পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/মইষাল বন্ধু

২। মইষাল বন্ধু। (২৯―৭৮, পৃঃ)

 ‘মইষাল বন্ধু’র দুইটি পালাই চন্দ্রকুমারের অসম্পূর্ণ সংগ্রহ। প্রথম পালাটি সূত্রকোণাগ্রামের চন্দ্রকুমার সরকার, কুল্লার আব্বাস নামক রায়ের বাজারের একজন গাড়োয়ান এবং সোহাগীগ্রামের নিধু ব্যাপারী নামক একজন পাট-ব্যবসায়ীর নিকট হইতে সংগৃহীত। দ্বিতীয় পালাটি ভাওয়াল পরগণার উছিগ্রাম নিবাসী গয়া নামক একজন নমঃশূদ্র, উক্ত গ্রামবাসী মাঝিয়া সেক নামক জনৈক ব্যক্তি এবং কাটঘরা গ্রামের গাছুনী সেখ নামক অপর একজন মুসলমানের নিকট হইতে সংগ্রহ করা হয়। প্রথম পালাটি ইংরেজী ১৯২৩ সালের ৭ই নবেম্বর তারিখে এবং দ্বিতীয়টি ১৯২৪ সালের ৭ই জানুয়ারী তারিখে আমি পাইয়াছি।

 মহিষরক্ষক ডিঙ্গাধর ও সুজাতী কন্যার অনুরাগকাহিনী অবলম্বনে মইষাল বন্ধুর দুইটি পালাই রচিত। কিন্তু পালা দুইটির বর্ণিত ঘটনার মধ্যে বিস্তর অনৈক্য আছে। অবস্থা-বিপর্য্যয়ে ডিঙ্গাধরের পিতাকর্ত্তৃক বলরামের নিকট হইতে ঋণগ্রহণ, ঋণগ্রহণানন্তর তাহার আকস্মিক মৃত্যু এবং তার পর নিঃসহায় ডিঙ্গাধরের পিতৃঋণ পরিশোধের জন্য বলরামের গৃহে চাকুরী-গ্রহণ পর্য্যন্ত আখ্যান ভাগ দ্বিতীয় পালাটিতে নাই। মঘুয়ার অনুপস্থিতিকালে মইষাল কর্ত্তৃক মঘুয়া-ভগিনী ময়নার পাণিগ্রহণ, দেশপ্রত্যাবৃত্ত মঘুয়ার কাঙ্গুরাজার নিকট বিচার প্রার্থণা এবং কাঙ্গুরাজা কর্ত্তৃক মইষালের প্রতি শূলের আদেশ―দ্বিতীয় পালার বর্ণিত এই উপাখ্যানাংশ প্রথম পালায় নাই। প্রথম পালায় আমরা মইষালের যে পিতৃবৃত্তান্ত পাই, তাহা মূল উপাখ্যানের সহিত সম্বন্ধহীন হইলেও উহার অবতারণা নিতান্ত উদ্দেশ্যহীন এবং ব্যর্থ হয় নাই। সঙ্গতিসম্পন্ন ‘সুজন’ গৃহস্থের অদৃষ্টবিড়ম্বনায় বিত্তনাশ এবং আকস্মিক মৃত্যু গ্রাম্য কৃষকজীবনের বিচিত্রতার চিত্র সুস্পষ্ট করিয়া দেখাইতেছে। পিতৃঋণের চিন্তায় আকুল, মলিনবেশী উপবাসী ডিঙ্গাধর একদিন বলরামের গৃহে উপস্থিত হইয়া যখন নিজের দৈন্য। নিবেদন করিয়া সুদীর্ঘ ছয়বৎসরের জন্য মহিষের রাখালী করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইল, তখন বড় দুঃখে তাহার মুখে যে হাসি ফুটিয়াউঠিল, কৃষক বালকের একান্ত দৈন্য সত্ত্বেও সেই হাসিতে তাহার ধর্ম্মভীরুতা ও পিতৃ-স্নেহ জাজ্জ্বল্যমান হইয়াছে। আমরা সাহস করিয়া বলিতে পারি, তথা-কথিত সভ্য জগতের কোন কৃষকের চিত্রে এই স্বৰ্গীয় জ্যোতি নাই। তার পর নির্জ্জন নদীর ঘাটে মইষাল সুজাতীর সাক্ষাৎ এবং আলাপে প্রথম যৌবনে কন্যার মুখে যে রক্তজবার রাগ ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহাতে অতি অল্প কথায় সমস্ত দৃশ্যটি উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে। পুর্ব্বরাগের পর তরুণতরুণীর মিলনের জন্য যে চিত্তের আকুলি ব্যাকুলী কবি বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা ভবৈশ্বর্য্যময় বৈষ্ণব কবিতা স্মরণ করাইয়া দিবে। ছয়মাস পরে মুক্তি পাইয়া অবস্থাচক্রের আবর্ত্তনে নানা সুখ দুঃখ অতিক্রম করিয়া ডিঙ্গাধর যখন অর্থসম্পদের অধিকারী হইল, তখনও সে সুজাতী কন্যার পূর্ব্বের অনুরাগ অক্ষুন্ন আছে কিনা, ইহার পরীক্ষা না করিয়া সোজাসুজি-ভাবে বলরামের বিধবার নিকট বিবাহ প্রস্তাব পাঠাইল না। ডিঙ্গাধরের চরিত্রে সর্ব্বদা এইরূপ একটা সংযমের ভাব দৃষ্ট হয়। ছদ্মবেশী ডিঙ্গাধর বলরামরে গৃহে উপস্থিত হইয়া সুজাতী কন্যা ও তাহার বিধবা মাতার যে দুর্দ্দশা প্রত্যক্ষ করিল তাহার চিত্র অত্যন্ত মর্ম্মস্পর্শী হইয়াছে। আষাঢ়িয়া মণ্ডলের চিত্র অপ্রাসঙ্গিক হইলেও ইহাদ্বারা কবি ব্যয়কুণ্ঠ কুসীদজীবীর একটা নিখুঁত ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন। রসুয়াঘটকের দ্বারা টাকা পাঠাইয়া, আষাঢ়িয়ার ঋণপরিশোধ এবং বাড়ী খালাস, এবং ডিঙ্গাধরের পরিচয় না দিয়া বিবাহের প্রস্তাব উত্থাপন, বিবাহ সম্বন্ধে সুজাতী কন্যার সর্ত্ত এবং পরিশেষে দুষ্মবেশী ডিঙ্গাধরের স্বরূপপ্রকাশ প্রভৃতি ঘটনা কবি অতি সুকৌশলে বর্ণনা করিয়াছেন। দুর্বৃত্ত মঘুয়ার কাহিনী এবং দ্বিতীয় পালায় বর্ণিত কাঙ্গুরাজার অদ্ভুত বিচার অনেকটা ভেলুয়ার পালার হিরণসাধুর বিবরণের অনুরূপ। পালাটি সম্পূর্ণভাবে সংগৃহীত না হওয়ায় গল্পের উপসংহার ভাগ সম্বন্ধে কোনও কথাই বলিতে পারিলাম না। তবে আখ্যায়িকার গতি পর্যালোচনা করিয়া ইহা অনুমান করা যাইতে পারে, দুর্বৃত্ত মঘুয়া অথবা নৃশংস কাঙ্গুরাজার শত অত্যাচারেও সুজাতী কন্যার নারীত্বের মর্য্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় নাই। পালাগানের প্রায় প্রত্যেকটীর উপসংহারে নায়িকার চিত্র গৌরবান্বিত হইয়াছে, এরূপ দেখা যায়। এই পালাটিতে ও সেই সাধারণ নিয়মের ব্যত্যয় হইয়াছে, বলিয়া মনে হয় না। বস্তুতঃ অসম্পূর্ণ গীতিকাটির শেষ কয়েক ছত্রে বিলাপাময়ী সুন্দরীর যে অটল একনিষ্ঠ প্রেমের রেখাপাত হইয়াছে,―তাহার শেষ দেখিবার ইচ্ছা আমাদের অতৃপ্ত রহিল। বাঙ্গালা দেশের ইতিহাসের অধ্যায়ে অধ্যায়ে সীতা-সাবিত্রী। কেহ জ্বলন্ত আগুণে পুড়িয়া মরিয়াছেন, কেহ বা তদপেক্ষাও কঠিনতর ত্যাগ দ্বারা স্বীয় মূর্ত্তি মহিয়ষী করিয়া দেখাইয়াছেন। অদূরে তমসা নদীর তীরে যে বীণা দূর অতীত কালে বাজিয়া উঠিয়াছিল―তাহার ঝঙ্কার যুগে যুগে কবিরা সুরতালমানযোগে প্রতিধ্বনি করিয়া এ দেশের প্রেম-মহাব্রতের পবিত্রতা প্রতিপন্ন করিয়াছেন। এই সকল নারী চরিত্রের কে বড় কে ছোট তাহা নির্ণয় করা শক্ত,―এ বাগানের গোলাপ ও স্থলপদ্ম, সন্ধ্যা মালতী ও মল্লিকা সকলটিই নিখুঁত সুন্দর। এই পালা-গানটিও বঙ্গসাহিত্যের আদি যুগের অর্থাৎ ত্রয়োদশ কিংবা চতুর্দ্দশ শতাব্দীর রচনা বলিয়া মনে হয়। ইংরেজী অনুবাদের মুখবন্ধে তৎসম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছি।

মইষাল বন্ধু

(১)

চলে নদী শিঙ্গাখালি ঢেউয়ে খুড়াসান[১]
যার জলে আশ্বিন মাসে খাইছে বাকের ধান[২]
সুজন গিরস্থ[৩] তথায় বসত যে করে।
তার কথা সভাজন শুন সুবিস্তারে[৪]
তের আড়া[৫] ভুইয়ের মধ্যে মইষে বায় হাল।
গোলাতে করিয়া তুলে সরু ধান চাল॥
এক পুত্ত্র আছে তার পূর্ণিমাসীর চান্[৬]
বাপ মা রাখ্যাছে তার ডিঙ্গাধর নাম[৭]
দশ না[৮] বচ্ছরের পুত্ত্র হাস্যা খেলায় পাড়া।
এমন কালে মর্‌ল মাও দুঃখ হইল বাড়া॥১০

একে একে তার ঘরের লক্ষ্মী গেল ছাড়ি।
আগুন লাগিয়া পুড়ে তিন খণ্ড[৯] বাড়ী॥১২
আরে ভাইরে—
বাতানে[১০] মইষ মরল পালে[১১] মরল গাই।
বিপদকালে রাখে তারে এমন বান্ধব নাই॥১৪
আইশনা[১২] পাণিতে তার খাইল বাকের ধান।
দুঃখের দরদী নাই করিতে আসান[১৩]১৬
কাণাকড়ার সম্বল নাই চিন্তা মনে মনে।
কি দিয়া বাইব[১৪] হাল বাঁকের জমীনে॥১৮
ভাবিয়া চিন্তিয়া সাধু কোন কাম করে।
গিঠেতে বান্ধিয়া চিড়া[১৫] যায় শিঙ্গাপুরে॥২০
শিঙ্গাপুরের বলরাম ধনী মহাজন।
ধনের লাগিয়া তার নাই অনাটন[১৬]২২
ধারে সুদে কত লোক টাকা লইয়া যায়।
সেই সুদে বলরাম সংসার চালায়॥২৪
বার মাসে তের পার্ব্বণ মণ্ডলের রাজা।
আশ্বিন মাসে বলরাম করে দুর্গাপূজা॥২৬
কার্ত্তিক মাসে কার্ত্তিক পূজা করে জাকাইয়া।
আগুণ[১৭] মাসে লক্ষ্মীপূজা[১৮] নয়া[১৯] ধান দিয়া॥২৮

পড়িল দুঃখের দিন কিছু টাকা চাই।
সোণার জমীন পড়্যা রইল হাল গরু নাই॥৩০
দয়া যদি কর প্রভু কির্‌পা[২০] যদি কর।
গণিয়া দিবাম সুদ দেও কিছু ধার॥৩২
একশ’ টাকা কর্জ্জ কর্‌ল কইরা লেখাপড়া[২১]
বাড়ীতে ফিরিল সাধু হইয়া গোয়ারা[২২]৩৪
আগুণে পুড়িয়া গেছে বান্ধে নয়া ঘর।
হালের মহিষ কিনিয়া লইল হরিষ অন্তর॥৩৬
জমিনে বাহিয়া হাল বুইন[২৩] করল ধান।
চৈত্রমাসে দিল সাধু জমীতে নিড়ান॥৩৮
বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ দুইমাস গেল এই মতে।
আষাঢ় মাসে পাকা ধান লাগিল কাটিতে॥৪০
কার ধান কেবা কাটে সাধু মৈল জ্বরে।
ক্ষেতের ধান ক্ষেতে রইল এমন প্রকারে॥৪২
আশা কইরা করে লোক নৈরাশে ডুবায়।
কার ধান জমি বাড়ী কোথায় রাখ্যা যায়॥৪৪

(২)

