥
দুইজোনে হাস রঙ্গ হৈল কতক্ষোণ।
জামাত উল্লা বয়াতি কয় ঘুম পার এহন॥১৩৬
(৮)
বিশ মর্দ্দ[২১৫] দুই কর্ত্তা[২১৬] চইল্ল ঘাটা মাইরা।
গাছের আগায় রৈদ তহন ব্যালা গেছে পৈড়া॥
বাসু কানুর হাতে দাও আর একখানি পাটী।
জুয়ানেরা হাতে নইল ঢাল সুরকি আর নাঠী॥৪
পলাশ বাড়ী যাইয়া তারা বইসা যে জিরায়।
কানু কৈল রাখাল রাজার দীঘি দ্যাহা যায়॥
ঐ যে দ্যাহ মস্ত দীঘি ফটিকের মত জল।
ঐ জলে দুষ্মণ কাইট্যা করমু আমরা তল॥৮
কপাল ক্যারমে কালুচোরা পায় নাই কোন দিশা।
আইজগা তাগর[২১৭] জুম্বাবার[২১৮] করব না যে নিশা॥
নানান্ কতা কৈয়া তারা হাসাহাসি কইরা।
দীঘির পথে বইল তারা ভাঙ্গা পাটী পাইড়া॥১২
চিনি চাম্পা কলা আর চিড়া খাইয়া নইল।
আজুইল[২১৯] ভইরা দীঘির জল পেট ভইরা খাইল॥
আবার আইসা বৈসা তারা খাইল গুয়া পান।
গরুর গাড়ীর ঘ্যার ঘ্যারানি পাইতা হুন্ল[২২০] কান্॥১৬
কানু কইল আইল মাল সামাল কর নাঠি।
কেউ জানি পলাও নারে মোন্ডা রাইখ খাটী॥
হুমহুমিয়া[২২১] আইল টেহা মাথায় বান্দা তোড়া।
আগে আগে খোদ পহরা সোয়ার অই যে ঘোড়া॥২০
আচম্বিতে ঘোড়ার ঠেংএ পৈল বাড়ি ধুপ্।
ঘোড়সোয়ার মাথা কাট্ল জোর্ম্মের মত চুপ॥
ছয় তোড়ার মালীক মৈল তোড়া গেল উইরা।
তোড়ায়ালা ছয় জোন রৈল ঘাটের পারে মৈরা॥২৪
বাসু গেল তোড়ার সাথে কানু কোচের বাড়ী।
রাখাল রাজার দীঘির ধারে নাগ্ল পাড়াপাড়ি[২২২]॥
খবর পাইয়া আইল কালু যাত্রা কৈরা পাছে।
বাসু নাই তার মুখের গেরাস কাইরা ছাইরা নিছে॥২৮
জোন পোঞ্চাশেক[২২৩] সাথীর সুম্কে কালু লজ্জা পাইল।
পাছে পাছে ধাইয়া যাইয়া কানুরে ধরিল॥
আর ধ’ল্ল জোন পাঁচেক জুয়ান মর্দ্দ কৈষা।
কালু চোরা হুকুম কইল বান্দা ঘাটে বৈসা॥৩২
এই শালা কানুরে বান্দ নায়ের গুরায়[২২৪] নিয়া।
ও ব্যাটাগর বাইন্দ ভালা পায় দড়ি দিয়া॥
পিছমোরা কইরা বাইন্দ দো দো[২২৫] জনার হাত।
কাইল বিচার করমু আমি পোষাইক আগে রাইত॥৩৬
(৯)
বাসু আইসা কানুর বাড়ী ছয় তোড়া নামাইল।
সই মাগ বুইলা টেহা কানুর মায়রে দিল॥
কানুর মাও কৈল বাবা আমার কানুক ফাইলা।
