পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/কাঞ্চনমালা

৩। কাঞ্চনমালা। (৭৮―১২০ পূঃ)

 “কাঞ্চনমালার” পালাটা রূপকথা। আমার ইংরেজীতে লেখা কথা-সাহিত্য (Folk Literature of Bengal) নামক পুস্তকে কাঞ্চনমালার পালা সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা আছে। রূপকথা-সাহিত্যে মালঞ্চমালার কাহিনী কবিত্বে, পবিত্রতার মাহাত্ম্যে ঘটনাসন্নিবেশনৈপুণ্যে এবং আধ্যাত্মিকতায় এক অপূর্ব্ব সামগ্রী, কাঞ্চনমালার গল্পটিও সেই সকল গুণে ঐশ্বর্য্যশালী এবং তাহাদের সঙ্গে এক পঙ‌্ক্তিতে স্থান পাইবার যোগ্য। কাঞ্চনমালা পালাটি চন্দ্রকুমার মরিচালীগ্রামের হরচন্দ্র বর্ম্মা ও আইথরনিবাসী রামকুমার মিস্ত্রীর নিকট হইতে সংগ্রহ করিয়া পাঠান। এই গদ্যপদ্যময় গীতিকথাটিকে আমি পনেরটি অধ্যায়ে বিভক্ত করিয়াছি।

 এই কাহিনীর কয়েকটি দৃশ্য ভুলিবার নহে। কাঠুরিয়াদের বনে কাঞ্চনমালার বাস তাহদের একটি। সেখানকার বনবাস ও লতাকুঞ্জ তাঁহার পিতার রাজপ্রাসাদের মহিমাকে পরিম্লান করিয়া দিয়াছে। সেই যে রূপসী যুবতী শিশুস্বামীকে ক্রোড়ে করিয়া, কাঠ মাথায় বহিয়া পথে চলিতেছেন,―গাছের ফল কুড়াইয়া তাহাকে খাওয়াইতেছেন; তাহার শিশু স্বামী কখনও বা কাঠুরিয়া বালকদের সঙ্গে খেলিতেছে―দুঃখের মধ্যে সে কি সুখের জীবন! বনবাসের মধ্যে সে কি সুখের গৃহবাস! এই মনোরম দৃশ্য পাঠকের মানসপটে চির অঙ্কিত থাকিবার যোগ্য। ‘ মত হস্তী যেমন সরোবর মন্থন করিয়া সরোরূহ উৎপাটন করিয়া লইয়া যায়, তেমনই রাজদস্যু আসিয়া সেই প্রশান্ত বনস্থলীকে নিষ্ঠুর ভাবে পীড়ন করিয়া শিশুটিকে লইয়া গেল। সে কি নিদারুণ শোক রমণীর বুকে হানা দিয়া তাঁহার এই নিবিড় বনকুঞ্জের বাস তুলিয়া দিল! কোথাও লেংটা কুকী মানুষের মাংস খায়, কোথায় গাড়ো পাহাড়ের ঝরণার তীরে মানুষ সাপ ও বাঘের সঙ্গে একত্র বাস করে, সেই সকল দুর্গম বনস্থলী ও গিরিগুহা কাঞ্চনের হাহাকারে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল।

 কুমারের মন যখন কুঞ্জলতা হইতে আস্তে আস্তে ফিরিয়া শৈশবের আশ্রয়, সেবিকাবেশিনী কাঞ্চনের প্রতি আকৃষ্ট হইতে লাগিল, তখন দুই রমণী যে পরস্পরকে লুকাইয়া কুমারের প্রতি অনুরাগের পাল্লা দিতেছিলেন, সে দৃশ্যে কবি মনস্তত্ত্বের একটা দিক‌্ প্রকাশ করিয়াছেন। কুমার লুকাইয়া নিদ্রিতা কাঞ্চনমালাকে কপাটের আড়াল হইতে চোরের মত সন্তর্পণে দেখিতেছেন। কুঞ্জলতাকে গোপন করিয়া কাঞ্চনের সঙ্গে চুপে চুপে কথা কহিতেছেন। অথচ কুঞ্জের কুমারগত প্রাণের নীবর ব্যাকুলতা ও সতর্ক চক্ষু তাঁহার সমস্ত ফন্দী আবিষ্কার করিয়া ফেলিতেছে। তিনি সহিতে পারিতেছেন না, এবং কহিতে পারিতেছেন না; ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করিতেছেন। অবশেষে কুমার একটা ভুল করিয়া বসিলেন, যাহা কুঞ্জের অসহ্য হইয়া উঠিল। তিনি শিকারে যাত্রা কালে সাশ্রনেত্রে কাঞ্চনের নিকট বিদায় লইলেন,―অথচ কাঞ্চনমালা যাঁহার ক্রীতদাসী, যিনি রাজকুমারী ও তাঁহার বিবাহিতা স্ত্রী―তাঁহার কাছে বিদায় লইতে ভুলিয়া গেলেন। এদিকে কাঞ্চন ও একটা ভুল করিয়া ফেলিল। একদিন বর্ষায় যখন সারারাত্র ধরিয়া বৃষ্টি পড়িতেছিল, যখন প্রকোষ্ঠ একান্ত নির্জন ও মন গত ব্যথায় ভরপুর, সেই পরিপূর্ণ হৃদয়াবেগের অসতর্ক মুহুর্ত্তে সে রাজকুমারীর কথায় ভুলিয়া তাঁহার জীবনের সমস্ত রহস্য অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া ফেলিল; সে রাত্রির দৃশ্যটিও ভুলিবার নহে। কাঞ্চনের উক্তি মর্ম্মস্পর্শী; তাহার করুণা পাষাণকেও দ্রব করিতে পারে, কিন্তু পারিল না কেবল রাজকুমারীর মর্ম্মস্পর্শ করিতে। তিনি বুঝিলেন, এই পরিচারিক তাঁহারই মত বড় ঘরের মেয়ে এবং সে তাঁহার স্বামীর পুর্ব্বপরিণীতা স্ত্রী। কুমারের উপর তাঁহারও যে দাবী, কাঞ্চনের তদপেক্ষা বরং বেশী দাবী। এইবার স্ত্রীচরিত্রের কোমলতা চলিয়া গেল। স্ত্রীলোক ভাগের প্রেম করিতে চায়না, এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের ন্যায়-অন্যায় বিচার থাকে না। অতি ক্রুর কৌশল অবলম্বন করিয়া তাঁহার মাতা ও তিনি কাঞ্চনকে নির্ববাসিতা করিয়া দিলেন। সর্ব্বশেষ অঙ্কটি হিমাদ্রির গৌরীশৃঙ্গের মত মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। কুঞ্জ যে পরীক্ষা দিয়াছেন, তাহা অগ্নি পরীক্ষারও উপরে। কৃষক কবি যে এতবড় আদর্শ কোথায় পাইলেন, তাহা জানিনা। স্বামী অন্ধ হইয়াছেন, কাঞ্চন সন্ন্যাসীর নিকট স্বামীর চক্ষুদান ভিক্ষা করিতেছেন। সন্ন্যাসী তাঁহাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করাইলেন, তিনি যাহা চাহিবেন, তাহাই কাঞ্চনকে দিতে হইবে। “আমার রাজত্ব লইয়া উহার দৃষ্টি ফিরাইয়া দিন,” সন্ন্যাসী এই দানে মাথা নাড়িলেন। “আমার দুটি চক্ষু লইয়া উঁহার চক্ষু দিন,” এবারও সন্ন্যাসী মাথা নাড়িয়া অসম্মতি জানাইলেন। “তবে কি?” “তুমি এই ফলটি লও, ইহার সঙ্গে তোমার এই সাম্রাজ্য কুঞ্জকে দান কর। কিন্তু অপেক্ষা কর, এই দানই চূড়ান্ত নহে; ইহার সঙ্গে তুমি সমস্ত স্বত্বত্যাগ করিয়া তোমার স্বামীকেও ইহাকে দান কর। শুধু তাহাই নহে। দান করিবার সময় তোমার বুক যেন কাঁপিয়া না উঠে, একটি দীর্ঘ নিশ্বাস কিংবা অশ্রু যেন পতিত না হয়; তবেই তোমার স্বামী চক্ষু পাইবেন, নতুবা নয়।”

 কাঞ্চনের শঙ্কিত স্বামী-গত প্রাণ আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিল। “আর এ জন্মে স্বামীকে দেখিতে পাইবনা, সপত্নীকে এই আমার যথাসর্ববস্ব দিয়া চলিয়া যাইতে হইবে। কাঁদিবার অধিকার পর্য্যন্ত আমার থাকিবে না,” মুহুর্তের উৎকণ্ঠার পর তিনি স্থির হইয়া নিজের সুখ অপেক্ষা স্বামীর ইষ্টকে বড় করিয়া দেখিলেন। পাষাণ হইয়া মুখের অপ্রসন্নতা ঘুচাইয়া, সপত্নীর হস্তে স্বামীকে সমর্পণ করিয়া চলিয়া গেলেন। এই মহীয়সী মূর্ত্তি কি মাইকেল এঞ্জেলো পাথরে গড়িতে পারিতেন?

 কবির বৈশিষ্ট্য ও প্রধান গুণ এই যে তিনি এই কাহিনীতে কোনও পক্ষপাতিত্ব দেখান নাই। কাঞ্চনের কষ্টেও তাঁহাকে যেমন করুণায় নিমজ্জিত করিয়াছে, কুঞ্জকেও তিনি তেমনই সহৃদয়তার সঙ্গে অঙ্কন করিয়াছেন। কেবল শেষ অঙ্কে কাঞ্চন যে শুধু প্রেমিকা নহেন, তিনি যে দধীচির মত নিজ অস্থি দিয়া স্বামীর জন্য সর্ব্বত্যাগিনী হইতে পারেন, তাহাই দেখাইয়া তাঁহাকে সমধিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করিয়াছেন। তিনি রমণী হৃদয়ে ঘা দিয়াছেন সেই জায়গায়, যে জায়গা সর্ব্বাপেক্ষা কোমল। যে সপত্নী তাঁহাকে ভয়ঙ্কর অপবাদ দিয়া নির্ব্বাসিত করিয়াছেন, সেই সপত্নীর অঙ্কে স্বামীকে দিয়া নিজে ভিখারিণীর বেশে দেশ ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন। স্ত্রী লোকের হৃদয়ের “দুর্ব্বলতম স্থানটি কৃষক কবি যে আবিষ্কার করিতে পারিয়াছিলেন, শুধু এইজন্য তাঁহাকে অসামান্য প্রতিভাসম্পন্ন বলিতে হয়।

 আমরা অনেক স্থলেই বলিয়াছি, এই সমস্ত পালাগান ও গীতিকথায় পুরাণ-প্রচারিত ব্রাহ্মণ্য-প্রভাব আদৌ নাই। কিন্তু বাক্যপল্লবের দ্বারা সতীত্বের মাহাত্ম্য ঘোষণা এবং অপরপার যে সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্বাভাবিকতা ও অসামঞ্জস্য এই পালাটির মধ্যে মধ্যে দৃষ্ট হয়, তাহার কারণ সহজেই অনুমান-যোগ্য। পরবর্তী যুগের গায়কসম্প্রদায় শ্রোতৃবর্গের তৃপ্তি-বিধানের জন্য ক্রমশঃ পৌরাণিক ধর্ম্মের প্রচার দ্বারা পালার আয়তন বৃদ্ধি করিয়া পালাটিকে এই সমস্ত দোষ-দুষ্ট করিয়াছেন।

কাঞ্চনমালা

গায়নের ভূমিকা।

* * * * *

বন্দনা করিলাম ইতি শুন সভাজন।
মন দিয়া কাঞ্চনমালার শুন বিবরণ॥
তাল মাত্র বোধ নাই থইয়া রইয়া[১] গাই।
উস্তাদের[২] চরণ বিনা আর ভরসা নাই॥

চাইর কোণা আসমান্ ভাইরে মধ্যে জ্বলে তারা।
তারা মধ্যে বসত করে দানা পরী যারা॥
ফিরে দানা পরী যারা॥
বড় বড় আবের ঘর পুরীর চারি ভিতে।
বিনা চেরাগে রোশনাই জিল্‌কী বান্দা তাতে॥
সোণার হুড়ুকা ভাইরে সোণার বান্দা ঝাপ।
রতন ঝলকে তার মধ্যে রাঙ্গা ছাপ॥১০
তার মধ্যে বসত করে দানা পরীর রায়[৩]
আবের পালঙ্কে তারা শুইয়া নিদ্রা যায়॥১২
একদিনের কথা সবে শুন দিয়া মন।
সভার মধ্যে কাঞ্চনমালা করয়ে নাচন॥১৪

