পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/পীর বাতাসী

পীর বাতাসী

 পীর বাতাসী পালাটি শ্রীযুক্ত চন্দ্রকুমার দের সংগ্রহ। তিনি লিখিয়াছেন, দুই বৎসরের অবিশ্রান্ত চেষ্টায় এই পালাটি সংগৃহীত হইয়াছে। এই পালাটির অধিকাংশ আজমীরিবাজার নিবাসী বৃন্দাবন বৈরাগীর নিকট হইতে পাওয়া গিয়াছে। অবশিষ্টাংশ লক্ষ্মীগঞ্জ নিবাসী শ্রীদাম পাটুনী ও জগবন্ধু গায়েনের নিকট হইতে সংগৃহীত হইয়াছে। গায়ক এই পালাটির সঙ্গে যে বন্দনা জুড়িয়া দিয়াছিলেন, তাহা হইতে জানা যায় যে কিছু পূর্ব্বে এদেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিশেষরূপ প্রীতির ভাব বিদ্যমান ছিল। মুসলমান গায়ক মক্কা-মদিনার সঙ্গে কাশী ও গয়াকেও প্রণাম করিয়া গীতি সুরু করিয়া দিয়াছেন। আমরা পালাগানে বারংবার এই সদ্ভাবের পরিচয় পাইতেছি; ইহা প্রকৃতই প্রতিবেশিজনােচিত সৌহার্দ্দ্যের নিদর্শন এবং হিন্দু ও মুসলমান এই দুই বৃহৎ সম্প্রদায় এক সময়ে ধর্ম্মগত পার্থক্য সত্ত্বেও যে কিরূপ আত্মীয়তার ভাবে আবদ্ধ ছিলেন, তাহা বিশেষভাবে প্রমাণ করিয়া দিতেছে।

 এই জল-জঙ্গলপূর্ণ বাঙ্গালার মাটিতে বিশেষতঃ বৃহৎ নদ-নদী-সঙ্কল পূর্ব্ববঙ্গে সর্পভীতি খুবই স্বাভাবিক। বহু পালাগানের উপাখ্যান-ভাগে আমরা সৰ্পদষ্ট ব্যক্তিদের বিবরণ পাইতেছি এবং বারংবারই বেহুলার ন্যায় সতীদিগের স্বামীর জন্য আশ্চর্য্য কষ্টসহিষ্ণুতা ও ত্যাগস্বীকারের দৃষ্টান্ত দেখিতেছি।

 পালার নায়িকা দুইটি—সুজন্তী ও বাতাসী। উভয়েই ভ্রষ্টা, স্বামীর প্রতি বিদ্রোহী; অথচ কবি ইহাদের এই গুরুতর সামাজিক অপরাধের উপর এরূপ অবহেলার সহিত চোখ বুলাইয়া গিয়াছেন যে আমাদের মনে হয় এই সকল গান ঠিক হিন্দু সমাজের জিনিষ নয়। কিছুদূর উত্তর-পূর্ব্বে গাড়ো পাহাড়ের চাকমা জাতির মধ্যে কিংবা ব্রহ্মদেশে ও আরাকানে বৌদ্ধ সমাজে নারীদিগের অনেকটা স্বাধীনতা দৃষ্ট হয়। এই স্বাধীনতার প্রভাব প্রতিবেশী হিন্দু ও মুসলমান সমাজ সম্পূর্ণরূপে এড়াইতে পারে নাই। সম্ভবতঃ এইজন্য এই গানগুলিতে সামাজিক নীতির কতকটা শিথিলতা দৃষ্ট হয়। হিন্দুদের চক্ষেই ইহা বেশী বাজে। কারণ এখানে সতীত্বের কড়াকড়ি বেশী। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও বলিতে হইবে যে এই গানগুলি অতি সহজে এবং নৈসৰ্গিক ভাবের প্রেরণায় রচিত হইয়াছিল। রচকেরা সমাজের কোন ধারই ধারেন নাই। এই বন-জঙ্গলের অধিবাসীরা যেন বন-জঙ্গলের পাখীর মতই স্বাধীনভাবে স্বীয় কাকলীর দ্বারা সকলকে মোহিত করিয়াছেন। তাঁহারা ব্রাহ্মণ্য সমাজ ও হিন্দু আদর্শের কোন ধারই ধারেন নাই, অথচ অন্ততঃ বাতাসীর চরিত্র আমাদের নিকট বড়ই করুণাত্মক এবং একনিষ্ঠ প্রেমের পরিচায়ক বলিয়া মনে হইতেছে। কবি তাহার বিবাহের ইঙ্গিত মাত্র আভাস দিয়া সে প্রসঙ্গ একেবারেই ছাড়িয়া দিয়াছেন, যেন বিষয়টা তাহার জীবনের একেবারেই গুরুতর ঘটনা নহে। এখানে কবি প্রেমকেই সর্ব্বাপেক্ষা বড় করিয়া দেখাইয়াছেন। বিবাহ, সতীত্ব-ধর্ম্ম, সামাজিক নিন্দা-প্রশংসা এসকল যেন অতি তুচ্ছ বিষয়। প্রাসঙ্গিক ভাবেও এ সম্বন্ধে কবি কিছু বলেন নাই। বাতাসীর অনুরাগ একনিষ্ঠ। সে যখন নদীর তীরে চোখের জল মুছিতে মুছিতে তাহার নায়ককে বিদায় দিতেছে, আমাদের সেই চিত্রই মনে পড়ে। যেখানে বাতাসী জলে নিমজ্জিত মুমুর্ষূ নায়কের মস্তক ক্রোড়ে ধারণ করিয়া প্রেমের প্রথম সুরের মোহিনী মুগ্ধ হইয়া তাহার সেবা করিতেছে, আমাদের সেই চিত্রই মনে পড়ে। অবশেষে যেখানে সে তাহার প্রাণাপেক্ষা প্রিয় বিনাথের মৃত্যুতে একেবারে সমস্ত সংযম হারাইয়া আত্মহত্যা করিতেছে, সেই পদ্মার স্রোতের ন্যায় দুৰ্দ্ধমনীয় প্রেমের তরঙ্গই আসিয়া তখন আমাদের হৃদয়ে অভিঘাত করে। সেই শেষ চিত্রের করুণরস উপলব্ধি করিতে করিতে যখন আমরা পালাটি সাঙ্গ করি তখন সমস্ত দৃশ্য, সমস্ত ঘটনা, সুমাই ওঝার অসাধারণ মন্ত্রশক্তি এবং ভীষণ ষড়যন্ত্র—এ সমস্ত ছাপাইয়া এই পতিদ্রোহী সমাজনিন্দিতা বাতাসীর ছবিটিই আমাদের মানসচক্ষে উজ্জ্বল হইয়া উঠে। এই সকল পালাগানে সমাজের, ধর্ম্মের, লৌকিক সংস্কারের জয় বর্ণিত হয় নাই। সর্ব্বত্রই প্রেমের জয়। এই প্রেম ইন্দ্রিয় লালসার সামগ্রী নহে। ইহা তপস্বীর তপস্যা ও সাধকের সাধনা। বেহুলা যে হিসাবে সতী, সে হিসাবে হয়ত বাতাসী অসতী, কিন্তু তথাপি ইহাদের উভয়ই এক পঙ্‌ক্তিতে স্থান পাইবার যোগ্য বলিয়া আমাদের মনে হয়। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে শারীরিক মিলনটার উপরও কবিরা কোনই জোর দেন নাই। “আঁধাবন্ধু”র পালায়ও আমরা তাহাই দেখি। এই সকল প্রেম-কাহিনীতে আত্মার পরিপূর্ণ ঐশ্বর্য্য দৃষ্ট হয়। একনিষ্ঠ প্রেম শরীর-নিরপেক্ষ, এই সাহসিক বর্ণনা এ ভাবে পৃথিবীর আর কোন কবি দিয়াছেন কি না জানি না। সদ্যোবিকশিত পদ্ম যেরূপ বৃন্তে ভর করিয়া পঙ্ক ও সলিল উভয় হইতেই অনেক উৰ্দ্ধে উঠে—এই একনিষ্ঠ প্রেম সেইরূপ জাগতিক অপরাপর সমস্ত কথার উৰ্দ্ধে উঠিয়াছে। অথচ পল্লীকবি একেবারেই প্রচারকের আসন গ্রহণ করেন নাই। তাঁহার ভাবগুলি স্বতঃ উচ্ছ্বসিত।

শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন

পীর বাতাসী

পীর বাতাসী

বন্দনা

বন্দুম পীর বন্দুম ছাহেব গাজিরে
বল হায় মুরলী হায়রে
পীর বন্দুম ছাহেব গাজিরে।
পরথমে বন্দনা গো করলাম আল্লা নিরঞ্জন।
বন্দুম পীর............
দ্বিতীয়ে বন্দনা গো করলাম মাও বাপের চরণ।
বন্দুম পীর............
তিতিয়ে বন্দনা গো করলাম ওস্তাদ বড় পীর।
বন্দুম পীর............
চারকোণা পিরথিমী বইন্দা মন করিলাম থির।
বন্দুম পীর............
সভাজনে বন্দিয়া ভাই হিন্দু মুসলমান।
বন্দুম পীর............
মক্কা মদীনা বন্দুলাম কালী গয়া থান।
বন্দুম..................
আর বন্দুলাম পার বন্দুলাম সমুদ্র সায়র।
জিন্দা স্থানে বন্দি আইলাম ছায়ব আলীর কয়বর
বন্দুম..................
হিমালী পর্ব্বত বন্দি গাই বেবাকের বড়।
আসর বন্দিয়া আমি মন করিলাম দড়।
বন্দুম..................

আসন থাইক্যা জিন্দাগাজী মোরে দেউখাইন[১] বর।
ভাল মান নাইসে জানি সদা মনে ডর॥
বন্দুম.................
আয়বার বন্দিয়া গাই সভার চরণ।
বন্দনা করিয়া ইতি পালা আরম্ভন॥২৬


(পালা আরম্ভ)

(১)

আদ্যের কাহিনী কথা শুন মন দিয়া।
জন্নম লইল বিনাথ জন্মদুঃখী হইয়া॥
একমাস দুইমাস তিনমাস যায়।
মায়ের কোলেতে বিনাথ শুইয়া নিদ্রা যায়॥
চারি পাঁচ ছয়রে মাস এহি রূপে গেল।
সাত মাসেতে বিনাথ বাপে হারাইল॥
শাইল ক্ষেতের দাম ছারিতে[২] বাপে খাইল শাপে।
অভাগিনী মাও কান্দে পড়িয়া বিপাকে॥
বেমান সংসার মাঝে আর বন্ধু নাই।
কোলের না কাঞ্চন ছাওয়াল কেমনে বাঁচাই॥
বাইরে রোজগাড়ী নাইরে পেটে নাই অন্ন।
অঙ্গের বসন খানি সেও হইল ছিন্ন॥
চিরা তেনা[৩] দিয়া মায় বিনাথে ঢাকিল।
মায়ের চোখ্‌খে পানি দরিয়া ভাসিল॥

হায় ভাবিয়া চিন্তিয়া মায় কোন্ কাম করে।
গাও গেরামে চান্দ মোরল গেল তার ঘরে॥
বড় ধনী চান্দ মোরল ক্ষেমতা অপার।
ছাওয়াল কোলে লইয়া মায় গেল বাড়ী তার॥
বায়াকুটি[৪] রাইন্দা তার বিনাথে পালিল।
এহি মতে বিনাথ তবে ছয় বছরের অইল॥

দুঃখের কপাল বিনাথ সুখ কোথা পায়।
সাত না বচ্ছর কালে হারাইল মায়॥
মাটিতে লুটাইয়ে বিনাথ কাঁদে মায়ের লাগিয়া।
এইমন দরদী মাও গেলা গো ছাড়িয়া॥
গায়ে যুদি কুটা গো বালি মায় ঝাইরা লইত কোলে।
হেন মাও অভাগারে কোথায় ছাইরা গেলে॥
চৌদিকে চাহিয়া দেখি আপন কেহ নাই।
সংসারে কে সুহৃদ্ আছে গো কই গিয়া দাড়াই॥

চাঁদের বাড়ীতে বিনাথ করে গরুর রাখালী।
কিছু কিছু কইরা বিনাথ দুঃখু যায়রে ভুলি॥
কাটিয়া মরাল বাঁশ বিনাথ বাঁশী বানাইল।
দেখিতে শুনিতে তার কুড়ি বছর হইল॥
ওস্তাদ ধরিয়া বিনাথ বাঁশীর গান শিখে।
চান্দের জননীরে বিনাথ মা বলিয়া ডাকে॥
সুজন্তী তাদের কথা চান্দের সমান।
এইমত সুন্দরী কন্যা নাইসে তিরভুবন॥
পুষ্প যেমন হেল্যা পড়ে পবনার বায়।
হালিয়া নাচিয়া কন্যার বার বচ্ছর যায়॥