টেহার তোড়া নিয়া ক্যানে আমার বাড়ী আইলা॥৪
বাসু কৈল ভয় কর ক্যান্ রৈচে আমার দল।
তাগার সাথে আইস্ব কানু দেইখা পাবা বল॥
এমুন সোমে[২২৯] জোন চারি পাঁচ আইল দলের লোক।
কান্দা মুখে কৈল তারা কৈলজার যত দুখ॥৮
বাসু ভাইরে আর কমু কি কালু চোরা আইল।
আমাগরে জোন চারি পাঁচ আর কানুক বাইন্দা নিল॥
নাও বাইন্দাচে খালের ঘাটে লোক যে সারি সারি।
বিয়ান বেলা[২৩০] কালুচোরা যাব আপন বাড়ী॥ ১২
এহি কতা না শুইনা বালু আপন বাড়ী গেল।
যেমুন ঘইটাছে যা মাণিকতারাক কৈল॥
বালু কৈল ভালা হব একা থাক যুদি।
তারা কৈল নাগ্ব না তা’ আইচে পঞ্চ দিদি॥১৬
এই কতা না শুইনা বাসু নোক জোন নইয়া।
কালুর নায়ে গেল আন্তে কানুরে ফিরাইয়া॥
আকাশ ভরা জোছনা চলে কালু নিদ্রা যায়।
আর হুগল সিপাই রৈচে খাড়া পহারায়॥২০
বাহু কৈল ক্যামনে যামু হাতিয়ার[২৩১] মুখে।
ঝোপের তলে বৈয়া থাকি সুযোগ পাবার ছলে॥২২
(১০)
কানুর বিপদ দেইখা তারা ভাবে মোনে মোনে।
ক্যামুন কৈরা ফিরাইয়া আনি কানুরে এহিনে॥
তবে সে কানুর মার ঘুচাবার পাই ঋণ।
ভাইবা তারার মুখে তহন সুখের উঠ্ল চিন্[২৩২]॥৪
ঘরে আইসা মাণিকতারা পঞ্চকে সাজাইল।
নানান রোঙ্গের জেহার[২৩৩] দিয়া অঙ্গ সাজাইল॥
কান্দের আঁচলে তোলে ধনুকতীর।
জুয়াইন ডাকাইত নৈল বাইছা যা আছে পতির॥৮
ঘাটে আইসা রঙ্গাইলা নায়[২৩৪] উঠ্ল সবে মিলা।
বায় রাইখা কালুর বাড়ী গেল খইরা বুইলা॥
সেইখানে যাইয়া পঞ্চ বাইয়ালী[২৩৫] সাজিল।
সুর ধইরা মাণিকতারা গাহানে মজিল॥১২
পঞ্চ নাচে ঝুমুর ঝুমুর তারা করে গান।
রোস্নাই[২৩৬] করিয়া নাও চলিল ভাইটান[২৩৭]॥
সুমুখে কালুর বাড়ী বাড়ীত নাই কেউ।
কালুর পোলা দুলু ডাইকা কৈল তাই॥
সোন্দর[২৩৮] নৈকাতে চৈড়া নাচ তোমরা কে।
ভালা চাস্ ত কালুর ঘরে পরিচয় দে॥
দুলুর আইজ্ঞা পাইয়া তারা নৈকা ভিড়াইল।
চরের উপুর কাজী আইচে মিত্যা কতা কৈল॥২০
এহি সোমে আমরা কিছু দারু[২৩৯] খাইয়া নাচি॥
এহি সোমে[২৪০] পাইলে বন্ধু বুকে ধইরা নাচি॥
আপনের কাছে আইচি আমরা দারু কর দান।
নৈকাতে উঠিয়া বৈস ঠাণ্ডা কর প্রাণ॥২৪
শুনিয়া যে দুলু চোরা উইঠা রৈল নায়।