বার দিয়া[৪] বসিয়াছে দানা পরীর রায়।
বাজুইয়া[৫] সভায় বসি খুঞ্জুরী বাজায়॥১৬
চাইর দিকে দানা পরীরা সব সভা করিয়া।
বসিয়াছে কাঞ্চা সরার উপরে উঠিয়া॥২০

কাঞ্চনমালা নাচন করিতেছে।


কমরে ঘুঙ্ঘুর পায়ে সোণার নুপুর।
থমকিয়া উঠে তাল রুনুর ঝুনুর॥২২
মহিত হইল সবে নাচন দেখিয়া।
নিত্য করে কাঞ্চনমালা সরাতি[৬] উঠিয়া॥২৪
লাগে বা না লাগে আঙ্গুল শূন্যে রাখ্যা ভর।
এহি মতে করে নাচন সভার ভিতর॥২৮
কপালে দৈবের লেখা খণ্ডন না যায়।
ভাঙ্গিল যে কাঞ্চা সরা পায়ের না[৭] যায়॥৩০
গোসা হইল পরীর রাজা শাপ দিল রোষে।
এক শাপে কাঞ্চনমালার বেণীর বান্ধন খসে॥৩২
আর শাপে খসে কন্যার রত্ন অলঙ্কার।
আর শাপে হইল কন্যা মরার আকার॥৩৪
বদন হইল কালী চক্ষু হইল আন্দা[৮]
পরী হইয়া মনুষ্য ঘরে রইব গিয়া বান্দা॥৩৬

বিশ বচ্ছর গেলে পরে শাপ হইব শেষ।
আরাক বার[৯] আসিবে কন্যা দানবের দেশ॥৩৮
দানা পরীর দেশের কথা এইখানে থইয়া।
মনুষ্যি জন্মের কথা শুন মন দিয়া॥৪০

আরম্ভ

(১)

ভরাই নগরে ঘর ছিল সাধু সদাগর,
চমৎকার ডিঙ্গা চইদ্দখান।
সাগর বহিয়া যায়, দেশে দেশে সাধু যায়,
চইদ্দ নাও ভরইরা অন্বেষণ॥
সোণার নির্ম্মাইয়া বাড়ী রহে সাধু নিজ বাড়ী,
কিছুকাল অতি দুঃখী মনে।
কন্যা পুত্ত্র নাহি তার, পুরীখানা অন্ধকার,
ধন রতন সকল অকারণে॥
জাওহর[১০] হইল জর প্রাণে হইয়া কাতর
কান্দে সাধু সকরুণ মনে॥
আমারে হইল বিধি বামরে।
যে নদীতে জল নাই নাম কিবা তার[১১],
ভাইরে কাম কিবা তার।
যে ঘরে চেরাগ[১২] নাই শুধা[১৩] অন্ধুকার
ভাইরে শুধা অন্ধকার॥১০

নিষ্ফলা গাছেতে কভু বান্দর নাহি চড়ে।
ফুলে মধু না থাকিলে না জিগায়[১৪] ভ্রমরে॥১২
পুত্ত্র বিনে সাধুর পুরী যে আন্ধাইর[১৫]
অনেক দুষ্কেতে সাধু হইল ঘরের বাইর॥১৪
দৈবযোগে এক যোগী পথে দিয়া যায়।
কান্দিয়া পড়িল সাধ্যু সন্ন্যাসীর পায়॥১৬
অপুত্ত্রা আটকুরা আমি দুনিয়ার দুষমণ।
আমারে দেখিলে লোকে ভাবে বিড়ম্বন॥১৮
খেজালতে[১৬] দরিয়ার ডুব্যা মরতে যাই।
দৈবে যদি দেখা দিলা রাখহ গোসাই॥২০

(২)

 (গদ্য) সদাগরের এই কথা শুনিয়া সন্ন্যাসীর মনে খুব দয়া হইল। সন্ন্যাসী তার হাতে একটা ফল দিয়া বলিল।

এই ফল নিয়া তুমি নিজ ঘরে যাও।
শনি কি মঙ্গলবারে রাণীরে খাওয়াও॥
আচরিত[১৭] কন্যা এক জন্মিবে তোমার ঘরে।
পুরীখানা আলো হবে রূপের পশরে॥
চন্দ্রসম সেই কন্যা হবে রূপবতী।
তার গুণেক[১৮] তোমার যত খণ্ডিবে দুর্গতি॥
কিন্তু এক কথা শুন হইয়া সাবধান।
নবম বচ্ছরে কন্যা দিবে গৌরীদান॥
নয় বচ্ছর পরে যদি দণ্ডেক ভারাও[১৯]
সাগরে ডুবিবে তোমার চৌদ্দখানা নাও॥১০

পুরীতে লাগিবে তোমার বেহুতি[২০] আগুনি।
ক্রুদ্ধ হইয়া ধনস্থলে বসিবেন শনি॥১২

(৩)

(সাধু সদাগর ফল লইয়া বাড়ী গেল)।

বারবেলা গেল শনির চাইর দণ্ড কাল।
পাঁচ দণ্ডে ফল সাধু করিল পাখাল[২১]
ছয় দণ্ডে চলে সাধু অন্দর ময়ালে।[২২]
রাণীর লাগাল পাইল সাধু সাত দণ্ড কালে॥
আট দণ্ড কালে সাধু ফল দিল রাণীর হাতে।
ভক্তি মনে ফল রাণী তুইল্যা নিল মাথে॥
নবদণ্ডে কালে ফল নবদুর্গা স্মরি।
সন্ন্যাসীর ফল খায় সদাগরের নারী॥
এক মাস গেল রাণীর ভাবিয়া চিন্তিয়া।
দুই মাস গেল রাণীর পালঙ্কে শুইয়া॥১০
তিন মাসে হইল রাণীর গর্ভের লক্ষণ।
চাইর মাসে সদাগর আনন্দিত মন॥১২
পাঁচ মাসে পঞ্চামিত্তি[২৩] ছয় মাস যায়।
সাত মাসে সাধ আসি খাওয়াইল মায়॥১৪
আট মাসে উচাটন হইল রাণীর মন।
নবম মাসেতে রাণীর আলস্য শয়ন॥১৬
দশমাস দশ দিন এইরূপে যায়।
জন্মিল কন্যা এক প্রভুর কিরপায়॥১৮
জন্মিতেই দেখে কন্যা চন্দ্রের সমান।
উজলা হইল পুরী রূপের বাখান॥২০

(8)

এক মাস দুইমাস করিয়া ক্রমে এক বচ্ছর। একবচ্ছর দুই বচ্ছর করিয়া ক্রমে চাইর বচ্ছরে পড়িল। চাইর পাঁচ বচ্ছর, ক্রমে ছয় বচ্ছর। দেখতে দেখতে ক্রমে সাত আট নয় বচ্ছর। সেই নয় বচ্ছরেরও মাত্র নয় দণ্ড বাকী।

দেবাংশী[২৪] হইল কন্যা নয় না বচ্ছরে।
যৈবনের লক্ষণ দেখা দিল না শরীরে॥
মাথায় দীঘল কেশ পাও বাইয়া পরে।
কেশের ভারেতে কন্যা হাটিতে না পারে॥
আকাশের তারা যেন দুই চক্ষু দেখি।
ঘনই সিন্দুরা যেন রাখে দুই ঠোটে মাখি[২৫]
সোণা গলাইয়া যেন বানাইছে পুতুলা।
গলায় দিয়াছে দিব্য রতনের মালা।

 এদিকে সদাগর খুব চিন্তায় পড়িল। নয় বচ্ছরের মাত্র নব দণ্ড বাকী।

দৈবের নির্ব্বন্ধ কথা শুন দিয়া মন।
সেই কন্যার বরাতে এতেক বিড়ম্বন॥১০
আস্‌মানে জন্মাইয়া তারা জমীনে ফালায়।
অভাগ্যা জনেরে বিধি কভু নাহি চায়[২৬]১২
সন্ন্যাসীর কথা সাধুর মনেতে পড়িল।
মনে মনে সদাগর আখইট[২৭] করিল॥১৪

নয় দণ্ডের এক দণ্ড মাত্র বাকী আছে।
কি জানি দৈবের শাপ ফলে তারি পাছে॥১৬
কি জানি সাগরে ডুবে চইদ্দ খানি নায়।
ভাবিয়া চিন্তিয়া সাধু না দেখে উপায়॥১৮
মনে মনে ভাবি সাধু মন মত্ত হইল।
অর্দ্ধ দণ্ড থাক্‌তে সাধু পরতিজ্ঞা করিল॥২০
এর মধ্যে যার মুখ দেখিবাম[২৮] কাছে।
তার কাছে দিবাম কন্যা কপালে যা আছে॥২২
কপালে থাকিলে দুঃখ খণ্ডান না যায়।
দুঃখের কপাল যার কি করিব বাপ মায়॥২৪

 এমন সময় এক ভিখারী বামুন আসিয়াই সেই সদাগরের কাছে হাজির হইল।

(৫)

অতি বৃদ্ধ বুড়া সে যে লড়িত[২৯] করি ভর।
কাকালে করিয়া আনে একটি কোঙর[৩০]
ছয় মাসের শিশু অন্ধ দুই আঁখি।
খারা আছে ভিক্ষাসুর[৩১] মুষ্টি অন্নের খাকী[৩২]
লাগিয়া আতুর দশা[৩৩] মরছে বরামণি[৩৪]
অন্ধ শিশু রাইখ্যা গেছে জ্বলন্ত আগুনি[৩৫]
এইত কাল ব্রাহ্মণের দুঃখে দুঃখে যায়।
পরকালের লাগ্যা ঠাকুর চিন্তয়ে উপায়॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া ঠাকুর কোন কাম করে।
অন্ধ পুত্ত্রে লইয়া আসে সাধুর গোচরে॥১০

ঠাকুর কহে সাধু তুমি এরে দেও ঠাঁই।
এরে রাখ্যা আমি তবে গয়া কাশী যাই॥১২
ইহকাল গেল মোর ভিক্ষা যে করিয়া।
পরকালের কাম করি গয়া কাশী গিয়া॥১৪
দুঃখের উপরে দুঃখ অন্ধ পুত্ত্র মোর।
তোমার কাছে সইপ্যা কাটি সংসারের ডোর॥১৬
ভাবিয়া চিন্তিয়া সাধু কোন কাম করিল।
অন্ধ পুত্ত্র লইয়া সাধু কন্যার কাছে গেল॥১৮

(৬)

 গদ্য—সেই অর্দ্ধ দণ্ড শেষ হইবার বেশী বিলম্ব নাই। সাধু গিয়া কন্যার সাম্‌নে খারাইছে,[৩৬] আর অঝর নয়নে তার চক্ষের জল পড়িতেছে।

এতেক দেখিয়া বাপে দুঃখিত হইল।
কান্দিয়া কাঞ্চনমালা কহিতে লাগিল॥
শুন শুন ওহে বাপ কহি যে তোমারে।
কি জন্য কান্দিছ বাপ কহ গো আমারে॥
কোন দোষ করিলাম পায় গো মুই অভাগিনী।
কোন দোষে তোমার চক্ষে বহে পানি॥
জন্মিয়া না দেখিলাম অভাগিনী মায়।
মাও বাপ এক হইয়া তুমি পালিলা আমায়॥
মেঘে যেমন পড়ে পানি গো নদী লালা ভাসে।
তোমার কান্দন দেইখ্যা ধৈর্য্য নাই সে আসে[৩৭]১০
কও কথা শুনি
কোথা হইতে আন্‌লে শিশু জ্বলন্ত আগুনি॥১২

কেমন সর্ব্বনাশী জানি এই শিশুর মাও।
পথেতে এড়িয়া গেল তাই তুমি পাও॥১৪
কেমন দুষ্‌মণ জানি এই শিশুর বাপ।
আর জন্মে করে শিশু না জানি কি পাপ॥১৬
দুধের ছাওয়াল এযে তার অন্ধ দুই আঁখি।
চান্দ সুরুজের জন্মে নাহি দেখি[৩৮]১৮
জন্ম দুঃখীর দুঃখু বাপ কভু নাহি যায়।
কোন কালে অন্ধের না রজনী পোহায়[৩৯]২০

(৭)

মুখে নাহি সরে রাও না কহিলে নয়।
কান্দিয়া কান্দিয়া সাধু কহে সমুদয়॥
শুনগো আদরের কন্যা কহি যে তোমারে।
সন্ন্যাসী যতেক কইল আমার গোচরে॥
অপুত্ত্রা আটকুড়া আমি ডুব্যা মরতে চাই।
দৈবযোগে সন্ন্যাসীরে পথে লাগাল পাই॥
এক ফল দিল যোগী তোমার কারণে।
সেই ফলের গুণে পাই তোমা এন[৪০] ধনে॥