কান্দে পুত্ত্র ডিঙ্গাধর আগে মইল মাও।
হয়রাণে[২৪] ফেলিয়া বাপা কোথায় চইলে যাও॥

তুমি ছাড়া এই সংসারে আর লক্ষ্য নাই।
গেরামে[২৫] না আছে কেউ জ্ঞাতি বন্ধ[২৬] ভাই॥
কান্দে পুত্ত্র ডিঙ্গাধর করি হায় হায়।
পাড়া পড়সীরা আস্যা ছাওয়ালে বুঝায়॥
বাপ মাও লইয়া কেউ জন্ম ভইরা না থাকে।
ডিঙ্গাধর কান্দে বিধি ফেলিলা বিপাকে॥
জ্ঞাতি নাই বন্ধু নাই মায়ের পেটের ভাই।
অকূলে ভাস্যাছি অখন কার বাড়ী যাই॥১০
হালের না মইষ বেচ্যা শেষ কাম করে।
তের বচ্ছর ডিঙ্গাধর কাটাইল ঘরে॥১২
বাপে ত কইরাছে ঋণ পুত্ত্র নাই সে জানে।
বলরাম বাড়ী আস্যা জানায় এক দিনে॥১৪
ধার্ম্মিক সুজন বড় ছিল তোমার বাপ।
অকালে মরিয়া গেল পাইনু বড় তাপ॥১৬
একশ টাকা করজ[২৭] করে বিপাকে পড়িয়া।
পরমাণ[২৮] করিল তাহা খত দেখাইয়া॥১৮
গাও গ্রামের লোক তারা সাক্ষী আছে।
দিবা কি না দিবা টাকা বলরাম পুছে॥২০
আসমান্ ভাঙ্গিয়া পড়ে ডিঙ্গাধরের শিরে।
সময় লইল দুইমাস বলরামের কাছে॥২২
হায় ভালা—
কান্দে ডিঙ্গাধর সাধু না দেখি উপায়।
কিমতে বাপের ডিঙ্গা সুজন[২৯] সে যায়॥২৪
ধার রাখ্যা মরে যদি নাহি হয় গতি।
ঋণের পাপেতে তার নরকে বসতি॥২৬

গাছ হইয়া জন্মে যদি লতা হইয়া বেড়ে[৩০]
ঋণ পাপের মুক্তি নাই জন্ম জন্মান্তরে॥২৮
গরু হইয়া খাট্যা মহাজনের ধার।
ভাবিয়া চিন্তিয়া মরে সাধু ডিঙ্গাধর॥৩০
জ্বর মাথাবিষ নাই দিনে দিনে বাড়ে[৩১]
এক পয়সা সুদ পাইলে কড়া নাই সে ছাড়ে॥৩২
বলার[৩২] কামরে যেমন মানুষ হয় ফানা[৩৩]
সকল দুঃখের অধিক দুঃখ যার আছে দেনা॥৩৪
অভাবে পড়িয়া বাপে বেচেছে ক্ষেত খোলা।
ঘর বাড়ী ভাঙ্গ্যা পড়্‌ছে নাই ছানি পালা[৩৪]৩৬
হালের মহিষ বেচ্যা আগে কর্‌ছে পিতৃকাম[৩৫]
কি দেখ্যা সুদের উসুল দিব বলরাম॥৩৮
ভাব্যা চিত্তা ডিঙ্গাধর কোন কাম করে।
দুপুর বেলা উপনীত সাধুর দুয়ারে॥৪০

(৩)

ছান[৩৬] নাই খাওয়া নাই সে দিনের উপবাসী।
বলরামের ঘরে গেল বড় দুঃখু বাসি।
বস্যা আছে বলরাম বাইর বাড়ী মহলে।
পায়ে ধর‍্যা ডিঙ্গাধর বলরামে বলে॥

শোধিতে বাপের ধার কইরাছি মনে।
তুমি যদি কির্‌পা কইরা রাখ ছিচরণে[৩৭]
বাপের যে ধার যত পুত্ত্রের হয় দেনা।
বলরাম কয় কাল কইরাছ..........॥
কত টাকা আনিয়াছ হিসাব কিতাব।
তোমার কাছেতে বাপু নাহি চাই লাভ॥১০
খালি হাত দেখাইয়া কান্দে ডিঙ্গাধর।
কড়ার ভিক্ষুক আমি তোমার চাকর॥১২
আস্যাছি দুয়ারে তোমার বড় আশা করি।
বাপের ঋণ শোধ দিব করিয়া চাকুরি॥১৪
সাত পাঁচ ভাবি তবে কয় বলরাম।
চেংড়া চাকরে আমার আছে এক কাম[৩৮]১৬
আজি হইতে কর্‌বা তুমি মইষের রাখালী।
ছয় বচ্ছর খাট্যা দিলে তবে হইব ফালি[৩৯]১৮
বড় দুঃখে ডিঙ্গাধরের হাসি আইল মুখে।
আজি হইতে বাপের ধার শুধব একে একে॥২০

* * * * *

(8)

ডিঙ্গাধর সাধুর কথা এইখানে থইয়া[৪০]
সাজুতী কন্যার কথা শুন মন দিয়া॥
বলরামের এক কন্যা যুবাবতী[৪১] ঘরে।
তার কথা কইবাম সভার গোচরে॥

দেখিতে শুনিতে কন্যা আস্‌মানের তারা।
পুরীমাঝে জ্বলে কন্যা চান্দের পশরা[৪২]
কাউয়া কালা কোকিল কালা কালা দইরার পানি[৪৩]
তাও হইতে অধিক কন্যার কেশের বাখানি[৪৪]
বাটীখুটী[৪৫] সুন্দর কন্যা চিরল দাঁতের হাসি।
কি কইবাম মুখের রূপ যেমন পুণ্ণুমাসী[৪৬]১০
একমাত্র সুন্দর কন্যা বলরামের ঘরে।
বিয়া দিত[৪৭] বলরাম সদাই চিন্তা করে॥১২
হিরাজিড়ীর ফুলময় রাখিত তুলিয়া। (?)
মঙ্গলচণ্ডী পূজে মাও বিয়ার লাগিয়া॥১৪
দৈবে ঘটাইল যাহা শুন দিয়া মন।
নদীর ঘাটে যায় কন্যা করিতে সিনান॥১৬
কাকেতে[৪৮] ঘরুয়া কলসী শিরে গন্ধ তেল।
একেলা চলিল কন্যা কেউনা সঙ্গে গেল॥১৮
আগল পাগল[৪৯] কালা মেঘ বাতাসেতে উড়ে।
ছান করিবারে কন্যা গেল নদীর পারে॥২০
নদীর জলে[৫০] পাগল ঢেউ পাড়ে মারে হানা[৫১]
এই পন্থে[৫২] পথিকের নাই সে আনাগুনা[৫৩]২২

হাটু জলে নাম্যা কন্যা হাটু মাঞ্ছন[৫৪] করে।
কোমর জলে নাম্যা কন্যা কোমর মাঞ্জন করে॥২৪
গলা জলে লাম্যা কন্যা চারি ভিতে চায়।
ঘরুয়া[৫৫] পিতলের কলসী সুতে[৫৬] ভাস্যা যায়॥২৬
কে দিবে আনিয়া কলসী কারে বা শুধাই।
সুজন দরদী[৫৭] বন্ধু কেউ কাছে নাই২৮
ঢেউয়ের তালে ভাস্যা কলসী যায় অনেক দূর।
কে দিব আনিয়া কলসী না জানি সাতুর[৫৮]
আসিয়া ছানের[৫৯] ঘাটে পড়িলাম বিপাকে।
কাঁকের কলসী মোর ভাস্যা গেল পাকে॥৩২
বাপে মায়ে দিব গালি বড় হইল বেলা।
একত কইরাছি দোষ আস্যাছি একেলা॥৩৪
আর ত কইরাছি দোষ কলসী নিল সুতে।
কি নিয়া যাইব ঘরে ফির্যা শুধু হাতে॥৩৬
আস্‌মানের দেবতা বায়ুরে উজান বহাও পানি।
সুতের কলসী মোর তুমি দেও আনি॥৩৮

* * * *

বাতাসে না শুনে কথা কন্যালো আমার কথা ধর।
আমি আন্যা দিবাম কলসী তুমি যাও ঘর॥
একেলা আছিল কন্যা হইল দুইজন।
জলের ঘাটে চারি চক্ষুর হইল মিলন॥৪০
মনে মনে কয় কন্যা মন সাক্ষী করি।
বাপের মৈষাল তুমি থাক বাথান বাড়ী[৬০]৪২

“আজিকার বাঁশীতে কেন কাড়িয়া লয় মন।” ৩৯ পৃঃ

লাজেতে হইল কন্যার রক্তজবা মুখ।
পরথম[৬১] যৌবন কন্যার এই পরথম সুখ॥৪৪
আনিল ঘরুয়া কলসী তুলিয়া মইষালে।
জল ভরিয়া কন্যা লইল কাঁকালে[৬২]৪৬
আষ্ট আঙ্গুল বাঁশের বাঁশী মধ্যে মধ্যে ছেদা।
নাম ধরিরা বাজায় বাঁশী কলঙ্কিনী রাধা॥৪৮
সেই বাঁশী বাজাইয়া মইষাল গোষ্ঠে যায়।
আজি কেন সুন্দর কন্যা ফির‍্যা ফির‍্যা চায়॥৫০
আজি কেন মইষাল তোমার হইল এমন।
তোমার হাতের বাশী হইল দোষমণ[৬৩]৫২
নিতি নিতি হইলে দেখা এমন না হয়।
আজি কেন সুন্দর কন্যার জীবন সংশয়॥৫৪
তেমল্লায়[৬৪] উঠিয়া কন্যা সিঞ্চা[৬৫] কাপড় ছাড়ে।
মন হইল উচাটন সেই না বাঁশীর সুরে॥৫৬
আর দিন বাজে বাঁশী না লাগে এমন।
আজিকার বাঁশীতে কেন কাড়িয়া লয় মন॥৫৮
এই বাঁশী সেই বাঁশী নয় বাজে নয়া তানে।
বিনাথ[৬৬] মইষাল আইজ মরিল বাথানে॥৬০
মইষ রাখ মইষাল বন্ধুরে ক্ষীর নদীর পারে।
মজিল অবুলার[৬৭] মন তোমার বাঁশীর সুরে॥৬২

রইদে[৬৮] কেন পুড়বে বন্ধু মেঘে কেন ভিজ।
বিলে আছে পউদের পাতা[৬৯] আন্যা মাথায় ধর॥৬৪
সুজন চিন্যা পিরীত করা বড় বিষম লেঠা
ভাল ফুল তুলিতে গেলে অঙ্গে লাগে কাটা॥৬৮
রে বন্ধু অঙ্গে লাগে কাটা॥
আমিত অবলা নারীরে বন্ধু হইলাম অন্তর পুড়া[৭০]
কুল ভাঙ্গিলে নদীর যেমন মধ্যে পড়ে চড়া[৭১]৭০
রে বন্ধু মধ্যে পড়ে চড়া॥
লাজ বাসি মনের কথা কইতে নাহি পারি।
দেখাইতাম বুকের দুঃখু বুক মোর চিরি॥৭২
রে বন্ধু বুক মোর চিরি॥
কইতে নাহি পারি কথা বাপ মায়ের কাছে।
লীলারী[৭২] বাতাসে মোর অন্তর পুড়্যা গেছে॥৭৪
রে বন্ধু মোর অন্তর পুড়্যা গেছে।
নদীর ঘাটে দেখাশুনা কঙ্খেতে[৭৩] কলসী।
সেইদিন পাগল কইর‍্যা গেছেরে বন্ধু তোমার ঐ না
মোহন বাঁশীরে বন্ধু॥৭৬
ঐ না মোহন বাঁশী॥

ঘরের বাহির হইতে নারি কুলমানের ভয়।
অবলা নারীর মনে আর বা কত সয়॥৭৮
রে বন্ধু আর বা কত সয়॥
মনের বুঝাই কত মন না মানে মানা।
এ ভরা যৌবন কলসী দিনে দিনে ঊণা[৭৪]৮০
রে বন্ধু দিনে দিনে ঊণা॥
পশু পঙ্‌খী[৭৫] এ নাই সে জানে না জানে পওন[৭৬]
মনের আমার দুষ্কু[৭৭] কথা জানে আমার মন॥৮২
রে বন্ধু জানে আমার মন॥
পক্ষী যদি হইতামরে বন্ধু উড়িয়া উড়িয়া।
তোমার মুখ দেখতাম বন্ধু ডালেতে বসিয়া॥৮৪
রে বন্ধু ডালেতে বসিয়া॥
ইচ্ছা হয় তোমার লাগ্যা ছাড়ি কুলমান।
মুছাইয়া শীতল করি তোমার অঙ্গের ঘাম॥৮৬
রে বন্ধু তোমার অঙ্গের ঘাম।
তুমি যথা থাকরে বন্ধু আমি থাকি তথা।
রৌদ্র কালে ছায়ার লাগ্যা শিরে ধরি পাতা॥৮৮
রে বন্ধু শিরে ধরি পাতা॥
আর কতদিন থাকব বন্ধু মন ভাড়াইয়া[৭৮]
বাপে মায়ে যুক্তি কইরা মোরে দিত[৭৯] বিয়া॥৯০
রে বন্ধু মোরে দিত বিয়া॥

বাপ মায় না জানে রে বন্ধু মনে যত বলে।
মন যদি পাগল হয় কি করিব কুলে॥৯২
রে বন্ধু কি করিব কুলে॥
একত[৮০] শীতল জলের হাওয়া আরত শীতল জানি।
তা হইতে অধিক শীতল ডাবের মধ্যে পানি॥৯৪
রে বন্ধু ডাবের মধ্যে পানি॥
তা হইতে অধিক শীতল যৈবনে[৮১] পিরীতি।
তা হইতে অধিক শীতল মনোবাঞ্ছার পতি[৮২]৯৬
রে বন্ধু মনোবাঞ্ছার পতি॥
গাঙ্গে উঠে খৈয়া ঢেউ[৮৩] আসমান কাছে নীলা।
তার মধ্যে ফুটে ফুল কালার মধ্যে ধলা॥৯৮
রে বন্ধু কালার মধ্যে ধলা॥
কার বা গলার মালারে বন্ধু কার বা মুখের হাসি।
ফুট্যা রইছে চম্পা ফুল না ঝরা না বাসী॥১০০
রে বন্ধু না ঝরা না বাসী॥
সেই ফুল তুলিয়ারে বন্ধু গাথ্যা দিতাম মালা।
ঘরের বাহির হইতে নারি আমি যে অবলা॥১০২
রে বন্ধু আমি যে অবলা॥

