পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/মদনকুমার ও মধুমালা

মদনকুমার ও মধুমালা। ২৭৫—৩১০ পৃঃ

 এক সময় গঙ্গার উপকূল হইতে সুরু করিয়া বিশাল পদ্মাতীর এবং ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র ও শীতলাক্ষা-ধবলিত সুবিস্তৃত ভূখণ্ডে মধুমালার গল্প প্রচলিত ছিল। ইন্দ্রের দুই অপ্সরা মধুমালা ও মদনকুমারকে একটি রাত্রের জন্য মিলিত করিয়া এক অপূর্ব্ব ভ্রান্তিবিলাসের সৃষ্টি করিয়াছিল। তাহাই নহে; মদনকুমারের আংটিটি তাহারা দিয়াছিল মধুমালার আঙ্গুলে, আর মধুমালার আংটি পরাইয়াছিল মদনকুমারের আঙ্গুলে। মদনকুমারের খাটে মধুমালাকে আর মধুমালার পালঙ্কে মদনকুমারকে তাহারা শোয়াইয়া দিয়াছিল। বাস্তব জগতে মিলনের এই অপূর্ব্ব প্রমাণ রাখিয়া তাহারা এই দুই নায়কনায়িকার জন্য প্রেমের যে বাগুরা রচনা করিয়াছিল, তাহাতে দুইটি প্রাণীই ধরা পড়িয়া গিয়াছিল। আমরা ছোটকাল হইতে এই রূপকথাটি শুনিয়া আসিয়াছি; গল্পকারিণীর মুখে “আমি স্বপ্নে দেখিলাম মধুমালার মূখ রে”—অতি শৈশবে শুনিয়াছি, সেই গীতের রেশ এখনও কাণে বাজিতেছে। মদনকুমার পাগল হইয়া গেলেন। তিনি নিদাঘনিশীথের বসন্ত বায়ু ভোগ করিতে করিতে একটি মধুর স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন, একথা ভাবিবার সুবিধা কোথায়? “স্বপন যদি মিথ্যা হ’ত, তার আংটি কেন আমায় দিত”? “স্বপন যদি মিথ্যা হত, খাট-পালঙ্ক কেন বদল হত”? অপ্সরাদের কয়েক মুহূর্ত্তের রঙ্গরসের ফলে “বুঝাইলে না বুঝে কুমার হইল পাগলা। খাওনে শোওনে কান্দে কোথায় মধুমালা”। মধুমালারও সেই অবস্থা। এই রূপকথাটি বঙ্গদেশের ভিন্ন ভিন্ন জেলায় এত বিভিন্নরূপে প্রচলিত আছে যে সেগুলির সমস্ত ছাপাইতে গেলে একটা প্রকাণ্ড পুস্তক হইয়া পড়িবে। বটতলায় মধুমালা ছাপা হইয়াছে, তাহা ছাড়া দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার মহাশয় আর একটা সংস্করণ ছাপাইয়াছেন। তৃতীয়টি এইখানে ছাপা হইল। এই ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণের মিল যেরূপ আছে, গরমিলও তেমনই আছে। তবে এ কথাটি বলা দরকার যে, এই সংস্করণে যে রমণীরা ইন্দ্রপুরীর কন্যা বা অপ্সরা বলিয়া অভিহিত, তাহারাই অন্যত্র পরী নাম উল্লিখিত হইয়াছে। কোন কোন স্থানে ইহাদের ডানা দেওয়া হইয়াছে। স্থানে স্থানে এইরূপ বিজাতীয় অবয়বে উপস্থিত হইলেও, এই গল্পটি যে খাঁটি বাঙ্গালা রূপকথা তৎসম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নাই। পরবর্ত্তী সময়ে মুসলমানী প্রভাবে অপ্সরারা পরী হইয়া গিয়াছেন। এখানে কিন্তু ইহারা ইন্দ্রপুরীর কন্যারূপেই প্রথমতঃ উপস্থিত হইয়াছেন, যদিও শেষের দিক্‌টায় বিদেশী প্রভাবের ফলে ইহাঁদিগকে মাঝে মাঝে ইন্দ্রপুরীর পরী বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে।

 এই গল্পে অপ্সরাদের উত্তর-প্রত্যুত্তর-বঙ্গের সুপ্রাচীন গল্পমালার চিরপরিচিত বিহঙ্গম-বিহঙ্গমার উত্তর প্রত্যুত্তরেরই মত। বঙ্গদেশের এই ভাবের একটি রূপকথা: “Faithful John” নামে য়ুরোপে প্রচারিত হইয়াছিল। গ্রীম ভ্রাতৃদ্বয় তাহা প্রকাশ করিয়া আমাদের বিহঙ্গম বিহঙ্গমাকে পাশ্চাত্য রাজ্যে সুপরিচিত করিয়াছেন। আমার Folk Literature of Bengal নামক পুস্তকে এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা আছে।

 মধুমালার গল্পটি কাব্য হিসাবে বড় আসন পাইতে পারে না। যে হেতু দীর্ঘকাল যাবৎ ছেলেদের মনোরঞ্জনার্থ কথিত হওয়ার দরুণ ইহা কতকটা শিশুজগতের উপযোগী হইয়াছে। কিন্তু ইহার ভিত্তিতে যে একটা কবিত্বমূলক উচ্চ আদর্শ ছিল, তাহার নিদর্শন অনেক স্থলেই পাওয়া যাইবে। প্রেমের জন্য অপূর্ব্ব সহিষ্ণুতা ও ত্যাগ-যাহা কাঞ্চনমালা, কাজল রেখা ও মালঞ্চ মালার দৃষ্ট হয়—তাহার ছিটা ফোঁটা এই গল্পটির মধ্যেও আছে। পূর্ব্বোক্ত গল্পগুলির নারী চরিত্রের মত মধুমালার, প্রাণ-প্রতিষ্ঠা হয় নাই-আজগুবি অংশের উপর. উপাখ্যানে বেশী জোর দেওয়া হইয়াছে,—শিশুদিগকে ভুলাইবার জন্য। মধুমালা অন্ধ স্বামীর চক্ষুদান করিতেছেন, কিন্তু তিনি একটি সর্ত্তে আবদ্ধ। স্বামী যদি চক্ষু পাইয়া তাহার দিকে লুব্ধ দৃষ্টিতে চাহেন, তবে তিনি পুনরায় অন্ধ হইবেন, এবং সে অন্ধত্ব কিছুতেই ঘুচিবে না। প্রেমিকা জানিতেন—সকল প্রেমিকাই জানেন, চক্ষু পাইলেই নায়ক প্রেম-দৃষ্টিতে প্রেমিকার দিকে চাহিবেন—ইহা অকাট্য। যদি তিনি পূর্ব্বেই তাঁহাকে সাবধান করিয়াও ঔষধ প্রয়োগ করিতেন, তথাপি স্বামীর সেই ব্যাকুল চাউনি এড়াইতে পারিতেন না। স্বামী শত চেষ্টা করিলেও দৃষ্টি সংযমিত করিতে পারিতেন না। এমতাবস্থায় যে একটি মাত্র উপায় ছিল, মধুমালা তাহাই অবলম্বন করিলেন—অর্থাৎ সর্ত্তের নির্দ্দিষ্ট কাল—বার বৎসরের জন্য স্বামীকে ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন।

 এই দীর্ঘকাল কত দুঃখ, কত বিপদ, কত উৎকট পরীক্ষার মধ্যে পড়িয়া স্বামীকে প্রতি ধাপে ধাপে অলক্ষিত ভাবে ধ্বংসের মুখ হইতে বাঁচাইয়া মধুমালা শেষে স্বর্গে চলিয়া গেলেন; যেন প্রখর একখানি তারোয়াল খেলিতে খেলিতে চোখ ধাঁধিয়া চলিয়া গেল; রমণীর অসাধারণ প্রতিভা যেন বিঘ্ন-সঙ্কুল তিমিরাবৃত একটি রাজ্যকে ক্ষণতরে আলোকিত করিয়া চলিয়া গেল। খর বিদ্যুদ্দামের মত তাঁহার রূপ, ততোধিক তাঁহার প্রত্যুতপন্নমতিত্ব, ততোধিক সংযম—যেন আমাদিগকে একটি স্বর্গের ছবি দেখাইয়া হঠাৎ নিবিয়া গেল।

 কিন্তু এই রূপকথায় এত বড় সাজ-সরঞ্জাম থাকা সত্বেও ইহা শিশুদিগেরই বেশী উপযোগী করা হইয়াছে। ইহার রস তরল হইয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছে—আজগুবির অরণ্যে উদ্‌ভ্রান্ত হইয়া গিয়াছে; তাহা পুষ্ট হইয়া কাব্যশ্রীমণ্ডিত চাইতে পারে নাই। কিন্তু তথাপি সেই শৈশবশ্রুত “স্বপ্নে দেখিলাম মধুমালার রূপ রে” আমাদের মনে অফুরন্ত রসের ধারা খুলিয়া দেয়। শৈশবে কতবার রাস্তায় রাস্তায় কৃষক কণ্ঠোচ্চারিত “স্বপ্ন যদি মিথ্যা হত, তার আংটি কেন আমায় দিত”—এই সুরতরঙ্গ কাণে আসিয়া পৌঁছিত। পূর্ব্ববঙ্গের পুরাতন যুগের শিশুরা মধুমালার কাহিনী লইয়া মাতোয়ারা ছিল। এই খাঁটি বাঙ্গালা রূপকথাটি আমাদিগকে অনেক বড় বড় কাব্যকে মনে করাইয়া দিবে। বেহুলার মত মধুমালা ডুমুনী সাজিয়া ‘খারীবিউণী’ বিক্রয়ের ছলে পিত্রালয়ে গিয়াছিল। তা’র মা যখন তা’কে চিনি চিনি করিয়াও চিনিতে পারেন নাই, অথচ ব্যাকুলভাবে তাহাকে ধরিয়া রাখিতে চাহিতেছিলেন, তখন সে ব্যঙ্গের স্বরে বলিয়াছিল; যিনি মা হইয়া মেয়েকে চেনেন না, এমন মায়ের কাছে থাকিয়া কি হইবে? (৩০৭পৃঃ) এবং স্বামী যখন তাহাকে দেখিয়া “নাক মুখ তোমার মতন, তোমার মতন চেহারা। চিন্যা নাহি চিন্‌তে নারি বার বচ্ছর ছাড়া।” বলিয়া বিলাপ করিতেছিলেন, তখন ছদ্মবেশিনী ডুমুনী মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিয়া ফেলিয়াছিল, “সোয়ামী হইয়া চিন্‌তে নারে যে আপনার নারী। তাহার কাছে যে আমি থাকিতে না পারি। (৩০৯, পৃঃ)।

 চন্দ্রকুমার বাবু এই পালাটি মৈমনসিংহ হইতে সংগ্রহ করিয়াছেন। কিন্তু এখনও বঙ্গের প্রতি জেলাতেই বোধ হয় ইহা ভিন্ন ভিন্ন আকারে প্রচলিত আছে। “মধুমালা” শেষে বঙ্গীয় জনসাধারণের সংস্কারে পরীরূপে পরিণত হইয়া গিয়াছিল। “মধুমাতী-সাধন” নামক একরূপ নায়িকা-সাধনের উল্লেখ কোন কোন পুস্তকে দৃষ্ট হয়। বৃন্দাবন দাস-কৃত চৈতন্যভাগবতে বিদ্রূপস্থলে এই সাধনের উল্লেখ আছে।

 গল্পের বর্ত্তমান সংস্করণটি চন্দ্রকুমার বাবু কৃষকদিগের মুখে যেমন শুনিয়াছেন, ঠিক সেই ভাবেই লিখিয়া লইতে চেষ্টা করিয়াছেন। একাজ বড় দুরূহ। শিক্ষিত লোকের লেখনী মাঝে মাঝে, চাষার কথার প্রতি ঘৃণার দরুণই হউক অথবা অভ্যাসগত অনবধনতা বশতই হউক, প্রাচীন রচনার উপর অনেকটা সংশোধন কার্য্য করিয়া থাকে। কয়েক স্থানে বর্ত্তমান সংগ্রাহক এই দোষ এড়াইতে পারেন নাই। তথাপি ইনি চাষার ভাষা যতটা খাটি রাখিয়াছেন, ততটা আর কোনও সংগ্রাহক রাখিতে পারিয়াছেন বলিয়া আমার জানা নাই।

 পূর্ব্ব মৈমনসিংহের ভাষা হইতে কয়েকটি সূত্র উদ্ধার করা যায়—(১) ‘ট’স্থান অনেকস্থলে তদ্দেশবাসীরা ‘ড’ ব্যবহার করেন, যথা ‘বেটা’ স্থলে ‘বেডা’ (২৭৮ পৃঃ); জটা=জডা (২৭৯ পৃঃ); মাটি=মাডি (২৮৩ পৃঃ) সেইটা=সেইডা (২৮৫ পৃঃ); পিটাইয়া=পিডাইয়া (২৮৯ পৃঃ); কথাটা=কতাডা (২৮৯ পৃঃ); কান্দাকাটি=কান্দাকাডি (২৯০ পৃঃ); মেয়েটারে=মাইয়াডারে (২৯০ পৃঃ); ছিটাইয়া=ছিডাইয়া (২৯৫ পৃঃ); পক্ষীটা=পক্ষীডা (২৯৫ পৃঃ); একটা=একডা (২৯8 পৃঃ)। কখন কখনও ‘ঠ’স্থানেও ‘ড’ ব্যৱহৃত হয়:—যথা কাঠুরিয়া=কাডুরিয়া (২৮৯ পৃঃ); কোঠা=কোডা (২৮৩ পৃঃ); পাঁঠা=পাঁডা (২৯২ পৃঃ); এইটা=এইডা (৩০০ পৃঃ)—এরূপ বহু উদাহরণ আছে; ‘শ’ ও ‘স’ স্থানে ‘হ’ পূর্ব্বববঙ্গের নিম্নশ্রেণীর মধ্যে প্রায় সর্ব্বত্রই ব্যবহার হইয়া থাকে; পূর্ব্ব-মৈমনসিংহে এই ব্যবহার বহুল পরিমাণে দৃষ্ট হয়:—যথা সেই=হেই (২৭৯, ২৮৪, ২৮৫ পৃঃ), সকল= হগ্‌গল (২৯৬, ৩০০, ৩০১ পৃঃ); শুন্‌ল=হুন্‌ল, সে=হে (২৯৭ পৃঃ) সাচা=হাচা (২৯৬ পৃঃ)। সুরিতে, (ঝাঁট দিতে)=হুরতে (২৮০ পৃঃ); শুন=হুন (২৮০ পৃঃ); ‘ক’ স্থানে ‘গ’—সকল=সগল (২৭৯ পৃষ্ঠ) জোকার=জোগার (২৮১ পৃঃ); শিকার=শিগার (২৮৭ পৃঃ)। ‘হ’ স্থানে ‘অ’ যথা হইতাম=অইতাম (২৮৭ পৃঃ); হরিণ=অরিণ (২৮৮ পৃঃ); হইব=অইব (২৯১ পৃঃ); হইয়া=অইয়া (২৯১ পৃঃ); হইয়াছিল=অইয়াছিল (২৯২ পৃঃ); হইতাম=অইতাম (২৭৮), আতের=হাতের (১৭০ পৃঃ); বিভক্তিগুলি মাঝে মাঝে বিচিত্র অবয়বে দৃষ্ট হয়, যথা:—পঞ্চমীতে, কোথা হইতে “কোথা তনে” (২৮৮ পৃঃ), বাড়ীথ্যে=বাড়ীথেকে, (২৭৮ পৃঃ)। সপ্তমীতে মাটীতে স্থলে “মাটীিৎ” (২৭৯ পৃঃ) বাড়ীতে=বাড়ীৎ (২৮২ পৃঃ) গলাতে=গলাৎ (২৯০ পৃঃ) ক্রিয়া-পদেরও নানা আকার দৃষ্ট হয়; বাহুল্যভয়ে তাহা এখানে দেওয়া গেল না, পাঠক তাহার উদাহরণ পত্রে পত্রে পাইবেন।

