পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/সন্নমালা

সন্ন (স্বর্ণ) মালা

 সন্নমালা পালাটি শ্রীযুক্ত চন্দ্রকুমার দে দুই বৎসর পূর্ব্বে ময়মনসিং হইতে সংগ্রহ করেন। সম্পূর্ণ পালাটি পাওয়া যায় নাই। যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহাতে ২৭৮ পঙ্‌ক্তি আছে। এই পালাটির মধ্যে ছন্দের একটা বৈচিত্র্য আছে। স্থানে স্থানে পয়ার কিংবা ত্রিপদী এই দুই প্রচলিত ছন্দের কোনটিই অবলম্বিত হয় নাই। ঘটক-কারিকা, ডাক ও খনার বচন প্রভৃতিতে যে স্বল্পাক্ষর ছন্দ দৃষ্ট হয় এই পালার মধ্যেও সেইরূপ। ৭৷৮৷৯৷১০ অক্ষরের ছত্র আছে। পালাটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় পাওয়া গিয়াছে, সুতরাং ইহাতে চরিত্রগুলি ফুটিয়া উঠে নাই। কিন্তু নায়িকার যে একনিষ্ঠ প্রেমের আভাস এই অসমাপ্ত কাব্যে পাওয়া যায়, তদ্দ্বারা মনে হয় যে পালার শেষভাগে তিনি খুব গৌরবমণ্ডিত হইয়া উঠিয়াছিলেন। প্রাচীন পালাসাহিত্য ভাল করিয়া পাঠ করিলে দেখা যাইবে যে সৰ্পদষ্ট স্বামীর প্রাণলাভের জন্য সতী-পত্নীর প্রাণান্ত চেষ্টা শুধু বেহুলা চরিত্রেই বর্ণিত হয় নাই। পূর্ব্ব কালের বহু উপাখ্যানে নায়িকাদের এইরূপ প্রচেষ্টার উদাহরণ দেখা যাইত। বেহুলার উপাখ্যান একটি বিশেষ ধর্ম্মের অন্তবর্ত্তী হওয়াতে সাধারণ্যে তাহার প্রচার খুব বেশী হইয়াছে। কিন্তু দেশময় বেহুলা-জাতীয় স্ত্রী-চরিত্রের উদাহরণ ছিল। পরবর্ত্তী বেহুলা উপাখ্যানগুলি যে সেই সব দৃষ্টান্ত দ্বারা পুষ্টিলাভ করিয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই।

 বাগানে কোন ফুলটি ঝরিয়া পড়ে এবং কোনটি বা সম্পূর্ণ সৌন্দর্য্যসম্পদে মণ্ডিত হইয়া শাখায় ফুটিয়া উঠে। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক বেহুলা বিলীন হইয়া গিয়াছেন। মনসাদেবীর বরে সাহ সদাগরের কন্যা অমরবর লাভ করিয়াছেন। সন্নমালা পালাটিতে স্বভাব-সৌন্দর্য্যের বর্ণনা অনেক স্থলে খুব চিত্তহারী হইয়াছে। রাজকন্যা বনবাসিনী হইয়া রাজপ্রসাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক যে গভীর জঙ্গলে বাস করিয়াছিলেন তাহার নৈসৰ্গিক সৌন্দর্য্য কবি যথাযথভাবে অঙ্কন করিয়াছেন। রাজপ্রাসাদ-সংলগ্ন উদ্যানবাটিকায় সখীদ্বয়ের মিলনও বেশ কবিত্বপূর্ণ। পালাগানটিতে একটা গ্রাম্য সৌন্দর্য্যের হাওয়া বহিয়া গিয়াছে। সেইটুকুই ইহার বিশেষত্ব।

 কুসংস্কারবশতঃ অপয়া শিশুকে বধ করা কিংবা বনবাস দেওয়া আমাদের দেশের একটা কাব্যকথা নহে। বঙ্গের শিশুদের অনেককে যেরূপ তাহাদের পিতামাতা নিজ হাতে তুলিয়া গঙ্গাসাগরে নিক্ষেপ করিয়াছেন, সেইরূপই নির্ম্মমভাবে আবার অনেকগুলি শিশুকে তাঁহারা পথে ফেলিয়া দিয়াছেন, কিংবা বনে শুকাইয়া মরিবার জন্য পরিত্যাগ করিয়াছেন। কাপালিকেরা কত শিশু চুরি করিয়া দেবতার পীঠস্থানে বলি দিয়াছে। শিশুদের পক্ষে এই কুসংস্কার মড়কের তুল্যই ভীষণ। আমরা কাজলরেখা পালায় (প্রথম খণ্ড, পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা) এইরূপ কুসংস্কারের পরিচয় পাইয়াছি। সুসঙ্গ দুৰ্গাপুরের রাণী কমলাও এইরূপ এক কুসংস্কারে স্বীয় জীবন বিসর্জ্জন দিয়াছিলেন। ইতিহাসেও আমরা এইরূপ কুসংস্কারের কিছু কিছু পরিচয় পাইতেছি। বঙ্গ-গগনের জ্বলন্তসূর্য্য প্রতাপাদিত্যকেও নিতান্ত দুর্ভাগা শিশু মনে করিয়া তঁহার পিতা বিক্রমাদিত্য বধ করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন। জ্যোতির্ব্বিদেরা গণনা করিয়া ঠিক করিয়াছিলেন যে এই শিশুর দ্বারা রাজপরিবারের এবং দেশের গুরুতর অনিষ্ট হইবে। প্রতাপাদিত্যের খুল্লতাত বসন্ত রায়ের চেষ্টায় শিশু প্রতাপাদিত্যের প্রাণরক্ষা হয়।