গাহান করিয়া তারা বাড়ী বুইলা যায়॥
বাড়ীতে আছিল পারা নতুন একখান পাট।
সেহিখানে বিছান পাইড়া কইরা দিল ঠাট[২৪১]॥ ২৮
[শেষ (অসম্পূর্ণ সংগ্রহ)]
- ↑ জোন=জন; গোণ=গণ; কোম=কম।
- ↑ পরথমে=প্রথমে।
- ↑ বন্দম=বন্দনা করি।
- ↑ মই=মুই, আমি
- ↑ মমিন=বিদ্বান্।
- ↑ ক্ষেমা দিবাইন গুণাগারী=ভ্রম প্রমাদ মার্জ্জনা করিবেন।
- ↑ গাহানে=গানে।
- ↑ নাইঙ্কা=নাইকো।
- ↑ কুদ্রতে=আশীর্ব্বাদে।
- ↑ দশোজনার=দশজনের, সাধারণের।
- ↑ ইদেশের=এদেশের।
- ↑ মাথালে=মাথার দিকে।
- ↑ বরমপুত্তুর=ব্রহ্মপুত্র; বরমদৈত্য=ব্রহ্মদৈত্য।
- ↑ নাইঙ্কা=নাইকো (প্রাদেশিক উচ্চারণ—অনুনাসিকযুক্ত)।
- ↑ চোক্কে মালুম দেয় না কার=(নদীর অপর পার) কাহারও দৃষ্টির গোচর নহে।
- ↑ চালি=নৌকার ছাদের মত উচু ঢেউ (গড়াণ) ভাঙ্গে।
- ↑ শিশু=নদীবিহারী প্রাণিবিশেষ। শিশুর তৈল বাত রোগে বিশেষ উপকারী।
- ↑ ঘইরাল=ঘড়িয়াল।
- ↑ চুবন খাইয়া=জলে ডুবিয়া।
- ↑ তেলছ মাত=
- ↑ যহন=যখন।
- ↑ ত্যালত্যালাইয়া=অতি মসৃণ ভাবে; স্বচ্ছন্দগতিতে।
- ↑ পাক....বাঁক=বাঁকের নিকট নদীর আবর্ত্ত দেখা যায়।
- ↑ ব্যাহুস=অসতর্ক।
- ↑ এম্নি......পাইলি। ভাত খাবার থাল যেমন সমতল, বাতাস না থাকিলে নদীর জল তেমনই সমতল ও মসৃণ হয়। না পাইলি=না পাইলে।
- ↑ গঞ্জের হাটের নিকটেই খেওয়া ঘাট।
- ↑ রুশাই=রন্ধন।
- ↑ পোষাইলে=পোহাইলে; প্রভাত হইলে।
- ↑ মান্দাইর=মান্দার কাটের নৌকা “মান্দারের বৈঠ।” সূর্য্যের গানে উল্লিখিত আছে—বঙ্গসাহিত্য পরিচয় ১৭১ পৃষ্ঠা, প্রথম ভাগ।
- ↑ নছিব=অদৃষ্ট।
- ↑ তলায়=তলাইয়া যায়, ডুবিয়া যায়।
- ↑ আজুরা=পারিশ্রমিক।
- ↑ কড়ির পাহাড়=অনেক কড়ি, এজন্য কড়ির স্তুপকে পাহাড় বলা হইয়াছে।
- ↑ তাক্ নাগ্বাইন্=তাক লাগিবে; চমৎকার লাগিবে।
- ↑ কেউবান্=কেহ বা।
- ↑ মাটী....হরি=পাড়ি দিয়া ডাঙ্গায় পঁহুছিতে পারিলে আরোহিগণ ভগবানের নাম স্মরণ করিত।
- ↑ গিরাম=গ্রাম।
- ↑ নুইটা=লুট করিয়া।
- ↑ ঐরাণ=অরণ্য শব্দের রূপান্তর। প্রাচীন বাঙ্গালা ও পূর্ব্ববঙ্গে ঐরাণ শব্দ জঙ্গলের শব্দের সঙ্গে সর্ব্বদা একত্র ব্যবহার হয় এবং ঐরাণ শব্দ “গভীর” অর্থ বাচক।
