পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/চন্দ্রাবতীর রামায়ণ

চন্দ্রাবতীর রামায়ণ

 বিখ্যাত মহিলা-কবি চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণ মৈমনসিং অঞ্চলে বহু স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্থ। বিবাহ-বাসরে এবং অপরাপর মহিলা-সম্মেলন-উপলক্ষে এই রামায়ণ সর্ব্বদা গীত হইয়া থাকে। মেয়েরাই ইহার গায়ক, ইহার কবি স্ত্রীলোক, ইহার শ্রোতা ও গায়কেরাও অধিকাংশ স্থলে স্ত্রীলোক। পাঠক এই রামায়ণটিকে কাব্য বলিয়া ভুল করিবেন না। ইহা প্রত্যেক বিষয়ে পালাগানগুলির সঙ্গে এক পংক্তিতে স্থান পাইবার দাবী রাখে। প্রত্যেক ছত্রের পরে ‘গো’ শব্দটি পালাগানের সুরটি মনে জাগাইয়া দেয়। যদিও কবি সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন, তথাপি তিনি পালাগানেরই ভাষা ব্যবহার করিয়াছেন; সংস্কৃত সন্ধি ও সমাস প্রকরণ বাঙ্গালার ঘাড়ে চাপাইয়া দেন নাই। উপমাগুলিও তিনি বঙ্গপল্লীর নৈসৰ্গিক চিত্রগুলি হইতে সংগ্রহ করিয়াছেন—সংস্কৃতের ভাণ্ডার হইতে ধার করিতে যান নাই। আমরা এখন একরূপ নিশ্চিত ভাবে বলিতে পারি পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকার প্রথম ভাগে প্রকাশিত মলুয়া পালাটিও চন্দ্রাবতীর রচনা। সেই পালায় একটি বন্দনা পাওয়া গিয়াছে, যাহাতে কবি নিজের ভনিতা দিয়াছেন এবং মৈমনসিংএর লোকের চিরাগত বিশ্বাস মলুয়া পালাটি চন্দ্রাবতীরই রচনা। পালা কবিতার মধ্যে মলুয়া মধ্যমণিস্বরূপ। বিবাহিতা স্ত্রীর অপূর্ব্ব দাম্পত্য প্রেমই মলুয়ার মূল বিষয়। এই পালাটির আর এক নাম কাজীর বিচার। আমরা সেই নামটি পরিবর্ত্তন করিয়া নায়িকার নামেই উহাকে পরিচিত করিয়াছি। কবি নয়ানচাদ প্রণীত চন্দ্রাবতীর সম্বন্ধে যে পালা গানটি আছে তাহাও অতি অপূর্ব্ব। সেই পালাটিও মৈমনসিং গীতিকার প্রথম ভাগে প্রকাশিত হইয়াছে। চন্দ্রাবতীর পিতা সুপ্রসিদ্ধ মনসাদেবীর ভাসান-গায়ক কবি বংশীদাস ভট্টাচার্য বঙ্গ সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতনামা ব্যক্তি। তিনি তাঁহার দুলালী কন্যা চন্দ্রাবতীকে সংস্কৃত ব্যাকরণ, সাহিত্য ও পুরাণাদি শিক্ষা দিয়াছিলেন। ‘কেনারামের’ পালায় আমরা বংশীদাসের যে উজ্জ্বল ছবিটি পাইয়াছি—নয়ানচাঁদ কবির হস্তে তাহা আরও সমুজ্জ্বল হইয়াছে। বংশীদাস অতি দরিদ্র ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন পরম ভক্ত ও একনিষ্ঠ সাধক। তিনি ব্রাহ্মণ্যগৌরবের স্তম্ভস্বরূপ ছিলেন। চন্দ্রাবতী তাঁহার যে চরিত্র দিয়াছেন তাহা জীবন্ত। নামাবলী, উত্তরীয়, আবক্ষোলম্বিত রুদ্রাক্ষমালা, সুদীর্ঘ গৌর বপু, এই ছিল তাঁহার সরঞ্জাম। তিনি যখন তন্ময় হইয়া গান করিতেন তখন আরণ্য প্রদেশে পক্ষীদের কাকলী থামিয়া যাইত ও তাহারা উড়িয়া আসিয়া তাঁহার নিকটে ডালের উপর বসিয়া মুগ্ধভাবে চুপ করিয়া থাকিত। এ দিকে গৃহে অন্ন নাই, গান গাহিয়া কিছু তণ্ডুল ও কড়ি তিনি সংগ্রহ করিতেন, কিন্তু নিত্যকার প্রয়োজনীয় যেটুকু, তাহার বেশী অর্থ লইতে স্বীকৃত হইতেন না। যখন কেনারাম দস্যু বহু কলসী স্বর্ণমুদ্রা তাঁহাকে উপঢৌকন দিয়া বলিল, অনেক পুরুষ পর্যন্ত আর আপনাদের অর্থাভাব হইবে না, তখন সগর্ব্বে বংশীদাস বলিলেন, “এই নররক্তরঞ্জিত অর্থ আমার চক্ষের সম্মুখ হইতে লইয়া যাও, উহা গ্রহণ করা দূরে থাক, দর্শন করাও আমার পাপ।” সেই দিন কেনারাম দস্যু প্রথমে হতবুদ্ধি হইল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বুঝিল সংসারে অর্থ হইতেও মূল্যবান্ জিনিষ আছে। ক্ষিপ্রহন্তে উন্মত্তের ন্যায় কলসী কলসী স্বর্ণমুদ্রা সে ফুলেশ্বরী নদীর জলে নিক্ষেপ করিয়া রিক্তহস্ত হইল, এবং কাঁদিয়া বংশীদাসের নিকট ধর্ম্মোপদেশ প্রার্থনা করিল। যে খড়্গ লইয়া সে বংশীদাসকে কাটিতে উদ্যত হইয়াছিল, বহুকাল সঞ্চিত সেই বিপুল অর্থের সঙ্গে সে খড়্গখানিও চিরতরে ফুলেশ্বরীর জলে বিসর্জ্জন দিল। জীবনে সে আর লৌহাস্ত্র ধারণ করে নাই।

 মলুয়া ও কেনারামের পালায় চন্দ্রাবতী যে অসামান্য প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন এই রামায়ণের পালায়ও সেই প্রতিভার যথেষ্ট পরিচয় আছে। ইহা যেমনি সরল, তেমনি করুণ। শ্রেষ্ঠ পালাগায়কদের যে অতি সংক্ষেপে মনোভাব প্রকাশ করিবার কৃতিত্ব দেখা যায় এই রামায়ণের পালায়ও সেই কৃতিত্বের পরিচয় আছে। এত ক্ষুদ্র আকারে এরূপ সরলভাবে রামায়ণের গল্প সম্ভবতঃ আর কেহ বর্ণনা করেন নাই। মলুয়া, কেনারাম এবং রামায়ণ এই তিনটি মাত্র কাব্য তাঁহার রচনা নহে, তিনি তাঁহার পিতাকে পদ্মাপুরাণ লিখিতে বিশেষ সাহায্য করিয়াছিলেন। বংশীদাস-কৃত পদ্মাপুরাণে চন্দ্রাবতীর লেখা অনেকাংশ দৃষ্ট হয়। প্রেমভঙ্গে ব্যথিত চিত্তকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এই রামায়ণ রচনায় তিনি প্রবৃত্ত হন। তাঁহার পিতার আদেশেই তিনি এই ভার গ্রহণ করেন। এ সমস্ত কথাই নয়ানচাঁদ কবি বিস্তৃতভাবে লিখিয়া গিয়াছেন। কেনারামের পালায় চন্দ্রাবতী স্বয়ং তাঁহার পিতা ও স্বীয় গৃহ-সম্বন্ধে যে সব কথা লিখিয়াছেন, তাহার সঙ্গে নয়ানচাঁদের বর্ণনার বিশেষ ঐক্য আছে। কেবল তাঁহার প্রণয়-কাহিনীটি তিনি সঙ্কোচের সহিত বাদ দিয়া গিয়াছেন এবং সেই কাহিনীর সবিস্তার বর্ণনাও আমাদিগকে নয়ানচাঁদ দিয়াছেন। চন্দ্রাবতী আজন্মকুমারীই রহিয়া গিয়াছিলেন। শৈশব-সঙ্গীর প্রতারণার পরে তিনি সাংসারিক সুখের আর কোন আশাই রাখেন নাই এবং এই রামায়ণ লিখিতে লিখিতেই অকালে তাঁহার মৃত্যু হয়। ১৫৭৫ খৃষ্টাব্দের কিছু পরে তাঁহার দুঃখান্ত জীবনের উপর পটক্ষেপ হইয়াছিল। এই রামায়ণের ইংরাজী ভূমিকায় আমরা তাঁহার সম্বন্ধে আরও অনেক কথা লিখিয়াছি।

 চন্দ্রাবতীর রামায়ণের কবিত্বই ইহার প্রধান গুণ নহে। এই রামায়ণে আমরা এমন অনেক জিনিষ পাইতেছি যাহাতে রামায়ণ-সাহিত্যের কতকগুলি আঁধার দিক্ আলোকিত হইয়া যাইতেছে। বৌদ্ধ জাতকের সঙ্গে রামায়ণের এতটা অধিক সাদৃশ্য রহিয়াছে যে একথা আমাদের স্পষ্টই ধারণা হইয়াছে—উভয়েই হয়ত কোন অজ্ঞাত মূল হইতে গৃহীত হইয়াছে নতুবা ইহারা পরস্পরের নিকট ঋণী। দশরথ-জাতককে আমরা বাল্মীকির পূৰ্ববর্ত্তী বলিয়া মনে করিয়াছি; তৎসম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য “The Bengali Ramayanas” নামক পুস্তকে বিস্তারিত ভাবে প্রদত্ত হইয়াছে। দশরথ-জাতক ছাড়া সাম জাতকে অন্ধমুনির কাহিনীটি ঠিক বাল্মীকির অনুরূপ ভাবেই লিখিত হইয়াছে। সম্বুলা জাতকের রাক্ষস নায়িকাকে যে সব ভীতি প্রদৰ্শন করিয়াছে অশোকবনে সীতার প্রতি রাবণের উক্তি ঠিক তদনুরূপ। বসন্তরা জাতকে বসন্তরার উক্তি এবং প্রত্যুক্তি বনবাসের প্রাক্কালে রামসীতার কথাবার্ত্তার অনুরূপ। এই জাতকগুলি এবং রামায়ণ তুলনা করিয়া পড়িলে স্পষ্টই ধারণা হইবে যে তাঁহাদের ঐক্য আকস্মিক নহে। সত্যই কবিরা পরস্পরের নিকটে ঋণী। আমরা এই প্রসঙ্গ অন্যত্র সবিস্তারে লিখিয়াছি সুতরাং এখানে তাহার পুনরাবৃত্তি নিম্প্রয়োজন। দশরথ-জাতকে লিখিত আছে যে রাম সীতার সহোদর ছিলেন। এই কথা লইয়া অৰ্দ্ধশিক্ষিত পাঠকমণ্ডলীর মধ্যে খুব হাস্য-পরিহাস হইয়া থাকে। পুরাকালে ব্যাবিলন, ইজিপ্ট এবং ভারতবর্ষের নানা স্থানে, বিশেষ জাভা দ্বীপে সহোদর-সহোদরার পরিণয় নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। বৌদ্ধ জাতকে লিখিত আছে, যে শাক্যবংশ শাক্যমুনি সমুজ্জ্বল করিয়াছিলেন, সেই বংশেই রামচন্দ্র জন্ম গ্রহণ করেন। এই শাক্যদের মধ্যে ভাইভগিনীর পরিণয় সর্ব্বদা ঘটিত। কুণাল জাতকে লিখিত আছে যে শাক্যদের প্রতিদ্বন্দ্বী অপর এক জাতি যুদ্ধক্ষেত্রে শাক্যদিগের নিন্দাবাদ করিয়া বলিয়াছিল “তোমরা তোমাদের ভগিনীদের বিবাহ করিয়া থাক। তোমরা পশু!” উত্তরে শাক্যেরা স্পৰ্দ্ধা করিয়া বলিয়াছিল-“আমরা সিংহ, আমরা তোমাদের মত শৃগালের নিকট কন্যা বিবাহ দিতে কখনই সম্মত হইতে পারি না।” (কুণাল জাতক, ৫৩৫ সংখ্যা, ২১৯ পৃষ্ঠা-এচ. পি. ফ্রান্সিস-এর অনুবাদ।)