 চাষাদের কোন কোন ঘটনা বর্ণনা করিবার একটা বিশেষ ভঙ্গী আছে, তাহা কবিত্বপূর্ণ। ভাষা স্থানে স্থানে এত ঘোরাল যে ঠিক পূর্ব্বঙ্গের লোক না হইলে সেই কবিত্বের রসাস্বাদ অন্যে করিতে পরিবেন কিনা সন্দেহ, একটি নিদর্শন দিতেছি—“এক দিন হইল কালি হাঞ্জা রাইত, আন্ধাইরে আর চান্নিতে মিইশ্যা গেছে” (২৮০ পৃঃ) কালি হাঞ্জা=সাঁঝের আঁধার একেবারে যে সূচি-ভেদ্য অন্ধকার তাহা নহে, মেঘাবৃত ক্ষীণ চন্দ্রিকা আঁধারের কোলে মিশিয়া কতকটা আলো-আঁধারের সৃষ্টি করিয়াছে। পূর্ব্ববঙ্গের লোকের মনে এই সকল কথায় যেরূপ স্পষ্ট একটা প্রাকৃতিক দৃশ্য উদিত হইবে, পদ্মার এপারে ঐ সকল কথার গ্রাম্যতা দোষের দরুণ সেরূপ স্পষ্ট ছবি মনে আসিবে না।



মদন কুমার ও মধুমালা

(১)

বন্দনা।

পরথমে বন্দিয়া গাইলাম আদি নিরাঞ্জন।
স্বর্গ মর্ত্ত্য বন্দিয়া গাইলাম যত দেবগণ॥
মাও বন্দুম[১] বাপ বন্দুম যত সভাজন।
মিন্নতি করিয়া বন্দি ওস্তাদের চরণ॥
চান্দ সূরুয বন্দি আসমান জমীন।
স্থলে বন্দুম পশু পংখী জলে বন্দুম মীন॥
সপ্ত পাতালে বন্দি নাগ আর নাগুনি[২]
সুন্দরবন বন্দিয়া গাইলাম বাঘা আর বাঘুনী[৩]
পূবেতে বন্দিয়া গাইলাম পূবের ভানুসর।[৪]
দক্ষিণে বন্দিয়া গাইলাম ক্ষীর নদী সায়র॥
পশ্চিমে বন্দিয়া গাইলাম গয়া কাশী যত।
উত্তরে বন্দিয়া গাইলাম কৈলাস পর্ব্বত॥
অধমেরে সভাজন না করিও হেলা।
চাইর কোণা পিরথিমী বইন্দা[৫] শুরু করলাম পালা॥

 এক আটকুড়[৬] রাজা। রাজা যুদি[৭], তার কুনু[৮] পুত্রু[৯] সন্তান নাই। এর লাইগ্যা[১০] রাজা খুব দুষ্কিত[১১]। রাজা যেমন দুষ্কিত রাজ্যের লোকও হেইমত[১২] দুঃখিৎ। রাজা এরুর[১৩] লাগ্যা যত রকম পূজাআর্‌চা[১৪], বর্ত্তপালি[১৫] দেবদানবে মানসিক কইরা, কিচ্ছুতেই কিছু হইল না। এই দারুণ কষ্ট মনের মধ্যে লইয়া রাজা আছে—থাকে—খায়। এর মধ্যে এক দিন অইল[১৬] কি রাজার নাপিত একদিন রাজাকে কামাইতে আইল। আৎকা[১৭] কামাইতে কামাইতে রাজার আঙ্গুল কাইট্যা গেল। সভার যত মন্ত্রী, সভাবত্যা[১৮] লোক নাপিত বেডা[১৯]রে গাইল[২০] দিতে লাগ্‌ল। সাত ছালার বুদ্ধির নাপিত[২১] হাত যোড় কর‍্যা কইল—দোয়াই[২২] ধর্মাবতার! আমার কিছু দোষ নাই। বাড়ীথ্যে[২৩] আওনের[২৪] সময় এক আটকুড় মালী বেডার মুখ দেখ্যা আইছি।[২৫] এর লাগ্যাই আমার এই দৈচ্ছত[২৬]। রাজা এই কথা হুন্যা[২৭] খুব দুঃখিৎ অইল। আমি রাজ্যের রাজা এরু লাইগ্যানা—। আমি যদি মালী অইতাম তা অইলে মাইন্‌ষে[২৮] কত কথাই না হম্‌কে[২৯] কইতো। রাজা দেখ্যাই অপর্‌কে[৩০] এমন অয়[৩১], তা না অইলে, আমিও যেমন আটকুড়, মালীও ত হেইমত আটকুড়। খায় না, ছান করে না, রাজা মনের জ্বল্লা[৩২] কষ্টে জোড় মন্দিরের কবাট খাট্যা অত্যা দিয়া পইড়া রইল। জান্ থাকতে রাজা আর চান্ সূরুয, পূব পচ্চিম[৩৩] দেখত না[৩৪]। এই মতে এক দুই তিন কইরা সাতদিন গুঁয়াইয়া যায়, এমন সময় রাজ্যে এক সন্ন্যাসী ঠাকুর আইলাইন[৩৫]। রাজা কই? রাজা কই? রাজা ত আইজ[৩৬] সাত দিন সাত রাইত[৩৭] মন্দিরের কবাট খোলে না। না খায় দানা—না ছয়[৩৮] পাণি। এর এতু[৩৯] কি? জান্‌তে জান্‌তে সন্ন্যাসী জান্‌ল—রাজার কুনু পুত্রু সন্তান নাই। আটকুড় রাজা মনের দুষ্কে অত্যা দিছে। অনেক কওয়া বলার পর রাজা কইল যে, সন্ন্যাসী যা চায়, তাই দিয়া বিদায় কইরা দেও। আমি আর বাইর অইতাম না[৪০]। সারা ভাণ্ডারের ধন দিলেও সন্ন্যাসী চায় না। সন্ন্যাসী চায় রাজার নিজের আতের[৪১] এক মুঠ ভিক্ষা।

 লোক লস্করের কথায় রাজা বাইরে আইয়া[৪২] সন্ন্যাসীরে পন্নাম[৪৩] কর্‌ল। সন্ন্যাসীর মাথায় খুব লাম্বা[৪৪] লাম্বা জডা[৪৫], সারা শইলে[৪৬] ভস্মমাখা; হাতে বেতাগা[৪৭]। লোক লস্কর ও রাজার মুখে এই সগল[৪৮] বির্ত্তান্ত[৪৯] হুইন্যা সন্ন্যাসী বাড়ীর মধ্যে পরথমে একটা বাড়ি[৫০] মার্‌ল। এই বাড়িতেই মাটি[৫১] ফাইট্যা[৫২] গেল; পাছে আরেক বাড়ি। এইবারে একটা গাছ উঠ্‌ল। তার পরে আরেক বাড়ি। এইবারে গাছে আম ধর্‌ল। তার পর আরেকবাড়ি—আম পাক্‌ল। আরেক বাড়িতে আম মাটিৎ[৫৩] পড়্‌ল।

 সন্ন্যাসী এই আম লইয়া রাজারে কইল—এই আমটা নিয়া রাণীরে খাওয়াও। তোমার ঘরে সুপুত্রু জন্মিবে। এই কথার পর রাজ্যের মধ্যে একটা ধুয়া বানের[৫৪] মত লাইগ্যা গেল। সন্ন্যাসী নাই, হেই আমগাছও নাই। হগ্‌গলে আচানক[৫৫] লাইগ্যা গেল। রাজা রাণীরে আমটা খাওনের[৫৬] লাগ্যা দিল। এই আম খাইয়া রাণীর গর্ভ হইল। এক মাস, দুই মাস করিয়া দশ মাস, দশ দিন যায়—রাজ্যে আনন্দের সীমা নাই।

(৩)

 এমন সময় আরেকটা কি কাণ্ড হইল হুন। কি কাণ্ড?—রাজার বাড়ীর মালী পর্‌তি দিন[৫৭] খুব সকালে বাড়ী হুর্‌ত[৫৮] যায়। একদিন হইল কি কালি হাঞ্জা[৫৯] রাইত, আন্ধাইরে[৬০] আর চান্নিতে[৬১] মিইশ্যা[৬২] গোছ। রাইত না দিন বোঝা যায় না। তখন হইল কি—মালী নিশি রাইতের আমলে[৬৩] রাইত পোষাইয়া[৬৪] গেছে মনে কইরা ঝাঁটা হাতে রাজবাড়ীর দিকে গেল। বাড়ীর লোক লস্কর সব ঘুমায়। একজন মানুষেরও শব্দ টব্দ নাই। এমন সময় দেখে কি—আচানক এক পুরুষ; মাথার মধ্যে খুব লাম্বা জডা, আগুনের মত দুই চোখ ঢ ঢ করিতেছে[৬৫]। এই না দেখ্যা মালী তাক্[৬৬] লাইগ্যা গেল। তার পরে মালী জিগাইল[৬৭]—তুমি কে হও ঠাকুর? ঠাকুর কইলাইল—তুই মুনু(ষ)[৬৮]; তোর কাছে এই সব কথা কওন[৬৯] যায় না মালীও ছাড়ে না—কও ঠাকুর, না কইলে ছাড়তাম না[৭০]। মালী ঠাকুরের পাও আঞ্জাইয়া[৭১] ধরল। তখন ঠাকুর কইলাইন্[৭২]—আমার কথা তর কাছে কইতাম[৭৩] পারি, যদি তুইন্‌[৭৪] কেউর[৭৫] কাছে না কছ[৭৬]। মালী পরতিজ্ঞা করল। ঠাকুর কইলাইন্‌—আইজ রাত দিন যখন দুই ভাগ অইব[৭৭] তখন রাজার ঘরে[৭৮] একটী পুত্রুসন্তান অইব[৭৯]। আমি করম পুরুষ[৮০] ঠাকুর। মানুষ জন্ম লইবামাত্রই তাহর সুখদুঃখু কপালে লেইখ্যা[৮১] দেই। মালী কইল—অতদিন পরে রাজার ছাল্যা[৮২] অইব—তুমি তার কপালে কি লেখ্যা আইছ[৮৩]

 ঠাকুর কইলাইন—তর কাছে যে আমার পরিচয় দিছি, এই বেশী। কইছ যখন ঠাকুর তখন মনুষ্যের কাছে কপালের লেখা কওন যায় না। কইছ যখন ঠাকুর তখন১ বেবাক[৮৪] কথাই কও—মালী ঠাকুরের পাও ধরিল। ঠাকুর মালীরে সমজাইয়া[৮৫] কইল—তর কাছে এইকথা কইতাম পারি কিন্তু তুই যদি কেউর কাছে এইকথা কছ, তা অইলে[৮৬] তুই একটা গাছ অইয়া[৮৭] যাইবে।

 মালী পরতিজ্ঞা করিল—আচ্ছা ঠাকুর আমি কেউর কাছে কইতামনা[৮৮], বাও[৮৯] বাতাসের কাছেও না। ঠাকুর তখন কইলেন,—বান্ন বছরের মধ্যে যদি রাজা ছাওয়ালের মুখ দেখে, তা অইলে রাজা একটা গাছ অইয়া যাইবে। এই কথার পরই রাজ্যে একটা ধুয়া বানের মতন হইয়া গেল। ঠাকুর আর নাই। কালিহাঞ্চা কাইট্যা[৯০] গেলে মালী দেখল যে আরও দুই চারি দণ্ড রাইত আছে। বাড়ীৎ[৯১] গিয়া মালী কেবল এই কথাই ভাবতে লাগ্‌ল কেউর কাছে কিছু কয়না, কেবল ভাবে। রাইত দিন দুই ভাগ হয় সময়[৯২] রাজার বাড়ীৎ পাঁচ ঝাড় যোগার[৯৩] পড়ল। রাজ্যের লোকের আর বুঝনের বাকি রইল না যে রাজার ঘরে এক ছাওয়াল[৯৪] জন্মিয়াছে।

মালীর গলার মধ্যে কাঁটা লাগ্‌ল—খোয়াইলে[৯৫] মরে—ঢোক্ গিল্লেও মরে।

গান:— ভাবিয়া চিন্তিয়া মালী মন করিল দড়[৯৬]
রাজার কাছে কইব কাইল নিশির খবর॥
আমি যদি মরে যাই তাতে কোনো ক্ষতি নাই।
আমার পরাণ দিয়া কেন্না[৯৭] রাজারে বাঁচাই।
এক হাতে ঝাঁটা লইল আর হাতে কোদাল।
রাজার বাড়ীৎ যায় মালী রাত্রিশেষের কাল॥

 মালী রাজবাড়ীতে গিয়া দেখল কি—রাজা পাত্র মিত্র লগে[৯৮], হীরামণ মানিক্যি লইয়া পুত্র মুখ দেখ্‌তে যায়। মালী রাজার পায় গিয়া উবুৎ[৯৯] হইয়া পড়ল।

গান:— শুন শুন রাজা আরে কইয়া বুঝাই তরে।
পুত্রুর মুখ দেখতে তুমি (ভালা) না যাইয়ো অন্দরে॥
কালরাত্রে কালস্বপন দেখ্যাছি[১০০] যে আমি।
তুমি রাজা মইরা যাইবা মইরা[১০১] যাইবা তুমি॥