 আমাদের এই পালাগানগুলির ভিতরে সমাজ, রাজনীতি, ভাষাতত্ত্ব ও কবিত্ব প্রভৃতি সম্বন্ধে নানাদিক্ দিয়াই অনেক মূল্যবান্ উপাদান পাওয়া যায়। বঙ্গদেশীয় জনসাধারণের ইতিহাস-লেখক নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে এই উপকরণগুলি মূল্যবান্ মনে করিবেন।

শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন

সন্নমালা

সন্নমালা

(১)

কথায়:— 
উজলা মাণিক, উজলা মাণিক,
জন্ম লৈল রাজার ঘরে
দিন দিন বাড়ে॥
চান[১] সূরুজ[২] তারা—
মায়ের বুক জোরা[৩]
চান সুরুজ তারা—
বাপের আঁখি তারা॥
ঘর খানি আলা দুয়ার খানি ঝালা[৪]
মায় বাপে রাখে, নাম সন্নমালা॥
সুরে:— 
আর ভাই রে ভাই—
আত্তিশালায়[৫] আছে ওরে আত্তি[৬], ভালা কথা,
ঘোড়া না শালে ঘোড়া।১২
ডাকে নামে ছিলাইন[৭] ওগো রাজা, ভালা,
পুব দেশ জোরা নারে—
আরে ভাই, ধামায় মাপ্যা ধন রাজার ভাণ্ডারে ত আছেরে
বংশে বাত্তি দিতে রাজার এক পুত্রু নাহিরে॥১৬

কথায়:— 
ঘর আন্ধার বাড়ী আন্ধার।
রাজা-রাণীর কাঁদন-কাটি সার॥১৮
বেপার-বাণিজ্যে পায় রে ধন পায়।
ষষ্ঠী নাই সে দিলে পুত পাইব কোথায়॥২০
দেব-দোয়ারে মানে, মানে পীরের ছিন্নি—
আঁটকুরা রাজার না হয় পুত্রু, না হয় কন্যা॥২২

 [কতকদিন এই রকমে কাটিলে, রাজার ঘরে কন্যা জন্ম লইল। মাতাপিতা খুব আদর করিয়া তাহার নাম রাখিলেন।]

কথায়:— 
সন্নের বরণ কন্যা ভালা।
নাম রাখে সন্নমালা॥২৪
মায় বাপে গৈরব করে—
আসমানে জ্বলে কি রে
তারা আর চান[৮]
আমার না সন্নমালা পুন্নুমাসীর[৯] চান॥২৮
জমিনে[১০] জ্বলে কিরে মাণিক মণি রতন।
আমার না সন্নমালা সাত রাজার ধন॥৩০

সুরে:— 
এক মাস দুই মাস আরে তিন মাস না গেল।
দিন দিন করা মায়ের না কোলে শিশু বাড়িতে
লাগিল রে॥৩৩

ছয় মাসের বাড়ন কন্যা বাড়ে এক না মাসে।
মায়ের কোলেতে কন্যা চান্দ সমান হাসে রে॥৩৪
সেই হাসি ঝইড়া না পড়ে ভালা মায়ের আইঞ্চলে।
লইক্ষ লইক্ষ চুম্ব না দিয়া মায় কন্যা লয় কোলে॥৩৬
কথায়:— 
ডুগ ডাগর[১১] আঁখি।
তারার সমান দেখি॥৩৮
লাম্বা[১২] কেশ উড়ে।
আডু[১৩] বাইয়া পড়ে
বান্ধি বা না বান্ধি॥৪১
ধাই দাসীরে ডাইক্যা কয় রাণী।
“বহু দুঃখে পাইয়াছি কন্যা দেব-দুয়ারে মানি[১৪]॥”৪৩

 তখন রাজ। করলাইন কি, যত যত গণক আছিল তাঁর রাজ্যে সক্কলরে আন্‌ল ডাকিয়া।

“ওরে গণক গণ্যা কুশল কও
ধামায় মাপ্যা ধন লও
কন্যার আয়ু বর—
কি মত উতুরিব তার বিয়ার ঘর॥”৪৭

 “ভয়ে কি নিভ্‌ভয়ে মহারাজ?”

 “কও নিভ্‌ভয়ে।”

 তখন গণক গণ্যা কইল।

সুরে:— 
“শুন শুন আরে রাজা
কইয়া না বুঝাই তুমারে রে।
কৈন্যা যে জন্ম্যাছে রাজা
এই না তুমার ঘরে রে॥
অলক্ষ্মীর অংশে জন্ম
কৈন্যার, শুন নরপতি।
এহি কন্যার লাগ্যা তোমার
নিবিব ঘরের বাতি॥৫৫
আত্তি[১৫] ঘোড়া মৈরা যাইব, রাজা,
যত পোষা প্রাণী।
টুইয়ে[১৬] ত লাগিব রাজা তোমার
দুপুরে আগুনি॥৫৯
রাজভাণ্ডারের ধন, রাজা, ফুঁয়ে[১৭] যাইব উড়ি।
দিনে দিনে অইবারে[১৮] তুমি কড়ার ভিখারী॥৬১
দেশে দেশে ভর্‌মিবারে রাজা, রাজা আরে,
কানন, বনে বনে॥৬৩
কবিলা[১৯] ছাড়িব ঘাস তোমার
দুঃখের কারণে॥৬৫
পাষাণ না মিলাইব,[২০] রাজা, আরে দেইখ্যা তোমার দশা।
দিনে দিনে আশা তোমার হইব নৈরাশা॥৬৭