- ↑ নাই=নাপিত।
- ↑ পোনাই=ছেলেপিলে।
- ↑ ছোন্=চালের খড়।
- ↑ বিরিক্ষির=বৃক্ষের।
- ↑ বিদিক=বিধিকে।
- ↑ পঞ্চমুখে কথা শুইনা=পাঁচটি ছেলের কথা শুনিয়া।
- ↑ ক্যারমে ক্যারমে=ক্রমে ক্রমে।
- ↑ এক বাসু.........সব গেল=‘সবে ধন নীলমণি’ বাসুর যদি কিছু হয়, তবে আমরা সর্ব্বস্বহারা হইব।
- ↑ অন্দলের নড়ি=অন্ধের যষ্টি।
- ↑ চাপের=নদীর পাড়ের।
- ↑ বাসুর মা ঢেউ=বাসুর মাতা স্বামীর মস্তক ঢেউএর সঙ্গে (তলাইতে) দেখিতে পাইল।
- ↑ নইয়া=লইয়া।
- ↑ পাছে থনে=পিছন থেকে।
- ↑ সন্তানের......বুক=অপত্যস্নেহে তাহার বক্ষ ভরিয়া উঠিল।
- ↑ আমির=পালা-রচয়িতা।
- ↑ পহর পাড়ে = পাহারা দেয়।
- ↑ জগদিষ্ট=যিনি জগতের ইষ্ট বিধান করেন; জগদীশ্বর।
- ↑ নইল=লইল।
- ↑ রহমই=রকমই।
- ↑ কানুর......বেকা=কানুর প্ররোচনায় বাসু বিপথগামী হইতে লাগিল।
- ↑ নিষদ=নিষেধ।
- ↑ পানায়(বাছুরে) পান করে; গোদোহনের পূর্ব্বে বাটে দুগ্ধ আনিবার জন্য বাছুরকে দিয়া ‘পানাইতে’ হয়। ‘পানান’ এটি বাঙ্গালা নাম ধাতু।
- ↑ চুঙ্গা=বংশপাত্রবিশেষ।
- ↑ বানে বারা=ভারা ভানে; ধান ভানা, চিড়া কোটা প্রভৃতি বৃত্তিকে ‘ভারা ভানা’ বলে। ইতরজাতীয়া বিধবা বা সম্বলহীনা স্ত্রীলোকের পল্লীগ্রামে ইহাই জীবিকার উপায়। (জাইলা গোরে=জেলে দের)।
- ↑ কতাডি=কথাটি।
- ↑ ওরা=উড়িবার উপযুক্ত অর্থাৎ উপার্জনক্ষম।
- ↑ নাফায়=লাফায়।
- ↑ সাকরিদ=শিষ্য।
- ↑ নাই=নাপিত।
- ↑ ফুলাইয়া ফিরে মোছ=মোছ ফুলাইয়া বেড়ান শারীরিক সামর্থ্যের পরিচায়ক। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে কালকেতুর বর্ণনা তুলনীয়, যথা, “মুচড়িয়া দুই গোঁফ বান্ধে নিয়া ঘাড়ে।”
- ↑ দেও বিরিক্ষ। দেও=দেবতা। এই বৃক্ষে দেবতা (ভুত) আশ্রয় করিয়া আছে, লোকের এই বিশ্বাস ছিল। যদিও “দেও” ও “দেব” একই শব্দ, তথাপি “দেও” শব্দ বাঙ্গালায় ভূতার্থ বাচক হইয়াছে।
- ↑ দিরি=দিকে।
- ↑ হাইরা কোণায়=ঈশান কোণে।
- ↑ প্যালা=ভাঙ্গা ঘর ঠেকাইয়া রাখিবার জন্য বংশদণ্ড; গুইঞ্জা=গুঁজিয়া যোগ দিয়া।