 কিন্তু হিন্দুরা যখন রামকে অবতার বলিয়া গ্রহণ করেন, তখন সীতাকে লাইয়া মই গোলযোগে পড়িয়া যান। বিশেষজ্ঞেরা জ্ঞাত আছেন, রামায়ণের আদিকাণ্ড এবং উত্তরাকাণ্ড বাল্মীকির রচনা নহে। অযোধ্যাকাণ্ড হইতে লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্তই বাল্মীকির রচনা। পরবর্ত্তী লেখকেরা সীতার জন্মকথা লইয়া নানারূপ আজগুবি গল্পের সৃষ্টি করিয়াছিলেন। সহোদরার সহিত বিবাহ অসম্ভব অথচ সেই সময়ে ভারতবর্ষের রাজাদিগের বংশাবলী এত সুপরিচিত ছিল যে তন্মধ্যে সীতাকে হঠাৎ প্রবেশ করাইয়া দেওয়া কোন প্রকারেই সম্ভব হইল না। Pargiter সাহেব ভারতীয় প্রাচীন ক্ষত্ত্রিয় বংশাবলী সম্বন্ধে যে সকল অকাট্য প্রমাণ দিয়াছেন, তাহাতে দৃষ্ট হইবে যে সেই সব সর্ব্বজনবিদিত বংশে কোন নূতন রাজপুত্ত্র বা রাজকন্যার প্রবেশ উদ্ভাবন করিলে তাহা কেহই গ্রহণ করিত না।

 যখন জাল ইতিহাস সৃষ্টি করার চেষ্টা অসাধ্য হইল, তখন নানা প্রকার অলৌকিক কিংবদন্তী দ্বারা রামায়ণের এই ঘটনাটিকে পুরণ করিবার আবশ্যক হইয়াছিল। সীতার উদ্ভব সম্বন্ধে কত কথাই যে কত পুরাণে রহিয়াছে, তাহার অবধি নাই।

 জাভা দেশের রামায়ণে লিখিত আছে যে সীতা রাবণ এবং মন্দোদরীর কন্যা। গণকেরা ভবিষ্যদবাণী করিয়াছিল, সীতা অতি দুর্ভাগিণী হইবেন। সুতরাং রাবণ জন্মমাত্র একটি কৌটায় শিশুটিকে আবদ্ধ করিয়া তাহা সমুদ্রে ভাসাইয়া দেন। জনক ঐ কৌটাটি উদ্ধার করেন। মালয় দেশের রামায়াণে আছে সীতা মন্দোদরীর কন্যা এবং তিব্বতী রামায়ণে সীতাকে রাবণের কন্যা বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। কাশ্মীরী রামায়ণেও সীতাকে রাবণের কন্যা বলিয়াই উল্লেখ করা হইয়াছে (দিবাকর প্রকাশ-প্রণীত কাশ্মীরী রামায়ণ—গ্রীয়ারসনের অনুবাদ)। শ্রীযুত ডব্লিউ স্‌টটার হ্যাম, (হল্যান্দ ইণ্ডিয়া সোসাইটির সম্পাদক) এই প্রসঙ্গ লইয়া বহু গবেষণা করিয়াছেন এবং তিনি আমাকে যে পত্র লিখিয়াছেন তাহাতে রামায়ণ সম্বন্ধে নানা দেশে প্রচলিত নানা উপাখ্যান ও গুজবের একটা তালিকা দিয়াছেন। আমাদের বাঙ্গালা রামায়ণেও সীতার জন্ম সম্বন্ধে নানারূপ আজগুবি গল্প লিপিবদ্ধ হইয়াছে। সীতা পৃথিবীর কন্যা, একটা ডিম্বরূপে জনকের হলাগ্র-ভাগে তিনি উত্থিত হন, ইত্যাদি কথা এদেশে সর্ব্বজনবিদিত।

 আশ্চর্য্যের বিষয় চন্দ্রাবতীর রামায়ণে বাল্মীকি বা কৃত্তিবাসের বৃত্তান্তের অনুরূপ কাহিনী আমরা পাই না। তির্ব্বত, মালয়, কাশ্মীর, জাভা প্রভৃতি স্থানে সীতার জন্ম সম্বন্ধে যে সব প্রবাদ প্রচলিত আছে, চন্দ্রাবতী সেই সকল কথাই আমাদিগকে শুনাইয়াছেন। আমরা যখন প্রথম চন্দ্রাবতীর রামায়ণ পাঠ করি তখন তদ্‌বর্ণিত কুকুয়ার চিত্রটি তাঁহারই মৌলিক কল্পনা বলিয়া মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু এখন দেখিতেছি। এই কুকুয়া চন্দ্রাবতীর সৃষ্টি নহে। এই চরিত্রটি কাশ্মীরী, মালয়, জাভা, কম্বোজ এবং তিব্বতী রামায়ণেও পরিদৃষ্ট হয়। মোট কথা। চন্দ্রাবতী মূল রামায়ণ পাঠ করিলেও তাঁহার জন্মভূমির নিকটবর্ত্তী প্রদেশে রামসীতা সম্বন্ধে যে সমস্ত কাহিনী প্রচলিত ছিল, তাহা হইতেই অধিকতর উপাদান সংগ্রহ করিয়াছেন।

 অনেকেই জানেন জৈনদিগের রচিত কতকগুলি রামায়ণ আছে। তন্মধ্যে খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে প্রাকৃত ভাষায় লিখিত “পউম চরিয়ম” (পদ্ম চরিত) নামক গ্রন্থই প্রসিদ্ধ। একাদশ শতাব্দীতে জৈন কবি হেমচন্দ্র আর একখানি রামায়ণ প্রণয়ন করেন। বাল্মীকির রামায়ণের সঙ্গে এই সকল রামায়ণের অনেক স্থলে অনৈক্য দৃষ্ট হয়। সকলেই জানেন বৌদ্ধ এবং জৈনেরা রাবণের পক্ষপাতী ছিলেন। মহাযান সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, রাবণ বুদ্ধের অন্যতম প্রধান শিষ্য ছিলেন। লঙ্কাবতার-সূত্র নামক সংস্কৃত গ্রন্থে বুদ্ধের সঙ্গে রাবণের অনেক তর্ক-বিতর্ক বর্ণিত হইয়াছে। এই পুস্তকের কতকাংশ কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ হইতে প্রকাশিত হইয়াছে। জৈন কবি হেমচন্দ্র রাবণের যে চিত্র আঁকিয়াছেন তাহা সিদ্ধপুরুষের। মৎকৃত Bengali Ramayanas গ্রন্থে এ সম্বন্ধে আমি বিশেষভাবে আলোচনা করিয়াছি। জৈন কবির গ্রন্থে রাবণের কথা লইয়াই রামায়ণের মুখবন্ধ করা হইয়াছে এবং সেই অধ্যায়ই অতিদীর্ঘ, রামের চিত্র পরবর্ত্তী এবং রাবণের ন্যায় উজ্জ্বল নহে। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে আমাদের চন্দ্রাবতীও রাবণের কথা লইয়াই তাঁহার রামায়ণের প্রারম্ভ করিয়াছেন এবং রাবণ সম্বন্ধে যে সকল উপাখ্যান লিখিয়াছেন তাহার মূল বাল্মীকি রামায়ণে নাই। উত্তরাকাণ্ডের সঙ্গে সেই সকল গল্পের কতক কতক ঐক্য আছে।

 রাবণ যে অতি প্রসিদ্ধ নৃপতি ছিলেন তৎসম্বন্ধে কোন সংশয় নাই। তিনি দাক্ষিণাত্যে বহু মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন (বম্বে গেজেটিয়ার ১, ৭, ১৯০, ৪৫৪ নং, ১৭, ৭৬, ২৯০,৩৪১ পৃঃ)। তিনি কেনারা প্রদেশে গোকর্ণ নামক স্থানে তপস্যা করিয়া সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন। উক্ত অঞ্চলে তাঁহার সম্বন্ধে বহু প্রবাদ আছে। ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধ পণ্ডিত ধর্ম্মকীর্ত্তি হিন্দুরা রাবণের চরিত্র কলঙ্কিত করিয়াছেন বলিয়া অনেক ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছেন।

 মৈমনসিংহের ব্রাহ্মণ্য-প্রভাব কতকটা আধুনিক। তৎপূর্ব্বে এই দেশে বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি নানা সম্প্রদায়ের নানারূপ কাহিনী ও প্রবাদ দেশময় প্রচলিত ছিল। জনসাধারণ এই সকল উপাখ্যান জানিত এবং চন্দ্রাবতী সংস্কৃত কাব্যের অনুরোধে জনসাধারণকে উপেক্ষা করিতে পারেন নাই। এই জন্যই তিনি তাহাদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনীগুলির স্থান দিয়াছেন এবং এই জন্যই আর্য্য সমাজের বহির্ভূত প্রদেশসমূহে রামায়ণের যে বিচিত্র উপাখ্যানমালা প্রচলিত ছিল তাহদের সহিত চন্দ্রাবতীর বিবরণের এইরূপ আশ্চর্য্য সাদৃশ্য। চন্দ্রাবতীর রামায়ণে আমরা বাল্মীকিপূর্ব্ব যে সকল উপাখ্যান দেশময় প্রচলিত ছিল এবং যেগুলি হইতে নির্ব্বাচন করিয়া কতক গ্রহণ এবং কতক পরিহার করার রীতি অনুসারে বাল্মীকি তাঁহার অপূর্ব্ব মহাকাব্য রচনা করিয়াছিলেন, সেই পুরাকালীন উপাখ্যানসম্পদের কতক আভাস পাইতেছি। এই হিসাবে কবিত্বের কথা না তুলিলেও রামায়ণের এই গানের অন্যবিধ মূল্য আমরা স্বীকার করিতে বাধ্য।

 চন্দ্রাবতীর রামায়ণের ইংরাজী ভূমিকায় আমরা এতৎসম্বন্ধে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করিয়াছি। এখানে সংক্ষেপে তাহার উল্লেখ করিলাম।

 চন্দ্রাবতীর রামায়ণে সংস্কৃতের প্রভাব যে একেবারে কিছু নাই তাহাও নয়। তিনি মাঝে মাঝে দু’এক পঙ্‌ক্তি সংস্কৃত কাব্যাদি হইতে গ্রহণ করিয়াছেন, যথা—সূর্য্য হ’তে কাড়ি নিল সহস্র কিরণ। (ষষ্ঠ অধ্যায়, চতুর্থ খণ্ড, প্রথম সংখ্যা, অষ্টম ছত্র) ছত্রটি অবিকল মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর “সমস্তরোমকূপেষু স্বীয়রাশ্মীন্ দিবাকরঃ” ছত্রের ঠিক অনুরূপ। স্থানে স্থানে বৈষ্ণব পদের অনুরূপ কবিতাও দৃষ্ট হয় যথা—“কৌশল্যা রাখিল নাম কাঙালের ধন”—ইত্যাদি (সপ্তম অধ্যায় ২৬ পৃঃ) ইহা কৃষ্ণের শতনামের একটি পরিচিত গাথা হইতে গৃহীত।