আজ সে বাঁচিয়া নাই তোর গর্ভধারী মাতা।
বাঁচিয়া থাকলে আজ শানে ভাঙ্গ্‌ত মাথা[৪১]১০
নয় বছর কালে তোরে দিব গৌরীদান।
কন্যা দান করি হইব ইন্দ্রেরই সমান॥১২
নয় বচ্ছর কোন মতে যায় গত হইয়া।
ভরাসহ চৌদ্দ ডিঙ্গা যাইব সায়রে[৪২] ডুবিয়া॥১৪
সন্ন্যাসী কহিল মাওগো নিষ্ঠুর বচন।
বুকে দিয়া বিন্দে শেল পিষ্ঠে বিদারণ[৪৩]১৬
নয় বছর ধরিয়া আমি দেশে আর বিদেশে।
তোমার যোগ্য বর আমি না পাইলাম তাল্লাসে॥১৮
নয় বচ্ছর পূর্ণ হইতে অর্দ্ধ দণ্ড বাকী।
অবিয়াইত কইরা তোমায় কেম্‌নে ঘরে রাখি॥২০
ভিক্ষাসুর বামুন এক আইল হেন কালে।
গয়া কাশী গেছে ঠাকুর রাখিয়া ছাওয়ালে॥২২
আজি হৈতে এই পুত্র পালন কর তুমি।
কপালে আছিল তোমার অন্ধ ছাওয়াল স্বামী॥২৪

(৮)

আশমান্ জুইড়া কাল মেঘ দেওয়ায় ডাকে রইয়া[৪৪]
বনের পশুপক্ষী কান্দে বৃক্ষডালে বইয়া[৪৫]
কান্দিতে লাগিল কন্যা স্মরি দুর্গার নাম।
বাপ হৈল বৈরী ফিরে বিধি হৈল বাম॥

পথে নাইরে চান্দের আলো ঘাটে নাইরে খেয়া।
দরদী মাও ত নাই দুনিয়ার মাঝে মেওয়া[৪৬]
এই ঘরে বইসা না মাও বাইন্দা দিত চুল।
আর ত না দেখিব অভাগী সেইত না মায়ের কোল[৪৭]
মায়ের রাও[৪৮] পবনের বাও[৪৯] এমন শীতল নাই।
জালুনি[৫০] তাপিত প্রাণ কি দিয়ে জুড়াই॥১০
বাঁচ্চিয়া যদি থাক্‌ত মাও থাকিত বাঁচ্চিয়া।
অন্ধ ছাওয়ালের কাছে নাই সে দিত বিয়া॥১২
বাপেরে বা দোষী কেনে কপাল হইল বোড়া[৫১]
সাক্ষী হও চন্দ্র সূর্য্য আস্‌মানের তারা॥১৪
কোলের মধ্যে সাক্ষী হও অন্ধ ছাওয়াল স্বামী।
আজি হইতে অভাগীর তুমি সে সোয়ামী॥১৬
সাক্ষী হওরে গাছ গাছালি বনের পশু পঙ্খী।
আজি হইতে কাঞ্চনমালা হইল উদাসী[৫২]১৮
এই মনে কান্দিয়া কন্যা রাত্রির ভিতর।
বাপের বাড়ী ছাইড়া যায় ভরাই নগর॥
(হায় হায় কইরা) বনে থাক বাঘ ভালুক কহি যে তোমারে।
এই ছাওয়াল রাখিয়া কেন না খাও আমারে॥২২

বড় দুঃখ পাইয়া ছাড়লাম ভরাই নগর।
বড় দুঃখ পাইয়া ছাড়লাম মা বাপের ঘর॥২৪
অচেনা অজানা পথ আন্ধারে মিলায়[৫৩]
কাঁটায় কাটিয়া কন্যার রক্ত বহে পায়॥২৬
কাম সিন্দূর যেন আস্‌মানের গায়।
সার দিন বন্ ভাঙ্গি সন্ধ্যা না মিলায়[৫৪]২৮
একেত আন্ধাইরা বন আরও আসে রাতি।
অন্ধ এক শিশু খালি সঙ্গের সঙ্গতি॥৩০

* * * * *

সত্য যুগের দাড়াক গাছ মিন্নতি তোমারে।
আজি রাত্রি কোলে স্থান দেওরে আমারে॥৩২
তুমি না বনের রাজা তুমি বাপ মাও।
ছাওয়ালেরে বাঁচাও প্রাণে মোর মাথা খাও॥৩৪
ইহা বইলা গাছের মধ্যে তিন টুকী মাইল।
সত্য যুগের সত্য গাছ দুই চির[৫৫] হইল॥৩৬

(৮)

 গদ্য—তখন সেই দাড়াক গাছের মধ্যে থাক্যা এক সন্ন্যাসী বাহির হইয়া কন্যারে জিজ্ঞাস করল, যে, কন্যা, তুমি এই রাইত ভিতে[৫৬] কই যাইবার লাগছ? কন্যা তখন তার যত দুঃখের বিবরণ সব সন্ন্যাসীয় কাছে কইল।

“আজি রাত্রি বঞ্চ লো কন্যা গাছের কোড়ালে।
কালি ত দেখিব তোমার কি আছে কপালে॥” ৯৩ পৃঃ

সন্ন্যাসী

আজি রাত্রি বঞ্চলো কন্যা গাছের কোড়ালে[৫৭]
কালিত দেখিব তোমার কি আছে কপালে॥

আবের বরণ চিকিমিকি হলুদ মাখিয়া।
রজনী হইলে গত সন্ন্যাসী আসিয়া॥
কহে কন্যাগো বড় বাপের ঝি তুমি
কপালে আছিল দুঃখ না যায় খণ্ডানী॥

* * * * *

এই ফল লইয়া তুমি ছাওয়ালে খাওয়াও।
চক্ষুদান পাইবে ছাওয়াল কহিলাম তোমায়॥
আগ বাড়ান্তে[৫৮] আসে যত কাঠুরিয়ার দল।
সেইখানে যাও তুমি লইয়া ছাওয়াল॥
এই স্বামী লইয়া থাক কাঠুরি ভবনে।
ছয় মাসের বাইর শিশু বাড়বে এক দিনে[৫৯]১১
দৈবে যদি পড়লো কন্যা কহি যে তোমারে।
আর দিন আইস কন্যা আমার নিকটে॥১৩

(৯)

 গদ্য—কাঞ্চনমালা তখন এই ছাওয়ালরে ফল খাওয়াইল। খাওয়াইলে পরেই তার চক্ষু খুইল্যা গেল।

তেরা লেঙ্গা[৬০] আছিল শিশু মইলানের কাটি।[৬১]
মরা যেন বাচ্যা উঠ্‌ল পাইয়া পছটী (?)॥

কন্যা আস্তে বেস্তে যায়।
কত দূর গিয়া কাঠুরিয়া ভবন সামনে দেখ্‌তে পায়
কাঠুরিয়া কাঠরাণী বইসাইয়াছে পাড়া।
লতায় পাতায় ঘর দেখতে কিবা সুন্দর
কাঠ বিকাইয়া খায় তারা॥
ফিরে কাঠ বিকাইয়া[৬২] খায় তারা॥
হাসি খুসি মুখখানি, যেন পূন্নিমার চান্নি,
সুখে ঘর করে স্বামীপুত্ত্র লইয়া॥
মাথায় চিরল কেশ, পিন্ধনে টুটির[৬৩] বেশ,
কন্যারে দেখিয়া আইল ধাইয়া॥১০
কোন বা দেশে বাড়ী কন্যা কোন বা দেশে ঘর।
কি কারণে বনে ভালা কহগো উত্তর॥১২
কেমন নিঠুর বাপ কেমন নিঠুর মাও।
সত্য কথা কও কন্যা মিথ্যা না ভারাও॥১৪
কেমন নিঠুর জানি নাগরিয়া লোক[৬৪]
তোমায় পাঠাইয়া বনে পায় কোন সুখ॥১৬
চন্দ্রের ছোরত[৬৫] কন্যা যেন দানা পরী।
তোমারে পাঠায়ে বনে দিল একেশ্বরী॥১৮
কুলের[৬৬] ছাওয়াল দেখি চান্দের সমান।
এরে এড়িল[৬৭] কেমনে নাগরিয়ার পরাণ॥২০
কেমন তোমার পিতা মাতা কেমন সে দরদিয়া[৬৮]
কেমন কইরা আছে তারা তোমায় বনে দিয়া॥২২

মাতা নাই সে পিতা নাই সে আমার গর্ভ সোদর ভাই।
সোতের শেওলা[৬৯] হইয়া ভাসিয়া বেড়াই॥২৪
বাপ মায় নাই সে দোষী নগরিয়ায় নাই সে দোষী।
কপালের দোষে আমি হইয়াছি বনবাসী[৭০]২৭

 সেই বনের মধ্যে কাঠুরিয়া আর কাঠুরাণী আছিল। তারার কোন পুত্ত্র-সন্তান আছিল না। তারা খুব যত্ন কইরা কন্যারে ঘরে স্থান দিল। কাঞ্চনমালা কাঠুরিয়া কাঠুরাণীর লগে[৭১] বনের মধ্যে কাঠ কাটে। সে যে পথ দিয়া যায়, সেই পথ তার রূপে পসর[৭২] হইয়া যায়। এ দেখ্যা তারা খুব ভাবতে লাগল।

কেউ বলে এই কন্যা হবে দানা পরী।
কেউ বলে এই কন্যা রাজার ঝিয়ারী॥২৮
খসিয়া আস্‌মানের চান্দ ভুঁয়েতে[৭৩] পড়িল।
কেউ বলে বনের লক্ষ্মী বনবাসে আইল॥৩০
কেউ বলে কাঠুরিয়ার খণ্ডিবে দুর্গতি।
মনে মনে কন্যার পায় জানায় মিন্নতি॥৩২

(১০)

 এক দুই কইরা চাইর বচ্ছর যায়। কাঠুরিয়ারা এক গুণ মালে চাইর গুণ বিকায়[৭৪]। তারা নিয্যাস[৭৫] ভাবল, দেবতা মায়া কইর‍্যা আমরারে[৭৬] ধরা দিছেন। এই দিকে কুলের[৭৭] দেবংশী[৭৮] ছাওয়াল ছয়মাসের বাইর[৭৯] এক দিনে বাড়ে। এইরূপে ছয় বচ্ছর গত হইয়া গেল।

এক দিন হইল কিবা শুন দিয়া মন।
শিকার করিতে বনে আইল রাজা এক জন॥
কপালের দুঃখু কথা না যায় খণ্ডানী।
কাঞ্চন মালারে লইয়াগিছে যত কাঠুরাণী॥
কাঞ্চনমালারে লইয়া গেছে দূর বনে।
বইয়া কাষ্ঠের বোঝা তারা সবে আনে॥
ভাল ভাল বনের ফল দেওত[৮০] তুলিয়া॥
ফল আনে কাঞ্চনমালা আইঞ্চলে বান্ধিয়া॥

 এদিকে হইল কি, সেই রাজা কাঠুরিয়ার ভবনে ফুলকুমারকে দেখ্‌তে পাইল। ফুলকুমার তখন আর আর কাঠুরিয়া বালকগণের সহিত পক্ষী শিকার কর্‌তেছিল।

চান্দের সমান পুত্ত্র নজর কইরা চায়।
এমন সুন্দর রূপ না দেখি কোথায়॥১০
কাঠুরিয়ার পুত্ত্র নয় সে ভাবে মনে মনে।
ডাক দিয়া ফুলকুমারে আনে ততক্ষণে॥১২
নজর কইরা চায়।
রাজটীকা ছাওয়ালের কপালে দেখা যায়॥১৪
এই রাজটীকা রাজা যখন দেখিল।
সঙ্গে কইরা লইতে চাওয়ালে হুকুম করিল॥১৬
খুষে[৮১] নাহি যায় যদি কি করিব তার।
বান্ধিয়া লইবা তবে হুকুম আমার॥১৮

এত শুনি লোক লস্কর যায় মার মার করি।
শিকারে বেড়িয়া যেন লইল সরইরী[৮২]২০
কাঠুরিয়ার ঘর ভাঙ্গি ফালায় জমীনে।
পক্ষীর বাসা ভাঙ্গে যেন বনেলা[৮৩] শয়তানে॥২২