(৫)

এহি মতে সুন্দর কন্যা করয়ে কান্দন।
বাথানে মৈষালের কথা শুন সভাজন॥
আসমানেতে ফুটে তারা ছিন্ন ভিন্ন দেখি।
মৈষাল ভাবে এই মত কন্যার দুইটী আখি॥

আসমান্ জুড়্যা কালা মেঘ উড়্যা উড়্যা যায়।
নীলাম্বরী পর‍্যা কন্যা জলের ঘাটে যায়[৮৪]
নদীতে উঠে খৈয়া ঢেউ লীলুয়ারী বাতাসে।
মৈষাল শুইয়া ভাবে কন্যার দীঘল লম্বা কেশে॥
জলের উপর পউদের ফুল চারিদিকে পাতা।
মৈষাল ভাবে কন্যার মুখ পিউরী[৮৫] দিয়া গাঁথা॥১০
ভাবিয়া চিন্তিয়া মৈষাল হইল পাগল।
কার মইষ কেবা রাখে ঘটিল জঞ্জাল॥১২
এক দিনের কথা সবে শুন দিয়া মন।
বাথানের মইষ গিয়া খাইল বাঁকের ধান॥১৪
ধুপুরিয়া[৮৬] সংবাদ কয় জমীদারের আগে।
বাঁকের যত ধান খাইছে বলরামের মইষে॥১৬
হাতে লাঠি পাইক পেয়দা বলরামের বাড়ী।
শীঘ্রি কইরা চল যাই রাজার কাচারি॥১৮
কান্দ্যা কান্দ্যা যায় বলরাম না দেখি উপায়।
শীতলমন্দির ঘরে কান্দে সাজুতীর মায়॥২০
সাজুতী সুন্দরী কান্দে আউলাইয়া[৮৭] কেশ।
আইজ হইতে বাপের আশা হইল বুঝি শেষ॥২২
দেউরী ঘরে[৮৮] বলরাম হইল হাজির।
চারিদিকে কুছামারা[৮৯] বড় বড় বীর॥২৪
এইরূপে রইল বলাই বন্দীখানা ঘরে।
এথা শুন ডিঙ্গাধর কোন কাম করে॥২৬

জোর হাতে খারা হইল জমিদারের আগে।
প্রভু বধ কর যদি ধর্ম্মের দুহাই[৯০] লাগে॥২৮
প্রভুরে ছাড়িয়া দেও মোরে আটক করি।
ছয় বচ্ছর খাট্যা দিবাম তোমার গুণাগারি[৯১]৩০
বাথানের মইষ আর ডিঙ্গাধরে থইয়া।
বলরাম মুক্তি পাইল শ্রীদুর্গা স্মরিয়া॥৩২
একেল। কান্দয়ে কন্যা এই কথা শুনিয়া।
আহা রে প্রাণের বন্ধু গেলারে ছাড়িয়া॥৩৪
কি আর করিব বন্ধু আমি ঘরের নারী।
নাকের নথ বেচ্যা দিতাম মইষের গুণাগারি॥৩৬
খাইতে না যায় কন্যা শুইতে না শুইয়ে।[৯২]
আঞ্চল পাতিয়া কন্যা পড়্যা থাকে ভূঁয়ে॥৩৮
মায়ে নাহি জানে দুঃখ বাপে নাহি জানে।
রইয়া রইয়া অন্তর পুড়ে তোষের আগুনে॥৪০
রে বন্ধু তোষের[৯৩] আগুনে॥
এমন আগুন রে বন্ধু জলে নাই সে নিবে।
কান্দিয়া কাটিয়া আর কতদিন যাবে॥৪২
নারীর যৈবন যেমন জোয়ারের পানি।
পন্থে বাহির হইলে লোকে করে কাণাকাণি॥৪৪
রে বন্ধু করে কাণাকাণি॥

* * * * *

* * * * *

(৬)

বিলাই বান্ধ্যা ভাত খায় আষাঢ়্যা মণ্ডল[৯৪]
মাউগের[৯৫] পিন্ধনে নাই কাপড় ভাইয়ে মারে চড়চাপড়[৯৬]
পুতে ডাকে লাউডের পাগল[৯৭]
লেংঠী পিন্ধ্যা থাকে শালা পাটি নাই ঘরে॥
দিন রাইত শুইয়া বইয়া[৯৮] সুদের চিন্তা করে॥
ট্যাকার কুমইর[৯৯] ব্যাটা লোকে করজ[১০০] দিলে।
হিসাব কইরা সুদ লয় কড়া ক্রান্তি তিলে॥
এক টঙ্কার[১০১] সুদ হয় যত বুড়ি কড়ি।
তিলে তুল্যে গণ্যা লয় হিসাব ঠাহরি[১০২]
এক সুন্ধ্যা[১০৩] খাইলে আর এক সুন্ধ্যা নাহি খায়
পাতার মশাল জ্বাল্যা রজনী গুয়ায়[১০৪]১১

ভাব্যা চিন্তা বলরাম যায় তার বাড়ী।
পাঁচশ’ টাকা করজ করে ইমান[১০৫] সাবুদ[১০৬] করি॥১৩
গুণাগারি দিয়া মইষ আনাইল ছুটাইয়া।
জমিদার কিরপা[১০৭] করি দিল সে ছাড়িয়া॥১৫
ছয়মাস পরে তবে সাধু ডিঙ্গাধর।
মুক্তি পাইয়া না আইল বলরামের ঘর॥১৭

* * * * *

* * * * *

(৭)

দারুণ্যা[১০৮] আষাঢ়্যা নদী পাগল হইয়া যায়।
নদীর কূলে ডিঙ্গাধর কান্দিয়া বেড়ায়॥
মাও নাই বাপ নাই গর্ভসোদর ভাই।
ঘরে যে জ্বালিব বাতি এমন বান্ধব নাই॥
সাতুরিয়া[১০৯] ডিঙ্গাধর নদী হয় পাড়ি।
ডেরুয়া[১১০] তুফানে তার শিরে লাগে বাড়ি॥
বাড়ি খাইয়া ডিঙ্গাধর উভে হয় তল।
এই খান নদীর মধ্যে সাত চইর[১১১] জল॥
দৈবের নির্ব্বন্ধ কথা শুন মন দিয়া।
পুবাল্যা বেপারী যায় সাত ডিঙ্গা বাইয়া॥১০
এক ডিঙ্গায় ধান চাউল এক ডিঙ্গায় সরু[১১২]
লবণ মরিচ আদা লইয়াছে গুরু[১১৩]১২

বাইশ দাঁড় বাইয়া যায় সুর্ম্মাই নদী দিয়া।
নজর কইরা ডিঙ্গাধরে লইল তুলিয়া॥১৪
আছে কি না আছে জিউ[১১৪] নাকে নাই সুয়াস[১১৫]
পুবাল্যা[১১৬] ব্যাপারী কয় নাই জীবনের আশ॥১৬
কতদিনে ডিঙ্গাধর পরিসুস্থ[১১৭] হইল।
পুবাল্যা ব্যাপারীর স্থানে বচ্ছর গুয়াইল॥১৮
বাপ হইল পুবাল্যা পুত্ত্র ডিঙ্গাধর[১১৮]
পুবাল্যা কয় বাপু এই তোমার বাড়ী ঘর॥২০
পুত ক্ষেত নাই মোর সাত ডিঙ্গা ছাড়া।
বাণিজ্যি করিয়া যাই দেশ বিদেশ খুড়া॥২২
উত্তর‍্যা[১১৯] বাতাস লাগ্যা পুবাল্যা যে মরে।
সাত ডিঙ্গা ধান তার পাইল ডিঙ্গাধরে॥২৪
দেশে চলে ডিঙ্গাধর সুর্ম্মাই নদী বাইয়া[১২০]
বার দিনে হাজির হইল নিজের দেশে যাইয়া॥২৬
চৌখণ্ডী[১২১] করিয়া তবে শিঙ্গাখালীর পারে।
বড় বড় ঘর বান্ধে দক্ষিণ দুয়ারে॥২৮
তবে ডিঙ্গাধর সাধু কোন কাম করিল।
সাজুতি কন্যার কথা মনেত পড়িল॥৩০
পাঁচ বচ্ছর গোঁয়াইল দেশ বিদেশ ঘুড়ি।
কেমনে কোথায় আছে সাজুতী সুন্দরী॥৩২
হৈছে কি না হৈছে বিয়া আছে কি না আছে।
একদিন তার কথা মনে নি পইরাছে॥৩৪

কান্ধে লইল ভিক্ষার থলি হাতে লইল লড়ি।[১২২]
গোপন বেশেতে চলে বলরামের বাড়ী॥৩৬
বড় বড় ঘর খালি ভাঙ্গ্যা হইছে সারা।
বলরাম মইরা গেছে বাড়ী পড়ছে পরা[১২৩]৩৮
গিরস্থ ভাই মইরা গেছে বাড়ী পড়ছে পরা।
কেউ লামায় চালের ছন কেউ ভাঙ্গে বেড়া[১২৪]৪০
মায়ে ঝিয়ে কান্দ্যা দেখ রজনী গোঁয়ায়।
তারে দেখ্যা ডিঙ্গাধর করে হায় হায়॥৪২
জিগির[১২৫] ছাড়িয়া ফকির খাড়াইল[১২৬] দুয়ারে।
এক মুইঠা চাউল নাই কি দিব ফকিরে॥৪৪
চাইয়া রইল সুন্দর কন্যা আখিতে জল ঝরে।
ফকির হইয়া কেমনে বিদায় করিব ফকিরে[১২৭]৪৬
পিন্ধন কাপড়ে কন্যার শত জোড়া তালি।
আগুনের ফুরুঙ্গি[১২৮] যেমন ছাইয়ে[১২৯] হইছে কালি॥৪৮
এই দেখ্যা ডিঙ্গাধরের কলিজা যে ফাটে।
বারুদের আগুন যেমন জিক্‌কাইর মার‍্যা উঠে[১৩০]৫০

(৮)

* * * * *

শুধা হাতে ডিঙ্গাধর আইল নিজ বাড়ী।
বিয়া না কইরাছে আইজও সাজুতি সুন্দরী॥
রসুয়া[১৩১] ঘটকে তবে দিল পাঠাইয়া।
রসুয়া চলিল তবে মুখে রস লইয়া॥
বিয়ার ঘটক আইছে বলরামের বাড়ী।
মায়েত বসিতে দিল নূতন একখান পিড়ি॥
যুবাবতী হইল কন্যা আছে তোমার ঘরে।
এমন সুন্দর কন্যা নাহি দেখি আরে॥
বিয়ার ঘটক আমি খবর লইয়া ফিরি।
আমায় কহিলে আমি ঘটাইতে পারি॥১০
মনের যতেক কথা কও মোর কাছে।
দশ বিশ পাত্র মোর সন্ধানেতে আছে॥১২
ঘটক কহিছে তবে ঘরুণীর[১৩২] আগে।
তোমার কন্যা বিয়া দিতে কি কি দ্রব্য লাগে॥১৪
কান্দিয়া কন্যার মায়ে অন্ধ করছে আখি।
চারিদিক আন্ধাইর হইল চক্ষে নাহি দেখি॥১৬
পাঁচ শ টাকা করজ থইয়া সাধু মইরা যায়।
ধারে বরে বান্ধিয়াছে না দেখি উপায়॥১৮
বাথানের মইষ যত বান্ধা বন্ধক দিয়া।
শুধ্যাছি অর্দ্ধেক ধার সময় চাহিয়া॥২০
ছয়মাসের মধ্যে ধার দিতে নাহি পারি।
আষাঢ়্যা লইয়া যাইব ঘরবণ্ডি[১৩৩] বাড়ী॥২২

ছেড়ারে[১৩৪] করাইব বিয়া সাজুতী কন্যায়।
কন্যা পণ দিতে হইব এই ঋণের দায়॥২৪
উরুম্বার[১৩৫] গোষ্ঠী সেই আষাঢ়্যা মরল।
কিনিতে আমার কুল হইয়াছে পাগল॥২৬
মারিয়া কাটিয়া কন্যা ভাসাইব জলে।
আপনি ডুবিয়া মরবাম্ কলসী বন্ধ্যা গলে॥২৮
ছয়মাস গুয়াইতে[১৩৬] সাত দিন আছে।
এর মধ্যে নাহি জানি কপালে কি আছে॥৩০
বাড়ী ঘর বান্ধ্যা দিবাম শুধ্যা দিবাম ধার।
সাত দিন মধ্যে আন্যা দিবাম সমাচার[১৩৭]৩২
একদিন দুইদিন তিনদিন গেল।
চারি দিনের দিনে তবে রসুয়া আইল॥৩৪
সুদে আর হালে[১৩৮] গণ্যা তবে কড়াক্রান্তি করি।
আষাঢ়্যার ধার শুধ্যা বান্ধ্যা[১৩৯] দিল বাড়ী॥৩৬
সম্বন্ধের কথা তবে রসুয়া তুলিল।
আর ছলে ডিঙ্গাধরের পরিচয় না দিল॥৩৮
তবে ত সাজুতী কন্যা ভাবে মনে মন।
বিয়ার দিনের আর নাহি বিলম্বন॥৪০
ঘটকে জানাইল কন্যা ছল যে করিয়া।
এক সত্য আছে মোর শুন মন দিয়া॥৪২
ঘর পাইলাম বাড়ী পাইলাম আর যত ধন।
পূর্ব্বকথা আছে মোর এক বিবরণ॥৪৪
বাপের মৈষাল ছিল থাকিত বাথানে।
কোন দেশে আছে তার না জানি সন্ধানে॥৪৬