ঢলুম ঢলুম[৫] মুখখানি কন্যার চিরল[৬] দাঁতের হাসি।
এরে দেখ্যা বাইজ্যা উঠে বিনাথের বাঁশী॥৪০


(২)

এমুন সময় হইল কিবা শুন দিয়া মন।
চান্দ ব্যাপারী যাইব বাণিজ্য কারণ॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া চাঁদ কোন্ কাম করিল।
একেলা বিনাথে তবে সঙ্গেত লইল॥
বার নাও তের পানসী ধানেত বুঝাইয়া।
উত্তর ময়ালে চলে ডিঙ্গ। ভাসাইয়া॥

গাঙ্গের বাঁকে কেওয়া ফুল রৈয়া রৈয়া ফুটে।
কত নারী ছান করে গাঙ্গির ঘাটে ঘাটে॥
কত নাইয়া নাও বাহিয়া যায়রে দূরের পানে।
এমন সুন্দর বিনাথ না দেখছে নয়ানে॥
দেখিয়া শুনিয়া বিনাথ বাঁশীতে মাইল টান।
ভাটি ছিল চিলা গাঙ্গরে বাহিল উজান॥
কাঙ্কের না ভরা কলসী নামাইয়া জমিনে।
ভিজা বসনে নারী বাঁশীর গান শুনে॥
কেবা যাওরে বাঁশের বাঁশী মোরে যাওরে কৈয়া।
এইখানে লাগুক ডিঙ্গা খানেক দাড়াইয়া॥
পাইয়া নবীন পাল উত্তরাল বাতাসে।
ছুটিল চান্দের নাও বাণিজ্যের আসে॥
ছয় মাসের পথ সাধু এক্কুদিনে যায়।
চিলা যেমুন আসমানেতে উড়িয়া পলায়॥

তের বাঁক পানি বাইয়া কংসনদী ধরে।
এইখানে গিয়া সাধু ডিঙ্গা কাছি করে[৭]
সাতদিনের পন্থরে বাইয়া নারয়ী মুলুক।
এইখানে পৌঁছিলে নাও সাধু পাইবে সুখ॥
এন কালেতে হইল কিবা শুন দিয়া মন।
রাত্রি নিশাকালে শুন দেয়ার গরজন॥
মেঘেতে আসমান ছাইল তুফান হইল ভারী।
কতেক পানসীর দেখ কাছি লইল ছিড়ি॥
শুতের মুখেতে যেমুন জলুইর কুটা ভাসে।
বিনাথে ভাসাইয়া নিল কংসনদীর পাকে।
বিনাথের কথা ভালা এইখানে থইয়া॥
শুমাই ওঝার কথা শুন মন দিয়া।৩২

(৩)

ভেউর[৮] জঙ্গলা দেখ কংস নদীর পারে।
সেইখানে হুমাই ওঝা বসতি না করে॥
মানুষের গতাগম্ব সদাকালে নাই।
আবশ্য পড়িলে লোকে ওঝারে বিছড়াই[৯]
নানা মন্তর জানে বেটা জ্ঞানে বিহস্পতি।
ঔষধ মন্ত্রের জোরে বনেত বসতি॥
মন্ত্র পড়া পঞ্চ না কড়ি আছে তার খানে।
জঙ্গলার যত সপ্ন সকল ধইরা আনে॥
কেউটা রোখা বর্মজাল নোওয়ায় দেইখ্যা মাথা।
বনের বিরক ওঝার দেখ মাথায় ধরে ছাতা॥

খরম পায় হাটে ওঝা নদীর না পাকে।
রাজা বাদ্‌সা নাগাল নাই সে পায়রে তাহাকে॥
কড়ি চালনা দিয়া দেখ সপ্প ধইরা আনে।
ছয় মাসের মরা জিয়ায় ঔষধের গুণে॥
বাতাসী ওঝার মাইয়া পাল্যা করছে বড়।
ওঝার সহিত থাকে বনের ভিতর॥
দেখিতে সুন্দর কন্যা বনের হরিণী।
সপ্নের মাথায় যেন জ্বলে দিব্য মণি॥
সিন্দুর মাখা ঠোট দুখানি কাজল মাথা আঁখি।
এহি মত সুন্দর কন্যা কভু নাইসে দেখি॥২০


(৪)

দৈবের নিববন্ধ কথা শুন দিয়া মন।
সুতেত ভাসিয়া বিনাথ কইরাছে গমন॥
আছে কিনা আছে পরাণ বিধাতা সে জানে।
দেখিয়া দৈচ্ছত[১০] কন্যা পাইল পরাণে॥
বাপের আগে কয়ত খবর ঘন ঘন সুয়াস।
সুন্দর কুমারের নাই সে জীবনের আশ॥
চান্দ যেমুন ভাস্যা যায় কংস নদীর পাকে।
কাহার কোলের যাদু পড়িল বিপাকে॥
উবু হইয়া আউল কেশ মাটিত লুটায়।
ওঝার পিছনে কন্যা পাগলিনী প্রায়॥
তবেত সুমাই ওঝা কোন্ কাম করিল।
মরার মতন বিনাথেরে টানিয়া ধরিল॥

দুইজনে ধরাধরি বিনাথের লইয়া।
জঙ্গলার ঘরে গেল বড় দুঃখ পাইয়া॥
ঝর ঝর বাতাসীর দুই চক্ষু ঝরে।
পরের লাগিয়া কন্যা কাইন্দা কেন বা মরে॥

* * * *

শেযেতে শুয়াইয়া ওঝা কোন্ কাম করিল।
ভেউর জঙ্গলার মধ্যে পরবেশ করিল॥
কইয়া গেল কইন্যা তুমি বইস লো শিয়রে।
যতক্ষণ ঔষধ লইয়া নাহি ফিরি ঘরে॥
শিয়রে বসিয়া কন্যা এক দিষ্টে চায়।
আছে কিনা আছে পরাণ বুঝা নাই গো যায়॥
কাহার কোলের পুত্রু কেবা মাতা পিতা।
আঞ্চল ধরিয়া কন্যা মুছে চক্ষের পাতা॥
ঘর আইন্ধাইর বাড়ীরে আইন্ধার এমন কইরা হায়।
এহারে ভাসাই ঘরে কেমনে আছে মায়॥
ডাকিতে ডুকুরে কন্যা নাম নাই সে জানে[১১]
হেনকালে আইল ওঝা তার বির্দ্দমানে॥