 রাজা আচানক লাইগ্যা মালীকে কারণ জিজ্ঞাসা করলাইন[১০২] মালী কইল—মহারাজ আমি কইতাম পারি কিন্তু এইকথা কইলেই আমি একটা গাছ হইয়া যাইবাম। আমার কথা না রাইখ্যা[১০৩] যদি পুত্রু মুখ দেখুইন্[১০৪], তা হলে আপনে[১০৫] একটা গাছ হইয়া যাইবাইন[১০৬]। কতক্ষণ ধন্ধ[১০৭] লাইগ্যা থাক্যা রাজা কইল—না, তর এই কথাটা কহনই[১০৮] লাগ্‌ব[১০৯]। তখন মালী করমপুরুষের যত কথা সব ভাইঙ্গা[১১০] রাজার কাছে কইল। অইল কি?—কথাটা কওন মাত্রই মালী একট গাছ হইয়া গেল। আচানক দেইখ্যা যত লোক লাকর পাত্র মিত্র রাজাকে পুত্রু মুখ দেখ্‌তে না করল। তার পরে অইল কি রাজা (এই) মাডির তলে একটা চোর কোডা[১১১] বানাইয়া বার বচ্ছরের খাওল[১১২] খোড়াক দিয়া রাণীরে, ছেলেরে ও একটা দাসী লগে দিয়া বার বচ্ছরের লাইগ্যা পাতাল পুরীতে পাডাইয়া[১১৩] দিল। এই তিনজন হেইখান[১১৪] খুব সুখে আছে, খায়। কপালের লেখা খণ্ডায় এমন কার বাপের সাধ্যি। বার বচ্ছরের একদিন বাকি আছে। আর একদিন গেলেই রাজা পুত্রু মুখ দেখতে পারবে—রাজ্যে খুব ধুমধাম হইতেছে। এমম সময় হইল কি—দুপইরা[১১৫] বেলা রাণী ঘুমাইতেছে। রাজবাড়ীর ধুমধাম দেখ্‌বার জন্য দাসী বাহিরে আইয়া[১১৬] পড়ল। কিন্তু, দাসী কপাট[১১৭] খাইট্যা থইয়া আইছিল না[১১৮]। আৎকা[১১৯] ঘুম থাক্যা উইঠ্যা রাজকুমার শুনে কি যে উপরে খুব সুন্দর একটা বাদ্যি শোনা যাইতেছে। কপাট খোলা,— রাজকুমার তাড়াতাড়ি মার কাছে না কইয়া বাইরে আইয়া পড়ল। তারা তিনজন ছাড়া আর কুনু লোকজন দেখ্‌ছে না[১২০]। দালান কোঠা, লোক জন, হাতী ঘোড়া, গাছ বিরিখ্[১২১]—এই সব না দেখ্যা রাজকুমার এক্কেবারে চমকিয়া গেল। যাইতে যাইতে এক্কেবারে রাজার দরবারে। চান্দের মতন সুন্দর কুমার—সেইক্ষণে রাজা তার মুখের দিকে চাইল, তখনই সিংহাসনের উপরে একটা গাছ হইয়া গেল। রাজ্য জুইড়া[১২২] তখন একটা কান্দাকাটির রোল পইড়া গেল। কিন্তু অদৃষ্টের লেখা ত আর খণ্ডান যায় না। মন্ত্রীটন্ত্রীর অনেক কওন বোঝানতে রাজকুমারই রাজা হইল। রাজ্যের লোকে তার নাম রাখল মদন কুমার।

(৫)

গান:— মদন কুমার রাজার কথা এইখানে থইয়া[১২৩]
ইন্দ্রপুরীর কন্যার কথা শুন মন দিয়া।

 দেওয়ের[১২৪] রাজা সে ইন্দ্র—সেই ইন্দ্রের সভায় তিন কন্যা নাচন করিত। কাঁচা সরার উপর উঠ্যা নাচন[১২৫] করন[১২৬] লাগত। দৈবাৎ একদিন নাচন কর্‌তে কর্‌তে ছোট বইনের[১২৭] নাইচের[১২৮] সরা ভাঙ্গিয়া গেল। তখন ইন্দ্র মুন্যি[১২৯] দিলাইন[১৩০]—বার বচ্ছর মর্ত্ত্যলোকে মুনিষ্যির ঘরে জর্ম্ম[১৩১] লইয়া আরও বার বচ্ছর খুব দুষ্কু[১৩২] পাইয়া পাপমোচন অইলে পর আমার সভায় জাগা[১৩৩] পাইবা। তখন তিন বইনে খুব কান্দাকাটি কর্‌ল। কিন্তু, দেবতার মুন্যি অখণ্ডি[১৩৪]। এর পর বার বচ্ছর যায়, এর মধ্যে মধ্যুম[১৩৫] যে সে বড় বইনেরে কইল—আমরার[১৩৬] ছুডু[১৩৭] বইন মর্ত্ত্যলোকে কার ঘর জন্ম লইছে[১৩৮]—লও[১৩৯] গিয়া দেখ্যা আয়ি[১৪০]। তখন পংখীর বেশে দুইজন ইন্দ্রপুরী থাক্যা বাইর অইয়া উড়্যা চল্ল। এক রাজার মুল্লুক থাক্যা—আরেক রাজার মুল্লুক,—এই রকম কর‍্যা ঘুরতে লাগল। এই রকমে আর এক রাজার পুরীতে যাইয়া একটা জোড়মন্দির ঘরে মৌপুকের[১৪১] মতন অইয়া প্রবেশ করল। দেখে কি!—একটা সোণার পালঙ্কের উপরে শুইয়া ঘুমাইতেছে। হেই মুখ, হেই কান, হেই চোখ, একটুও বেতিক্রম অইছে না[১৪২]। দেখ্যাই[১৪৩] তারার[১৪৪] ছুডু বইন্‌রে চিন্‌ল। মধ্যুম বইনে কইল—বইন্‌ত পাইলাম। কিন্তু অখন[১৪৫] যে বিয়ার যোগ্য। পিরথিমিরে তার যুগ্যি[১৪৬] জামাই খুঁজ্যা আয়ি চল। তখন দুইজন আবার পংখীর বেশ ধইরা ফির‍্যাবার[১৪৭] ঘুর্‌তে চল্‌ল।

গান:— এক মুল্লুক ছাড়া তারা আর মুল্লুকে যায়
মনের মতন সুন্দর জামাই তল্লাসি বেড়ায়।
যাইতে যাইতে গেল উজানি নগর
যথায় বসতি করে রাজা দণ্ডধর॥

 দেখ্‌তে সোণার পুরী। সোণার ঘরের মধ্যে উড়্যা যাইতে তারা উপুর[১৪৮] থাক্যা দেখ্‌ল যে একটা মন্দিরের মধ্যে একটা চেরাগের রোশনাই মত দেখা যাইতেছে। তখন দুই বইন উড়্‌তে উড়্‌তে হেই মন্দিরে চূড়ায় বইল[১৪৯]। মালুম কইরা[১৫০] দেখে কি?—মন্দিরের মধ্যে যেন একটা আগুনের মত জ্বলতাছে[১৫১]। তখন দুই বইন্, মৌপোকের বেশ ধইরা মন্দিরে মধ্যে পর্‌বেশ করল। হেইডা[১৫২] আগুণ ত না, মদন কুমারের রূপ। দেখ্যা দুইজন খুব মোহিত হইল। এইক্ষণ দুইজনরে মিলাইয়া দেখন[১৫৩] বাকি তখন দুইজনে পালঙ্ক সমেত মদন কুমাররে লইয়া সরবরাসর[১৫৪] ছুডু বইনে কাছে নিয়া রাখল। হঠাৎ মধুমালা জাগ্যা উঠ্‌ল। উঠ্যা দেখে কি!—পালঙ্কের উপরে এক রাজকুমার ঘুমাইতেছে। তখন মধুমালা একটা গান করল:—

গান—(মধুমালা)।

একেলা শুইয়া আছ্‌লাম[১৫৫] (আরে) পালঙ্কের উপরে
কোথাতনে আইলারে কুমার জোড়মন্দির ঘরে।
কপাটে সোণার খিল মক্ষি[১৫৬]র আইতে[১৫৭] মানা
কেমন কইরা সুন্দর কুমার করে আনাগোনা॥

জাগিয়া সুন্দর কুমার দেওনারে উত্তর।
কিবা নাম মাতাপিতার কোথায় বাড়ী ঘর॥
কিবা নাম ধইরা তোমায় ডাকে বাপ মাও।
জাগ জাগ সুন্দর কুমার কত নিদ্রা যাও॥
কোন্ ফুলের ভ্রমরা তুমি আইছরে উড়িয়া।
বুক না করিয়া খালি আইসাছ[১৫৮] ছাড়িয়া॥

 তখন মদন কুমার জাগ্যা আর একটা গান কর্‌ল।

 মদন কুমারের গান:—

উজানি নগরে ঘর নামে রাজা দণ্ডধর (গো রাজকন্যা)
আমি তার পুত্র মদন কুমার(রে)।
মন্দিরে আছিলাম শুইয়া নিদ্রায় বিভুল[১৫৯] হইয়া (গো রাজকন্যা)
আমি কেম্‌নে আইলাম তোমার ঘরে(রে)॥
কার পুরী বা কার ঘর কন্যা কিবা নামটী তোমার (গো রাজকন্যা)
কিবা নামটী তোমার বাপমার (রে)।
মধুমালা— কাঞ্চন নামেতে ঘর তার রাজা হীরাধর (গো রাজকুমার)
আমি তার কন্যা মধুমালা(রে)।

* * * * *

 এইরূপে দুইজনের মধ্যে খুব ভালবাসা জন্মিল। কিন্তু তারা কিছুতেই বুঝত পার্‌ল না যে কেমন কইরা মদন কুমার এইখান আইল। তখন ভাব্‌তে ভাব্‌তে ফির‍্যাবার তারা ঘুমাইয়া পড়্‌ল। তখন দুই বইনে মদন কুমাররে লইয়া উজানি নগরে রাখ্যা ফির‍্যাবার ইন্দ্রপুরে চল্য। গেল।

(৬)

 রাইত যখন শেষ অইল, তখন মদন কুমার জাগ্যা দেখে মধুমালা নাই। এই না দেখ্যা হায় মধুমালা! হায় মধুমালা! কইতে কইতে ঘরের বাইর ভাইল। কেউ কিছু বুঝ্‌ত[১৬০] পারে না।

গান:—

মায়েতে জিজ্ঞাসা করে কাইন্দা কুমার ভূমিত[১৬১] পড়ে
আমি স্বপনে দেখি মধুমালার মুখ রে।
স্বপন যদি মিথ্যা হইত তার আংটি কেন আমায় দিত
স্বপনে দেখি।
স্বপন যদি মিথ্যা হইত খাট পালঙ্ক কেন বদল হইত
আমি স্বপনে দেখি।

 পাত্রমিত্র লোকজনে অনেক বুঝাইত পড়াইত[১৬২] লাগল। কিন্তু মদন কুমার কিছুতেই প্রবোধ মানিতে চাইল না। স্বপ্ন নয়।

যদি স্বপ্ন হইত, তা হইলে হাতের আংটী, খাট, পালঙ্গ বদল হইত না।

অন্ন নাই সে খায় কুমার নাহি খায় সে পানি
মধুমালার লাইগ্যা কুমার অইল উন্মাদিণী।[১৬৩]
মায় বুঝায় মইস্যে[১৬৪] বুঝায় বুঝায় লোকজনে
যত বুঝায় মদনকুমার পর্‌বোধ না মানে॥
কান্দিয়া কাটিয়া কুমার মন কর্‌ল দড়
বন্দেতে যাইব[১৬৫] কুমার বারিতে শিগার[১৬৬]
তুমি বাছা এক পুত্র দুক্ষিণীর ধন
কেমন কইরা তোরে বাছা যাইতে দিবাম বন॥
বুঝাইলে না বুঝে কুমার হইল পাগলা
খাওনে শুওনে[১৬৭] কান্দে কোথা মধুমালা॥

 মদন কুমার তখন শিগারে যাত্রা কর্‌ল। মায়ে সঙ্গে লোক লস্কর হাতী ঘোড়া গিয়া দিল।

আমি স্বপ্নে দেখ্‌ছি মধুমালার রূপ।
মদনকুমার যাত্রা করে হারুইলেতে মানা করে
আমি স্বপ্নে দেখছি মধুমালার মুখরে॥
মদনকুমার শিগারে যায় কান্দিয়া অভাগী মায়
ধান্য দুর্ব্বা গাইটে[১৬৮]তে বান্ধিলরে।
বাঁও[১৬৯] পা’র ধুলা দিয়া ভরে[১৭০]তে কাজল দিয়া
গলাত[১৭১] ধইরা কত যে কান্দিলরে॥

* * * *

(৭)

 লোক লস্কর সঙ্গে লইয়া উজানি নগর ছাইড়া চল্যা গেল। এক রাজার মুল্লুক—এইরূপে যাইতে যাইতে সামনে দেখে সে একটা অরণ্য জঙ্গল। দেখে কি সে একটা সোনার অরিণ[১৭২] দৌড়িয়া যাইতাছে। মদনকুমার এরে না দেখ্যা পাছে পাছে দৌড়াইতে লাগল। সঙ্গের লোক জন যে কই পইড়া রইল তার খুঁজ খবর নাই। আন্ চোক্[১৭৩] চাইয়া দেখে সে অরিণও নাই। তখন মদনকুমার ভাব্‌তে লাগল:—

পরথমে শিগারে আইলাম জঙ্গলাতে পর্‌বেশ করলাম
কোথাতনে আইল সোনার অরিণরে।

* * * * *
* * * * *

 তখন ঘুরতে ঘুরতে কই যায়, কি করে—! এক গাছতলায় বস্যা চিন্তা কর্‌তে লাগল। এই দিগে খাওন পানি বেগর[১৭৪] খুব কষ্ট পাইতে লাগল। এই সময় দেখে যে একদল কাডুরিয়া[১৭৫] কাডের[১৭৬] বুঝা[১৭৭] লইয়া যাইতেছে[১৭৮]। নিরূপায় অইয়া মদনকুমার তারার দলে গিয়া মিশ্‌ল। তখন মদনকুমার করে কি? পর্‌তি দিনই তারার লগে কাঠ কাডে[১৭৯] আর কাডের বুঝা লইয়া নগরে বেচত[১৮০] যায়।

 একদিন এক বুড়া কাডুরিয়ার মুখে মদনকুমার শুন্‌তে পাইল যে এই দেশের (যে) রাজ কন্যা আৎকা একদিন রাইত পাগল অইয়া গেছে। ফুইদ্[১৮১] কইরা মদনকুমার জান্‌ল যে রাজকন্যা কেবল মদনকুমার মদনকুমার কইরা কান্দে। বাজারে ঢুল[১৮২] পিডাইয়া[১৮৩] দিছে যে, যে এই রাজ কন্যারে ভালা করত পারব[১৮৪], তারে চাইর আনি রাজত্ব লেখ্যা দিব। তখন মদনকুমায় বুড়া কাডুরিয়ারে কইল যে তুমি গিয়া ঢুলে ধর। তখন বুড়া কাডুরিয়া গিয়া ঢুলে ধরল। রাজার লোকজন বুড়া কাডুরিয়ারে রাজার নিকট লইয়া গেল। রাজা ফুইদ্ কর্‌ল—তুমি আমার কন্যারে ভালা কর্‌তা পারবা[১৮৫]? তখন কাডুরিয়া কইল—পারবাম[১৮৬]। আপনার কন্যা ইচ্ছাবর লইব বল্যা[১৮৭] যত দেশের যত রাজপুত্রু আছে নিমন্তন্ন করখাইন[১৮৮]। ও! আরেকটা কথা কিন্তু রইয়া গেছে। মদনকুমার এই কথাডা[১৮৯] কিন্তু আগেই কাডুরিয়ারে শিখাইয়া দিছিল।