ছয় বচ্ছরের লাগ্যা[১৪০] লইছিল চাকুরি।
ছয় মাস খাট্যা দিয়া গেছে নিজ বাড়ী॥৪৮
কোন দেশে বাড়ী ঘর না জানি সন্ধান।
তাহাদের আনিয়া দিবা মইষের কারণ॥৫০
মা ঝি দুইজন আছি হারা দিশ[১৪১]
নারী হইয়া কেমনে পালি বাথানের মহিষ॥৫২
রসুয়া এতেক শুনি চলিল ধাইয়া।
বার্ত্তা জানাইল তবে ডিঙ্গাধরে গিয়া॥৫৪
কথা শুনি ডিঙ্গাধর কোন কাম করে।
আপনি ঘটক সাজ্যা যায় কন্যার ঘরে॥৫৬
দীঘল কেশের জুঠী[১৪২] শিরেত বান্ধিল।
আড়াঙ্গী[১৪৩] মাথায় দিয়া পন্থে মেলা দিল॥৫৮
কতক্ষণে উপনীত বলরামের বাড়ী।
রসুয়া ঘটকের কথা কয় দড়বড়ি[১৪৪]৬০
পর্‌তিজ্ঞা[১৪৫] কইরাছ কন্যা এই কথা শুনিয়া।
ডিঙ্গাধর কয় আমি তোমার লাগিয়া॥৬২
রসুয়া আমার ভাই ঘটকালি জানে।
আগেতে জানাইতে উচিত ছিল তোমার পণে॥৬৪
ঘরবাড়ী বান্ধ্যা দিলাম উচিত মত কথা।
আষাঢ়্যার ঋণ যত শুধ্যা দিলাম তথা॥৬৬
সম্বন্ধ করিয়াছি স্থির বিয়ার লাগিয়া।
বিয়ার জামাই আছে খাটেতে বসিয়া[১৪৬]৬৮

কোথায় পাইবাম মইষালেরে কোন দেশে যাই।
কিরূপে তাহারে বল খুঁজিয়া সে পাই॥৭০
আজ হইতে করবাম আমি মইষের রাখালি।
সম্বন্ধ করিয়া মোর রাখ ঘটকালী॥৭২
দীর্ঘকেশ ছাড়ে আর ঘটকালীর বেশ।
হাতে ফলা[১৪৭] মাথায় টুপ[১৪৮] মইষাল বন্ধুর বেশ॥৭৪
তখন সাজুতী কন্যা নজর কইরা চায়।
মৈষাল বন্ধুরে তার সাম্‌নে দেখা যায়॥৭৬
হাতে ছিল আঁড় বাশী[১৪৯] বাঁশীতে মাইল টান[১৫০]
কতদিনে বাজ্যা উঠল্ পুরাণ বন্ধুর গান॥৭৮
সভায় উঠল্ গণ্ডগোল রাত্র বেশী নাই।
এক ছুলুম তামাক খাইয়া বিয়ার গীত গাই॥৮০
ঢুল[১৫১] বাজে ডগর[১৫২] বাজে শানাই বাজে রইয়া[১৫৩]
ডিঙ্গাধরের সঙ্গে হইল সুন্দর কন্যার বিয়া॥৮২


দ্বিতীয় শাখা

চাডী গাইয়া[১৫৪] মঘুয়া যায় পাঁচ ডিঙ্গা বাইয়া।
সেই ডিঙ্গা বাইয়া যায় সুর্ম্মাই নদী দিয়া॥
(আরে ভালা) লাল বইডা[১৫৫] নীল বইডা ঝুমুর ঝুমুর[১৫৬] করে।
বইডার খিচুনীতে[১৫৭] জল তোলপাড় করে॥
জাল বায় বুন্ধারে[১৫৮] মাঝি মাল্লাগণ।
পুইছ[১৫৯] করিল এই দেশের কিবা নাম॥
হাত বাঁক[১৬০] পাণি বাইয়া ডিঙ্গাধরের ঘাট।
সেই ঘাটে বান্ধা আছে পাষাণের পাট[১৬১]
পাটেতে সাজতী কইন্যা বইসা করে ছান।
সুরূপ সুন্দরী কন্যা পূণ্ণিমাসীর চান্॥১০
ভিজা নীলাম্বরী ফুট্যা বাহির হয় গায়ের রূপ।
ঘাটেতে বসিয়া কইন্যা খোয়ায়[১৬২] পঞ্চ খুপ[১৬৩]
আঞ্চলে ঘসিয়া তুলে পায়ের মেন্দি বাটা।১৩

* * * * *

এরে দেইখ্যা মথুয়া তবে হইল পাগল।
ভাটি গাঙ্গে থাইক্যা বেটা করিল নজর॥১৫

নজর কইরা চায়।
কিমত সুন্দরী কন্যা ঘাটে দেখা যায়॥১৭
পরীর সমান রূপ আউলাইল মাথার কেশ।
অঙ্গেতে শোভেছে কন্যার নীলাম্বরী বেশ॥১৯
মুখখানি দেখে কইন্যার চান্দের মতন।
জলের ঘাটে বইস্যা কইন্যা করয়ে মাঞ্জন[১৬৪]২১
ভিন্‌দেশী নাইয়ারে[১৬৫] দেখ্যা কন্যা কোন কাম করিল।
ঘড়ুয়া কলসী[১৬৬] কন্যা কাঙ্খে[১৬৭] করি লইল॥২৩
বাড়ীর পানে যাইতে কন্যা পন্থে দিল মেলা।
পর্‌থম যৌবন কন্যা চলিল একেলা॥২৫
জলের ঘাটেতে ডিঙ্গা কাছি বন্দ করি।
কিছুকাল রইল মঘুয়া আপনা পাসরি॥২৭
সন্ধ্যাবেলা যায় মঘুয়া ডিঙ্গাধরের বাড়ী।২৮

* * * * *

বইয়া আছে ডিঙ্গাধর কামটঙ্গী ঘরে[১৬৮]
অথিত[১৬৯] হইল মঘুয়া গিয়া তার পুরে॥৩০
ছলেতে মিতালি পাতি রজনী গোঙায়।
বাণিজ্যি ব্যাপারের কথা বন্ধুরে শুনায়॥৩২
আরঙ্গের দেশ আছে উত্তর পাটনে।
বাণিজ্যি-কারণে বন্ধু যাই সেইখানে॥৩৪

কিবা সে দেশের রীতি শুন দিয়া মন।
আমনে[১৭০] বদল করে সোণা মণে মণ॥৩৬
শুক্‌ন্যা মাছ কিন্যা লয় সোণার ঘটি দিয়া।
জাম্বুরা[১৭১] বদল করে হীরামণি দিয়া॥৩৮
পান সুপারী তারা না দেখে নয়নে।
ঝিনাইর মুক্তা[১৭২] দিয়া তবে পাইলে তাহা কিনে॥৪০
কলা নারিকেল আদি মিষ্ট দ্রব্য যত।
সোণার পাতে কিন্যা লয় মনে ধরে যত॥৪২

এই সব শুনিয়া তবে সাধু ডিঙ্গাধর।
বাণিজ্য করিতে যায় উত্তর নগর॥৪৪
সাজুতী কন্যার কাছে লইয়া বিদায়।
ছয় মাসের পথ সাধু ছয় দিনে যায়॥৪৬
নগর নাগরিয়া যত বড় বড় দেশ।
কত যে ছাড়াইয়া চলে কহিতে বিশেষ॥৪৮
সাম[১৭৩] গুঞ্জরিয়া যায়[১৭৪] রবি পাটে বসে[১৭৫]
উইড়াছে[১৭৬] ডিঙ্গার পাল লীলুয়ারী[১৭৭] বাতাসে॥৫০
মনে বিষ[১৭৮] মঘুয়া কয় মাঝিমাল্লাগণে।
আইজ রাইতের লাগ্যা ডিঙ্গা বান্ধ এই খানে॥৫২

খেলায় খেলুনী[১৭৯] পাশা রাত্রি নিশি পাইয়া।
মঘুয়ার নায়ে ডিঙ্গাধর পড়ে ঘুমাইয়া॥৫৪
তবে ত দুষ্‌মণ মঘুয়া কোন কাম করে।
কাটিয়া ডিঙ্গার কাছি ভাসায় সায়রে[১৮০]৫৬
সাধু লইয়া মঘুয়ার ডিঙ্গা সুতে ভাইস্যা যায়।
ডিঙ্গাধরের মাঝিমাল্লা সুখে নিদ্রা যায়॥৫৮
ঠার[১৮১] পাইয়া মঘুয়ার যত মাঝিমাল্লাগণ।
উজান সুতে[১৮২] উড়ায় পাল পৃষ্ঠেতে পবন॥৬০

* * * * *

একেলা আছয়ে ঘরে সাজুতী সুন্দরী।
দুই চার দাসী তার আছে পাটুয়ারী[১৮৩]
বিয়ান বেলা[১৮৪] বুন্ধা[১৮৫] আইসা খবর জানায়।
সাধুত আইসাছে ঘাটে শব্দ শুনা যায়॥
এই কথা শুনিয়া তবে ডিঙ্গাধরের নারী।
কোমরে বান্ধিয়া পড়ে ময়ূর পাঙ্খা শাড়ী॥
হাতেত পরে তার বাজু করিয়া যতন।
চাম্পা ফুল দিয়া কন্যা বান্ধিল লুটন[১৮৬]
লুটনে তুলিয়া দিল সোণার ভমরা।
কপালে কাটিয়া দিল সুবর্ণের তারা॥১০
নাকেতে বেশর দিল কাণে ঝুম্‌কা ফুল।
কপালে সিন্দুর দিল পক্ষী সমতুল॥১২
পায়ে দিল গোল খারু পঞ্চম গুঞ্জরী।
এই মতে সাজন করে ডিঙ্গাধরের নারী॥১৪

ডালা সাজাইল কন্যা ধান দূর্ব্বা দিয়া।
বনদুর্গার আগ লইল আইঞ্চল[১৮৭] বান্ধিয়া॥১৬
ছয়মাস পরে সাধু ফিরে আইল দেশে।
ডিঙ্গা আর্গিবারে কইন্যা চলিল বিশেষে॥১৮
আপন ঘাটের ডিঙ্গা দেইখ্যা খুসী হইল।
ডিঙ্গা আনিবারে কন্যা ত্বরিতে চলিল॥২০
অর্গিয়া পুছিয়া[১৮৮] ডিঙ্গা তুইল্যা লইব ধন। ২১
হাটু জলে লাইম্যা[১৮৯] কন্যা কোন কাম করিল।
ঘলইয়ে[১৯০] সিন্দুর ফোটা ধান্য দুর্ব্বা দিল॥২৪
স্বামী ত ফিরিয়া আইছে বহু দিন পরে।
ভরা বুক হাসি খুসী মুখে নাহি ধরে॥২৬
তবেত দুষমণ মঘুয়া কোন কাম করে।
চিলা[১৯১] যেমত থাপা দিয়া কাটুনীর[১৯২] মাছ ধরে॥২৮
হাতেতে ধরিয়া তুলে ডিঙ্গার উপরে।
ইঙ্গিত পাইয়া মাল্লা ডিঙ্গা দিল ছেড়ে॥৩০
একেত ভাটিয়াল পানি জোরে বয় হাওয়া।
পালেতে বান্ধিল বাতাস[১৯৩] আশমানে ডাকে দেওয়া॥৩২

দেখ দেখ না দেখ দেখ চলিল ভাসিয়া।
পারে থাইক্যা পারের লোক রহিল চাহিয়া॥৩৪
সাজুতী সুন্দরী কন্যা কান্দে থাপাইয়া[১৯৪] মাথা।
রাক্ষসে হরিল যেমন জঙ্গলার[১৯৫] সীতা॥৩৬


মইষাল বন্ধু

দ্বিতীয় পালা

মইষাল বন্ধু

দ্বিতীয় পালা

(১)

প্রাণ কান্দে মইষাল বন্ধুরে
বন্ধু আরে সুরমাই— সুরমাই নদী পারে
কোথায় থাক্যা বাজাও বাঁশী না দেখি তোমারে রে।
প্রাণ কান্দে মইষাল বন্ধুরে॥
কালাপাড় ধলাপাড়[১৯৬] মধ্যে গঙ্গার[১৯৭] রে পাণি।
কোথাও থাক্যা বাজাও বাঁশী না দেখি না শুনি॥
গাঙ্গের পারে হিজল গাছ কইয়া[১৯৮] বুঝাই তরে।
কোনজনে বাজাইল বাঁশী অইনা মধুর স্বরে॥
গাঙ্গের পারে ফুট্যা রইছে কেওয়া চাম্পার ফুল।
বাঁশীর সুরে হইরা নিল অবলার মানকুল॥১০
ভরা না কলসীর জল জমিনে ঢালিয়া
জলের ঘাটে যায় কন্যা কলসী লইয়া॥১২
ঘড়ুয়া কলসীর জল মৃত্তিকায় শোষে[১৯৯]
কইন্যার আক্ষির জলে বসুমাতা ভাসে॥১৪
পথ নাই রে দেখে কন্যা নয়নের জলে।
উইড়্যা কেন না আইসে ভ্রমর অইনা ফুটা[২০০] ফুলে॥১৬

(২)