“শুন শুন বাতাসী কন্যা কহিযে তোমারে।
ঔষধ বাটিয়া শীঘ্র আনহ ত্বরিতে॥”
ধুইয়া মুছিয়া কন্যা শিল পাটা লইল।
বাপের দেওয়া ওষুধ খানি নিপেশ বাটিল॥
মন্ত্র পড়িয়া সুমাই অসুধ খাওয়ায়।
কিছু কিছু আছে পরাণ যেন বুঝা যায়॥

কিছু কিছু সুরে সুয়াস আশার মতন।
তবে ওঝা স্মরণ করে ওস্তাদের চরণ॥

নয়ন মেলিয়া বিনাথ চারিদিকে চায়।
আপনার জন কেউ দেখা নাই সে পায়॥
স্বপ্নের মতন যেমন দেখিতে লাগিল।
বাতাসী কন্যার পানে চক্ষু তুইল্যা চাইল॥
লাজে রাঙা রক্ত না জবা কন্যা নোওয়াইল মাথা
সরম ভরম কন্যার আগে ছিল কোথা॥৪২


(৫)

এক দুই করি দেখ যায় তিন মাস।
তবেত হইল তার জীবনের আশ॥
একতে একতে পড়ে মনে মা বাপের কথা।
বনেত বসিবার আগে বসত ছিল কোথা॥
সেই দেশেত মাও নাই গর্ভ সোদর ভাই।
দরদী বান্ধব নাই কোন্ দেশে বা যাই॥
একতে একতে পড়ে মনে বাকী বক্কা যত।
কে মোরে আদর করব আপন মায়ের মত॥
একতে একতে মনে পড়ে সুজন্তী কন্যায়।
সক্কল ভুলিল কন্যা বাতাসীর দায়॥
নগর থাক্যা বিজন ভালা আপন থাক্যা পর।
ঘর থাক্যা বাহির ভালা আশায় করলো ভর॥
বাপ মরিল সপ্পের বিষে তাও পড়িল মনে।
মন্তর শিখিব বিনাথ ওস্তাদের চরণে॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া বিনাথ মন করিল থির।
সুমাইরে মানিয়া লইল গুরু মন্ত্রের পীর॥১৬

(৬)

(দিশা) পুষ্প তোরে কোন বিধি সিরজিল। 
বনানী পাতার ঘরে কেন বা জন্ম দিলরে......
পুষ্প তোরে......॥
বনে থাক বনের ফুলরে মুখে মিষ্ট হাসি।
কোন বিধাতা করলো লো কন্যা তোরে বনবাসী রে
পুষ্প তোরে......॥
বনে থাক সুন্দর কন্যা বনেলা হরিণী।
একেলা ভরমনা করলো সুন্দর কামিনীরে
পুষ্প তোরে......॥
ভমরে না পাইছে লাগাম মধু ভরা ভরা।
একটি কথা শুন কন্যা সামনে থাক্যা খাড়ালো
পুষ্প তোরে......॥
কেবা তোমার মাতা পিতা কোথায় বাড়ী ঘর।
কিবা দেখি বনবাসী দেহত উত্তর লো
পুষ্প তোরে......॥
বাতাসে উড়াইয়া নিছে অঙ্গের বসন খানি।
এইখানে খাড়াইয়া কন্যা মুখের কথা শুনি লো
পুষ্প তোরে......॥

“নাহি আমার মাতারে পিতা থাকি ভেউর বনে।
ছেউরা শৈশব হইতে পালে অন্য জনে॥
লালিয়া পালিয়া মোরে এত কৈল বড়।
সেই মোর বাপ মাও আছি তার ঘর॥
কেবা তোমার মাতাপিতা কেবা তোমার ভাই।”
“তোমার মতন কন্যা আমার কেউ নাই॥
জনমি না দেখিলাম জন্নম দাতা বাপে।
অবুঝ শৈশব কালে খাইল তারে সাপে॥

এমন করিয়া মাও গেলত ফেলিয়া।
কাল বিধাতা দিল মোরে সাওরে ভাসাইয়া॥
হতের সেওলা যেমুন ভাসিয়া বেড়াই।
তোমার কারণে কন্যা পরাণ বাঁচাই॥”৩০

* * * *

(৭)

তবেত হইল কিবা শুন দিয়া মন।
দুই জনে হইল দেখ পরাণে মিলন॥
তিল দণ্ড না দেখিলে বাহিরায় পরাণী।
বনেলা কৈতরী যেন পাইলা জোরনী[১২]
তবেত বিনাথ দেখ, কোন্ কাম করে।
পীরের নিকটে বিনাথ মন্তর শিক্ষা করে॥
পরথমে শিখিল মন্তর নামে ফুল কড়ি।
জঙ্গলার যত সপ্প আনে তারে ধরি॥
দ্বিতীয়ে শিখিল মন্ত্র ওস্তাদে বাখানি।
থাপার চুইডেতে[১৩] দেখ বিষ করে পানি॥
বাপেত দিয়াছেরে বিয়া থাকি পরের ঘরে।
তিতিয়ে শিথিল মন্ত্র বরম্মজাল নামে।
চালুনি ভরিয়া জল আনে যার গুণে॥
চতুর্থে শিখিল মন্ত্র নালে নামে বিষ।
পঞ্চমে শিখিল মন্ত্র উত্তর পাতর।
বাসুকী নোয়ায় মাথা ঝারি সে মন্তর॥
ষষ্ঠেতে শিখিল মন্তর নাম তার খৈয়া।
কালীদহের কালী নাগ যায় পলাইয়া॥

সপ্তমে শিখিল যত ধূলাপড়া আছে।
কেউটিয়ার ফণায় বিণাথ খাড়াইয়া নাচে॥
অষ্টমে শিখিল মন্তর নামেতে গাড়ুইয়া
ধন্বন্তরীর যশ রৈল মরা বাঁচাইয়া॥
জীয়ন মন্তর শিখে বিনাথ ওস্তাদের চরণে।
ছয় মাসের মরা জিয়ে যে মন্ত্রের গুণে॥