 যত দেশের যত রাজকুমার নিমন্তন পাইয়া রাজপুরীতে আইল। রাজ্য জুইড়া এক্কেবারে চান্দের বাজার বইয়া গেল। ঠিক এই সময় কাডুরিয়ার বেশ ধইরা মদনকুমার রাজ বাড়ীর নিকট এক গাছের তলায় গিয়া বইয়া রইল। আগে আরেকটা কথা কইতে ভুল কর্‌ছি। কাডুরিয়ার মুখে, মধুমালা যে পাগল অইছে এই কথা শুন্যা সে যে এই রাজ্যে আইছে, এই কথাডা একটা পত্র লেখ্যা এক কাড়ুরাণীরে দিয়া মধুমালার নিকট পাডাইয়া দিছিল্[১৯০]। স্বয়ংবরের দিন রাজ্যে একটা ভয়ানক গণ্ডগোল বান্ধ্যা[১৯১] গেল। যত রাজকুমার হগ্‌গল তারে থইয়া[১৯২], মধুমালা কর্‌ল কি? কাডুরিয়াবেশী মদনকুমারের গলাত দিল। রাজ্যের লোকের একটা ঘিন্নার ভাব জন্মিয়া গেল। রাজা আর মধুমালার পাঁচ ভাই গোসা কইরা তারা দুইজনরেই এমুন একটা অরণ্য জঙ্গলার মধ্যে নিব্বাস[১৯৩] দিয়া আইল যেখান[১৯৪] নাকি জনমানুষের নামগন্ধ নাই, কেবল বাঘ ভালুকের রাজত্বি।

 এই অরণ্য জঙ্গলার মধ্যে দুইজনে পইড়্যা কান্দাকাডি করতে লাগল। তারার সঙ্গে মা বাপে না দিছে একমুঠ চাউল চিড়া। খিদায় পিয়াসায় দুইজন খুব কাতর অইয়া পড়ল। তখন মদনকুমার বন থাক্যা ফল আন্‌ত গেল[১৯৫]। গিয়া দেখে কি? একটা গাছে দুইডা পাতা আর দুইডা ফল। মদনকুমারের খুব খিদা পাইছিল[১৯৬]। সে দুইডা ফলই পাইড়া একটা ফল গাছের তলায় খাইয়া ফাল্‌ল[১৯৭]। আরেকটা ফল মধুমালার খাওনের লাগ্যা রাখ্‌ল। এই ফলটা খাইতে মাত্রই মদনকুমার অন্ধ হইয়া গেল। তখন আর তার মধুমালার কাছে ফিরা যাওনের[১৯৮] শক্তি রইল না। তখন মধুমালা মদনকুমারকে বিচরাইতে[১৯৯] বাইর অইল। কতক দূর যাইয়া দেখে যে তার অন্ধ স্বামী বনের মধ্যে পইড়া তাকিতুকি করতাছে[২০০]। মধুমালা যখন দেখল যে তার সোয়ামী অন্ধ অইয়া গেছে, তখন আর তার দুঃখের সীমা রইল না। তখন মদনকুমার ও মধুমালা একটা গাছ তলায় শুইয়া কান্‌তে[২০১] লাগল। কানতে কান্‌তে মদনকুমার ঘুমাইয়া পড়ল।

(৮)

মধুমালার দুঃখের কাইণী[২০২] এইখানে থইয়া
ইন্দ্রপুরীর কন্যার কথা শুন মন দিয়া।

 সেই যে মধ্যম বইন্ বড় বইন্‌রে জিগাইল[২০৩]—আচ্ছা, কওছে[২০৪] অতদিন গুঁয়াইয়া যায়, হেই যে আমরা দুই জনেরে একখানে মিলাইয়া আইছলাম[২০৫]; তারপর আর কোন খোঁজ খবর নাই। চল, ছোট বইনকে দেখ্যা আসি। অখন বড় বইন ছোট বইনের কাছে মদনকুমার ও মধুমালার সমস্ত দুষ্কের কথা কইল।—কি রকমে তারার বিয়া অইল, কি রকমে বনবাসী অইল, আর কি রকমে বা অন্ধই হইল। তখন ছুডু বইন্ কইল—লও যাই চক্ষের দেখা দেখ্যা আই তখন দুইজন পরী তোতার বেশ ধইরা, সেই যে গাছ—যে গাছের তলে মদনকুমার মধুমালা ঘুমাইতে আছিল—হেই গাছে গিয়া বইল[২০৬]। মদনকুমার তখনও ঘুমাইতেছে। মধুমালা জাগ্যা শুনে কি!—গাছের উপরে কিয়ে[২০৭] জানি কথা বার্ত্তা কইতাছে[২০৮]। তারা দুই বইনে তখন কথা কইতাছিল[২০৯]। ছুডু বইনে বড় বইনেরে কয়—বইনের এই যে কষ্ট অইছে, তা কেমনে যাইব[২১০] আর মদনকুমারেরই বা কেমনে চক্ষুদান অইব[২১১]। তখন বড় বইনে কইল— এই বনের মধ্যে একটা অমির্ত্তি[২১২] ফলের গাছ আছে। হেই গাছ হইতে যদি একটা ফল আইন্যা[২১৩] খাওয়ায় তা অইলে ভালা অইব[২১৪]। তখন ছুডু বইনে কইল এই কথাডা আমি গিয়া মধুমালার কানে কইয়া আয়ি[২১৫]। তখন বড় বইনে কইল—তাতে আরেকটা বিপদ আছে। এই ফল খাইলে মদনকুমার ভালা অইব ঠিক, কিন্তু সে ভালা অইয়া যদি লোভের চক্ষে আর একবার মধুমালার দিকে চায়, তা হইলে আর একবার যে অন্ধ অইব[২১৬], আর ভালা অইত না[২১৭]। এই কথা কইয়া ইন্দ্রপুরীর কন্যা ইন্দ্রপুরীতে চল্যালেন। কারণ, তারার ইন্দ্রপুরীতে নাচ গান করণের[২১৮] সময়টা ঘনাইয়া আইছিল[২১৯]। এই দিকে মধুমালা জাগ্যা কর্‌ল কি হেই অমির্ত্তি ফলের সন্ধানে বাইর[২২০] অইল। গিয়া হেই অমির্ত্তি ফলের গাছে থাকা একটা ফল পাইড়া আন্‌ল। ফল পাইড়্যা আন্যা[২২১] মদনকুমারকে জাগাইল। জাগাইয়া কইল—আমি জল লইয়া আয়িগা[২২২] তুমি এই ফলটা খাও। এই কথা কইয়া হে[২২৩] খুব তাড়াতাড়ি বনের মধ্যে চইল্যা গেল। কারণ, সে জান্‌তো যে তার সোয়ামী ভালা হইয়া লোভের চক্ষে তার দিকে চাইলেই আবার অন্ধ হইয়া যাইবে। এই মিয়াদটা বার বছরের লাইগ্যা। মধুমালা যখন মদনকুমাররে ছাইড়া যায় তখন তার খুব কষ্ট অইছিল।

(৯)

গান:— মদনকুমারের কথা এই খানে থইয়া।
কি করিল মধুমালা শুন মন দিয়া॥
কান্দিতে কান্দিতে কন্যা মেলা দিয়া যায়।
বারনা বচ্ছরের লাইগ্যা সোয়ামী ছাইড়া যায়॥

 বার বচ্ছরের লাইগ্যা মধুমালা তার সোয়মীরে ছাইড়া যাইতাছে[২২৪]। তার চক্ষের জলে বনের লতা পাতা ভিইজ্যা[২২৫] যাইতাছে। এক বন থাইক্যা আর বন, আর বনথাক্যা আর বন—এই রকমে অনেকদূর চইল্যা গেল। এই সময়ে ক্ষিধো তেষ্টায় তার পরাণ ফাইট্টা যাইতাছিল[২২৬]। একটা গাছের তলায় শুইয়া ঘুমাইয়া পড়্‌ল। বনের মধ্যে খুব একটা গণ্ডগোল আরম্ভ অইল।

 একদেশের এক রাজকুমার শিকারে আইছিল[২২৭]। সে কর্‌ল কি!—মধুমালারে পাইয়া জোর কইরা তারে তার দেশে লইয়া গেল। সে রাজ্যের মধ্যে ঢোল পিডাইয়া দিল যে, রাজকুমার বন থাকা যে একটা পরীর মতন সুন্দর স্ত্রীলোক ধইরা আন্‌ছে, তারে বিয়া করব[২২৮]। সেই রাজ্যে আছিল এক নাপিত। সেই নাপিতের বউ একদিন মধুমালারে গিয়া দেখ্‌ল। নাপতানি এমন সুন্দর মাইয়া লোক[২২৯] আর কখখনও দেখ্‌ছে না[২৩০]। হে মনে করল যে কোনো রাজরার মাইয়া[২৩১] জোর কইরা ধইরা লইয়া আইছে[২৩২]। এরে যদি কোনো রকমে রাজার হাত থাইক্যা উদ্ধার কর্‌তাম্ পারি[২৩৩], তাহইলে খুব পুরস্কার পাইব। তখন হে মধুমালার কাচে বইসা তার যত দুঃখের কথা হুন্‌ল[২৩৪]। হুইন্যাই[২৩৫] হে রাণীর কাছে গেল। রাণীরে এই কথা কইয়া বুঝাইল যে রাজা যে নতুন বিয়া কর্‌তাছে[২৩৬], সে সেইরকম[২৩৭] পরীর মাফিক সুন্দর—সে যদি রাণী হয় তাহইলে এরাজ্যে আর তোমার জাগা নাই। তখন মনে মনে রাণী ভাব্‌ল যে কথাত ঠিকই। রাণী তখন নাপতানীরে কইল যে—এই বিয়া যদি কোনো রকমে না কোনো রকমে বা এই মাইয়াডারে[২৩৮] যদি রাজ্যের মধ্যে থাক্যা কোনো রকমে সরাইতে পারছ[২৩৯], তা অইলে আমার গায়ের যত অলঙ্কার সব তোরে দিয়াম[২৪০]; আরো লক্ষ টাকা দিয়াম।

 অলঙ্কারের কথা হুইন্যা নাপ্‌তানী নাপিতের কাছে গিয়া সব কথা ভাইঙ্গা[২৪১] খোলাসা কইল। তখন সাতছালা বুদ্ধির নাপিত নাপতানীরে একটা পরামর্শ দিল। এই কথাটা নাপতানী গিয়া আবার রাণীর ঠাঁই কইল; মধুমালার কাছেও কইল! তখন ঠিক হইল যে বিয়ার রাইতা চেলী কাপড় পইড়া রাণী মধুমালা ঘরে গিয়া থাকবে। আর মধুমালা রাণীর কাপড় চোপড় অলঙ্কার পইরা রাণীর বেশ ধরবে। তারপর অইলগা[২৪২]— বিয়ার দিন মধুমালা রাণীর কাপড় চোপড় পইরা[২৪৩] পলাইল। মধুমালা যাওনের সময় তার গায়ের যে অলঙ্কার পত্র কাপড় চোপর আছিল—সব নাপতানীরে দিয়া এক পুরুষের বেশ ধইরা যাইতে লাগল তারপর যাইতে যাইতে, যাইতে যাইতে ছয় মাস পরে উজানী নগরে মদনকুমারের বাড়ীৎগিয়া অতিথ অইল[২৪৪]। মদনকুমারের মা একমাত্র পুত্রশোকে কান্‌তে কান্‌তে এক্কেবারে অন্ধ অইয়া গেছে। মধুমালা কইল যে আমি মদনকুমারের বন্ধু আমি তারে দেখ্‌তাম আইছি[২৪৫]। তখন মদনকুমারের মা কাইন্দ্যা কাইন্দ্যা[২৪৬] কইল—বাপুরে! আমার মদন কি আর আছে। আইজ[২৪৭] কয় বছর যায় আমি তার লাইগ্যা কান্‌তে কান্‌তে চোখ আরাইছি[২৪৮]। তখন মধুমালা কইল—মা তুমি কাইন্দনা; আমারে একডা ডিঙ্গা দেও, আর কএকজন লোক; আমি তার উদ্দিশ কর‍্যা আই[২৪৯]। তহন হে ডিঙ্গা বাইয়া রওনা হইল। তার সোয়ামীর বাড়ীঘর রাজত্বি দেইখ্যা হে খুব সুখী অইছিল[২৫০]। বাইট্যাইল[২৫১] বাতাসে ডিঙ্গা বাইয়া যাইতাছে[২৫২]; ছাদের উপর মধুমালা ঘুমাইতেছে।

(১০)

মধুমালা কন্যার কথা এইখানে থইয়া।
ইন্দ্রপুরীর কন্যার কথা শুন মন দিয়া॥

 মধ্যম বইন বড় বইনের কাছে কইল,—অনেক দিন হয়, মধুমালা, বনের মধ্যে অন্ধ সোয়ামীরে লইয়া আছিল[২৫৩] দেইখ্যা আইছি[২৫৪]। অখন হে কোন খানে আছে, একটা খোঁজ লওনের কাম[২৫৫]। তখন বড় বইন কইল যে— “এই দুঃখুই দুঃখু না, আরো দুঃখু আছে। মধুমালার দুঃখুর কথা কইবাম তোমায় পাছে”। শেষে মধ্যম বইনের কথায় তারা দুইজন পক্ষীর বেশে উড়্‌তে উড়্‌তে মধুমালার ডিঙ্গার মস্তুলে গিয়া বইল[২৫৬]। তখন মধ্যম বইন বড় বইনেরে কইল—কওছে, এই যে, এত কষ্ট কইরা মধুমালা তার সোয়ামীর উদ্দিশে বাইর অইছে[২৫৭], কই[২৫৮] গেলে তারে পাইব[২৫৯]। তখন বড় বইন কইল যে—মদনকুমার পরীর স্থানে চইল্যা গেছে। মধুমালা যদি পরীর দেশে যাইতে পারে[২৬০], তা অইলে মদনকুমাররে অন্‌ত পারব[২৬১]। মধ্যম বইন কইল যে পরীর মুল্লুকে যাওনের পথ কোন্‌খান দিয়া। তখন বড় বইন কইল যে এই নদী দিয়া যাইতে যাইতে চাইরটা ডাল[২৬২]—এক ডালে দিয়া, দেখ্‌ব[২৬৩] যে দুধের মত পানি যায় আর যত রকম ফুল ভাইস্যা যাইতাছে; হেই ডাল দিয়া গেলে পরীর মুল্লুক পাইব। হেই পরীর মুল্লুকে পরীরা মদনকুমাররে তোতাপক্ষী বানাইয়া রাখ্‌ছে তখন মধ্যম বইন আবার জিজ্ঞাসা করল—তারে উদ্ধার করব কি রকমে। তখন সেই বড় বইন কইল— ইন্দ্রের পুরীর মধ্যে যে অমৃতসরোবর আছে, হেইখান থাক্যা[২৬৪] জল আন্যা যদি পক্ষীডার গায় ছিডাইয়া দিত পারে[২৬৫] তা অইলে পক্ষীডা মানুষ অইয়া যাইব। তখন আবার মধ্যম বইন কইল—পরীরা তারে দেখ্‌লে মাইরা ফালতনা[২৬৬]? তখন বড়বইনে কইল এই কথা যে—হেইখানে হে কুনুরকমে লুকাইয়া থাইক্যা পরীরা যে ইন্দ্রপুরীত্[২৬৭] যায় সেই রথ কোনো রকমে লুকাইয়া রাখ্‌ত পারে অ্যার কোনো রকমে যদি পরীরা এক রাইত ইন্দ্রের পুরীতে না যায় তা অইলে ইন্দ্রের শাপে তারাও পক্ষী অইয়া যাইব[২৬৮]। কিন্তু সতী কন্যা ছাড়া কেউ স্বর্গের যাইত পারত না[২৬৯] পরীর মুল্লুকেও না।

 এই কইয়াই দুই বইন উইড়া গেল। মধুমালা কিন্তু শুইয়া শুইয়া হেই কথা গুলাইন্‌ হুন্‌ল[২৭০]। তখন আবার ভাইট্যাল ডিঙ্গা বাইয়া যাইতে লাগল। যাইতে যাইতে সেখানে নদীর চাইর ডাল, যে ডালে দুধের সোত বইত, হেই ডাল দিয়া যাইতে যাইতে পরীর মুল্লুকে গিয়া দাখিল অইল। গিয়া দেখে কি এইখানে কেবল সোনারূপার ঘর আর কেবল ফুলের বাগান। কত যে ফুল ফুইট্যা রইছে তার সীমা সংখ্যা নাই। মধুমালা রাইত হেইখান গেছিল[২৭১]। দেখে কি?—সোনারূপার সব ঘর পইড়া রইছে, একটা মানুষও নাই। তখন হে একটা ঘরের মধ্যে গিয়া দেখল, কত রকমের যে ফল পইড়া রইছে তার আর সীমা নাই। আর একটা ঘরের মধ্যে গিয়া দেখ্‌ল যে সোনার খাট পালঙ্ক, তার উপরে এক্কেবারে দুধের মত বিছানা। এই উপরে কতরকমের যে ফুল পইড়া রইছে, তার আর সীমা সংখ্যা নাই। এই রকম কইরা দেখ্‌তে দেখ্‌তে দেখল যে একটা ঘরের কোনায় একটা পিন্‌রা[২৭২]র মধ্যে একটা তোতা আছে। তোতাডা তারে দেইখ্যা কইল— হায় মনুষ্যি, তুমি কেরে এইখানে আইছ[২৭৩]?