সুতেতে ভাসায়ে কলসী শুনে বাঁশীর গান
বাঁশীর সুরে হইরা নিল অবলার প্রাণ॥
ঘাটেতে বসিয়া কইন্যা খোয়ায় পঞ্চ খোপ[২০১]
ভিজা বসন দিয়া কন্যার ফুট্যা[২০২] বাইর হয় রূপ॥
ঘাইষ্ট গিলা[২০৩] ঘসিয়া তুলে শাড়ীর আঞ্চলে।
পায়ের মেন্দি উঠ্যা গেল দুসুতিয়ার[২০৪] জলে॥
হাটু জলে নামিয়া কইন্যা হাটু মাঞ্জন[২০৫] করে।
কোমর জলে নামিয়া কন্যা কোমর মাঞ্জন করে
গলা জলে নামিয়া কন্যা চারিদিক্ সে চায়।
ঐ পারে মইযালের বাঁশী শব্দে শুনা যায়॥১০
লীলারি[২০৬] বয়ারে[২০৭] বাঁশী বাজে ঘন ঘন।
বাঁশীর সুরে হইরা নিল যৈবতীর[২০৮] মন॥১২
আগল পাগল কালা মেঘ বাতাসেতে উড়ে।
কোন গহনে বাজে বাঁশী অইনা মধুর সুরে॥১৪
নিতি নিতি জলের ঘাটে বাঁশীর গান সে শুনি।
বাঁশীর সুরে মন পাগলা হইলাম উন্মাদিনী॥১৬
কেওয়া ফুলের মধু খাইয়া উইড়া যায় ভ্রমরা।
কোন জনে বাজায় বাঁশী কইয়া যারে তরা[২০৯]১৮

কইয়া দেরে তরা মোরে দেরে দেখাইয়া।
অভাগী হারাইলাম আঁখি কান্দিয়া কান্দিয়া॥২০
আজি আদি কালি আসি ফিইরা ফিইরা যাই।
যে জনে বাজাইল বাঁশী তারে দেখ্‌তে নাইসে পাই॥২২
সাতার যদি জান্‌তাম আমি দেখিতাম বিচারি।
মনচোরা ভ্রমর বন্ধু আন্‌তাম তারে ধরি॥২৪
পচ্চিমের[২১০] কালা মেঘ পুবে উইড়া যায়।
ঘড়ুয়া পিতলের কলসী সুতেতে ভাসায়॥২৬
চমক ভাঙ্গিল কইন্যার নিশার স্বপন।
কে দিব আনিয়া কলসী নাহি এমন জন॥২৮
ঢেউয়ের তালে ভাইস্যা কলসী অনেক দূরে যায়।
সাতার নাই সে জানে কন্যা কি হবে উপায়॥৩০
কুক্ষণে আইলাম ঘাটে পড়িলাম বিপাকে।
কাকের কলসী ভাইস্যা মোর গেল নদীর পাকে॥৩২
বাপে মায়ে দিব গাল বড় হইল বেলা।
একত করেছি দোষ আইসাছি একেলা॥৩৪
আরত করেছি দোষ কলসী নিল সুতে।
কি লইয়া ফিরিব ঘরে খালি শুধা হাতে॥৩৬
আস্‌মানের দেবতা পবন উজান বহাও পানি।
ভাসান হইতে কলসী আইন্যা দেহ তুমি[২১১]৩৮
শুনরে দারুণ নদী বহিয়া উজানি।
ভাটি বইয়া যায় কলসী আইন্যা দেহ তুমি॥৪০

বাতাসে না শুনে কন্যালো আমার কথা ধর।
আমি আইন্যা দিবাম কলসী তুমি যাও ঘর॥৪২

বাড়িয়া দারুণ বেলা হইল দুই পর।[২১২]
হাতে বাঁশী মাথায় টুপ[২১৩] অচিনা নাগর॥৪৪
একেলা আছিলাম ঘরে হইলাম দুইজন।
জল ঘাটে কাল বিধাতা নির্ব্বন্ধের মিলন॥৪৬
লাজেতে হইল কন্যার রক্তজবা মুখ।
পরথম যৈবন কন্যার এই পরথম সুখ॥৪৮
ফুলের উপরে যেন ভমরার দংশন।
পরথম যৈবনে কন্যার পরথম মিলন॥৫০
আনিল ঘড়ুয়া কলসী তুলিয়া মইষালে।
ভরন্ত কলসী কন্যা লইল কাঁকালে[২১৪]৫২
কে তুমি সুন্দর কোমার[২১৫] না দেখি না চিনি।
বিপদ কালেতে মোর বাঁচাইলে পরাণী॥৫৪
তোমার হাসি তোমার বাঁশী তোমার বাঁশীর গান।
শুনিতে কাড়িয়া লয় নিলোভার[২১৬] প্রাণ॥৫৬
পরিচয় কথা কন্যালো তোমারে জানাই।
ঐ পারের মইষাল আমি মইষ রাখ্যা খাই॥৫৮
মেঘে ভিজি রৌদ্রে পুড়ি মইষের বাতানে।
আপনার দুঃখের গান গাই আপনার মনে॥৬০
আজি হইতে হিজল বনে থাকবাম আমি বইয়া[২১৭]
জলের ঘাটে আইস তুমি কলসী লইয়া॥৬২
এক পারে থাক্‌বাম আমি আর পারে তুমি।
কেবল দেখিয়া যাইবাম[২১৮] চক্ষেরি চাহনি॥৬৪
অষ্ট আঙ্গুল বাঁশের বাঁশী মধ্যে মধ্যে ছেদা।
আর দিন বাজিতে বাঁশী বলে রাধা রাধা॥৬৬

আইজের বাঁশীতে কেন বাজে নয়া গান।
আইজের বাঁশীতে কেন ধরে নয়া তান॥৬৮
আইজ কেন মইষাল তোমার হইল এমন।
আইজ কেন হাতের বাঁশী হইল দুষ্‌মণ॥৭০
নিতি নিতি বাজে বাঁশী এমন না হয়।
আইজ কেন বাঁশীর গানে পরাণ সংশয়॥৭২
ফুলটুঙ্গী ঘরে[২১৯] কন্যা সিঞ্চা[২২০] কাপড় ছাড়ে।
কেওয়া[২২১] বনে বাজে বাঁশী অইনা মধুর সুরে॥৭৪

এই বাঁশী সেই বাঁশী নয় বাজে নয়া তানে।
বিপথে মইষাল বুঝি মরিল বাথানে॥৭৬
মইষ রাখ মইষাল বন্ধুরে ক্ষীর নদীর পারে।
মজিল অবলার মন তোমার বাঁশীর সুরে॥৭৮
মেঘে কেন ভিজ রে বন্ধু রইদে কেন পুড়।
গাছের ডাল ভাঙ্গিয়া বন্ধু কেন না মাথায় ধর॥৮০
আমিরে অবুলা[২২২] নারী না সহে পরাণ।
শীতল অঞ্চল দিয়া মুইছা দিতামরে ঘাম॥৮২

এইমতে সুন্দর কন্যা করয়ে ক্রন্দন।
বাথানে মইযালের কথা শুন সভাজন॥৮৪

(৩)

আস্‌মানেতে ফুটে তারা ছিন্ন ভিন্ন দেখি।
মইষাল ভাবে এই মত কইন্যার দুইটি আখি॥
আস্‌মান জুইরা কালা মেঘ উইড়া উইড়া ধায়।
নীলাম্বরী পইর‍্যা কইন্যা জলের ঘাটে যায়
নদীত উঠে খইয়া ঢেউ[২২৩] লীলারি বাতাসে।
মইষাল শুইয়া ভাবে কইন্যার দীঘল লম্বা কেশে॥
জলের উপর পউদের[২২৪] ফুল চারিধারে পাতা।
মইষাল ভাবে কইন্যার মুখ পিউরী[২২৫] দিয়ে গাথা॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া মইষাল হইল পাগল।
কার মইষ কেবা রাখে ঘটিল জঞ্জাল॥১০

একদিনের কথা সবে শুন দিয়া মন।
বাথানের মইষে গিয়া খাইল বাঁকের[২২৬] ধান॥১২
বাহুন্যায়[২২৭] সংবাদ কয় জমিদারের আগে।
বাকের যত ধান খাইল বাথানের মইষে॥১৪
হাতে লাঠি পাইক প্যাদা চলিল ধাইয়া।
মইষালেরে আনে হাতে গলেতে বান্ধিয়া॥১৬
কাড়িয়া বাথানের মইষ দিয়া বেড়াবাড়ি।
অভাগ্যা মইষালেরে রাজা করল দেশান্তরী[২২৮]১৮
দারুণ্যা[২২৯] আষাইরা[২৩০] নদী পাগল হইয়া যায়।
নদীর পারেতে মইষাল কান্দিয়া বেড়ায়॥২০

নাই পিতা নাই মাতা নাই বন্ধু ভাই।
বনেলা[২৩১] পঙ্খীর মত কোন বা দেশে উইড়া যাই॥২২
বইয়া যাওরে ভাইটাল নদী শুন কই তোমারে।
ঘাটে লাগাল পাইলে কন্যা খবর কইও তারে॥২৪
খবর কইও আরে নদী পাইলে নদীর কুলে।
তোমার মইষাল ডুইব্যা মরছে অতাইল[২৩২] জলে॥২৬
উইড়া যাওরে কাল ভমরা কইও কন্যার ঠাই।
তোমার মইষাল বন্ধু প্রাণে বাঁইচা নাই॥২৮
উইড়া যাওরে বনের পঙ্খী বাঁশের আগা চাইয়া[২৩৩]
মরিছে তোমার মইষাল জলেতে ডুবিয়া॥৩০
উইড়া যাওরে চিল চিলুনী[২৩৪] বইসা গাওরে কাগা[২৩৫]
কইওরে মইষাল মরছে মনে পাইয়া দাগা॥৩২

ঝাপ দিয়া পড়ে মইষাল নদীর কালা জলে।
অঙ্গের বসনখানি বাইন্ধা লইল গলে॥৩৪
ঢেউয়ে বাড়ী খাইয়া মইষাল উভে[২৩৬] হয় তল।
এইখানে দইরার মধ্যে সাত চইর[২৩৭] জল॥৩৬

দৈবের নির্বন্ধ কথা শুন মন দিয়া।
পুবাল্যা[২৩৮] ব্যাপারী[২৩৯] যায় সাত ডিঙ্গা বাইয়া॥৩৮
এক ডিঙ্গায় ধান চাউল আর ডিঙ্গায় দর[২৪০]
মরিচ লবণ আদা লইয়াছে বিস্তর॥৪০

বাইশ দারে[২৪১] বাইয়া যায় সুরমাই নদী দিয়া।
আধা মরা মইষালেরে লইল তুলিয়া॥৪২
পুবাল্যা ব্যাপারীর বাড়ী থাকিয়া মইশালে।
বাণিজ্য ব্যাপারী শিখে যইবনের[২৪২] কালে॥৪৪
বেপারী রাখিল তার নাম ডিঙ্গাধর।
বাণিজ্য করিতে পাঠায় গাঢ়র পাহাড়[২৪৩]৪৬
তথা হইতে ফিরে মইষাল পন্থে পাইল ঝড়ে।
বাঁশ না কাটিয়া মইযাল বানাইল বাঁশী॥৪৮

(8)

* * * *

এথাতে কইন্যার কথা শুন সর্ব্বজন।
পিরীতের লাগিয়া কন্য্যার ঘটল বিড়ম্বন॥
শুকাইয়া হইয়াছে কন্যা কাষ্ঠের পরমাণ।
রুক্ষ শুষ্ক হইছে কেশ শনের সমান॥
অঙ্গেতে না ধরে কইন্যার অঙ্গের বসন।
সেই হইতে ছাইড়াচে কইন্যা খাওন পিন্দন[২৪৪]
মায়ে বুঝায় বাপে বুঝায় বুঝায় সর্ব্বজনে।
বনে কান্দে পশু পঙ্খী কন্যার কান্দনে॥

আমিত অবুলা নারীরে বন্ধু হইলাম অন্তরপুরা[২৪৫]
কূল ভাঙ্গিলে নদীর জল মধ্যে পড়ে চড়া[২৪৬]১০
রে বন্ধু মধ্যে পড়ে চড়া॥

বইস্যা কান্দে ফুলের ভ্রমর উইড়া কান্দে কাগা।
শিশুকালে করলাম পিরীত যৌবনকালে দাগা॥১২
রে বন্ধু যৌবন কালে দাগা॥
সুজন চিন্যা পিরীত করা বড় বিষম লেঠা।
ভাল ফুল তুলিতে গেলে অঙ্গে লাগে কাঁটা॥১৪
রে বন্ধু অঙ্গে লাগে কাঁটা॥
লাজ বাসি মনের কথা কইতে নাই সে পারি।
বুকেতে লাইগাছে বন্ধু দেখাই কারে চিরি॥১৬
রে বন্ধু দেখাই কারে চিরি॥
কইতে নারি মনের কথা মাও বাপের কাছে।
লীলারী বাতাসে আমার অন্তর পুইরা গেছে॥১৮
রে বন্ধু অন্তর পুইরা গেছে॥
নদীর ঘাটে দেখা শুনা কাঙ্খেতে কলসী।
ঐছন[২৪৭] করিয়া গেছে তোমার মোহন বাঁশী॥২০
রে বন্ধু তোমার মোহন বাঁশী॥
ঘরের বাহির হইতে নারি কুলের মানের ভয়।
পিঞ্জরা ছাড়িয়া মন বাতাসে উড়য়॥২২
রে বন্ধু বাতাসে উড়য়॥
কত কইরা বুঝাই পাখী নাই সে মানে মানা।
ভরা কলসী হইলরে বন্ধু দিনের দিনে উণা[২৪৮]২৪
রে বন্ধু দিনে দিনে উণা॥
পশুপক্ষী নাই সে জানে না জানে পবন।
দারুণ মনের দুষ্কু জানে কেবল মন॥২৬
রে বন্ধু জানে কেবল মন॥