পুরীতে সন্ধ্যার বাত্তি, রাজা,
আর জ্বলে বা না জ্বলে।৬৯
সিতাবী[২১] কন্যারে রাজা
পাঠাও বনবাসে॥”৭১

(২)

পুরীতে উঠিল আরে কান্দনের রোল।
রাজা কান্দে, রাণী কান্দে, কান্দে ধাই-দাসী॥
মায়েরে বুঝায় কন্যা, বাপেরে বুঝায়।
“কি লাগিয়া কান্দ মাগো, কি পইরাছে দায়[২২]
হিয়ার মাংস কাট্টা দিলে মাগো
দুঃখু তোমার যায়।
সেইত কাটিয়া মাগো
দিবাম তোমার দায়॥”
রাজা কান্দে, রাণী কান্দে, ভালা আরে,
এক্কই খাটে বৈয়া[২৩]
জলন্ত আগুনি মায়ের উঠে রৈয়া রৈয়া॥১১
“দশ মাস দশ না দিন গো তোরে রাখ্যাছি উদরে।
স্তইনের না দুগ্ধু দিয়া মাগো পাল্যাছি তোমারে॥১৩
পালা কুড়া জ্বালা[২৪] বুঝে মাগো পাল্যাছে যে জন।”
ঝিয়ের না ধইরা গলা মায় জুড়িল কান্দন॥১৫
“শুন শুন পরাণের ঝি গো
তোরে বনে না দিয়া।১৭
কি সুখে থাকিবাম ঘরে গো
কোন্ বা ধন লইয়া॥১৯

সোণামণি হাড়াইয়া[২৫] গেল মোর
আইঞ্চলে কেন গির[২৬]২১
রাজ্য ছাইড়া সঙ্গেত ভালা
হইবাম বনান্তর॥”২৩
ঝিয়ে ত কান্দিয়া বুঝায় “মা গো কহি যে তোমারে।
আমার লাগ্যা না কর সে দুঃখু ছাইড়া দেহ আমারে॥২৫
জন্ম ত দিয়াছ বাপ-মাও গো কপাল দিবা কি?
কপালে ত আছে তোমার মাগো বনবাসী ঝি॥”২৭

এহি মতে কান্দন-কাটি সাত দিন রাইত না।
কন্যারে লইয়া রাজা বনে চলিলাইন আপনে॥২৯
আরে ভালা বাঘ না ভালুক না রে ঘোর জঙ্গলায় বাসা।
রাজ্য ছাড়িয়া অইল কন্যার জঙ্গলাতে বাসা॥৩১
কামেলা[২৭] যতেক মিলি হুকুম পাইল।
পাতালতা দিয়া ভালা খয়রাত[২৮] করিল॥৩৩
বান্ধিয়া ছান্দিয়া ঘর রাজা কন্যারে কহিল।
“তোমার বরাতে মাগো এত দুঃখু ছিল॥৩৫
জনম তোমার মাও গো জোড়-মন্দির ঘরে।
সোণার পালঙ্গে শুইতা মাগো পুষ্পের উপরে॥৩৭
আর মাগো কোন্ বিধি ভাঙ্গিল তোর এমন সুখের বাসা।
রাজার বাড়ী ছাইড়া অইল মাগো কুঁড়ে ঘরে বাসা॥”৩৯

এই মতে কাইন্দা বাপ গো হইল বিদায়।
বনবাসে সন্নমালার এক মাস যায়॥৪১

(৩)

 অইল কি, সাধু সদাগর বাণিজ্যে যায়। বার বচ্ছরের পারি[২৯] সঙ্গে লৈয়া। সাত ডিঙ্গা ধন, সাত খান পাল, সাত মাসের খোরাক, সাত রাজ্য ভরমণ[৩০]। দেশে রাজা কৈয়া দিছে—এই এই চিজ-বস্তু[৩১] আমি চাই, না অইলে সদাগরের গর্দ্দান যাইব।

ভরা সায়র অলছ্-তলছ্[৩২] পানি।
কোন্‌ দৈবে করল দুষ্‌মনী॥

 বনের কাছে আইয়া সাত ডিঙ্গা চড়ে[৩৩] আইটকা গেল, তখন সাধু সদাগর মাঝি-মাল্লারে কয়, “ও মাঝি-মাল্লাগণ।”—“কও কও সদাগর কিবা বিবারণ।” “বনে উঠ্যা দেখ চাই বনে আছে কোন্ দেবতা, কোন্ বা পীর। পীরের সিন্নি দিবাম, দেবতার দিবাম পূজা। ভরা সায়রে দিল চড়া। সাত মাসে না ফিরি রাজা লইব গর্দ্দান।”

সুরে:— 
তবে মাঝি-মাল্লাগণে বন ভাঙ্গিয়া বিচারে[৩৪]
গাছ বিরিক্ষ যত দেখে একে একে॥
বাঘ ভালুক না দেখে ময়ূরা-ময়ূরী।
হরিণ না হরিণা দেখে ত ভালা জঙ্গলার পরী॥
হীরামণ শাড়ী[৩৫] দাড়াকের[৩৬] ডালে।
সোণালী কৈতরা[৩৭] দেখে সোণা এন[৩৮] জ্বলে॥
এর মধ্যে দেখে কন্যা সোণার বরণ।
ডিঙ্গায় ফিরিয়া তারা কয় বিবারণ॥১০