রাজা নিজ দেশে গেল।
ততক্ষণে কাঠুরিয়ারা নিজ ঘরে আইল॥২৪
সর্ব্বনাশ করি সবে করে হাহাকার।
কিমত দুষমণে কইল এমন আচার॥২৬
ডাকাতে লুটিয়া লইল ঘর গিরস্থী ধন।
মুণ্ডে হাত দিয়া সবে জুড়িল ক্রন্দন॥২৮
কেউ কান্দে ঘরের লাগ্যা কেউ বা কান্দে রইয়া।
অভাগিনী কন্যা কান্দে সোয়ামী না পাইয়া[৮৪]৩০
সতীর না পতি যেমন সাপের মাথার মণি।
দণ্ডেক ছাড়িয়া গেলে নাই সে বাঁচে প্রাণী॥৩২
কাণ্ডারী না থাক্‌লে যেমন নাও পাকে পড়ে।
সেই নারীর দুঃখু না যায় স্বামী যারে ছাড়ে॥৩৪
যে নারীর পতি নাই কিবা আছে তার।
চেড়াগ নিবাইলে যেমন দুনিয়াই অন্ধকার॥৩৬
ধন জন থাউক শত তাতে কিবা আসে যায়।
চান্দ যদি নাহি থাকে কি করিবে তারায়॥৩৮
আস্‌মানে সুরুজ যেমন রাত্রি কালের বাতি।
সেই মত ঘরের মধ্যে সতী নারীর পতি॥৪০
সোয়ামী ছাড়িয়া গেলে সংশয় জীবন।
কে রাখিবে কুলমান জীবন যৈবন॥৪২

অধবা[৮৫] নারীর ভাগ্যে দুঃখ নাহি যায়।
কেউবা বলে সাম্‌নে মন্দ কেউবা আউজায়[৮৬]৪৪
কাঞ্চনমালার কান্দনেতে বৃক্ষের পাতা ঝরে।
গইন[৮৭] বনের পশু পক্ষী উইড়া ঝুইড়া[৮৮] মরে[৮৯]৪৬

(১১)

 গদ্য—কাঞ্চনমালা পাগলের মত সেই কাঠুরিয়ার সঙ্গে দেশ বিদেশ ঘুরতে লাগ্‌ল।

শুন্দা মেথীর দেশ ভালা মাইন্‌সে মানুষ খায়।
সেইনা দেশে কাঞ্চনমালা স্বামীরে বিচরায়[৯০]
জিগার[৯১] পাহাড় ভাইরে অতি দূর দেশে আছে।
সাপের সহিত লোক বসত করে তাতে॥
বাঘ ভালুকে লোক ধইরা ধইরা খায়।
সেই দেশে উল্‌মাদিনী[৯২] সোয়ামীরে বিচরায়॥
উত্তরিয়া গাঢ়ো খুকী[৯৩] বড়ই দুর্জ্জন।
লেংটা হইয়া তারা বেড়ায় বনে বন॥

মানুষ খাইয়া তারা গায়ে করছে বল।
একেলা যায়ত কন্যা সেই পাহাড় তল॥১০
পাথরে পিছলাইয়া কন্যা আছাড় খাইয়া পড়ে।
পাইয়া দারুণ দুঃখ কান্দে উচ্চৈঃস্বরে॥১২
চৈত্রমাসের বালু যেন খুলায়[৯৪] ভাজিয়া।
সেই পথে বালু যেন রাখিছে ঢালিয়া॥১৪
সেই পথের উপর দিয়া কন্যা হাটিয়া যে যায়।
আগুনের তাপে তার ঘা হইল পায়॥১৬
নানা পাহাড়িয়া দেশ নানা রাজ্য ঘুরি।
চলিতে লাগিল কন্যা দুর্গার নাম স্মরি॥১৮
ছয় বছর ঘুরি কন্যা কোন কাম করে।
উপনীত হইল গিয়া সুমাই[৯৫] নগরে॥১২০

(১২)

সুমাই নগরের রাজা বিদ্যাধর নাম।
কুঞ্জলতা কন্যা তার অতি অনুপাম॥
ঢুলুয়া[৯৬] দিতেছে ঢোল সঙ্গে বাজে কাশী।
রাজকন্যা কুঞ্জমালার চাই এক দাসী॥

 গদ্য—এই ঢোলের কথা শুন্যা কাঞ্চনমালা তার কাঠুরিয়া পালক পিতার কাছে কইল, আমি আর কোন খানে না যাইয়া এই রাজকন্যার দাসী হইয়া থাকব।

চলিতে চলিতে আমার নাই সে চলে পাও।
বিদায় দেও জন্মের মত আমার কাঠুরাণী মাও॥

বিদায় দেও জন্মের মত কাঠুরিয়া বাপ।
আমার লাগিয়া তোমরা পাইলা বড় তাপ॥
তোমাদেরে ছাইড়া যাইতে মনে নাহি লয়।
কইছি বা না কইছি কত থাকুক সমুদয়[৯৭]১০
জন্মিয়া না দেখিয়াছি মায়ের চান্দ মুখ।
তোমরা দুইয়ে দেখ্যা মাগো পাসুরছিলাম[৯৮] দুখ॥১২
বনের কথা মনের কথা সব রইল পড়ি।
আজি হইতে যাও তোমরা অভাগীরে ছাড়ি॥১৪
কার কাছে কইবাম দুঃখ কার বা কাছে চাই।
আইজ হইতে জানিও মাগো কাঞ্চনমালা নাই॥১৬

কান্দে কান্দে কাঠুরাণী মাথা থাপাইয়া[৯৯]
কেমনে যাইব মাগো তোমারে ছাড়িয়া॥১৮
অপুত্ত্ররার[১০০] পুত্ত্র তুমি নির্ধনিয়ার ধন।
কেমনে ছাড়িয়া তোমায় যাইবাম আমরা বন॥২০
শীতল নদীর পানি দাড়াকের ছায়া।[১০১]
ছাইড়া যদি যাইবা কেন বাড়াইলে মায়া॥২২
গলাগলি মায়ে ঝিয়ে জুড়িল কান্দন।
দৈবযোগে হইয়াছিল মায়ার বান্দন॥২৪

(১৩)

কন্যা ঢোলে হাত দিল।
রাজার লস্করে সবে তারে ধরিয়া লইল॥
সবে নজর কইরা চায়।
কুঞ্জমালার হেন রূপ চক্ষে দেখ্‌তে পায়॥[১০২]
লস্করেরা[১০৩] বিক্রী দারে তালাস করিয়া।
কাঠুরিয়ায় তুষ্টু করে লক্ষ তঙ্কা[১০৪] দিয়া॥

 গদ্য—তখন লোক লস্করেরা কাঞ্চনমালাকে লইয়া রাজার কাছে গেল।

তার পরেতে হইল কিবা শুন মন দিয়া।
সেই কোমারের[১০৫] সঙ্গে হইল কুঞ্জলতার বিয়া॥
সুখে তারা আছে, থাকে যোর মন্দির ঘরে।
ময়ূরে ময়ুরে যেমন তোষাখানার ঘরে॥১১
কৈতরা কৈতরী[১০৬] যেমন খোপাতে বসিয়া,
বাস করে মুখে মুখ মিলাইয়া॥[১০৭]১৩
তারা দুইজনে............
মনের আনন্দে শুইয়া কাটে দিনরাত॥১৫

একদিন কুঞ্জলতা কয় প্রভুর স্থানে।
বনেতে আছিলা গো পতি কাঠুরি ভবনে॥১৭
বনেতে আছে বাঘ ভালুক কেম্‌নে কর্‌তা বাস।

* * * * *

(আর) কেবা তোমার মাও বাপ কোন দেশেতে ঘর।
কেম্‌নে কইরা আইলা এই ঐ বনের ভিতর॥২০

রাজার দুলাল রূপ কেন্‌বা বনবাসে।
কিসের লাগিয়া তুমি জ্বল হা হুতাশে॥২১
মাও নাই বাপও নাইরে কন্যা ছিলাম বনবাসী।
তোমার বাপে আন্‌ল আমায় দেখিয়া বৈদেশী॥২২
শুন শুন কন্যা ল শুন দিয়া মন।
বড় সুখে ছিলাম আমরা সেই গইন বন॥২৪

এক কথা কইতে কোমার[১০৮] আর কথা লোকায়[১০৯]
তা কুঞ্জমালা ধইরা কয় আপন স্বামীর পায়॥২৬

কও কও বনের কথা শুনতে ভালবাসি।
আমারে না লোকায় কথা আমি তব দাসী[১১০]২৮

গইন বনে ছিলাম কন্যালো কাঠুরিয়া সনে।
মনের সুখে কাটাইতাম যতদিন মনে॥৩০
এক কন্যা কাঠুরিয়ার ছিল সে সুন্দরী।
তার রূপের কথা কইতে নাই পারি॥৩২
কিছু কিছু মনে পরে সেই কন্যার কথা।
তাহার হারাইয়া মনে পাইয়াছি বড় ব্যথা॥৩৪
সাই[১১১] সাথিনী আমার সেই কন্যা ছিল।
তাহার নিকট হইতে তোমার বাপে কাড়িয়া আনিল॥৩৬
বনে ছিল বনের মাও সেই দুষ্কের কালে।
আমারে লালিয়া পালিয়া সেই বড় করিয়া তুলে॥৩৮

মাথায় কাষ্ঠের বোঝা ঘাম বাইয়া পরে।
বনের ফল আন্যা আমায় খাওয়াইত আদরে॥৪০
কুলে কইরা[১১২] বনের পথে করিত ভরমণা[১১৩]
এক দণ্ড না দেখলে মোরে হইত দাওনা॥[১১৪]৪২
তাহারে ছাড়িয়া কন্যা তোমার বাপ লইয়া আইসাছে।[১১৫]
আমারে ছাড়িয়া কন্যা কেমন জানি আছে॥৪৪

(১৪)

কি কইলা কি কইলা প্রভুরে আচরিত কথা।
তোমার কথা শুইন্যা মনে পাইলাম বড় ব্যথা॥
কোথা হইতে আইল কন্যা কেন থাকে বন।
অভাগী কন্যার কেউ নাই কি আপন॥
নাই কি তার বাপ মা গর্ভসুদর ভাই।
আপনা বলিতে তার কেও কিরে নাই॥
না জানি সুন্দর কন্যা দেখিতে কেমন।
আঁকিয়া দেখাও তার সুন্দর মুখ খান॥

ভাবিয়া চিন্তিয়া কুমার কোন কাম করে।
কন্যার রূপ আঁকে কুমার যোড় মন্দির ঘরে॥১০

মাথার দিঘল কেশ পাও বাইয়া পড়ে।
তারা[১১৬] ভুরু আঁকে কুমার এক এক করে॥১২
তবে ত আঁকিল তার চিক্কণ কাকালি।
সর্ব্বাঙ্গ আঁকিল কন্যার কদম্বের কলি॥১৪
দেখিয়া কন্যার রূপ কুঞ্জমালা মনে।
ভাবিয়া চিন্তিয়া তবে কয় প্রভুর স্থানে॥১৬

(১৫)

 বাপের কাছে কুঞ্জমালা আসিয়া কইল, আমার একজন দাসী চাই। সে এরকম[১১৭] সুন্দর হওন চাই। রাজা তখন বাজারে ঢোল্‌ পিটাইয়া দিল। সকলেই বলাবলি করিতে লাগিল যে, কুঞ্জমালার জন্য রাজা যে দাসী আনিয়াছে সে হয়ত কোন রাজকন্যা, বিপাকে পড়িয়া রাজার কন্যা হইয়া দাসী হইয়াছে। সেই দিন কুঞ্জমালা কুমারের আঁকা ছবির সঙ্গে মিলাইয়া দেখ্‌ল যে, এই কন্যাই সে কাঠুরিয়া কন্যা কাঞ্চনমালা।

দুরন্ত ভাবনায় মন উঠাপড়া করে।
খাল কাটিয়া কেন আনিলাম কুম্ভীরে॥
বেগান[১১৮] দুষ্মণ কেন আনিলাম তুলি।
বনেতে আছিল ভাল বনের ভেওলী॥[১১৯]

আস্‌মানের চান যেমন মেঘেতে ঢাকিল।
সতীন ঘরে দেইখ্যা কন্যা দুঃখিত হইল॥
কেন দুঃখিত হইল তার কারণ শুন মন দিয়া।
কুমারের সঙ্গে যখন কুঞ্জলতার হইল বিয়া॥
তখন ছিল একদিন আর এখন একদিন।
সুখের দিন চইল্যা গিয়া আইছে দুঃখের দিন॥১০

যোড় মন্দিরের ঘরে কুমার শুইয়া নিদ্রা যায়।
পালঙ্কেতে কুঞ্জমালা ধীরে ধীরে যায়॥১২
আর দিন হাসিখুসী মনের মিলান।
আভেতে ঘিরিল আজ পূন্নিমারি চান্॥১৪
দেখি বা না দেখি তারে মুখে মিলায় হাসি।
কালি যে ফুটিয়া কলি আইজ হইল বাসি॥১৬
সুখের রজনী ছিল গেল পোহাইয়া।
উপায় না পায় কন্যা ভাবিয়া চিন্তিয়া[১২০]১৮

(১৬)