 তুমি জাননা যে এইডা পরীর মুল্লুক? রাইত তারা ইন্দ্রের পরীত নাচগান করত গেছে, কাইল দিনে আইয়া[২৭৪] তোমারে দেখ্‌লেই আমার মত তোমারে পক্ষী বানাইয়া পিনরার মধ্যে ভইরা রাখব[২৭৫]। এইরকমে আমরা সাতজন রাজকুমার সাত ঘরে বন্দী আছি। তখন মধুমালা আর ছয় ঘরে গিয়া দেখল যে হাচই[২৭৬], ছয় ঘরে ছয়ডা তোতা বন্দী। তারাও তারে দেইখ্যা এই রকমই আক্ষেপ করল। পরীর মুল্লুকে মধুমালা এই সব দেইখ্যা শুইন্যা[২৭৭], একটা চাম্পাফুলের ডালের মধ্যে রাইত পোয়ায় পোয়ায় সময়[২৭৮] গিয়া লুকাইয়া রইল। রাইত পোয়ায় পোয়ায় সময় দেখে কি!— আসমান থাইক্যা একট সোনার রথ পক্ষীর মতন উইড়া আইতেছে[২৭৯]। রথ আইসা চাম্পাফুলের গাছের তলে নাম্‌ল। এই রথ থাক্যা সাতবইন পরী বাইর অইয়া সাতজন সাতটা সোনার ঘরে গিয়া কপাট খাটল[২৮০]। এইরকমে রাইত কাছাইতে[২৮১] লাগ্‌ল। বিকাইল্যা[২৮২] সময় চাইয়া দেখে কি সাত বইন বেড়াইতে আইছে; তারার লগে[২৮৩] সাতজন রাজকুমার। হগলের ছুডু বইনের লগে[২৮৪] যে রাজকুমার আছে, মধুমালা চিন্‌ল যে হেই তুমি জাননা তার সোয়ামী। তখন পরীরা কতক্ষণ গানটা কইরা, সন্ধ্যার সময় আবার যার তার ঘরে গেল। সন্ধ্যা মিলাইয়া গেলে[২৮৫] পরে সোনার সাজোয়া[২৮৬] পইরা[২৮৭], সাত বইন পরী হাইজ্যা পাইড়া[২৮৮] ঘরে আইয়া উঠ্‌ল। রথে উইঠ্যা একটা মন্ত্র কইয়া হাত তিনডা থাপা দিল[২৮৯]

মন্ত্র:— সাত বইন পরী আমরা রথে দিলাম পাও
যথায় আছে ইন্দ্রপুরী তথায় লইয়া যাও।

 তিনডা থাপা দিতেই, রথ আবার পক্ষীর মতন উইড়া ইন্দ্রপুরীর দিকে চল্‌ল। এই রকমে একদিন, দুইদিন গেল। একদিন মধুমালা গিয়া রথের নীচের তালাত[২৯০] লুকাইয়া রইল। সেই দিন মধুমালারে লইয়াই রথ ইন্দ্রপুরীত গেল। মধুমালা সতী কন্যা বল্যাই[২৯১] ইন্দ্রপুরীতে যাইত পার্‌ছিল[২৯২]। ইন্দ্রপুরীত যাইয়া সোনা রূপার ঘর আর কত রকমের বাগ বাগিচা, আর দেবতারা সব ইন্দ্রপুরীতে নাচ গান দেখ্‌ত যাইতাছে[২৯৩]। এই সব না দেখ্যা, মধুমালা এক্কেবারে অবাক্যি লাইগ্যা গেল[২৯৪]। হে সাত পরীর পাছে পাছে লুকাইয়া ইন্দ্রের সভার মধ্যে গেল। গিয়া এক কোণায় রইল। সাত বইনের নাচগান শেষ অইলে পরে তারা অমৃত সরোবরের মধ্যে গিয়া ছান করল। অমৃতের ফল খাইল। এই সব দেখ্যা মধুমালা আগেই আইয়া রথের নীচের তালাত বইয়া রইল। হেই রাইত সাত বইনের লগে পরীর মুল্লুকে আইয়া পড়ল। আগের দিনের লাকান[২৯৫], সাত বইন গিয়া সাত ঘরের কপাট খাট্‌ল। আগের দিনের লাকান বিকাইল্যা সময় তারা সাত রাজ কুমার লইয়া বেড়াইত বাইর অইল[২৯৬]। আবার সন্ধ্যার সময় সাজত পাড়ত[২৯৭] ঘরে চইল্যা গেল। হেই দিন অইছিল কি?—সকলের ছুডু বইনের যে একটা আংডি—হেইডা[২৯৮] হারাইয়া ফাল্‌ছিল[২৯৯]। হেইডা বিচ্‌রাইতে বিচ্‌রাইতে হেই দিন একটু রাইত অইয়া পর্‌ছিল[৩০০]। এই দিকে, মধুমালা করল কি চাম্পাগাছের থাক্যা লাইম্যা[৩০১] একলাই রথে উইঠ্যা মন্ত্রডা কইয়া হাতে তিনডা থাপা দিল। থাবা দিতেই রথ পক্ষীর মত স্বর্গে উইঠ্যা গেল। স্বর্গে যে ‘অমৃত সরোবর’, তাতো মধুমালা আগের দিনই দেইখ্যা গেছিল[৩০২]। সেই অমৃত সরোবর থাইক্যা জল লইয়া পরের দিন বিয়াইন্যা[৩০৩] বেলা পরীর রাজ্যে ফিইর‍্যা আইল। এদিকে ইন্দ্রপুরীতে দেবতারা নাচগান না শুইন্যাই ফিইর‍্যা আইল[৩০৪]। ইন্দ্র এতে খুব রাগ অইয়া সাত বইন পরীরে শাপ দিয়া তোতা বানাইয়া থুইল। মধুমালা গিয়া সাতটা পিন্‌রার মধ্যে থাইক্যা সাতটা পক্ষীরে বাইর কইরা অমৃত সরোবরের জল ছিডাইয়া[৩০৫] দিল। তারা সাত রাজকুমার অইয়া পড়ল। তারারে[৩০৬] লইয়া মধুমালা ডিঙ্গাত[৩০৭] কইরা দেশের দিকে রওনা অইল। সাত জন রাজপুত্রুরে যার যার বাড়ীত পৌছাইয়া দিয়া নিজে এক জায়গায় বাড়ী বানাইয়া বার বচ্ছর গোঁয়ানের লইগ্যা হেইখানে রইল।

(১১)

 কতদিন পরে মদনকুমার আবার দেশ দেখত বাইর অইল। ডিঙ্গা কইরা যাইতে যাইতে হেই নদীর চৌমাথায় গেল। গিয়া দেখে যে এক ডাল দিয়া কালাপানি্ বইয়া যাইতাছে[৩০৮], আর নদীর দুই পারে গাছের ডালে বইয়া[৩০৯] বে-পরিমাণ কাউয়া[৩১০] কা কা করতাছে। এই দেইখ্যা মদনকুমার হেই দিকেই নৌকা চালাইল। অনেক দূরে গিয়া দেখে যে একটা পুরী দেখা যাইতাছে। হেই পুরীত[৩১১] সব কালা পাথরের ঘর, গাছের ফুল পাতা সব মিচ্‌মিচা কালা[৩১২]। একখান ডিঙ্গা থুইয়া মদন কুমার হেই পুরীর মধ্যে গেল। গিয়া দেখল কি— ভূতের মতন কালা চেহারার একটা বুড়ী একট্টা গাছের তলায় বইয়া রইছে। চাইর দিকে তার, মেলা[৩১৩] পাঁঠায় ঘাস খাইতেছে। এই পুরীর বির্ত্তান্ত বুড়ীর কাছে শুননের লইগ্যা মদনকুমার বুড়ীর কাছে গেল। মদনকুমার যেই বুড়ীর কাছে গেছে হেমনই[৩১৪] বুড়ী ফুলের মালা মদনকুমারের গলায় দিল। গলায় দিতেই মদনকুমার একটা পাঁঠা হইয়া গিয়া হেই দলের লগে ঘাস খাইতে লাগল।

 এই রকমে মদনকুমারের ছয়মাস পার অইয়া গেল। একদিন ইন্দ্রপুরের কন্যার কাছে মধুমালা জান্‌ত পার্‌ল যে তার সোয়ামী এইরকমে দেওদানবপুরে বিপদগ্রস্ত অইছে[৩১৫]। হে তখন করল কি?—একটা ডিঙ্গা কইরা মেলা দিল[৩১৬]। যাইতে যাইতে হেই চৌমাথায় গিয়া দাখিল অইল। যেদিক দিয়া নাকি কালাপানি বইয়া যাইতাছিল[৩১৭], হেই দিক দিয়া ডিঙ্গা উজাইতে উজাইতে, হেই দেওদানব[৩১৮] পুরীতে গিয়া উপস্থিত অইল। খুব বাক্কা[৩১৯] একটা পুষ্যের[৩২০] বেশ ধইয়া মায়া বুড়ীর কাছে গিয়া উপস্থিত অইল!

 তখন বুড়ী করল কি—তার গলায় একটা ফুলের মালা দিল। এই পর্য্যন্ত বুড়ী যত গুলি রাজকুমারের গলায় ফুলের মালা দিছে[৩২১], সবগুলিই পাঁডা[৩২২] অইয়া গেছে। কিন্তু, এই যে রাজকুমার সেই মানুষ, হেই মানুষ। দেখ্যা বুড়ী আচানক লাগ্‌ল। বুড়ী জান্‌ত যে দিন এই দেশে আইয়া[৩২৩] সতী কন্যা পাড়া[৩২৪] দিব, হেই দিন থাক্যা তার যাদু নষ্ট অইয়া যাইব। তখন বুড়ী কন্যাডারে খুব নেওরা[৩২৫] কর্‌ত লাগ্‌ল। তখন মধুমালা কইল যে—তুমি ক্কিয়ের লাগ্যা[৩২৬] এই সগলি[৩২৭] রাজকুমাররারে[৩২৮] পাঁডা বানাইয়া কষ্ট দিতাছ? তখন বুড়ী কইল, এই দেশে যে রাজকন্যা, তার একটা বর্‌ত[৩২৯] পরতিষ্ঠা[৩৩০] আছে। তার লাগ্যা একশ একটা পাঁডা লাগব। এই একশ একডা পাঁডা যে যোগাড় কইরা দিতে পারব, তারে রাজা খুব ভালা দেখ্যা একটা পুরস্কার দিব। তখন মধুমালা কইল—এই যে পাঁডা বানানির[৩৩১] যাদুড়া, এইডা যদি আমারে হিকাইয়া[৩৩২] দেও, তা অইলে তোমার ছাল্যা[৩৩৩]র লগে রাজকন্যার বিয়া দিয়া দিয়াম। তখন বুড়ী আয়নার পাড়ের[৩৩৪] মধ্যে যে মায়া ফুলের গাছ আছে;—হেই গাছের কথা মধুমালারে কইল। এই কথা হুন্যা মধুমালা একদিন পাড়ে গিয়া ফুল তুল্যা আন্যা মালা গাঁথল। এই মালা লইয়া মধুমালা করল কি—একটা সন্ন্যাসীর বেশ ধইরা রাজদরবারে গেল। সিঙ্গাসনের[৩৩৫] উপরে পাড়ের মত যে দানবরাজা বইয়া আছিল, তার গলায় হেই মালাডা দিল। দেওন মাত্রই হেই রাজা পাঁডা অইয়া দৌড় মারল। তখন রাজ্যের যত পাত্র মিত্র আছিল, সগলেই ডরাইয়া পলাইয়া গেল। আগে একটা কথা কইতে ভুল্যা গেছলাম। হেই যে মায়া ফুলের পাতা, হেই পাতা খাওয়াইলে, ফির‍্যাবার[৩৩৬] পাঁডা গুলাইন মানুষ অইয়া যায়। তখন মধুমালা কর্‌ল কি—যত পাঁডা আছিল, মায়াফুলের পাতা খাওয়াইয়া মানুষ কর্‌ল। এই মাইনষের[৩৩৭] মধ্যে তার সোয়ামী মদনকুমারও আছিল্। কিন্তু বার বছর না গেলে পরিচয় দিতে পারে না। তখন করল কি বুড়ীর ছাল্যার সঙ্গে দানব রাজার কন্যার বিয়া দিয়া রাজকুমাররারে যার তার বাড়ীতে পাডাইয়া দিল।

(১২)

 আর এক বচ্ছ‌র পরে মদনকুমার ফির‍্যাবার বানিজ্যে গেল। যাইতে যাইতে হেই মায়ানদীর চৌমাথায় গিয়া উপস্থিত হইল। এক ডাল দিয়া লীল[৩৩৮] রংয়ের পানি উজাইয়া যায়। হেইখানে গাছের পাতা, ফুল ফল সব লীল। পইখপাখালী[৩৩৯] যে হেও[৩৪০] লীলরঙ্গের। গিয়া দেখে যে একটা লীল পাথরের পুরী। এই পুরীর মধ্যে মদনকুমার গেল।

 এর মধ্যে ইন্দ্রপুরীর হেই কন্যার কাছে মধুমালা শুনল যে লীল পুরীর যে জিন্[৩৪১]—মদনকুমার হেইখানে বন্দী আছে।