“শুন শুন সাধু আর কৈয়া বুঝাই তোরে রে।
জঙ্গলায় দেখিলাম আচানক্যা[৩৯] কন্যা এক
বসতি না করে॥১২
দানাপরী হবে কি হবে বনের দেবতা।
এমন সুন্দর রূপ নাহি দেখি কোথা॥”১৪

তবে সাধু সদাগর মেলা যে করিল।
কন্যার নিকটে গিয়া দরিশন দিল॥১৬
আইঞ্চল বিছাইয়া কন্যা শুইয়া নিদ্রা যায়।
মা মা বলিয়া সাধু কন্যারে জিগায়॥১৮

“কোথা কারে সুন্দর কন্যা আইলা কোথা হইতে।
রাজার ছাওয়াল[৪০] কেন আইলা বনেতে॥২০
আসমানের চান্দ কেন জমিনে বিছান।
মাও বাপ কন্যা লো তোর জিয়ন্তের পাষাণ॥২২
কেমন কইরা কন্যা লো তোরে কোন্ পরাণে ছাড়ি।
এমুন বয়স কালে লো কৈল বনচারী।”২৪

“শুন শুন ধর্ম্মের বাপ গো কহি যে তোমারে।
জন্ম লইয়া ছিলাম আমি এক রাজার ঘরে॥২৬
নিষ্ঠুরা হইয়া মাও বাপে কর্‌লো বনবাসী।
কান্দিয়া কাটিয়া আমি গো পোহাই দিবানিশি॥”২৮

 কন্যা তখন সাধুর কাছে যত বিরি বিত্তান্ত[৪১] এক এক কইর‍্যা সকল কইল। তখন সাধু কইল, যা থাকে কপালে এই কন্যারে লইয়া যাইবাম দেশে।

 আচরিত কথা; যখনে সাধু কন্যারে ডিঙ্গায় তুল্যা লইল তখন ডিঙ্গা পানির উপর ভাস্যা উঠ্‌ল। কন্যার রূপে ডিঙ্গা উজল, পানি তর্ তর্, কন্যার রূপে সাত ডিঙ্গা পশর[৪২]। সাত মাস ঘুইর‍্যা সাধু বাড়ী চল্ল। এইবার বাণিজ্যে তার দোন দ্বিগুণ[৪৩] লাভ। পনে কাউন;[৪৪] জিরায় হীরা;[৪৫] সাধুর আনন্দ দেখে কে? মার্ মার্ কইর‍্যা সাত মাসের সাত দিন থাকতে ঘাটে ডিঙ্গা লাগ্‌ল। গলুইয়ে[৪৬] ধান, দূর্ব্বা‌, সিন্দুর। সদাগরের সাত নারী ডিঙ্গা আর্ঘ্যা[৪৭] পুচ্ছা[৪৮] ঘরে ধন-দৌলত নিল তুল্যা॥

ধন নিল দৌলত নিল রে আর বা নিল কি?
নিছিয়া পুঁছিয়া[৪৯] লৈল সদাগরের ঝি॥৩০
এক পুত্র আছিল সাধুর আরে ভালা অন্ধের নয়ন।
দেখিতে সুন্দর কুমার সোণার বরণ॥৩২
কিছু কিছু কুমারে সাধু শিখায় লিখাপড়া।
কিছু কিছু শিখায় সাধু বাণিজ্য-বেপার॥৩৪
কুড়ি বচ্ছর যায় কুমার পড়িল যৌবন।
এন কালে কন্যার সাথে হইল দরিশন॥৩৬

 দুইজনে একইখান বৈয়া লিখাপড়া করে। সদাগরপুত্র কন্যারে হাত ধইরা লিখাপড়া শিখায়। এই মতে যায় দিন। পরথম যৌবন, চাঁদ-সুরুজে মিলন। তারা দুই জনরে দেখ্‌লে চৌখের ঘুম পল্‌কে[৫০] যায়, পেটের ভুক্[৫১] লুকায়। যে দেখে, কয়—কি সুন্দর দুইজনে। সোণার পঙ্খী, পঙ্খিনী!

মাথায় লৈয়া পুষ্পের ডালা কন্যা ফুল তুলিতে যায়।
শিরে ত চিকুন কেশ পায়ে ত লুটায়॥৩৮
পুষ্প না তুলিয়া কন্যা গাঁথে ফুলের মালা।
সাধু-পুতের গলায় মালা বিনাইত[৫২] উজালা॥৪০

এক দিনের কথা কন্যা কোন্ কাম করিল।
লিখিতে লিখিতে কলম ভালা ভূমিতে পড়িল॥৪২
পরথম যৈবন কন্যা অঙ্গ হইল ভারী।
আলসে ভাঙ্গিয়া পড়ে বেকুলা[৫৩] সুন্দরী॥৪৪

“শুন শুন কুমার আরে কৈয়া বুঝাই তোমারে।
উঠিতে না পারি আমি গা যেন কেমুন করে॥৪৬
কলম তুলিয়া কুমার রে তুল্যা দেও মোর হাতে।
মাথা খাও নবীন রে কুমার লাজে নাই সে বাঁচি॥৪৮
পড়ায় নাহিক মন রে হইলাম উদাসী॥
আজি যদি ক্ষেমা রে কর কুমার আর সে নাহি চাই।
আমার পড়ার স্থান করবাম অন্য ঠাঁই॥”৫১

“সত্য কর সুন্দর রে কন্যা সত্য কর বৈয়া—
যুদি দেই তুলিয়া কলম মোরে কর্‌ব কিনা বিয়ারে!”৫৩