এই দিকে হইল কিবা শুন দিয়া মন।
দরিদ্র পাইল যেমন হারাইছিল ধন॥
সাপেতে পাইল যেন তার হারা মণি।
রাজপুত্ত্রে পাইয়া কন্যা হইল পাগলিনী॥
দুইজনেতে মনের মিল রয় ভরাভরি।
এই মতে রয় যেন কইতরা কইতরী॥
শুক আর শারী যেন কাননেতে বসি।
কুকিল কুকিলা যেমন বাজায় প্রেমের বাঁশী॥

এক দণ্ড না দেখিলে মন উচাটন।
মনে মনে হইল তবে দুহার বান্ধন[১২১]১০

 পরে এমন হইল যে, কাঞ্চনমালা খাওন না দিলে রাজপুত্ত্র খাইত না। কাঞ্চনমালা বাতাস না দিলে রাজপুত্ত্র ঘুমায় না। ক্রমে কাঞ্চনমালা যেমন তার শিয়রের বালিশের মত হইয়া বসিল। তখন ভাবিয়া চিন্তিয়া কুঞ্জমালা আর কিছুই স্থির করিতে পারে না। সে দেখল, কাঞ্চনমালা তার দাসী না হইয়া বরাবর[১২২] তার স্বামীর দাসী হইয়া পরিয়াছে। কাঞ্চনমালা কোথায়ও ঘুমাইলে রাজপুত্ত্র শিরে দাঁড়াইয়া তাকে বাতাস করে। আওঝায়[১২৩] থাকিয়া কাঞ্চনমালার রূপ দেখে। এই সব দেখিয়া রাজকন্যা কুঞ্জমালার চোখ টাটাইতে লাগ্‌ল। আর একদিন হইল কি, ফুলকুমার বনে শিকারে যাইবে, তখন সে কাঞ্চনমালার নিকট হইতে বিদায় লইল, কিন্তু কুঞ্জমালাকে কিছু বলিল না।

(১৭)

নিরালা ডাকিয়া তবে কুঞ্জমালা কয়।
শিকারেতে গেল প্রভু কি জানি কি হয়॥
আজি নিশি আমরা দু’জন যোড়মন্দির ঘরে।
আনন্দে কাটাইবাম নিশি পালঙ্ক উপরে॥

আস্‌মানে জ্বলে তারা রাইত্রি দুপুর হইল।
এন কালেতে কুঞ্জমালা ডাকিয়া কহিতে লাগিল॥
বনে ছিলা বনের কন্যা শুন দিয়া মন।
আচরিত কথা তব জন্ম বিবরণ॥
কেবা তোমার মাতা পিতা কেবা তোমার ভাই।
তোমার মত দুঃখিনী কন্যা ত্রিভূবনেতে নাই॥১০

পর্‌তি[১২৪] দিন ভাবি আমি করিব জিজ্ঞাসা।
পর্‌তি দিন পরভু[১২৫] মোরে কইরাছে নৈরাশা[১২৬]১২
আজ প্রভু গেছে বনে শিকারের লাগিয়া।
কও কও জন্ম কথা শুনি মন দিয়া॥১৪

সুবুদ্ধি আছিল কন্যার কুবুদ্ধি হইল।
পূর্ব্বাপর যত কথা কহিতে লাগিল॥১৬
ভরাই নগরের কথা পর্‌থমে তুলিয়া।
বাপের কথা কয় কন্যা কান্দিয়া কান্দিয়া॥১৮
আস্‌মানেতে দেওয়া ডাকে মেঘে জল ঝরে।
জন্ম কথা কইতে কন্যা কাঁদিয়া যে মরে॥২০
এক হাতে মুছে কন্যা নয়নের পানি।
মায়ের কথা কয় কন্যা দুষ্কের কাহিনী॥২২
সৈন্ন্যাসীর যতেক কথা এক দুই করি।
কুঞ্জমালার আগে কয় কান্দনা যে করি॥২৪
বাপের যত ইতিকথা কহিতে লাগিল।
অন্ধ ছাওয়াল স্বামীর কথা কহিতে লাগিল॥২৬
কন্যার চক্ষের জলে নদী নালা ভাসে।
কিরূপে আইল কন্যা দারুণ বনবাসে॥২৮
কাঠুরিয়ার কথা কন্যা কহিতে লাগিল।
যেইরূপে কাঠুরিয়া ভবনে আছিল॥৩০
দয়ার শরীর বড় কাঠুরি বাপ মায়।
কি মতে রাখিল বনে কইল সমুদায়॥৩২
মুখে নাহি সরে কথা আকুলা কান্দিয়া।
গিয়াছিল বনের মধ্যে কাষ্ঠের লাগিয়া॥৩৪
প্রভুরে না পাইল কন্যা গৃহেতে ফিরিয়া।
ছয় মাস দেশে দেশে ভরমণা করিয়া॥৩৬

দৈবের লিখনেতে আইলাম এই দেশ।
জন্মকথা এই কইয়া করিলাম শেষ॥৩৮

(১৮)

সরল মনেতে কইল গরল উঠিল।
কুঞ্জমালা এই কথা মায়ের আগে কইল॥
শোন গো দরদী মা দুষ্কিনীর কথা।
কালি নিশিতে মনে পাইলাম বড় ব্যথা॥
বুকেতে বিন্দিয়া শেল পৃষ্ঠেতে বাহির হইল।
এক এক করি মায়ে সকল কহিল॥
সতীন আইল ঘরে হইল সর্ব্বনাশ।
সাপের সঙ্গতি যেন হইল গিরবাস[১২৭]
যে নারীর সতীন ঘরে তার নাই সুখ।
বিধাতা লেইখ্যাছে তারে জন্মভরা দুখ॥১০
পালঙ্কে শুইলে যেন কাটা ফুটে গায়।
হাজার সুখে থাকলে তবু সুখ নাহি পায়॥১২
ঘরেতে আগুন লাগলে পুইরা করে ছাই।
সতীন থাকিলে ঘরে জন্মে সুখ নাই॥১৪
সতীনের দুখের কথা কইতে না যুয়ায়[১২৮]
একের সুখের কপাল আরে লইয়া যায়[১২৯]১৬

 তখন মায়ে ঝিয়ে যুক্তি কইরা কাঞ্চনমালাকে বনবাসে দিবার জন্য মন্ত্রণা করিতে লাগ্‌ল। কাঞ্চনমালার দুষ্কের কপাল। এর মধ্যে হইল কি,— কুঞ্জলতার বাপ, দেশের রাজা, মরিয়া গেল। তার কয়েকদিন পরে রাজার যে পাটহাতী[১৩০] সেও মরিয়া গেল। ফুলকুমার শিকার করিয়া দেশে আসিবার পূর্ব্বেই দেশ জুইড়া রটনা হইল যে ডাকুনি[১৩১] কন্যা দেশে আসিয়াছে। ফুলকুমার দেশে আসিয়া এই কথা শুনিল, কিন্তু বিশ্বাস করিল না। তখন রাণী লোকজনের লগে চক্রান্ত কইরা রাজার যে পাট ঘোড়া সেই ঘোড়াকে মারিয়া তাহার রক্ত কাঞ্চনমালার শোয়নের ঘরের দুয়ারে, তার বিছানায় ঢালিয়া রাখিল, এবং রাজপুত্ত্রকে দেখাইল। এদিকে দেশ জুইড়া লোকে বলাবলি করিতে লাগিল, চল আমরা দেশ ছাইড়া চইলা যাই। রাজা ডাকিনী কন্যা দেশে আনিয়া হাতী ঘোড়া খাওয়াইয়া ফেলিয়াছে। আর কিছুদিন থাকিলে আমাদেরও খাইয়া ফেলিবে। ফুলকুমার উপায় না দেখিয়া দুষ্কিণী কাঞ্চনমালাকে বনমধ্যে নির্ব্বাসন দিল।[১৩২]

(১৯)

কতেক সুখ কতেক দুখ কতক চাকামাকা।[১৩৩]
এই ছিল আস্‌মানে চান্নি এই সে মেঘে ঢাকা॥
মানুষের ভাগ্যে সুখ যেমন পদ্মপাতার জল।
এই আছে এই নাই করে টলমল॥
আজ যে রাজা দেখ সুখের সীমা নাই।
কাইল সে দারুণ পথে ঘাটে ভিক্ষা মাইগ্যা খাই॥
আইজ দেখ যার আছে লক্ষ টাকা কড়ি।
কাইল দেখ সেই জন পথের ভিখারী॥
আইজ যে ছিল ধনপতি শিরে ধরে ছাতি।
কাইল সে দেখ গাছতলাতে দুখে পোহায় রাতি॥১০
আইজে দেখ যেই জন সাতপুত্রের বাপ।
কাইল সে দেখ দুষ্‌মণ কপাল[১৩৪] তার দিল শাপ॥১২
আইজ যে ছিল যেই জন রাজার ঘরাণী[১৩৫]
কাইল তারে বিধাতা কৈল কাননবাসিনী॥১৪

সুখ লইয়া বড়াই করে লোকে দুখর পাছে আয়[১৩৬]
জোয়ার ভাটায় জল যেমন আসে আর যায়॥১৬

* * * * *

কোন পথে যাইবাম আমি গো বইলা দেওরে পথ।
দুষ্কের কপাল মোর দুষ্ক হইল যত॥১৮
বাপে খেদাড়িল মোরে আপনা ভাবিয়া[১৩৭]
অন্ধ ছাওয়াল স্বামীর সঙ্গে বিধি দিল বিয়া॥২০
আকালেতে মাও মইল নাইরে সোদর ভাই।
বনে বনে গেল দিন কান্দিয়া বেড়াই॥২২
রে আমার দুঃখের দিন॥
কপালে থাকিলে দুঃখ খণ্ডন না যায়।
পঞ্চমাসের গর্ভ সীতা বনবাসে যায়॥২৪
আমারে খাইয়া বনের বাঘ গায় কররে বল।
আমারে খাইয়া ভাল্লুক গায় কররে বল॥২৬
বনে থাক বনের সাপ কহিরে তোমারে।
দারুণ দংশন কইরা বাঁচাও[১৩৮] আমারে॥২৮
মরিলেও বাঁচি আমি বাঁচিলে যে মরি।
জন্মভরা দুষ্ক কত সইতে না পারি॥৩০
রে আমার দুঃখের কাহিনী॥
এইরূপে কান্দিয়া কন্যা বেড়ায় বনে বনে।
আর নাহি গেল কন্যা কাঠুরি ভবনে॥৩২
রাত্র যায় দিনরে আসে বাম হইয়াছে বিধি।
পাগল হইয়া ছুটে কন্যা যেমন শাঙন মাইসা নদী[১৩৯]৩৪

(২০)

 এইরূপে ছয়মাস বনে বনে ঘুইরা হঠাৎ কন্যার মনে পর্‌ল যে সেই সন্ন্যাসী বিপদকালে তারে মনে করতে কইছিল। আন্ধাইতে আন্ধাইতে[১৪০] ছয়মাস পর সেই দাড়াক[১৪১] গাছের নিচে কন্যা উপস্থিত হইল।

এক টুকি দুই টুকি তিন টুকি মাইল[১৪২]
বিরিক্ষ[১৪৩] হইতে সন্ন্যাসী বাহির হইল॥
নজর কইরা চায়।
অগ্নির সমান কন্যা সামনে দেখা যায়॥
সন্ন্যাসী দেখিয়া তবে চিনিয়া লইল।
পায়েতে ধরিয়া কন্যা কান্দিতে লাগিল॥
পূর্ব্বাপর যত কথা কহিল সকল।
সরল হইয়া কন্যা পাইল গরল[১৪৪]
মায়ে ঝিয়ে মিলিয়া করিল সর্ব্বনাশ।
কি মতে হইল কন্যার দারুণ বনবাস॥১০

 সন্ন্যাসী কন্যারে অভয় দিয়া কইল, যে তুমি আমার কাছে কিছুকাল থাক। সন্নাসীর কথামত কন্যা সেই গাছের খোড়লের[১৪৫] মধ্যে রইল। এক দিন দুই দিন কইরা তিন দিন যায়। কন্যা শুনে যে রাইতের নিশাকালে যেন লক্ষ লক্ষ লোক-লস্কর বনজঙ্গল কাইট্যা সাফ্ করিতেছে। একদিন রাইত নিশাকালে কন্যা গাছের খোড়ল হইতে বাইর হইয়া দেখল।

সোণার লাঙ্গল রূপার ফাল।
বাঘে ভইষে যোড়ছে হাল॥১২
লোক জনের সীমা সংখ্যা নাই।

জঙ্গল কাটিয়া তারা নগর কইরাছে সারা।
দালান কোঠার ইতি অন্ত নাই॥১৫

 নয় রাইত নয় দিন পরে সন্ন্যাসী কাঞ্চনমালাকে ডাকিয়া বাহিরে আনিল। কাঞ্চনমালা দেখিয়া অবাক্কি[১৪৬] লাগিল। ভরাই নগরে তার বাপের বাড়ীও অত বড় না। কুঞ্জমালার বাপের বাড়ীও অত বড় না। কত কত দেশে কুঞ্জমালার সোয়ামীর লাইগ্যা গেছে। অত বড় বাড়ী দেখে নাই।