 চন্দ্রাবতীর রামায়ণের ভাষা যেমন সহজ তেমনি সুন্দর। একটি নির্ম্মল জলপ্রবাহের মত সেই কবিত্ব অবাধ গতিতে ছুটিয়াছে। কোন স্থানে বহ্বাড়ম্বর কিংবা ভাষা-পল্লবের বাহুল্যে সেই গতির বিঘ্ন সাধিত হয় নাই। সর্ব্বত্র করুণ রসের একটি মধুর ঝঙ্কার আছে। সীতার কষ্টে সেই রস উথলিয়া উঠিয়াছে। নিজের জীবনে প্রণয়ভঙ্গজনিত দারুণ ব্যথায় সীতার দুঃখ বর্ণনা করিতে যাইয়া তিনি এতটা দুঃখার্দ্র হইয়াছেন। মাইকেলের লেখায় সরমার নিকট সীতা পঞ্চবটীর যে বর্ণনা দিয়াছিলেন, অবিকল তদ্রূপ বর্ণনা সীতা অযোধ্যায় তাঁহার সখী দিগকে দিয়াছেন। আমার বিশ্বাস মাইকেল মৈমনসিংহের কবির রামায়ণটি কোন স্থানে শুনিয়া মাহিলা-কবির দ্বারা প্রভাবান্বিত হইয়াছিলেন। চন্দ্রাবতীর রচনায় মাইকেলী ভাষার শব্দচ্ছটা ও আড়ম্বর নাই, কিন্তু তাহা অধিকতর সরল, অধিকতর করুণ ও অধিকতর মধুর। তাহা চক্ষু ঝলসাইয়া দেয় না। কিন্তু প্রাণ গলাইয়া দেয়। মাইকেলের “ছিনু মোরা সুলোচনে! গোদাবরী-তীরে, কপোতকপোতী যথা উচ্চ-বৃক্ষ-চূড়ে বাঁধি নীড়, থাকে সুখে;” প্রভৃতি পদ পড়িয়া চন্দ্রাবতীর “গোদাবরী নদীকূলে গো পঞ্চবটী বন, ঘুরিতে ঘুরিতে গো আইলাম। আমরা তিনজন। কি করিব রাজ্য সুখে গো রাজসিংহাসনে, শত রাজ্যপাট গো আমার প্রভুর চরণে॥” এই রচনাটি পড়িলে দেখিতে পাইবেন প্রথমটি ছবির ন্যায় চোখের সম্মুখে বিচিত্র দৃশ্যের অবতারণা করে, কিন্তু দ্বিতীয়টি বাঁশীর সুরের মত কাণের ভিতর দিয়া মর্ম্মে প্রবেশ করে। সীতা তাঁহার সখীর নিকট তাঁহার জীবনের প্রথম হইতে বনবাসের কিঞ্চিৎপূর্ব্বকাল পর্য্যন্ত ঘটনাবলীর পরপর যে বর্ণনাটি দিয়াছেন এক একটি সংক্ষিপ্ত পদে তাহা এক একটি সম্পূর্ণ ভাবের আলেখ্যস্বরূপ। Byronএর সুপ্রসিদ্ধ Dream নামক কবিতায় বর্ণিত ঘটনাগুলির ন্যায় সীতার পূর্ব্বজীবনের স্মৃতিসম্পৃক্ত এই বিবরণীটি করুণ-মধুর রসের উৎস।

শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন

চন্দ্রাবতীর রামায়ণ

চন্দ্রাবতীর রামায়ণ

প্রথম পরিচ্ছেদ

(১)

লঙ্কার বর্ণনা

সাগরের পারে আছে গো কনক ভুবন।
তাহাতে রাজত্বি করে গো লঙ্কার রাবণ॥

বিশ্বকর্ম্মা নির্ম্মাইল গো রাবণের পুরী।
বিচিত্র বর্ণনা তাহার গো কহিতে না পারি॥
যোজন বিস্তার পুরী গো দেখিতে সুন্দর।
বড় বড় ঘরগুলি গো পাহাড় পর্ববত॥

সাগরের তীরে লঙ্কা গো করে টলমল।
হীরামণ মাণিক্যতে গো করে ঝলমল॥
বড় বড় পুষ্কু’ণী গো বান্ধ্যা চারিধার।
সোণায় রূপায় বান্ধ্যাইল ঘাট অতি চমৎকার॥১০

স্বর্গপুরে আছে যথা ইন্দ্রের নন্দন।
সেইমতে লঙ্কাপুরে গো অশোকের বন॥১২
দিন রাইতে ফুটে ফুল গো অশোকের বনে।
লঙ্কায় ফুটিলে গন্ধ গো ছুটে তির্‌ভুবনে॥১৪

এক দিনে ফুটি ফুল গো বচ্ছরে না বাসি।
তা দিয়ে সাজান করে গো যতেক রাক্ষসী॥১৬
বারমাস ফলে বৃক্ষে গো অমৃত রসাল।
পাক্‌না ফলের ভরে গো ভাইঙ্গা পড়ে ডাল॥১৮

রাতিতে প্রদীপ জ্বালে গো না নিভে দিবসে
নিশিদিন কাটে সবে গো গীত-বাদ্য-রসে॥২০
পক্ষী যদি উড়ে যায় গো যায় দুই সারে।
চন্দ্র সূর্য্য গো দূর হইতে নমস্কার করে॥২২
বড় বড় ঘরগুলি গো পাহাড় পর্ব্বত।
তাহাতে বসতি করে গো রাক্ষসেরা যত॥২৪
সোণায় ছাইয়া ঘর গো রূপায় দিছে বেড়া।
জমিনে থাকিয়া ঠেকে গো আসমানেতে চূড়া॥২৬

রাবণের কেলিগৃহ গো তাহার মাঝখানে।
চান্দেরে বেড়িয়া যেন গো শোভে তারাগণে॥২৮
হাজার-দুয়ারী ঘর গো আবে ঝিলিমিলি।
সোণার কপাট মধ্যে গো রূপার দিছে খিলি॥৩০
হীরামণ মাণিক্য দিয়া গো করেছে সাজন।
এমন সুন্দর ঘর গো নাহি তির্‌ভুবন।৩২

রূপেতে রূপসী যত গো রাক্ষস-কামিনী।
পারিজাত ফুলে তারা গো বিনাইয়া বান্ধে বেণী॥৩৪
মণি-মাণিক্যেতে কেউ গো চাঁচর কেশ বান্ধে।
বায়ু মুরভিত হয় গো শ্রীঅঙ্গের গন্ধে॥৩৬
হীরামণ-মাণিক্য গো অঙ্গে পায় লাজ।
দণ্ডে দণ্ডে ধরে তারা গো নব রঙ্গের সাজ॥৩৮
সোণার পালঙ্কে তারা গো শুইয়া নিদ্রা যায়।
দেবের অমৃত তারা গো সুখে বৈস্যা খায়॥৪০

বিচিত্র সুবর্ণ লঙ্কা গো নির্ম্মাইল বিশাই[]
এমন বিচিত্র পুরী গো তির্‌ভুবনে নাই॥৪২
বড়ই দুরন্ত রাজা গো দেবে নাই ডরে।
অমর হইয়াছে দুষ্ট গো বিরিঞ্চির বরে॥৪৪
ইন্দ্র আদি দেবতাগণ গো রাবণে করে ডর।
কেবল তাহার বৈরী গো নর আর বান্দর॥৪৬
ধামায় মাপিয়া তারা গো ভুলে রত্নধন।
এমন বৈভব কারো গো নাই তির্‌ভুবন॥৪৮
বিত্ত-বৈভব তার গো বর্ণনা না যায়।
হীরামণ-মাণিক্য তারা গো তলইয়ে শুকায়॥৫০
একদিন রাবণ রাজা গো পাত্র মিত্র লইয়া।
যুক্তি করে দশানন গো লঙ্কাতে বসিয়া॥৫২


(২)

রাবণের স্বর্গ জয় করিতে গমন

স্বর্গ জিনিতে রাজা গো করিলেক মন।
লইয়া রাক্ষস-সৈন্য গো করিল গমন॥
বড়ই দুরন্ত সেই গো রাক্ষসের সেনা।
স্বর্গের দুয়ারে যাইয়া গো দিল সবে হানা॥

দেবরাজে বার্ত্তা গিয়া গো জানাইল চরে।
আইল রাবণ রাজা গো স্বর্গ জিনিবারে॥
ইন্দ্রাদি দেবতা সবে গো চিন্তিত হইল।
রাইক্ষসের রোলে স্বর্গ গো কাঁপিয়া উঠিল॥

একে ত রাবণ রাজা গো সাক্ষাৎ শমন।
যার সম বীর নাহি গো এহি তির্‌ভুবন॥১০
কাটিলে না কাটে মুণ্ডু গো আগুনে না পুড়ে।
এমনি হইয়াছে দুষ্টু গো বিরিঞ্চির বরে॥১২
স্বৰ্গ ছাইড়া পলাইল গো যত দেবগণ।
ইন্দ্র যমে লইল রাজা গো করিয়া বন্ধন॥১৪
পারিজাত বৃক্ষ ছিল গো ইন্দ্রের নন্দনে।
ডালে মূলে উপাড়িয়া গো লইলা রাবণে॥১৬
ঐরাবত হস্তী লইলা গো উচ্চৈঃশ্রবা ঘোড়া।
কাইড়া লইয়া পুষ্পক রথ গো শূন্যে দিল উড়া॥১৮
মণিমুক্তা লইলা কত গো না যায় গণন।
ঝাইড়া মুইছ্যা লইলা রাজা গো ভাণ্ডারের ধন॥২০
দেবকন্যাগণে লইল গো রাজা রথেতে তুলিয়া।
হরষিতে চলে রাজা গো জয়লক্ষ্মী লইয়া॥২২
ইন্দ্রাদি দেবতাগণে বন্দী করি গো লয়।
স্বর্গপুরী শ্মশান হইল গো চন্দ্রাবতী কয়॥২৪


(৩)

রাবণ কর্তৃক মর্ত্ত্য ও পাতাল বিজয়

পরে ত চলিল রাজা মরত ভুবন।
মর্ত্ত্যেতে আছিল শুন গো যত রাজাগণ॥
বিনাযুদ্ধে সকলে গো মাগিল পরিহার[]
পাতালপুরে চলে রাজা গো করি মার্ মার্॥

পাতালে বাসুকী আদি গো যত নাগগণ।
বিনাযুদ্ধে আসি সবে গো লইলা শরণ॥
পরে ত চলিল রাজা গো গহন কাননে।
যথায় তপস্যা করে গো যত মুনিগণে॥
রাজকর চায় রাজা গো ঘূর্ণিত লোচন।
জটাচুলে ধরিয়া সবে গো করে বিরম্মন[]১০
কপীন সম্বল তারা গো ফল মুলাহারী।
রাবণের পায়ে পড়িয়া গো যায় গড়াগড়ি॥১২
দয়ামায়া নাহি গো দুষ্ট রাবণের মনে।
নানামতে বিরম্মনা গো করে মুনিগণে॥১৪

কুশাগ্রে চিরিয়া বুক গো রক্ত সবে দিল।
মুনির রক্ত কর লইয়া গো কৌটায় ভরিল॥১৬
লঙ্কায় চলিল রাজা গো হরষিত মন।
মন্দোদরী রাণীর আগে গো দিল দরশন॥১৮
রক্ত-কটরা খুলি গো রাণীর হাতে দিল।
চিন্তিত হইয়া রাণী গো রাবণে পুছিল॥২০