- ↑ বাসুক=বাসুকে।
- ↑ বইয়া=বসিয়া।
- ↑ খাওয়ার দিব্য=দিব্য আহার্য্য; সুন্দর খাবার।
- ↑ কাইলা দেওয়া=কালো মেঘ।
- ↑ কাণে মালুম নাই=তোমার স্বর শুনিয়। ঠাহর করিতে পারি নাই।
- ↑ ঘুমের......ছাই=ঘুমের ঘোরে কি ছাই ভষ্ম বলিয়া ফেলিয়াছি।
- ↑ নাটী =নড়ী, ষষ্ঠি
- ↑ কারবান=কাহার।
- ↑ থোনে=থেকে।
- ↑ কেওয়ার=খিল; অর্গল।
- ↑ নোড়ায়া=দৌড়াইয়া।
- ↑ কৈল=কহিল।
- ↑ কেওয়ার মার=অর্গলবন্ধ কর; খিল দাও
- ↑ পোক পাকালী বুইনা=পক্ষী পাখালী ও বন্যজন্তুর মত আমাকে অগ্রাহ্য করলি অর্থাৎ আমার আদেশ লঙ্ঘন করিয়া চলিয়া গেলি।
- ↑ দোয়াই দেই=দোহাই দিতেছি; শরণ লইতেছি।
- ↑ বুড়া ঠাইরাইণ=‘বুড়া ঠাকুরাণী’ বা ‘বুড়া মা’ গ্রামে গ্রামে এখনও পূজা পাইয়া থাকেন; ইনি শক্তিরূপিণী চণ্ডী দেবীরই অন্য সংস্করণ
- ↑ কাহা কাহা—কা কা।
- ↑ ওপাইরা ভারাইটা=ওপারের ভাড়াটিয়া; নদীর অপর পারের যাত্রী।
- ↑ ঠাকুর আর ঠাইরাইন=ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণী।
- ↑ আপন ভারা রাইখা=নিজের ভাড়া ছাড়িয়া, অর্থাৎ লভ্যাংশ ত্যাগ করিয়া।
- ↑ সুবিতা=সুবিধা।
- ↑ দিন......গারা=এখনও চা’র পাঁচ দিন তার নৌকা চলাচল বন্ধ থাকিবে (মাটিতে লগি বা চইড় পোতা থাকিবে)।
- ↑ কাছি=দড়ি।
- ↑ আগার নিগার নাই=এত বড় যে তাহার পরিমাণ করা শক্ত, ‘লেখা জোখা নাই’ এইরূপ অর্থ, আগার=আকার।
- ↑ ভুরা=ভেলা।
- ↑ যাব=যাবে।
- ↑ দাইড়া···নাড়ে =শ্মশ্রুবিশিষ্ট ব্রাহ্মণ ছাগলের মত শ্মশ্রু সঞ্চালন করিবে
- ↑ কাইয়া=কাক।
- ↑ পোক=পাখীর অপভ্রংশ।
- ↑ পাকালি=পাখালি, পোক পাকালি অর্থ পাখি পাখালি।
- ↑ দিব্যে=দ্রব্যে।
- ↑ জর্ম্ম=জন্ম।
- ↑ টোপলা=বস্তা।
- ↑ আন্ধাইর=আন্ধার।
- ↑ আচিল=ছিল।
- ↑ আছাড়ি=বাট।
- ↑ কিবান=একি, কিবা
- ↑ বরমবধ=ব্রহ্মবধ। বরমশাপ=ব্রহ্মশাপ।
- ↑ কল্ল মাটির তল=মৃত্তিকাগর্ভে প্রোথিত করিয়া রাখিল।
- ↑ আশ্যি পশ্যি=আশেপাআশের লোক; পাড়াপ্রতিবেশী।
- ↑ হাইটা=হাটিয়া, হেটে।
- ↑ য়্যাহন তহন=মুমূর্ষু, এখন তখন।