“পরের ঘরে থাকিরে কুমার পরের ঘরে বাসী।
কিবা সত্য কর্‌বাম আমি হইয়া পরের দাসী॥৫৫
কিবা সত্য কর্‌বাম কুমার, কুমার আরে, কি দেই বা উত্তর।
ভাবিয়া চিন্তিয়া আমার গায়ে উঠিল্ জ্বর॥৫৭
ভাবিয়া চিন্তিয়া আমার মাথায় হইল বিষ।
কিবা ন করিব সত্য নাই সে আমার দিশ॥৫৯

বাপে খেদাইল কুমার অলক্ষ্মী জানিয়া।
বেকুল[৫৪] জঙ্গলার মধ্যে নিব্বাস[৫৫] দিল রে নিয়া॥৬১
গাছের গলা ধইরা কান্দিরে কুমার এই করলাইন[৫৬] ধাতা[৫৭]
আমার কান্দনে ঝড়ে দারাকের[৫৮] পাতা॥৬৩
দুই আখ্‌খির জলেরে কুমার, কুমার আরে, বসুমাতা ভিজে।
পালঙ্ক ছাড়িয়া শয়ান কঠিনা মাটির শেজে[৫৯]৬৫
আমারে করিলে বিয়া পড়িবে বিপাকে।
গাইষ্ঠে[৬০] বাইন্ধা নিজের মন্দ পরে কেবা দেখে॥৬৭
অধম অলক্ষ্মী কন্যা, কুমার রে, বাপে খেদাইল।
সংসারের যত লোক ঠাঁই নাই সে দিল॥৬৯
ক্ষেমা কর সুন্দর কুমার, কুমার রে, চিত্তে ক্ষেমা দিয়া।
কত কত রাজার কন্যা মায় করাইব বিয়া॥৭১
যদি যাইরে গাছের তলে অভাগীর কর্ম্মদোষে।
সেও গাছ জ্বলিয়া যায় মোর কর্ম্মের বাতাসে॥৭৩
জলে গেলে শুকায় জল কেউ না দেয় থান[৬১]
সুন্দর পুরীতে নাই সে দেও অলক্ষ্মীরে স্থান॥”৭৫

“শুন শুন সুন্দর কন্যা তুমি না ভাবিয়।
সকল ছাড়িয়া কন্যা কর্‌বাম তোরে বিয়া লো॥৭৭
ভরা বানিজ্জি মোর উভে[৬২] হউক তল।
তোমারে দেখিয়া কন্যা হইয়াছি পাগল॥৭৯
ভাল মন্দ আমার হবে লো কন্যা তোমার নাই সে দায়।
সত্য কর সুন্দর কন্যা গায়ে দিয়া হাত॥”৮১

“সত্য করিলাম রে কুমার এই খানে ত বসি।
আজি হইতে হইলাম কুমার শ্রীচরণের দাসী॥৮৩

* * * *

তবে ত তুলিয়া কলম কন্যার হাতে দিল॥৮৫

(8)

 কন্যার রূপের কথা সহরে বাজারে রাষ্ট-পষ্ট। গায় গেরামে শুনে। রাজায় পরজায় জানে। চান্দের সমান রূপ উজল ঘরের বাতি। সদাগর বন থাক্যা আন্‌ছে পরথম যৈবন কন্যা রূপবতী। এরে শুইনা রাজার কন্যা কর্‌ল কি, চামর ধামর দুই ধাই-দাসী পাঠাইল সদাগরের কাছে। রূপবতী কন্যার সাথে রাজকন্যা পাতবা সহেলা[৬৩]। ‘সদাগর সদাগর বাড়ীত নি[৬৪] আছ? রাজকন্যা পাঠাইল তোমার কন্যা দেখতো। তার বড় সাধ আলা ঝালা গলার মালা তোমার কন্যার সাথে রাজ কন্যার অইব সহেলা। ঢুলী ডগরী যে যেখানে আছে এতমনদার[৬৫] খেজমতকার[৬৬] সকলের নিমন্তন আজ, রাজকন্যার সঙ্গে সদাগর কন্যার সহেলা।’

রাজ না বাড়ীর আগে পুষ্পের বাগান।
মধুমাসে ডালে বইস। কুইলায়[৬৭] করে গান॥

আকর বাকর চাম্পা নাহি হয় বাসি।
ফুট্যা রইছে গন্ধরাজ সোণালী অতসী॥
দুই সইয়ে কোলাকুলি বনে ত বেড়ায়।
মধুমাসে ডালে বইসা কুইলাতে গায়॥
পরথম যৈবন দোঁহে রূপে ত উজালা।
পুষ্প তুলিয়া দোঁহে গাথে বনমালা॥
দৈবের নিবন্ধ কথা কহন না যায়।
ছিড়িল কন্যার কেশ আকড়[৬৮] কাঁটায়॥১০
দিশা— রূপের বাহার গো, ঝাড়িয়া বান্ধিত মাথার কেশ।

রাজকুমার


“শুন শুন পরাণের বইন গো কইয়া বুঝাই তরে।
কোন্ জনে আইল কাইল বাগান ভরমণে॥”১২

রাজকন্যা


“শুন শুন প্রাণের ভাই কইবাম তোমায়
কালুকা বেড়াইয়া গেল সদাগরের ঝি॥”১৪

রাজকুমার


“শুন শুন পরাণের বইন গো কহি যে তোমায়।
কি মত দেখিতে কন্যা দেখ্‌বানি যায়॥”১৬

রাজকন্যা


“শুন শুন পরাণের ভাইরে বলি তোমার ঠাঁই।
এমতি সুন্দর রূপ তিরভুবনে নাই রে॥১৮
এক তিল রূপ না কন্যার লক্ষ টাকার মুল।
হাঁটিতে ভূমিত পড়ে দীঘল মাথার চুল॥২০