পক্ষী যদি হইতাম রে বন্ধু যাইতাম উড়িয়া।
দেখিতাম তোমার মুখ ডালেতে বসিয়া॥২৮
রে বন্ধু ডালেতে বসিয়া॥
তুমি যথা থাক্‌তে বন্ধু আমি থাক্‌তাম তথা।
দারুণ রৌদেতে বন্ধু শিরে ধরতাম পাতা॥৩০
রে বন্ধু শিরে ধরতাম পাতা॥
আর কয়দিন থাক্‌বা রে বন্ধু মনেরে ভারাইয়া।
বাপে মায় যুক্তি করে মোরে দিব বিয়া॥৩২
যে বন্ধু মোরে দিব বিয়া॥
বাপে মায়ে না জানেরে বন্ধু মনে যত বলে[২৪৯]
মন যদি পাগল হয় কি করিব কুলে॥৩৪
রে বন্ধু কি করিব কুলে॥
একত শীতল জলের হাওয়া আরত শীতল জানি।
তা হ’তে অধিক শীতল ডাবের মধ্যের পানি॥৩৬
রে বন্ধু ডাবের মধ্যের পানি॥
তা হ’তে অধিক শীতল যৌবনে পীরিতি।
তা হ’তে অধিক শীতল মনোবাঞ্ছার পতি[২৫০]৩৮
রে বন্ধু মনোবাঞ্ছার পতি॥
গাঙ্গে উঠে খইয়া ঢেউ আস্‌মানেতে নীলা।
তার মধ্যে ফুটে ফুল কালার মধ্যে ধলা[২৫১]৪০
কার বা গলার মালারে বন্ধু কার বা মুখের হাসি।
ফুটে রইছে কনক চাম্পা রে বন্ধু না ঝরা না বাসি॥৪২

সেই ফুল তুলিতে গিয়া ঝরে দুই নয়ন।
শুইলে স্বপন দেখি তোমার মতন[২৫২]৪৪
রে বন্ধু তোমার মতন॥

(৫)

এই মতে সুন্দর কন্যা করয়ে কান্দন।
চাটিগাইয়া মঘুয়ার কথা শুন দিয়া মন॥
ষোল দাঁড়ে বাইয়া তবে মঘুয়া যায় দেশে।
ষোল না দাঁড়ের পান্‌সী ঢেউয়ের উপর ভাসে॥
ভাটী বাঁকে থাকি মঘুয়া শুনে বাঁশীর গান।
কার বাঁশীতে ভাটিয়াল নদী বহিল উজান॥
দুইয়ে জনে দেখাদেখি নদীর উপরে।
দুই জনে হইল সুখী দেখিয়া দুয়েরে॥
আরে বন্ধু চল আমার ঘরে॥
চাটীগাও আমার ঘর চল যাই তথি।
বচ্ছরেক সেইখানে করিও বসতি॥১১
বাইরিবাম্[২৫৩] দুইজন বাণিজ্য কারণে।
এক বচ্ছর থাইক্য তুমি আমার ভবনে॥১৩
গাছের ডালে কোকিল ডাকে রজনী পোষায়।
মেজেতে শুইয়া কন্যা করে হায় হায়॥১৫
আইজ কেন কোকিলা তোমার নাহি ফুটে গান।
আইজ কেন চন্দমা শূন্য তুমিরে আস্‌মান্॥১৭
বহুদিন হইতে বন্ধু হইল দেশান্তরী।
ফুটিয়া বনের ফুল পইরা গেল ঝরি॥১৯
আমি রে অবলা বন্ধু ঠেক্যাছি বিষম দায়।
বাসি ফুলের মধু যেমন অন্তরে শুকায়॥২১

রাত্রনিশাকালে কইন্যা চমকিয়া উঠিল।
বহুদিন পরে বন্ধু বাঁশী বাজাইল॥২৩
বাপেরে না কয় কন্যা মায়েরে না কয়।
অন্তরে না হইল কন্যার কুল মানের ভয়॥২৫
বাপ মায়ের কান্দন কাটি রাত্র পোষাইয়া।
পাড়াপড়সী দিব গালি কুলটা বলিয়া॥২৭
এর[২৫৪] না ভাবিল কন্যা তের[২৫৫] না ভাবিল।
বাঁশীর রব শুনি কন্যা ঘাটে মেলা দিল[২৫৬]২৯
মেঘেতে ঢাকিল চান্নি কালি আঞ্জি[২৫৭] রাতি।
নদীর ঘাটে যায় কন্যা মজিয়া পিরীতি॥৩১
বাপে মায় কান্দিব যে রাত্রি পোষাইয়া।
পাড়ার লোকে গালি দিব কুলটা বলিয়া॥৩৩
এর না ভাবিল কন্যা তের না ভাবিল।
মইষালের সঙ্গে কন্যা দেশান্তরী হইল॥৩৫
ঘুমত[২৫৮] উঠিয়া মায় জুড়িব যে কান্দন।
খাঁচার পোষণ্যা[২৫৯] পাখী কাটিল বান্ধন॥৩৭
ঘুমত উঠিয়া বাপে জুড়িব কান্দন।
এই কথা ভাবিতে কন্যার ঝরিল নয়ন॥৩৯
পাড়া পরশী গালি দিব কুলটা বলিয়া।
কেমনে সহিব মায় সেই মুখ চাইয়া॥৪১
ষোল দাঁড়ের পাগল পান্‌সী পক্ষী উড়া দিল।
কত দিনে মঘুয়ার দেশে উপনীত হইল॥৪৩
এক বচ্ছর যায় কন্যার না পায় লাগল।
দেখিয়া কন্যার রূপ মঘুয়া পাগল॥৪৫

বাটি গুটি[২৬০] সুন্দর কন্যা চিরল[২৬১] মাথার কেশ।
মথুয়া পাগল হইল দেখ্যা সেই বেশ॥৪৭

* * * *

(৬)

আরে বন্ধু শুন কথা রইয়া।
আর কত দিন থাকবাম্ বল গিরেতে[২৬২] বসিয়া॥১২০
কাঠুয়া[২৬৩] কামাইয়া[২৬৪] পান্‌সী ভাসাইয়াছে জলে।
বাণিজ্য কারণে যাইবাম্ উত্তর ময়ালে[২৬৫]
সেই দেশের কথা তোমার জানা নাহি আছে।
কিঞ্চিৎ কহিবাম আমি বন্ধু তোমার কাছে॥
পুরুষ বসিয়া থাকে মাইয়ালে[২৬৬] কামায়[২৬৭]
হাট বাজার যত নারী-লোকের দায়[২৬৮]
দরিয়ার পানিতে যত আছে হীরা মণি।
জালেতে ঠেকাইয়া রাখে না বাছি না গুণি[২৬৯]১০
আমনে বদল করে সোণা মনে মন[২৭০]
শুড়ি[২৭১]মাছ বদলে দেয় কাঠা মাপ্যা ধন॥১২
কাটুয়া[২৭২] কাছিম পাইলে তারা অতিশয় সুখী।
আর যদি পায় মেষ ছাগল খাসী॥১৪

সোণা রূপা মাপ্যা দেয় লেখা জোখা নাই।
বাণিজ্য কারণ বন্ধু লও তথি যাই॥১৬
বাপেত কামাইয়া আন্‌লে নাতিএ বইসা খায়।[২৭৩]
এক পুরুষে কামাইয়া আন্‌লে তিন পুরুষ যায়॥১৮
বন্ধুরে লাগাইয়ো ঠাস্‌কি[২৭৪] মঘুয়া কোন কাম করিল।
ঘরে আছিল বইন্‌ মইনা তার কাছে গেল॥২০

শুন শুন বইন মইনা কইয়া বুঝাই তরে।
বাণিজ্যেতে যাইবাম আমি উত্তর ময়ালে॥২২
চন্দ্রমুখী ঘরে কন্যা তাহারে দেখিও।
শাড়ীর আইঞ্চলে তারে ঢাকিয়া রাখিও॥২৪
চন্দ্রসূর্য্যে নাহি দেখা না দেখে দুষ্‌মণে।
এমনি ঘরে ছাপাইয়া[২৭৫] তারে রাখ্‌বা রাত্রদিনে॥২৬
দেশেতে ফিরিব আমি ছয় মাস পরে।
দেশে আইস্যা বিয়া তরে[২৭৬] দিবাম্ ভালা বরে॥২৮
সোণায় গড়াইয়া দিবাম্ গলার হাছুলি[২৭৭]
উত্তম দেখিয়া শাড়ী দিবাম গঙ্গাজলি[২৭৮]৩০
নাকের নথ দিবাম তরে পায়ের গোল খারুয়া[২৭৯]
হাতেতে দিবাম তরে সোণার বাজুয়া॥৩২
এতেক দেখাইয়া লোভ মঘুয়া কোন কাম করিল।
বন্ধুরে লইয়া পান্‌সী জলে ভাসাইল॥৩৪
ষোল দাঁড়ে মঘুয়ার পান্‌সি বায় বাইছাগণে[২৮০]
তের দাঁড়ে মইষালের পান্‌সি চলে পাছ বাড়ানে[২৮১]৩৬

উত্তর ময়ালে আছে কোকি গারর[২৮২] দেশ।
মানুষ ধরিয়া খায় রাক্ষসের বেশ॥৩৮
সে দেশে যে জন যায় না আসে ফিরিয়া।
বন্ধুরে পাঠাইব মঘুয়া ছলনা করিয়া॥৪০

তের বাঁক পানি বহিয়া পাইড়াতে[২৮৩] পড়ে।
দুই নাল[২৮৪] দুই দিকে উজান পানি ধরে॥৪২
এক নালে কালা পানি ঢেউয়ে খরশাণ।
এই নালে যাও বন্ধু ধরিয়া উজান॥৪৪
এই নালে গিয়া পাইবা কামুনীর দেশ।
ধনরত্নের সীমা নাই নাই আদি শেষ॥৪৬
এই নালে আমি যাইবাম ভারুই ময়ালে।
ছয় মাসের আড়ি[২৮৫] রইল আসিবার কালে॥৪৮
আগে যদি আইও তুমি কইয়া দেই তোমারে।
নালার মুখে বাইন্ধ পান্‌সী বার চাইও মোরে[২৮৬]৫০
আগে যদি আমি আই পাইবা এই খানে।
মিলিয়া মিশিয়া দেশেতে যাইবাম দুইজনে॥৫২
দুইজনে দুই নালা ধরিয়া চলিল।
এতেক দুর্গতি দেখ দৈবে ঘটাইল৫৪

শিবের জটা পিঙ্গল মেঘ আস্‌মানেতে খেলে।
কুন্দিয়া[২৮৭] তোফান আসে দরিয়ার জলে॥৫৬
পাড় পর্ব্ব‌ত ভাইঙ্গা ঢেউ ফলকিয়া[২৮৮] উঠিল।
কে জানে দুষ্‌মণ মঘুয়া কইবা ভাষ্যা গেল॥৫৮

তের দাড়ীএ ডাক দিয়া কইল মইষালেরে।
উজান ধরিতে দায়[২৮৯] চল যাই ঘরে॥৬০
কাঁড়াল[২৯০] ভাঙ্গিয়া যায় পালের ছিড়ে দড়ি।
সামাইল্যা রাখ্‌তে নাও[২৯১] আর নাহি পারি॥৬২
তের বাইছার ডাক মান্যা[২৯২] মইষাল কোন কাম করিল।
ছাড়িয়া বাণিজ্যের আশা দেশেতে চলিল॥৬৪
উজাইতে ছয় মাস লাগে ভাটি যায় তের দিনে।
মঘুয়ার বাড়ীতে যায় কন্যার কারণে॥৬৬
তুফানে পড়িয়া মঘুয়ার নাও হইছে তল।
দেশেতে রটিয়াছে কথা শুনে সর্ব্বজন॥৬৮
এক বচ্ছর দুই বচ্ছর তিন বচ্ছর যায়।
মঘুয়ার লাগিয়া মইষাল পন্থ পানে চায়[২৯৩]৭০
বাঁচিয়া থাকিলে মঘুয়া আসিত ফিরিয়া।
সাত পাঁচ ভাইব্যা মইষাল মইনারে করে বিয়া॥৭২

(৭)

চাটীগাইয়া কাঙ্গু রাজা শুন দিয়া মন।
বড়ই অধর্ম্মী রাজা রাজ্যের দুষ্‌মণ॥
সাতশত সুন্দর নারী আছে তার ঘরে।
সুন্দর পাইলে রাজা আরও বিয়া করে॥