“কিবা ধন আনিয়াছ গো কটরায় ভরিয়া।”
রাণীরে কহিলা রাজা গো সান্ত্বনা করিয়া॥২২

“সতত আমার বৈরী গো যত দেবগণ।
অমর হইয়াছে সবে গো অমৃত কারণ॥২৪
ইন্দ্র যমে আনিয়াছি গো লঙ্কায় বান্ধিয়া।
সবারে মারিব গো এই বিষ খাওয়াইয়া॥২৬
যত্ন করি এই কৌটা গো তুল্যা রাখ ঘরে।”
এত বলি রাবণ রাজা গো চলিলা বাহিরে॥২৮

(8)

সীতার জন্মের পূর্ব্ব-সূচনা

রাজ্য করে রাবণ রাজা গো পাত্র মিত্র লইয়া।
সীতার জনম-কথা গো শুন মন দিয়া॥
চন্দ্র হইতে জ্যোতি রাজা গো করিয়া হরণ।
মটুকে রাখিল করি রাজা গো শীর্ষের আভরণ॥
সূর্য্য হইতে কাড়ি লইল গো সহস্র কিরণ।
কুড়ি চক্ষে ভরি রাখে গো জ্বলন্ত অনল॥
দেবতা তেত্রিশ কোটি গো আইল লঙ্কাপুরে।
করযোড়ে দণ্ডাইল গো রাবণের ডরে॥
কেহ ঝাড়ুদার কেহ গো বাগানের মালী।
দেবের উপরে রাক্ষস গো করে ঠাকুরালী॥১০
কুবের হইল আসি গো রাজার ভাণ্ডারী।
একাদশ রুদ্র হইল গো শিয়রের পরী॥১২
দ্বাদশ আদিত্য হইল গো শিরে ছত্রধর।
দেবতা হইয়া পবন গো ঢুলায় চামর॥১৪
বরুণ আসিয়া রাজার গো চরণ পাখালে।
লঙ্কাপুরে পারা[] দেয় গো শমন কোটালে॥১৬
অশ্বশালে থাকি ইন্দ্র গো কাটে ঘোড়ার ঘাস।
চন্দ্র সূর্য্য আলো দেয় গো বার তিথি মাস॥১৮

গন্ধর্ব্বপুরেতে যত গো গন্ধর্ব্ব-কুমারী।
বলেতে আনিয়া রাজা গো আনে নিজ পুরী॥২০
সাত শত দেবকন্যা গো রাজা রথেতে তুলিয়া।
শূন্যরথে করি আনে গো লঙ্কায় হরিয়া॥২২

বলে ছলে পড়ি কেহ গো পাপিষ্ঠে ভজিল।
ঝাঁপাইয়া সাগরজলে গো কেউ বা মরিল॥২৪

অশোক কাননে রাজা গো হরষিত মতি।
দেবকন্যা সঙ্গে কেলি গো করে দিবারাতি॥২৬
হীরা মণি মুক্তা আদি গো যত আভরণে।
আপনি মদন রতি সাজায় রাবণে॥২৮

চেড়ী গিয়া বার্ত্তা কয় গো মন্দোদরী আগে।
“এতকাল রাণী তুমি গো আছিল সোহাগে॥৩০
দেবকন্যা সহিত রাজা গো অশোক কাননে।
কেলি করে নিরন্তর গো হরষিত মনে॥”৩২

এহি কথা শুনিলেন গো মন্দোদরী রাণী।
অভিমানে দরদরি গো চক্ষে বহে পানি॥৩৪
বহুবল্লভ মন্দোদরী গো জানিয়া রাবণে।
কটরায় আছিল বিষ গো পড়িলেক মনে॥৩৬
“যে বিষ খাইয়া মরে গো দেবতা অমর।
আমি কেন নাহি খাই গো সেই কাল জর॥”৩৮

(৫)

মন্দোদরীর গর্ভসঞ্চার ও ডিম্ব-প্রসব

এতেক ভাবিয়া রাণী গো কি কাম করিল।
কৌটায় আছিল বিষ গো মুখে তুলি দিল॥
দৈবের নিবন্ধ কভু গো না যায় খণ্ডানি।
বিষ খাইয়া গর্ভবতী গো হইলেন রাণী॥

একমাস দুইমাস গো তিনমাস গেল।
দশমাস দশদিনে গো পূর্ণিত হইল॥

বিষেতে অবশ অঙ্গ গো বদন হইল কালা।
ভূমিতে শুইল রাণী গো কাল বিষের জ্বালা॥
দিন যায় রাত্রি আসে গো শনির বারবেলা।
এমন কালে রাণী এক গো ডিম্ব প্রসবিলা॥১০
চরে গিয়া বার্ত্তা তবে গো জানায় রাবণে।
ডিম্ব প্রসবিলাইন রাণী গো অতি অল্পক্ষণে॥১২
এহি কথা রাবণ রাজা গো যখনি শুনিল।
গণক আনিতে রাজা গো চর পাঠাইল॥১৪

পাঞ্জি পুঁথি লইয়া গণক গো আইল রাজার পুরে।
খড়ি পাতি গণক তবে গো লাগে গণিবারে॥১৬

“অবধান কর আজি গো রাক্ষসের নাথ।
সুবর্ণ লঙ্কার শিরে গো হইল বজ্রাঘাত॥১৮
এই ডিম্বে কন্যা এক গো লভিল জনম।
তা’ হইতে রাক্ষস-বংশ গো হইবে নিধন॥২০
আর এক কথা শুন গো রাক্ষসের পতি।
কন্যার লাগিয়া বংশে গো না জ্বলিবে বাতি॥২২
দৈবের নির্ব্বন্ধ কভু খণ্ডান না যায়।
আপনি মরিবে রাজা গো এই কন্যার দায়॥২৪
রাক্ষসের রক্ষা নাই গো গণিলাম সার।
সুবর্ণের লঙ্কাপুরী হৈল ছারখার॥”২৬

এহি কথা রাবণ রাজা গো শুনিল যখন।
কুড়ি চক্ষে অগ্নি ছুটে গো জ্বলন্ত নয়ন॥২৮
কেহ বলে ‘কাট ডিম্ব’ গো কেহ বলে ‘ভাঙ্গ।’
‘অনলে পুড়াইয়া’ কেউ গো বলে ‘কর সাঙ্গ॥’৩০

এই কথা অন্তঃপুরে গো শুনিলেন রাণী।
অন্তরে জ্বলিল যেন গো জ্বলন্ত আগুনী॥৩২

কান্দিল মায়ের পরাণ গো এহি কথা শুনি।
দরদর করি রাণীর চক্ষে বহে পানি॥৩৪
বনের পশুপক্ষী যারা গো সন্তানে রাখে বুকে।
তারাও ঝুরিয়া মরে গো পুত্র-কন্যার শোকে॥৩৬
কান্দিয়া রাবণে রাণী গো জানাইল বারতা।
“নষ্ট করিও না ডিম্ব গো রাখ মোর কথা॥৩৮
না ভাইঙ্গ না পুইর ডিম্ব গো আমার মাথা খাও।
যদি নাই রাখ ডিম্ব গো সায়রে ভাসাও॥”৪০

রাণীর কথায় রাবণ গো কি কাম করিল।
পঞ্চজন কারিগর গো ডাকিয়া আনিল॥৪২
বানাইল কৌটা এক গো সন্ধান করিয়া।
তাহাতে ভরিল ডিম্ব গো যতন করিয়া॥৪৪
সোণার কটরা মধ্যে গো রূপার খিল দিয়া।
সায়রে ভাসাইলা ডিম্ব গো ভবানী স্মরিয়া॥৪৬
ঘনাইয়া আইল সন্ধ্যা গো রবি বসে পাটে।
এমন সময় লাগ্‌ল ডিম্ব গো জনক ঋষির ঘাটে॥৪৮

(৬)

মাধব জালিয়া ও সতা জাল্যানী

মিথিলা নগরে ছিল গো মাধব জালিয়া।
জাল বায় মাছ ধরে গো ঘাটে দেয় খেয়া॥
নগরের মাঝে মাধব গো সবার দীনহীন।
হাটের চাউল ঘাটের পানি গো দুঃখে যায় দিন[]

পিন্ধনে কাপড় নাই গো পেটে নাই ভাত।
রাত্রদিন ভাবে সতা গো শিরে দিয়া হাত॥

এক সুখ কপালে তার গো লিখিলা বিধাতা।
আছিলা ঘরের নারী গো সতী পতিব্রতা॥
সতা নামে নাম তার গো জনম-দুঃখিনী।
স্বামীর সুখেতে সুখী গো দুঃখেতে দুঃখিনী॥১০
জাল বাইয়া আইসে মাধব গো কাদা ভরা পায়।
ধুয়াইয়া মুছাইয়া সতা গো ঘরে লইয়া যায়॥১২
দারুণ গরমে মাধব গো ছটফট করে।
তালের পাখা লইয়া সতা গো অঙ্গে বাতাস করে॥১৪
মাঘ মাসেতে দুঃখ গো শীতের রজনী।
আপন অঞ্চলে পাতে গো স্বামীর বিছানী॥১৬
ক্ষুদকণা য’হা থাকে গো খাওয়ায় স্বামীরে।
পাতের প্রসাদ সতা গো খায় ভক্তিভরে॥১৮

পাতালতার ঘরখানি গো ভাঙ্গা বেড়া তায়।
স্বামী বুকে লইয়া সতা গো সুখে নিদ্রা যায়॥২০
এমন যে দুঃখ তবু গো কপালের না দোষে।
স্বামী লইয়া থাকে সতা গো মনের সন্তোষে॥২২
উবাসে কাবাসে দিন গো গত হইয়া যায়।
দারুণ বিধাতা গো মুখ তুলিয়া না চায়॥২৪
ছেঁড়া পাটের শাড়ী গো কোমরেতে বেড়ি’।
মাছের ঝাঁপি মাথায় সতা গো ফিরে বাড়ী বাড়ী॥২৬
মলিন বয়ান গো সতার ঘামে ভিজে কেশ।
হাসিমুখে কহে কথা গো নাহি ভাবে ক্লেশ॥২৮

একদিন মাধব গো কোমরে বান্ধি ডোলা।
জাল বাইতে যায় গো মাধব তিন-সন্ধ্যাবেলা॥৩০

বাইতে বাইতে গো জাল রজনী আইল।
মাছ নাহি পায় গো মাধব চিন্তিত হইল॥৩২
দৈবের নির্ব্বন্ধ কথা গো শুন মন দিয়া।
আরবার গো জাল ফেলে মনসা স্মরিয়া॥৩৪
তাড়াতাড়ি করি মাধব গো টানে জালের দড়ি।
জালেতে ঠেকিয়া উঠে গো সোণার কটরি॥৩৬
চন্দ্রাবতী কহে “মাধব গো ঘরে ফিইরা যাও।
পোহাইল দুঃখের নিশি গো সুখে বৈস্যা খাও॥”৩৮

বাড়ীতে আসিয়া মাধব গো তিন ডাক দিল।
শীঘ্রগতি হইয়া সতা গো ঘরের বাহির হৈল॥৪০
আজি বুঝি গো দোনা মাছ পাইলেন পতি।
শীঘ্র ক’রে জ্বালে সতা গো আন্ধাইর ঘরে বাতি॥৪২

মাধব কহে বিধি কিবা গো লিখিল কপালে।
কাণা কড়ির মৎস্য আজগো না পড়িল জালে॥৪৪
কাণে কাণে কয় গো মাধব শুনে বা না শুনে।
কি জানি পাড়ার লোক গো গোপন কথা জানে॥৪৬
আস্তে ব্যস্তে কৌটা মাধব গো দিল সতার হাতে।
সুবর্ণ কটরা সতা গো তুইল্যা লইল মাথে॥৪৮
কাঠালের পিড়িতে গো সতা আসন পাতিল।
যতন করিয়া গো তথি কটরা রাখিল॥৫০