 তখন মধুমালা কর্‌ল কি?—ডিঙ্গা লইয়া লীল পানি বইয়া যাইতে লাগ্‌ল। যাইতে যাইতে জিনের পুরীত গিয়া উপস্থিত অইল। হেইখান গিয়া দেশে যে বড় বড় লীল পাথরের ঘর তার মধ্যে আবার কতগুলাইন গাছ আছে! হেইগুলির ফুল পাতা সব সোনার। কিন্তু অত বড় রাজ্যিডার মধ্যে মানুষের পরপরিন্দা[৩৪২]ও নাই। তখন একটা গাছের তলায় বইয়া রইল। বইতে বইতে একটু ঘুমের আবেশ অইয়া[৩৪৩] শুইয়া পড়্‌ল। এই সময় দেখে যে খুব সুন্দর একটা রাজকুমার তার দিকে আইতাছে[৩৪৪]। দেখ্যাই চিন্ল যে এই তার সোয়ামী মদনকুমার। তখন মদনকুমার কইল যে—হায়! মনুষ্য রাজার পুত্র, তুমি কিয়ের লাগ্যা এইখান মর্‌তা আইছ[৩৪৫]? এই রাজ্যে এক জীনের বাস। এই জীন্‌ করে কি—এক একজন নতূন রাজকুমার আইলেই[৩৪৬] পুরাণ রাজকুমার যে থাকে, তারেও সোনার গাছ বানাইয়া রাখে। এই যে সোনার গাছ দেখ্‌তাছ[৩৪৭]; এই গুলাইন্‌ সব রাজকুমার। আইজ তুমি আইছ কাইল আমার গাছ অওন লাগব[৩৪৮]। দিনে হে পুরীত থাকে না, রাজ্যের বাইরে খাইতে যায়। তার ফিরনের[৩৪৯] সময় অইয়া আইছে[৩৫০]

 সন্ধ্যা হইতেই শুনে যে দূরে আশমানের দিকে একটা শব্দ অইতাছে[৩৫১]। পরে এই জীনের পুরীত বাতাসের মত কি একটা উড়্যা আইল, তাতে অইল কি,—লীল পাথরের বাড়ী গুলাইন আর সোনার গাছ গুলাইন কাঁপতে লাগল। কতক্ষণ পরে দেখে একটা সুন্দর কন্যা তারা দুইজনের দিকে আইতাছে। তখন্ আইয়াই মধুমালারে লইয়া একটা মন্দিরের মধ্যে গেল। গিয়া তারে খুব ভালাভালা খাওনের জিনিষ দিল। দিয়া হে বাইর অইয়া গেল। মধুমালা তখন খেড়কীর দুয়ার দিয়া দেখে কি—যে হেই জীনডা একটা পুষ্কুণীর[৩৫২] পারে গেল;—গিয়া জলের মধ্যে নামল। তখন জলের মধ্যে নাম্‌তেই একটা বোয়াল মাছ তার কাছে আইল। সে বোয়াল মাছটার পেটে হাত দিয়া একটা পাথর বাইর করল। হেই পাথরটা আগুনের মতন জ্বলে। এই পাথরটা লইয়া মদনকুমার যে মন্দিরে গেছিল্‌[৩৫৩], হেই মন্দিরে গেল। রাইত পোয়াইলে পরে মধুমালা জাগল। জাগ্যা দেখে হেই মন্দিরে মদনকুমার ও নাই, হেই কন্যাও নাই। দেখে কি হে একশ সোনার গাছের মধ্যে আরেকটা গাছ বেশী। তখন বুঝ্‌ত পারল যে এই গাছটাই তার স্বামী মদনকুমার। এই দেখ্যা হে খুব চিন্তিত অইয়া তার মন্দিরে ফিরা আস্যা বইয়া রইল[৩৫৪]। মনে করল যে বোয়াল মাছের পেটের পাথরটার মধ্যে নিরচয়[৩৫৫] কোনো গুণ আছে। এই মনে কইরা হে জলের মধ্যে গিয়া নাম্‌ল। নাম্‌লেই বোয়াল মাছটা তার কাছে আইল। হে কর্‌ল কি,—পেটের মধ্যে হাত দিয়া পাথরটা বাইর করল। পরে এই পাথরটা আন্যা গাছ গুলাইনে মধ্যে ছুঁওয়াইল। ছুঁওয়াইবা মাত্রই গাছ গুলাইন্‌ মানুষ অইয়া গেল। এর মধ্যে মদনকুমাররেও পাইল। তার পরেদিন থাক্‌তে থাক্‌তেই তারা দেশ বুল্যা[৩৫৬] রওনা অইল।

(১৩)

 তারপর আর এক বছরের কথা। মদনকুমার ফির‍্যা বার বানিজ্যে রওনা অইল। এই দিকে মধুমালা, বার বছরের আর কয়দিন আছে, একটা গাছের তলে শুইয়া শুইয়া তাই গণতাছে। এমন সময় হেই গাছের উপরে, ইন্দ্র পুরীর দুই কন্যা আইয়া উড়্যা বইলা। মধ্যম বইন্ বড় বইনেরে ফুইদ্ করে—এই কন্যার দুঃখু দূর অইবার আর কত দিন বাকি আছে? বড় বইন্‌ কইল—অনেক দিন বাকি। তার স্বামী এই মাত্র রাক্ষসের পুরীত গেছে। অখন মদনকুমার যে ভাবে আছে, বুঝত পারতাছেনা যে এইডা রাক্ষসের পুরী। কারণ রাক্ষসটা একটা সুন্দর কন্যার রূপ ধইয়া তারে বিয়া কইরা রাখ্‌ছে। কোনো কালে যদি আর কোনো রাজপুত্রু হেই রাক্ষসের পুরে যায়, তবে হে পুরাণডারে খাইয়া নয়াডারে বিয়া করব। মধ্যম বইন তখন জিজ্ঞাসা করল—তবে হেই রাক্ষসটা মরব কি রকমে। বড় বইন কইল যে—রক্তের নদী আর হাড়ের পাড়[৩৫৭]; তার মাঝখানে একটা অজাগর[৩৫৮] সাপ আছে। সাপটারে যদি কেউ মার্‌ত পারে তবে রাক্ষসটা মর্‌ব। কিন্তু তাতে আরও বিপদ; যুদি অজগরডার এক ফোডা[৩৫৯] রক্ত মাডিত পড়ে, তবে শত শত অজাগর অইব। তখন মধ্যম বইন জিজ্ঞাসা করল——তা অইলে এইডারে মারব কি কইরা[৩৬০]? বড় বইন কইল যে, সতী কন্যা ছাড়া এই ডারে কেউ মারত পারব না। তখন মধ্যম বইন জিজ্ঞাসা করল—যদি মধুমালা হেই খানে যায়, তখন ত মদনকুমাররেও খাইয়া ফাল্‌ব। তবে আর মদনকুমাররে বাঁচাইব কি রকমে? বড় বইন কইল যে—তারও পথ আছে। হেই যে অজাগরের মাথায় মণিডা—হেইডা যদি আন্যা, যত গুলাইন্ হাড় আছে তার মধ্যে ছুওয়ায়, তা অইলে সব গুলাইন হাড়ই মানুষ অইব। এই কথা কইয়া তারা উড়্যা গেল (গা)। তখন পুরুষ বেশ ধইরা মধুমালা ডিঙ্গা কইরা রওনা অইল। যাইতে যাইতে হেই চৌমাথায় গিয়া উপস্থিত অইল। গিয়া দেখে যে, এক নালা দিয়া রক্তের সোত বইতাছে,—আর হাড়গুর, মাইনষের মাথা ভাইস্যা আইতাছে[৩৬১]। হে গিয়া রাক্ষসের পুরীত উপস্থিত অইল। গিয়া দেখে কি যে একটা সুন্দর কন্যা একটা সুন্দর রাজকুমারের হাত ধইরা বেড়াইতাছে। আর মানুষ গরুর বাতাসও নাই। মধুমালা মদনকুমাররে চিন্‌ল। আর বুঝল সে হেই কন্যাডাই রাক্ষসী। হেই রাক্ষসনীডা মধুমালারে পাইয়া খুব আদর কইরা এক মন্দিরে লইয়া গেল। হেই খান তারে খুব ভালা খাওন দিয়া বাইর অইয়া আইল। ঘুম থাক্যা উঠ্যা মধুমালা দেখল যে মদনকুমার আর নাই—বুঝত পার্‌ল যে তার সোয়ামীকেও রাক্ষসনী খাইয়া ফেল্‌ছে। কতক্ষণ পরে রাক্ষসনী[৩৬২] আইয়া মধুমালারে কইল যে তুমি আমারে বিয়া কর। মধুমালা কইল—আমায় একটা অশোজ্[৩৬৩] আছে। তিন দিন তেরাত্র পর তোমারে বিয়া করবাম্। রাক্ষসনী যখন খাওনের লাগ্যা রাজ্যের বাইরে গেল তখন মধুমালা এক খান ধারের তউরাল[৩৬৪] হাতে লইয়া যেদিকে রক্তের নদী হাড়ের পাড় আছে, হেই দিকে যাইতে লাগল। গিয়া দেখে রক্তের নদী হাড়ের পারের মধ্যে আসমান মঞ্চ জোরা[৩৬৫] এক অজাগর সাপ। হে তখন তউরাল দিয়া সাপটারে ছেও[৩৬৬] দিয়া ফাল্‌ল[৩৬৭]। তার রক্ত থাইক্যা মেলা অজগর বাইর অইতে লাগ্‌ল। আর হুনল কি সাঁ সাঁ কইরা একটা শব্দ অইতাছে। বোঝা যায় যেমন পিরথিমীডারে উল্ডাইয়াই ফালতাছে[৩৬৮]। তখন মধুমালা করল কি। বাঁয় কাট্যা[৩৬৯] ডাইনে মুছল, ডাইনে কাট্ট্যা বাঁয় মুছল, তার পরে অজাগ্‌গরডাও মইরা গেল। শব্দও থামল, রাক্ষসনীডাও মইরা গেল। অজাগ্‌গরের মাথায় সে একটা মনি সূরুযের মত জ্বলতে আছিল্, হেইডা লইয়া রাক্ষসীর—পূরীতে আইয়া যত গুলাইন হাড় আছিল তার মধ্যে ছুঁওরাইতেই হাড় গুহাইন মানুষ অইল। তার পরে সব রাজকুমাররারে লইয়া মদমকুমারের বাড়ীৎ গিয়া উপস্থিত অইল। সভা কইরা বেবাক[৩৭০] রাজকুমার বইছে[৩৭১], তার মধ্যে রাজকুমার বেশে মধুমালাও বইছে। তখন আর আর রাজকুমাররা মধুমালা যে অত কষ্ট কইরা তারারে বাঁচাইয়া আন্‌ছে, তার লাগ্যা তারে সগলে[৩৭২] খুব বাখ্‌নাইতে[৩৭৩] লাগ্‌ল। তখন মধুমালা কইল—এইডা আর একটা কষ্ট কি। একটা রাজ কন্যা, তার স্বামীরে কত খান্‌তে[৩৭৪], কত কষ্ট কইরা যে বাঁচাইয়া আন্‌চে, তার কথা হুন্‌লে আপনারা একেবারে আপানারা আচানক অইবাইন[৩৭৫]। এই কথা শুন্যা রাজকুমাররাও সেই কন্যাকে কথা কওনের লাগ্যা বেগার্‌তা[৩৭৬] আরম্ভ করল। মধুমালা কইল—আমি হেই কথা কইতাম[৩৭৭] পারি, কিন্তু আমার একটা কথা আছে। আমি কথা শুরু করলে কেউ যদি মাঝ্‌খানে ভাঙ্গতি[৩৭৮] দেয়, তা অইলে আর আমি কথাও কইতাম না[৩৭৯]; এই জর্ম্মে[৩৮০] আমার লগে আর তানি দেখাও অইত না[৩৮১]। তখন সগলে পর্‌তিজ্ঞা করল যে “হু” ছাড়া আর তারা কোন শব্দ করত না[৩৮২]

 মধুমালা তার কথা আরম্ভ করল। নামের পরিচয় গোপান্ কর‍্যা, মদনকুমারের জর্ম্ম কইতে কথা আরম্ভ হইল। তার পর খাটপালঙ্ক বদলের কথা, স্বয়ংবরের কথা, বনবাসের কথা, কি রকমে রাজকুমার অন্ধ অইল —তার কথা, তার পরে কি রকমে রাজ কন্যারে ভিনদেশী রাজকুমারে বনের মধ্যে পাইয়া জোর কইরা ধইরা লইয়া গেছিল্[৩৮৩] তার কথা, তার পরে—কি্ রকমে হেই রাজকুমারের হাত থাক্যা উদ্ধার পাইয়া তার সোয়ামীরে বাঁচাইয়া আননের[৩৮৪] লাগ্যা পরীর মুল্লুকে গেল, তার কথা। এই কথা শুন্যাই মদনকুমার চীৎকার কইরা উঠ্‌ল। কইল এই কথা “রও রও!” বন থাক্যা আমি যে কি রকমে পড়ীর মুল্লুকে গেলাম, হেইডা তুমি জান না। আমি কইয়া লই[৩৮৫]। তখন্ কন্যা সগলরে সাক্ষী কইরা কইল—আমার কথা এই খানে শেষ। আমার লগে তোম্‌রার[৩৮৬] যে দেখা সক্ষাৎ তারও শেষ। অতদিনের পরে মদনকুমার ফির‍্যাবার, হায় মধুমালা! হায় মধুমালা! কর্‌তে কর্‌তে পাগল অইয়া গেল।

(১৪)

 তার এই দুঃখু দেখ্যাও মধুমালা পরিচয় দিল না কারণ, তখনও বার বচ্ছর পূর্ণিত হয় নাই। আর ছয় মাস বাকি আছে,—এমন সময় মধুমালা কর্‌ল কি একটা ডুমণীর বেশ ধইরা কতগুলি খাড়ি, বিউণী তৈয়ার কর্‌ল। এই যে খাড়ি, বিউণী গুলাই বাইন[৩৮৭] কর্‌ছে তার মধ্যে মদনকুমার মধুমালার ছবি। এই খাড়ি বিউণী লইয়া মধুমালা তার বাপের বাড়ীত গেল। খাড়ি বিউণী দেখ্যা মধুমালার মা কান্‌তে লাগ্‌ল। আর কইল—ডোমণী। তুমি এই খাড়ি বিউণী কই পাইলা? তার মায়ের কান্দন দেখ্যা মধুমালা কইল—মা ঠাকুরাইন! তুমি কেরে কান্দ? তখন রাণী কইল—এই মধুমালা আমার কন্যা আছিল্। পাঁচ ভাইয়ের বইন্; আমি তারে হারাইয়া কান্‌তে কান্‌তে অন্ধ হইছি। তখন ডোম্‌ণী কইল —ইচ্ছা কইরা যে কন্যারে নিব্বাস দিছ, তার লাগ্যা আর কান্দা কাডি কেরে[৩৮৮]? রাণী ডোমণীরে আঞ্জাইয়া[৩৮৯] ধর্‌ল—মা! তুই নির্য্যাস[৩৯০] মধুমালার খবর জানছ্[৩৯১]—ক হে কোন্ খানে, কেমনে আছে? তখন ডোমণী কইল—আমি তোমার মধুমালারে জানিও না, চিনিও না। বার বচ্ছর ধইরা নিব্বাস দিছ, হে কি আইজও আছে? তখন রাণী কইল—আমার ঝি ঠিক তোমার মতনই আছিল্। ডোমণী! তুমি আমার কাছে থাক। তোমার মুখ দেখ্যা আমি মধুমালার কথা পাশুরবাম্[৩৯২]। তখন ডোমণী কইল—তাকি অয়[৩৯৩]? যে মা তার নিজের কন্যার খবর লয় না, তারে চিনে না, তার কাছে থাক্যা কি অইব[৩৯৪]? তখন মায়ে ঝিয়ে চিনা অইল। দুইজনে তখন গলাগলি কইরা খুর কতক্ষণ কান্দ্‌ল।

 বার বছর পূর্ণিত হওনের[৩৯৫] আর তিন দিন বাকি আছে। মধুমালা ডোমণীর বেশে মদনকুমারের বাড়ীর দিকে রওনা অইল। যে দিন বার বচ্ছরের শেষ, হেইদিন গিয়া মদনকুমারের বাড়ীত্ উপস্থিত অইল। গিয়া জান্‌ল যে সাতদিন ধইরা মদনকুমার দানা পানি ছাড়া অইয়া জোড়মন্দির ঘরের কপাট লাগাইয়া রইছে।

 এই কথা শুন্যা মধুমালা গিয়া জোড়মন্দির ঘরের কপাটে হাত দিতেই সতীকন্যার হাত লাগ্যা কপাট খুল্যা গেলা, তখল মধুমালা মন্দিরে পর্‌বেশ কর‍্যা মদনকুমারের পালঙ্কের উপরে একখান বিউনী রাখ্‌ল।

গান:— মদনকুমার জিজ্ঞাস করে সাধু ডোমের নারী
কি কারণে হেথা আইলে কোন্ বা দেশে বাড়ী?
কাঞ্চন নগরে ঘর মদন ডোমের নারী
খাড়ি বিউণী বিকাইয়া দেশে দেশে ফিরি।

নানান্ দেশে যাও ডোমনী খাড়ি বিউণী লইয়া
মধুমালা কন্যার কথা আইছ নি শুনিয়া[৩৯৬]
কিসের লাগ্যা কুমার তুমি হইয়াছ এমনি
কিসের লাগিয়া তুমি ছাড়্‌ছ[৩৯৭] দানাপানি[৩৯৮]?