বন থাক্যা সদাগর আনিল পাইয়া।
সহেলা পাত্যাছি আমি সুন্দর দেখিয়া॥২২
পরীর সমান রূপ অঙ্গে নাই সে ধরে।
হাঁটিয়া যাইতে রূপ তার তিলে তিলে ঝরে॥”২৪

রাজকুমার


“শুন শুন প্রাণের বইন গো কহি যে তোমারে।
অছিলা[৬৯] ধরিয়া কন্যা দেখাও আমারে॥”২৬

 পরদিন আবার নিমন্তন। দুই সইয়ে কোলাকুলি হুলাহুলি। গাছের পাতায় লুকাইয়া রাজপুত্র রূপ দেখিয়া পাগল।..........

 “শুন পরাণের বইন, আমি পরতিজ্ঞা করছি।”

 “কি পরতিজ্ঞা কইরাছ?”

 “এই কেশ যার, তায় বিয়া করবাম। আর যদি না পাই তা অইলে জোড়-মন্দির ঘরে না খাইয়া না লাইয়া[৭০] পরাণ তেগ্‌বাম[৭১]।”

 রাজকন্যা তখন একদিন চুপি চুপি সদাগর-কন্যার মনের কথা লৈল। অনেক দুঃখ কইরা কন্যা তখন বাপের বাড়ীর কথা হইতে আরম্ভ না কইর‍্যা বনবাসের কথা কইল। একটা কথাও গোপন কর্‌ল না। সদাগর-পুত্রের সাথে সত্য করনের কথা, তাও কইল। কইল যে সত্যের কারণ আম্‌রার বিয়া অইয়া গেছে, একথা কেউ জানে না।

“শুন শুন পরাণের সই গো কহি যে তোমারে।
আমার গোপন কথা তুমি না কইয়ো গো কারে॥২৮
একদিন হস্তের কলম গো ভূমিতে পড়িল।
সেই কলম সাধুর পুত্রু হস্তে তুল্যা দিল॥৩০
সত্য কইর্‌লাম রাজার কন্যা গো কলম হাতে লইয়া।
শুন শুন সাধুর পুত্রু তোমায় করবাম বিয়া॥৩২

আকড় অতসী চাপা ফুট্যা হইল বাসি।
আজি হইতে হইলাম তোমার শ্রীচরণের দাসী॥”৩৪

যত ইতিকথা কন্যার ভাইয়েরে জানায়।
কুবুদ্ধি রাজার পুত্রু রহে অছিলায়[৭২]৩৬

 রাজপুত্র জোড়-মন্দিরের কপাট লাগাইয়া শুইল, খায় না ঘুমায় না। রাজ্য জুড়িয়া হুলুস্থুল। রাজারাণী পাগল। রাজপুত্র কেন এমন, জান্‌তে জান্‌তে জান্‌ল রাজপুত্র এক ধন চায়। কি ধন চায়। “সাপের মাথার মণি।” রাজা সদাগররে ডাক্যা কইল, “আজ থাক্যা ছয় মাসের মধ্যে সাপের মণি আন্যা হাজির কর, নইলে জান-বাচ্ছার[৭৩] গর্দ্দান যাইব।” সদাগর চিন্তায় পড়ল। বাণিজ্য কইর‍্যা মাথার চুল পাকাইছে, দাঁত পড়ছে, রাজার বন্দরে কত কত রাজার দেশে গিয়াছে,— সাপের মণি কোনো দিন দেখে নাই। লোকে কয় শুনা কথা—

বড় দুঃখিত হইল সদাগর কহে পুত্রে আগে।
“এতক দিন পরে পুত্রু খাইল জংলার বাঘে॥৩৮
রাজার হুকুম হইল আনতে সাপের মণি।
কোথায় জ্বলে সাপের মণি শব্দেও না শুনি॥”৪০

সাধু-পুত্র কহে “বাপগো না চিন্তিও তুমি।
বাণিজ্য কারণে আইজ যাইবাম আমি॥৪২
অতিবৃদ্ধ অইলা তুমি, ঘরে বইস্যা খাই।
ডিঙ্গা সাজাইয়া দেও গো বাণিজ্যেতে যাই॥”৪৪

মায় মানা বাপে মানা, মানা নাই সে শুনে।
যাইব সাধুর পুত্রু বাণিজ্য কারণে॥৪৬
“শুন শুন সুন্দর কন্যা কহি যে তোমারে।
ছয় মাস থাক তুমি আমার বাপের পুরে॥৪৮

রাজার আদেশ হইল আন্‌তে সাপের মণি।
বিরধ[৭৪] বাপে না পাঠাইব যাইব আপনি॥”৫০

ধরিয়া চাঁচর কেশ কন্যা পা দুখানি মুছে।
“এইত চরণ ছাড়া আমার সংসারে কি আছে॥৫২
ভালমন্দ নাই সে জানি অন্য নাই সে চাই।
বিদেশে বিপাকে রক্ষা করুন গোঁসাই॥”৫৪