জয়াদি জোকার দিয়া গো মঙ্গল জানায়।
পঞ্চ সিন্দুরের ফোটা গো দিল কৌটার গায়॥৫২
ধান্য দুর্ব্বা আলপনা গো কৈল বিধিমতে।
আম্র শাখে রাখে ঘট গো জল ভরি তা’তে। ৫৪

পঞ্চ গাছি সইলতা[] দিয়া গো জ্বালে ঘৃতের বাতি।
ধূপ ধূনা জ্বালাইয়া গো করিল আরতি॥৫৬
সাষ্টাঙ্গে ভূমিতে পড়ি গো করিল প্রণাম।
সতার গৃহেতে হইল গো লক্ষ্মী অধিষ্ঠান॥৫৮

পোহাইল দুঃখের নিশি গো আইল সুখ ভোর।
আজ হইতে হইল সতার গো সকল দুঃখ দূর॥৬০
গোয়ালেতে বন্ধ্যা গাভী গো কামধেনু হইল।
সরু শস্য ধানে চাউলে গো উভরা ভরিল॥৬২
ক্ষেতে যদি গো বীজ ফেলে দোনা শস্য ফলে।
এখন হইতে মাধব আর গো নাহি যায় জালে॥৬৪
মাছের ডুলি মাথায় সতা গো না যায় বাড়ী বাড়ী।
‘রাম-লক্ষ্মণ-শাঁখা’ পরে গো মাধবের নারী॥৬৬
‘গঙ্গাজল-শাড়ী’ পরে গো পিন্ধন বাহার।
কোমরে বেড়িয়া পরে গো পাটের পসার॥৬৮
কাঞ্চন সরা বাটায় গো সুখে পান গুয়া খায়।
ফুলের মাচায় শুইয়া গো সুখে নিদ্রা যায়॥৭০

পাড়াপড়শীরা সবে গো করে কাণাকাণি।
এই না আছিল সতা গো জনম-দুঃখিনী।৭২
সতা বলে “পাড়াপড়শী গো থাক আশার আশে।
কপালে থাকিলে গো সুখ একদিন আসে॥”৭৪

(৭)

ডিম্ব লইয়া সতার জনক-মহিষীর নিকট গমন

একদিন রাত্রে গো সতা দেখিল স্বপন।
সে বড় আশ্চর্য্য কথা গো শুন সখীগণ॥

আড়াই প্রহর রাত্রি গো সতা শুইয়া নিদ্রা যায়।
চান্দের আলোক গো তার যুরে আঙ্গিনায়॥
কৌটা হইতে গো এক কন্যা বাহির হইয়া।
মা মা বলি ধরে গো সতার গলা জড়াইয়া॥
আশ্চর্য্য রূপসী কন্যা গো যেন পুষ্পডালা।
উজলা করিল গো গৃহ সাক্ষাৎ কমলা॥
ধরিয়া সতার গলা গো কহে ধীরে ধীরে।
“আমারে লইয়া যাও গো জনক রাজার ঘরে॥১০
বাপ মোর জনক রাজা গো রাণী মোর মাও।
কালি প্রাতে মোরে লইয়া গো রাণীর কাছে যাও॥”১২

ভোর না হইতে গো সতা সকালে উঠিয়া।
সুবর্ণ কটরা লইল গো অঞ্চলে বান্ধিয়া॥১৪
গত নিশির স্বপ্নের কথা গো রাণীরে কহিল।
অঞ্চল খুলিয়া কৌটা গো রাণীর হাতে দিল॥১৬

রাণী বলে “কিবা দিব গো ইহার বদলে।”
গজমোতি হার এক পরায় সতার গলে॥১৮
ধামায় মাপিয়া দিলা গো রত্নাদি কাঞ্চন।
সতা বলে “এ সকলে কোন প্রয়োজন॥২০
তোমার রাজ্যেতে বসি গো জন্ম-কাঙ্গালিনী।
আছয়ে মিনতি এক গো শুন রাজরাণী॥২২

স্বপ্ন যদি সত্য হয় গো কন্যা জন্মে ইতে।
আমার নামেতে গো কন্যার নাম রাইখ্যো সীতে॥”২৪
এত বলি সতা তবে গো বিদায় হইল।
সুবর্ণ কটরা রাণী গো যতনে রাখিল॥২৬

শুভদিনে শুভক্ষণ গো পূর্ণিত হইল।
ডিম্ব ফুটিয়া গো শিশু ভূমিষ্ঠ হইল॥২৮

সর্ব্বসুলক্ষণা কন্যা গো লক্ষ্মীস্বরূপিণী।
মিথিলা নগর যুড়ি গো উঠে জয়ধ্বনি॥৩০
জয়াদি জোকার দেয় গো কুলবালাগণ।
দেবের মন্দিরে গো বাদ্য বাজে ঘনে ঘন॥৩২
স্বর্গে মর্ত্ত্যে জয় জয় গো সুর নরগণে।
হইল লক্ষ্মীর জন্ম গো মিথিলা ভবনে॥৩৪
সতার নামেতে গো কন্যার নাম রাখে সীতা।
চন্দ্রাবতী কহে গো কন্যা ভুবন-বন্দিতা॥৩৬

(৮)

রামের জন্ম

পুণ্যকথা এক চিত্তে শুন গো দিয়া মন।
যে রূপে জন্মিলা গো প্রভু রাম নারায়ণ॥
এক অংশ নারায়ণ গো চারি রূপ ধরি।
জন্ম লইলেন আসি গো অযোধ্যা নগরী॥
রাজ্য করে দশরথ গো অযোধ্যা নগরে।
প্রজাগণে পালে রাজা গো পুত্র সমাদরে॥

অপুত্রক ছিলা রাজা গো দুঃখযুক্ত হিয়া।
একে একে করিলেন গো তিনখানি বিয়া॥
কৌশল্যা কৈকেয়ী আর গো সুমিত্রা ঠাকুরাণী।
রাজার আছিল এই গো তিনজন রাণী॥১০
বশিষ্ঠেরে লইয়া রাজা গো করয়ে মন্ত্রণ।
পুত্রের লাগিয়া করে গো যজ্ঞ আরম্ভণ॥১২

নানাদেশ হইতে গো ডাকি আনে মুনিগণে।
যজ্ঞ করে দশরথ রাজা গো পুত্রের কারণে॥১৪

যতেক যজ্ঞের ফল গো হইল নিষ্ফল।
আটকুরা রাজার ভাগ্যে গো না ফলিল ফল॥১৬

একদিন দশরথ গো বড় দুঃখ মন।
যোড়মন্দির ঘরে যাইয়া করিল শয়ন॥১৮
কপাটেতে খিল দিয়া গো অনাহারে রয়।
মনদুঃখে হইল রাজার গো জীবন সংশয়॥২০
একদিন দুইদিন গো তিনদিন গেল।
মন্দিরের কপাট রাজা গো মুক্ত না করিল॥২২
দৈবের নির্ব্বন্ধ কথা গো শুন দিয়া মন।
আচম্বিতে আইল তথা গো মুনি একজন॥২৪
অতিদীর্ঘ জটাভার গো পড়ে ভূমিতলে।
ললাটে চন্দন তিলা গো তারা যেন জ্বলে॥২৬
হস্তেতে তালের যষ্টি গো কান্ধে বাঘছাল।
মুনিরে দেখিয়া গো ভয় লাগে দ্বারপাল॥২৮
দুয়ারে খাড়াইয়া মুনি গো তিন ডাক মাইল।
মুনির বচনে রাজা গো দুয়ার খুলিল॥৩০
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া দিল গো বসিতে আসনে।
তাতে না বসিয়া মুনি গো বসে কুশাসনে॥৩২

রাজারে জিজ্ঞাসে মুনি গো কিসের কারণ।
এহি মতে অনশনে গো ত্যজিছ জীবন॥৩৪
দুঃখের কথা কয় রাজা গো মুনির চরণে।
সান্ত্বনা করেন মুনি গো মধুর বচনে॥৩৬
অকাল অমৃত ফল গো খুলি ঝুলা হইতে।
আস্তে ব্যস্তে দেয় মুনি গো দশরথের হাতে॥৩৮

এই ফল দেও নিয়া গো কৌশল্যা রাণীরে।
এই ফলে পাবে গো পুত্র দেবতার বরে॥৪০

ফল লইয়া দশরথ গো অতি ধীরে ধীরে।
শীঘ্রগতি চলে রাজা গো কৌশল্যার মন্দিরে॥৪২
ফল লইয়া দিল রাজা গো কৌশল্যার হাতে।
রাজারে দেখিয়া রাণী গো উঠে চমকিতে॥৪৪
মুনির বৃত্তান্ত রাজা গো বলে সমুদয়।
* * * * ৪৬
ফল পাইয়া কৌশল্যা গো আনন্দিত হিয়া।
সোণার কাটরা মাঝে গো রাখিল তুলিয়া॥৪৮
সরলা কৌশল্যা দেবী গো কি কাম করিলা।
মুনির দেওয়া ফল রাণী গো তিন ভাগ কৈল॥৫০
এক ভাগ নিজে খাইল রাণী গো আর দুই ভাগ লইয়া।
সুমিত্রা কৈকেয়ীর ঘরে দিল গো পাঠাইয়া॥৫২

কিছুকাল পর শুন গো দৈবের ঘটন।
গর্ভবতী হইল ক্রমে গো রাণী তিন জন॥৫৪
অযোধ্যা নগরে উঠে গো জয়াদি জোকার।
শুনি নাগরিয়া লোকে গো লাগে চমৎকার॥৫৬
ঢাক ঢোল বাজে রঙ্গে গো নাচে প্রজাগণ।
ভাণ্ডার খুলিয়া সবে গো করে ধন বিতরণ॥৫৮
ব্রাহ্মণেরে দিলা রাজা গো ধনরত্ন দান।
দুগ্ধবতী গাভী দিলা গো সহিত রাউখ্যাল॥৬০

এক দুই তিন করি গো পঞ্চমাস গেল।
গর্ভের লক্ষণ গো ক্রমে প্রকাশ হইল॥৬২
জ্যেঠি খুড়ি মিলি সবে গো সাধ খাওয়াইল।
জয়রবে অযোধ্যাপুরী গো ভরিয়া উঠিল॥৬৪
অলস হইল গো তনু মুখে হাই উঠে।
সোণার পালঙ্ক ছাড়ি গো ভূমে পড়ি লুটে॥৬৬

পোড়া মাটি খায় গো ঘুমে ঢুলে দু’নয়ন।
চন্দ্রাবতী কয় গো এই গর্ভের লক্ষণ॥৬৮

দশমাস দশদিন গো পূর্ণিত হইল।
সর্ব্ব সুলক্ষণ শিশু গো ভূমিষ্ঠ হইল॥৭০
সুবর্ণ কাটরীতে গো ধাই নাড়ী ছেদ করে।
জয়াদি জোকার পড়ে গো কৌশল্যার মন্দিরে॥৭২
দূতে গিয়া বার্ত্তা কইল গো দশরথের আগে।
হিরামণ মাণিক্যি দিয়া গো রাজা পুত্রমুখ দেখে॥৭৪
সুগন্ধি চন্দন যত ছিটায় গো রাজপথে।
শিশু দেখ্‌তে রাজগণ গো আইল শূন্য রথে॥৭৬
নেতের পতাকা উড়ে গো প্রতি ঘরে ঘরে।
বলিদান বাদ্যভাণ্ড গো দেবের মন্দিরে॥৭৮
আম্ৰশাখে পূর্ণ কুম্ভ গো তীর্থজলে ভরি।
হুলাহুলি কুলাকুলি গো দেয় কুলনারী॥৮০
যতেক নাটুয়াগণ করে গো নাচগান।
আনন্দেতে তুলপার গো করে পুরীখান॥৮২