সন্ন্যাসী ত দেশে বিদেশে করিল ঘোষণা।
নয়া[১৪৭] নগরে কন্যা সুবর্ণ পরতিমা[১৪৮]১৭
যোগ্য দিনে এই কন্যা হবে স্বয়ংবরা।
সাত রাজ্যেতে তবে পড়ল ঢোল কাড়া॥১৯
সাত রাজ্যের রাজপুত্ত্র শুনিয়া আইল।
হার মানিয়া সবে নিজ দেশে গেল॥২০

(২১)

 রাজকন্যার এক পণ আছে। সে একটা গান জানে; সেই গানের অর্দ্ধেক সে গায়। বাকী অর্দ্ধেক যে পূর্ণ করিয়া দিতে পার্‌বে কাঞ্চনমালা তাহাকেই বিবাহ করিবে। সাত রাজ্যের রাজপুত্ত্র‌ ফিরিয়া গেল।

অন্ধ এক ভিক্ষুক আইয়া দাড়াইল দ্বারে।
লড়িত ভর দিয়া যায় চলিতে না পারে॥
ভিক্ষা দেও গো কাঙ্গালেরে নওয়া[১৪৯] দেশের রাণী।
বড় ডাক শুইন্যা[১৫০] এই দেশে আইলাম আমি॥
কাঞ্চনমালা নজর কইরা চায়।
অগ্নির সমান রূপ সাম্‌নে দেখা যায়॥
সোণার থালায় কন্যা ভিক্ষা যে লইয়া।
ভিক্ষাসুরে দিতে আইল ধাইয়া॥

লাম্বা দাড়ি লাম্বা চুল চিনন না যায়।
কোন দেশেত[১৫১] আইল ভিক্ষাসুর কোন দেশে বা যায়॥১০
ভিক্ষাসুর কয় কন্যা শুনিলাম বিশেষে।
ঢোলের ঘোষণা শুইন্যা আইলাম এই দেশে॥১২
ভিক্ষা না লইব কন্যা আগে কও শুনি।
শুনিতে তোমার গান আইলাম আমি॥১৪
শুন বলি সুন্দর কন্যা শুন বলি রইয়া।
পণে যদি জিনি মোরে করবা কিনা বিয়া॥১৬

পরতিজ্ঞা রাখিতে কন্যা গান যে গাইল।
আপনার জন্মকথা সকল কহিল॥১৮
বাপের বাড়ীর কথা সব কয় আনাগুনি[১৫২]
কিরূপে পাইল কন্যা অন্ধ ছাওয়াল স্বামী॥২০
সন্ন্যাসীর কথা কয় দুঃখ বনবাস।
কাঠুরিয়ার ভবনে যে কন্যা করে বাস॥২২
এত দুঃখ দিল কন্যা নির্বন্ধের কাল।
জন্মভরা দুঃখ পাইল দুঃখের কপাল॥২৪

নিজ কথা কয় কন্যা কিচ্ছার আকারে[১৫৩]
অন্ধ স্বামী ছাইড়া গেল যেমন প্রকারে॥২৬
তারপর দেশে দেশে কইরাত ভরমণ।
কিরূপে স্বামীর সঙ্গে হইল মিলন॥২৮
কেমনে রাজার কন্যা হইল পরের দাসী।
মায়ে ঝিয়ে ডাকুনীরে করল বনবাসী॥[১৫৪]৩০

তাহার পর কি হইল কন্যা নাহি জানে।
সেই কথা যেই জন শুনাইবে গানে॥৩২
তাহারে সুন্দর কন্যা করিবেক বিয়া।
ভিক্ষাসুর কহে আমি যাই সে গাহিয়া॥৩৪

(২২)

(অন্ধ ভিক্ষুকের গান

“বনে দিয়া বনের রাণী রাজা হইল পাগল।
অন্ন নাহি খায় রাজা নাহি ছয়[১৫৫] জল॥
পইরা রইল কুঞ্জমালা খাট আর পালং।
পইরা রইল রাজার রাজ্য রাজসিংহাসন॥
পইরা রইল লোক লস্কর শীতল মন্দির ঘর।[১৫৬]
কাঞ্চনমালার লাইগ্যা রাজা ছাড়িল নগর॥
কান্দিতে কান্দিতে রাজার অন্ধ হইল আখি।
রাজার কান্দনে কান্দে বনের পশুপাখী॥
এইমত কাইন্দ্যা রাজা বনেতে বেড়ায়।
আছে কি মইর‍্যাছে রাজা কহন না যায়॥১০

(২৩)

 এই ভিক্ষাসুরই ফুলকুমার। দুইজনেরই চেনাজানা হইল। কাঞ্চনমালা অন্ধ সোয়ামীর পদসেবা করতে লাগল।

পাণিতে ধোয়াইয়া পাও কেশেতে মুছায়।
এইরূপে কাঞ্চনমালার দুঃখের দিন যায়॥

 এই দিকে ছয় মাস ধরিয়া সন্ন্যাসীর সঙ্গে কাঞ্চনমালার আর দেখা নাই। ছয় মাস পরে যখন সন্ন্যাসী ফিরিয়া আইল, তখন কাঞ্চনমালা তার দুঃখের সকল কথা সন্ন্যাসীরে খুলিয়া বলিল।

পইরাছিলাম[১৫৭] ঘোর বিপদে রাখছিলা কুলমান।
পায়ে ধইরা মাগে কন্যা অন্ধের নয়ন দান॥
একবার কইরাছ ভালা নয়ন দান দিয়া।
সৈন্ন্যাসীর পায়ে কন্যা ধরয়ে কান্দিয়া॥
স্বামী সে স্ত্রীলোকের,গতি স্বামী ভিন্ন নাই।
স্বামী সুখ বিনা অন্য সুখ নাহি সে চাই॥
স্বামী সে পরমগুরু স্বামী কুলমান।
স্বামীরে বাঁচাও আগে দিয়া নয়নদান॥১০
রাজ্য না চাই ধন না চাই হইয়া তাঁর দাসী।
সোয়ামী লইয়া আরবার হই বনবাসী॥১২

 তখন সৈন্ন্যাসী কইল যে, একবার তোমার স্বামীরে নয়ন দান দিয়াছি। আরবার কেন? তখন কন্যা কান্দিয়া কইল যে তুমি বলিয়াছিলে, আবার যখন বিপদে পড়, তখন আমার স্মরণ লইও।

ইহার চেয়ে কিবা বিপদ আছয়ে সংসারে।
ইয়ার[১৫৮] চেয়ে নারী-লোকের[১৫৯] কি বিপদ হইতে পারে॥১৪
ধন রাজ্য নাহি চাই করহ আছান[১৬০]
আমায় অন্ধ কইরা কর স্বামীর নয়ন দান॥১৬

(২৪)

পরতিজ্ঞা কর্‌ল কন্যা এই শেষ কথা।
আমার কথা ধর কন্যা কইবাম যেই কথা॥
এই রাজ্য ছাইরা যাইবা বুকে দিয়া হাত।
এই দেশ ছাইরা তুমি যাইবা আইজ রাত॥
জন্মের মত ছাইরা যদি স্বামীরে তোমার
তবে ত হইবে কন্যা স্বামীর উদ্ধার॥

তবেত তোমার স্বামী পাইবে চক্ষুদান।
তবেত হইবে তার বিপদে আছান॥
মনে না ভাবিয়া দুঃখ সুখে যাইবা ছাড়ি।
অন্ধ স্বামীরে তবে চক্ষু দিতে পারি॥১০
রাজার ঝিয়ারিয়ে[১৬১] কাইন্দ্যা বেড়ায় বনে।
সোয়ামী হারাইয়া সেই ছাইড়াছে ভবনে॥১২
এই রাজ্য রাজপাট ধনের বাতান[১৬২]
সোয়ামীর সহিত এই কন্যারে কর দান॥১৪

এই কথা কাঞ্চনমালা যখন শুনিল।
হাহাকার কইরা কন্যা কান্দিতে লাগিল॥১৬
বাড়ীর শোভা বাগবাগিচা ঘরের শোভা বেড়া।
কোলের শোভা পুত্ত্র ছাওয়াল আসমানে চান্[১৬৩] তারা॥১৮
জলের শোভা পদ্মলতা স্থলের শোভা ফুলে।
দিনের শোভা সুরুজ[১৬৪] যখন উঠে ভোরের কালে॥২০
রাজ্যের শোভা রাজা দেখ ভাণ্ডারের শোভা ধন।
শিরসের[১৬৫]শোভা মুকুটমণি কয় যে সর্ব্বজন॥২২
অন্ধকারে পরদিম[১৬৬] শোভা সাপের শোভা মণি।
সতী নারীর পতি শোভা আর কিছু না জানি॥২৪
ঘুর পাকে[১৬৭] পরিয়া নাও না থাক্‌লে কাণ্ডারী।
ধন জন সহিত যেমন ডোবে সেই তরী॥২৬

সময় কালে দেয় বিয়া মাও আর বাপে।
যে নারীর পুরুষ নাই কি করব তার রূপে॥২৮
পুরুষ ছাড়া হইলে নারী কে রাখে কুলমান।
বাঁচা মরা এ সংসার তার দুই-ই সমান॥৩০

এতেক বলিয়া কন্যা কান্দিতে লাগিল।
কান্দিয়া চক্ষের জল মুছিয়া লইল[১৬৮]৩২
স্বামীর সুখের নাইগ্যা আমি যাইবাম ছাড়িয়া।
সোয়ামীরে কর সুখী নয়ন দান দিয়া॥৩৪

(২৫)

 তখন সন্ন্যাসী কাঞ্চনমালাকে লইয়া আর একটা দাড়াক বৃক্ষের মূলে গেল। সেইখানে গিয়া সেই বৃক্ষের মূলে তিন টুকী মারিল। তখন সেই বৃক্ষ হইতে এক কন্যা বাহির হইয়া আসিল। কাঞ্চনমালা দেখ্‌ল যে, সে তার সতীন কুঞ্জমালা। সন্ন্যাসী কাঞ্চনমালার হাতে এক ফল দিয়া কইল যে, এই ফল খাইলে তোমার স্বামীর চক্ষু ভালা হইবে। এই ফল তুমি কুঞ্জমালাকে দান কর।

এই ফল সুধা নহে[১৬৯] কন্যা শুন মোর কথা।
আমার কথা শুইন্যা মনে না ভাবিও ব্যথা॥
ফলের সহিত কর সোয়ামীরে দান।
মনে না ভাবিও দুঃখ কাতর না হও প্রাণ॥
মনে দুঃখ লইয়া যদি দান কর শেষে।
অন্ধ না পাইবে চক্ষু কহিলাম বিশেষে॥

তখন কাঞ্চনমালা কোন কাম করে।
নিজের সুখ দুঃখের কথা পাসরণ করে॥

দুঃখ নাই সুখ নাই অন্তর হইল খালি।
স্বামীর লাগিয়া কন্যা না হইল শোকালি[১৭০]১০
ফলের সহিত কন্যা পুনঃ কাম করে।
রাজ্যসহ সোয়ামীরে সমর্পণ করে॥১২
চক্ষে নাই যে জল কন্যার বুকে নাই দুখ।
স্বামী এড়ি যায় কন্যা মনে নাই শোক॥১৪
কি জানি কান্দিলে পাছে স্বামী না হয় ভাল।
মনের যত শোক দুঃখ মুছিয়া ফেলিল॥১৬
এ বড় কঠিন পণ নারী হইয়া জিনে।
না জিনিব হেন পণ পুরুষ পরবিনে[১৭১]১৮


পরবর্ত্তী সংগ্রহ

 তখন সন্ন্যাসী কাঞ্চনমালাকে কইল, তুমি তোমার বাপের দেশে যাও। তোমার বাপ তোমাকে যে বিমাতার চক্রান্তে বনবাস দিয়াছে,[১৭২] সে মানুষ নয়। সে একটা মায়া রাক্ষসী। তুমি এই মায়াকাটি লইয়া তোমার মায়ের দেশে যাও। সে দেশের অনেক মানুষকে সেই রাক্ষসী ধরিয়া খাইয়াছে। তুমি মায়াকাটি লইয়া সেই দেশে গেলে মায়ারাক্ষসী পলাইয়া যাইবে এবং তোমার বাপ মুক্তি পাইবে। তখন কাঞ্চনমালা ভরাই নগরে গিয়া রাক্ষসের হাত থাক্যা তার বাপেরে মুক্ত কর্‌ল। কিছুকাল ধইরা কাঞ্চনমালা ভরাই নগরে আছে। পাত্রমিত্র সকলে কাঞ্চনমালার বিয়ার কথা রাজার কাছে তুল্‌ল। কিন্তু কাঞ্চনমালার বিবাহ লইয়া গণ্ডগোল উপস্থিত হইল। দেশ ছাড়িয়া এতদিন কাঞ্চনমালা কোথায় ছিল।