 তখন মধুমালা করল কি?—একখান্ বিউণী মদনকুমারের চক্ষের সাম্‌নে ধরল।

এইনা দেখ্যা মদনকুমার আঁখি মেল্যা চায়।
বিউণী উপরে মধুমালা কন্যা দেখ্‌তে পায়॥
এইনা দেখ্যা মদনকুমার কান্দ্যা ভূমিত পড়ে।
বিউণীর উপরের কন্যা তুমি দেখ্‌ছনি কেউরে ঘরে[৩৯৯]
কন্যা আমার চক্ষের কাজল কন্যা মাথার মণি।
তারে হারাইয়া আমি ছাড়ছি দানা পানি॥

* * * *

কেমন তোমার মধুমালা কিবা রূপ তার
যার লাগিয়া পাগল তুমি সুন্দর কুমার।

* * * *

নাক মুখ তোমার মতন তোমার মতন চে—রা[৪০০]
চিন্যা নাহি চিন্‌তে নারি বার বচ্ছর ছাড়া[৪০১]

স্বপ্নের মত মধুমালা মনে লাগ্যা আছে
সুন্দর ডোমের নারী তুমি থাক আমার কাছে।
তোমার মুখ দেখ্যা আমার যাইব আধা দুখ্
তোমায় দেখ্যা পাশরিবাম মধুমালার মুখ।

* * * *

সোয়ামী হইয়া চিনতে নারে যেইজন আপন নারী
তাহার যে কাছে আমি থাকিতে না পারি।

* * * *

 বার বচ্ছর শেষ হইয়া গেল। তারা দুইজনের চিনা অইয়া মিলন অইয়া গেল।

(১৫)

মদনকুমার মধুমালা এইখানে থুইয়া
ইন্দ্রপুরীর কন্যার কথা শুন মন দিয়া।

 মধ্যম বইন জিজ্ঞাস করে বড় বইনেরে—বার বচ্ছরত শেষ অইয়া গেছে। অখন ত তার দুঃখের দিন গেছে। তখন বড় বইন কইল ইন্দ্র-লোকের কন্যা মনুষ্য-লোকে গিয়া কোন্ দিন সুখ পায়? মধ্যম বইন জিজ্ঞাস করে—কোনো সুখ পায় না। বড় বইন কইল—এই ত হে সতী না অসতী, মনুষ্যিরা অখন তার একটা পরীক্ষা লইব[৪০২]। মধ্যম বইন কইল—তার শাপের দিন ত শেষ হইয়া গেছে। শূন্য রথ[৪০৩] লইয়া চল তারে আমরার[৪০৪] কাছে লইয়া আয়ি। তখন তারা শূন্য-রথ লইয়া রওনা অইল।

 এই দিকে মধুমালার পরীক্ষা আরম্ভ হইছে। পরথম্ পরীক্ষা—মধুমালার শ্বশুর ও রাজ্যের মালী বার বছর ধইরা গাছ অইয়া রইছে—সতীকন্যা অইলে হে তারারে মানুষ করুক। তখন মধুমালা জীনের পুরীর পাথর ছুঁওয়াইয়া তারার[৪০৫] মানুষ করল। পরে, তুলা পরীক্ষা তারপরে অগ্নি পরীক্ষা। আগুনের কুণ্ডের মধ্যে মধুমালা ঝাঁপ দিল; পরে মাইনষে দেখে কি যে আগুণের কুণ্ডু থাক্যা একটা রথ শূন্যের দিকে উঠ্‌তাছে। তার মধ্যে ইন্দ্রপুরীর তিন কন্যা বইয়া আছে। ইন্দ্রপুরীর রথ ইন্দ্রপুরীতে চল্যা গেল। আমার কিচ্ছা[৪০৬]ও শেষ অইল।

সমাপ্ত

 (এই কেচ্ছার শেষ ভাগে মধুমালার সাড়ীর অঞ্চল ধরিয়া মদনকুমার ইন্দ্রপুরীতে চলিয়া যায়—একজন গায়ক এই বলিয়াও শেষ করে)