মঙ্গল চণ্ডিকা পূজে গো দেবী সুবচনী।
বনদুর্গা পূজা করে গো ডরাই ডাকুনী॥৮৪
শীতলা-ষষ্ঠীর পূজা গো করে বিধিমতে।
মনসাদেবীরে পূজে গো নেতার সহিতে॥৮৬
ষাটিহারা[] দিন দেখি গো নামাকরণ কৈল।
গণিয়া বাছিয়া নাম গো পুরবাসী থৈল॥৮৮

কৌশল্যা রাখিল নাম গো কাঙ্গালের ধন।
দশরথ নাম রাখে গো অযোধ্যা-ভূষণ॥৯০

রাজ্যবাসী নাম রাখে গো রাম রঘুবর।
পুরনারী নাম রাখে গো শ্যামল সুন্দর॥৯২
ধ্যানেতে জানিয়া গো বশিষ্ঠ তপোধন।
নাম রাখে গো রামচন্দ্র কমল-লোচন॥৯৪

করকোষ্ঠী হেতু গো রাজা গণকে ডাকিল।
পুঞ্জি পুঁথি হাতে লৈয়া গো গণক আইল॥৯৬
খড়ি পাতি সাত পাঁচ গো ঘর যে আঁকিয়া।
গণক কোষ্ঠীর ফল গো কহিল ভাবিয়া॥৯৮
“জোর ভুরো দীপ্ত আঁখি গো সূর্য্য সম জ্বলে।
রাজটীকা আছে গো ঐ শিশুর কপালে॥১০০
আগুনে না পুড়িবে গো শিশু জলে নৈব তল।
ধনুকধারী হবে শিশু গো বলে মহাবল॥১০২
ইন্দ্রতুল্য পরাক্রান্ত গো রাজ্য অধিকারী।
মরিবে ইহার বাণে গো ত্রিজগতের বৈরী॥”১০৪
সপ্তম ঘরেতে গণক গো শূন্য যদি দিল।
গোপন ঘরের কথা গো গোপনে রাখিল॥১০৬

গোপন ঘরের কথা গো রাখিল গোপনে।
কপালের দোষে রাম গো যাইবেন বনে॥১০৮
ফলিবে সে ব্রহ্মশাপ গো পুত্রের কারণ।
এই পুত্র লাগি গো রাজা ত্যজিবে জীবন॥১১০
এইরূপ জন্মিলেন গো রাম রঘুপতি।
কৌশল্যা মায়ের পদে গো ভনে চন্দ্রাবতী॥১১২


প্রথম পরিচ্ছেদ সমাপ্ত

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

সীতার বারমাসী

(১)

সাত পাঁচ সখী বইসা গো জোড়-মন্দির ঘরে।
এক সখী কহে কথা গো জিজ্ঞাসে সীতারে॥
তুমি যে গেছ্‌লা গো সীতা এই বনবাসে।
কোন্ কোন্ দুঃখ পাইয়াছিলা গো কোন্ কোন্ মাসে॥

“আমার দুঃখের কথা গো কহিতে কাহিনী।
কহিতে কহিতে উঠে গো জ্বলন্ত আগুনী॥
জনম-দুঃখিনী সীতা গো দুঃখে গেল কাল।
রামের মতন পতি পাইয়া গো দুঃখেরি কপাল॥
এক ত দিনের কথা গো শুন সখীগণ।
চাইর বইন আছি গো মোরা মিথিলা ভুবন॥১০
আনন্দে কাটয়ে দিন গো শৈশবের বেলা।
মায়ের কোলেতে থাকি গো করি খেলাধূলা॥১২
বাপের আছিল পণ গো আচরিত কথা।
যে ভাঙ্গিবে শিবের ধনু গো তারে দিব সীতা॥১৪

কত রাজা আইল গো গেল সীমা-সংখ্যা নাই।
ধনুক ভাঙ্গিতে পারে গো সাধ্য কারো নাই॥১৬
একদিন রাত্রে আমি গো দেখিলাম স্বপন।
শিয়রে বসিয়া প্রভো গো কমল-লোচন॥১৮
‘উঠ উঠ জানকী গো কত নিদ্রা যাও।
আমি রামচন্দ্রে ডাকি গো আঁখি মেইল্যা চাও॥২০

বহুদূর দেশ হইতে গো আইলাম মিথিলা ভবন।
ভাঙ্গিব শিবের ধনু গো করিয়াছি পণ॥’২২

রজনী প্রভাত হইল গো ভাঙ্গিল স্বপন।
নয়নে লাগিয়া রৈল গো শ্যামল বরণ॥২৪
দুর্ব্বাদল শ্যাম তনু গো সঙ্গেতে লক্ষ্মণ।
আজি বুঝি সত্য হইল গো নিশার স্বপন॥২৬
সঙ্গেতে আসিলা তার গো বিশ্বামিত্র মুনি।
যজ্ঞস্থলে গেলা প্রভু গো রাম রঘুমণি॥২৮
মিথিলার লোকে দেখে গো বলে অতঃপর।
যেই জন দেখে বলে গো সীতার যোগ্য বর॥৩০
চন্দ্র সূর্য্য দুই ভাই গো নর-বেশ ধরি।
পণে উদ্ধারিতে বাপে গো আইল বুঝি পুরী॥৩২
আজানু-লম্বিত বাহু গো মুনির ইঙ্গিতে।
ভাঙ্গিল শিবের ধনু গো যেন অলক্ষিতে॥৩৪

জয় জয় শব্দ হইল গো মিথিলা ভবন।
নৃত্যগীত করে যত গো সহচরীগণ॥৩৬
মন্দ বর ধন্ধ লাগে গো কেউ বলে কালী।
কেউ বলে মেঘের গায়ে গো শোভিছে বিজলী॥৩৮
হাস্য পরিহাসে দেখ গো রজনী পোহায়।
সীতারে লইয়া প্রভো গো অযোধ্যাতে যায়॥৪০
আর ত দিনের কথা গো শুন মন দিয়া।
এই মতে প্রভোর সঙ্গে গো অভাগিনীর বিয়া॥৪২

অযোধ্যা নগরে আছি গো হরষিত মন।
শুইয়া প্রভুর কোলে গো দেখিলাম স্বপন॥৪৪
সিংহাসনে বসি প্রভু গো কমল-লোচন।
তার পাছে দাণ্ডাইল গো ভাই তিনজন॥৪৬

চামর ঢুলায় কেউ গো শিরে ছত্র ধরে।
যথাবিধি তিন ভাই গো পদসেবা করে॥৪৮
এর মধ্যে আর দিন গো দেখিলাম স্বপন।
রামচন্দ্র রাজা হবে গো অযোধ্যা ভুবন॥৫০

স্বপন সফল হইল গো কালি অধিবাস।
মন্থরা কুমন্ত্র দিয়া গো ঘটায় সর্ব্বনাশ॥৫২
রামচন্দ্র রাজা হবে গো পইরা তিলক ছটা।
বিমাতা কৈকেয়ী তারে গো পইরায় বাকল জটা॥৫৪
শরতের চান্দ যেন গো মেঘেতে ডুবিল।
সোণার অযোধ্যা পুরী গো অন্ধকার হইল॥”৫৬

(২)

“বৈশাখ মাসেতে দিন রে অরন্য প্রবেশ।
শিরে জটা প্রভু রামের গো সন্ন্যাসীর বেশ॥
জৈষ্ঠ মাসেতে দিন রে রবির বড় জ্বালা।
হাটিয়া যাইতে প্রভুর গে। বদন হৈল কালা॥
পাষাণে ঠেকিল পদ গো রক্ত পড়ে ধারে।
দুঃখিত হইয়া প্রভো গো সীতার অঙ্গে বাতাস করে॥
পদ্মপত্রে জল আনে গো ঠাকুর লক্ষ্মণ।
কতক্ষণ প্রভুর কোলে গো ছিলাম অচেতন॥
ঘুরিতে ঘুরিতে আইলাম গো আমরা তিনজন।
গোদাবরী নদীর কূল গো পঞ্চবটী বন॥১০
এইখানে রঘুনাথে গো কহিলা লক্ষ্মণে।
কুটির বান্ধিয়া গো বাস করি এইখানে॥১২
লতাপাতা দিয়া গো কুটির বান্ধিল লক্ষ্মণ।
কুটির-মধ্যে মোরা গো থাকি দুইজন॥১৪

বৃক্ষতলে দাণ্ডাইল গো দেবর লক্ষ্মণ।
ধনুহাতে দিবা নিশি গো রহে জাগরণ॥১৬
দেবরের গুণ আমি গো না পারি কহিতে।
অরণ্য ভাঙ্গিয়া গো ফল তুলি দেয় হাতে॥১৮
রসাল বনের ফল গো পাতার কুটির পাইয়া।
অযোধ্যার রাজ্যপাট গো গেলাম ভুলিয়া॥২০
লক্ষ্মণ কানন হইতে গো আনি দেয় ফল।
পদ্মপত্রে আনি আমি গো তমসার জল॥২২
চরণ ধুয়াইয়া প্রভুর গো তৃণ শয্যা পাতি।
মনের আনন্দে কাটি গো বনবাসের রাতি॥২৪

কি করিবে রাজ্যসুখ গো রাজসিংহাসনে।
শত রাজ্যপাট আমার গো প্রভুর চরণে॥২৬
ভোরেতে উঠিয়া মালা গো গাঁথি বনফুলে।

আনন্দে পরাই মালা গো প্রভু রামের গলে॥২৮


সুন্দর দীঘল প্রভুর গো বাহু উপাধান।
প্রত্যেক রজনী সীতার গো এমতি সয়ান॥৩০
মৃগ ময়ূর আর গো বনের পশুপাখী।
সীতার সঙ্গের সঙ্গী গো তারা সীতার দুঃখে দুঃখী॥৩২

শুকসারী ছিল দুই গো পঞ্চবটী বন।
বনে হইল প্রতিবাসী গো তারা দুইজন॥৩৪
কভু বা শুনায় গান গো শুক আর সারী।
কানন বেড়াই গো প্রভু রামের গলা ধরি॥৩৬
কায়ার সঙ্গেতে যেমন গো ছায়ার ঘূরণ।
পর্ব্বত-কাননে ঘুরি বেড়াই গো তিনজন॥৩৮
আর ত দিনের কথা গো শুন সখীগণ।
কপালে আছিল সীতার গো এতেক বিড়ম্বন॥৪০

(৩)

“পোহাইল সুখের নিশি গো আমি অভাগিনী।
বঞ্চিয়া প্রভুর সাথে গো সুখের রজনী॥
গগনেতে হইল বেলা গো দণ্ড তিন চারি।
সে দিনের দুঃখ কথা গো কহিতে না পারি॥
কুটিরের বাইরে বসি গো আমরা দুইজন।
তরুতলে বসিয়াছেন গো দেবর লক্ষ্মণ॥
বসিতে বসিতে মোর গো ঘুমে ঢুলে আঁখি।
অলস নয়নে গো প্রভুর চান্দমুখ দেখি॥
ঊরু উপাধান গো প্রভু পাতিল তখন।
অঞ্চল পাতিয়া গো আমি করিলাম শয়ন॥১০
এমন সময়ে এক গো সোনার হরিণী।
কুক্ষণে নজর পড়ে গো মুই অভাগিনী॥১২
মেঘের অঙ্গেতে যেমন গো বিজলীর ঝলা।
চলিছে সোণার মৃগ গো বন করি উজলা॥১৪
প্রভুরে কহিলাম আমি গো যুড়ি দুই পাণি।
এত যে হইবে গো নাহি জানি অভাগিনী॥১৬