পাত্রমিত্র কয় রাজা, রাজা আরে কহি তোমারে।
চাইর বচ্ছরের শিশু লইয়া কন্যা গেল বনান্তরে॥
কইবা ছিল কন্যা তোমার কই বনে আইল।
সঙ্গে ছিল ছাওয়াল স্বামী সেই বা কই গেল॥
পুরুষ ছাড়া নারী হইল তার যে নাই গতি।
····থাক্যা না লোকে বলেক অসতী॥
রাজ্যের দুষ্‌মণ রাজা হায়রে রাজা তোমারে কইব বুরা।
সভার মধ্যে অপমান বাঁচ্যা থাক্যা মরা॥
রাজা আরে কই যে তোমারে।
ঘর হইতে বাহির হইয়া নারী যদি যায় বাহিরে॥১০
তা হইলে সে নারীর মন ঘরে নাই সে রয়।
যেমন বাহির হইলে হাতির দাঁত সম্বুরা না যায়[১৭৩]১২

* * * * *

* * * * *

 এবং সকলে মিলিয়া কাঞ্চনমালার পরীক্ষার আয়োজন করিল। পরীক্ষা এই হইল যে একটা মাকড়সার সুতা ধরিয়া কাঞ্চননালা শূন্যে ঝুলিয়া থাকিবে। তা হইলে সে সতী বলিয়া লোকে জানিবে। সাত রাজ্যের রাজারা নিমন্ত্রিত হইয়া আসিল। নয়ানগর হইতে কুঞ্জমালা আর তার স্বামী আইল।

বিদায় দেও, বাপ ওগো কহি যে তোমারে।
জন্মের মত বিদায় দাও দুষ্কিণী কন্যারে॥১৪
বিদায় দেও পাত্র মিত্র রাজ্যের বান্ধব ভাই।
আজি হইতে জান্যো আর কাঞ্চনমালা নাই॥১৬
রাত্রদিবা কালের সাক্ষী সুরুজ আর চান্দ্।
পাপপুণ্য নাই যে জানি না জানি ভালমন্দ॥[১৭৪]১৮
বিদায় দেও কুঞ্জমালা সাতজন্মের ভইনি[১৭৫]
তোমার কাছে রাইখ্যা গেলাম প্রাণের সোয়ামী॥২০
বিদায় কর প্রাণপতি বিদায় কর মোরে।
কুঞ্জমালা লইয়া তুমি যাও নিজের দেশে॥২২
আমার লাগিয়া তুমি মনে না ভাবিও তাপ।
কুড়ি বচ্ছর পূণ্ণ[১৭৬] হইল খণ্ডিল মোর শাপ॥২৪
তোমার চরণে মোর শতেক পণ্ণামী[১৭৭]
কুঞ্জমালা রইল কাছে বিদায় হইলাম আমি॥২৬
সাত রাজ্যের রাজার কাছে মেলানি মাগিয়া।
ধীরে ধীরে উঠে কন্যা মাকড়সা ধরিয়া॥২৮
কাঞ্চনমালা কন্যায় কেও না দেখিল আর।
বাতি নিবাইলে যেমন ঘর অন্ধকার॥৩০
ভরাই নগরের লোক কান্দিতে লাগিল।
দেববংশী কাঞ্চনমালা দেবপুরে গেল॥৩২


  1. থইয়া রইয়া=থুইয়া রহিয়া অর্থাৎ অনেক বাদ সাদ দিয়া এবং ত্রুটী স্বীকার করিয়া।
  2. উস্তাদের=ওস্তাদের, গুরুর।
  3. রায়=রাজা।
  4. বার দিয়া=দরবার করিয়া কৃত্তিবাস প্রভৃতি কবিরা “বার দিয়া” কথাটি অনেক স্থলে ব্যবহার করিয়াছেন।
  5. বাজুইয়া=বাদ্যকর।
  6. সরাতি=সরাতে, সরার উপর। কাঁচা সরা পদাঙ্গুলি মাত্রে স্পর্শ করিয়া নৃত্য করিতে হইত।
  7. না=‘না’ শব্দ এখানে নিষেধার্থক নহে। শব্দটি নিরর্থক, শুধু জোর দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত, অব্যয়।
  8. আন্দা=অন্ধ।
  9. আরাক বার=পুনরায়।
  10. জাওহর=জহরৎ। জর=জ্বরের মত ক্লেশদায়ক।
  11. নাম কিবা তার=সে নদীর নাম দিয়া আর কি হইবে?
  12. চেরাগ=আলো।
  13. শুধু=শুধু, কেবল।
  14. না জিগায়=জিজ্ঞাসা করে না।
  15. আন্ধাইর=অন্ধকার।
  16. খেজালত=কষ্ট
  17. আচরিত=আশ্চর্য্য, অপূর্ব্ব।
  18. গুণেক=গুণেতে।
  19. ভারাও=ছল করিয়া দেরি কর।
  20. বেহুতি=বৃথা, অকারণে।
  21. পাখাল=প্রক্ষালন।
  22. ময়ালে=মহালে।
  23. পঞ্চামিত্তি=পঞ্চামৃত উৎসব।
  24. দেবাংশী=দেবতার অংশ যাহাতে আছে, অর্থাৎ দেবতার মত সৌন্দর্য্য-বিশিষ্টা।
  25. ঘনই.....মাখি=যেন ঘন সিন্দুরের প্রলেপ দিয়া দুই ঠোঁট মাখিয়া রাখিল। অর্থাৎ অধর খুব রক্তবর্ণ হইল।
  26. আসমানে.....চায়, দৈব দুর্ব্বিপাকে আকাশের তারা মাটীতে পড়িয়া যায়, সেইরূপ দুর্ভাগ্য ব্যক্তির প্রতি ভগবানের দয়া হয় না। খুব ভাল ঘরে জন্মিলে ও অদৃষ্ট দোষে সে কষ্ট পায়।
  27. আইখট=উৎকট সঙ্কল্প বা প্রতিজ্ঞা।
  28. দেখিবাম=দেখিব।
  29. লড়িত=লড়িতে।
  30. কোঙর=কুমার, সন্তান।
  31. ভিক্ষাসুর=ভিক্ষুক।
  32. খাকী=লোভী।
  33. আতুর দশা=সূতিকা রোগ।
  34. বরামণি=ব্রাহ্মণী।
  35. জলন্ত আগুনি=জ্বলন্ত অগ্নির ন্যায় উজ্জ্বল বা সুন্দর।
  36. খারাইছে=দাঁড়াইয়াছে। কন্যার এই কথা শুনিয়া সাধু খুব কান্‌তে লাগ্‌ল।
  37. মেঘের জল পাইয়া যেরূপ নদী নালা কুল ছাপাইয়া উঠে, তদ্রূপ তোমার কান্না দেখিয়া আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গিয়া যাইতেছে।
  38. এই শিশু জন্মান্ধ, সুতরাং চন্দ্র সূর্য্যের মুখ দেখিতে পায় নাই।
  39. অন্ধের রাত্রি কখনও প্রভাত হয় না।
    কাঞ্চনমালার উক্তি হইতে বোঝা যাইতেছে প্রথম দর্শন মাত্রই অন্ধ বালকের প্রতি তাহার হৃদয়ে অপার করুণা জাগিয়া উঠিয়াছে—এই করুণা অনুরাগের অগ্রদূত। এত ছোট শিশুর প্রতি যে স্নেহ হইতে পারে—তাহাই কবি স্বাভাবিক ভাবে বর্ণন করিয়াছেন। কিন্তু অঙ্কুরে
    যেরূপ বৃক্ষ লুক্কায়িত থাকে—এই স্নেহ তদ্রূপ পরবর্ত্তী ভালবাসার আভাস দিতেছে।
  40. এন=হেন।
  41. তোমার মাতা জীবিতা থাকিলে আজ তোমার দুর্ভাগ্য দেখিয়া পাথরেয় উপরে মাথা আছড়াইয়া ভাঙ্গিতেন।
  42. সায়রে=সাগরে।
  43. শেল বুকে বিধিঁয়া পৃষ্ঠ বিদীর্ণ করিয়া বাহির হইল।
  44. রইয়া=রহিয়া রহিয়া।
  45. বইয়া=বসিয়া।
  46. দরদী......মেওয়া=পৃথিবীর মধ্যে স্নেহশীলা (দরদী) মাতা অতি বড় মিষ্ট দ্রব্যের মত।
  47. কোল=ময়মনসিংহবাসীরা ‘কোল’, শব্দকে “কুল” উচ্চারণ করেন এবং সেইরূপ উচ্চারণ করিলে ‘চুল’ শব্দের সঙ্গে মিল ভাল হয়।
  48. রাও=রব, কণ্ঠস্বর।
  49. বাও=পবন দেবের প্রদত্ত হাওয়া। মাতার কণ্ঠস্বর ও মৃদু শীতল পবন উভয়ই প্রাণ জুড়াইয়া দেয়।
  50. জালুনি=জ্বলন্ত।
  51. বোড়া=বিরুদ্ধ।
  52. উদাসী=উদাসিনী, সংসার বিরাগিনী।
  53. অজ্ঞাত পথ দূর দূরান্তরে অন্ধকারে মিশিয়া যাইতেছে।
  54. সারাদিন পথ ভাঙ্গিয়াও সন্ধ্যা শেষ হইতেছে না অর্থাৎ সর্ব্বদাই সেই গভীর অরণ্যে সন্ধ্যার ন্যায় অন্ধকার বিরাজ করিতেছে।
  55. দুই চির=দুই খণ্ড।
  56. রাইত ভিতে=এই রাত্রির ভিতরে।
  57. কোড়ালে=কোটরে।
  58. আগবাড়ান্তে=অগ্রসর হইয়া। একটু এগিয়ে গেলে যে সকল কাঠুরিয়া দেখিতে পাইবে।
  59. এখানে থাকিলে শিশু এরূপ বাড়িয়া উঠিবে যে ছয় মাসে স্বভাবতঃ যতটা বাড়ে, একদিন তাহাই হইবে।
  60. তেরালেখা=বিকলাঙ্গ; এই শব্দটি ময়নামতীয় গানে আছে।
  61. মইলানের কাটি=অতি রোগা—একটা কাটির মত।
  62. বিকাইয়া=বেচিয়া।
  63. টুটির=ছিন্ন বস্ত্রের।
  64. “লোক” ময়মনসিংবাসীদের মুখে “লুক” উচ্চারিত হয়, এবং তাহা হইলে “সুখ” কথার সঙ্গে নির্দ্ধোষ মিল হয়।
  65. ছোরত=শ্রী
  66. কুলের=কোলের
  67. এড়িল=ত্যাগ করিল।
  68. দরদিয়া=স্নেহশীল, সহানুভূতি-পরায়ন।
  69. সোতের সেওলা=স্রোতের শৈবাল, এই কথাটি পুরাতন সাহিত্যে অনেক স্থলেই পাওয়া যায় মথা “কোন বিধি সিরজিল সোতের শেওলী, এমন ব্যথিত নাই ডাকি বঁধু বলি।” চণ্ডীদাস
  70. কপালের......বনবাসী=কাঞ্চন কাহাকের দোষী করিল না,—এই চিত্ত-সংযম ও ক্ষমাগুণ তাহার চরিত্রের বিশেষত্ব।
  71. লগে=সঙ্গে।
  72. পসয়=আলোক্তি, প্রকাশিত।
  73. ভুঁয়েতে=ভূমিতে।
  74. একগুণ দ্রব্য চারগুণ লাভে বিক্রয় করে।
  75. নিয্যাস=নিশ্চয়।
  76. আমরারে=আমদিগকে।
  77. কুলের=কোলের।
  78. দেবংশী=দেবতার অংশ যাহাতে আছে অর্থাৎ দেবতেজ বিশিষ্ট।
  79. বাইর=বাড়ণ বৃদ্ধি।
  80. দেওত=দেয় তো।
  81. খুষে=খুসীর সহিত অর্থাৎ স্বেচ্ছায়।
  82. সরইরী=শরারী, শরালি, পক্ষী-বিশেষ।
  83. বনেলা=বনের।
  84. অভাগিণী...... পাইয়া=কাঞ্চন তার শিশুস্বামীকে না পাইয়া কাঁদিতে লাগিল।
  85. অধবা=স্বামীছাড়া; স্বামি-বর্জ্জিতা।
  86. আউজায়=আড়ালে।
  87. গইন=গহন, গভীর।
  88. উইড়া ঝুইড়া=উড়িয়া ঝুরিয়া।
  89. কাঞ্চনের এই বিলাপটি খুব শোভন হয় নাই। ইহা স্বামী ভক্তির একটা নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক উপদেশের মত শুনায়। এরূপ শিশু স্বামীর উপর কুলমান রাখার দায়িত্ব আরোপ করিয়া এবম্বিধ শোক প্রকাশ নিতান্ত অস্বাবিক। ইহা মূল গল্প লেখকের রচনা বলিয়া মনে হয় না, পরবর্ত্তী কোন গায়েন এই উপলক্ষে সতীত্ব ধর্ম্মের পণ্ডিতোচিত নীতিমূলক বাজে একটি বক্তৃতা জুড়িয়া দিয়া তাহার শাস্ত্রজ্ঞান দেখাইয়া লইয়াছে।
  90. বিচরায়=অনুসন্ধান করে।
  91. জিগার পাহাড়=জইন্তা পাহাড়, মৈয়মনসিংহের উত্তরে—তথায় জিগাতলা নামক গ্রাম এখনও আছে।
  92. উল্‌মাদিনী=উন্মাদিনী।
  93. গাঢ়ো খুকী=গারো এবং কুকী (প্রসিদ্ধ পার্ব্বত্য জাতিদ্বয়)।
  94. খুলায়=খোলায়। বালু যেন খোলাতে ভাজিয়া সেই পথে কেহ ছড়াইয়া রাখিয়াছে।
  95. সুমাই=সুহ্মদেশ, সুর্‌মা উপত্যকার নিকট।
  96. ঢুলুয়া=যে ঢোল বাজায়।
  97. যে সকল কথা তোমাদিগকে বলিয়াছি ও যাহা বলি নাই, সে সমস্ত কথা আজ আর তুলিব না। পরের এক ছত্রেও এই ভাবটি আছে—