শিক্ষা নাই সে দিয়া সুমাইর হিংসা হইল মনে।
শিষ্যি না হইয়া বিনাথ নিজগুরু জিনে॥
দেশেতে হুইল খেতি বিনাথের গুণ।
এরে দেখ্যা সুমাই ওঝা হিংসিত আগুন॥
বিনাথে মারিতে ওঝা যুক্তি করে মনে।
এই কথা শুনিল বিনাথ বাতাসীর খানে॥
চক্ষে দর দর ধারা কন্যা কান্দিয়া বুঝায়।
বিমনা হইল বিনাথ ঘটলো বিষম দায়॥
তবে ত বিনাথ ওঝা কোন্ কাম করে।
গোপনে কহিল কথা বাতাসী কন্যারে॥
“শুন শুন পরাণের কন্যা আমার কথা ধর।
এই দেশ ছাড়িয়া আমি যাইবাম দেশান্তর॥
বাপ হইয়া বৈরী হইল এদেশে থাকা দায়।
নিজমনে ভাব কন্যা নিজের উপায়॥
পুষ্প যদি হইতা কন্যা ফুট্যা থাকতা ডালে।
না হইত না পাইত কন্যা এইমত জঞ্জালে॥
পক্ষী যদি হইতা কন্যা পিঞ্জরা ভরিয়া।
সঙ্গেত লইতাম তোমায় যতন করিয়া॥
নানা মন্তর জানে পীর ভয় হয় মনে।
এ দেশ ছাড়িয়া আমি যাইব তে কারণে॥”৪৪

(৮)

সাঞ্ঝ্যা গুঞ্জরিয়া যায় লীলারি বয়ারে।
ছোটু ছোটু নদীর ঢেউ তোলাপাড়া করে॥
গাঙ্গের ঘাটে যাইতে কন্যা মুছে চক্ষের পাণি।
“কেমুনে বিদায় করি না ধরে পরাণী॥”
বিরখ হইয়া থাকরে বন্ধু জঙ্গলার মাঝে।
ছায়া হইয়া থাকি বন্ধু তোমার না কাছে॥
ভমরা হইয়া রে বন্ধু পাতায় লুকাও।
এই বনে না থাক্যা বন্ধু পুষ্পের মধু খাও॥
সারস হইয়ারে থাক ঐ না জলে স্থলে।
তোমার আমার হৈব দেখা রাত্রনিশাকালে॥”


ঘাটে বান্ধা পানসী নাও বিনাথ বান্ধন খুলিল।
আস্তে ব্যস্তে বিনাথ দেখ নায়ে পাও দিল॥
পানিতে মারিল বাড়ি পবন বৈটা দিয়া।
চলিল বিনাথের পানসী এ দেশ ছাড়িয়া॥
ডাক দিয়া বলে বিনাথ “কন্যা ঘরে যাও।
আমারে ভুলিয়া যাইও আমার মাথা খাও॥
এই দেখা শেষ দেখা আর যেন না ফিরি।
তোমারে ভুলিলে কন্যা যেন জলে ডুবা মরি॥”


সাঞ্যা গুঞ্জরিয়া যায় আন্ধার হইল বন।
শূন্য ঘরে যাইতে কন্যার নাইসে চলে মন॥
নিজ দেশে গেছে বিনাথ নিজ মন লইয়া।
খাড়াইয়া রহিল কন্যা অন্ধকারে চাহিয়া॥২২

* * * *

(৯)

(হায় ভালা) দেশে ত পৌছিয়া বিনাথ কোন্ যুক্তি করে। 
এক্কবারে চল্যা গেল বিনাথ চান্দ মড়লের ঘরে॥
দেশেতে জাহির হৈল তাহার জহরা[১৪]
কেউ চায় তাবিজ কবচ কেউ বা জলপড়া॥
সপ্পের ভয় দূরে গেল জানে সর্ব্ব জনে।
জিয়াইল সাপ কাটা জিয়ন মন্ত্রের গুণে॥
চান্দের আপন পুত্র কুশাই নাম ধরে।
সেও পুত্র বাচ্যা গেল সাপের কামড়ে॥

তবে চান্দ মড়ল কোন্ কাম করিল।
সুজন্তী কথার সঙ্গে বিভা তার দিল॥
বচ্ছর গোয়াইল বিনাথ চান্দ মোড়লের ঘরে।
অতঃপর কিবান হইল জানাই সভার গোচরে॥
বিনাথ সুজন্তী হায় না হইল মিলন।
বিনাথে ভাবিল কন্যা আপন দুষ্‌মন॥
লুকাইয়া সুজন্তী বাসে[১৫] পাড়ার নাগরে।
এই কথা বিনাথ ষে জানিল সুস্তরে॥
রৈয়া রৈয়া পড়ে মনে বাতাসীর কথা।
বাতাসে আসিয়া কয় কন্যার মনের বেথা॥
স্বপ্নেত দেখায় বিনাথ কন্যা নদীর কূলে খাড়া।
ছিন্ন ভিন্ন চিকণ কেশ হইল আউল দরা॥২০

(১০)

এখনে হইল কিবা শুন দিয়া মন।
দেশে আস্যা সুমাই ওঝা দিল দরশন॥

নানা মন্ত্র জানে বেটা বড় কুজ্ঞেয়ানী।
শিষ্য সেবক কত হইল ডাকুরাণী॥
ছল কইরা হুমাই ওঝা কোন্ কাম করিল।
জিয়ন মন্ত্র ছিল তার হরণ করিল॥

তবেত হইল বিনাথ দেশে হতচ্ছারা।
যত গুণ গেরাম ছিল সক্কল হইল হারা॥
কি মতে হরিল মন্তর শুন দিয়া মন।
সুমাই লুকাইয়া লইল সুজন্তীর শরণ॥
করিল যতেক তত বিনাথ না জানে।
মিষ্ট বুলে সুজন্তী কহিল স্বামীর স্থানে॥
জিওন মন্ত্র জান তুমি মোরে শিক্ষা দেও।
আমিত তোমার শিষ্য নহে অন্য কেও॥
বিনাথ ভাঙ্গাইয়া[১৬] বলে তুমি নারী জাতি।
ওস্তাদের হুকুম নাই নারীরে শিখাইতে॥
সুজন্তী যতেক বলে বিনাথ নাই সে মানে।
ঠেকিল বিনাথ শেষে সুজন্তীর স্থানে॥
ঠেকিয়া জীয়ন মন্ত্র দিল আড়াই অক্ষর।
নিজ মন্ত্র পণ্ড হইল ওস্তাদের বর॥

নিজ কার্য্য সাইরা হুমাই গেল নিজ বাড়ী।
দেশের যত লোক হইল বিনাথের বৈরী॥
বিষ ছাড়া সপ্প যেমুন বিনাথ সকল হারাইয়া।
আবার চলিল বিনাথ এদেশ ছাড়াইয়া॥
কোথায় যাইব বিনাথ না পায় ভাবিয়া।