‘এমন সুন্দর মৃগ গো কভু দেখি নাই।
সোনার হরিণ ধরি গো দেহ ত গোঁসাই॥১৮
শুক্‌না লতায় বান্ধি গো কুটিরের দ্বারে।
যাবৎ না মানে পোষ গো রাখিব ইহারে॥২০
অযোধ্যাতে যাব মোরা গো এই মৃগ লইয়া।
বনের চিহ্ন রাখ গো প্রভু ইহারে ধরিয়া॥’২২

হাতে ধনু উঠিলেন গো কমল-লোচন।
নাগপাশ অস্ত্র লইয়া গো করিয়া যতন॥২৪

‘হরিণ ধরিতে আমি গো চলিলাম বনে।
সীতারে রাখিও লক্ষ্মণ অতি সাবধানে॥’২৬

এত বলি প্রভু রাম গো করিলা গমন।
কতক্ষণ পরে শুনি গো প্রভুর ক্রন্দন॥২৮
‘কোথারে লক্ষ্মণ ভাই গো শীঘ্র কইর‍্যা আইস।
রাক্ষসের হাতে মোর প্রাণ হইল নাশ॥’৩০

শুইয়াছিলাম আমি গো বসিলাম উঠিয়া।
আর বার কহে প্রভু গো লক্ষ্মণে ডাকিয়া॥৩২
‘শুন শুন দেবর গো আমার মাথা খাও।
প্রভুরে রক্ষিতে তুমি শীঘ্র কইরা যাও॥’৩৪

হাতেতে ধনুর শর গো চলিলা লক্ষ্মণ।
চিন্তায় আকুল প্রাণ গো পবন-গমন॥৩৬
একাকিনী বনমধ্যে গো আমি অভাগিনী।
ভুজঙ্গ চলিল যেমন গো এড়াইয়া মণি॥৩৮
এত দুঃখ ছিল সীতার গো যদি জানিতাম।
মৃগ ধরিবারে প্রভুর গো সঙ্গে যাইতাম॥”৪০

(৪)

“শিবশঙ্কর নাম গো লইয়া আচম্বিতে।
দণ্ডাইল যোগী এক গো আসিয়া দ্বারেতে॥
দণ্ড-কমণ্ডলুধারী গো অঙ্গে মাখা ছাই।
দুয়ারে আসিয়া বলে গো ‘ভিক্ষা কিছু চাই॥’
‘কি ভিক্ষা দিব গো আমি শুনহ গোসাঞ।
শূন্যগৃহে একাকিনী গো প্রভু সঙ্গে নাই॥
আজি যদি থাকতাম আমি গো অযোধ্যা ভবনে।
ধামায় মাপিয়া গো দিতাম রত্নাদি কাঞ্চনে॥’

যোগী বলে ‘ধনে মোর গো নাহি প্রয়োজন।
ঘরে আছে বনের ফল গো তাই কর দান॥১০
ক্ষুধায় অবশ অঙ্গ গো আইলাম তব দ্বারে।
অতিথে না দিলে ভিক্ষা গো যাই তবে ফিরে॥’১২

একটি বনের ফল গো অঞ্চলে বান্ধিয়া।
কুটিরের বাহির হইলাম গো ভাবিয়া চিন্তিয়া॥১৪
আমি কি গো জানি সখি কালসর্পবেশে[]
এমনি করিয়া সীতায় গো ছলিবে রাক্ষসে॥১৬
প্রণাম করিনু আমি গো পড়িয়া ভূতলে।
উড়িয়া গরুড় পক্ষী গো সৰ্প যেমন গেলে॥১৮
রথেতে তুলিল মোরে গো দুষ্ট লঙ্কাপতি।
দেবগণে ডাকি কহি গো দুঃখের ভারতী॥২০
অঙ্গের আভরণ খুলি গো মারিনু রাক্ষসে।
পর্ব্বতে মারিলে ঢিল গো কিবা যায় আসে॥২২
কতক্ষণ পরে গো আমি হইলাম অচেতন।
এখনো স্মরিলে কথা গো হারাই চেতন॥২৪

জাগিয়া দেখিনু আমি গো আছি লঙ্কাপুরী।
আমারে বেড়িয়া পাশে গো বসি যত চেড়ী॥২৬
অশোক-কাননে গো বাস আমি অভাগিনী।
সেইদিন সাজিলাম গো যৌবনে যোগিনী॥২৮
বস্ত্র অলঙ্কার ত্যজি গো নিদ্রা ও আহার।
রাক্ষসের গৃহে থাকি গো করি অনাহার॥৩০

কান্দিয়া নয়ন গলে গো মৈলান হইল কেশ।
দিবানিশি জাগে প্রভুর গো সন্ন্যাসীর বেশ॥৩২
পাগলিনী হইল সীতা গো নাহি কিছু জ্ঞান।
প্রভুরে দেখিতে শুধু গো রাখিলাম প্রাণ॥৩৪
মরণে বাসনা নাই গো চরণ পাইবার আশে।
সীতার চক্ষের জলে গো অশোক-বন ভাসে॥”৩৬

(৫)

“আষাঢ় মাসেতে দিন রে ঘন বরিষণ।
তৰ্জ্জিয়া গৰ্জ্জিয়া আসে গো যত দেয়াগণ॥
মেঘে তত নাইকো পানি সীতার চক্ষে যত জল।
কান্দিয়া ভিজাই আমি গো অশোকের তল॥
বিষ খাই জলে ডুবি গো বুঝিতে না পারি।
সান্ত্বনা করিয়া রাখে গো সরমা সুন্দরী॥

শ্রাবণ মাসেতে আমি গো দেখিনু স্বপন।
হইল প্রভুর সঙ্গে গো সুগ্রীব-মিলন॥

ভাদ্রে স্বপন দেখি গো দিবসে জাগিয়া।
অশোকের ডালে পক্ষী গো বসিল উড়িয়া॥১০
পক্ষী নয় পক্ষী নয় গো প্রভু রামের চর[]
বীর হনুমান বৈসে গো ডালের উপর॥১২
কত ভাবে মতে গো সীতারে বুঝায়।
প্রাণ ত বুঝে না গো সীতার হইল বড় দায়॥১৪
রামের অঙ্গুরী বীর গো দেখাইল মোরে।
অঙ্গুরী দেখিতে সীতার গো অশ্রু পড়ে ধারে॥১৬
পাইল রামচন্দ্র গো সীতার বারতা।
তারপর শুন গো সীতা উদ্ধারের কথা॥১৮

আশ্বিন মাসেতে সীতা গো দেখিলা স্বপন।
বনেতে করেন প্রভু গো অকাল-বোধন॥২০
রাবণ বধিতে প্রভু গো পুজেন অম্বিকায়।
সীতার দুঃখের দিন গো এইরূপে যায়॥২২

কার্ত্তিক মাসেতে দিন রে ছোট হইল বেলা।
কান্দিয়া কাটাই দিন গো বসিয়া একেলা॥২৪
নয়নের জলে মোর গো নদী বইয়া যায়।
সুখের বারতা আইস্যা গো সরম। জানায়॥২৬
কান্দিতে কান্দিতে সাঁতার গো অস্থিচর্ম্ম-সার
এত দুঃখ ছিল বিধি গো কপালে আমার॥২৮

অগ্রহায়ণ মাসেতে শুনি গো বৃক্ষ আর পাথরে।
দুরন্ত সাগর, আসি গো, বান্ধিল বানরে[১০]৩০

পৌষ মাসেতে দিন রে পৌষ অন্ধকার।
বানর-কটকে ঘিরে গো লঙ্কার চারিধার॥৩২

মাঘ মাসেতে আমি গো দেখিনু স্বপন।
রণে মরে ইন্দ্রজিত গো রাবণ-নন্দন॥৩৪
স্বপন সফল হইল গো লঙ্কা ছারখার।
সাগরের কূলে শুনি গো রাক্ষসের হাহাকার॥৩৬
ফাল্গুন মাসেতে আমি গো দেখিনু স্বপনে।
সবংশে মরিল রাবণ গো শ্রীরামের বাণে॥৩৮
স্বপন সফল হইল গো দুঃখের দিন যায়।
বানর-কটক শুনি গো রামগুণ গায়॥৪০

চৈত্র মাসেতে সীতার গো দুঃখ হইল দূর।
পোহাইল দুঃখের নিশি গো আইল সুখ ভোর॥৪২
অন্ধেতে পাইল যেমন গো নয়নের মণি।
তেমতি দুঃখিনী সীতা গো পাইল রঘুমণি॥”৪৪

সীতার বারমাসী কথা গো দুঃখের ভারতী।
বারমাসের দুঃখের কথা গো ভনে চন্দ্রাবতী॥৪৬


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ সমাপ্ত

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

সীতার বনবাসের পূর্ব্ব-সূচনা

(১)

সুখ-বসন্তের কথা গো শুন সখীগণ।
রতন-মন্দিরে বসি গো কৌশল্যা-নন্দন॥
উপরে চান্দোর টাঙ্গায় গো নীচে শীতল পাটি।
রামসীতা বসিলেন গো হাতে পাশার কাটি॥
আবের পাখায় বাতাস গো করে সখীগণ।
কৌতুকে করেন রাম গো প্রেম-আলাপন॥

গুয়া পান খায় কেহ গো হাসে খলখলি।
চান্দেরে ঘেরিয়া যেন গো তারার মণ্ডলী॥
সুবর্ণের গুটিতে গো ঘর সাজাইয়া।
রামচন্দ্র খেলে পাশ। গো সীতারে লইয়া॥১০
লক্ষ্মীর সহিত পাশা গো খেলে নারায়ণে।
ইন্দ্র যেন খেলে পাশা গো শচীরাণী সনে॥১২
মদনের সহিত পাশা গো খেলে যেন রতি।
হরের সহিত কিংবা গো খেলায় পার্ব্বতী॥১৪
হাসিয়া কহিছে তবে গো সহচরীগণ।
“এক কথা শুন রাম গো কমল-লোচন॥১৬
হার-জিত হবে যেই গো আগে কর পণ।
হারিলে জিতিলে কিবা গো দিবে কোন্ জন॥”১৮

শ্রীরাম বলেন “পাশায় গো আমি যদি হারি।
হস্ত হইতে দিব খুলে গো রতন-অঙ্গুরী॥২০

জানকী হারিলে বল গো দিবে কিবা পণ।”
সখীগণ বলে “দিবে গো প্রেম-আলিঙ্গন॥”২২

লাজে অধোমুখী গো সীতা পড়িলেন ঢলি।
পত্রের ভারেতে যথা গো চম্পকের কলি॥২৪
পড়িল পাশার দান গো খেলিতে খেলিতে।
হারিলেন রামচন্দ্র গো সীতাদেবী জিতে॥২৬

হাসিতে হাসিতে তবে গো যত সহচরী।
সীতারে বেড়িল গো রামে দিয়া টিটকারী॥২৮
জোর করি শ্রীরামের গো অঙ্গুরী খসাইয়া।
সীতার অঙ্গুলে সখী গো দিল পরাইয়া॥৩০
“পুরুষ হইয়া হারে গো রমণীর সনে।”
তিরস্কার করে রামে গো মিষ্ট আলাপনে॥৩২

ছয় তিন কাঁচাগুঁটি গো পাকা যে হইল।
এইবার সীতাদেবী গো পণেতে হারিল॥৩৪
হাসিয়া শ্রীরাম ক’ন গো সহচরীগণে।
“প্রতিজ্ঞা-পালন কথা গো আছে কিনা মনে॥”৩৬
আড়িকুলা করি তবে গো যতেক সঙ্গিনী।
শ্রীরামের কুলে দিলা গে। জনক-নন্দিনী॥৩৮
চুম্বন করিয়া সীতায় গো বলেন রঘুবর।
“যাহা ইচ্ছা মনোমত গো বাছি লও বর॥”৪০