 লাল নিশান, নীল নিশান উড়াইয়া সদাগর-পুত্রু যায় বৈদেশে। সাত শ ডঙ্কা ঘন ঘন বাজে। কে যায় বাণিজ্যে? সদাগরের পুত্রু। নগরের লোকে জয় জয়। ছয় মাস পর সাধু-পুত্রু দেশে ফির্‌ল। সাপের মণি নাই, আচাভুয়া[৭৫] কথা। সদাগর-পুত্রু পা’র[৭৬] পর্ব্বত ভাইঙ্গা হাজার-বিজার[৭৭] সাপ ধইরা আন্‌ছে; লগে[৭৮] তার একদল বাদ্যা—শঙ্খরাজ, মণিরাজ, মাছুয়া, চিলাবাকা, খৈয়াগোক্ষুরা। সাপ আছে মণি নাই। রাজা গোঁসা হইল। অত শত সাপের মণি সদাগর-পুত্রু সম্বরিয়া লৈছে; রাজারে ফাঁকি দিছে। এই সাপ দিয়া সদাগর-পুত্রুরে খাওয়াও, তবে আমার পুত্রু বাঁচে। রাজার হুকুম পাইয়া লোক জনে সদাগর-পুত্রের হাতে গলায় ছাইন্ধা বাইন্ধা সাপের মুখে ফালাইয়া দিল।

কালত গরল বিষরে অঙ্গ ছাইল।
কাল বিষের জ্বালায় সাধু-পুত্রু পরাণ ত্যজিল॥৫৬
সোণার বরণ অঙ্গ, বিষে হইল ছালী[৭৯]
সাধু সদাগর কাঁদে পুত্রু পুত্রু বলি॥৫৮
মরা পুত্রু কোলে কান্দে সাধুর না নারী।
নগরিয়া লোকে কান্দে করি হাহাকারি॥
সাপের ডৌকা[৮০] পুড়িতে[৮১] ভাইরে দেশাচারে মানা॥৬১

বান্ধিল ডাগর ভেরা[৮২] নগরের লোকে।
নেহালি[৮৩] নেহালি সাধু পুত্রু মুখ দেখে॥৬৩
ভেরায় তুলিয়া পুত্রু ভাসাইল জলে।
কান্দিয়া বেকুলা কন্যা ভাসে আখ্‌খি জলে॥৬৫

“শুন শুন ধর্ম্মের রাজা কহি যে তোমারে।
সাগর শুকাইল আমার কপালের দোষে॥৬৭
বিরখ নীচে খাড়াইলাম ছায়া পাইবার দায়।
সেই বিরখ জ্বলিয়া গিয়া হইল অঙ্গার॥৬৯
তুমি ত ধর্ম্মের রাজা রাজ্য অধিপতি।
পতির সঙ্গে ত যাইতে কর অনুমতি॥৭১
সদাগর শ্বশুর ওগো মোর কথা ধর।
স্বামীর সহিত যাইতে গো অনুমতি কর॥৭৩
জান না না জান বিয়া গো করিল আমারে।
অল্প কালে ত পতি গো ছাইড়া যায় সে মোরে॥৭৫

কার বা বাড়া ভাতে গো দিয়াছিলাম ছালী[৮৪]
কপাল খাইতে মোরে কে দিলরে গালী॥৭৭
কোন্ কাঁচী[৮৫] বাছুরার[৮৬] গলা না টিপিয়া।
মায়ের উরের[৮৭] দুধ খাইছিলাম কাড়িয়া॥৭৯
কার পুত্রু খাইলাম জানি[৮৮] বাঘুনী হইয়া।
কার ধন বা হইরাছিলাম[৮৯] গো মাথায় বাড়ি[৯০] দিয়া॥৮১
সাপিনী হইয়া খাইলাম কোন্ বা বাসার ছাও[৯১]
কোন্ দোষে পতি আমার, মোরে ছাইড়া যাও॥”৮৩

দুই চইক্ষের জলে কন্যার নদী নালা ভাসে।
ঢেউয়ের উপর ভেরা মরা লৈয়া ভাসে॥৮৫
ভাসিয়া চলিল ভেরা মরারে লৈয়া।
পাছে পাছে চলে কন্যা পাগল হইয়া॥৮৭
নদীর না পাড়ে পাড়ে কন্যা কান্দিয়া বেড়ায়।
আইঞ্চল ধরিয়া কন্যা দুই চোখ্ মুছে।
চলিল সুন্দর কন্যা মরা স্বামীর পাছে॥৯০

(অসমাপ্ত)