* * * *

রৈয়া রৈয়া উঠে মনে বনের কন্যার কথা।
দুঃখীর কপালেরে দুঃখ লিখ্যাছে বিধাতা॥২৭

(১১)

নয়া গাঙ্গের পাড়েরে ফুটিল চাম্পার ফুল।
কে তুমি বসিয়া কন্যা শুখাও ভিজা চুল॥
নয়া গাঙ্গের পারের বিরক্ক চিরল চিরল পাতা।
আমি ডাকি সুন্দর কন্যা পিছন ফিইরা চায়।
মনের মধ্যে ডাকে কন্যায় চাহিয়া না পায়॥
বন্ধে চাহিয়া না পায়।
বাতাসে কাঁপিছে কন্যার নূতন বসনখানি।
দূরের পানে চাহে কন্যার অঝোরে ঝরে পানি॥
কোথা হইতে আইসারে নৌকা উজান বইয়া যাও।
ভিন দেশী বন্ধুর লাগ কোথা নাকি পাও॥
আমি কান্দি কইও বন্ধে নদীর কূলে বইয়া।
আমারে লইতে বন্ধে যেন পানসী নাও সে বাইয়া॥
উজান বাঁকে থাকরে বন্ধু ভাইটাল বাঁকে থানা।
মুখের হাসি চোখের দেখা তোরে কে করিল মানা॥
(রে বন্ধু কে করিল মানা)
ভাটিয়ালা শুকনা নদী জোয়ার পানে ভাসে।
নারী যৈবন ভাটি পইলে আর না ফিইরা আসে রে॥
(বন্ধু আর না ফিইরা আসে)
আমি যে অবুলারে নারী কৈতে নারি কথা।
তুমি কি বুঝনা বন্ধু আমার মনের ব্যেথা॥
সপ্প যেমুন হারাইয়া নিজ মাথার মুণি।
তোমার লাগিয়া বন্ধু আমি পাগলিনী রে বন্ধু॥
(আমি উন্মাদিনী)
বাপেত দিয়াছে বিয়া দেইখ্যা বড় ঘরে।
তোমারে ছাড়িয়া বন্ধু কেমনে থাকি ঘরেরে॥
(বন্ধু, কেমনে থাকি ঘরে)

খাট পালঙ্কের আমার কোন কাজ নাই।
বিরক্কের নীচে তোমায় লইয়া আইঞ্চল বিছাই॥
আমিত অবলা নারী কইতে নারি কথা।
তুমি বিনা অভাগীর জীবন যৌবন বৃথা রে॥
(বন্ধু কেমনে থাকি ঘরে)
কাটিয়া চাচর কেশ পাথারে ভাসাই।
কাজলী মাখিয়া চক্ষে কোন কার্য্য নাই।
দিনান্তে তোমার দেখা নাহি পাই যুদি।
কাটারিতে কাট্যা তুলি এই দুটি আঁখি রে॥
(বন্ধু.........)
আমার মরণ নাইরে বন্ধু আমার মরণ নাই।
মনে যে পক্ষী হইয়া উড়িয়া না পলাই॥
পিরীত নদীর পারে বাস পিরীত বিরকের তল।
পিরীত গাছের ফল আমি খাইয়া গায়ে কইরাছি বল॥
(রে বন্ধু আমার মরণ নাই)
জলেতে ডুবিলে বন্ধু দরিয়া শুকায়।
আগুনে ঝাঁপিলে বন্ধু আগুন নিব্যা যায়॥
(রে বন্ধু আমার মরণ নাই)
বিরক্ক ডালে বুরা[১৭] লতায় টানিলাম ফাঁসি।
ফাঁসি হৈল গলার মালা আমি কর্ম্মদোষী রে॥
(বন্ধু আমার মরণ নাই)
দড়ি লইলাম কলসী লইলাম আন্ধাইর রাতের নিশি।
নদীর পাড়ে শুনলাম রে বন্ধু তোমার পুরাণ বাঁশী॥
(বাঁশী করিল মানা বন্ধু)

কলসী কহে কানেরে কন্যা না ডুবিও জলে।
প্রাণ থাকিলে হইব দেখা ঐনা নদীর কূলেরে॥
(বন্ধু কলসী করলো মানা)
দড়ি কহে পাগলী কন্যা আমি হই যে ফাঁসী।
কাইল বিয়ানে[১৮] শুনতে পাইবা তোমার বন্ধের বাঁশী॥
বন্ধু ...
কাটারী কয় কন্যা তুমি আমার কথা ধর।
আমারে বাঁধিয়া গলায় কোন্ বা দোষে মর॥
লো কন্যা......
কাল গরল কয় কন্যা না হইও গো ভুঁখা।
জীবন থাকিলে দেখ একদিন হইব দেখা॥
রে কন্যা......
পোষা পঙ্খিনী কয় কন্যা রাখ নিজ পরাণ।
কাইল নিশীতে আমি যেমুন শুন্যাছি বাঁশীর গান॥
লো কন্যা......
বনের পঙ্খী ডাক্যা কয় কন্যা থাক আশার আশে।
আইজ বা গেল মন্দে রে মন্দে কাইল বা সুদিন আসে॥
রে কন্যা......
যুদি আইসে তোমার বন্ধু তোমার লাগিয়া।
এই ময়ালে[১৯] না পায় যুদি কেমনে ধরব হিয়া।
তোমার বন্ধু মরব কন্যা তোমার লাগিয়া॥৭২

(১২)

পরাণ ধরা নাই সে যায়।
পরাণ ধরা নাই সে যায়।
আর কত দিন রাখব জীবন আশায় আশায়॥

বাগ লাগাইয়া রে বন্ধু রোপণ করলাম লতা।
না ফুটল তার আশার কলি সকল হইল বেরথা॥
আইল বান্ধিলাম পাইল বান্ধিলাম নয়ন জলে পানি[২০]
ঢালিয়া না পাইলাম ফল শুকাইয়া মরে প্রাণী॥
পুষ্প যেমন তিলে দণ্ডে দিনে দিনে ফুটে।
দিন মাদানে[২১] বাসি হইয়া জীবন যৌবন টুটে॥
বান্ধিয়া ছান্দিয়া রে ঘর আশানদীর পাড়ে।
আশাপান্থ চাইয়া বন্ধু অন্ধ আঁখি ঝুরে
রে বন্ধু—
আমি আর ত পারিনা রে বন্ধু আর ত পারি না।
যৌবন হইল বিষের বোঝা ধরতে পারি না॥