    “বনের কথা মনের কথা সব রইল পড়ি”।


    ইহার পূর্ব্বে একস্থানে আছে যে কাঞ্চনমালা একাকী বনে বনে ঘুরিতেছে অথচ এখানে দেখা যায় তার কাঠুরিয়া মা বাপ তার সঙ্গে সঙ্গে ছিল। এই সকল অসঙ্গতি গায়েনদের প্রক্ষিপ্ত ও বিকৃত রচনার দরুণ ঘটিয়াছে।

  98. পাসুরছিলাম=পাশরিয়া ছিলাম, ভুলিয়াছিলাম।
  99. থাপাইয়া=থাপড়াইয়া।
  100. অপুত্ত্ররার=অপুত্ত্রকের।
  101. নদীর জল শীতল ও ‘দাড়াক’ বৃক্ষের ছায়া শীতল, তোমার স্নেহও সেইরূপ।
  102. কুঞ্জমালার—পায়=কুঞ্জমালার রূপ যেমন এই কন্যার রূপও তেমনই বলিয়া তাহারা মনে করিল।
  103. লস্করেরা.....দিয়া=লস্করেরা বিক্রয়কারীকে খোঁজ করিয়া বাহির করিয়া তাহাকে (কাঠুরিয়াকে) লক্ষ মুদ্রা দিয়া তুষ্ট করিল।
  104. রূপ-কথার রাজ্যে ‘লক্ষ’ কথাটা খুব সুলভ।
  105. কোমার=কুমার।
  106. কৈতর কৈতরী=কপোত ও কপোতী।
  107. C.F “কপোত কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষশাখে বাঁধি নীর থাকে সুখে।
  108. কোমার=কুমার।
  109. লোকায়=লুকায়, স্পষ্টই কাঞ্চনমালার কথা ফুলকুমার গোপন করিতে চেষ্টা করিতেছিলেন। এক কথা বলিতে যাইয়া কুমার অন্য কথা লুকাইতেছিলেন, তাহা কুঞ্জলতা ধরিয়া ফেলিয়া স্বামীর পদে এই নিবেদন করিলেন।
  110. আমারে না...দাসী=আমার কাছে কোন কথা লুকিও না, আমি তোমার দাসী।
  111. সাই=সখী (সই)
  112. কুলে কইরা=কোলে করিয়া।
  113. ভরমণা=ভ্রমণ।
  114. দাওনা=পাগল।
  115. অতি অল্প কথায় কাঞ্চনমালার যে সকল ছোট খাট চিত্র দেওয়া হইয়াছে—তাহা বালক বয়সের অর্দ্ধ-স্মৃতি জড়িত হইয়া কুমারের বর্ণনায় বড় মধুর হইয়া উঠিয়াছে। সে বন-লক্ষী আমার বনবাস কালে জননী-কল্পা হইয়া আমাকে লালন করিয়াছিলেন। মনে হইতেছে কাঠের বোঝা মাথায় করিয়া ঘর্ম্মসিক্ত দেহে তিনি আমার জন্য বন্যফল সংগ্রহ করিয়া কত আদরে খাওয়াইতেন, কতবার বন-পথে তিনি আমাকে কোলে করিয়া ভ্রমণ করিয়াছেন এবং একদণ্ড আমাকে না দেখিলে ক্ষিপ্তের মত হইয়া যাইতেন, তাঁহার নিকট হইতে তোমার পিতা আমাকে কাড়িয়া মানিয়াছেন। না জানি আমাকে হারাইয়া তিনি যেন কেমন আছেন।
  116. তাঁরা=চোখের তারা।
  117. এরকম=ছবিটি দেখাইয়া কুঞ্জলতা তদ্রূপ সুন্দরী চাহিতেছেন।
  118. বেগান=পর, অনাত্মীয়।
  119. ভেওলী=অনাথা নারী (?)।
  120. রাজকন্যার মনের ভাব এই সকল বর্ণনায় খুব নৈপুণ্যেরসহিত চিত্রিত হইয়াছে। কাঞ্চনমালার আগমনের পর হইতে কুমারের যে ভাবান্তর হইতে লাগিল, কুঞ্জমালা ব্যথিত চিত্তে তাহা লক্ষ্য করিতে লাগিল। মনে পড়িতে লাগিল—যে দিন তাঁহার সঙ্গে কুমারের বিবাহ হইয়াছিল এখন আর সে দিন নাই; আগে তো শয্যার পার্শ্বে গেলে কত হাসি কত আনন্দের সঙ্গে কুমার তাঁহাকে আদর করিতেন, আজ যেন পুর্ণিমার চন্দ্রকে অভ্রে ঘিরিয়াছে, সে রূপ আনন্দ তো আর নাই। জোর করিয়া তিনি যে হাসি অধরে আনিতে চেষ্টা করেন, তাহা দেখিতে না দেখিতে মিলাইয়া যায়। এই সে দিন মাত্র যে সুখের কলিকা ফুটিয়া উঠিয়াছে, আজই তাহা ঝরা ফুল হইয়া গেল।
  121. মনে...বান্ধন=মনে মনে উভয়ে উভয়ের নিকট বাঁধা পড়িল।
  122. বরাবর=সোজাসুজি।
  123. আওঝায়=আড়ালে।
  124. পর্‌তি=প্রতি।
  125. পরভু=প্রভু, স্বামী।
  126. নৈরাশা=নিষেধ।
  127. সাপের সঙ্গে একত্র যেন গৃহবাস করিতে হইল।
  128. যুয়ায়=যোগ্য হয়, কহিবার যোগ্য নয়, কিম্বা কথা আইসে (যোয়াব) না।
  129. একজনের সৌভাগ্য অপরের আয়ত্ত হয়।
  130. পাটহাতী=রাজহাতী; যে হাতীর হাওদার উপর রাজসিংহাসন স্থাপিত হয়।
  131. ডাকুনি=ডাকিনী, ডাইনী।
  132. পূর্ব্বাপর হইতে, সেই রামরাজার আমল হইতে, পুরুষ-চরিত্রগুলির এই দুর্ব্বলতা চলিয়া আসিয়াছে।
  133. চাকামাকা=সুখদুঃখের সংমিশ্রন?
  134. দুষমণ কপাল=কপাল শত্রু হইয়া (তাহাকে অভিশপ্ত করিল)।
  135. ঘরাণী=ঘরণী, গৃহিণী।
  136. আয়=আইসে।
  137. আপনা ভাবিয়া=নিজের স্বার্থ চিন্তা করিয়া।
  138. বাঁচাও=আমাকে দুঃখের যন্ত্রণা হইতে নিষ্কৃতি দাও।
  139. শ্রাবণ মাসের নদীর ন্যায় কন্য। পাগল হইয়া ছুটিল।
  140. আন্ধাইতে আন্ধাইতে=সন্ধান করিতে করিতে (?)
  141. দাড়াক—সম্ভবতঃ পার্শী نرخہمٹا দারাখ্‌ৎ (=বৃক্ষ) শব্দের অপভ্রংশ। এই শব্দের সঙ্গে সংস্কৃত “দারু” শব্দের হয়ত সম্পর্ক থাকিতে পারে।
  142. মাইল=মারিল।
  143. বিরিক্ষ=বৃক্ষ।
  144. সরল এবং নিরসন্দিগ্ধচিত্তে কুঞ্জমালার নিকট আত্মকাহিনী বলার ফলে গরল উৎপন্ন হইয়াছে।
  145. খোড়ল=কোটর।
  146. অবাক্কি=অবাক্, আশ্চর্য্য।
  147. নয়া=নূতন।
  148. পরতিমা=প্রতিমা।
  149. নওয়া=নূতন।
  150. বড় ডাক শুইন্যা=বড় নামডাক শুনিয়া; প্রতিপত্তির কথা শুনিয়া।
  151. দেশেত=দেশ হইতে। (দেশাৎ)
  152. অন্ধ...আনাগুনি=তার অন্ধ শিশু স্বামীর কথা এবং বাপের বাড়ীর কথা প্রভৃতি সমস্ত আগাগোড়া (আনাগুনি) সে বলিয়া ফেলিল।
  153. কিচ্ছার আকারে=গল্পের মতন করিয়া।
  154. মায়েঝিয়ে...বনবাসী=কুঞ্জমালা এবং তার মাতা পরমার্শ করিয়া কি ভাবে তাহাকে ডাইনী বলিয়া বনবাসে পাঠাইয়াছে।
  155. ছয়=ছোয়, স্পর্শ করে।
  156. শীতল মন্দির ঘর, C.F— “কার লাগিয়া বান্ধিলাম শীতল মন্দির ঘর”
    ময়নামতীর গান।
  157. পইরাছিলাম=পড়িয়াছিলাম।
  158. ইয়ার=ইহার।
  159. নারী লোকের=স্ত্রীলোকের।
  160. আছান=আসান্, মুক্তি। দুঃখ হইতে পরিত্রাণ কর।
  161. ঝিয়ারিয়ে=কুন্যা, প্রথমাবিভক্তিতে এই “এ” কার এখনও পূর্ব্ববঙ্গের কথায় চলিত আছে যথা “বাঘে খাইয়াছে, রামে ডাকিয়াছে।”
  162. বাতান=ভাণ্ডার।
  163. চান্=চান্দ, চন্দ্র।
  164. সুরুজ=সূর্য্য।
  165. শিরসের=শীর্ষের, মস্তকের।
  166. পরদিম=প্রদীপ।
  167. ঘুরপাকে=ঘূর্ণীপাকে।
  168. এই যে চক্ষের জল সে মুছিয়া লইল, তাহা আর ফেলিল না। স্বামীর ইষ্টের নিমিত্ত সে আত্ম বলিদান দিতে প্রস্তুত হইল।
  169. সুধা নহে=শুধু এই ফলটি নহে। ইহার সঙ্গে স্বামীকেও দিতে হইবে।
  170. শোকালী=শোকার্ত্তা।
  171. এ বড়...পরবিনে=স্ত্রীলোক হইয়া ও কাঞ্চন এই মহাত্যাগের পণ পালন করিতে পারিয়াছিল, প্রবীন পুরুষেরা এইরূপ পরীক্ষা উত্তীর্ণ হইতে পারিতেন না।
  172. সংগৃহীত গীতাংশে এরূপ কোন কথা নাই যে বিমাতার চক্রান্তে কাঞ্চনমালার বনবাস হইয়াছিল।
  173. যেমন যায়=যেমন হস্তীর দন্ত একবার বাহির হইলে আর সংবরণ করিয়া ভিতরে নেওয়া যায় না।
  174. পাপ পুণ্য...মন্দ C.F. “সতী বা অসতী, তোমাতে বিদিত ভাল মন্দ নাহি জানি।” চণ্ডীদাস।
  175. ভইনি=ভগিনী।
  176. পুণ্ণ=পূর্ণ।
  177. পণ্ণামী=প্রণাম।