- ↑ দাঐ=ঔষধ।
- ↑ বাগা নাঠি=বাঘা লাঠ, বৃহদাকৃতি যষ্ঠি
- ↑ খাটাখুটা=খর্ব্বাকৃতি; ‘খাটখোট’।
- ↑ নাফা গোফা=‘নাদুস নুদুস'; স্থূলকায়।
- ↑ কাঞ্জী=আমানি।
- ↑ তশ্যু=আগামী পরশ্বের পরদিবস।
- ↑ মরা কান্দে নইয়া=মৃতদেহ স্কন্ধে বহন করিয়া।
- ↑ ইপিণ্ডার=এই দেহপিণ্ডের।
- ↑ ক্যারমে ক্যারমে=ক্রমে ক্রমে।
- ↑ তফিলগুণ বার নৈল=তহবিলপত্র বাহির করিয়া লইল।
- ↑ কাইঠা চিড়া=কাঠের মত শক্ত শুক্না চিঁড়া।
- ↑ কোরোশ তিনি ঘাটা=তিন ক্রোশের পথ।
- ↑ টলটলা=স্বচ্ছসলিল; এখানে ‘টলটলা’ ও ‘কলকলাইয়া চলে’ এই দুইটি পদ ব্যবহৃত হইয়া যথাক্রমে জলের নির্ম্মলত্ব এবং প্রবাহের মৃদুমধুর তান সূচিত করিতেছে। ভারতচন্দ্র তুলনীয়, “ছলচ্ছল্ টলট্টল্ কলক্কল্ তরঙ্গা।”
- ↑ নিয়াস=নিশ্বাস।
- ↑ দিরে=দিকে।
- ↑ আজইল=অঞ্জলি।
- ↑ মৌঢালা=মধুস্রাবী; মধুময়।
- ↑ পইরাণী=পরী।
- ↑ বর্ণক=‘ক’ দ্বিতীয়া বিভক্তির চিহ্ন।
- ↑ লৌ ছোটে জানে=শোণিত প্রবাহ দ্রুত ও উষ্ণ হয়।
- ↑ দুই নয়নে........নাড়া=অপাঙ্গদৃষ্টির সময় চক্ষুর ঘন কৃষ্ণ তারকাদ্বয় ইতস্ততঃ সঞ্চালিত হইয়া আগ্নেয়াস্ত্রের মত দর্শকের প্রাণ হরণ করে।
- ↑ বৈশ্যাল=বেশ্যা।
- ↑ দ্যাপ্তা=দেবতা; গৃহলক্ষ্মী।
- ↑ দিল্=অন্তর।
- ↑ ঘাটা=পথ।
- ↑ আপনে......ঘর=আপনি যদি কৃপা প্রকাশ করিয়া আমার গৃহস্থালী যাহাতে বজায় থাকে তাহার ব্যবস্থা করেন।
- ↑ জীবমানে=যাবজ্জীবন।
- ↑ জুটি=যোগ্য পাত্র; অনুরূপ বর।
- ↑ জবর ঘুম=গাঢ় নিদ্রা।
- ↑ মাইজান=মধ্যমা।
- ↑ ছান্......আছান=স্নান সমাপন করিয়া বাড়ী ফিরিয়া তাহারা স্বস্তি পাইল না (রান্না না হওয়ায়)।
- ↑ তেমু=তবুও।
- ↑ হউড়ি=শ্বাশুড়ী।
- ↑ গালির......তালী=শিং মাছের কাটার আঘাতের উপর প্রলেপ দিল।
- ↑ নতুন ইষ্টি=নূতন কুটুম্ব অর্থাৎ ভাবী জামাতা।
- ↑ ফোটা......বাঘ=শ্বশুর স্নানান্তে ফোটা তিলক করিয়া বাঘ সাজিয়া আহারের প্রতীক্ষায় বসিয়া রহিল।
- ↑ মাইজাল=ঘরের মেঝে।
- ↑ চক্কু...নাল=চক্ষু লাল হইল অর্থাৎ ক্রুদ্ধ হইলেন।
- ↑ হাম্বিতাড়া=তর্জ্জন গর্জ্জন।