একেলা সুন্দর লো কন্যা কাঁখেতে কলসী।
কার পিরীতে মজিয়া কন্যা হইলা উদাসী॥
জল দায়ে নয়রে ঘাটে হইয়াছি উদাসী।
কাইল নিশীথে শুনলাম আমি পুরাণা বন্ধুর বাঁশী॥
ঘরে নাই সে থাকে মন বাহির হইতে চায়।
বনেলা পঙ্খিনী যেমুন পিঞ্জরা ভাঙ্গায়॥
তোমার পিরীতে বন্ধু গলায় দিব ফাঁসি।
আপনা ভুলিয়া হইলাম ছিচরণে দাসী॥
আগেত জানিনারে পিরীত তুই যে গরল জ্বালা।
জানিলে না করতাম তোরে গলার রতন মালা॥
আগেত জানিনারে পিরীত তুই তোষের আগুনি।
ঘুষিয়া ঘুষিয়া পুড়ে অবলার পরাণী॥

আগেত জানিনারে পিরীত এমুন করবা মোরে।
তোরে ছাইড়া গিয়া দাণ্ডাতাম দূরে॥
আগেত জানিনারে পিরীত এমুন দিবা ফাঁকি।
অন্ধ যে করিয়া রাখতাম না চাহিতাম আঁখি॥

রজনী গোপালে কয় কন্যা পিরীতে না দোষ।
বিচ্ছেদ ভুলিয়া কন্যা বন্ধুর কোলে বইস॥
পিরীত কর গলার মালা পিরীতে কর পুজা।
পিরীতি অজপা মন্তর পিরীত নহে সাজা॥
মিলন হইতে বিচ্ছেদ ভালা মহাজনে বুলে।
গদ[২২] হইতে ভুখা ভালা জানতে পারবা কালে॥
কাছ হইতে দূরে ভালা যদি প্রাণের টান।
বিরহ বিচ্ছেদ দুই পিরীতির পরাণ॥
বহুতা পিয়াসে যেমুন পান করিলে পানি।
বিরহ বিচ্ছেদ মতে মিলে দুই পরাণী॥
দুঃখ ভুঞ্জিলে কন্যা সুখ লাগিব মিঠা।
জানিয়া শুনিয়া বিধি পুষ্পে দিল কাঁটা॥৪২

(১৩)

তোমার বাঁশী শুন্যারে বন্ধু আইলাম নদীর ঘাটে
কে জানি কোথায়ে থাকি তোমারে বা দেখে॥
বাপেত দিয়াছেরে বিয়া থাকি পরের ঘরে।
যত বিষ খাইয়া মরি জানে তা অন্তরে॥
বনের পঙ্খিনী:বন্ধু পিঞ্জরে ভরিয়া।
আমারে রাখিছে বন্ধু শিকলে বান্ধিয়া॥

ঘরে নাইসে থাকে মন তোমার লাগিয়া।
আমি ধুয়ার ছলনে কান্দি চক্ষে বসন দিয়া[২৩]
খাট পালঙ্করে ছাইড়া জমিনে বিছান।
জিজ্ঞাসিলে কই কথা আমার পুইড়া গেছে প্রাণ॥
অন্তরায় লোহার কবাট সেও খাইয়াছে ঘুণে।
নিশিদিন তোমার মুখ দেখি যে স্বপনে॥
আর না থাকিতেরে পারি গিরে চল্যা যাই।
দুষ্‌মনে দেখিলে লজ্জা রাখতে স্থান নাই॥
তোমারে ছাইড়ারে বন্ধু যাই নিজ ঘরে।
চরণ অবশ গতি মনে নাই সে ধরে॥
ভ্রমরা হইয়া বন্ধু লুকাও বনের ফুল।
আইজ নিশীথে হইব দেখা ঐনা নদীর কূল॥

নিশি রাইতে বাজল বনে মন-পাগেলা বাঁশী।
শিরে হাত দিয়া ভাবে অন্ধকারে বসি॥
পচ্চিম দুয়ার কন্যা ত্বরিতে খুলিল।
অস্তেব্যস্তে সুন্দর কন্যা পৈটায় পারা দিল॥
হস্তের জলের ঝারি ভুয়ে নামাইল।
গলার রতন হার দূরে ফালাইল॥
গায়ের যত অলঙ্কার একে একে খুলে।
উঠান হইয়া পার অস্তেব্যস্তে চলে॥
অন্ধকারে হস্তের তালা দেখা নাহি যায়।
একেলা ঘরের নারী সেইনা পথে যায়॥
একবার না ভাবে কন্যা চলে একেশ্বর।
ঘর হইল বাহির কন্যায় আপন হইল পর[২৪]

কলঙ্ক কাজল হইল কুলের নাই সে ভয়।
বান্ধিয়া না রাখতে পারে পিরীতে যারে লয়॥
গম্ভীরা রাইতের নিশা নাই সে পউখ পাখালীর রাও।
কুল ছাড়িয়া কুলের নারী অকূলে দিল পাও॥

* * * *

গয়িন জঙ্গলার মধ্যে পরবেশ করিল।
তিন দিনের পন্থ তারা একদিনে গেল॥
মানুষের নাই গতাগম্ব জঙ্গলা যে বড়।
সেইখানে গিয়া বিনাথ বান্ধিলেক ঘর॥
লতায় বান্ধিয়া ঘর পাতায় দিল ছানি।
সেই ঘরে বসত করে তারা দুইটি প্রাণী॥
কইতরা কইতরী যেমুন মুখে মুখ দিয়া।
বড় সুখ পাইল কন্যা কাননে আসিয়া॥
মস্তক না রইল যুদি কি করিব চুলে।
বন্ধু যুদি না মিলিল কি করিব কুলে॥৪৪

* * * *


( ১৪ )

হেথাতে সুমাই ওঝা গোস্বায় আগুনি।
দুষ্কর্ম্ম কইরাছে বিনাথ মনে অনুমানি॥
পদ্মনাল সপ্প সুমাই ডাকিয়া আনিল।
মন্তর পড়িয়া সুমাই চালনা যে করিল॥
মা মনসার নাগ তুমি শীঘ্র কইরা যাও।
যথায় পাও দুষ্‌মনেরে শীঘ্র কইরা খাও॥