* * * * *

আরে ভালা তিন বচ্ছর গত হইল চাইর বচ্ছর যায়।
চাইর বচ্ছর গত হইল পাঁচ বচ্ছর যায়॥

শুক্‌না কাষ্ঠের লাক্‌ড়ী[২৯৪] মুখে পাক্‌না[২৯৫] দাড়ী।
ছয় বছর পরে মঘুয়া আইল নিজ বাড়ী॥
এতেক অবস্থা দেখ্যা মঘুয়া রাগে জ্বলে।
ঘিরতের ছিটা পড়্‌ল যেমন জ্বলন্ত অনলে॥১০
পাড়া পড়শীগণে মঘুয়া ডাকিয়া আনিল।
পাড়া পড়শী জানে মঘুয়া জলে ডুব্যা মইল॥১২
কাচা চুল পাক্যা গেছে কেউ আয়[২৯৬] দেখিতে।
ভূত বলিয়া কেউ চায় খেদাইতে॥১৪
কেউ বলে রাখ রাখ কেউ বলে ধর।
সময় পাইয়া কেউ মারে চর চাপড়॥১৬
নাকাল[২৯৭] হইয়া যায় মঘুয়া কাঙ্গু রাজার কাছে।
তোমার কাছে আমার এক নিবেদন আছে॥১৮
শুন শুন রাজা আরে শুন দিয়া মন।
আগেত হইয়া বন্ধু পরেত দুষ্‌মণ॥২০
ঘর বাড়ী থইয়া[২৯৮] যাই বাণিজ্য কারণে।
বিয়া কইরা ঘরের নারী লইয়াছে দুষ্‌মণে॥২২
মইনা বইনেরে আমার করিয়াছে বিয়া।
ঘরগিরস্থি করে দুষ্‌মণ দুই নারী লইয়া॥২৪
আমার বাড়ী হইতে দুষ্‌মণ আমায় দিল খেদাড়িয়া।
আইলাম তোমার কাছে বিচারের লাগিয়া॥২৬

কাঙ্গুরাজার বিচার কথা শুন দিয়া মন।
না জানি সুন্দর নারী দেখিতে কেমন॥

আরদালী পেদালী[২৯৯] দুই ত্বরিত পাঠাইয়া।
মইনা সহিতে আনে কন্যারে ধরিয়া॥৩০
শূলের হুকুম হইল মইষালের উপরে।
এমন কালে সাজুতী কন্যা কোন কাম করে॥৩২