- ↑ পুরী=মাণিকতারার অন্য নাম; পিতৃগৃহে ব্যবহৃত আদরের নাম।
- ↑ নোন্দগোণ=ননদেরা।
- ↑ ঐষ্ঠক্ষণ=অষ্টপ্রহর।
- ↑ ওরাইয়া=উড়িয়া গেল অর্থাৎ নিঃশেষিত হইল।
- ↑ নালুচে=লালসায়, লোভে।
- ↑ আচপোইনা শালে=আচমন করিবার স্থানে। (“আচপন শালা” হইবে)
- ↑ মোণ্টব=মণ্ডপ।
- ↑ কতা=কথা।
- ↑ ঘরে বাইরে......তাক্=মাণিকতারা সমান ভাবে ভিতরের ও বাহিরের কাজ করে; তাহার কার্য্যদক্ষতার পুরুষেরও চমৎকার লাগে।
- ↑ তার উপুর......নাক=কার্য্যে তাহার এইরূপ একনিষ্ঠ প্রীতি যে তাহার কার্য্যের উপর অপরের কর্তৃত্বে সে অসহিষ্ণু হইয়া উঠে। তাহার নাক কাটিয়া রাখে=তাহাকে জব্দ করে।
- ↑ চান্=চান্দ।
- ↑ দিরি=দিকে।
- ↑ কাঞ্চা বসে=কাঁচা বয়সে; তরুণ বয়সে। অল্পবয়সে কিরূপে সে নিজে গৃহ কার্য্য করিয়া আহারাদি প্রস্তুত করিবে।
- ↑ বিদপা=বিধবা।
- ↑ হেই=সেই। যাব=যাবে
- ↑ আধামত দিল=অর্দ্ধেক সম্মত হইল।
- ↑ বিয়াল বেলা=বিকাল বেলা।
- ↑ টেহা=টাকা।
- ↑ গাহান=গান।
- ↑ অয়=হয়।
- ↑ পরচে=বর কন্যাকে পর্চা করা; বরণকরা।
- ↑ জোন্মায়স্তী=জন্মায়ুষ্মতী; চিরায়ুষ্মতী।
- ↑ টোনা=যাহাতে স্বামী বশীভূত হয়, সেইরূপ মেয়েলী প্রক্রিয়া। যথা উড়িয়া গানে “ভজন সাধন নাহি জানন্তু, জানে বাঙ্গালিনী টোনা”
- ↑ দুই হস্তে=মাতার দুই হস্তে। এন্দুর=ইন্দুর।
- ↑ শুইজবার=শুধিবার; পরিশোধ—করিধার।
- ↑ হেন্দুর......মাটি=হিন্দুর শাস্ত্র প্রামাণ্য বটে; কিন্তু সমস্ত মাতৃঋণ এই ইন্দুরের মাটি দিয়া পরিশোধিত হইল, এই কথা কি সত্য?
- ↑ পশ্যি জোন=প্রতিবেশী।
- ↑ বাইড়া জুটি=অনুরূপ জীবন সঙ্গিনী; যোগ্য পত্নী।
- ↑ যেমন পুত্র তাহার তেমনি বধূ, উৎকৃষ্ট মিলন হইয়াছে।
- ↑ বাসু....ঘর=বাসুশীল তারাকে এক্লা রাখিয়া গৃহবহির্ভূত হইল না।
- ↑ বিচ্রাইল=অনুসন্ধান করিল।
- ↑ কাঞ্চি কোণাতে=কোণে কাণাচে; গৃহের সর্ব্বত্র।
- ↑ কৈলজার নহু=বক্ষের রক্ত।
- ↑ চঙ্কের=চক্ষুর।
- ↑ ঘরে........ ..চুমুক দিমু=আমার মুখের কাছে সুপেয় পানীয় জল রহিয়াছে! আমি কি সরবৎ ফেলাইয়া বিষের পাত্রে চুমুক দিব?