চন্দ্রা কহে পোহাইল গো সুখের রজনী।
সাবধানে মাগ বর গো জনক-নন্দিনী॥৪২
ধীরে ধীরে ক’ন সীতা গো রামের গোচরে।
“মনের বাসনা প্রভু গো কহি যে তোমারে॥৪৪
বহুদিন হইতে মোর গো আশা ছিল মনে।
আর বার বেড়াইব গো পুণ্য তপোবনে॥৪৬

তমসা নদীর কথা গো সদা পড়ে মনে।
রাজহংসী খেলা করে গো কমল-কাননে॥৪৮
তমালের ডালে নাচে গো ময়ূরাময়ূরী।
সোনার হরিণী ছিল গো মোর সহচরী॥৫০
প্রতি নিশি স্বপ্ন দেখি গো মুনিকন্যাগণে।
তোমার সঙ্গেতে যেন গো বেড়াই বনে বনে॥”৫২

চুম্বন করিয়া রাম গো কহেন সীতারে।
“আজ নিশি কর বাস গো রতন-মন্দিরে॥৫৪
কালি প্রাতে আশা তব করিব পূরণ।
লক্ষ্মণ সহিতে তোমা গো পাঠাইব বন॥”৫৬
চন্দ্রা কহে দৈবদুঃখ গো না যায় খণ্ডানি।
কি বর মাগিলে গো হায় জনক-নন্দিনী॥৫৮

(২)

শয়ন-মন্দিরে একা গো সীতা ঠাকুরাণী।
সোণার পালঙ্কোপরি গো ফুলের বিছানী॥
চারিদিকে শোভে তার গো সুগন্ধি কমল।
সুবর্ণ-ভৃঙ্গার ভরা গো সরযুর জল॥
নানাজাতি ফল আছে গো সুগন্ধে রসিয়া।
যাহা চায় তাহা দেয় গো সখীরা আনিয়া॥
ঘন ঘন হাই উঠে গো নয়ন চঞ্চল।
অল্প অবশ অঙ্গ গো মুখে উঠে জল॥

উপকথা সীতারে গো শুনায় আলাপিনী।
হেন কালে আস্‌ল তথায় গো কুকুয়া ননদিনী॥১০

কুকুয়া বলিছে “বধূ গো মম বাক্য ধর।
কিরূপে বঞ্চিলা তুমি গো রাবণের ঘর॥১২

দেখি নাই রাক্ষসে গো শুনিতে কাঁপে হিয়া।
দশমুণ্ড রাবণ রাজা গো দেখাও আঁকিয়া॥”১৪

মুর্চ্ছিতা হইল সীতা গো রাবণ-নাম শুনি।
কেহ বা বাতাস দেয় গো কেহ মুখে পানি॥১৬
সখীগণ কুকুয়ারে গো করিল বারণ।
“অনুচিত কথা তুমি গো বল কি কারণ॥১৮
রাজার আদেশ নাই গো বলিতে কুকথা।
তবে কেন ঠাকুরাণীর গো মনে দিলে ব্যথা॥”২০
প্রবোধ না মানে গো কুকুয়া ননদিনী।
বার বার সীতারে গো বলয়ে সেই বাণী॥২২

সীতা বলে “আমি তারে গো না দেখি কখন।
কিরূপে আঁকিব আমি গো পাপিষ্ঠ রাবণ॥”২৪
যত করি বুঝান সীতা গো কুকুয়া না ছাড়ে।
হাসিমুখে সীতারে গো সুধায় বারে বারে॥২৬

বিষলতার বিষফল গো বিষগাছের গোটা।
অন্তরে বিষের হাসি গো বাধাইল লেঠা॥২৮
সীতা বলে “দেখিয়াছি গো ছায়ার আকারে।
হরিয়া যখন দুষ্ট গো লয়ে যায় মোরে॥৩০
সাগর-জলেতে পরে গো রাক্ষসের ছায়া।
দশ মুণ্ড কুড়ি হাত গো রাক্ষসের কায়া॥”৩২

বসি ছিল কুকুয়া গো শুইল পালঙ্কেতে।
আবার সীতারে কয় গো রাবণ আঁকিতে॥৩৪
এড়াতে না পারে সীতা গো পাখার উপর।
আঁকিলেন দশমুণ্ড গো রাজা লঙ্কেশ্বর॥৩৬

শ্রমেতে কাতর সীতা গো নিদ্রায় ঢালল।
কুকুয়া তালের পাখা গো বুকে তুলি দিল॥৩৮

(৩)

কালসাপিনী কুকুয়া গো কালকূটে ভরা।
সীতার মুখ দেখতে নারে গো এম্‌নি কপালপোড়া॥
কুরূপা কুৎসিতা সে যে গো ক্রুর ও মুখরা।
শিখায়ে পালিয়ে বড় গো কইরাছে মন্থরা॥

কৈকেয়ীর কন্যা সে যে গো ছোট ভরতের।
রাজার ঘরে বিয়া হইয়া গো কপালের ফের॥
শ্বশুর শাশুড়ী তার গো দুই চক্ষের বালি।
পাড়ার লোকেরা ডাকে গো নিন্দুক কুন্দলী॥

বাতাসে করিয়া ভর গো পাতয়ে কুন্দল।
ঔষধ খাওয়াইয়া কর্‌ছে গো স্বামীরে পাগল॥১০
দেবর ভাসুরে খেদায় গো দিয়া বেড়াবাড়ি।
পরের কলঙ্ক গাইয়া গো ফিরে বাড়ী বাড়ী॥১২
পরের কলঙ্ক কথায় গো কুকুয়। দশমুখ।
স্বামি-স্ত্রীতে কোন্দল বাধায় গো দেখিতে কৌতুক॥১৪

সধবা হইয়া কুকুয়া গো কার্য্য-দোষে রাঁড়ী।
দশ বচ্ছর ধইর‍্যা কেবল আছে বাপের বাড়ী॥১৬
রাম-সীতার সুখ তার গো পরাণে না সয়।
অন্তরে বিষের ধার গো হেসে কথা কয়॥১৮

বসে আছেন রামচন্দ্র গো রত্ন-সিংহাসনে।
উপনীত হইল গিয়া গো শ্রীরামের স্থানে॥২০
কালনাগিনী যেমন গো ছাড়িয়া নিশ্বাস।
দণ্ডাইল কুকুয়া গো শ্রীরামের পাশ॥২২

নয়নে আগুনি তার গো ঘন শ্বাস বহে।
তৰ্জ্জিয়। গৰ্জ্জিয়া তবে গো শ্রীরামেরে কহে॥২৪

“শুন শুন দাদা ওগো কহি যে তোমারে।
বলিতে পাপের কথা গো বাক্য নাহি সরে॥
সীতা ধ্যান সীতা জ্ঞান দাদা গো সীতা চিন্তামণি[১১]
প্রাণের চাইতে অধিক তোমার গো জনক-নন্দিনী॥
বিশ্বাস না কর কথা গো না শুনিলে কাণে।
অসতী নিলাজ সীতা গো ভজিল রাবণে॥
কি কব সীতার কথা গো কইতে লাগে ভয়।
পড়িলে তোমার কোপে গো জীবন সংশয়।
রূপসী দেখিয়া দাদা গো আপনি মজিলে।
রঘুবংশে কালি দিতে গো সাঁতারে আনিলে॥
এক নয় দুই নয় গো পূর্ণ দশ মাস।
আছিল তোমার সীতা গো রাবণের পাশ॥
বলিলে রাবণের কথা গো সীতার চক্ষে বহে ধারা।
মুখ ফিরাইয়া কান্দে দাদা গো তোমার নয়ন-তারা॥
সংসার না বুঝ দাদা গো তুমি ত সরল।
অমৃত ভাবিয়া দাদা গো পিইলে গরল॥
জানিয়া পুষ্পের মালা গো দাদা পরিলে গলায়।
সময় পাইয়া কালনাগিনী গো দংশিল তোমায়॥
চণ্ডালে ছুঁইলে ফুল গো না লাগে পূজায়।
কুকুরের উচ্ছিষ্ট অন্ন গো লোকে নাহি খায়॥৪৪
বিশ্বাস না কর দাদা গো দেখহ আসিয়া।
তোমার সীতা নিদ্রা যায় গো রাবণ বুকে লইয়া॥”৪৬


হরিণী মারিতে যেমন গো বাঘিনী ধায় রড়ে[১২]
শীঘ্রগতি পশে দুইয়ে সাঁতার মন্দিরে॥৪৮

পঞ্চমাসের গর্ভ সীতা গো অলসে ঘুমায়।
অঙ্গুলি হেলাইয়া কুকুয়া গো রামেরে দেখায়॥৫০

শিরেতে হানিল বাজ গো বাক্য নাহি সরে।
চলিয়া গেলেন রাম গো আপন মন্দিরে॥৫২
বিষবাণ বিন্ধিল গো শ্রীরামের পরাণে।
সর্ব্বনাশের কথা সীতা গো কিছুই না জানে॥৫৪

বনেতে আগুনি জ্বলে গো সায়রে ছোটে বান[১৩]
উন্মত্ত পাগল প্রায় গো বসিলেন রাম॥৫৬
রাঙ্গা জবা আঁখি রামের গো শিরে রক্ত উঠে।
নাসিকায় অগ্নিশ্বাস ব্রহ্মরন্ধ্র ফুটে॥৫৮
যে আগুন জ্বালাইল আজ গো কুকুয়া ননদিনী।
সে আগুনে পুড়িবে সীতা গো সহিত রঘুমণি॥৬০
পুড়িবে অযোধ্যাপুরী গো কিছু দিন পরে।
লক্ষ্মীশূন্য হইয়া রাজ্য গো যাবে ছারখারে॥৬২
পরের কথা কাণে লইলে গো নিজের সর্ব্বনাশ।
চন্দ্রাবতী কহে রামের গো বুদ্ধি হইল নাশ॥৬৪

(অসম্পূর্ণ)

  1. বিশাই=বিশ্বকর্ম্মা।
  2. পরিহার=ক্ষমা।
  3. বিরম্মন=বিড়ম্বনা।
  4. পারা=পাহারা
  5. হাটের····দিন=নিজের ক্ষেত নাই, হাট হইতে চাল কিনিয়া খাইতে হইত; নিজের পুকুর নাই পরের ঘাট হইতে জল লইয়া খাইতে হইত।
  6. সইলতা=সল্‌তে।
  7. ষাটিহারা দিন=ষষ্ঠীর দিন।
  8. এই রামায়ণের অনেকাংশের সঙ্গে মেঘনাদবধ কাব্যের আশ্চর্য্য রকমের ঐক্য দৃষ্ট হয়, আমার ধারণা, মাইকেল নিশ্চয়ই চন্দ্রাবতীর রামায়ণ গান শুনিয়াছিলেন, এই গান পূর্ব্ববঙ্গের বহুস্থানে প্রচলিত ছিল এবং এখনও আছে।
  9. পক্ষী নয়......চর=ঠিক অরূপ কথা মহুয়ায় আছে।
  10. দুরন্ত সাগর······বানরে=বানর আসিয়া দুরম্ভ সাগরকে বন্ধন করিল
  11. চিন্তামণি=একরূপ বহুমুল্য মণি, যাহার গুণে যাহা চিন্তা করা যায় তাহাই লাভ হয়।
  12. রড়ে=বেগে।
  13. বনেতে......বান=বনেতে আগুন লাগিলে অথবা নদীতে বান ডাকিলে যেরূপ ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়, রামকে সেইরূপ ভয়ঙ্কর দেখাইতেছিল।