* * * * *

* * * * *

ভাই হইয়া দুষ্‌মণ হইল.........
মইনার কান্দনে কাদে বনের পশুপক্ষী॥


  1. খুড়াসান=খরশাণ, খরতর, বেগবান্।
  2. যার জলে····ধান=যাহার জল আশ্বিন মাসে নদীর বাঁকের ধান্য গ্রাস করিয়াছে।
  3. গিরস্থ=গৃহস্থ।
  4. সুবিস্তারে=বিস্তৃতভাবে, বিশদভাবে।
  5. আড়া=জমির পরিমাপ বাচক শব্দ।
  6. পূর্ণিমাসির চান্=পৌর্ণমাসীর চন্দ্র।
  7. ‘ডিঙ্গাধর’ নামটি লক্ষ্য করিবার বিষয়। ইহা গীত রচনার সমসাময়িক যুগের পূর্ব্ববঙ্গবাসীদিগের বাণিজ্যপ্রীতি ও নৌচালন দক্ষতার পরিচায়ক।
  8. ‘না’ শব্দটি এরূপ স্থলে নিষেধার্থক নহে—কথার মাত্রা, অথবা জোর দিবার
    জন্য ব্যবহৃত হয়।
  9. তিন খণ্ড=বাড়ীর তিনটি বিভাগ, মহাল।
  10. বাতানে=যেখানে গোমহিষাদি পালন করা হয়। বাতান গৃহসংলগ্ন গোশালা নহে, গোচারণের প্রান্তরমধ্যস্থ গোশালা।
  11. পালে=গরুর দলে।
  12. আইশনা=আশ্বিন মাসের।
  13. আসান=সান্ত্বনা।
  14. বাইব=কর্ষণ করিবে।
  15. দূরপথে-যাইতে হইলে পূর্ব্বে লোকে কাপড়ের খুঁটে বা আঁচলে চিড়া বান্ধিয়া লইয়া যাইত। চিড়াই বিদেশ যাত্রার সহচর বা পথের সম্বল ছিল।
  16. অনাটন=অনটন।
  17. আগুণ=আগণ, অগ্রহায়ণ।
  18. লক্ষ্মীপূজা=অগ্রহায়ণ মাসে ‘কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা’ নহে; বোধ হয় নবান্নকে বুঝাইতেছে।
  19. নয়া=নূতন।
  20. কিরপা=কৃপা।
  21. কইরা লেখা পড়া=দলিল প্রস্তুত করিয়া।
  22. গোয়ারা=প্রফুল্ল।
  23. বুইন=বপন (ধান ‘বুনা’ অর্থাৎ বীজধান্য বপন করা, ‘রোয়া’ বা রোপণ হইতে পৃথক)।
  24. হয়রাণে=ঘোর বিপদে।
  25. গেরামে=গ্রামে।
  26. বন্ধ=বন্ধু।
  27. করজ=কর্জ্জ।
  28. পরমাণ=প্রমাণ।
  29. সূজন=পরিশোধ।
  30. অপরিশোধিত ঋণের পাপ জন্মজন্মান্তরেও অধমর্ণের পশ্চাদ্ধাবন করে, এই বিশ্বাস নানা কুসংস্কার সত্বেও আমাদের জন-সাধারণের নৈতিক দায়িত্ব ও সাধুতার পরিচায়ক।
  31. জ্বর..বাড়ে=ডিঙ্গাধরের জ্বর, মস্তক বেদনা বা অন্য কোন রোগ পীড়া নাই, তথাপি দুশ্চিন্তারূপ রোগ ক্রমশঃ বাড়িতেছে।
  32. বলা=বোল্‌তা।
  33. ফানা=পাগল।
  34. ছানি পালা=ছাউনি ও খুটি।
  35. পিতৃকাম=পিতৃশ্রাদ্ধ।
  36. ছান=স্নান।
  37. ছিচরণে=শ্রীচরণে।
  38. চেংড়া····কাম=আমার একটি অল্পবয়স্ক চাকরের প্রয়োজন আছে
  39. ফালি=মুক্তি।
  40. থইয়া=থুইয়া, রাখিয়া।
  41. যুবাবতী=যুবতী। কবিকঙ্কণ “যুবতী যৌবনবতী ত্যজিলাম রোষে।
  42. পশরা=আলো।
  43. দইরা=দরিয়া, নদী।
  44. বাখানি=ব্যাখ্যা করি, প্রশংসা করি।
  45. বাটীখুটি=একটু খর্ব্ব ছন্দের।
  46. পুণ্ণুমাসী=পৌর্ণমাসী
  47. দিত=দিতে, দেওয়ার জন্য।
  48. কাকেতে=কক্ষে।
  49. আগল পাগল=এলোমেলো, ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত।
  50. হানা=আঘাত।
  51. নদীর জলে......হানা=উন্মত্ততরঙ্গ আসিয়া তীরভূমিতে প্রতিহত হইতেছে।
  52. পন্থে=পথে।
  53. আনাগুনা=যাতায়াত
  54. মাঞ্ছন=মাজন, মার্জ্জন।
  55. ঘরুয়া=ঘড়া।
  56. সুতে=স্রোতে।
  57. দরদী=সহানুভূতিসম্পন্ন।
  58. সাঁতুর=সাতার।
  59. ছানের=স্নানের।
  60. বাথান বাড়ী=গোচারণের প্রান্তর সংলগ্ন গোশালা।
  61. পরথম=প্রথম।
  62. কাঁকাল=কক্ষ।
  63. দোষমণ=দুষ্‌মণ, শত্রু।
  64. তেমল্লায়=তিন মহলায়, ত্রিতলগৃহে।
  65. সিঞ্চা=ভিজা।
  66. বিনাথ=অনাথ। সুর এত করুণ যেন মনে হয় হতভাগ্য মহিষালের আজ প্রাণ যাইতে চলিয়াছে।
  67. অবুলা=অবলা।
  68. রইদে=রৌদ্রে।
  69. পউদের পাতা=পদ্মপত্র।
  70. অন্তর পুড়া=দগ্ধ হৃদয়।
  71. কুল ভাঙ্গিলে·····চড়া=নদীর কূল ভাঙ্গিয়া সেই মাটি নদীর মধ্যে যেমন চড়া হইয়া উঠে; অর্থাৎ কূলের সঙ্গে সম্পর্কহীন, অথচ নদীর মধ্যেও খাপছাড়া, কোন দিকেই আপন বলিবার নাই।
  72. লীলারী=ক্রীড়াশীল, লীলাময়।
  73. কঙ্খেতে=কক্ষে।
  74. ঊণা= ন্যুন হওয়া, জল ক্রমে ক্রমে কমিয়া যায়; যৌবন ধীরে ধীরে চলিয়া যায়।
  75. পঙ্‌খী=পক্ষী।
  76. পওন=পবন।
  77. দুষ্কু=দুঃখ।
  78. ভাঁড়াইয়া=ভাণ্ডাইয়া, প্রতারণা করিয়া, গোপন করিয়া।
  79. দিত=দিবে
  80. একত=একেত।
  81. যৈবনে=যৌবনে।
  82. মনোবাঞ্ছার পতি=নিজ মনোনয়নের স্বামী।
  83. খৈয়া ঢেউ=খৈএর মত শুভ্র জলবিন্দু উৎক্ষিপ্ত করে যে ঢেউ।
  84. আকাশের মেঘ দেখিয়া কন্যার নীলাম্বরী শাড়ীর কথা মনে পড়ে।
  85. পিউরী=পদ্মের পাঁপড়ি।
  86. ধুপুরিয়া=চৌকিদার, যে দুপুর বেলা পাহারা দেয়।
  87. আউলাইয়া=আলুলায়িত করিয়া, এলাইয়া।
  88. দেউড়ী ঘর=দ্বাররক্ষীদের ঘর।
  89. কুচ্ছামারা=মালকোচা আঁটা।
  90. দুহাই=দোহাই।
  91. গুণাগারি=ক্ষতিপূরণ।
  92. শুইতে না শুইয়ে=শয়ন করিতে গিয়াও শয়ন করিতে পারে না।
  93. তোষের=তুষের।
  94. আষাঢ়িয়া মণ্ডল নাম জনৈক মহাজন বিড়ালটিকে বান্ধিয়া ভাত খাইতে বসে, পাছে বিড়াল দুই একটা ভাত বা মাছের কাঁটা খাইয়া ফেলে।
  95. মাউগের=স্ত্রীর।
  96. ভাই তাহার কার্পণ্যে ক্রোধান্বিত হইয়া তাহার গালে চড়চাপড় মারে।
  97. পুত্ত্র তাহাকে লাউড়ের পাগল বলিয়া গালি দেয়। “লাউড়ের” শব্দটি একান্তই স্থানীয়। ইহার অর্থ “বাউল” বা “ক্ষেপা” হইতে পারে।
  98. বইয়া=বসিয়া।
  99. ট্যাকার কুমইর=টাকার কুমীর, অর্থাৎ বিপুল ধনশালী।
  100. করজ=কর্জ্জ
  101. টঙ্কার=টাকার, তঙ্কার।
  102. ঠাহরি=ঠাহর করিয়া অর্থাৎ খুব ভালরূপে পর্যবেক্ষণ করিয়া।
  103. সুন্ধ্যা—সন্ধ্যা।
  104. পাতার......গুয়ায়=তৈল খরচের ভয়ে বৃক্ষপত্র দিয়া দীপ জ্বালাইয়া আলোর কাজ চালায়। গুয়ায়=যাপন করে।
  105. ইমান=ধর্ম্ম।
  106. সাবুদ=সাক্ষী।
  107. কিরপা=কৃপা।
  108. দারুণ্যা=দারুণ।
  109. সাতুরিয়া=সাঁতারিয়া।
  110. ডেরুয়া=ডাঙ্গর অর্থাৎ প্রচাণ্ড
  111. চইর=একরূপ মাপ।
  112. সরু=সরিষা।
  113. গুরু=গুড়।
  114. জিউ=জীবন।
  115. সুয়াশ=শ্বাস।
  116. পুবাল্যা=পূর্ব্বদেশবাসী।
  117. পরিসুস্থ=ভালরূপে সুস্থ।
  118. পূর্ব্বদেশীয় ব্যাপারী পিতৃস্থানীয় ও ডিঙ্গাধর পুত্ত্রস্থানীয় হইল।
  119. উত্তর‍্যা=উত্তর দিকের (উত্তর দিকের ঠাণ্ডা হাওয়া লাগিয়া)।
  120. বাইয়া=বাহিয়া।
  121. চৌখণ্ডী=চারটি মহাল।
  122. লড়ি=লাঠি।
  123. বাড়ী পড়ছে পরা=বাড়ীখানি পতিত অবস্থায় রহিয়াছে।
  124. কেউ চাল হইতে ছন্ নামাইয়া লইয়া যায়, কেউ বেড়া ভাঙ্গিয়া বাঁশ সংগ্রহ করে।
  125. জিগির=উচ্চৈঃস্বরে হাক্ ছাড়া।
  126. খাড়াইল=দাঁড়াইল।
  127. ফকির......ফকিরে=নিজে ফকির অর্থাৎ রিক্তহস্ত হইয়া ফকিরকে কি দিব?
  128. ফুরুঙ্গি=স্ফুলিঙ্গ।
  129. ছাইয়ে=ভস্মে।
  130. জিক্‌কাইর মার‍্যা=হঠাৎ ফাটিয়া যাইয়া আওয়াজ করিয়া উঠে।
  131. রসুয়া=বোধ হয় রসিক শব্দের অপভ্রংশ, বাক্‌পটু।
  132. ঘরুণীর=গৃহিণীর।
  133. ঘরবণ্ডি=ঘরবন্দী, গৃহহারা সীমাবদ্ধ বাড়ীখানি।
  134. ছেড়ারে=তাহার পুত্রকে।
  135. উরুম্বার=কোনা নিকৃষ্টবংশের।
  136. গুয়াইতে=যাপন করিতে।
  137. এটা ঘটকের উক্তি।
  138. হালে=আসলে।
  139. বান্ধ্যা=নূতন করিয়া বান্ধিয়া।
  140. লাগ্যা=জন্য।
  141. হারাদিশ=দিশেহারার মত।
  142. জুঠী=ঝুটি।
  143. আড়াঙ্গী=বাঁশ ও তালপাতা দিয়া প্রস্তুত ছত্রবিশেষ।
  144. দড়বড়ি=তাড়াতাড়ি।
  145. পরতিজ্ঞা=প্রতিজ্ঞা।
  146. খাটেতে বসিয়া আছে=অর্থাৎ প্রস্তুত হইয়া আছে।
  147. ফলা=পাঁচন বাড়ী।
  148. টুপ=টুপী।
  149. আড়বাশী=সাধারণতঃ বাঁশের তৈরী (আড়বাঁশী সঙ্কেত করিবার বাঁশী)।
  150. টান মাইল=বাজাইল।
  151. ঢুল=ঢোল।
  152. ডগর=বাদ্যযন্ত্র বিশেষ, দ্রগর।
  153. রইয়া=রহিয়া রহিয়া।
  154. চাড়ী গাইয়া=চট্টগ্রাম বাসী।
  155. বইডা=বৈঠা; বহিত্র শব্দের অপভ্রংশ।
  156. ঝুমুর=কলরব যুক্ত গীতবাদ্যের মত শব্দ।
  157. খিচুনী=প্রক্ষেপ।
  158. বুন্ধারে=বুন্ধা নামক ব্যক্তিকে অথবা বৃদ্ধকে।
  159. পুইছ=জিজ্ঞাসা।
  160. হাত বাঁক=এক হস্ত পরিমিত বাঁক বহিয়া গেলে।
  161. পাট=নদীর ঘাটে প্রস্তর নির্ম্মিত সোপান।
  162. খোয়ায়=খসায়।
  163. খুপ=খোঁপা।
  164. করয়ে মাঞ্জন=শরীর মার্জ্জনা করিতেছে।
  165. নাইয়া=নৌকাচালক।
  166. ঘড়ুয়া=ঘড়াকলসী, অথবা ঘরের কলসী (?)
  167. কাঙ্খে=কক্ষে।
  168. কামটঙ্গী=সাধারণতঃ পুকুরের মধ্যে বড়লোকেরা ঘর নির্ম্মাণ করিয়া গ্রীষ্মকালে তাহাতে বাস করিতেন। তাহার নাম কামটঙ্গী ঘর।
  169. অথিত=অতিথি
  170. আমনে—মণ=আমনধান পাইলে মণ-পরিমিত সোনা দিয়া তাহা ক্রয় করে।
  171. জাম্বুরা=বাতাপী লেবু।
  172. ঝিনাইর মুক্তা=ঝিনুকের মুক্তা।
  173. সাম=সন্ধ্যা।
  174. গুঞ্জরিয়া যায়=অতীত হয়।
  175. পাটে বসে=অস্ত যায়।
  176. উড়াইছে=উড়িতেছে।
  177. লীলুয়ারী=ক্রীড়াশীল।
  178. মনে বিষ=“মনে বিষ মুখে মধু জিজ্ঞাসে ফুল্লরা” কবিকঙ্কণ।
  179. খেলুনী=খেলিবার।
  180. সায়রে=সাগরে। এখানে নদীকেই বুঝাইতেছে)।
  181. ঠার=ইঙ্গিত।
  182. সুতে=স্রোতে।
  183. পাটুয়ারী=সঙ্গী।
  184. বিয়ান বেলা=প্রভাত সময়।
  185. বুন্ধা=ভৃত্যের নাম।
  186. লুটন লোটন=খোপা
  187. আগ=বনদুর্গার প্রসাদী ভোগের অগ্রভাগ। আইঞ্চল=অঞ্চলে।
  188. অর্গিয়া পুছিয়া=অর্ঘ্য দিয়া বরণ করিয়া।
  189. লাইম্যা=নামিয়া।
  190. ঘলইয়ে=ডিঙ্গার গলুইতে।
  191. চিলা=চিল পাখী।
  192. কাটুনী=যে মাছ কাটিতে বলিয়াছে।
  193. পালেতে প্রচুর বাতাস আবদ্ধ হইল।
  194. থাপাইয়া=থাপরাইয়া।
  195. জঙ্গলার=বনবিহারিনী।
  196. একদিকে পাড় উচু, সে দিক্‌টা ভাঙ্গে, তাহার রং কতকটা কালো অপর দিকটা বালুময়, সাদা।
  197. গঙ্গা বা গাঙ্গ সাধারণতঃ সমস্ত নদীকেই বুঝাইত।
  198. কইয়া=কহিয়া।
  199. শোষে=শোষণ করিয়া লয়।
  200. ফুটা=ফোটা, প্রস্ফুটিত।
  201. খোয়ায়...খোপ=পাঁচটি খোঁপা খসাইলেন।
  202. ফুট্যা=ফুটিয়া।
  203. ঘাইষ্ট গিলা=গিলা দিয়া অঙ্গ পরিষ্কার করা এবং তার পরে শাড়ীর অঞ্চল দিয়া মার্জ্জনা করা বঙ্গের পল্লীতে এখনও প্রচলিত আছে। ঘাইষ্টা শব্দের অর্থ গিঠে (অঞ্চলের) বাঁধা।
  204. দুসুতিয়া=নদীর নাম কি? দ্বিস্রোতা।
  205. মাঞ্জন=মার্জ্জন।
  206. লীলারি=ক্রীড়াশীল।
  207. বয়ারে=বায়ুতে।
  208. যৈবতীর=যুবতীর।
  209. কইয়া যারে তরা=তোমরা বলিয়া যাও। তরা=তোরা, তোমরা।
  210. পচ্চিম=পশ্চিম।
  211. ভাসান....তুমি=স্রোত উজানে বহিলে কলসীটি ভাসিয়া আসিয়া তীরে লাগিবে।
  212. দুইপর=দুই প্রহর।
  213. টুপ=টুপী।
  214. কাঁকালে=কক্ষে।
  215. কোমার=কুমার।
  216. নিলোভার=লোভহীন বা সরল প্রকৃতি ব্যক্তির।
  217. বইয়া=বসিয়া।
  218. যাইবাম=যাইব।
  219. ফুলটুঙ্গী ঘরে=পুকুরের জলের ভিতর হইতে উত্থিত গৃহ, বা পুষ্প কুঞ্জ। পূর্ব্বে ধনীদের গ্রীষ্মবাসের জন্য এইরূপ আরাম গৃহ নির্ম্মিত হইত। ‘টুঙ্গী’ শব্দ ‘তুঙ্গ’ শব্দের অপভ্রংশ; উচ্চ থাকার দরুণ এইরূপ নাম হইয়াছে।
  220. সিঞ্চা=ভিজা।
  221. কেওয়া=কেতকী।
  222. অবুলা=অবলা, অথবা যে কথা বলিতে পারে না, যথা—
    “বদন থাকিতে না পারি বলিতে, তেঁই সে অবোলা নাম।” চণ্ডীদাস।
  223. খইয়া=খইএর মত সাদা সাদা ফেণা নিক্ষেপ করিয়া সে সকলে ঢেউ উঠে।
  224. পউদ=পদ্ম।
  225. পিউরি=পাঁপড়ি।
  226. বাঁক=নদী যেখানে বাকিয়া গিয়াছে।
  227. বাহুন্যায়=সংবাদ বাহক।
  228. এইখানে দুইটি ছড়ার মধ্যে সামঞ্জস্য নাই।
  229. দারুণ্যা=দারুণ।
  230. আষাইরা=আষাঢ়িয়া, আষাঢ় মাসের।
  231. বনেলা=বন্য।
  232. অতাইল=অতল।
  233. বাঁশের আগা চাইয়া=বংশের অগ্র ভাগের দিকে অর্থাৎ খুব ঊর্দ্ধে লক্ষ্য করিয়া।
  234. চিলুনী=চিলের স্ত্রী।
  235. কাগা=কাক।
  236. উভে=সম্পূর্ণরূপে।
  237. চইর=জলের মাপ বিশেষ
  238. পুবাল্যা=পূর্ব্বদেশীয়।
  239. বেপারী =বাণিজ্য ব্যবসায়ী।
  240. দর=
  241. দারদাড়,=দণ্ড শব্দের অপভ্রংশ।
  242. যইবন=যৌবন।
  243. গাঢ়র পাহাড়=গারো পাহাড়।
  244. খাওন পিন্দন=খাওয়া পরা।
  245. অন্তরপুরা=দগ্ধহৃদয়।
  246. কূল····চড়া=কূল ভাঙ্গিয়া যে চড়া পড়ে, তাহা কূলের সঙ্গে সম্বন্ধ বিচ্যুত; অথচ উহা জলের সঙ্গেও এক হইতে পারে না; সুতরাং অতি নিঃসহায় অবস্থায় থাকে।
  247. ঐছন=ঐরূপ
  248. ভরাকলসী....উণা=পূর্ণ কলসীর জল দিন দিন কমিয়া যাইতেছে; অর্থাৎ যৌবন চলিয়া যাইতেছে।
  249. মন যত বলে=মন যত কথা বলে, আমার মনে যে সকল ভাব হয়।
  250. তা হ’তে·····পতি=সর্ব্বাপেক্ষা মিষ্ট হচ্ছে স্বীয় মনোনয়নের পতি।
  251. কালো আকাশের মধ্যে ধবল ফুলের ন্যায় সেই তরঙ্গ-ভঙ্গের বিন্দু বিন্দু জল। নানারূপ বেদনাজড়িত জীবনের মধ্যে তোমার স্মৃতিও সেইরূপ সুন্দর ও শুভ্র।
  252. তোমার মতন=তোমার ন্যায় একজনকে অর্থাৎ তোমাকে।
  253. বাইরিবাম=বাহিরে যাইব বিদেশে বাহির হইব।
  254. এর=ইহা।
  255. তের=তাহা। অর্থাৎ ইহা উহা সে কিছুই চিন্তা করিল না।
  256. মেলা দিল=যাত্রা করিল।
  257. কালি আঞ্জি=অঞ্জনবৎ কৃষ্ণবর্ণ।
  258. ঘুমত=ঘুম থেকে।
  259. পোষণ্যা=পোষা।
  260. বাটগুটি=খর্ব্বছন্দের সুন্দর গড়ন।
  261. চিরল=চিক্কণ ও কোঁকড়ানো
  262. গিরেতে=গৃহে।
  263. কাঠুয়া=কাষ্টচ্ছেদক, ছুতোর।
  264. কামাইয়া=নির্ম্মাণ করিবা।
  265. ময়ালে=মহালে, দেশে।
  266. মাইয়ালে=স্ত্রীলোকে।
  267. কামায়=উপার্জ্জন করে।
  268. হাট.. দায়॥ হাটবাজার স্ত্রীলোকেরা করে। দায়=কর্ত্তব্য।
  269. দরিয়ার......গুণি=নদীর মধ্যে যত হীরা, মণি প্রভৃতি আছে, তাহ। না বাছিয়া না গুণিয়া জাল দিয়া আটকাইয়া তুলে, অর্থাৎ সেগুলি এত অপরিমিত যে গোণা বাছা যায় না।
  270. আমনে......মন=আমন চাউলের বিনিময়ে মণ পমিত সোণা দেয়।
  271. শুড়িমাছ=শুক্‌টি মাছ, শুষ্ক মৎস্য।
  272. কাটুয়া=কচ্ছপ, কেঠো।
  273. বাপেতে....খায়=পিতা যদি উপার্জ্জন করেন, তবে পুত্র ও পৌত্রের আর উপার্জ্জন করিতে হয় না।
  274. ঠাস্‌কি=ধোঁকা, বন্ধুকে ঠাস্‌কি লাগাইয়া অর্থাৎ ধোঁকা দিয়া।
  275. ছাপাইয়া=লুকাইয়া।
  276. তরে=তোমাকে।
  277. হাছুলি=হাঁসুলি।
  278. গঙ্গাজলি শাড়ীর কথা অনেক প্রাচীন বাঙ্গালা কাব্যে আছে।
  279. খারুয়া=মল।
  280. বাইছাগণে=মাঝিরা, যাহারা নৌকা বাহে।
  281. পাছ বাড়ানে=পশ্চাৎ পশ্চাৎ।
  282. কোকি গারর দেশ=কুকী ও গারোদের দেশ।
  283. পাইড়া=দুই স্রোতের মধ্যস্থল।
  284. নাল=স্রোত।
  285. আড়ি=নির্দ্দিষ্ট কাল।
  286. বার চাইও মোরে=সম্মুখের দিকে আমার প্রতীক্ষায় থাকিও।
  287. কুন্দিয়া=ক্রুদ্ধ হইয়া।
  288. ফল্‌কিয়া=লাফাইয়া।
  289. দায়=বিসজ্জ্বনক।
  290. কাঁড়াল=কাণ্ডার।
  291. নাও=নৌকা
  292. বাইছা=যাহারা বাছ দেয়, নৌকাবাহক। তের জন মাঝির ডাক (দোহাই) মান্য করিয়া মইষাল প্রত্যাবর্ত্তন করিল।
  293. মইষাল মঘুয়ার আশায় পথের দিকে চাহিয়া রহিল।
  294. শুক্‌না কাষ্ঠের লাকড়ী=শুষ্ক কাষ্ঠের মত।
  295. পাক্‌না=পাকা।
  296. আয়=আসে। কেহ কেহ তাকে দেখিতে আসিল।
  297. নাকাল=বিপদাপন্ন, অপমানিত।
  298. থইয়া=থুইয়া, রাখিয়া। ঘর বাড়ী ইহার জেম্মায় রাখিয়া।
  299. আরদালী পেদালী=আরদালি ও পেয়াদা।