  1. বন্দুম=বন্দনা করিলাম।
  2. নাগুনি=নাগিনী।
  3. বাঘুনী= বাঘিনী।
  4. ভানুসর=ভানু + ঈশ্বর=সূর্য্য।
  5. বইন্দা=বন্দিয়া।
  6. আটকুড়=সন্তানহীন।
  7. যুদি=যদি।
  8. কুনু=কোন।
  9. পুত্রু=পুত্র।
  10. লাইগ্যা=লাগিয়া।
  11. দুঃখিৎ, দুষ্কিত=দুঃখিত।
  12. হেইমত—সেইমত।
  13. এরুর=ইহার।
  14. আর্‌চা=অর্চ্চনা
  15. বর্ত্তপালি=ব্রত, পালনাদি।
  16. অইল=হইল।
  17. আৎকা=হঠাৎ।
  18. সভাবত্যা=সভাস্থ।
  19. বেডা=বেটা।
  20. গাইল=গালি।
  21. সাতছালার বুদ্ধির নাপিত=প্রবাদ এই যে, নাপিতেরা অত্যন্ত কুবুদ্ধি এবং ইহাদের বুদ্ধির পরিমাণও প্রচুর। এমন কি সাতটী বস্তায় ধারণ যোগ্য বুদ্ধি ইহারা রাখে।
  22. দোয়াই=দোহাই।
  23. বাড়ীথ্যে=বাড়ী হইতে।
  24. আওনের=আসিবার।
  25. আইছি =আসিয়াছি।
  26. দৈচ্ছৎ=দুরদৃষ্ট!
  27. হুন্যা=শুনিয়া।
  28. মাইন্‌ষে—মানুষে।
  29. হমকে=সামনে।
  30. আপরকে=পরোক্ষে।
  31. অয়, অইত, অইল, অত্যা—ইত্যাদির -অ’স্থানে ‘হ’কার ব্যবহার করিলেই অর্থ সুগম হয়।
  32. জ্বল্লা=জ্বালা।
  33. পচ্চিম=পশ্চিম।
  34. দেখ্‌তনা=দেখিবে না।
  35. আইলাইন=আসিলেন।
  36. আইজ=আজ।
  37. রাইত=রাত।
  38. ছয়=ছুঁয়ে; স্পর্শ করে।
  39. এতু=হেতু।
  40. অইতাম না=হইব না।
  41. আতের=হাতের।
  42. আইয়া=আসিয়া।
  43. পন্নাম=প্রণাম।
  44. লাম্বা=লম্বা।
  45. জডা=জটা।
  46. শইলে=শরীরে।
  47. বেতাগা=বেত্র-যষ্ঠি।
  48. সগল, হগল=সকল।
  49. বির্ত্তান্ত=বৃত্তান্ত।
  50. বাড়ি=আঘাত, প্রহার।
  51. মাডী=মাটি।
  52. ফাইট্যা=ফাটিয়া।
  53. মাটিৎ=মাটিতে।
  54. ধুয়াবান=ধুমাচ্ছন্ন অস্পষ্টতা ধুয়া=ধুম।
  55. আচানক=আশ্চর্য্য।
  56. খাওনের=খাওয়াইবার।
  57. পর্‌তিদিন=প্রতিদিন।
  58. হুর্‌ত=ঝাঁট্‌ দিতে।
  59. কালিহাঞ্জা=কালি (আঁধার), হাঞ্জা (সাঁঝ); আঁধার সন্ধ্যা।
  60. আন্ধাইর=অন্ধকার।
  61. চান্নি=জ্যোৎস্না।
  62. মিইশ্যা=মিশিয়া।
  63. নিশি রাইতের আমলে=নিশীথে।
  64. পোষাইয়া=পোহাইয়া।
  65. ঢ ঢ করিতেছে=ধক্ ধক্ করিতেছে।
  66. তাক্=আশ্চর্য্যান্বিত।
  67. জিগাইল=জিজ্ঞাসা করিল।
  68. মুনুষ্যি=মনুষ্য।
  69. কওন=কহা।
  70. ছাড়তামনা=ছাড়িতামনা।
  71. আঞ্জাইয়া=জড়াইয়া।
  72. কইলাইন্‌=কহিলেন।
  73. কইতাম=কহিতে।
  74. তুইন্=তুই।
  75. কেউর=কাহারও।
  76. কছ=কস্, কহিস্।
  77. ‘রাতদিন যখন দুইভাগ অইব’=যখন প্রভাত হইবে।
  78. ঘর=ঘরে।
  79. অইব=হইবে।
  80. করম পুরুষ=কর্ম্মপুরুষ।
  81. লেইখ্যা=লিখিয়া।
  82. ছাল্যা=ছেলে।
  83. আইছ=আসিয়াছ।
  84. বেবাক=সমস্ত।
  85. সমজাইয়া=বোঝাইয়া।
  86. তা অইলে=তাহা হইলে।
  87. অইয়া=হইয়া।
  88. কইতাম না=কহিব না।
  89. বাও=বায়ু=বায়।
  90. কাইট্যা=কাটিয়া।
  91. বাড়ীৎ=বাড়ীতে।
  92. হয় সময়=হওয়ার সময়।
  93. পাঁচঝার জোগার; ঝার=ঝঙ্কার ধ্বনি। জোগার=জোকার, জয়ধ্বনি, হুলুধ্বনি। পাঁচবার হুলুধ্বনি করা হইল। পুত্রসন্তান জন্মিলে পাঁচবার, কন্যা সন্তান জন্মিলে তিনবার, হুলুধ্বনি করিয়া তাহার জন্মবার্তা প্রকাশ্যে ঘোষিত হয়। বুঝনের=বুঝিতে।
  94. ছাওয়াল=ছেলে।
  95. খোয়াইলে=খুলিলে।
  96. দড়=দৃঢ়।
  97. কেন্না=কেন না?
  98. লগে=সঙ্গে।
  99. উবুৎ=উপুর।
  100. দেখ্যাছি=দেখিয়াছি।
  101. মইরা=মরিয়া।
  102. করলাইন্=করিলেন।
  103. রাইখ্যা=রাখিয়া।
  104. দেখুইন=দেখেন।
  105. আপনে=আপনি।
  106. যাইবাইন=যাইবেন।
  107. ধন্ধ=বিস্ময়ে স্তব্ধ।
  108. কহনই=কহিতেই হইবে।
  109. লাগব লগব=লাগবে।
  110. ভাইঙ্গা=ভাঙ্গিয়া, খুলিয়া
  111. কোডা=কোঠা।
  112. খাওন=খাদ্য।
  113. পাডাইয়া=পাঠাইয়া।
  114. হেইখান=সেইখানে।
  115. দুপইরা=দ্বিপ্রহর
  116. আইয়া=আসিয়া।
  117. কপাট=কবাট।
  118. খাইট্যা থইয়া আইছিল না=বন্ধ করিয়া দিয়া আসে নাই।
  119. আৎকা=হঠাৎ।
  120. দেখ্‌ছে না=দেখে নাই।
  121. বিরিখ=বৃক্ষ।
  122. জুইড়া=জুড়িয়া।
  123. থইয়া=রাখিয়া।
  124. দেওয়ের=দেবতার।
  125. নাচন=নর্ত্তন।
  126. করণ লাগত=করিতে হইত।
  127. বইন্‌=ভগ্নী।
  128. নাইচ=নাচ।
  129. মুন্যি=ক্রোধবশতঃ অভিশাপ। “মন্যু” হইতে। “মন্যুর্ণতে ত্বয়া কার্য্যং দেবি ক্রমি তবাগ্রতঃ” (রামায়ণ অযোধ্যা)।
  130. দিলাইন=দিলেন।
  131. জর্ম্ম=জন্ম।
  132. দুষ্কু=দুঃখ।
  133. জাগা=জায়গা।
  134. অখণ্ডি=অখণ্ড্য।
  135. মধ্যুম=মধ্যম।
  136. আমরার=আমাদের।
  137. ছুডু=ছোড।
  138. লইছে=লইয়াছে।
  139. লও=চল।
  140. দেখ্যা আয়ি=দেখিয়া আসি।
  141. মৌপুক=মৌ পোকা, মক্ষিকা, মৌমাছি।
  142. বেতিক্রম অইছেনা=ব্যতিক্রম হয় নাই।
  143. দেখ্যাই=দেখিয়াই।
  144. তারার=তাদের।
  145. অখন=এখন।
  146. যুগ্যি=যোগ্য।
  147. ফির‍্যাবার=(ফিরিয়া আবার) পুনরায়।
  148. উপুর=উপর।
  149. বইল=বসিল।
  150. মালুম কইরা=সূক্ষ্মানুসন্ধান করিয়া।
  151. জ্বলতাছে=জ্বলিতেছে।
  152. হেইডা=সেইটা।
  153. দেখন=দেখিতে।
  154. সরববাসর=সোজাসুজি।
  155. আছ্‌লাম=ছিলাম।
  156. মক্ষি=মাছি।
  157. আইতে=আসিতে
  158. আইসাছ=আসিয়াছ।
  159. বিভুলা=বিভোল, বিভোর।
  160. বুঝ্‌ত=বুঝিতে।
  161. ভূমিত=ভূমিতে।
  162. বুঝাইত পড়াইত=বুঝাইতে পড়াইতে; প্রবোধ দিতে।
  163. উন্মাদিণী=উন্মাদ।
  164. মইস্যে=মাসীতে।
  165. যাইব=যাইবে।
  166. শিগার=শিকার।
  167. খাওনে শুওনে=খাইতে শুইতে।
  168. গাইট=গাঁট, বস্ত্র-প্রান্ত।
  169. বাঁও=বাম।
  170. ভর=ভ্রূর অপভ্রংশ।
  171. গলাত=গলায়।
  172. অরিণ=হরিণ।
  173. আন্ চোক্‌=আড়চোখ।
  174. খাওন পানি বেগর=খাদ্য ও জল বিনা।
  175. কাডুরিয়া=কাঠুরিয়া।
  176. কাডের=কাঠের।
  177. বুঝা=বোঝা।
  178. যাইতাছে=যাইতেছে।
  179. কাডে=কাটে।
  180. বেচত=বেচ্‌তে।
  181. ফুইদ=জিজ্ঞাসা।
  182. ঢুল=ঢোল।
  183. পিডাইয়া=পিটাইয়া।
  184. ভালা করত পারব=ভাল করিতে পারিবে।
  185. ভালা করতা পারবা=করিতে পারিবে।
  186. পারবাম=পারিব।
  187. লইব বল্যা=লইবে বলিয়া।
  188. করআইন=করুন।
  189. কথাডা=কথাটা।
  190. পাডাইয়া দিছিল্=পাঠাইয়া দিয়াছিল।
  191. বান্ধ্যা=বাঁধিয়া, ঘটিয়া।
  192. হগ্‌গলতারে থইয়া=সকলকে পরিত্যাগ করিয়া।
  193. নিব্বাস=বনবাস।
  194. যেখান=যেখানে।
  195. আন্‌ত গেল=আন্‌তে গেল।
  196. পাইছিল=পাইয়াছিল।
  197. ফাল্‌ল=ফেলিল।
  198. ফিরা যাওনের=ফিরিয়া যাওয়ার।
  199. বিচরাইতে=অনুসন্ধান করিতে।
  200. তাকি তুকি করতাছে=ইতস্ততঃ হাতরাইয়া ফিরিতেছে।
  201. কানতে=কাঁদিতে।
  202. কাইনি=কাহিণী।
  203. জিগাইল=জিজ্ঞাসা করিল।
  204. কওছে=বলতো।
  205. মিলাইয়া আইছলাম=মিলিত করিয়া দিয়া আসিয়াছিলাম।
  206. হেই গাছ গিয়া বইল=সেই গাছে গিয়া বসিল।
  207. কিয়ে=কিসে।
  208. কইতাছে=কহিতেছে।
  209. কইতাছিল=কহিতেছিল।
  210. যাইব=যাইবে।
  211. অইব=হইবে।
  212. অমির্ত্তি=‘অমৃতের’ অপভ্রংশ; আম।
  213. আইন্যা=আনিয়া।
  214. তা অইলে ভালা অইব=তাহা হইলে ভাল হইবে।
  215. কইয়া আয়ি=কহিয়া আসি।
  216. অন্ধ অইব=অন্ধ হইবে।
  217. ভালা অইতনা=ভাল হইবে না। অইতনা —ভবিষ্যৎকাল বোধক।
  218. করনের=করিবার।
  219. ঘনাইয়া আইছিল=ঘনাইয়া আসিতেছিল।
  220. বাইর=বাহির।
  221. পাইড়্যা আইন্যা=পাড়িয়া আনিয়া।
  222. আয়িগ=আসিগে।
  223. হে=সে।
  224. যাইতাছে=যাইতেছে।
  225. ভিজ্যা=ভিজিয়া।
  226. ফাইট্টা যাইতাছিল—ফাটিয়া যাইতেছিল।
  227. আইছিল=আসিয়াছিল।
  228. বিয়া করব=বিয়া করিবে।
  229. মাইয়া লোক=মেয়ে লোক।
  230. দেখছেনা=দেখেনাই।
  231. মাইয়া=মেয়ে।
  232. জোর কইরা ধইরা লইয়া আইছে=জোর করিরা লইয়া আসিয়াছে।
  233. করতাম্ পারি=করিতে পারি।
  234. হুন্‌ল্=শুন্‌ল।
  235. হুন্যাই=শুনিয়াই।
  236. কর্‌তাছে=করিতেছে।
  237. সেইরকম=তেমন।
  238. মাইয়া ডারে=মেয়েটাকে।
  239. পারছ=পার।
  240. দিয়াম্‌=দিব।
  241. ভাইঙ্গা=ভাঙ্গিয়া।
  242. অইল গা=হলো গে।
  243. পইরা=পরিধান করিয়া।
  244. অতিথ অইল=অতিথি হইল।
  245. দেখ্‌তাম আইছি=দেখিতে আসিয়াছি।
  246. কাইন্দ্যা কাইট্যা=কাদিয়া কাটিয়া।
  247. আইজ=আজ।
  248. আরাইছি=হারাইয়াছি।
  249. উদ্দিশ কর‍্যা আই=অনুসন্ধান করিয়া আসি।
  250. অইছিল=হইয়াছিল।
  251. বাইট্যাইল=ভাটিয়াল।
  252. বাইয়া যাইতাছে=বাহিয়া যাইতেছে।
  253. আছিল=ছিল।
  254. দেইখ্যা আইছি=দেখিয়া আসিয়াছি।
  255. কাম=কাজ।
  256. বসল—বসিল।
  257. বাইর অইছে=বাহির হইয়াছে।
  258. কই=কোথায়।
  259. পাইব=পাইবে।
  260. যাইতে পারে=যাইতে পারে।
  261. অন্‌ত পারব=আনিতে পারিবে।
  262. চাইরটা ডাল=চারিটা শাখা।
  263. দেখ্‌ব=দেখিবে।
  264. হেইথান থাক্যা=সেই খান হইতে।
  265. দিতপারে=দিতেপারে।
  266. মাইরা ফাল্‌তনা=মারিয়া ফেলিবেনা?
  267. ইন্দ্রপুরীত=ইন্দ্রপুরীতে।
  268. অইয়া যাইব=হইয়া যাইবে।
  269. যাইত পারতনা=যাইতে পারিতনা।
  270. হেই কথা গুলাইন হুনল=সেই কথাগুলি শুনিল।
  271. রাইত হেইখান গেছিল্=রাত্রে সেখানে গিয়াছিল।
  272. পিন্‌রা=পিঞ্জরের অপভ্রংশ।
  273. হায় মনুষ্যি! তুমি কেরে এইখান আইছ?—হায় মানুষ! তুমি কেন এখানে আসিয়াছ?
  274. আইয়া=আসিয়া।
  275. ভইরা রখব=ভরিয়া (পূরিয়া বদ্ধ করিয়া) রাখিবে।
  276. হাচই=(সাচ্চা হইতে) সত্য সত্যই।
  277. দেইখ্যা শুইন্যা=দেখিয়া শুনিয়া।
  278. রাইত পোয়ায় পোয়ায় সময়=রাত্রি পোহাইবার প্রাক্কালে।
  279. উইড়া আইতাছে=উড়িয়া আসিতেছে।
  280. খাটল=বন্ধ করিয়া দিল।
  281. কাছাইতে=নিকট বর্ত্তী হইতে।
  282. বিকাইল্যা=বিকাল।
  283. তারার লগে=তাদের সঙ্গে।
  284. হগলের ছুডু বইনের লগে=সকলের ছোটবোনটির সঙ্গে।
  285. মিলাইয়া গেলে=সম্পূর্ণরূপে সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিলে।
  286. সাজোয়া=সাজসজ্জা।
  287. পইরা=পরিধান করিয়া।
  288. হাইজ্যা পাইড়া=সাজিয়া গুজিয়া।
  289. হাত তিনডা থাপা দিল=তিন বার হাত চাপড়াইল।
  290. তালাত=তলদেশে।
  291. বল্যাই=বলিয়াই, জন্যই।
  292. ইন্দ্রপুরীতে যাইত পারছিল=ইন্দ্রপুরীতে যাইতে পারিয়াছিল।
  293. দেখ্‌ত যাইতাছে=দেখিতে যাইতেছে।
  294. অবাক্যি লাইগ্যা গেল=আশ্চর্য্যে নির্ব্বাক হইয়া গেল।
  295. লাকান=মতন, ন্যায়।
  296. বেড়াইত বাইর অইল=বেড়াইতে বাহির হইল।
  297. সাজত পাড়ত=সজ্জা-প্রসাধন করিতে।
  298. হেইডা=সেইটা।
  299. ফাল্‌ছিল=ফেলিয়া ছিল।
  300. ‘হেইডা···পরছিল’=সেটা খুঁজিতে খুঁজিতে সে দিন খানিক রাত্রি হইয়া গিয়াছিল।
  301. লাইম্যা=নামিয়া।
  302. দেইখ্যা গেছিল=দেখিয়া গিয়াছিল।
  303. বিয়াইন্যা=(বিহান হইতে), সকালবেলায়।
  304. শুইন্যাই ফিইর‍্যা আইল=শুনিয়াই ফিরিয়া আসিল।
  305. ছিডাইয়া=ছিটাইয়া।
  306. তারারে=তাহাদিগকে।
  307. ডিঙ্গাত=ডিঙ্গায়।
  308. কালা পানি বইয়া যাইতাছে=কাল জল বহিয়া যাইতেছে।
  309. বইয়া=বসিয়া।
  310. কাউয়া=কাক।
  311. হেই পুরীত=সেই পুরীতে।
  312. মিচ্‌মিচ কালা=ঘোর কৃষ্ণবর্ণ।
  313. মেলা=অসংখ্য।
  314. হেমনই=তৎক্ষণাৎ।
  315. অইছে=হইয়াছে।
  316. মেলা দিল=যাত্রা করল।
  317. বইয়া যাইতাছিল=বহিয়া যাইতেছিল।
  318. দেওদানব=দৈত্য দানব।
  319. বাক্কা=সুন্দর।
  320. পুষ্যের=পুরুষের।
  321. দিছে=দিয়াছে।
  322. পাঁডা=পাঠা।
  323. আইয়া=আসিয়া।
  324. পাড়া=পদক্ষেপ।
  325. নেওরা=অনুরোধ; কাকুতি মিনতি।
  326. কিয়ের লাগ্যা=কিসের জন্য।
  327. সগলি=সকল।
  328. রাজকুমাররারে=রাজকুমারদিগকে।
  329. বর্‌ত=ব্রত।
  330. পর্‌তিষ্ঠা=প্রতিষ্ঠা।
  331. বানানির=তৈয়ার করার।
  332. হিকাইয়া=শিখাইয়া।
  333. ছাল্যা=ছেলে!
  334. পাড়ের=পাহাড়ের।
  335. সিঙ্গাসন=সিংহাসন।
  336. ফির‍্যাবার=(ফিরিয়া আবার) আবার।
  337. মাইন্‌ষের=মানুষের। ‘মানুষ’ কে ‘মাইনষে’ বলা কেবল পূর্ব্ববঙ্গে নহে, উত্তর বঙ্গেও প্রচলিত আছে। “নাইয়া উঠ্‌ছিস মাইন্‌সের রক্তে”। ৺রজনী সেন।
  338. লীল=নীল।
  339. পইখপাখালী=পক্ষী ইত্যাদি।
  340. হেও=সেও।
  341. যে জিন=যে জিন্ আছে তাহার কাছে।
  342. পরপরিন্দা=সাড়াশব্দ।
  343. অইয়া=হওয়ায়।
  344. আইতাছে=আসিতেছে।
  345. মর্‌তা আইছ=মরিতে আসিয়াছ।
  346. আইলেই=আসিলেই।
  347. দেখতাছ=দেখিতেছ।
  348. অওন লাগব=হইতে হইবে।
  349. ফিরনের=ফিরিবার
  350. অইয়া আইছে=হইয়া আসিয়াছে। ‘হয়ে আস্‌ছে’।
  351. অইতাছে=হইতেছে।
  352. পুষ্কুণী=পুষ্করিণী।
  353. গেছিল্=গিয়াছিল
  354. ফিরা আস্যা বইয়া রইল=ফিরিয়া আসিয়া বসিয়া রহিল।
  355. নিরচয়=নিশ্চয়।
  356. বুল্যা=(বলিয়া) উদ্দেশে।
  357. পাড়=পাহাড়।
  358. অজাগর=অজগর।
  359. ফোডা=ফোটা।
  360. ‘তা অইলে এইডারে মারব কি কইরা?’—তবে, ইহাকে কেমন করিয়া মারিবে?
  361. ভাইস্যা আইতাছে=ভাসিয়া আসিতেছে।
  362. রাক্ষসনী=রাক্ষসী।
  363. অশোজ=অশৌচের অপভ্রংশ।
  364. তউরাল=তরোয়াল।
  365. আসমান মঞ্চজোরা=(সুদূর) আকাশ ও পৃথিবী জুড়িয়া।
  366. ছেও=(ছেদ হইতে) কাটিয়া ফেলা।
  367. ফাল্‌ল=ফেলিল।
  368. উল্ডাইয়া ফালতাছে=উল্‌টাইয়া ফেলিতেছে।
  369. কাইট্যা, কাট্ট্যা=কাটিয়া
  370. বেবাক=সকল।
  371. বইছে=বসিয়াছে।
  372. সগলে=সকলে।
  373. বাখনাইতে=প্রশংসা করিতে।
  374. কতখান্‌তে=কত স্থান হইতে।
  375. অইবাইন্=হইবেন।
  376. বেগার্‌তা=অনুরোধ।
  377. কইতাম=কইতে, বলিতে।
  378. ভাঙ্গ্‌তি=বাধা।
  379. কইতাম না=কহিব না।
  380. জর্ম্মে=জন্মে।
  381. আইত না=হইবে না।
  382. করত না=করিবে না।
  383. গেছিল=গিয়াছিল।
  384. আননের=আনিতে।
  385. আমি কইয়া লই——আমাকে বলিতে দাও।
  386. তোমরার=তোমাদের।
  387. বাইন্‌=বুনন্, বয়ন।
  388. কেরে=কেন।
  389. আঞ্জাইয়া=জড়াইয়া।
  390. নির্য্যাস=খাঁটি; সত্য।
  391. জানছ=জানিস্।
  392. পাশুরবাম=পাশরিব, ভুলিয়া যাইব।
  393. অয়=হয়।
  394. অইব=হইবে।
  395. পূর্ণিত হওনের=পূর্ণহওয়ার।
  396. আইছ নি শুনিয়া=শুনিয়া আসিয়াছ কি?
  397. ছাড়ছ=ছাড়িয়াছ।
  398. দানাপানি=অন্নজল।
  399. বিউণীর......কেউর ঘরে?—পাখার উপর চিত্রিতা কন্যার মত কাউকে কি তুমি কারও ঘরে দেখিয়াছ?
  400. চে—রা=চেহারা।
  401. চিন্যা.....বার বচ্ছর ছাড়া—যুগব্যাপী বিচ্ছেদে মধুমালার অবয়বসমুহ, মদনকুমারের স্মৃতিতে আর তেমন উজ্জ্বল ভাবে চিত্রিত নাই। তাই, মধুমালাকে সে চিনিয়াও যেন চিনিতে পারিতেছে না।
  402. লউব=লইবে।
  403. শূন্য-রথ=যে রথ শূন্য দেশ দিয়া গমনাগমন করে। ব্যোমযান।
  404. আমরার=আমাদের।
  405. তারারে=তাহাদিগকে।
  406. কিচ্ছা=কেচ্ছা, গল্প।