বিষতেজে পদ্মনালরে চলিল উড়িয়া।
বেউরা জঙ্গলার মধ্যে পরবেশ করল গিয়া॥

সুখে নিদ্রা যায় বিনাথ নারী বুকে লইয়া।
সুখনিদ্রা ভাঙ্গিল মাগো চরণে দংশিয়া॥
“উঠ উঠ কন্যা তুমি কত নিদ্রা যাও।
জিয়ন মন্তর হারাইয়াছি সপ্পে খাইল পাও॥
কালনাগে খাইল মোরে বিষে ছাইল অঙ্গ।
সংসারের সুখের খেলা আইজ হইতে ভঙ্গ॥”
বিষে কালি হইল অঙ্গরে ঘন বহে শ্বাস।
ততক্ষণে ছাড়ে বিনাথ জীবনের আশ॥
মাথা থাপাইয়া কন্যা কান্দে পাগলিনী।
আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কোথা যাও তুমি॥
চান্দের সমান বন্ধুরে তোমার মুখের হাসি।
আর না দেখিব তোমায় পোহাইয়া নিশি॥
ভেউর জঙ্গলা বন্ধুরে নাইরে সঙ্গী সাথী।
একেলা রাখিয়া বিধি নিলা পরাণের পতি॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া কন্যা শোকেতে বিউর[২৫]
মাথার না কেশ ছিইড়া পায় বান্ধিল ডুর॥

ঊর্দ্ধ নালে সপ্পবিষ উজাইয়া চলে।
মস্তকে উঠিল বিষ সেই ঊর্দ্ধ নালে॥
ঢলিয়া পড়িল বিনাথ কন্যার যে কোলে।

* * * *

হেন কালে সুমাই ওঝা জঙ্গলায় আসিল।
দেখিয়া কন্যা কান্দিয়া পড়িল॥
মন্তর পড়িয়া সুমাই দিল জলপড়া।
নাকেত শুয়াস নাই প্রাণের নাই সাড়া॥
জিয়ন মন্তর ঝাড়ে ওঝা নাহিক পত্যয়।
মহাজ্ঞান মন্ত্র ওঝার হইল ব্যত্যয়[২৬]

লোভেতে পড়িয়া ওঝা লইল টঙ্কাকড়ি।
জিয়ন মন্তরের গুণ ওঝায় গেছে ছাড়ি॥
বৈমুখ হইল ওঝা বিনাথ মরিল।
কৈন্যার কান্দন দেখি পাষাণ গলিল॥
বনে কান্দে বনের পশুপক্ষী কান্দে ডালে।
“হায় বন্ধু ছাইড়া গেলে এমন যৌবন কালে॥
মনুষ্য যে দিব গালি আইলাম বনে।
আমারে ছাড়িয়া বন্ধু চলিলা আপনে॥
শুনরে দারুণ বিধি আমার মাথা খাও।
অভাগীর পরমাই দিয়া বন্ধেরে বাঁচাও॥”৪৪


( ১৫ )

মহাসুতে চলে ধারা সান্তরিয়া নদী।
থল নাই কূল নাই চলে নিরবধি॥
অভাগী ওঝার কন্যা কোন্ কাম করে।
বন্ধু কোলে লইয়া কন্যা গেল নদীর পারে॥
সাক্ষী হইও দেব ধরম সাক্ষী তরুলতা।
কি দোষ পাইয়া বিধি দিল এমুন বেথা॥
চান্দ সুরুজ সাক্ষী কইরা কন্য। কোন্ কাম করিল।
আপনে ভাসাইয়া সুতে বন্ধে ভাসাইল॥
সাওরিয়া পাগলা নদী ঢেউয়ে ভাঙ্গে পাড়।
থল নাই সে কূল নাই সে নদী অকূল পাথার॥
কুল-কলঙ্কিনী কন্যা সকলেতে দোষে।
কুল ছাড়িয়া কুলের কন্যা অকূলেতে ভাসে॥

পিরীতি অজপা মন্তর পিরীত কর সার।
পিরীতি নৌকায় হবে ভবনদী পার॥

মানুষ পিরীত কইরা দেবতারে বান্ধি।
রজনীগোপালে কয় ঐ পিরীতির সন্ধি॥
ভাটীলা[২৭] ময়ালে ঘর জগন্নাথের পুত্র।
মাও হইলা সোণামণি মধুকুল্য গোত্র॥
পরিচয় দিয়া আমি পালা করি ইতি।
সভার চরণে জানাই পান্নাম মিন্নতি॥২০


  1. দেউখাইন=দিউন।
  2. দাম ছারিতে=আগাছা লতা যাহা জলমগ্ন শস্যের চারাকে জড়াইরা ধরে (দাম) তাহা ছাড়াইতে যাইয়া।
  3. চিরা তেনা=ছেঁড়া কাপড়।
  4. বায়াকুটি=(?)
  5. ঢলুম ঢলুম=ঢল ঢল।
  6. চিরল=চিকণ
  7. ডিঙ্গা কাছি করে=ডিঙ্গা কাছি দিয়া বান্ধিল, নঙ্গর করিল।
  8. ভেউর=গভীর।
  9. আবশ্য.....বিছড়াই=প্রয়োজন হইলে লোক তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিত।
  10. দুঃখ।
  11. ডাকিতে......জানে=ডুকুরিয়া (চীৎকার করিয়া) ডাকিবার জন্য তাহার নাম জানা ছিল না।
  12. জোরনী=জোড়া, সঙ্গী।
  13. থাপার চুইডেতে=চাপড়ের চোটে।
  14. জহরা=গুণপনা।
  15. বাসে=ভালবাসে।
  16. ভাঙ্গাইয়া=খুলিয়া, সকল কথা ভাঙ্গাইয়া
  17. বুরা=বহুদিনের, এজন্য শক্ত।
  18. বিয়ান=প্রভাব।
  19. ময়ালে=মহলে, স্থানে।
  20. আইল......পানি=জল সঞ্চয় করিবার জন্য আইল বাঁধিলাম; ‘পাইল’ শব্দটি আইল শব্দের পিঠে একটা কথা বিশেষ কোন অর্থ আছে বলিয়া মনে হয় না। যেমন—হাতটাত, দাঁতফাত—কথার কথা মাত্র।
  21. দিন মাদানে=দিবাবসানে।
  22. গদ=প্রচুর আহারের অস্বস্তি।
  23. “রন্ধন শালাতে যাই, তুয়া বঁধু গুণ গাই, ধোঁয়ার ছলনা করি কান্দি।”
    —লোচনদাস
  24. “ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর।

    পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর॥” —চণ্ডীদাস।
  25. বিউর=বিধুর।
  26. ব্যত্যয়=ব্যর্থ।
  27. ভাটীলা=ময়মনসিংহের পূর্ব্বভাগে।