- ↑ হইরকাল=হরিকালী নামক পক্ষী।
- ↑ ফাটক=ফাঁদ।
- ↑ হেকমত=ফন্দী; প্রণালী।
- ↑ ধুন্কী বাটেল=ধলুক ও বাটুল।
- ↑ সাইঞ্জার=সাঁঝের; সন্ধ্যার।
- ↑ কয়=কত।
- ↑ আছার পিছার নইল=মাছাড় পিছাড় খাইয়া ছট্ফট্ করিতে লাগিল।
- ↑ মাত্=চমৎকার।
- ↑ শিগার=শিকার।
- ↑ দুষ্মণ=শত্রু।
- ↑ বইতাম সিঙ্গাসোনে=সিংহাসনে বসিতে পারিতাম অর্থাৎ রাজা হইতে পারিতাম।
- ↑ গিরস্তালী.........ছাড়=তোমার সঙ্গ ছাড়া আমাদের গৃহস্থালী চলিবে না, অর্থাৎ তোমার আমার মধ্যে কোনও ব্যাপার গোপন থাকিলে আমাদের গৃহস্থালী চলিতে পারে না।
- ↑ অন্বিশ্বাসী=অবিশ্বাসী।
- ↑ আনছান=তস্ততঃ করা অর্থাৎ দ্বিধা বোধ করা।
- ↑ তর=তোমার।
- ↑ জান=প্রাণে
- ↑ কি পত্তি দেহ তারে=তাহাকে কি প্রতিদান দিবে। পত্তি= পথ্য, এখানে খাওয়ার জিনিষ বা উপহার।
- ↑ বাইল্ল=বাড়িল।
- ↑ ঘরের.........ডরে=তোমার ভয়ে আমি লুণ্ঠিত বিত্ত সম্পত্তি গৃহ হইতে, স্থানান্তরিত করিয়াছি।
- ↑ যাবার নয়রে=যাইতে উদ্যত হয়।
- ↑ শাঙ্খনীর ধোরা=যেমন শাঁখিনী সাপের কাছে ঢোঁড়া সাপ একেবারে আড়ষ্ট হইয়া পড়ে।
- ↑ নছিব=অদৃষ্ট।
- ↑ বিশাস জোয়ানের=বিশজন শক্তিমান্ পুরুষের।
- ↑ অন্দলের=অন্ধের।
- ↑ চাইকের মধু=মধু চক্রের মধু।
- ↑ বিশ মর্দ্দ=বিশজন সমর্থ পুরুষ।
- ↑ দুই কর্ত্তা=ডাকাইত দলের নেতৃদ্বয়, অর্থাৎ বাসু—ও কানু।
- ↑ তাগর=তাহাদের।
- ↑ জুম্বাবার=নমাজ বা উপাসনার দিন।
- ↑ আজুইল=অঞ্জলি।
- ↑ হুন্ল=শুনিল।
- ↑ হুমহুমিয়া=বাহকেরা হুম্ হুম্ শব্দ করিয়া।
- ↑ পাড়াপাড়ি=মস্ত তোলপাড়।
- ↑ জোন পোঞ্চাশেক=পঞ্চাশ জনের মত।
- ↑ গুরা=নৌকার তক্তার পাটাতন যে ছোট খুটির উপর পাতান হয়, উহাকে ‘গুরা’ বলে; সুতরাং ‘গুরা’ নৌকার ‘ডালি’ বা তলভাগে অবস্থিত।
- ↑ দো দো জনার=এক সঙ্গে দুই দুই জন করিয়া।
- ↑ নায়ের কর পাড়া=নৌকার পাড়া পুতিয়া রাখ অর্থাৎ নৌকা বাঁধিয়া রাখ।
- ↑ অপ্ছর=অবসর।
- ↑ তা না অইলে..ঘাট=নতুবা গঞ্জের ঘাটে তাহাদিগকে ডুবাইয়া মারিবে। (?)
- ↑ সোমে=সময়ে।
- ↑ বিয়ান বেলা—সকাল বেলা; প্রভাতকাল। প্রাচীন বাঙ্গালায় “বিহান যথা “বিহানে বিকালে বীর শুনেন পুরাণ”—কবিকঙ্কণ চণ্ডী।
- ↑ হাতিয়ার=অস্ত্রশস্ত্র।
- ↑ ভাইবা....চিন্=ভাবিতে ভাবিতে তারার মুখে হঠাৎ আনন্দের চিহ্ন প্রকাশিত হইল (কালুর মুক্তির উপায় উদ্ভাবন করিয়া)।
- ↑ জেহার=জহর; মণিমুক্তা।
- ↑ রঙ্গাইলা নায়=রঙ্গিন ও সুসজ্জিত নৌকায়।
- ↑ বাইয়ালী=নর্ত্তর্কী।
- ↑ রোস্নাই=আলোক মণ্ডিত হইয়া।
- ↑ ভাইটান=ভাটীর দিকে।
- ↑ সোন্দর=সুন্দর।
- ↑ দারু=সুরা; মদ্য।
- ↑ সোমে=সময়ে।
- ↑ ঠাট=ঠমক; ভুলাইবার ফন্দী।
- ↑ ছিরকল=শৃঙ্খল।
- ↑ খাইয়া কালুর হাতা=কালুর হাতে মা’র খাইয়া।