  1. চান=চাঁদ।
  2. সূরুজ=সূর্য্য।
  3. জোরা=জোড়া।
  4. ঝালা=আলা-ঝালা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
  5. আত্তিশালায়=হাতীশালা।
  6. আত্তি=হস্তী।
  7. ছিলাইন=ছিল
  8. চান=চন্দ্র।
  9. পুন্নু মাসীর=পৌর্ণমাসীর।
  10. জমিনে=মাটিতে।
  11. ডুগ ডাগর=বড় বড়, সুন্দর।
  12. লাম্বা=লম্বা।
  13. আডু=হাঁটু।
  14. দেব-দুয়ারে মানি=দেবের দুয়ারে মানত করিয়া।
  15. আত্তি=হাতী।
  16. টুইয়ে=খড়ো ঘরের উপরকার কাঠের বাঁধন, অথবা চালা ঘরের উপরে যে অংশে চালে চালে জোড়া দেওয়া হয়।
  17. ফুঁয়ে=ফুঁদ্বারা, ফুৎকারে।
  18. অইবারে=হইবে।
  19. কবিলা=কপিলা গাভী; গরু তোমার দুঃখে আর ঘাস খাইবে না।
  20. পাষাণ না মিলাইব=তোমার দশা দেখিয়া পাষাণ গলিয়া যাইবে।
  21. সিতাবী=শীঘ্র।
  22. দায়=বিপদে, সঙ্কটাপন্ন অবস্থায়।
  23. বৈয়া=বসিয়া।
  24. পালা কুড়া জ্বালা=পোষা কুড়া-পাখীর জন্য শোক।
  25. হাড়াইয়া=হারাইয়া।
  26. গির=গিয়া, গাঁইট্; পশ্চিমবঙ্গে এইরূপ একটা প্রবাদ আছে “সোণা বাইরে আঁচলে গিরে।” এখানে অর্থ এই যে সোণা এবং মণি হারাইয়া গিয়াছে, সুতরাং এখন আঁচলে গিরে দেওয়া বৃথা।
  27. কামেলা=মজুর।
  28. খয়রাত=(?)
  29. পারি=প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি।
  30. ভরমণ=ভ্রমণ
  31. চিজ-বস্তু=দ্রব্যাদি।
  32. অলছ্-তলছ্=উত্তাল তরঙ্গ যুক্ত।
  33. চড়ে=চরে, চরভূমিতে।
  34. বিচারে=অনুসন্ধান করে।
  35. শাড়ী=শারী পাখী।
  36. দাড়াকের=এক প্রকার বৃহৎ বন্য বৃক্ষ।
  37. কৈতরা=কপোত।
  38. এন=হেন, মতন।
  39. আচানক্যা=হঠাৎ।
  40. ছাওয়াল=সন্তান।
  41. বিরি বিত্তান্ত=বিস্তারিত কাহিনী। এই ‘বিরি’ শব্দের কোন অর্থ নাই, শুধু ইহা কথার পিঠে একটা কথা; বোধ হয় “বৃত্তান্ত” শব্দটির বিস্তারিত ভাব বুঝাইবার জন্য উহা ব্যবহৃত হইয়াছে।
  42. পশর=আলো।
  43. দোন দ্বিগুণ=দোন শব্দটী এখানে নিরর্থ; “দোন-দ্বিগুণ” একই কথার পুনরাবৃত্তি মাত্র।
  44. পনে কাউন=এক পনে এক কাহন লাভ।
  45. জিরায় হীরা=জিরা বিক্রয় করিয়া হীরা লাভ।
  46. গলুই=নৌকার অগ্রভাগ।
  47. আর্ঘ্যা=অর্ঘ্য দান করিয়া।
  48. পুচ্ছ্যা=পুছিয়া।
  49. নিছিয়া পুঁছিয়া=অতি যত্নপূর্ব্বক অঙ্গাদি মার্জ্জনা করিয়া।
  50. পল্‌কে=পলকমাত্র সময়ে চলিয়া যায়।
  51. ভুক্‌=ক্ষুধা।
  52. বিনাইত=মানাইত, শোভা পাইত
  53. বেকুলা=ব্যাকুল।
  54. বেকুল=গভীর, নিবিড়।
  55. নিব্বাস=নির্ব্বাসন।
  56. করলাইন=করিলেন।
  57. ধাতা=বিধাতা।
  58. দারাকের=বৃহৎ বৃক্ষ-বিশেষ।
  59. শেজে=বিছানায়।
  60. গাইষ্ঠে=গিঁঠে।
  61. থান=স্থান।
  62. উভে=সমস্ত।
  63. সহেলা=সই। এই ‘সই পাতান’ বঙ্গের একটা বড় সুন্দর উৎসব ছিল। শুধু মেয়েতে মেয়েতে নয়, পুরুষে পুরুষেও সখ্য পাতান হইত। তাহাতে বাদ্যভাণ্ড প্রভৃতি উৎসবোচিত সমস্ত ব্যাপারই অনুষ্ঠিত হইত এবং পরস্পরের সুখে দুঃখে আজীবন ভাগী হওয়ার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হইত। এখনকার মত শুধু বাক্যে মাত্র পরিণত বন্ধুত্ব তখন ছিল না।
  64. নি=প্রশ্নার্থসূচক অব্যয়, আছ নি? গেছ নি? করবা নি?—আছ কি? গেছ কি? করবে কি?’র তুল্য।
  65. এতমনদার=যাহারা নির্ভর করে, আশ্রিত ব্যক্তিগণ।
  66. খেজমতকার=খিদমগার, চাকর-বাকর।
  67. কুইলায়=কোকিল।
  68. আকড় কাঁটা=আকড়ার কাঁটা, যথা চৈতন্য-ভাগবতে—“আকড়ার কাঁটা দেয় মাথার উপরে।”
  69. অছিলা=ছুতা, ছল।
  70. লাইয়া=নাহিয়া, স্নান করিয়া।
  71. তেগবাম=ত্যাগ করিব।
  72. অছিলার=ছুতার অপেক্ষা করিয়া।
  73. জান-বাচ্ছার=ছেলেপুলে সকলের।
  74. বিরধ=বৃদ্ধ।
  75. আচাভুয়া=ফাঁকা, বাজে।
  76. পা’র=পাহাড়।
  77. হাজার-বিজার=হাজার হাজার।
  78. লগে=সঙ্গে।
  79. ছালী=ছাই; ভস্মের মত কৃষ্ণবর্ণ।
  80. ডৌকা=মড়া; শব।
  81. পুড়িতে=পোড়াইতে।
  82. ভেরা=ভেলা।
  83. নেহালি=নিরীক্ষণ করিয়া, সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করিয়া
  84. ছালী=ছাই।
  85. কাঁচী=কচি, অল্পবয়স্ক।
  86. বাছুরার=বাছুরের।
  87. উরের=বক্ষের।
  88. জানি=জানি না।
  89. হইরাছিলাম=হরণ করিয়াছিলাম।
  90. বাড়ি=লাঠি।
  91. ছাও=শাবক।